চারকোণা বাক্স

চারকোণা বাক্স

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি নিউইয়র্ক যাবার জন্য চার্লেস্টন থেকে ক্যাপ্টেন হার্ডির ‘ইণ্ডিপেন্সে’ জাহাজে টিকিট কেটেছি। আবহাওয়া ভালো থাকলে জুনের পনেরো তারিখে আমাদের রওনা হবার কথা তাই চোদ্দ তারিখেই আমি জাহাজে গেলাম কতকগুলো ব্যবস্থা পাকা করে নেবার জন্যে। গিয়ে দেখি জাহাজের যাত্রী অনেক আর মহিলা যাত্রীর সংখ্যা একটু অস্বাভাবিক রকমের বেশী । তালিকায় অনেকগুলি পরিচিত নাম দেখে খুশী হলাম। বিশেষ করে মিঃ কর্ণেলিয়াস ওয়াটের নাম দেখে খুব ভালো লাগল। এই তরুণ চিত্রকরটি ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু । একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একত্রে থেকেছি আর লেখাপড়া করেছি। উনি প্রতিভাবান ব্যক্তি, ওঁর চরিত্রের মধ্যে একই কালে কিন্তু উৎসাহ, সংবেদনশীলতা আর মনুষ্যদ্বেষিতা দেখেছি। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার। এ ধরনের মানুষ খুব অল্পই দেখা যায়।

তালিকায় দেখলাম উনি নিজের, স্ত্রীর অর দুই বোনের টিকিট কেটেছেন। ওঁর নাম তিনখানা কামরার গায়ে লাগানো আছে দেখা গেল। কামরাগুলো বেশ বড়, প্রত্যেকটাতে একটার ওপর আর একটা এই ভাবে দুটো করে শোবার জায়গা আছে। শোবার জায়গাগুলো এত ছোট নয় যাতে একজন শুতে পারেনা, তবুও চার জনের জন্য তিনখানা কামরা ভাড়া যে কেন করা হয়েছিল বুঝতে পারলাম না। ঐ সময়টাতে নিতান্ত ছোটখাট জিনিস নিয়েও আমি বড় বেশী কৌতূহলী হয়ে উঠতাম। আমার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে যে জাহাজের কামরার সংখ্যা নিয়ে আমি অযৌক্তিক আর বিশ্রী কতকগুলো অনুমান করতে শুরু করেছিলাম। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজনীয়তাই আমার ছিলনা তবু এই

সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করবার জন্যে আমি তৎপর হয়ে উঠলাম। শেষে যখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম তখন মনে হোল এই সমাধানে আমার অনেক আগেই পৌঁছনো উচিত ছিল। একটা কামরা নিশ্চয় চাকরের জন্য নেওয়া হয়েছে, বোকার মত এই সাধারণ কথাটা আমি আগে ভাবিনি। যাত্রীদের তালিকাটি আবার খুঁটিয়ে দেখলাম কিন্তু তাতে চাকরের উল্লেখ দেখলাম না। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওঁরা সঙ্গে চাকর আনার সিদ্ধান্ত গোড়ায় নিয়েছিলেন। তালিকায় চাকরের নাম লিখে পরে তা কেটে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই সঙ্গে কিছু বেশী মালপত্র আছে। আমার মনে হোল, ওঁর সঙ্গে এমন কিছু জিনিস অবশ্যই আছে যেগুলোকে উনি নিজের নজরে রাখতে চান। হতে পারে কিছু মূল্যবান ছবিই সঙ্গে আছে, ইতালীয় ইহুদী নিকোলিনোর সঙ্গে এই ছবি নিয়েই দরদস্তুর চলেছে হয়ত। যাই হোক এই কথাগুলো মনে হবার পর আমার সমস্ত কৌতূহল তিরোহিত হোল।

ওয়াটের দু’টি বোনকেই আমি জানতাম। ওরা বেশ বুদ্ধিমতী আর ভদ্র। ওয়াট সম্প্রতি বিয়ে করেছিলেন তাই তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের কোন সুযোগ আমার হয়নি। ওঁকে অবশ্য ওঁর স্ত্রী সম্বন্ধে খুব উৎসাহিত ভাবেই আমার সামনে আলোচনা করতে দেখেছি। উনি নাকি খুবই সুন্দরী, বুদ্ধিমতী আর মার্জিতরুচিসম্পন্ন। ওঁর সঙ্গে তাই পরিচয়ের জন্যে আমার খুব আগ্রহ ছিল।

যে চোদ্দ তারিখে আমি জাহাজে সব বিলিব্যবস্থা দেখতে গিয়ে ছিলাম সেদিন মিঃ ওয়াটদেরও আসার কথা বলে ক্যাপ্টেনের কাছে শুনলাম। আমার তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু মিসেস ওয়াটের সঙ্গে পরিচয় হবে এই আশায় এক ঘণ্টারও বেশী সময় ওখানে অপেক্ষা করলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন না। কৈফিয়ৎ শোনা গেল, তার শরীর সুস্থ নয়। আগামী কাল জাহাজ ছাড়ার সময় তিনি এসে পৌঁছবেন।

পরের দিন হোটেল থেকে জাহাজ ঘাটে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি এমন সময় ক্যাপ্টেন হার্ডি এসে হাজির। তিনি বললেন, ‘বিশেষ কারণে’ ( কথাগুলো একদম বাজে। লোকে সুবিধেমত ব্যবহার করে এগুলোকে!) ইণ্ডিপেণ্ডেল’ দিন দুই যাত্রা স্থগিত রাখছে। সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেলে ওঁরা আমাদের খবর দিয়ে যাবেন। বিশেষ কারণ’ কথাটায় আমার ভীষণ বিরক্তি বোধ হোল। দক্ষিণের বাতাস বইছিল। আবহাওয়া সুন্দরই ছিল। তবু আমার কিন্তু কিছুই করার ছিল না তাই বাড়ী ফিরে বিরক্তি আর অধৈর্য মানসিক অবস্থাটাকে একান্তে শান্ত করে তুললাম।

প্রায় এক সপ্তাহ ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে কোন খবর এলো না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত খবর এসে পৌঁছল আর সঙ্গে সঙ্গেই আমি রওনা হয়ে গেলাম। জাহাজের ওপর তখন বেশ ভীড়। জাহাজ ছাড়বে তার জন্য সব দিকেই ব্যস্ততা। আমার পৌঁছনোর প্রায় মিনিট দশেক পরে মিঃ ওয়াট তার লোকজন নিয়ে পৌঁছলেন। সঙ্গে ছিল দু’ বোন আর স্ত্রী। তার কিন্তু মেজাজের মধ্যে সেই অসামাজিক ভঙ্গীটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যাকে আমি মানবদ্বেষি বলেই অভিহিত করেছি। এ সব অবস্থার সঙ্গে আমার পরিচয় কম ছিল না তাই আমিও মোটেই মনোযোগ দিলাম না। উনি তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন না। ওঁর বোন মেরিয়ান বেশ বুদ্ধিমতী আর মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। দায়িত্বটা শেষ পর্যন্ত ওই গ্রহণ করল। অল্প কয়েকটা কথা বলে তাড়াতাড়ি পরিচয়ের পর্ব চুকিয়ে ফেলল সে।

মিসেস ওয়াট ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। আমার স্বীকার করতে বাধা নেই যে আমার নমস্কারের প্রতি-নমস্কার জানাতে গিয়ে উনি ওড়নাটা তুলতেই আমি ভীষণ বিস্মিত হলাম। বন্ধুর আগ্রহের অতিশয্যে চিত্রকর-সুলভ বর্ণনার অতিরঞ্জন সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাই ছিল আমার তাই এ ক্ষেত্রে আমার বিস্ময়ের পরিমাণ বরং কমই হয়েছিল বলা চলে। বিষয় বস্তু যদি সৌন্দর্যসম্পর্কিত হয় তাহলে কল্পনার আবেগে তিনি কতখানি তাকে আদর্শায়িত করতে পারেন তা আমার জানা ছিল।

সত্যি কথা বলতে কি মিসেস ওয়াটকে আমি সুন্দরী ভাবতেই পারলাম না। তিনি কুৎসিত না হলেও তারই কাছাকাছি বলা যায় তাঁর রূপকে। পোষাক পরিচ্ছদ ছিল অবশ্য অত্যন্ত উঁচু স্তরের। আমার এই ধারণাই হল যে এই মহিলাটি তাঁর সদ্গুণাবলী আর বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেই আমার বন্ধুর হৃদয় জয় করে থাকবেন। অল্প কয়েকটা কথা বলে উনি মিঃ ওয়াটের সঙ্গে তাঁর কামরায় চলে গেলেন।

আমার সেই চিরন্তন কৌতূহল ততক্ষণে ফিরে এসেছে। আমি নিশ্চিত হলাম যে ওঁদের সঙ্গে চাকর নেই। এবার তার বাড়তি জিনিস পত্রের খোঁজ নিলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা ঠেলা গাড়ীতে কাঠের একটা চারকোনা বাক্সএলো। বেশ বুঝলাম ঐটি ছাড়া ওঁদের আর কোন জিনিস আসার ছিল না। যাই হোক এর পরই জাহাজ ছেড়ে দিল আর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বারদরিয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম।

কাঠের বাক্সটা ছিল প্রায় ছ’ফুট লম্বা আর আড়াই ফুট চওড়া। ওটাকেই আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। ওটার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে মনে হল আমার। আমার অনুমানের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল না। এবার মনে হোল বন্ধুর বাড়তি এই বাক্সটির মধ্যে একটা বা অনেকগুলো ছবি আছে। আমি জানতাম, কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধুটি নিকোলিনোর সঙ্গে কি সব আলোচনা করছিলেন। এ বাক্সটা দেখে তাই মনে হয় এতে লিওনার্দোর লাস্ট সাপার ছবির প্রতিলিপি আছে। আমি জানি ফ্লোরেন্সের ছোট-রুবিনির আঁকা এমনি একটা প্রতিলিপি দীর্ঘদিন নিকোলিনোর কাছে ছিল । এ বিষয়ে তাই আমার কোন সন্দেহই রইল না। নিজের সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধির ওপর বেশ খানিকটা শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কিন্তু এত বড় একটা শিল্পকর্ম সম্পর্কে ওয়াট আমাকে কিছুই জানাতে চাননা কেন? নিশ্চয় আমার অজ্ঞাতসারেই বস্তুটাকে গুপ্তভাবে নিউইয়র্কে পাচার করতে চান। আমিও স্থির করলাম এ নিয়ে বেশ মজা করব ওর সঙ্গে একটা ব্যাপার লক্ষ করে খুব বিরক্ত বোধ করলাম। বাক্সটাকে ওঁরা বাড়তি কামরায় না পাঠিয়ে নিজের কামরায় রাখলেন। ওটা ঘরের পুরো মেঝে দখল করে রইল আর বলাই বাহুল্য যে এতে মিঃ ওয়াট আর তাঁর স্ত্রী উভয়ের অবশ্যই অসুবিধে হচ্ছিল। তাছাড়া বক্সিটার ওপর যে রঙ দিয়ে বড় বড় হরফে ঠিকানা লেখা হয়েছিল তা থেকে বিশ্রী এক ধরনের গন্ধও বেরুচ্ছিল। বাক্সের ঢাকনার ওপর লেখা ছিল,–’মিসেস এডেলাইড কার্টিস, আলবানি, নিউইয়র্ক। প্রেরক–মিঃ কর্ণেলিয়াস ওয়াট। এই দিকটি উপরে রাখুন। সাবধানে নড়াবেন। এখন বুঝলাম ঐ মিসেস এডেলাইড কার্টিস মিঃ ওয়াটের শাশুড়ী। কিন্তু ঠিকানাটায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। আমি জানতাম যে ওই বাক্স বন্ধুর নিউইয়র্ক শহরে চেম্বার্স স্ট্রীটে যে স্টুডিও আছে তা থেকে উত্তর দিকে কখনোই যাবে না।

প্রথম তিন চার দিনে আমরা উপকুল ছাড়িয়ে সমুদ্রের মধ্যে অনেকখানি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম। আবহাওয়াও বেশ শান্ত ছিল তখন।

জাহাজের আরোহীদের মন মেজাজ তখন বেশ ভালোই ছিল আর সবাই সবার সঙ্গে বেশ সামাজিক ব্যবহার করে চলেছিল। কিন্তু এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলব যে মিঃ ওয়াট আর তার বোনেরা মোটেই ভালো ব্যবহার করছিলেন না। বরং বলব ওঁরা যাত্রীদের সঙ্গে অভদ্র আচরণই করছিলেন। ওয়াটের ব্যবহারের জন্য আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। উনি মুখ গোমড়া করেই ছিলেন আর ঐটেই তার স্বভাব। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওঁর বিষণ্ণতাকে আমি বিশেষ চারিত্রিক লক্ষণ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু তার বোনদের আমি ক্ষমা করতে পারছিলাম না। অধিকাংশ সময়ই ওরা ওদের ঘরের মধ্যে থাকছিল। আমি বহুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোন যাত্রীর সঙ্গে মেলামেশায় ওরা রাজী হয়নি।

মিসেস ওয়াটের ব্যবহার কিন্তু খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। উনি সকলেরই সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। মাঝ-দরিয়ায় এইভাবে সকলের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর মূল্য অনেকখানি। আমার মনে হোল উনি নারী আর পুরুষদের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতার সঙ্গেই মিশছিলেন। খুব আনন্দ দিচ্ছিলেন তিনি সবাইকে। হ্যাঁ, আনন্দ দিচ্ছিলেন বলা ছাড়া আর কীইবা বলতে পারি। আমি আবিষ্কার করলাম তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে না বরং সব হাসিঠাট্টায় তিনি খোলাখুলি ভাবে যোগ দিচ্ছেন। পুরুষেরা ওঁর সম্পর্কে প্রায় নীরবই ছিলেন কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই নারীরা ঘোষণা করলেন যে মহিলাটি দেখতে সুন্দরী ত নয়ই, তিনি অশিক্ষিতা আর আন্তরিকতা থাকলেও রুচির দিক থেকে অত্যন্ত অমার্জিত। এই মহিলা কী ভাবে ওয়াটকে কাঁদে ফেললেন আর বিয়েতে রাজী করালেন সেইটি আমার কাছে একটা রহস্য হয়ে দাঁড়ালো। অর্থ অবশ্যই একটা সাধারণ সমাধান সূত্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি কেননা মিঃ ওয়াট আমাকে আগেই বলেছেন যে উনি সঙ্গে করে একটা ডলারও আনেন নি বা ভবিষ্যতে যে কোথাও থেকে কিছু পাওয়া যাবে এমন সম্ভাবনার পথও দেখান নি। ওয়াট বলেছিলেন যে শুধু ভালোবেসেই নাকি উনি এঁকে বিয়ে করেছেন আর সেদিক থেকে ইনি অতুলনীয়া। বন্ধুর কাছ থেকে শোনা এই সব কথা যখন মনে পড়ল তখন আগাগোড়া ব্যাপারটাই আমার কাছে পরম রহস্যময় হয়ে উঠল। তবে কি ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে আসার সময় ওঁর ইন্দ্রিয়গুলো ক্রিয়াশীল ছিল না। যে মানুষ এতখানি মার্জিতরুচিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, বিচারশীল, সৌন্দর্য সম্পর্কে এত বেশী সচেতন মানুষের পক্ষে বিশেষ করে ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে এমন অসহিষ্ণু মানুষের পক্ষে এ কী করে সম্ভব। তবে এ কথা ঠিক যে ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে এই ভালোবাসা বড় বেশী পরিমাণেই প্রকাশিত হোত। সে সময় উনি কথাবার্তার মধ্যে প্রায়ই স্বামীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলতেন, আমার প্রিয়তম স্বামী মিঃ ওয়াট কিন্তু এই রকমই বলেন। স্বামী শব্দটা তো তাঁর জিভের ডগায় লেগেই থাকত। বলা বাহুল্য এই উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে উল্লিখিত কথাগুলোও তাঁরই। জাহাজের সব যাত্রীই কিন্তু এটা লক্ষ্য করেছিলেন যে মিঃ ওয়াট কিন্তু স্ত্রীকে বেশ এড়িয়ে চলছেন। স্ত্রীকে অবাধে-সকলের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিয়ে উনি ওঁর কামরার মধ্যে অধিকাংশ সময় একাই কাটিয়ে দিচ্ছিলেন।

আমার পক্ষে যা কিছু দেখা আর শোনা সম্ভব হয়েছিল তা থেকে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলাম যে ভদ্রলোক নিয়তির পরিহাসে বা সাময়িক উত্তেজনার বশে বা উৎসাহের আতিশয্যে ওঁর চাইতে সব দিক থেকে নিম্নশ্রেণীর একজন মহিলাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন। এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে ওঁর মনে অতি দ্রুত এক ধরণের ঘৃণা সৃজিত হয়েছে। ওঁর সম্পর্কে আমার মনে করুণার সৃষ্টি হোল ঠিকই কিন্তু পরমুহূর্তেই ঐ ‘লাস্ট সাপার’ ছবি নিয়ে যে গোপনীয়তা উনি রক্ষা করছিলেন তার জন্যে নির্মম হয়ে উঠলাম। এর জন্যে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটাই দৃঢ় হোল শেষ পর্যন্ত।

একদিন তিনি ডেকের ওপর বেরিয়ে এসেছিলেন আর অভ্যাস মতো তাঁর হাত ধরে এদিক ওদিক পায়চারী করছিলাম আমি। তার স্বাভাবিক বিষণ্ণভাবটি কিন্তু বজায় ছিল। উনি যেন বেশ চেষ্টা করেই মাঝে মধ্যে একটুখানি কথা বলছিলেন। দু একবার ওঁর সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তার পরিবর্তে ওঁর হাসিকে বড় বেশী করুণ মনে হোল। হতভাগ্য ওয়াটের স্ত্রীর কথা মনে পড়তে এ বিশ্বাসটিই দৃঢ় হল যে বন্ধুর পক্ষে কোন আনন্দের ভান করাও সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত আমি নিজের কাজ শুরু করলাম। প্রসঙ্গক্রমে ঐ চারকোনা বাক্সটা সম্পর্কে দু’একবার ইঙ্গিত করলাম। ওঁকে পাকেচক্রে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম যে এ ব্যাপারে তিনি যে একটা রহস্য রেখে দেবেন, তা আমি হতে দিতে চাইনে। আসলে কয়েকটা তীক্ষ্ণ আক্রমণই চালালাম ওঁর ওপর যদিও সবই খুব অপ্রত্যক্ষভাবে। ওঁর সেই চারকোনা বাক্সটার প্রসঙ্গ তুলে বললাম যে তার অদ্ভুত আকৃতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। কথা বলতে গিয়ে আমি একটু সবজান্তার ভাব দেখিয়ে হাসলাম এমন কি আমার তর্জনী ওঁর বুকে ঠেকিয়ে একটা গভীর ইঙ্গিতও করলাম।

ওয়াট কিন্তু যেভাবে আমার সমস্ত নির্দোষ পরিহাস হজম করে ফেললেন তাতে বুঝলাম উনি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। প্রথমটা উনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন পরিহাসের কোন অর্থই উনি বুঝতে পারছেন না। তার পর যখন কিছুটা অর্থবোধ হোল, তখনো আগের মতোই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন। এর পর ওঁর মুখ চোখ লাল হয়ে উঠল আবার পরক্ষণেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন তিনি। আবার এর পরমুহূর্তেই আমার রসিকতা বুঝে ফেলেছেন এই রকম ভঙ্গীতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার পক্ষে অবাক হবারই কথা, উনি প্রায় মিনিট দশেক বা তারও বেশী সময় ওইভাবে হাসতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত হাসতে হাসতে উনি জাহাজের পাটাতনের ওপর আছাড় পড়ে গেলেন। ওঁকে তাড়াতাড়ি তুলে ধরতে গিয়ে দেখলাম ওঁর সমস্ত শরীরে মৃত্যুর লক্ষণ পরিস্ফুট।

অনেকেই আমাদের সাহায্যের জন্য দৌড়ে এলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর তার চেতনা ফিরে এলো। জ্ঞান ফেরার পরও বেশ কিছুক্ষণ তিনি এলোমেলো কথা বলতে থাকলেন। যাই হোক আমরা তার কামরায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। পরদিন সকালে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখা গেল। অন্তত শরীরের দিক থেকে কোন রকমের অসুস্থতা তখন আর ছিল না। তার মনের খবর নিইনি। জাহাজে থাকার বাকী ক’দিন আমি তাঁকে এড়িয়ে চলেছি। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার মতৈক্য ঘটেছিল। তার অনুবোধ মতোই আমি মিঃ ওয়াটের সঙ্গে মেলামেশা করিনি আর তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জাহাজের অন্য কোন যাত্রীর সঙ্গে কোন রকমের আলোচনাও করিনি।

মিঃ ওয়াটের এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল আর আমার মনের মধ্যে যে কৌতূহল স্তিমিত হয়ে এসেছিল তা আবার উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। আমি বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলাম তাই বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেললাম। এর ফলে দু’রাত্রি আমার একেবারেই ঘুম হোল না। আমার কামরার দরজা খুলে খাবার ঘরে যাওয়া যেত। প্রকৃত পক্ষে একক যাত্রীর জন্যে নির্দিষ্ট সব কামরারই ঐ এক ব্যবস্থা ছিল। মিঃ ওয়াটের কামরাগুলো ছিল অন্য দিকে। ও ঘরগুলোর একটা ছোট দরজা খুলে খাবার ঘরে আসা যেত। ওদের সেই দরজাগুলোকে রাত্রেও তালা দিয়ে রাখা হোত না। আমরা সমুদ্রে বাতাসের যথেষ্ট আনুকুল্য পেয়েছিলাম। এর ফলে জাহাজটা যখনই বাতাসের দিকে মুখ করে দক্ষিণদিকে মোড় নিচ্ছিল তখনই ঐ ছোট দরজাগুলো খুলে যাচ্ছিল। কোন যাত্রী তার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজাগুলো বন্ধ করার কষ্টটুকুও স্বীকার করতে রাজী ছিলনা। তাই দরজাগুলো খোলাই থেকে যাচ্ছিল। এদিকে গরমের জন্য আমি আমার কামরার দরজা খোলাই রেখেছিলাম। এর ফলে ওদিকের ঘোট দরজা দিয়ে অন্য কামরাগুলোর বিশেষ করে মিঃ ওয়াটের কামরাটার ভেতরটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। যে দু’ রাত্রি আমার ঘুম হয়নি (পরপর দু’রাত্রি নয় কিন্তু সে দু’টি রাত্রেই দেখলাম রাত এগারোটা নাগাদ মিসেস ওয়াট খুব সাবধানে ওঁদের কামরা থেকে বেরিয়ে ওই বাড়তি কামরাটায় গিয়ে ঢুকছেন আর ভোর পর্যন্ত ওখানেই থাকছেন। ভোরে তার স্বামী ডাকলে তিনি কামরায় ফিরে আসছেন। ওঁরা যে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। পাকাঁপোক্ত ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করে নেবার আগে ওঁরা বাড়ীতেও নিশ্চয় পৃথক ঘর ব্যবহার করছিলেন। এখানে একটা বাড়তি কামরা ভাড়া করার রহস্যটা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গেল।

আরও একটা ঘটনায় আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। নিদ্রাহীন ঐ দু’টো রাত্রে মিসেস ওয়াট অন্য কামরায় চলে যাবার পর ওঁর স্বামীর কামরায় খুব সাবধানী চাপা কণ্ঠস্বর শুনলাম আমি। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর ওর অর্থবোধ হোল একেবারে নির্ভুল ভাবেই। শিল্পী ভদ্রলোক ছেনী আর হাতুড়ী দিয়ে ওঁর চারকোনা বাক্সটি খোলর চেষ্টা করছিলেন অথচ হাতুড়ীর আঘাত পড়ছিল এমন সব জায়গায় যেগুলো সুতী বা পশমী কোন বস্তু দিয়ে ঢাকা ছিল।

আমি বেশ অনুভব করতে পারছিলাম যে কোন এক সময় বাক্সের ঢাকনাটি খোলা হয়ে গেল এবং মেঝেতে রাখার জায়গা ছিলনা তাই ওটাকে রাখা হোল নীচের শোবার জায়গাটায়। খুব সাবধানে রাখার চেষ্টা করা হলেও কাঠের শব্দ বেশ পেয়েছিলাম আমি। এর পর কামরার মধ্যে নেমে আসতে নিচ্ছিদ্র নীরবতা আর ভোর পর্যন্ত সেই পরিবেশই বজায় থাকত। ভোরে কিন্তু চাপা গলায় ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আর ফিস্ ফিস্ করে কথা বলার আওয়াজ শুনেছিলাম। অবশ্য জানিনে এগুলো আমারই মনের মধ্যে তৈরী হচ্ছিল কিনা। হয়ত ওঁর কামরা থেকে ফুঁপিয়ে কান্না বা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ সত্যিকারের কোনটিই আমি শুনিনি। শিল্পী হয়ত তার কাঠের সেই চারকোনা বাক্সটা খুলে অমূল্য আর অপূর্ব শিল্পকৃতির আস্বাদই প্রাণভরে গ্রহণ করছিলেন। এর মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবার মত বোধ হয় কিছুই ছিল না। তাই আমি আবার বলছি যে এটা খুবই স্বাভাবিক যে ক্যাপ্টেন হার্ডির কাছে বেশ কয়েকবার চা খাওয়ার ফলে এ সবই আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত। সেই দু’ রাত্রির শেষে ভোরের দিকে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করার শব্দ শুনেছি, পেরেকের ওপর সাবধানে হাতুড়ী পেটানোর আওয়াজও পেয়েছি। তার পর পোক বদলে তিনি বাড়তি কামরাটা থেকে মিসেস ওয়াটকে ডেকে আনতে যেতেন।

সাতদিন সমুদ্র যাত্রার পর আমরা যখন কেপ হটেজ পেরিয়ে গিয়েছি ঠিক তখনই দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে প্রচণ্ড বাতাস বইতে আরম্ভ করল। এ ধরণের ভয় একটা ছিল কারণ কয়েকদিন ধরেই তার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। যাই হক এর জন্য যতখানি সাবধানতা নেবার তা নেওয়া হোল। জাহাজটি তার সমুদ্রযাত্রার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকল। প্রায় আট

চল্লিশ ঘণ্টার শেষের দিকটায় আমরা যে প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম তাতে জাহাজের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল আর তিন জন মাল্লা প্রাণ হারিয়েছিল। একটা মাস্তুল ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। ঝড় পুরো থেমে যাবার লক্ষণ দেখা গেল না। তৃতীয় দিনে আর একটা মাস্তুলের ক্ষতি হোল। আমরা যখন ওটাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন খবর এলো জাহাজের খোলে চার ফুটের মতো জল জমে গিয়েছে। সমস্যাটা গুরুতর হয়ে দাঁড়ালো যখন দেখা গেল যে জল সেচের পাম্পগুলো প্রায় অকেজো হয়ে রয়েছে।

আমরা যখন এইভাবে প্রচণ্ড হতাশা বিমূঢ়তার মধ্যে রয়েছি তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ভারি জিনিষপত্র ফেলে দিয়ে জাহাজটাকে যতদূর সম্ভব হালকা করে ফেলা হবে, এমন কি বাকী দুটো মাস্তুলও কেটে ফেলা হবে। এ সব কাজ করার পরও দেখা গেল অবস্থার এমন কিছু উন্নতি হয়নি। পাম্পগুলো তখনো অকেজো অথচ ওদিকে খোলের ছিদ্রটার আয়তন বেড়ে চলেছিল। সূর্যাস্তের সময় হাওয়ার তীব্রতা আর সেই সঙ্গে সমুদ্রের উন্মত্ততা অনেকখানি কমে গেল। আশা হোল আমরা বোধহয় এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম। রাত আটটা নাগাদ বাতাস থেমে গেল আর মেঘের ফাঁক দিয়ে আকাশে পূর্ণচন্দ্র দেখা গেল। এতে আমাদের হতাশার ভাব অনেকখানি দূর হয়ে গেল।

অমানুষিক পরিশ্রমের পর আমরা প্রথম ছোট নৌকোখানা জাহাজের পাশ থেকে জলে নামাতে পারলাম। ঝড়ে ওটার বড় একটা ক্ষতি করে নি। ওর মধ্যে সমস্ত মাঝিমাল্লা আর অধিকাংশ যাত্রীকে তুলে দেওয়া হোল। নৌকোটা তক্ষুনি রওনা হয়ে গেল আর তিন দিনের দিন ওক্রাকোকে গিয়ে পৌঁছল নিরাপদেই।

এদিকে ভাঙা জাহাজে আমরা ছিলাম চৌদ্দ জন যাত্রী আর ক্যাপ্টেন। আমাদের ভরসা ছিল আর একটা ছোট নৌকোর ওপর। এবার ওটাকে জলে নামানো হোল। অবশ্য নামানোর সময় একটা বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল। যাই হোক দৈবানুগ্রহে নৌকোটা

ঠিকমত জলে ভাসল আর ক্যাপ্টেন আর তার স্ত্রী, মিঃ ওয়াটের লোকজন, একজন মেক্সিকান অফিসার আর তার স্ত্রী এবং চারটি ছেলেমেয়ে, আমি ও একজন নিগ্রো–এই কজন সবাই গিয়ে ওটাতে উঠলাম।

কিছু খাদ্য ও পানীয়, অত্যাবশ্যকীয় কিছু যন্ত্রপাতি ছাড়া অন্য কিছু জিনিষপত্র সঙ্গে নেবার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার নৌকোটা জাহাজ থেকে কয়েক হাত এগোতে-না-এগোতেই মিঃ ওয়াট উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ হার্ডিকে তার চারকোনা কাঠের বাক্সটা নিয়ে আসবার জন্যে নৌকোটাকে জাহাজের কাছে নিয়ে যেতে বললেন।

কিছু রূঢ়তার সঙ্গেই ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, ‘আপনি চুপ করে বসে থাকুন মিঃ ওয়াট। আপনি কি আমাদের নৌকোটা ডুবিয়ে দিতে চান? দেখছেন না, জল এর মাথায় মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

মিঃ ওয়াট তখনো দাঁড়িয়ে। তিনি বলে উঠলেন, কিন্তু আমার বাক্সটা? ক্যাপ্টেন হার্ডি, আপনি মানা করতে পারেন না, করা উচিত নয় আপনার। ওটার ওজন এমন কিছু বেশী নয়। না, মোটেই নয়। আপনার জন্মদাত্রী মায়ের নামে আপনার কাছে অনুরোধ করছি, ক্যাপ্টেন, ফিরে চলুন, আমার বাক্সটা নিয়ে আসতে দিন।’

শিল্পীর আবেগকম্পিত অনুরোধ শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য হয়ত বা ক্যাপ্টেন সহানুভূতি অনুভব করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আগের মতোই কঠোর ভাবে বলে উঠলেন, ‘মিঃ ওয়াট, আপনি উন্মাদ। আপনার কথা আমি শুনতে চাইনে। আপনি চুপ করে বসে পড়ন নইলে আমাদের নৌকো ডুবে যাবে। ওঁকে ধরে বসান তো সবাই, আটকে রাখুন ওঁকে। উনি লাফিয়ে পড়বেন মনে হচ্ছে, হ্যাঁ তাই, ঐ যে, গেল–গেল!

ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে না হতেই মিঃ ওয়াট সত্যি সত্যিই লাফিয়ে উঠলেন আর অপুর্ব দক্ষতার সঙ্গে জাহাজ থেকে ঝুলতে থাকা একটা দড়ি ধরে ফেললেন। ওই দড়িটা জাহাজের একটা মোটা শেকলের সঙ্গে বাঁধা ছিল। পর মুহূর্তেই তিনি জাহাজে উঠে গিয়ে তাঁর কামরার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এদিকে আমাদের ছোট নৌকোটার অবস্থা কাহিল। ওটা সমুদ্রের দয়ার ওপর তখন পুরোপুরি নির্ভরশীল একটা পালকের মতো নগণ্য জিনিসমাত্র। যাই হোক প্রাণপণ চেষ্টা করে আমরা নৌকোটাকে সামলে নিলাম আর বুঝতে পারলাম যে মিঃ ওয়াটের ভাগ্য মন্দ।

জাহাজ থেকে আমাদের নৌকোটার দূরত্ব তখন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ দেখা গেল ওটার ডেকের ওপর তার চারকোনা বাক্সটাকে টানতে টানতে এনে দাঁড়িয়েছেন ওয়াট। দূর থেকে জাহাজের পাটাতনের ওপর তার চেহারাটাকে খুব বড় দেখাচ্ছিল। আমাদের বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে দেখা গেল উনি তিন ইঞ্চি মোটা একটা দড়ির কয়েকপাক বাক্সটায় দিয়ে নিয়ে তারপর নিজের শরীরেও জড়ালেন সেটা। তারপর মুহূর্তেই বাক্সসহ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওয়াট আর চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন।

আমাদের কারো মুখে কথা ছিল না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা নৌকোটার মধ্যে বসে থেকে ঠিক যেখানটায় মিঃ ওয়াট ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেইদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মত সময় নির্বাক অবস্থায় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত সেই কঠোর নীরবতা ভঙ্গ করলাম আমি। বললাম, আচ্ছা আপনি লক্ষ্য করেছেন ক্যাপ্টেন, কত দ্রুতবেগে ওয়াট তার বাক্স নিয়ে জলের তলায় ডুবে গেলেন? ব্যাপারটা একটু অসম্ভব মনে হচ্ছে না? বাক্সের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিয়ে উনি যখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখন কিন্তু আমি আশা করেছিলাম অন্য রকম।

ক্যাপ্টেন উত্তর দিলেন, “উনি ডুবে গেলেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই। প্রায় একটা ভারী গোলার মত। তবে উনি আবার ভেসে উঠবেন–কিন্তু যতক্ষণ নুনটা গলে না যাচ্ছে ততক্ষণ নয়।

‘নুন?’–আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘না, এখন নয়,–মিঃ ওয়াটের স্ত্রী আর বোনেদের দেখিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘পরে কোন এক সময় এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

.

খুব বিপদের ভেতর দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত নিয়তির কৃপায় আমরা তীরে গিয়ে পৌঁছলাম আর আগের নৌকোয় যারা এসেছিলেন তাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। অবশ্য আমাদের অবস্থা মৃতপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারদিনের দিন আমরা পৌঁছেছিলাম রোনোক দ্বীপের বিপরীত দিকের তটভূমিতে। এখানে আমরা সবাই ভালো ব্যবহার পেয়েছিলাম। প্রায় সপ্তাহখানেক এখানে কাটিয়ে, আমরা নিউইয়র্ক রওনা হয়ে গেলাম।

.

‘ইণ্ডিপেণ্ডেন্স’ ডুবে যাবার প্রায় একমাস পরে একদিন ব্রডওয়েতে ক্যাপ্টেন হার্ডির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বলা বাহুল্য আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো জাহাজডুবি আর হতভাগ্য মিঃ ওয়াটের শেষ অবস্থা। ঐ আলোচনাসূত্রেই পুরো খবরটি আমি পেয়েছিলাম।

শিল্পীটি নিজের, স্ত্রীর, দুই বোনের আর একজন চাকরের জন্য জাহাজে জায়গা সংগ্রহ করেছিলেন। আগে যেভাবে বলা হয়েছে ওঁর স্ত্রী ছিলেন অসামান্যা রূপসী। যে চোদ্দ তারিখে আমি প্রথম জাহাজে গিয়েছিলাম সে দিনই ওয়াটের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন আর মারা যান। যুবক স্বামী প্রায় উন্মাদ হয়ে যান কিন্তু নানা কারণে নিউইয়র্ক যাত্রা করার দিন বেশী পিছোনো সম্ভব হয় নি। মায়ের কাছে স্ত্রীর মৃতদেহটি নিয়ে যাওয়া দরকার অথচ সাধারণ ভাবে তা নিয়ে যাওয়া সংস্কারে বাধে। মৃতদেহ জাহাজে তুললে সব যাত্রীই নেমে পালাবে।

এ সমস্যার সমাধান ক্যাপ্টেন হার্ডিই করেন। উনিই পরামর্শ দেন যে মৃতদেহটায় ওষুধপত্র মাখিয়ে যথেষ্ট নুনের মধ্যে একটা প্রয়োজনীয় আকারের বাক্সে পুরে, সাধারণ মালপত্র হিসেবে জাহাজে তোলা যেতে পারে। ভদ্রমহিলার মৃত্যু সম্পর্কে কোন কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু মিসেস ওয়াট হিসেবে কাউকে যাত্রী নেওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। মৃত স্ত্রীর পরিচারিকাকে ঐ ভূমিকায় নেওয়া সহজেই সম্ভব হয়েছিল। আগে মিসেস ওয়াটের জীবৎকালে যে কামরাটি এই পরিচারিকার জন্যে ভাড়া করা হয়েছিল সেইটেই তার জন্যে রয়ে গেল। এই পরিচারিকা রাত্রিতে ওই কামরায় ঘুমোত আর ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই এই তথাকথিত পত্নীটি তার ভূমিকায় যথাযথ ভাবে কর্তব্য পালনের চেষ্টা করত। একটা সুবিধে ছিল এই যে যাত্রীদের কেউই মিসেস ওয়াটকে চিনতেন না।

আমার ত্রুটি সম্পর্কে এবার আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। বুঝতে পারলাম যে আমি শুধু অসতর্কই যে হয়েছিলাম তাই নয়, বড় বেশী কৌতূহলী হয়ে অন্ধ আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলাম। ইদানীং কিন্তু আমার ঘুম ভালোই হচ্ছে। কখনো কখনো শুধু একটা মুখের ছায়া আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে আর চিরদিনই বোধহয় একটা উন্মত্ত অট্টহাস্য আমি একাই শুনতে পাব।

.

৭. এমোনটিল্লাভোর পিপে

ফর্চুনাটো ক্ষতি করেছে আমার অজস্র আর সব কিছু আমি হাসিমুখেই সহ্য করেছি। সে কিন্তু যেদিন আমাকে অপমান করতে সাহসী হয়ে উঠল সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি প্রতিশোধ নেবো। যারা আমাকে ভালো করে চেনে তারা জানে মনের কোন কথাই আমি মুখে প্রকাশ করিনে। যাই হোক প্রতিশোধ যে আমি নেবোই এতে কোন সন্দেহ রইল না যদিও এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করতে গেলে যে ঝুঁকির প্রশ্ন আছে তা আমি বিস্মৃত হলাম না। আমার তাই সিদ্ধান্ত ছিল এই যে প্রতিশোধ আমি নেবো কিন্তু তার জন্য কোন শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হবে না। প্রতিশোধ যে নিতে চায় সে যদি নিজেই হারিয়ে যায় তা হলে অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া অন্যায় যে করেছে প্রতিশোধ নেবার বেলায় সে যদি প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে অবহিত না হয়, তাহলেও প্রতিশোধস্পৃহা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।

কথায় বা কাজে ফর্চুনাটোকে আমি এমন কোন সুযোগ কোন দিনই দিই নি যাতে আমার শুভেচ্ছা সম্পর্কে তার সন্দেহ জাগতে পারে। চিরাচরিত অভ্যাসমততই তার মুখের কথায় হেসেছি আমি। সে বুঝতেও পারেনি যে সে হাসির উৎসমুখ আমার প্রতিশোধস্পৃহার মধ্যেই নিহিত ছিল।

সাধারণভাবে বলতে গেলে ফর্চুনাটোর যে সব গুণাবলী ছিল তার জন্য সে সকলের শ্রদ্ধার এমন কি ভীতির পাত্র হলেও তার একটা দুর্বল দিক ছিল। সে নিজেকে মদ্যরসিক বলে জাহির করত। উচ্চতর দক্ষতা সম্পর্কে এ ধরণের দাবী কম ইতালীয়ই করতে পারেন। ওদের সমস্ত উৎসাহ সময় আর সুযোগ লক্ষ্য করে ব্যয়িত হোত, বিশেষ করে ব্রিটিশ আর অষ্ট্রিয়ান লক্ষপতিদের

প্রতারণা করার বেলায় খুব বেশী পরিমাণে। চিত্রাঙ্কন বা মণি মাণিক্য সম্পর্কে ফর্চুনাটোর ধারণা নিম্নশ্রেণীর হলেও পুরোনো মদ সম্পর্কে সে ছিল একেবারে রসপণ্ডিত। এ ক্ষেত্রে তার সততা একেবারে প্রশ্নাতীত। আমার কিন্তু এই বিশেষ ব্যাপারে ওর সঙ্গে মতপার্থক্য ছিলনা, কেননা ইতালীয় মদে আসক্তি আমারও ছিল। সুযোগ পেলেই ও মদ আমি প্রচুর পরিমাণে কিনে ফেলতাম।

যে সময়টায় মেলা আর নানা রকমের উৎসব নিয়ে হৈ হুল্লোড় শুরু হয় তেমনি সময় এক দিন সন্ধ্যেবেলায় আমি বন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণ ধরেই ও মদ গিলছিল। আমাকে দেখে ভীষণ অান্তরিক ভাবে স্বাগত জানালো সে। নোংরা পোষাক পরে বসেছিল সে, আঁটসাট ডোরাকাটা জামাপ্যান্ট আর ঘণ্টা ঝুলোনো লম্বা টুপী পরা ওকে দেখে মনে হয়েছিল ওর সঙ্গে করমর্দন করাই আমার উচিত নয়।

আমি ওকে বললাম, দেখ ফর্চুনাটো, বড় ভাগ্যের কথা যে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তোমাকে আজ কিন্তু দেখতে খুব ভালো লাগছে। আমি এক পিপে মদ কিনেছি। ওরা বলছে ওটা এমোনটিল্লাডো। আমার কিন্তু বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

ও বলল, এমোনটিলাভো? এই মেলার সময়? তাও আবার এক পিপে? অসম্ভব।

আমি বললাম, সন্দেহ আমারও আছে। আমি কিন্তু এমোনটিল্লাডোর দামই পুরোপুরি দিয়েছি তাও তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করে। তোমার দেখা পাওয়া গেলনা অথচ এদিকে দেরী করলে জিনিসটাই হাতছাড়া হয়ে যায়।

–এমোনটিল্লাডো!

–আমার কিন্তু সন্দেহ আছে।

–এমোনটিল্লাডো।

–পুরো দামটা কিন্তু দিতে হল ওদের

–এমোনটিল্লাডো

–তুমি ব্যস্ত ছিলে। আমি তাই গেলাম সুচেসির কাছে। কেউ এসব জিনিস ঠিক মত চিনতে যদি পারে তাহলে সে। সেই আমাকে বলে দেবে

-লুচেসি শেরী আর এমোনটিল্লাডোর পার্থক্য কখনোই ধরতে পারেনা।

-বোকারাও কিন্তু বলবে যে মদ চেনার ব্যাপারে তারা তোমার সমকক্ষ।

–ঠিক আছে। চল যাই।

–কোথায়?

–তোমার মাটির তলাকার মদের ভাঁড়ারে।

-না, বন্ধু না, তুমি ভালো মানুষ বলে চিরদিনই তোমার ওপর আমি জবরদস্তি করব এ কোন কাজের কথা নয়। তা ছাড়া তোমার জরুরী কাজও আছে আমি জানি। সুচেসি–

-না, আমার কোন জরুরী কাজ নেই। চল যাই।

-না, তা হয় না। আমি ঠিক জরুরী কাজের কথা বলছিনে। তোমার ভীষণ ঠাণ্ডা লেগেছে দেখছি। আমার মাটির তলাকার মদের ভাড়ারটা মারাত্মক রকমের সঁতসেঁতে আর তা ছাড়া ওখানকার পরিবেশ রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর।

-তা হোক গে। তবু চল আমরা যাই। এমন কিছু ঠাণ্ডা লাগেনি আমাকে। এমোনটিল্লাডো! আমি জানি কেউ ওটা তোমাকে জোর করে গছিয়েছে, আর লুচেসি? শেরী আর এমোনটিল্লাডো বোঝবার শক্তিই তার নেই।

কথা বলতে বলতে ফর্চুনাটো ততক্ষণে আমার হাত ধরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিছু জামাকাপড় চাপিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওর সঙ্গে বাড়ীর দিকে রওনা হলাম। বাড়ীতে চাকর বাকর কেউ ছিল না। মেলা দেখবার জন্যে সবাই পালিয়েছিল। আমি বলেছিলাম ওদের যে পরদিন সকাল বেলা বাড়ী আসব। ওরা যেন কিছুতেই বাড়ীর বাইরে না যায়, সে নির্দেশ বিশেষভাবেই দেওয়া ছিল। কিন্তু আমি একথাও জানতাম যে আমি পিছন ফিরতে না ফিরতেই ওরা সবাই হাওয়া হয়ে যাবে।

দুটো মশাল নিয়ে ফর্চুনাটোর হাতে তার একটা গুঁজে কামরাগুলো পেরিয়ে আমরা রওনা হলাম মদের ভাঁড়ারের দিকে। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওকে বার বার সাবধান করে দিলাম আমি। শেষ পর্যন্ত আমার মাটির তলার ভাঁড়ারের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে নেমে এলাম ।

বন্ধু তখন স্থির হয়ে হাঁটতে পারছিলেন না আর মাথার টুপীর ঘন্টাগুলো ঝুম্ ঝুম্ করে বেজে চলেছিল।

ও জানতে চাইল, কই, পিপেটা কোথায়? আমি বললাম, ওই যে ওখানে। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে মাকড়শার সাদা রঙের জালগুলো দেখছ : বন্ধু আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে মদের ঘরে ঝিমিয়ে আসা চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে রইল। একটু পরে সে বলল, নাইট্রিক এ্যাসিডের গন্ধ পাচ্ছি?

নাইট্রিক এ্যাসিড! কিন্তু তোমার এই কাশিটা কতদিন ধরে হচ্ছে?

খুক, খু, খু– । বন্ধু অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারল না। বেশ কিছু সময় পরে সে বলল, না এমন কিছু নয় এটা।

আমি মন স্থির করে নিয়ে বললাম, চল আমরা ফিরে যাই। তোমার শরীর অনেক মূল্যবান। তুমি ধনী, সম্মানিত, প্রশংসিত, বহু মানুষের স্নেহ ভালোবাসায় তোমার জীবন পরিপূর্ণ আর তুমি এজন্যে পরম সুখীও বটে। অবশ্য এককালে এ সবের অনেক কিছুই আমার ছিল। তোমার কোন প্রকার ক্ষতি অসহনীয়। আমার কথা বাদ দাও। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুরো দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়বে। সেটা ভালো নয়। চল আমরা ফিরে যাই। তাছাড়া সুচেসি যখন রয়েইছে–

–ও সব কথা থাক। এ কফকাশি কিছুই নয়, এতে আমার কোন ক্ষতি হবে না। আমি কফকাশিতে মরবো না।

-হ্যাঁ সেতো ঠিকই আর তাই না হওয়া উচিত। দেখ, আমি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনে কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যে যে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এই নাও, এই ‘ম্যাডোক আমাদের ঠাণ্ডা-লাগা থেকে রক্ষা করবে।

কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে যেখানে অনেক বোতল রাখা ছিল সেখান থেকে একটা বোতল তাড়াতাড়ি নামিয়ে এনে খুলে ফেললাম। মদের বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, নাও, ধরো’। ও বাঁকা চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বোতলটা তুলে ধরল মুখের কাছে । ওর বহু-পরিচিত মাথা নাড়বার ভঙ্গীটিও দেখলাম যার ফলে টুপীর ঘণ্টাগুলো আবার বেজে উঠল।

সে বলল, আমার আশে পাশে যারা মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছে আমি তাদের উদ্দেশে মদ্যপান করছি।

–আর আমি পান করছি তোমার দীর্ঘ জীবন কামনা করে।

এরপর সে আমার হাত ধরে এগিয়ে চলতে চলতে বলল, এই ভাড়ারগুলো বেশ বড়।

আমি বললাম, আমাদের পরিবারটাও এককালে বেশ বড় ছিল। সংখ্যায় অনেক লোকজন।

–তোমাদের প্রতীক চিহ্ন যে কী ছিল ভুলে গেলাম।

–খোলা মাঠে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে, তার পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছে একটা বিষধর সাপ আর সাপটার দাঁত মানুষটির পায়ের গোড়ালীতে আটকে আছে।

-কী যেন বক্তব্য একটা ছিল ওর সঙ্গে?

–অপরাধ করলে কোন মানুষই শাস্তির হাত থেকে রেহাই পায় না।

-বাঃ, বেশ ভালো।

ওর চোখে তখন মদের ফেনা চক্ চক্ করে উঠল আর মাথার ঘণ্টাগুলো বেজে উঠল ঝন্ ঝন করে। মদ আমার ওপরও কাজ করছিল। কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠছিলাম আমি। আমরা যে দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম সেদিকে দেয়ালের পাশে অজস্র কঙ্কাল আর মদের কিছু পিপে। আমি ওর হাত ধরে এগিয়ে চলেছিলাম।

আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, এই যে নাইট্রিক অ্যাসিড দেখছ, এগুলো কিন্তু বেশ বেড়ে ওঠে। এই ভাড়ারগুলোতে শ্যাওলার মতো এগুলো জমে যায়। আমরা তো নদীর তলায় দাঁড়িয়ে আছি। ওপর থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে কঙ্কালগুলোর ওপর। যাক, খুব দেরী হয়ে গেছে। চল ফিরে যাই, তোমার আবার কফকাশি–

–ও কিছু নয়। কী বলছিলে বল, কিন্তু তার আগে আর একবার ‘ম্যাডোক’ হয়ে যাক।

আমি এবার ওর হাতের কাছে এক বোতল ‘দ্য গ্রাভে’ এগিয়ে দিলাম। এক নিশ্বাসে ও বোতলটা খালি করে ফেলল। ওর চোখে তখন আগুনের জ্যোতি। হেসে ও এমন একটা ভঙ্গী করে বোতলটা ওপরের দিকে ছুঁড়ে ফেলল যার সঠিক অর্থবোধ আমার পক্ষে সহজ হোল না। আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালাম, ও সেই অদ্ভুত ভঙ্গীটির পুনরাবৃত্তি করল।

সে বলল, বুঝলে কিছু?—না, বুঝলাম না।

–তাহলে তুমি সংঘের সদস্য নও।

–কেন?

–তুমি ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য নও।

–অবশ্যই, অবশ্যই আমি ওদের একজন।

–তুমি? অসম্ভব। ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য?

–হ্যাঁ, ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্য।

–কোন চিহ্ন দেখাতে পারে?

আমি পোষাকের ভাজের ভেতর থেকে একটা কর্ণিক বার করে ওকে দেখালাম। তুমি ঠাট্টা করছ–বলল সে, যাই হোক, চল তোমায় এমোনটিল্লাডোর কাছে যাই।

-তাই চল, বলে আমি ওকে নিয়ে এগিয়ে চললাম। কর্ণিকটা ততক্ষণে পোষাকের মধ্যে পুরে ফেলেছি আমি। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার ওপর ভর দিয়েই হাঁটছিল । আমরা এমোনটিল্লাডোর খোঁজে চললাম। কতকগুলো নীচু খিলানের তলা দিয়ে গিয়ে আমরা একটু তলায় নেমে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে আবার একটু তলায় নামলাম। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম একটা গুপ্ত কক্ষের মধ্যে। ওখানকার বাতাস দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল। সে বাতাসে আমাদের মশালগুলো চক্ করে উঠল।

গুপ্ত কক্ষের এক প্রান্তে আরও ক্ষুদ্র একটা কক্ষ দেখা যাচ্ছিল। ওর দেওয়ালগুলোর গায়ে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত নরকঙ্কালের স্তূপ। তিনটে দেওয়ালের গায়েই এই দৃশ্য। চতুর্থ দেওয়ালের গা থেকে কঙ্কালগুলো মেঝের মাঝখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক জায়গায় অবশ্য ওগুলো মেঝের উপরেই একরকম স্কুপ হয়ে গিয়েছিল। যে দেওয়ালটার গা থেকে কঙ্কালগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল তারই গায়ে তিন ফুট চওড়া, চার ফুট গভীর, ছ’সাত ফুট লম্বা একটা তাকের মত দেখা যাচ্ছিল। ওটা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরী হয়েছিল বলে মনে হোল না। দুটো থামের মাঝখানে পেছনের গ্রানাইট দেওয়ালের গায়ে ওই রকম একটা তাক হয়ে গিয়ে থাকবে।

ফর্চুনাটো তার মৃদু আলোর মশালটা তুলে ধরে বৃথাই ওখানে খোঁজ করছিল। আলোর মৃদু রেখা কক্ষটার শেষ প্রান্তে মোটেই পৌঁছচ্ছিল না।

আমি বললাম, আর একটু এগিয়ে চল। এমোনটিল্লাডো ঐখানেই আছে। সুচেসি বলে—

–ওটা একটা মূর্খ। বলে উঠল বন্ধুটি। টলতে টলতে সে চলল এগিয়ে আর আমি চললাম তার পেছনে। পর মুহূর্তে সে গিয়ে পৌঁছল কক্ষের শেষ প্রান্তে, পাথরের দেওয়ালের কাছে। ওখানে গিয়ে ও বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়ল। পর মুহূর্তে আমি ওকে গ্রানাইট পাথরের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম । পাথরের গায়ে দু’ফুট তফাতে পাশাপাশি দুটো লোহার গজাল লাগানো ছিল। একটা থেকে একটা ছোট শেকল আর অন্যটাতে একটা চাবি ঝোলানো ছিল। ওর কোমরের ওপর দিয়ে শেকলটা ঘুরিয়ে নিয়ে তালা লাগিয়ে দিতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল মাত্র। ও এতই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে বাধা দেবার মত শক্তিও তার ছিল না। তালা থেকে চাবিটা বার করে নিয়ে আমি সে কক্ষ থেকে সরে এলাম।

ওকে বললাম, দেওয়ালটা বড্ড স্যাঁতসেঁতে, কিন্তু উপায় নেই। আমি অবশ্য তোমাকে ফিরে যাবার জন্যে শেষ অনুরোধ করব। কী, ফিরবেনা? তাহলে তোমাকে এখানে ফেলে যাওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।

বন্ধুর বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। সে মোহগ্রস্তের মত উচ্চারণ করল, এমোনটিল্লাডো!

–হ্যাঁ, এমোনটিল্লাডো।

কথা বলতে বলতে আমি কঙ্কালগুলো সরিয়ে ওর তলা থেকে কয়েকখানা পাথর আর কিছু মশলা বার করে ফেললাম। এর পর কর্ণিকটার সাহায্যে পাথর আর মশলা দিয়ে এই ছোট্ট কক্ষটার প্রবেশ-পথ বন্ধ করে ফেললাম।

একপ্রস্থ পাথর বসানো শেষ করার পূর্বেই বুঝতে পারলাম ফর্চুনাটোর মদের নেশা অনেকখানি কেটে গেছে। এর প্রথম প্রমাণ পেলাম ওর মৃদু আর্তনাদ থেকে। কক্ষের গহ্বর থেকে সে আর্তনাদ শুনে বুঝতে পারলাম যে তা মাতালের কণ্ঠস্বর নয়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল এরপর। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্তর পাথর বসানোর পরই শেকলের প্রবল ঝন্‌ ঝন্ শব্দের অনুরণন অনুভব করলাম। বেশ কয়েক মিনিট ধরে খুব তৃপ্তির সঙ্গে আমি তা উপভোগ করলাম। এরপর একটু সময় কঙ্কালস্কৃপের ওপর বসে রইলাম আমি। শেকলের শেষ ধ্বনিটুকু মিলিয়ে যাবার সঙ্গে আবার উঠে তৎপরতার সঙ্গে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম স্তর পাথর বসিয়ে আমার কাজ নিপুণভাবে শেষ করে ফেললাম। নতুন দেওয়ালটা তখন প্রায় আমার বুক-সমান উঁচু হয়ে উঠেছে। মশালটা উঁচু করে ধরে ওপাশের মূর্তিটাকে একবার দেখে নিতে চাইলাম আমি।

শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষটার গলা থেকে এমন একটা তীব্র আর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো যে আমি কয়েক পা পিছিয়ে এলাম নিজেরই অজান্তে। একটু সঙ্কোচ, একটা শিহরণ অনুভব করলাম যেন। একটা তলোয়ার খাপ থেকে বার করে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম খানিকক্ষণ। একটু পরেই কিন্তু স্বাভাবিকতা ফিরে এলো আমার মধ্যে। যে দেওয়াল আমি গড়ে তুলছিলাম হাত দিয়ে তার দুর্ভেদ্যতা অনুভব করে বড় তৃপ্ত হলাম আমি। এরপর আবার আমার কাজ শুরু করলাম। ওদিকের আর্তনাদের প্রত্যুত্তরে আমিও চীৎকার করতে থাকলাম–আরও বেশী করে, তীব্রতর ভাবেই। ওর আর্তনাদ আমার চীৎকারের প্রচণ্ডতার মধ্যে সম্পূর্ণভাবেই ডুবে গেল । সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল এর পর।

তখন প্রায় রাত দুপুর। আমার কাজও শেষ হয়ে আসছিল। অষ্টম, নবম আর দশম স্তরের গাঁথনীও শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর পরের একটা স্তর শেষ করে তার ওপর একটা মাত্র পাথর বসিয়ে দিয়ে পলস্তারা লাগানোটুকু মাত্র তখন বাকী। পাথরটা বেশ ভারী। ওটা নিয়ে আমি টানাহ্যাঁচড়া করছিলাম। ওটাকে তার জায়গায় যখন প্রায় এনে বসিয়েছি ঠিক তখনই ভেতর থেকে মৃদু কণ্ঠের হাসির শব্দে আমার শরীর শিউরে উঠল। মাথার চুলগুলো সবই যেন খাড়া হয়ে উঠল আমার। তার পরমুহূর্তেই করুণ কণ্ঠস্বরে কিছু কথা শুনতে পেলাম আমি। ওটা ফর্চুনাটোর গলার স্বর বলে চিনে নিতে অবশ্য একটু বিলম্ব হয়েছিল আমার। শুনলাম, হাঃ হাঃ হাঃ, এ রসিকতাটা কিন্তু মন্দ নয় ।-বেশ উচ্চস্তরের রসিকতাই বলতে হবে। ও-বাড়ীতে এ নিয়ে রসিকতার অনেক বেশী সুযোগ এরপর পাওয়া যাবে। হেঃ হেঃ হেঃ, আমাদের এই মদ খাওয়া নিয়েই রসিকতা, হাঃ হাঃ, হাঃ।

আমি বলে উঠলাম, এমোনটিল্লাড়ো!

হাঃ হাঃ হাঃ, এমোনটিল্লাডোই বটে। কিন্তু আমরা কি যথেষ্ট দেরী করে ফেলিনি? ওদিকে লেডি ফর্চুনাটো আর অন্যেরা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছেন। চল, এবার আমরা ফিরে যাই।

–হ্যাঁ, যাওয়া যাক্ এবার।

–ঈশ্বরের দোহাই।

–ঈশ্বরের দোহাই।

এরপর বেশ খানিক সময় অপেক্ষা করেও কোন কথা শুনতে পেলাম না। বেশ অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ফর্চুনাটো! কোন উত্তর শোনা গেল না। আবার ডাক দিলাম, ফর্চুনাটো! কোন উত্তর নেই। যে একটুখানি ফাঁক ছিল গাথনীর মধ্যে তার ভেতর দিয়ে মশালটা গলিয়ে ওপাশে ফেলে দিলাম আমি। এর পরিবর্তে ও দিক থেকে শেকলের আর ঘণ্টার ঝন্ ঝন্ শব্দ ভেসে এলো শুধু। ভূগর্ভস্থ সে কক্ষটির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অসুস্থ বোধ করছিলাম। কাজ যেটুকু করার ছিল, সেটি তাই তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইলাম আমি। শেষ পাথরটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে আমি তার ওপর পুরু পলস্তারা লাগিয়ে দিলাম। এই নতুন গাথনীর গায়ে পুরোনো কঙ্কালের একটা প্রাচীর গড়ে তুললাম এরপর। অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে কোন মানবসন্তান ওদের স্থানচ্যুত করেনি। শান্তিতে থাকুক ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *