জনতার মানুষ

জনতার মানুষ

জার্মান ভাষায় রচিত কোন একটি গ্রন্থ সম্পর্কে বলা হয় যে ওটি পড়বার জন্য রচিত হয়নি। একই ভাবে বলা যায় যে কিছু গোপনীয় তথ্য আছে যেগুলি কোনদিনই প্রকাশযোগ্য নয়। এই ধরণের অত্যন্ত গোপনীয় তথ্যের ঘৃণ্য বোঝা বয়েই কিছু মানুষ রাত্রির নির্জনতার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এরা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে স্বীকারোক্তি করে আর করুণভাবে তাকিয়ে থাকে সবার মুখের দিকে। তারপর এক সময় হতাশার ভারে ওদের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে আর সব ফুরিয়ে যায়। তবুও মানুষ মাঝে মধ্যে এই ধরণের ভয়ঙ্কর বোঝা বয়ে বেড়ায় আর শেষ পর্যন্ত সেইসব বোঝ নিয়েই কবরের মধ্যে চলে যায়। হয়ত এই জন্যেই অপরাধমূলক সব কাজের মৌলিক কারণগুলো অজ্ঞাতই থেকে যায়।

খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। শরৎসন্ধ্যায় লণ্ডনের ডি কফিহাউসের বড় জানালার পাশে আমি বসেছিলাম। মধ্যে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, অবশ্য সম্প্রতি আমি সুস্থ হয়ে উঠছিলাম আর আমার মন মেজাজও ভালোই ছিল। মন আমার বেশ শান্ত ছিল আর সব কিছু সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বোধ করছিলাম। আমি একটা সিগার ধরিয়ে খবর কাগজ নিয়ে বসেছিলাম। বিকেল বেলাটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল, কখনো কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ে, কখনন ঘরের মধ্যে যারা আসছিলেন তাদের সান্নিধ্য পেয়ে আবার কখনো ঘোলাটে কাঁচের জানালা দিয়ে বড় রাস্তাটা দেখতে দেখতে সময় বেশ কেটে যাচ্ছিল।

কফিহাউসের সামনে ঐ রাস্তাটা শহরের অন্যতম প্রধান রাস্তা। সারাদিন লোকজনে ওটা চঞ্চল থাকত। সন্ধ্যার অন্ধকার যতোই ঘনিয়ে আসতে লাগল, লোকের ভিড়ও যেন তত বাড়তে লাগল, রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠার পর দেখা গেল কফিহাউসের দরজার

সামনে দিয়ে জনতার দু’টো স্রোত যেন অবিচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলেছে। এই রকম কোন সন্ধ্যা আমি কফিহাউসে বসে কাটাইনি তাই জন সমুদ্রের এই অভিনবত্ব আমার খুবই ভাল লাগছিল। ঘরের ভেতরের কোন জিনিসের ওপর আমার আর তখন নজর ছিলনা। সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল বাইরের জনস্রোতের ওপর।

গোড়ার দিকে আমার চিন্তাটা ছিল নিতান্তই সাধারণ নির্বস্তুক ধরনের। পথিকদের দেখছিলাম সমষ্টিগতভাবেই। কিন্তু একটু পরেই আমি সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম, তাদের পোষাক আকৃতি চলন-ভঙ্গী এমন কি মুখের ভাবভঙ্গীতেও মনোযোগী হয়ে উঠলাম।

বেশীর ভাগ লোকেদের সুখী আর কাজের মানুষ মনে হচ্ছিল। ওরা সবাই যেন সবার আগেভাগে চলে যাবার চেষ্টা করছিল। ভুরু কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে সবাই এগিয়ে চলেছিল। মজার কথা, পথে অন্য কোন পথিকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলেও বিরক্ত হচ্ছিল না কেউই। বিন্দু মাত্রও অধৈর্য না হয়ে জামাকাপড় সামলে নিয়ে আবার হন হন করে হেঁটে চলেছিল। বেশ কিছু লোককে বড় বেশী ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। লোকারণ্যের মধ্যেও তারা যেন নিঃসঙ্গ এই ভাবে নিজেরা কথা বলে, অঙ্গভঙ্গী করে খুশী মনে হেঁটে চলেছিল। চলার পথে বাধা পেলে এর কথা বলা বন্ধ করছিল বটে কিন্তু মুখভঙ্গীর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল ওদের। একটু হেসে ওরা আবার এগিয়ে যাচ্ছিল। কেউ ধাক্কা দিলে ওরা মাথা নীচু করছিল তাদেরই কাছে যারা ওদের ধাক্কা দিচ্ছিল। একটুখানি হতবুদ্ধি অবস্থায়ও পড়ছিল ওরা। দু’ধরনের পথিকদের সম্পর্কে যা বললাম এর চাইতে নতুন কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না। সবার পোষাক পরিচ্ছদ ছিল মোটামুটি ভদ্র আর সুন্দর। ওরা নিশ্চয় ব্যবসায়ী, উকিল প্রভৃতি শ্রেণীর সম্মানিত মানুষ। কর্মব্যস্ত আর অবসর উপভোগের জন্যে আগ্রহী মানুষের দল। ওদের দেখে নতুন কোন চিন্তাই আমার মনে এল না।

কেরানীদের দুটো দলকেও পরিষ্কার ভাবে বেছে নিতে পারছিলাম আমি। ওদের মধ্যে একদল ছিল জাঁকালে অফিসের নিম্নপদস্থ কেরাণী। ওই সব যুবকদের আঁটসাট জামাকোট, চকচকে জুতো, তেল চকচকে মাথার চুল আর ঘৃণাব্যঞ্জক ঠোঁটগুলো বেশ চিনতে পারছিলাম। ওদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাক দেখে মনে হয় ওগুলো বছর দেড়েকের মধ্যে বরাত দিয়ে করিয়ে নেওয়া। সমাজের আদব-কায়দা-দুরস্ত ভদ্রলোকদের মত এই মানুষগুলিকে নতুন কোন সংজ্ঞা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

পুরোনো বনেদী অফিসের কিছু বয়স্ক কেরানীদের বেছে নিতেও ভুল হোলনা আমার। কালো বা বাদামী রঙের ঢিলে ঢালা জামা প্যান্ট, সাদা ওয়েস্ট কোট, চওড়া-মাথা ভারী বুটজুতো, বেশ মোটা মোজা প্রভৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে অফিসে ওঁষা বেশ আরামে সময় কাটান। ওঁদের প্রত্যেকেরই মাথায় ছিল ছোটখাটো টাক আর ডানকানে কলম গুঁজে রাখার অভ্যাসের দরুন ওটা একটু অন্য রকম হয়ে উঠেছিল। ওঁদের ঘড়ির : চেন ছিল সোনার আর মাথায় টুপীটা পরে নেবার জন্যে বা ঠিক করে বসিয়ে নেবার জন্যে ওঁরা ব্যবহার করছিলেন দু’হাত। ওঁদের ভাবভঙ্গীর মধ্যে বেশ একটা বনেদী ভদ্রলোকের ভাব আনার চেষ্টা ছিল।

খুব চকচকে পোষাক পরা লোকজনও দেখছিলাম আমি। বুঝতে অসুবিধে ছিলনা যে ওরা পকেটমারের দল। আজকের বড় শহর গুলো ওদের বৃত্তিধারী লোকজনে ছেয়ে গেছে। আমার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছিল না কী করে প্রকৃত ভদ্রলোকেরা ওইগুলোকে ভদ্রলোক ভাবেন। ওদের চওড়া মনিবন্ধ, আকৃতি আর বড় বেশী খোলাখুলি আচরণ দেখেই চিনে ফেলা উচিত যে ওরা পকেটমার।

জুয়াড়ীদেরও দেখছিলাম আমি। সংখ্যা তাদের কম ছিলনা। ওদের পোষাক– ছিল নানা রকমের, গুণ্ডাদের পোষাক থেকে ধর্ম যাজকদের পোষাক–ওরা সব কিছুই ব্যবহার করছিল। কিন্তু তাই বলে জুয়াড়ী হিসেবে চিনে নিতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। কালো চোখমুখই ওদের চিনিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য আরও দুটো চিহ্ন দেখে আমি ওদের চিনে নিতে পারছিলাম। ওরা কথা বলছিল খুব সাব

ধানে নীচু গলায় আর বুড়ো আঙুল’ বাড়িয়ে কোন একদিকে ইঙ্গিত করছিল। যাদের সঙ্গে ওরা কথা বলছিল তারা সবাই ভিন্ন শ্রেণীর লোক কিন্তু জুয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সমগোত্রীয়। এরা বুদ্ধির জোরে অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত ভদ্রলোক। জুয়াড়ীরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদল হলেন ফুলবাবু যাদের মুখে হাসি আর মাথায় লম্বা চুল। অন্য দল হলেন সৈনিক সম্প্রদায় যাদের পরনে সামরিক জামা কাপড় আর চোখমুখ ভ্রুকুটিকুটিল।

ভদ্রসমাজ থেকে একটু নীচের দিকে নেমে এসে একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ইহুদী ফিরিওলাদের দেখলাম আমি। ওদের বাজের মত তীক্ষ্ণ চোখজোড়া ছাড়া আকৃতির মধ্যে হীনমন্য তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। দেখলাম শক্ত সমর্থ পেশাদার ভিখিরিদের। জীবন সম্পর্কে হতাশা নিয়ে ওরা রাত্রে ভিক্ষে চেয়ে বেড়াচ্ছে আর সাধুসন্ন্যাসী দেখলে তাদের কাছে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভিক্ষে চাইছে। ক্ষীণপ্রাণ বিকৃতদর্শন বিকলাঙ্গদের দেখতে পেলাম আমি। নিশ্চিত মৃত্যু ওদের ওপর যেন ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। ওরা পথের পাশ দিয়ে কম্পিত পদক্ষেপে এগোবার চেষ্টা করছিল আর কিছু আশা আর সান্ত্বনা লাভের উদ্দেশ্যে জনতার প্রতিটি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখলাম, কর্মক্লান্ত তরুণীদের নিরানন্দ বাড়ীর পথে ফিরে যেতে। ইতর ছেলে-ছোকরাদের চাউনি থেকে অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজেদের বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছিল ওরা। কখনো কখনো ওদের মুখোমুখী হয়ে পড়তে হচ্ছিল মেয়েদের কিন্তু তা থেকে রেহাই পাবার পথ ছিল না। কিছু ছেঁড়া কাপড়জামা পরা কুষ্ঠ রোগীদেরও দেখলাম রাস্তায় আর দেখলাম কুঞ্চিত মুখমণ্ডল কিছু বয়স্ক নারীদের যারা গয়না আর প্রসাধন দ্রব্যের সাহায্য নিয়ে যৌবন ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। চলেছিল কিছু মাতাল। ছেঁড়া জামা কাপড় পরে টলতে টলতে আর বিড় বিড় করে বতে বকতে ওরা চলেছিল এগিয়ে। ওদেরই একদলকে দেখলাম মোটামুটি ভালো জামাকাপড় পরা, আজও জামা কাপড়ে বুরুশ দেওয়া হয়েছে তাদের কিন্তু ম্লানমুখ বিভ্রান্তদৃষ্টি রক্তচক্ষু এই মানুষগুলি জনতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলবার সময় হাতের নাগালের মধ্যে যা পাচ্ছিল তাই কম্পমান আঙ্গুলে মুঠো করে ধরছিল। এ ছাড়া জনতার সঙ্গে মিশে চলেছিল ক্লান্ত কুলি মজুর, জিনিষপত্রে শানপালিশ দেবার, বাঁদর খেলাধার, গান গেয়ে পয়সা উপার্জন করবার মানুষেরাও। সব মিলিয়ে যে প্রাণবন্যা আর ধনিপ্রবাহ সৃজিত হচ্ছিল তা আমার কানে একটা ছন্দহীন শব্দতরঙ্গ আর চোখে বিসদৃশ দৃশ্যের অবতারণা করছিল।

ক্রমশ রাত গম্ভীর হতে থাকল আর সেই সঙ্গে গভীরতর হয়ে উঠল চলমান দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণ করবার জন্যে আমার ঔৎসুক্য। এদিকে এই দৃশ্যের পরিবর্তনটিও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার মধ্যেকার ভদ্র আর নিয়মানুগ অংশগুলো অন্তর্হিত হয়ে গিয়ে কুখ্যাত আর অশোভন অংশগুলোই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল। দিনের অপসৃয়মান আলোর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে রাস্তার বাতি গুলো মিটমিট করছিল। এতক্ষণে ওরা উজ্জ্বলতর হয়ে কুৎসিত দৃশ্যগুলোকেই ঝলমলে করে তুলেছিল।

সেই উজ্জ্বল আলোয় জানালা দিয়ে অল্প যেটুকু সময় দেখবার সুযোগ পাচ্ছিলাম তারই মধ্যে প্রতিটি মুখ আরও খুটিয়ে দেখতে লাগলাম আমি। শুধু এক পলক দেখার সুযোগ ছিল আমার তবু মনে হতে লাগল যে ওরই মধ্যে প্রতিটি মুখে বহু বৎসরের ইতিহাস পাঠ করতে পারছিলাম আমি।

জানালার কাঁচে চোখ ঠেকিয়ে জনতার প্রতিটি মুখ দেখে নিতে আমি যখন যথেষ্ট ব্যস্ত, ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল জরাজীর্ণ ষাট বা পঁয়ষট্টি বছর বয়সের একটি মুখ। ঐ মুখটির মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল অথচ সামান্যতম লক্ষণের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচিতি ছিলনা। মুখটিকে দেখা মাত্রই মনে হোস রেজ তাঁর বিখ্যাত শয়তানের ছবিটি আঁকবার আগে এই মুখটি অবশ্যই দেখে ছিলেন। ওই মুখটির প্রাথমিক অর্থ বোঝবার জন্যে যে স্বল্পতম সময়

আমি পেয়েছিলাম তারই মধ্যে আমার মনে বিচিত্র বিপরীত চিন্তার উদয় হোল। মনে হোল ওই মুখের রেখায় রেখায় যে বিরাট মানসিক শক্তির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার মধ্যে একাকার হয়ে আছে সাবধানতা আর দৈন্য, শান্তি আর ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর সাফল্য, আনন্দ আর অপরিসীম ভীতি আর সেই সঙ্গে নিঃসীম হতাশা। মনে হোল এমন ভয়ঙ্কর আকর্ষণীয় মুখ আমি আর কখনো দেখিনি। কী এক আদিম আর অস্বাভাবিক ইতিহাসই না ঐ মানুষটি তার অন্তরে বহন করে চলেছে’-বলে উঠলাম আমি। হঠাৎ মনে হোল এ মানুষটিকে নজরে রাখা দরকার, ওর কথা অনেক বেশী করেই জানা দরকার । তাড়াতাড়ি ছড়ি আর টুপিটা তুলে নিয়ে ওভার কোটটি গায়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম আর যে দিকে ওই ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন ভিড়ের ভেতর দিয়ে সেদিকে তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলাম। একটু পরেই ওঁকে খুঁজে পেলাম আর ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ওঁর পিছু নিলাম।

এখন ওঁকে ভাল করেই দেখতে পারলাম আমি। ছোটখাটো চেহারার দুর্বল গড়নের এই মানুষটির পরনে ছিল ময়লা আর ছেঁড়া জামা কাপড়। উজ্জ্বল আলোর তলায় আসা মাত্রই বুঝতে পারলাম জামাকাপড় এককালে তৈরী হয়েছিল দামী কাপড়েই। আর যদি আমার চোখের তীক্ষ্ণতা ঠিক থাকে আর তারা আমাকে প্রতারিত না করে থাকে তাহলে এও দেখলাম যে উনি হীরে ব্যবহার করছেন আর পোশাকের তলায় আছে একটা ছোরা। আমার উৎসাহ বেড়ে গেল, স্থির করলাম যে উনি যেখানেই যান না কেন আমি তাকে অনুসরণ করে নেব।

তখন বেশ রাত হয়েছে, সারা শহরের ওপর যে ঘন কুয়াশা জমেছিল তারই পরিণতি তখন ঘটছে বর্ষণে। বর্ষা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে আলোড়ন লক্ষ্য করা গেল আর পরমুহূর্তেই মানুষের পরিবর্তে দেখা গেল অজস্র ছাতা। জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য আর গুঞ্জন তখন দশগুণ বেড়ে গিয়েছে। বর্ষার জন্যে আমার কিন্তু কোন অসুবিধেই হচ্ছিল না। আমি মুখের ওপর একটা রুমাল জড়িয়ে নিয়ে ভদ্রলোকটিকে পাছে হারিয়ে ফেলি তাই একেবারে তাঁর গা ঘেষে হাঁটছিলাম। ভদ্রলোকটি একবারও পেছন ফেরেননি বা আমাকে লক্ষ্য করেননি। কিছুক্ষণ পরে আমরা অন্য এমন একটা রাস্তায় পৌঁছলাম যেখানে লোকজন খুব কম। এখানে পৌঁছেই ওঁর আচরণে পরিবর্তন দেখা গেল। এখন অনেকখানি সঙ্কোচের সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে চললেন উনি। কিছুটা লক্ষ্যহীনভাবে রাস্তাটায় এদিক ওদিক পায়চারী করলেন। আমি কিন্তু ওঁর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই চললাম। অপ্রশস্ত আর দীর্ঘ পথটায় ঘণ্টাখানেক ধরে চললেন তিনি। ইতিমধ্যে পথের লোকজন আরও কমে এসেছে। পার্কের কাছে ব্রডওয়েতে দুপুরবেলা যে রকম লোকজন দেখা যায়, এখন এ রাস্তায় তার চাইতে বেশী লোক ছিল না। লণ্ডনের জনবহুল শহরের সঙ্গে আমেরিকার কোন শহরের এই পার্থক্যটি সহজেই চোখে পড়ে। আর একটা মোড় ফিরে আমরা অন্য একটা আলোকোজ্জল আর জনবহুল রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের আচরণে পরিবর্তন এসে গেল। ওঁর চিবুকটা বুকের কাছে নেমে এলো কিন্তু আশপাশে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে তার চোখ এদিকে ওদিকে কী যেন খুঁজে বেড়াতে লাগলো। বেশ সাবধানতার সঙ্গে তখনো এগিয়ে চলেছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ একবার পেছন ফিরে কিছুটা উল্টোমুখে হেঁটে গিয়ে তিনি আবার ফিরে এলেন। ওঁকে এই ভাবে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখে খুব বিস্মিত হলাম আমি। মধ্যে একবার আমাকে দেখে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছিল।

এইভাবে আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। বৃষ্টি বাড়ার ও ঠাণ্ডা পড়ার ফলে লোকজন এবার বাড়ী ফিরতে আরম্ভ করেছিল তাই পথে লোকজনের দিক থেকে বাধা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছিল। কিছুটা যেন অসহিষ্ণুতার সঙ্গে পথিকটি অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। এই রাস্তায় প্রায় সিকি মাইল পথ উনি যে পরিমাণ দ্রুততার সঙ্গে হেঁটে গেলেন, তার সঙ্গে তাল রেখে চলা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠল। তারপর উনি একটি ওঁর অতিপরিচিত বাজারে গিয়ে পৌঁছলেন আর অজস্র ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে আগের মতই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।

এখানেই প্রায় ঘণ্টাদেড়েক কাটল। এর মধ্যে নিজেকে ওঁর নজর থেকে দূরে রাখতে আমাকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে আমার পায়ে নরম জুতো ছিল আর নিঃশব্দে হাঁটা ফেরা করতে পারছিলাম আমি। আমি যে ওঁর ওপর নজর রেখে চলেছি একটি মুহূর্তের জন্যেও তিনি তা বুঝতে পারেননি। উনি প্রায় প্রতিটি দোকানে ঢুকলেন আর সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখলেন কিন্তু কোন জিনিসেরই দাম জানতে চাইলেন না। ওঁর এই সব আচরণে আমি খুবই বিস্মিত হয়ে উঠেছিলাম। মনে মনে স্থির করে ফেললাম ওঁর সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ না-করা পর্যন্ত আমি ওঁকে নজরে রাখবে।

একটা বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে এগারোটা বাজল। বাজারের লোকজন এবার কমতে শুরু করল। একজন দোকানদার তার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পায়ে ধাক্কা খেল। দেখলাম ভদ্রলোক যেন কেঁপে উঠলেন, পরমুহূর্তেই তিনি বড় রাস্তায় পৌঁছে এদিক ওদিক কী যেন দেখে নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়ে চললেন। বহু ছোট ছোট জনশূন্য গলি,,আর আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে উনি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন ডি– কফিহাউসের সামনে সেই বড় রাস্তায়। এ রাস্তার চেহারা সেই আগের মতোই ছিল। তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। গ্যাসের আলোয় দেখা যাচ্ছিল লোকজনের যাতায়াত অনেক কমে গিয়েছে। ভদ্রলোকের মুখ তখন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। একদা জনবহুল সেই রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আবার কতকগুলো রাস্তা পেরিয়ে নদীর দিকে রওনা হলেন। শেষ পর্যন্ত উনি পৌঁছলেন একটা বড় থিয়েটার হলের সামনে। ওটা তখন বন্ধ হবার মুখে। দরজা দিয়ে লোকজন বেরিয়ে আসছিল। দম নেবার জন্যেই যেন উনি দ্রুতবেগে ঐ জনতার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনে হচ্ছিল ইতিমধ্যে তাঁর মানসিক উত্তেজনা অনেকখানি কমে এসেছে। মাথা আবার ঝুঁকে পড়ল বুকের দিকে। প্রথম যে অবস্থায় তাকে দেখেছিলাম, এখন আবার সেই রকমই মনে হতে লাগল আমার। লোকজন বেশীর ভাগ যেদিকে চলেছিল উনিও সেইপথে এবার এগিয়ে চললেন। ওঁর ব্যবহার ক্রমশ আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল।

যেতে যেতে আগের অস্থিরতা আর অস্বস্তি যেন আবার ফিরে এলো। দশবারো জনের একদল লোকের পেছনে পেছনে উনি চলছিলেন। কিছুদূর যাবার পর এক একজন কমে গিয়ে দলটিতে রইল মাত্র তিনজন। ওরা তখন চলেছে প্রায় অন্ধকার একটা নির্জন সরু গলি দিয়ে। পথিক একটু থমকে দাঁড়ালেম হঠাৎ। মনে হোল গভীর চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছেন তিনি, পরক্ষণে আবার দ্রুতবেগে হাঁটতে হাঁটতে শহরের উপকণ্ঠে এমন একটা এলাকায় এসে পৌঁছলেন যেটি এতক্ষণ যে সব এলাকায় আমরা ঘোরাঘুরি করছিলাম তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। চরম দারিদ্র্য আর অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য কুখ্যাত বিশ্রী দুর্গন্ধপূর্ণ লণ্ডনের এই এলাকায় আলোও বেশী ছিল না। মাঝে মধ্যে এক আধটা আলোয় বড় বড় ঘুনে ধরা নড়বড়ে পুরোনো দিনের কাঠের বাড়ী নজরে পড়ছিল। বাড়ীগুলোর মাঝখান দিয়ে রাস্তাটাও ভালো করে চোখে পড়ছিল না। পাথরগুলো খুলে গিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল আর রাস্তার সেই ফাঁকগুলোতে ঘাস গজিয়ে উঠেছিল। চারদিকে আবর্জনার ভয়ঙ্কর ভূপ। এলাকাটাকে ভীষণ নির্জন মনে হচ্ছিল। যাই হোক কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে তারপর মানুষের সাড়া পাওয়া গেল। লণ্ডন শহর থেকে বহিষ্কৃত জনসমষ্টির একটা অংশকে ঘোরা ফেরা করতে দেখা গেল। নির্বাণোম্মুখ প্রদীপের মত ভদ্রলোকের প্রাণশক্তি যেন শেষবারের মত উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। আবার তিনি এগিয়ে চললেন, একটা মোড় ফিরেই পৌঁছলেন শহরতলীর কুখ্যাত মদচোলাইয়ের আঁটিগুলোর সামনে। সুরাসক্তির সেই প্রাসাদগুলির সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম।

তখন ভোর হয়ে আসছিল। হতচ্ছাড়া মাতালরা তখন ভাটিখানার মধ্যে যাতায়াত করছিল। ভদ্রলোক যেন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তারপর সেই মাতালদের দলে ভিড়ে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। একটুক্ষণের মধ্যেই যে ভাবে লোকজন বেরুতে লাগল তাতে বোঝা গেল যে সে রাত্রের মত ভাটিখানার মালিক তার দোকান বন্ধ করছে। ভদ্রলোকটির মুখের ওপর দীর্ঘসময় ধরে লক্ষ্য করে চলেছিলাম। এখন মনে হোল হতাশ না হয়ে উনি যেন বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। পাগলের মত আবার ফিরে চললেন তিনি লণ্ডন শহরের দিকে। বেশ দ্রুত বেগেই হেঁটে চললেন তিনি আর আমিও চললাম সমান বেগে পূর্বের মত ঔৎসুক্য নিয়ে। সূর্য উঠেছে। উনিও এগিয়ে চলেছেন। একটু পরে আবার সেই ডি–কফিহাউসের সামনের রাস্তায় তিনি গিয়ে পৌঁছলেন। আগের দিন সন্ধ্যায় যে ভাবে লোকজনের ভিড় দেখেছিলেন তখন প্রায় সেইরকম ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। আগের মতই ভদ্রলোক হাঁটতেই থাকলেন, এদিক ওদিক একেবারে লক্ষ্যহীন ভাবে। সারাদিন ধরে যাত্রীমুখর পথেই হাঁটতে থাকলেন তিনি। আবার যখন সন্ধ্যা হয় হয় তখন ক্লান্তিতে আমি একেবারে ভেঙে পড়ছিলাম। আমি সামনে এসে ওঁর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি কিন্তু থামলেন না, এগিয়ে চললেন। আমি থেমে গিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম, এই বৃদ্ধ। ভদ্রলোকটি অপরাধমূলক কাজকর্মের জীবন্ত প্রতীক। উনি কখনো একা থাকতে পারতেন না তাই জনতার মানুষ হয়ে গিয়েছেন তিনি। ভগবানের এইটুকু আশীর্বাদ উনি লাভ করেছেন যে জনতার মধ্যে মিশে থেকে উনি কিছুটা সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *