০৭. আচরণবাদ এবং মূল্যবোধ

আচরণবাদ এবং মূল্যবোধ

একখানি আমেরিকান উন্নত ধরনের সাময়িকীতে আমি একদিন এ বক্তব্য দেখতে পেলাম যে পৃথিবীতে একজন মাত্র আচরণবাদী আছেন, তার নাম হলো ড. ওয়াটসন। কিন্তু পৃথিবীতে আধুনিকমনা মানুষের সংখ্যা বেশি বলে আমার মতে তাদের সংখ্যাও বেশি। তার অর্থ আমি এ বলছি না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যত্রতত্র আচরণবাদীদের দেখা মেলে। তা সত্ত্বেও আমি ছিলাম আচরণবাদী, কিন্তু রাশিয়া এবং চীন না দেখা পর্যন্ত, আমি যে আধুনিক নই সে কথা আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি। নিরপেক্ষ আত্মসমালোচনা আমাকে এ সত্য বিশ্বাস করতে বাধ্য করল যে, যদি আমি তা হই তাহলে মঙ্গলজনক হবে। এ প্রবন্ধে আমার মতো মানুষেরা অনুভব করে এমন কতক অসুবিধা সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই। বিজ্ঞানে আধুনিকতা কী তা গ্রহণ করতে গিয়ে মধ্যযুগীয় ধারণা থেকে আলাদা করার বেলায় জীবনধারণের ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। মূল্যবোধের উপর আচরণবাদের কি যুক্তিগত প্রভাব পড়েছে আমি শুধু সে সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে চাইনে; কিন্তু সাধারণ মানব-মানবীর উপর এর যা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যদি তাও ব্যাপকভাবে অশোধিত উপায়ে গৃহিত হয়, আমি সে সম্বন্ধেও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। আচরণবাদ মনঃসমীক্ষার এত উম্মত্ত হয়ে এখনো ওঠেনি, তা যদি কখনো তেমন হয়ে ওঠে তাহলে ড. ওয়াটসনের শিক্ষার সঙ্গে তার আসমান জমিন তফাৎ হবে। যেমন প্রচলিত ফ্রয়েডবাদ বহুলাংশে ফ্রয়েডের চেয়ে ভিন্নতর।

আচরণবাদের মোদ্দাকথা হলো আমার মতে, অতীতে মন বলে একটা জিনিস ছিল যা অনুভব, জানা এবং ইচ্ছা এই তিনরকম ক্রিয়া করতে সক্ষম ছিল। মন বলে যে কিছু নেই বর্তমানে তা উদঘাটিত হয়েছে, শরীরটাই সব। শারীরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমাদের সকল রকম কর্মপ্রক্রিয়া নিহিত। অনুভূতি হচ্ছে অন্তর যন্ত্র সম্পর্কিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে গ্রন্থির সঙ্গে সংযোগশীল যে সকল প্রতিক্রিয়া। জানা হচ্ছে গলঃনালীর সঙ্গে সম্পর্কশীল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের শরীরের ডোরাকাটা পেশীর আর সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সম্প্রতি একজন বিখ্যাত নর্তকী যখন একজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীকে বিয়ে করলেন, তাদের মধ্যে সমতার অভাব দেখতে পেলেন কেউ কেউ। কিন্তু আচরণবাদে এ ধরণের সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নৃত্যপটিয়সী ভদ্রমহিলা হাত এবং পায়ের চর্চা করেছেন এবং ভদ্রলোক গলঃনালীর পেশীসমূহের চর্চা করেছেন, সুতরাং আলাদা পেশার আলাদা পদ্ধতি হলেও তারা দুজনেই পেশীসঞ্চালনকারী। আমরা একমাত্র শরীরসঞ্চালন করতে পারি বলে সাধারণের পক্ষে স্থির ধারণা পোষণ করা খুবই স্বাভাবিক, যে আমরা শরীরকে যদৃচ্ছা সঞ্চালন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতত্ত্ব অথবা রিলেটিভিটি সম্বন্ধীয় অসুবিধার সৃষ্টি হবে। প্রশ্ন হলো, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কি পরস্পর আপেক্ষিকভাবে কাজ করা উচিত? না শরীর সামগ্রিকভাবে শরীরযন্ত্রের নিয়মানুসারে কাজ করে অথবা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কশীল যে গতি তাই কি এ গুণের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। প্রথম মতামত অনুসারে অঙ্গ সঞ্চালনকারী দড়িবাজিকর হবে আদর্শ মানুষ; দ্বিতীয় মতানুসারে আদর্শ মানুষ হবে ক্রমশ নিম্নে অবতরণকারী মই বেয়ে উঠে যাওয়া মানুষ; তৃতীয় মতানুসারে যে মানুষ সারাজীবন উড়োজাহাজে কাটিয়ে দেয় সে আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলশ্রুতিস্বরূপ যে বিতর্কের সৃষ্টি হবে কোন নীতি অবলম্বন করলে পরে তার নিষ্পত্তি হবে তা বলা খুব সহজ হবে না। সে যাহোক শেষমেষ আমি শূন্যচারীদের কথা বলছি।

সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রদায়কে যে উৎকর্ষ সাধিত ধারণাসমূহ পরিচালিত করে সে সব বিবেচনা করলে আমরা এ উপসংহারে আসতে বাধ্য হব যে আচরণবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র থিয়োরিগত যৌক্তিকতাই প্রদান করে। যারা শরীরচর্চায় বিশ্বাসী এবং যাদের মতে খেলোয়ারদের উপর জাতির পৌরুষ নির্ভরশীল, অঙ্গ সঞ্চালনকারী দড়িবাজিকররা তাদের নিকট আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। বৃটিশ শাসকশ্রেণীর অনুসৃত মতবাদ হলো তাই। নিম্নে অবতরণকারী মইয়ে চড়ে উপরে উঠে যাওয়া মানুষ পেশীবান খ্রিষ্টানদের আদর্শ মানুষ বলে স্বীকৃতি অর্জন করবে। তারা মনে করে পেশীর উৎকর্ষ সাধন করা চূড়ান্ত মঙ্গলজনক কিন্তু তার সঙ্গে আনন্দের কোন সংযোগ থাকতে পারবে না। এই মতবাদ ওয়াই. এম. সি. এ চীন দেশে প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছে এবং শাসকেরা শাসিত সকল জাতি এবং শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শূন্যচারীরা, যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য সংরক্ষিত অভিজাত আদর্শ। কিন্তু এসবের উর্ধ্বে একটি সর্বোচ্চ ধারণা রয়েছে যা এরিস্টটলের আনমুভড মুভার (Unmoved mover) বা অচলা চালকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে হলো কেন্দ্রের শাসনকর্তা আর সকলে তার চতুর্দিকে বিভিন্ন গতিতে পরিভ্রমণ করে তার জন্য সর্বোচ্চ গতিসঞ্চয় করবে। এই ভূমিকা আমাদের অতিমানুষ, বিশেষ করে পুঁজিপতিদের জন্য সুনির্দিষ্ট। আমাদের কল্পনার উপর যন্ত্রের ক্রমশ জবরদখলের ফলে মানবোকর্ষের যে ধারণা গ্রিকযুগ এবং মধ্যযুগ থেকে আমরা পেয়েছি, তার চাইতে আলাদা একটি দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিগতভাবে আচরণবাদের সঙ্গে খাপ খেতে পারে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিতে গড়পড়তা নাগরিকের ক্ষেত্রে তা অচল। সে প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অনুভূতি এবং জানাকে কর্মের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। শিল্পকলা এবং ধ্যান-ধারণাকে বিশাল পরিমাণ পদার্থের পরিবর্তন সাধন করার মতো প্রশংসনীয় জ্ঞান করা হতো। নিষ্কাম ঈশ্বরপ্রেম এবং নির্মল ঈশ্বরভক্তিই তাদের দৃষ্টিতে মানবের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ করা হতো। আদর্শের সবটাই ছিল স্থির অনড়। স্বর্গে সঙ্গীত গাওয়া হয় এবং বীণা বাজানো হয় একথা সত্য, কিন্তু প্রত্যেকদিন একই সঙ্গীত গাওয়া হয় বীণা যন্ত্রের কেননা উন্নতি সহ্য করা হয় না। এরকম কিছুর অস্তিত্ব আধুনিক মানুষের কাছে বিরক্তিকর। মিলটন নরকে যন্ত্রপাতি পাঠাতে পারলেও স্বর্গে তার পক্ষে উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি পাঠানো সম্ভব হয় নি। ধর্ম মতের মার খাওয়ার কারণসমূহের মধ্যে এটি হলো একটি।

প্রত্যেক নৈতিক পদ্ধতি কতকগুলো বিশ্লেষণাতীত বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, একথা ধরে নেয়া যায়। দার্শনিক প্রথমে বস্তুর প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা মিথ্যা থিয়োরি আবিষ্কার করে, তারপরে উপসংহারে, যে সকল কর্ম সে থিয়োরিকে মিথ্যা বলে দেখিয়ে দেয়, সে গুলোকে খারাপ কাজ বলে আখ্যায়িত করে। ঐতিহ্যবাদী খ্রিস্টানদের দিয়ে শুরু করা যাক। তাদের মতে প্রত্যেক জিনিস ঈশ্বরের হুকুম মেনে চলে, সুতরাং ভগবানের হুকুম অমান্য করাটাই হলো গর্হিত কাজ। তারপরে ধরা যাক হেগেলপন্থীদের কথা, তাদের মতে ব্রহ্মাণ্ড হলো বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি পরিপূর্ণ জীবদেহ বিশেষ, সুতরাং তাদের মতে সে সমস্ত হলো মন্দস্বভাব যে গুলো ব্রহ্মাণ্ডের মৃসণগতিকে খাট করে দেখে, কি রূপে এ জাতীয় ব্যবহারের উৎপত্তি হয় যদিও তা তলিয়ে দেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, কেননা এ তাদের থিয়োরির জন্যে ব্রহ্মাণ্ডের নিরংকুশ সঙ্গতি বিজ্ঞানের প্রয়োজন। ফরাসি জনগণের জন্য লিখবার সময় বের্গসঁকে যারা সমর্থন করেন নি তাদের তিনি ভয় দেখিয়েছেন যা নৈতিকভাবে ঘৃণা করার চাইতেও মারাত্মক। আমি তার হাস্যাস্পদ করার ভয়ের কথাই বলছি। তিনি দেখিয়েছেন যে মানুষ কখনো যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করে না এবং হাসি (Laughter) বইতে তিনি বলেছেন কোন মানুষকে যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করতে দেখলেই আমাদের হাস্যোদ্রেক হয়। সুতরাং বের্গসঁর দর্শনকে যখন আপনি ভ্রান্ত বলবেন তখনই আপনি হাস্যাস্পদ ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। দর্শনের কোন নৈতিক ফলশ্রুতি যে মিথ্যার উপর ভর করা ছাড়া থাকতে পারে না, এই উদাহরণগুলো তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেবে বলে আমি আশা করি, বরঞ্চ সত্যিকারের নৈতিক ভিত্তি বলে কোন কিছু থাকলে যে কাজগুলো তা পাপ বলে সংজ্ঞায়িত করে কখনো সে সব করা সম্ভব হতো না।

আচরণবাদের ক্ষেত্রে এসকল মন্তব্য প্রয়োগ করে, আমি এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে, এর যদি কোন নৈতিক ফলাফল থেকে থাকে তা ভ্রান্ত। পক্ষান্তরে সত্যিকারের কে” নৈতিক ভিত্তি থাকলে আচরণের উপর এর কোনও প্রভাব নেই। প্রচলিত আচরণবাদের ক্ষেত্রে (যদিও কড়াকড়ি বৈজ্ঞানিকভাবে নয়) এগুলো প্রয়োগ করে আমি ভ্রান্তির কয়েকটা প্রমাণ পেয়েছি। প্রথমতঃ কোন নৈতিক ফলাফল নেই একথা মানুষ জানতে পেলে সবরকমের বিশ্বাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এক্ষেত্রে আলাদা করার প্রয়োজন আছে। সত্য মতবাদের নৈতিক ফলাফল না থাকলেও বাস্তব ফলাফল রয়েছে। যদি কোন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যেটাতে দুটো মুদ্রা দিয়ে জিনিস নেয়া যায় এত করে তৈরি করা হয়েছে, একটাকে দিয়ে নিতে চাইবার চেষ্টা করে যখন বিফল হবেন, সেখানে সত্যের বাস্তব ফলাফল মানে আপনাকে আর একটা মুদ্রা দিতেই হবে। কেউ একে নৈতিক বলবে না, কিভাবে আপনার ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করতে হবে তার সঙ্গেই এর সম্বন্ধ। একইভাবে ড. ওয়াটসনের বইয়ে এমন সব বিষয় বিকশিত করা হয়েছে, যেগুলো বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আপনি যদি একটি শিশুর ব্যবহার বিশেষভাবে চালিত করতে চান, তাহলে ফ্রয়েডের চেয়ে ড. ওয়াটসনের উপদেশ অনুসরণ করা আপনার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তা নৈতিক নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাপার, যখন কতেক কাজকে তাদের ফলাফলের চাইতে স্বাধীনভাবে করা উচিত বলে আপনি মনে করেন, তখনই আসে নৈতিকতা।

আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে আচরণবাদ যতই অযৌক্তিক হোকনা কেননা প্রকৃত অর্থে একটা নীতিশাস্ত্রের অনুমোদন করে। এর যুক্তি হতে পারে, আমরা শুধুমাত্র পদার্থকে গতিশীল করতে পারি, সুতরাং আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সে পরিমাণ পদার্থ গতিশীল করা উচিত এবং শিল্পকলা ও চিন্তাভাবনা যে পর্যন্ত বস্তুর গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, সে পরিমাণ মূল্যবান। সে যাহোক, এ হলো দৈনন্দিন জীবনধারণের একটি অতি দার্শনিক বৈশিষ্ট্য। এর বাস্তব বৈশিষ্ট্য হলো উপার্জন। ড. ওয়াটসনের থেকে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি নেয়া যাক।

“চরিত্র এবং ক্ষমতা ব্যক্তির বার্ষিক সাফল্যের নিরিখে পরীক্ষা করাই হলো আমার মতে ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহের মধ্যে একটি। আমরা তা নিরপেক্ষভাবে সময়ের দীর্ঘতা অনুসারে যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার আয়ের বৃদ্ধি সাধন করেছে বার্ষিক হিসাব যে অনুসারে করতে পারি। যদি ব্যক্তিটি একজন লেখক হয় তাহলে বছর বছর গল্প লেখার সে টাকা পেয়েছে একটি বক্ররেখা এঁকে তা দেখাতে পারি। আমাদের প্রধান সাময়িকী থেকে তিরিশ বছর বয়সে গড়পড়তা যা পাচ্ছে, চল্লিশ বছর বয়সেও সে একই টাকা পেয়েছিল তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে সে একজন বাজে লেখক, এছাড়া আর কিছু সে করতে পারবে না!”

বুদ্ধ, খ্রিস্ট, মুহম্মদ, মিলটন এবং ব্লেক সম্পর্কে একই বৈশিষ্ট্য আরোপ করলে আমাদের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ নির্ধারণের বেলায় একটি আকর্ষণীয় পুনঃসামঞ্জস্য বিধানের দেখা পেয়ে থাকি। উল্লিখিত অনুচ্ছেদে ব্যক্ত বিষয় ছাড়া আরো দু’টো মতামত সংগোপনে বিরাজমান। তার একটা হলো উৎকর্ষকে সহজে অনুধাবনশীল হতে হবে, অন্যটা আইনত তাতে একটা পারস্পর্য বজায় থাকতে হবে। এ দুটো হলো পদার্থবিজ্ঞানের থেকে উপসংহার হিসেবে নীতিশাস্ত্রে অবতরন করার পদ্ধতি। কিন্তু আমার মতে, উল্লেখিত অনুচ্ছেদে ড. ওয়াটসন যে নীতিশাস্ত্রের বর্ণনা করেছেন তা আমার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। গুণ যে আয়ের অনুপাতে নির্ধারিত হয় একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে। অথবা দলের সঙ্গে না মিশতে পারার অসুবিধাকেও আমি দোষ মনে করিনে। এসব বিষয়ে আমার মত যে একপেশে তাতে সন্দেহ নেই, কেননা আমি হলাম গিয়ে দরিদ্র এবং যান্ত্রিক। তারপরেও এ সত্য আমি স্বীকার করি যে, সেগুলো আমারই মতামত, নির্দ্বিধায় তা আমি বলতে পারি। এখন আমি আচরণবাদের আরেকটি দিক-নাম করে বলতে গেলে এর শিক্ষাগত দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করব। এখানে আমি ড. ওয়াটসনের উদ্ধৃতি দেবো না, কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে তার মতামতসমূহকে আমার খুবই সুন্দর মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি তার বইতে শিক্ষার পরবর্তী স্তর সম্পর্কে কিছুই বলেননি এবং সেখানেই আমার ঘোরতর সন্দেহ। আমি একটা বই নিচ্ছি যা সম্পূর্ণভাবে আচরণবাদী না হলেও আচরণবাদ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গীর অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। বইটির নাম ‘শিশু, তার প্রকৃতি এবং প্রয়োজন।’ (The child, his nature and his needs) বইটির প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। কেননা মনস্তত্ব বইটিতে খুবই প্রশংসনীয়ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে; কিন্তু নীতিশাস্ত্র এবং সৌন্দর্যের তত্ত্বে সমালোচনার প্রচুর অবকাশ রয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। তত্ত্বের অপর্যাপ্ততা দেখাবার জন্য আমি নীচের অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি দিচ্ছি। (পৃঃ সংখ্যা ৩৮৪)

“পঁচিশ বছর আগে ছাত্রেরা দশ থেকে পনের হাজার শব্দ বানান করতে শিখতো। পরের দু’দশকে অনুসন্ধান করে দেখা গেলো যে উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য কোন গ্রাজুয়েটের দরকার হয় না, এমনকি ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও দরকার পড়ে না, যদি না তার বিশেষ ধরনের কারিগরী কথাবার্তা রপ্ত করতে হয়। সাধারণ আমেরিকানরা চিঠি-পত্র লেখা এবং সংবাদপত্রের জন্য লিখবার সময় পনেরশ’র বেশি শব্দ ব্যবহার করে না। এসকল বিষয় বিবেচনা করে, দৈনন্দিন জীবনে যে-সকল শব্দের প্রয়োজন তার উপর ভিত্তি করে উচ্চারণ শিক্ষার কোর্স নির্ধারণ করা হয়েছে এবং অতি প্রয়োজনীয় শব্দসমূহ স্বাভাবিকভাবে উচ্চারণ করার এত দক্ষ করে তোলা হবে। প্রচলিত কারিগরী শব্দসমূহ আগে শিক্ষা দেয়া হতো এবং যেগুলোর ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা নেই থিয়োরিগতভাবে যা অন্ততঃ স্মৃতিশক্তির পরীক্ষায় মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে।”

শেষ বাক্যে প্রথম বাক্যের মুখস্ত করার যুক্তির বিপক্ষে একটি সুষ্ঠু মনস্তত্ত্ব সম্মত আবেদন লক্ষ্য করেছি। তার থেকে মনে হয় যে বাস্তবকে জানা ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে মুখস্ত করা উচিত নয়। তা মেনে নিয়ে আমরা অনুচ্ছেদটির অন্যন্য বক্তব্যসমূহের দিকে নজর দিচ্ছি।

প্রথমতঃ কোন কিছু উচ্চারণ করতে পারা সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। অনেকে শেক্সপিয়র এবং মিলটন উচ্চারণ করতে পারতেন না। আবার মেরি করেলি এবং আলফ্রেড অস্টেন উচ্চারণ করতে পারতেন। অশিক্ষিত আর শিক্ষিতের মধ্যে সহজে ভেদ রেখা টানা যায় মতো আংশিকভাবে হামবড়ামী, আংশিক নিখুঁত পোশাক পরে দলে বৈশিষ্ট্য অর্জন এবং অংশত প্রাকৃতিক আইনের অনুরাগীরা ব্যক্তির স্বাধীনতার আওতার মধ্যে অন্ততঃপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারণ করার জন্য হয়, তাহলে সব সময়ে পাঠকদেরকে উদ্দেশ্যের প্রতি সজাগ রাখা সম্ভবপর।

দ্বিতীয়তঃ চীনা ছাড়া অন্য সকল লিখিত ভাষা কথা বলার ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে, যার মধ্যে ভাষার যাবতীয় সৌন্দর্য-তত্ত্ব নিহিত, যে যুগে মানুষ অনুভব করল যে ভাষাকে সুন্দর করা যায় এবং ভাষা সুন্দর হওয়া উচিত; তখন থেকেই তারা উচ্চারণ করতে সাবধানী এবং লিখতে অসাবধানী হয়ে উঠলো। আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরাও সাধারণ শব্দ ছাড়া অন্যান্য শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। সে জন্য তারা অনেক কবিতার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পেশাগত ছাত্র ছাড়া আজকের আমেরিকায় চল্লিশ বছরের নিচে এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে শব্দ ক’টির অর্থ বের করতে পারে।

Scattering unbeholden
Its aerial hue.
ছড়িয়ে আছে না দেখা তার
বায়বীয় রঙ

শিক্ষার মধ্যে যদি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধীয় কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে শিশুদের উচ্চারণ শেখানোর চাইতে উচ্চস্বরে আবৃত্তি শিক্ষা করতে দেয়া উচিত। আগে উচ্চস্বরে বাইবেল আবৃত্তি করা হতো যা সে উদ্দেশ্য সাধন করত, বর্তমানে তার প্রচলন একেবারে নেই বললেই চলে।

উচ্চারণ করতে জানাই শুধু প্রয়োজন নয়। সৌন্দর্যতত্বের জন্য অপর্যাপ্ত শব্দসম্ভার থাকাও উচিত। যারা পনেরশ শব্দ শুধু ব্যবহার করতে জানে তারা কখনো নিজেদের সংক্ষিপ্ত অথবা সুন্দরভাবে সহজ সরল বিষয় ছাড়া প্রকাশ করতে পারবে

এবং তাও অনেক সময় কপাল গুণে। আজকের আমেরিকার অর্ধেক জনসাধারণ শেক্সপিয়র যত সময় স্কুলে কাটিয়েছেন, তত সময় ব্যয় করেন, কিন্তু তাদের শব্দসম্ভার শেক্সপিয়রের দশভাগের একভাগও নয়। তা সত্বেও তাকে সেম যুগের সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছিল, কেননা তা তার নাটকসমূহের বাণিজ্যিক সফলতা লাভের প্রয়োজন ছিল। আধুনিক মতামত হলো যে মানুষ নিজেকে ভাষার মধ্যে অপরকে বোঝাতে পারার এত প্রকাশ করতে পারে, ভাষার ওপর তার যথেষ্ট অধিকার আছে বলে স্বীকার করা হয়। পুরনো মতামত ছিল, কথা এবং লেখায় সৌন্দর্য এবং আনন্দ দেয়া তার উচিত।

আধুনিক লেখকের মতো যে বাস্তব বিষয় বর্ণনার ব্যাপারে ছাড়া অন্যান্য বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে অনুমিত নৈতিকতা এবং সৌন্দর্য তত্ত্বকে বর্জন করে আচরণকে গ্রহণ করেছে তার সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়? ড. ওয়াটসনের প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে এবং তার বইগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমার বিবেচনায় পদার্থবিজ্ঞান হলো থিয়োরিটিক্যাল বিদ্যার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং শিল্পায়ন ব্যবস্থা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক লক্ষণ। তাই বলে আমি অকেজো জ্ঞান এবং শিল্পকলা, যেগুলো শুধুই আনন্দ বিতরণ করে, তার প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকতে পারিনে। সমস্যাটা যুক্তিভিত্তিক নয়, যেহেতু আমরা দেখেছি। আচরণবাদ সত্য হলে অপ্রধানভাবে কোন একটা নির্দিষ্ট কাজের সমাপ্তির কারণে কী পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত তা দেখিয়ে দেয়া ছাড়া মূল্যবোধের প্রশ্নে আচরণবাদের কোনও প্রভাব নেই। ব্যাপক অর্থে এটা হলো রাজনৈতিক প্রশ্ন, যেহেতু এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে অধিকাংশ মানুষ ভুল করতে বাধ্য, সে ক্ষেত্রে অসত্য বিষয় থেকে সত্য সিদ্ধান্ত টানা ভালো? এ জাতীয় কোন প্রশ্নের সমাধান সম্ভব নয়। এর ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা দেয়া উচিত, যাতে করে তারা যেন-তেন বক্তব্য থেকে উপসংহার টানতে বিরত থাকে। উদাহরণস্বরূপ যখন বলা হয় যে ফরাসিরা যুক্তিবাদী, তারা তখন সামগ্রিকভাবে একজন মানুষের যুক্তি বহির্ভূত সূক্ষতা যা ভুলবশতঃ আসল বক্তব্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাও হিসেবের মধ্যে গণ্য করে। তাহলো একটি সর্বশ্রেষ্ঠ অনভিপ্রেত গুণ, তা থেকে সার্বিকভাবে ইংরেজি ভাষাভাষী জাতিগুলো অন্যান্যের তুলনায় অধিকতর স্বাধীন ছিল। কিন্তু তার অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে যে তারা যদি এ বিষয়ে স্বাধীন থাকতে চায় তাহলে তাদের পক্ষে অতীতের চাইতে অধিকতর দর্শন এবং ন্যায়শাস্ত্রর প্রয়োজন রয়েছে। আগে ন্যায়শাস্ত্রকে অনুমান করার পদ্ধতি বলে বিবেচিত করা হতো।

কিন্তু এখন ন্যায়শাস্ত্র অনুমান করা থেকে বিরত হওয়ার পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে; যেহেতু এটা দেখা গেছে যে, যে সকল অনুমানের প্রতি আমরা স্বভাবতইঃ অনুরক্ত সেগুলো ধোপে টিকার মতো নয়। সুতরাং উপসংহারে আমি বলতে চাই যে, স্কুলে এমনভাবে ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা দেয়া উচিত, যাতে করে মানুষকে অনুমান না করতে শিক্ষা দেয়া হয়, যদি তারা অনুমান করে, তাহলে তারা ভুল অনুমান করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *