১০. গোঁড়া মতবাদের পুনরাবির্ভাব

গোঁড়া মতবাদের পুনরাবির্ভাব

যুদ্ধের সময়ে সকলদেশের ক্ষমতাশালীরা জনতাকে অস্বাভাবিক রকমের সুযোগ সুবিধা ঘুষ হিসেবে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগল। মজুরদের বেঁচে থাকার মতো মজুরি দিতে স্বীকার করা হলো, হিন্দুদের বলা হলো তারাও মানুষ, সুতরাং পরস্পর ভাই ভাই। মহিলাদের ভোটদানের অধিকার প্রদান করা হলো এবং যুবকদের সে সকল নির্দোষ আনন্দ উপভোগ করার অধিকার দেয়া হলো যা বুড়োরা নৈতিকতার নামে সব সময় লুণ্ঠন করতে তৎপর ছিল। যুদ্ধজয়ের শেষে বিজেতারা সাময়িকভাবে সাধারণ্যে যে সুযোগ সুবিধাদান করেছিল তাদেরকে যুদ্ধে পাঠিয়ে জয়লাভ করার জন্যে, তা থেকে বঞ্চিত করার মানসে আবার সক্রিয় সংকল্প গ্রহণ করতে শুরু করে দিলো। ১৯২১ এবং ১৯২৬ সনের কয়লাখনির ধর্মঘটের মাধ্যমে মজুরদের সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা হলো। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বলে আবার হিন্দুদের তাদের পূর্বের স্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করা হলো। মেয়েদের ভোটাধিকার যদিও হরণ করা হয়নি, তবুও বিয়ের পরে তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, যদিও পার্লিয়ামেন্টে তা করা হবে না বলে একটা আইন পাশ করা হয়েছিল। খোলাসা করে বলতে গেলে এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়ের আওতাভূক্ত। ইংল্যাণ্ডে শ্রেণী সমূহের স্বার্থরক্ষার জন্যে যেমন সুশৃঙ্খল ভোটদাতাদের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তেমনি ভারতে রয়েছে ইংরেজ শ্রেণীসমূহের স্বার্থের পরিপন্থী অনুরূপ সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোন সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান একজন নারী এবং একজন পুরুষ কারো কোন ক্ষতি না করে সুখী জীবনযাপন করার স্বাধীনতায় বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের বিচার করেনি বলে পিউরিটানেরা এ পর্যন্ত তেমন কোন প্রবল প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হয়নি এবং তাদের অত্যাচারের ক্রমবিকাশমান একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন বলে বিবেচিত হয়নি।

এক গোঁড়া অথবা পিউরিটানকে এভাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তার ধারণা কিছু কাজ, যদিও কর্তা ছাড়া অন্যকারো উপর তা দৃশ্যমান কোন খারাপ প্রভাব বিস্ত রি করতে পারে না, তবুও সেগুলো অন্তর্নিহিতভাবে পাপময় সুতরাং যে কোন সক্রিয় উপায়ে ফৌজদারি আইনের বলে অথবা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে জনমতের সাহায্যে তা দমন করা কর্তব্য বলে মনে করে। কিন্তু মুলতঃ এ হচ্ছে উপযোগবাদী বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কশীল, তাহলে কোন সম্প্রদায় বিশেষ বিশেষ অপরাধকে সহ্য করে নিলে সম্প্রদায়ের দেবতাদের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়, সুতরাং সে জন্যে সে কাজগুলো সামাজিকভাবে অনিষ্টকর সোডম (Sodom) এবং গোমোরাহর কাহিনীর মধ্যে এ দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে। যারা এ সকল কাহিনা সত্যি বলে বিশ্বাস করে তারা উপযোগবাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে যথাযথ ভাবে অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত আইনকে বিচার করতে পারবে-যার ফলে ঐ সকল নগরী ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আজকের দিনে পিউরিটানেরা কদাচিৎ ঐ দৃষ্টিভঙ্গিকে সত্য বলে গ্রহন করে থাকে। এমনকি লণ্ডনের প্রধান যাজকও বলেন না যে টোকিওর ভূমিকম্প এর অধিবাসীদের বিশেষ কোন অপরাধের কারণে হয়েছে। সুতরাং যে আইনগুলো সমাজে চালু আছে এবং যে সব আইনের সম্বন্ধে কথা উঠেছে সেগুলোকে একমাত্র প্রতিহিংসামূলক শাস্তিদানের যুক্তিতে ছাড়া আর কিছুতেই সমর্থন করা যায়না, যে অনুসারে কিছু পাপ একমাত্র কর্তাকে ছাড়া আর কারো কোন ক্ষতি করে না, সেগুলো এত জঘণ্য যে পাপীকে শাস্তি প্রদান করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। উনবিংশ শতাব্দীতে বেনথামের মতবাদের প্রভাবের ফলে এ মনোভাবের অপসৃতি ঘঠে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে উদারনৈতিক মনোভাবের অবক্ষয়ের ফলে পিউরিটান মতবাদ আবার হারানো ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মধ্যযুগের যে কোন নৃশংসতার এত নতুন অত্যাচারের হুমকী দর্শন করেছে।

আমেরিকাতে এ নতুন আন্দোলন পরিপুষ্টি লাভ করেছে। এর প্রধান কারণ মহাযুদ্ধে একমাত্র বিজয়ী শক্তি হলো আমেরিকা। পিউরিটান মতবাদের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সপ্তদশ শতাব্দীতে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তারা ইংল্যাণ্ডের ক্ষমতা দখল করেছিল, কিন্তু জনসাধারণ তাদের অত্যাচারে এত বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে পুনরায় তাদেরকে ক্ষমতায় আরোহন করার কোন সুযোগ দান করেনি। পিউরিটানেরা ইংল্যাণ্ডের অত্যচার নির্যাতন চালিয়েছে, নিউ ইংল্যাণ্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যকে উপনিবেশে পরিণত করেছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ইংল্যাণ্ডের গৃহযুদ্ধের ফলে হয়েছিল, যেহেতু দক্ষিণাঞ্চলে অধিকাংশ স্টেট পিউরিটানদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের এত আমেরিকাতে পিউরিটান দল পরাজিত হয়নি, বরং চিরতরে জয়লাভ করেছিল। এর ফল দাঁড়াল এই যে শ্রেষ্ঠতম শক্তিকে যারা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পেল তাই ক্রমওয়েলের চরিত্রের লৌহ কঠিন দিকটার উত্তরাধিকারী।

পিউরিটান মতবাদ যে মানুষের কল্যাণ করেছে সেটুকু ঢেকে রেখে শুধু দোষগুলো দেখালে অবিচার করা হবে এবং তা শোভনও নয়। ইংল্যাণ্ডের সপ্তদশ শতাব্দী থেকে আধুনিক যুগের পূর্বপর্যন্ত পিউরিটান মতবাদ রাজকীয় আমলাতন্ত্রে জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সমর্থনে সংগ্রাম করেছে। আমেরিকাতে দাস প্রথা রহিত করার স্বপক্ষে অংশ নিয়েছে এবং আমেরিকাকে সমগ্র বিশ্বের গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে রূপ দিতে পিউরিটান মতবাদ অবিস্মরনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এগুলো হচ্ছে এ মতবাদের লোকহিতৈষী কার্যাবলী, কিন্তু এসব ঘটেছিল অতীতে। বর্তমানে সংখ্যালঘুদের প্রতি শাসনমিশি, উদারতার মতো রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সমস্যা তেমন প্রখর নয়। বর্তমানে যে সমস্যা তা বিচার করতে হলে পিউরিটানদের চাইতে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। নৈতিকতার বন্ধনের চাইতে সহানুভূতির প্রসারতা এবং সহনশীলতাই এজন্য অত্যধিক প্রয়োজনীয়। কিন্তু পিউরিটানদের মধ্যে প্রসারিত সহানুভূতির বেগ খুব বেশি জোরালো নয়।

আমেরিকাতে প্রবেশের বিরুদ্ধে জারীকৃত নিষেধাজ্ঞার ফলে পিউরিটান মতবাদের যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিজয় সূচিত হয়েছে সে সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। যদি কোন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞায় প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে নীতিগতভাবে কাবু করতে না পারে। তাহলে তারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশকারী কোকেনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সমর্থন করবে, যেহেতু তাতেও একই নীতিগত প্রশ্ন বিজরিত।

অন্যান্য ধর্মোম্মত্ততার মতো পিউরিটন মতবাদের বাস্তব প্রতিবন্ধক হলো, সবগুলো দোষকে না দেখিয়ে দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ধর্মোম্মাদেরা বোঝেনা যে প্রকৃত দোষীর উপর নির্দয় চাপ প্রয়োগ করলে ফলাফল যা হবে তা আরো ভয়াবহ। উদাহরণস্বরূপ আমরা অশ্লীলতা প্রচারের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনকে নিতে পারি। কেউ অস্বীকার করেনা যে অশ্লীলতা নিকৃষ্ট ধরণের আনন্দ বিতরণ করে এবং যারা অশ্লীলতার প্রচার করে তারাও নিঃসন্দেহে ক্ষতি করে। কিন্তু আইন যখন তা দমন করতে অগ্রসর হয় তখন অনেক প্রত্যাশিত গুণাবলীকেও দমন করে। কয়েক বছর আগে একজন প্রখ্যাত ওলন্দাজ শিল্পী ডাকযোগে কিছু ছবি ইংরেজ ক্রেতাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পোস্ট অফিসের কর্মচারীরা ছবিগুলো আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে রায় দিলো যে ওগুলো অশ্লীল। (শৈল্পিক উৎকর্ষের প্রশংসা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কাছে থেকে প্রত্যাশা করা যায় না। সুতরাং তারা সেগুলো বিনষ্ট করে ফেলল, ক্রেতা তার ক্ষতিপূরণ পাননি। ডাকযোগে কিছু এলে তা যদি কর্মচারীরা অশ্লীল মনে করে, নষ্ট করে ফেলার অধিকার আইন পোষ্টাফিসকে দিয়েছে এবং তাদের গৃহিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর কোথাও কোন নালিশ করা চলবেনা।

জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পিউরিটানদের বিচারের যা বক্তব্য তাহলে আর একটি দোষের জ্বলন্ত উদাহরণ। এটা স্পষ্ট যে অশ্লীলতাকে আইনের পরিভাষায় প্রকৃতভাবে সংজ্ঞাবদ্ধ করা সম্ভব নয়, তবে বাস্তবে আদালতে যা বিচারকের স্নায়ুতে আঘাত করে তাকেই অশ্লীল বলে গণ্য করা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের সংবাদ শুনে গড়পড়তা বিচারকের যে স্নায়ুতে আঘাত লাগবে তেমন কোন কথা নেই; যদি জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটা ব্যয় বহুল গ্রন্থ রচনা করে প্যাচালো বাক্য এবং লম্বাচওড়া বাগ্বিদির মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তা কি অশিক্ষিত লোকে বুঝতে পারে এত সরল বাক্য বিন্যাসের মারফত প্রকাশ করা হলে বিচারকের স্নায়ুতে আঘাত লাগবে। ফলতঃ বর্তমান ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের সংবাদ দেয়া বেআইনি যদিও শিক্ষিত লোকের কাছে এ সংবাদ দেওয়াটা আইনতঃ অসিদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও খেটে খাওয়া মজুরদের জন্য এ খবরের দরকার অনেক বেশি। সমস্ত বিষয়কে এখন একটি মাত্র প্রশ্নের নিরিখে বিচার করে দেখতে হবে। যদি এর প্রচারপত্র কোন নোংরা মনোভাবসম্পন্ন বালকের হাতে পড়ে, তাহলে তা কি তাকে কোনরকমের আনন্দ দিতে পারবে? যদি তা পারে, যতই সামাজিক প্রয়োজনীয়তা থাকুক না কেননা অবশ্যই বিনষ্ট করতে হবে। জোর করে আরোপিত অজ্ঞতার কি ফলাফল হতে পারে তা বলা যায় না। অভাব, নারীদের পুরনো রোগ, রোগাক্রান্ত শিশু প্রসব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং যুদ্ধ এসবকে পিউরিটান আইন স্রষ্টারা কতক বোকা বালকের কাল্পনিক আনন্দের চাইতে কম দোষাবহ বলে মনে করে।

আইন যত কঠিন মনে হয় প্রয়োগ করলে পরে ঐ কঠিনতা বা কড়াকড়ি থাকে না। লীগ অব ন্যাশনস এর উদ্যোগে ১৯২৩ সনের ১৭ ই সেপ্টেম্বরের দি টাইমস এর মতে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, অশ্লীল প্রকাশনা বন্ধ করবার মানসে লীগ অব ন্যাশন এর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোসহ এক আন্তর্জাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৃটিশ প্রতিনিধি স্পষ্টতঃ ঐ ভালো কাজটির প্রতি ঈর্ষা পোষণ করেছেন।

অন্য একটি ব্যাপার, তাহলো সাদামানুষ এবং দাসদের জন্য আলাদা যানবাহন ব্যবস্থা, প্রণীত আইনের সুদূরপ্রসারী ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে, তার ক্ষতির গুরুত্ব অপরিসীম এবং ফৌজদারি আইনের উপযুক্ত বিষয়। অরো ক্ষতির কারণ হয় তখন যখন অজ্ঞ তরুণীদের মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে অর্থ দাসত্বের বাঁধনে জড়িয়ে ফেলা হয় যাতে তাদের স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং তারা চরমতম দুর্দিনের সম্মুখীন হয়। শ্রমিকদের জন্য এটা হলো একটা অপরিহার্য প্রশ্ন, ফ্যাক্টরি আইন এবং ট্রাক আইনের মতো তাদেরকে এরও সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে দাস এবং সাদা মানুষদের জন্য আলাদা যানবাহনের ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অচল, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সর্ব সাধারণ খোঁড়া যুক্তি প্রয়োগ করার হস্ত ক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য হয়। কয়েক বছর আগে ইংরেজি সংবাদ পত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয়। একজন মানুষ একটি গণিকার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে। কয়েক বছর সুখী জীবন যাপন করার পর উক্ত মাহিলা তার পূর্বে পেশায় ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করে ফেলে। স্বামী যে স্ত্রীকে তার পূর্বের ব্যবসায়ে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছে বা কোন উপায়ে তার কাজকে অনুমোদন করেছে তার কোন সঙ্গত কারণ নেই। কারণ সে হঠাৎ ঝগড়া করে স্ত্রীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়নি। তার এ অপরাধের জন্যে তাকে বেত্রাদণ্ড দান করা হয় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এমন একটা আইনের বলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল যা ছিল তখনকার দিনে প্রচলিত এবং যা এখন পর্যন্ত আইনের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে লিখিত আছে।

আমেরিকাতে এই রকমভাবে যদিও গৃহকত্রী নিয়োগ করা বেআইনী নয় তবু তাকে নিয়ে এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটে ভ্রমণ করা বেআইনী। নিউইয়র্কবাসী তার গৃহকত্রীকে নিয়ে বরুকলিনে যেতে পারে কিন্তু জার্সি শহরে যেতে পারে না। বিভিন্নতার মধ্যে নৈতিকতার এমন কি ইতর বিশেষ পার্থক্য রয়েছে তা স্পষ্টতঃ সরল মানুষের কাছে বোধগম্য নয়।

এ সমস্ত ব্যাপার লীগ অব ন্যাশনসও অধিকতর কঠোর বিচার-ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। কিছুদিন আগে লীগ অব ন্যাশনস-এর কমিশনে কানাডার প্রতিনিধি বলেছেন যে, যে বয়সেরই হোক না কোন স্বামী অথবা বাপ-মা দু’জনের একজন সঙ্গে না থাকলে কোন মহিলাকে স্টিমারে ভ্রমণ করতে দেয়া উচিত নয়। তার এ প্রস্তাব গৃহিত গয়নি, কিন্তু তার ফলে আমরা যে দিকে মোড় ঘুরছি যে দিকে উজ্জ্বল সংকেত দান করা হয়েছে। এটা স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান সে এ ব্যবস্থার ফলে শ্বেতাঙ্গ রমণীদেরকে অর্ধদাসে পরিণত করা হবে। নারীরা যতদিন পর্যন্ত কেউ তাদেরকে নৈতিকতাবহির্ভূত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, তার জন্য ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারবে না। এ সকল সংস্কারের একমাত্র যুক্তিযুক্ত লক্ষ্য হলো পর্দা।

পিউরিটান মতবাদের বিপক্ষে আরো একটি সর্বজনীন যুক্তি রয়েছে। মানবজীবনের ধর্ম হলো-মানুষ জীবন থেকে কিছু অনন্দ আহরণ করতে চায়। সাধারণভাবে বাস্তব প্রয়োজনের জন্য মানুষ প্রবৃত্তি থেকে যে আনন্দ আহরণ করে তা আনন্দের প্রাথমিক স্তর এবং তা মনের থেকে আহরিত আনন্দের চাইতে ভিন্নতর। ঐতিহ্যবাহী নীতিবাগীশেরা প্রথম প্রকারের আনন্দের মূল্যে দ্বিতীয় প্রকারের আনন্দের প্রশংসা করে। বরঞ্চ দ্বিতীয় প্রকারের আনন্দকেও সে বাহ্য জ্ঞান করে, কারণ সে তা আনন্দ বলে স্বীকার করে না। ভাবে তার বিশ্লেষণ বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভরযোগ্য নয় এবং অনেকগুলো ক্ষেত্রে সে নিজে নিজের উপর সন্দেহপরায়ন। তাহলে কি শিল্পের আনন্দ ইন্দ্রিয়গ্রাম থেকে উদ্ভূত? না মন থেকে? যদি সে অধিকতর কঠোর হয় তাহলে একবাক্যে এ্যরিস্টটল অথবা পাদরিদের এত শিল্পকে অবজ্ঞা করে উড়িয়ে দেবে। আর যদি সে কম বেশি ধর্মমত সম্বন্ধে উদার মনোভাব পোষণ করে, আর্টের মধ্যে কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা সে সহ্য করে এবং স্বভাবতঃই শিল্প হিসেবে তা হবে নিকৃষ্ট ধরণের। এটা টলস্টয়ের মতবাদ। বিয়ে হলো আরেকটা জটিল সমস্যা। কড়া নীতিবাগীশেরা মনে করে থাকে যে বিয়েটা হলো বড়ো দুঃখজনক। অধিকতর কম কড়া নীতিবাগীশেরা বিয়ের প্রশংসা করে এ কারণে যে সাধারণতঃ তা নিরানন্দময় হয়ে থাকে এবং তা হয় যখন তারা বিচ্ছেদটা অসম্ভব হিসেবে ভাবতে থাকে।

সে যা হোক তা আমার বুলবার বিষয় নয়। আমার বলবার বিষয় হলো, যেগুলোকে আনন্দ বলে পিউরিটানেরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রচার করে থাকে তার চাইতে তারা যেগুলোকে খারাপ বলে নিন্দা করে থাকে তা কম ক্ষতি করে। নিজেদের আনন্দ উপভোগ করার পরেই অন্যকে আনন্দ উপভোগে বাধাদানের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দ। অধিকতর খোলামেলাভাবে বলতে গেলে তা হলো ক্ষমতা অধিকার করার আনন্দ। মদ খাওয়া এবং অন্যান্য যে দোষগুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি করে তার চেয়ে বর্তমানের পিউরিটানদের ক্ষমতা প্রীতি অনেক বেশি অনিষ্টকর। যারা পিউরিটান মতবাদের আওতাভূক্ত তারা অত্যধিকভাবে ক্ষমতা প্রেমিক হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের ক্ষমতাপ্রীতিকে ঘন্টা করে কল্যানেচ্ছা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া সমাজে অত্যন্ত মৃদু। এ থেকে এটুকু প্রমাণিত হয় যে আমরা আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করার জন্য নয় শুধু খারাপ হওয়ার কারণেই বিজিতের শাস্তি দিয়ে থাকি। এর প্রত্যেকটার ফল স্বরূপ অত্যাচার এবং যুদ্ধের সৃষ্টি হতে পারে। নৈতিকভাবে ঘৃণা করা আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর শক্তির একটি, যার মন্দ প্রভাবে প্রোপাগাণ্ডা যারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাদের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি ঘোরানো হয়।

শিল্পোৎপাদনের সাথে সাথে অপ্রতিরোধ্যভাবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি সাধন ঘটেছে এবং শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। পৃথিবী আরো জনবহুল হয়ে উঠেছে; সে কারণে প্রতিবেশীদের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা ঘনিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছে। সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত যে সকল অস্পষ্ট এবং অপ্রত্যক্ষ সমস্যা বর্তমান তাও যদি পরস্পর পরস্পরকে খুব ভালোভাবে জ্ঞাত না করাই তাহলে জীবন অসহ্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের অবশ্যই অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে শ্রদ্ধা পোষণ করতে জানতে হবে এবং একজনের নৈতিক বোধ অন্যের উপরে চাপানো মোটেই সমীচীন হবেনা। পিউরিটানেরা কল্পনা করে যে, তাদের নৈতিক মানদণ্ডই আসল মানদণ্ড। তারা অনুভব করে যে অন্যযুগে, দেশে এমনকি তাদের নিজের দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে যা তারা পিউরিটানদের মতো খাঁটি এবং আসল মনে করে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পিউরিটানদের আত্নবিরুদ্ধনীতির মধ্যে যে স্বাভাবিক ক্ষমতা প্রীতি রয়েছে তা তাদের অন্যান্যদের পক্ষে তাদেরকে বাধা দান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চলুন আমরা উদার শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানুষের বিস্তৃত জ্ঞান কামনা করি যা আমাদের অতি ধার্মিক শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রমকে দুর্বল করতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *