০৬. রাস্তায় বেরিয়ে মনস্থির

রাস্তায় বেরিয়ে আমি মনস্থির করতে পারছিলাম না এখন কোথায় যাব। অনুপদা আমাকে গলিটা পার করে কোথায় গিয়ে ট্রাম চাপব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা ট্রাম স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম। কেন যেন মনে হল সুতারকিন স্ট্রীটে আনন্দবাজার অফিসে গেলে অনেক লেখক বন্ধুর সাথে আমার দেখা হবে। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে যাদের সাথে আমি কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম হয়ত এদের অনেকের সাথেই আমার সাক্ষাৎ হবে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে অন্তত চাক্ষুষ দেখতে পাব। এদের সাথেই আমি একদা কবিতা পত্রিকা ও কৃত্তিবাসে লেখা শুরু করেছিলাম। এখন তো ওরাই পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ লেখক। আনন্দবাজারের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠানে এখন এরা কর্মরত। হয়ত সেখানে গেলে এরা আমাকে আমার এই দিশেহারা অবস্থায় কোনো সুপরামর্শ দিয়ে সাহায়্য করতে পারে। তাছাড়া যে কোনো অবস্থায় থাকি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমার কিছু লেখা উচিত। হয়ত আমার রচনা যে কোনো রাজনৈতিক বক্তার বক্তব্যের চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে।

ট্রাম স্টপেজ দাঁড়িয়ে নানা চিন্তায় মনটা ভার হয়ে এল। হামিদা, আমার স্ত্রী এই কালকাতাতেই কিংবা এর আশেপাশে কোথাও কোনো সামরিক ট্রেনিং ক্যাম্পে আছে। আট নম্বর থিয়েটার রোডে গেলেই তার হদিস বের করা অসম্ভব হবে না। অথচ আমার মন সেদিকে যেতে চাইছে না কেন তবে কী আমি হামিদাকে ভালবাসি না? নন্দিনীর প্রতি আমার এই পক্ষপাত কী তবে অপরাধ? অবৈধ শারীরিক আকর্ষণ মাত্র? নাকি সম্পূর্ণ অসহায় ভাবে আমি এই দুটি নারীকেই ভালবেসে ফেলেছি? দুটি নারীর প্রতি এক পুরুষ-আত্মার ভালবাসা কী পাপ? ধর্মীয়ভাবে এর সমর্থন আছে, তা আমি জানি। কিন্ত ধর্মের সমর্থন আমি খুঁজছি কী তবে আমার ব্যক্তিগত লোভকে একটা যুক্তিগ্রাহ্য সামাজিক সমাধান দিতে?

এসব এলোমেলো চিন্তার মধ্যে স্টপেজে ট্রাম এসে দাঁড়ালে আমি তাতে উঠে পড়লাম। আমিও জানি না এ ট্রাম কোথায় যাবে? খালি সীট পেয়ে আমি বসে পড়লাম। পাশের সীটের যাত্রীকে বললাম, আমি সুতারকিন স্ট্রীটে যাব। সামনে কোথায় গিয়ে নামলে আমার সুবিধে হবে?

এ্যাসপ্লানেড।

এ ট্রাম কী এ্যাসপ্লানেড যাবে?

হ্যাঁ। আপনি ঠিক ট্রামেই উঠেছেন। আপনি জয় বাংলার লোক?

হ্যাঁ।

আপনারা কী পাকিস্তানের সাথে পেরে উঠবেন?

সাড়ে সাত কোটি মানুষ ওদের সাথে না থাকতে চাইলে মেরে কেটে কত দিন রাখবে?

এটা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। তবে দেখবেন পাকিস্তানী তাড়িয়ে আবার মাড়োয়ারিদের পাল্লায় পড়বেন না।

লোকটার কথায় এবার আমি তার দিকে ভালো করে দেখলাম। মধ্য বয়ক অভিজ্ঞ বাঙালি ভদ্রলোক। চোখে মোটা কাঁচের চশমা। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গায়ের রং বেশ ফর্সা। আমি বিহ্বলের মতো তাকিয়ে আছি দেখে ফের বললেন, দেখুন না কলকাতা তথা সারা পশ্চিমবঙ্গকে মাড়োয়ারিরা কবজা করে নিয়েছে। কলকাতা প্রকৃতপক্ষে আর বাঙালিদের শহর নেই, বুঝলেন, একটু সাবধান থাকবেন।

ভদ্রলোকের কথা ফুরোবার আগেই ট্রামটা অন্য এক স্টপেজে এসে দাঁড়িয়েছে।

আচ্ছা, নমস্কার আসি। সামনের আরও একটা স্টপেজ পার হলেই চৌরঙ্গী, এ্যাসপ্লানেড।

বলতে বলতে ভদ্রলোক নেমে গেলেন। কন্ডাকটর আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে টিকেট দিল। আমি এ্যাসপ্লানেডে ঢোকার মুখে চৌরঙ্গীতে নেমে একটা ট্যাকসি ধরলাম।

বেলা তিনটার দিকে আমি সুতারকিন স্ট্রীটে আনন্দবাজার অফিসের সামনে এসে নামলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পত্রিকা অফিসের কাউন্টারে কাঁচের এপাশ থেকে দেখলাম বিশাল গোফলা এক রিসেপশনিস্ট অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত হয়ে আগন্তুকদের সাথে কথা বলছে। আমি দর্শনার্থীদের ভিড় থেকে আলাদা হয়ে এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম না আমি কার সাথে দেখা করার কথা রিসেপশনের স্লিপে লিখব। শক্তি না সুনীলের? এখনও আমার দ্বিধা কাটছে না। এরা কী সত্যি এতদিন পরেও আমার নাম মনে রেখেছে? যদি দেখা না করতে চায়?

এসময় রিসেপশনের গোঁফঅলা ভদ্রলোক হাতের ইশারায় আমাকে কাছে যেতে ডাকলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমার নাম সৈয়দ হাদী মীর। সুনীর গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে চাই।

ভদ্রলোক আমার কথা শেষ হওয়ামাত্রই টেলিফোন তুললেন। অপর প্রান্তের সাথে তার কী কথা হল আমি বুঝতে না পারলেও টেলিফোন রেখে দিয়ে বলরেন, যান।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে রিসেপশন হয়ে ভেতরে লিফটে এসে দাঁড়ালাম। লিফট চালককে সুনীল বাবুর কথা বলতেই সে বোতামে চাপ দিল। লিফট এসে নির্দিষ্ট তলায় থামলে সে আমাকে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে যেতে বলল। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাঁ দিকে একসারি কামরা পার হয়ে এগোতে লাগলাম। শেষে বাইরে টুলের ওপর বসে থাকা একজন পিয়নের দেখা পেতেই সুনীল বাবুর কামরাটা দেখিয়ে দিতে বললাম। ছেলেটি উঠে এসে আমাকে সুনীলের কামরায় পৌঁছে দিয়ে বলল, ভেতরে যান। বাবু ভেতরে আছেন।

আমি ভেতরে প্রবেশ করেই সুনীল বাবুকে সামনে পেলাম। আমি এর আগে কখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চাক্ষুষ দেখি নি। অথচ কৃত্তিবাস সম্পাদনার সময় তার সাথে কত চিঠিপত্র আদান-প্রদান ও বাংলাদেশের কবিতা সম্বন্ধে মতো বিনিময় হয়েছে। একবার তিনি আমার কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে তার প্রিয় কবিদের তালিকায় তিনি আমার নামও লিখে রেখেছেন। এই তো এখন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সামনে। তার মুদ্রিত ছবি আমি এর আগে কোনো কোনো পত্র পত্রিকায় দেখেছি বলেই এখন তাকে চিনতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। আমাকে দেখেই হাত থেকে কলম রেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আপনি হাদী মীর? কখন, কীভাবে বর্ডার ক্রস করলেন? গতকালই তো আপনার নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে কবি শঙ্খ ঘোষ অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠ করলেন। বসুন। আপনার পরিবার-পরিজন কে কোথায়? তারা সবাই ঠিকমত আছে তো?

আমি বললাম, যতটুকু জানি আমার পরিবার-পরিজনের এখনও তেমন কোনো বিপর্যয় ঘটে নি। ঢাকা থেকে বেরুবার আগেই স্ত্রীর সাথে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। শুনেছি তিনি নিরাপদেই এখানে, এই শহরে এসে পৌঁছেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত আছেন। এখনও তার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে নি। আশা করছি, দুএকদিনের মধ্যেই তার সাথে দেখা হবে। আমি ও আমার এক বোন, ভাগ্নি এবং ভগ্নিপতি গতকাল কলকাতায় এসে পৌঁছেছি। বোনের জামাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বড় কর্মকর্তা, সচিব। এখন উডস্ট্রীটে একটি আর্মেনিয় হোটেলে উঠেছি। আগামীকাল ভারত সরকারের সহায়তায় পাওয়া পার্ক সার্কাসের একটা বাড়িতে গিয়ে স্থায়ীভাবে উঠব।

আমি তো ভাবতেই পারছি না আপনি পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছেন। আমার সামনে সৈয়দ হাদী মীর? এটা সত্যি এক অভাবনীয় ঘটনা। আমাদের ভয় ও আফসোস ছিল আপনারা সবাই হয়ত পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিগোলায় মারা পড়েছেন কিংবা সামরিক ক্যাম্পে আটক।

আনন্দমিশ্রিত বিহ্বল কণ্ঠে সুনীল বললেন। আমি বললাম, আপনার আন্দাজ একেবারে মিথ্যে নয়। তবে প্রথম আঘাতটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকামী ছাত্রছাত্রী ও রাজনীতিকদের ওপর দিয়ে গেছে। সাংবাদিকদের ওপরও। ইত্তেফাক অফিসটিকে আমার চোখের সামনে গোলার আঘাতে জ্বলতে দেখেছি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে ঢাকার একমাত্র পুলিশ অবস্থানকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। আসার সময় পথে-প্রান্তরে কত যে নিরীহ মানুষের লাশ আর জ্বালিয়ে দেয়া গ্রাম দেখে এসেছি তার হিসেব নেই। শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। জানি না আমাদের এই দলে দলে ভারতে পালিয়ে আসার রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিণাম কী হবে। ভারতই বা এই বিপুল উদ্বাস্তুর ভার কীভাবে সইবে? কতদিন সইবে?

এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করবেন না। চলে যখন এসেছেন একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। বললেন সুনীল।

আমি বললাম, আপনি আমাকে তুমি করেও বলতে পারেন। আপনি আমার থেকে পাঁচ ছবছরের বড়ই হবেন।

ঠিক আছে তুমিই বলব। তোমার তো একটা নতুন কবিতার বই বেরুবার কথা ছিল। বেরিয়েছে?

না। কম্পোজ হয়েছিল। প্রুফের ফর্মাগুলো সাথে নিয়ে এসেছি। হোটেলে আছে।

ভালই হল। এখান থেকেই বেরুবে। তুমি পান্ডুলিপি তৈরি করে আমাকে এনে দিয়ে যেও। তোমার কাছে টাকাকড়ি আছে তো?

আমি বললাম, আছে। প্রকৃতপক্ষে আমি বা আমার বোন-ভগ্নিপতির তেমন অসুবিধে নেই।

খুব ভালো কথা। এখন তাহলে তোমার স্ত্রীর খোঁজখবর নিয়ে শান্ত হও। লেখালেখি শুরু করে দাও। অচিরেই আশা করছি তোমাদের দুর্ভোগ কেটে যাবে। হতাশ হবার কিছু নেই। আমরা মানে আমি তোমাকে দেখব।

সুনীলদার কথায় আমার দুচোখ পানি বেরিয়ে এল। ভারতে প্রবেশের পর এই প্রথম একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন সুপরিচিত ব্যক্তির প্রকৃত সহানুভূতির কথা শুনে মনে হল আমি অনাত্মীয় পরিবেশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ি নি। এখানেও লেখক হিসেবে স্বাধীন মর্যাদা থাকবে। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমার কলমকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে পারব।

আমি বললাম, সুনীলদা আপনার কথায় সাহস পাচ্ছি। মনে হচ্ছে লিখতে পারব। এই কয়দিন ঢাকা থেকে বেরিয়ে পথে-প্রান্তরে মানুষের প্রতি মানুষের যে নিষ্ঠুরতা আর পাশবিকতা দেখে এসেছি তাতে মনে হয়েছিল বুঝি কবিতার আর মূল্য থাকবে না। মানুষের সর্বপ্রকার সুকুমার বৃত্তিরই বুঝি অবসান ঘটে গেছে। এখন আপনার সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে, আমার ধারণা বোধ হয় একপেশে।

সুনীলদা হাসলেন, কবিদের প্রকৃত কাজ বন্দুকবাজরা যদি শেষ করতে পারতো তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীরাই সব শেষ করে দিয়েছিল। তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রবীন্দ্রনাথকে আবার পুনরুজ্জীবিত করল। এটাই কী বড় প্রমাণ নয় যে মানুষের সুকৃতি কখনো পরাজয় মানে না?

সুনীল বললেন।

আমি বললাম, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হতে চাই। তিনি তো আনন্দবাজারেই আছেন জানি।

হ্যাঁ। এখানেই। আনন্দবাজারের ছোটদের বিভাগ দেখেন। আগে একটু চা খাও। আমি শক্তিকে খবর দিচ্ছি। এখানে আরো তোমার পরিচিতজনেরা আছেন। সবার সাথেই তোমার সাক্ষাৎ হবে। তাছাড়া ঢাকার একজন লেখক তা বেশকিছু দিন যাবতই কলকাতা প্রবাসী। বেলালকে চেনো? বেলাল চৌধুরী?

আমি বললাম, হাঁ চিনি বৈকি।

তাকেও তোমার আগমন বার্তা জানিয়ে দেব। তোমার খুঁজে বের করতে হবে না। খবর পেরে সেই তোমাকে খুঁজে বের করবে।

বলে তিনি কলিং বেল টিপলেন। একজন পিয়ন ঘরে এসে ঢুকলে বললেন, চা দাও। আর শক্তিবাবুকে বল বাংলাদেশ থেকে আমাদের বন্ধু নাম হাদী মীর এসেছেন। আমার সামনে আছেন।

লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক ঘরে এসে ঢুকলেন, কই, আপনিই হাদী?

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

সুনীল বললেন, এই যে শক্তি। ইনি হাদী মীর।

আমি শক্তি বাবুর বাড়িয়ে দেয়া হাতখানা চেপে ধরলাম, আপনি আমার প্রিয় কবি।

আরে হাদী, তোমার কবিতা আমার যা ভালো লাগে না, ওসব কী মুখে বলে কোনো কবিকে বোঝানো যায়? বল ভাই, কীভাবে এলে? আসতে কোনো কষ্ট পাও নি তো? আমাকে তুমি বলে ডাকো। তোমার বন্ধুত্ব চাই হাদী। তোমার আত্মীয়তা চাই।

শক্তির কথায় আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম। তার সাথে কোলাকুলি করতে গিয়ে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেললাম। যেন বহুদিন প্রবাস যাপনের পর দুই সহোদরের সাক্ষাৎ ঘটেছে। আমাদের পরস্পরের আলিঙ্গন মুহূর্তে কখন যে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন এখানকার পরিচিত কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ বুঝতে পারি নি। আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়েই দেখি গৌরকিশোর ঘোষ ও নীরেন চক্রবর্তী শক্তির সাথে আমার কোলাকুলির দৃশ্যটি উপভোগ করে হাসছেন। সুনীল এদের দুজনের সাথেই আমার পরিচয় করিয়ে দিলে আমি গৌরকিশোরকে বললাম, আপনি সত্যযুগ পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা ছেপেছিলেন। এতদিন পর আপনাকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি লাগছে।

জানি। তোমার আসতে কষ্ট হয় নি তো? বললেন গৌরকিশোর।

কষ্ট-লাঞ্ছনা একটু হয়েছে। তবে আল্লাকে ধন্যবাদ শেষপর্যন্ত এসে এখানে পৌঁছেছি।

তোমার স্ত্রী?

তিনিও এসেছেন অন্যপথে। আমার সাথে এখনও সাক্ষাৎ হয় নি। অচিরেই দেখা পাওয়ার আশা করছি।

কোথায় উঠেছ?

আপাতত একটা হোটেল।

আমার জবাবের সাথে সাথেই সুনীল সকলকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, হাদীর ভগ্নিপতি এ্যাকজাইল বাংলাদেশ সরকারের বড় কর্মকর্তা। আপাতত ওর কোনো অসুবিধে নেই।

সুনীলের কথায় সকলেই আশ্বস্ত হল। সকলেই আমাকে ঘিরে বসে চা পানে যোগ দিলেন। আমি আগরতলার পথে যেভাবে ভারতে প্রবেশ করেছি সব খুলে বললাম। নন্দিনীদের কথাও। সীমাদির করুণ মৃত্যুর কথা শুনে এরা স্তম্ভিত হয়ে থাকল। শুধু নন্দিনীর ওপর অত্যাচারের কাহিনী আমি মুখে ফুটে বলতে পারি নি। কেন যেন মনে হল এতে আমার দুর্দিনের সঙ্গিনীর অপমান হবে। গৌহাটিতে পাওয়া ব্যাগটার কথাও চেপে গেলাম।

আমার দুর্ভোগপূর্ণ পদযাত্রা ও সীমান্ত অতিক্রমের বিবরণ শুনে সকলেই সহানুভূতি জানালেন। সকলেই আবার মনস্থির করে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে পরামর্শ দিলেন। সকলেই আমাকে কোনো না কোনো ভাবে সাহায্য করতে চান দেখে মনটা ভরে গেল। আমি দৃঢ়তা ও সাহসে উজ্জীবিত হয়ে আনন্দবাজার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।

সন্ধ্যায় হোটেলে পৌঁছে সিঁড়ির ওপর মিতুকে পেলাম। আমাকে দেখে মিতু দ্রুত ছুটে এসে আমার হাত ধরল, এই যে মামা। আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন? নন্দিনী ফুপু কই?

তোমার নন্দিনী ফুপু ভবানীপুর তার আত্মীয়দের বাসায় গেছেন। কাল সকালে আসবেন।

বলতে বলতে আমি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে গেলে মিতু আমার হাত টেনে ধরে সিঁড়ির মাঝামাঝি এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল।

দাঁড়ান না মামা। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার জন্য সারপ্রাইজ?

হ্যাঁ।

বেশ এখন তোমার সারপ্রাইজটা বলে আমাকে কাঠ বানিয়ে দাও তো মা।

না! অমনি বুঝি খালি খালি হবে?

আমি বললাম, বারে খালি খালি হবে কেন? তোমার ডিমান্ডটা শুনলে তো ব্যবস্থা করতে পারি।

সত্যি মামা?

সত্যি!

তাহলে আমার ডিমান্ডটা হল আগামী রোববার আমাকে ম্যাটেনি শো সিনেমা দেখাতে হবে। রিকুয়েল ওয়াজের দারুণ একটা এ্যাডভেঞ্চার ছবি চলছে চৌরঙ্গীর একটা হলে। মামা, রাজি?

আমি বললাম, চোখ বন্ধ করে রাজি।

তবে চোখ বন্ধ করে ওপরে ওঠে যান। আমাদের কামরায় গিয়ে চোখ মেলবেন। দেখতে পাবেন জিনসের প্যান্ট আর খাকি রংয়ের পুলওভার পরা এক মুক্তিযোদ্ধা আমার মায়ের সঙ্গে চা পান করছে। নাম মীর হামিদা বানু বেগম। কী মামা সারপ্রাইজ না?

আমার মুখ দিয়ে আর কথা সরতে চায় না। আমি মিতুর সামনে হকচকিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বললাম, সত্যি সারপ্রাইজ মিতু, তোর মামি কখন এসেছেন?

তিনটের দিকে। আব্বার অফিসে এসেছিলেন। সেখান থেকে আব্বা গাড়িতে করে মামানিকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। প্যান্ট আর পুলওভারে মামানিকে যা সুন্দর মানিয়েছে না, ওপরে গিয়ে দেখুন।

মিতুর কথায় সত্যি আমি যেন কাঠ হয়ে গেলাম। যেন তুলতে ভুলে গেছি কিংবা কেউ মন্ত্র বলে সিঁড়ির ওপর আমার পা দুটিকে জুতো সুদ্ধ পেরেক দিয়ে এঁটে দিয়েছে।

আমার অবস্থাটা মিতুকে আবার কৌতূহলী করে এই ভয়ে আমি খুব অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, চল তো মা ওপরে গিয়ে তোমার মুক্তিযোদ্ধা মামিকে কনগ্রেচুলেট করি।

তাড়াতাড়ি চলুন মামা।

বলেই মিতু আমার হাত ধরে টেনে ওপরের দিকে চলতে লাগল। অগত্যা আমি মিতুর সাথে নিঃসাড় মানুষের মতো চলতে লাগলাম।

ইমামদের কামরার দরজায় এসে আমরা একটু দাঁড়ালাম। আমি ঠিক স্বাভাবিক ছিলাম না। প্রকৃতপক্ষে আমার পা দুটিতে এক ধরনের কম্পন অনুভব করছিলাম। এক ধরনের অপরাধবোধই আমাকে কাঁপাচ্ছিল। আমি হামিদার সামনে যাচ্ছি। যাকে আমি একদা আন্তরিক প্রেমের মধ্যেই নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। পারিবারিক বোঝাপড়া নয়, ভালোবেসে বিয়ে। তাছাড়া এমন কোনো কারণও ঘটে নি যাতে হামিদার প্রতি প্রেমে কোনো সন্দেহের ছিটা লাগতে পারে। লাগলেও হামিদা তা জানে না। নন্দিনীর সাথে দৈব যোগাযোগের কথা হামিদা এখনও জানে না। জানলে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা অজানা। হামিদাকে সব কথা খুলে বলার সাহস কী আমার আছে? না, নেই। তবুও হামিদা মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ পরিস্থিতির দুর্দৈব সম্বন্ধে মোটামুটি ওয়াকিবহাল। তাছাড়া আমার স্ত্রীর উচ্চশিক্ষা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। কিন্তু নন্দিনীর সাথে দৈবাৎ সাক্ষাৎ ঘটলেও আমার যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে এর কী ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে? আমি কী নন্দিনীকে বলি নি আমি তাকেও ভালবাসি? আমি কী তবে কোনো সাময়িক প্রলোভনে নন্দিনীকে স্তোকবাক্যে বশীভূত করার জন্যে মিথ্যে বলেছি? নাকি অযৌক্তিকতার ভয়ে আমি স্বীকার করতে চাইছি না আমি দুজনকেই ভালবাসি? একজন পুরুষের দুটি নারীকেই একই সাথে ভালবাসা কী পাপ? এর মধ্যে কী কোনো লাম্পট্য ও লজ্জা আছে? যদি তাই হবে, ইসলাম-আল্লার ধর্ম এ বিধান দিত না। আমার কী উচিত নয় যা সত্য তাই আমার স্ত্রীকে বলা?

একি মামা, দাঁড়ালেন কেন, ভেতরে যান না।

আমি দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে আছি দেখে মিতু অবাক।

আমি বললাম, দাঁড়া না, তোর মামিকে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার আগে তোর মার সাথে তার কী আলাপ হচ্ছে একটু শুনে নিই।

আমার কথায় মিতুও মজা পেল। মুখের ওপর তর্জনী রেখে কপাটে কান পাতল। ফিসফিস করে বলল, ভেতরে খুব হাসাহাসি চলছে মামা। বেল টিপব?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানলে মিতু বেল টিপল। কিছুক্ষণ পরেই ছিটকিনি খুলে পারুল কপাট ধরে দাঁড়াল, এই যে ভাই এসেছেন। আসুন। ভাবি কখন এসে বসে আছে। আপনার খোঁজ নেই। নন্দিনী আপা কোথায়?

সে তো ভবানীপুরে তার আত্মীয়ের বাসায় আজ থাকবে। আগামীকাল সকালে আসবে বলেছে। শুনলাম তোর ভাবি এসেছে?

হ্যাঁ। আসুন ভেতরে।

পারুল কপাট ছেড়ে সরে দাঁড়ালে আমি ভেতরে ঢুকেই হামিদার সামনে পড়ে গেলাম। হামিদা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।

আরে তুমি তো দারুণ পুলওভার পরেছ? কেমন আছ?

ভাল। তুমি কেমন?

ভালই।

শুনলাম পথে নাকি দারুণ দুর্ভোগ পুহিয়েছ। ভৈরবের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছ শুনে খুব দুঃশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে তোমার আগরতলা পৌঁছার সংবাদ পাই। আরও পরে জানতে পারি তুমি আগরতলায় পারুলদের সাথে ভাল আছ। আমি যোগাযোগের খুব চেষ্টা করেছি, বিশ্বাস করো।

বলল হামিদা।

আমি বললাম, এসব কথা এখন থাক। আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও যে তুমি নিরাপদে এখানে পৌঁছেছ। বসো।

হামিদা বসল।

পারুল বলল, ভাইকে এক কাপ চাপ দিই।

আমি বললাম, শুধু চাতে এখন চলবে না পারুল। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি। চায়ের সাথে থাকে তো যৎসামান্য নাস্তাও দরকার।

কি কাণ্ড আপনি দুপুরে কিছুই খান নি?

ভবানীপুর থেকে আনন্দবাজার অফিসে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুদের সাথে দেখা হল। সেখানে অবশ্য চা-নাস্তা খেয়ে খিদে মরে গিয়েছিল। এখন আবার ভুক লেগেছে।

বললাম আমি। পারুল মিতুর দিকে ফিরে বলল, যাতো, নিচে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয় তো এখন হ্যাভি কিছু পাঠাতে পারবে কিনা? স্যাণ্ডউইচ থাকলেও চলবে।

মিতু বলল, আমি দেখছি নিচে গিয়ে। তুমি বরং রুম সার্ভিসে টেলিফোনে একটু বলে দাও।

পারুল রিসিভার তুলল।

আমি এই অবসরে হামিদাকে আড় চোখে একটু দেখে নিলাম। জলপাই রংয়ের ফাঁপানো পুলওভারে তাকে চমৎকার লাগছে। মিতু ঠিকই বলেছিল। এ পোশাকে হামিদাকে যে কোনো পরিচিতের পক্ষেই চেনা মুস্কিল হবে। আমি তাকে দেখছি এটা সম্ভবত হামিদা আন্দাজ করতে পেরে মুখ ফিরিয়ে তার স্বভাবসুলভ সলাজ হাসি আড়াল করার জন্যে একটু কাত হয়ে আছে।

এসময় পারুল রিসিভার রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, পুরো লাঞ্চ না হলেও ভাত, মাটন আর ডাল পাওয়া যাবে। আমি কবি ভাইয়ের ঘরে খাবারটা পাঠিয়ে দিতে বলেছি। ভাই ভাবিকে নিয়ে গিয়ে সেখানে হাতমুখ ধুয়ে চারটা খেয়ে নিন। রাতে খাওয়ার সময় সকলে একসাথে খাব। ইমাম একটু জরুরি কাজে বেরিয়েছে। রাত সাড়ে আটটায় ফিরবে। ভাবি তো আজ থাকছেনই, কী ভাবি?

হামিদা কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নুইয়ে নিঃশব্দে হাসল। পারুল হামিদার এই মিষ্টি লাজুকতায় একটু মজা পেয়ে টিম্পনী কাটতে ছাড়ল না, কি নতুন বৌ-এর মতো এমন ঢং করছ কেন? ট্রেনিং নিয়েও দেখছি বৌ ভাবটা যায় নি?

ট্রেনিং শেষ করলেও মোটিভেশনটা এখনও চলছে কিনা। আগে সেটা শেষ করতে দাও।

ওরে বাপরে, তখন তো তুমি পুরোপুরি ফ্রীডম ফাইটার বনে যাবে। তখন স্বামীর বুকেও রাইফেল তুলতে বাঁধবে না, কী বল?

জোরে হাসল পারুল।

হামিদা ও আমি পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসলাম।

এসময় মিতু ছুটে এসে বলল, মামা আপনার ঘরে দুজনের খাবার পাঠিয়ে দিতে বলেছি।

হামিদা বলল, দুজনের খাবার দিয়ে কী হবে? আমি তো দুপুরে ক্যাম্প থেকে খেয়েই বেরিয়েছিলাম।

ঠিক আছে, আমার সাথে না হয় আরও দু এক লোকমা খাবে।

বলে আমি হামিদাকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই হামিদা বলল, মহিলাটি কে?

কোন মহিলার কথা বলছ? ও নন্দিনীর? আসার সময় পথে পরিচয়। বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে আমার সাথে এসেছে।

আমি যতটা পারি গলাটা হালকা করে জবাব দিলাম।

শুনলাম তোমাদের সাথেই থাকবে?

এখন আর থাকবে কিনা বলা মুস্কিল। এতদিন বিপন্ন অবস্থায় আমাদের সাথেই থাকার কথা বলত। এখন অবশ্যি ভবানীপুরে তার আপনজনদের খোঁজ পেয়েছে। তারা তাকে ফেলে দেবে বলে মনে হয় না। আর যদি ফেলেই দেয় আমি, মানে আমরা অর্থাৎ পারুলরা তাকে ফেলে দিতে পারবে না। আমি নন্দিনীকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছি হামিদা।

কী ব্যাপার তোমার খুব খাতির যত্নের মধ্যেই আছেন বলে মনে হচ্ছে?

হামিদার কথায় তীব্র সন্দেহের বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল।

আমি বললাম, তোমার কথা মিথ্যে নয়। নন্দিনীর ওপর যে ধরনের নির্যাতন গেছে আমি এর নিরুপায় সাক্ষী। আমার উচিত ছিল প্রাণ দিয়ে তার সম্ভ্রম রক্ষা করা। আমি তা পারি নি বলেই একটা কর্তব্যবোধের তাড়না আছে।

সে তাড়নাটা কিন্তু নিজের স্ত্রীর জন্য একবারও বোধ কর নি। এ পর্যন্ত একবারও জিজ্ঞেস কর নি, পঁচিশে মার্চের রাতে একদল পলায়নপর ছাত্রছাত্রীর সাথে আমাকে পালাতে বলার পর আমি কীভাবে এখানে এসেছি? আমার ওপর দিয়েও তো তোমার নন্দিনীর মতই লাঞ্ছনা যেতে পারত। যদি যেত তখন কী করতে? আমাকে নিয়েও কী তখন প্রেমে ডগমগ খেতে, না লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতে?

হামিদার এ ধরনের উত্তেজিত চেহারা আমার কাছে নতুন।

আমি কপাটের ছিটকিনি তুলে দেব কিনা ঠিক করতে পারছিলাম না। শুধু মনে হল হামিদার কথার এখনই জবাব দেয়া অনুচিত হবে। আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম, বিছানায় একটু শান্ত হয়ে বস হামিদা। বেয়ারা এখনই খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকবে। খেয়েদেয়ে আগে তো আমার কথা শোনো। পরে না হয় তোমার যা বলতে ইচ্ছে করবে বলবে। তোমাকে কী পারুল কিছু বলেছে?

পারুলের দোষ দিও না তো। আমি ইমামের কাছেই তোমার বান্ধবীর বর্ণনাটা শুনেছি।

বর্ণনা মানে রূপের কথা শুনেই ভয় পেয়েছ?

আমি হাসলাম।

এ সময় কপাট ঠেলে ট্রে হাতে খাবার নিয়ে বেয়ারা ঢুকল, নমস্তে সাব। খানা।

আমি সামনের নিচু সেন্টার টেবিলটা দেখিয়ে বললাম, ওখানে রেখে দাও।

বেয়ারা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে আমি ছিটকিনি তুলে দিয়ে ফিরে এসে হামিদার হাত ধরলাম, আজ অন্তত ঝগড়া না করে আমার সাথে চারটা খেয়ে বিশ্রাম নাও। ইমামের কাছে শুনেছি পুরোপুরিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়েছ এবং দেশের ভেতরে অপারেশন চালাতে যাচ্ছ। এ অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা আমরা কী সন্দেহহীন থাকতে পারি না?

আমার কথা শুনে হামিদা যেন পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাকে একবার দেখে নিল।

তবে আমাকে বল সন্দেহের কোন কারণ ঘটে নি।

আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে পারব না। বরং বলব সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অনেক কারণ ঘটেছে। তবুও তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমাকে ভালবাসি। নন্দিনী সম্বন্ধে আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলতে চাই। এতে যদি তুমি ধৈর্য রাখতে পার ভালো কথা তা না হলে তোমার সিদ্ধান্ত তোমার কাছে।

আমি সব শুনতেই এসেছি।

বেশ। এখন তাহলে পোশাকটা পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে এস। শাড়ি পরবে?

আলনায় নন্দিনীর নতুন কেনা শাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। হামিদা বলল, শাড়িগুলো কার?

নন্দিনীর। পরবে?

না।

তাহলে পারুলের ঘর থেকে একটা চেয়ে নিয়ে আসি।

তোমার যেতে হবে না। আমিই আনছি।

বলে হামিদা দরজা খুলল।

আমি বললাম, দোহাই তোমার পারুলকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জেরা করো না।

আমাকে অত ছোট লোক ভেব না। অন্তত তোমার বোনের কাছে তোমাকে নোংরা করতে যাব না।

কপাট ভেজিয়ে দিয়ে হামিদা শাড়ি আনতে গেলো। আমি বুঝলাম হামিদা তার সহজাত আকুলতায় এমন কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে যা আমার পক্ষে অস্বীকারের জো নেই। আমি মনে মনে স্থির করলাম হামিদার কাছে কোনো কিছুই গোপন করব না। এতে যে দুর্ভাগ্যই নেমে আসুক এর সামনাসামনি দাঁড়াব।

আমি এগিয়ে গিয়ে ঘরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিলাম। বাতাসের সঙ্গে বিচিত্র ধরনের শব্দ তরঙ্গ এসে ঘরে ঢুকল। বাইরে গাড়ির শব্দের সাথে জমাটবাঁধা জনপদের অস্পষ্ট কলরব যেন এসে কানে শিরশিরানী তুলল। সূর্য নিশ্চয়ই এখন গড়ের মাঠের পশ্চিমপ্রান্তে অনেক দূর পর্যন্ত ঝুঁকে পড়েছে। উডস্ট্রীটের ওপরে ঝাউগাছগুলোর ধূলিধূসর পাতায় জমে থাকা আস্তরণে এখন পর্যন্ত সূর্যের তাম্ৰাভা রক্ত বর্ণের শেষ তাপটুকু বিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি টয়লেটে ঢুকে মুখে পানির ছিটা দিতে বেসিনে উবু হয়ে পড়লাম। কল খুলে চোখে পানির ঝাপটা দিতেই মনে হল, আহ্ কী আরাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ফিরে এলাম। হাত মুখ মুছে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আমার পেছনে হামিদার ছায়া পড়ল। গোলাপি রংয়ের টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে সে রক্ত রংয়ের ব্লাউজ পরেছে। আমি চিরুনি ফেলে দিয়ে ফিরলাম, দারুণ।

কেবল দারুণ? কবি এখন কার্পণ্য কর না। আর একটু বাড়িয়ে বল। ভয় নেই তোমার নন্দিনী শুনতেও পাবে না।

আমি হেসে বললাম, না ঠাট্টা নয় দারুণ লাগছে। তৃতীয় কেউ থাকলে কবিত্ব করেই বলতাম, জাগুন জাগুন, পাড়ায় আগুন।

এবার হামিদাও হাসল, পারুলের কাছে শুনলাম পথে কুড়িয়ে পাওয়া দেবীটিও নাকি সুন্দরী। কখন ফিরবে দর্শন করে মন প্রাণ জুড়াতে চাই।

কাল সকালে আসবে।

জবাব দিলাম আমি। বুঝলাম নন্দিনীকে না দেখা এবং তার সামনে নিজেকে হাজির না করা পর্যন্ত হামিদা মনে শান্তি পাচ্ছে না। আমি বললাম, আগামীকাল নাস্তা সেরে আমরা হোটেল ছেড়ে পার্ক সার্কাসের একটা বাড়িতে গিয়ে উঠব। এর আগেই নন্দিনী দেখা করতে আসবে। তখন না হয় একহাত দেখে নিও।

ভয় করো না হাতাহাতি হবে না। ঐ স্বাদ মেটাবার জন্য ভীষণ প্রতিজ্ঞা আছে আমার। সে কথা জানাতেই তোমার কাছে আসা।

ব্যাপারটা কী রকম?

আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা বাহিনীর সাথে জড়িত। এর মধ্যে আমি শপথ গ্রহণ করেছি যে পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে হানাদার মুক্ত না হবে ততক্ষণ আমি আমার জান প্রাণ ইজ্জত দিয়ে হলেও শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে এই লড়াই চলবে। অস্ত্রে, কৌশলে, সত্যে এবং প্রয়োজনবোধে মিথ্যেয় ক্রমাগত এদের আক্রমণ করে যাব। দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সাংসারিক বন্ধন বা ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফিরে যাব না।

তার কথা গুলি বেশ গুছিয়ে বলল হামিদা। তার কথার মধ্যে এবং মৃদু উচ্চারণ ভঙ্গিতে একটা বাড়তি দৃঢ়তা লক্ষ্য করে আমি বললাম, এ ধরনের শপথ নেওয়ার আগে কারো অনুমতি বা উপদেশ গ্রহণের সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজন হয় না কী বল?

হয় কিনা আমি জানি না। হয়ত হয় না। তবে তোমার অনুমতি ছাড়া আমি একটা সামরিক ইউনিটে নাম লিখিয়ে মানসিক অনুশোচনায় ভুগছি। আমার স্বামী আছে অথচ এদের বলেছি আমি অবিবাহিত। আমাদের ক্যাম্পে সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্রছাত্রী। অনেকেই তোমার নাম জানে। তোমার কবিতার ভক্ত। অথচ আমি বলি নি যে আমি অমুক কবির স্ত্রী। কারণ যুদ্ধের সময় তুমি কোন পক্ষ নেবে তা আমি জানতাম না। আমাদের পরিচিত অনেকেই স্বাধীনতার বিপক্ষে আছে।

তুমি কী তাদের সামনে পেলে আক্রমণ করতে পারবে?

গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেব। ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেব। এই যুদ্ধে আমাদের জিততে হবে কবি।

আমি যদি তোমার শত্রু পক্ষে থাকতাম কী করতে?

তুমি অন্যায়ের পথে থাকতে পার না।

হলফ করে বলা যায় না। তুমি তো এই ভয়েই স্বামীর পরিচয় গোপন করেছ।

দেখো আমাকে মানসিকভাবে আর পীড়ন করো না। তাহলে তোমার সাথে না খেয়ে না থেকেই আমি এক্ষুণি চলে যাব।

বলল হামিদা। উত্তেজনায় তার ঠোঁট জোড়া চড়ুই পাখির মতো কাঁপছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে। চলো খেয়ে নেই পরে কথা হবে। এখন আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমি ক্ষুধার্ত। চল চারটা খেয়ে নিই।

হামিদা কোনো জবাব না দিয়ে খাবার ট্রে টার সামনে গিয়ে বসল। বলল, আমার ক্ষিদে নেই। তবুও তোমার সাথে সামান্য মুখে তুলব। কে জানে হয়ত বা এটাই হবে আমার প্রিয়জনের সাথে শেষ আহার্য। শেষ মিলন।

শেষ মিলন মানে?

আমি এ সপ্তাহেই কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকব। যদিও বলা বারণ তবুও তোমাকে জানিয়ে যাচ্ছি আমরা ঢাকার কাছে ডেমরার একটা গ্রামে আস্তানা গেড়েছি। সেখান থেকে ঢাকায় অপারেশন চালাতে হবে। আমার কাজ হবে সংবাদ আদান-প্রদান ও আক্রমণের ধারা পরীক্ষা করে ইউনিটকে জানানো। খুব রিস্কি।

তোমাকে এরা খুব কঠিন দায়িত্ব দিয়েছে।

কেউ দেয় নি আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। তুমি দোয়া কর যেন সফল হই।

হামিদার কথায় আমি চুপ মেরে থাকলাম। সে খাবারের বাটিগুলা থেকে ঢাকনা সরাতে সরাতে বলল, নাও শুরু কর।

হামিদা খাসির ঝাল গরম সরুয়া থেকে একটা বড় হাড্ডিসহ মাংসের টুকরা আমার পাতে দিল। যেমন অতীতে সব সময় দিয়ে এসেছে। আমি বাষ্প-জমা দৃষ্টিতে তার পরিবেশন দেখতে লাগলাম।

হামিদা মুখ তুলে একবার আমাকে দেখল, মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। পুরুষের কান্না খুব বিশ্রি লাগে, জানো। আজ রাতটা তোমার সাথে থাকব। থাকতেই এসেছি। আর তোমার বান্ধবীর ব্যাপারেও কোনো প্রশ্ন করবো না। কেন করব? আমি স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আমি আর আগের মতো নেই। আমি কোনো প্রতিদ্বন্ধীকেই হিংসা করার মতো অবস্থায় এখন আর নেই হাদী। তুমি কী নন্দিনীর জন্য হৃদয়ে কোনো টান অনুভব করছ? নাকি শুধু কবির কর্তব্যবোধ?

আমি হামিদার এধরনের কথার কী জবাব দেব? একবার শুধু তাকে মুখ তুলে একটু দেখে মাথা নুইয়ে ভাতের লোকমা বাঁধতে লাগলাম।

এখন আবার কথা বলছ না কেন? আমি নন্দিনী সম্বন্ধে সবকথা তোমার বোন ও ভগ্নীপতির কাছে শুনেছি। তারা আমার ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে আমাকে ডেকে এনেছে। আমি কোনো ঝগড়া বা ঘরকন্না করতেও আসি নি। তবে যেটুকু না জানলে নারীর হৃদয় সহজে শান্ত হয় না তা জানার জন্যই এতক্ষণ জ্বালাতন করলাম। নন্দিনী কী সত্যি আমার শূন্যস্থান পূরণ করার যোগ্য?

আমি জানি না। যখন তোমার কোনো খোঁজ পাত্তা জানতাম না তখন সে বলত তোমার ফিরে আসার শর্তে সে আমার সঙ্গে থাকবে। তুমি চলে এলে সে তার পথ দেখবে। এখন সে জানে তুমি এদেশেই আছ এবং মুক্তিযোদ্ধা।

আমি সত্য কথাই আমার স্ত্রীকে বলতে গেলাম। হামিদা ততক্ষণে খাওয়া শুরু করেছে। খেতে খেতে বলল, তাহলে তো তার সাথে সাক্ষাৎ ঘটার আগেই আমার চলে যাওয়া উচিত। আমাদের মুখোমুখি হওয়া কিছুতেই উচিত নয়। ভেবেছিলাম রাতটা তোমার সাথে থাকব।

এর মানে তুমি এখনই চলে যেতে চাও?

আমার মনে হয় এটাই ঠিক হবে।

এবেলা তুমি কোথায় গিয়ে উঠবে?

আমার ক্যাম্পে যাওয়ার গাড়ি আট নম্বর থিয়েটার রোড থেকে দিনরাত আসাযাওয়া করছে। আমার চলে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। যদি তুমি অনুমতি দাও খেয়েই রওনা হব।

একটা রাত অন্তত আমার সাথে থাকতে পার না?

আমি একটু অনুনয় মিশিয়ে বললাম।

বেশ কিছুকাল পরে আমাকে পেয়ে তোমার লোভ জেগে উঠেছে কবি। দেশের কথা, স্বাধীনতার কথা একটু ও ভাবছ না। তুমি না কবি, একটু সেক্রিফাইসও করতে পার না?

হামিদা রহস্যময়ীর মতো হাসল।

আমি বললাম, তোমার এই মুহূর্তের রূপ, এই গোলাপি শাড়ি আর গাঢ় লাল রংয়ের ব্লাউজ, সোনাদানাহীন নিরলংকার শরীরই তো একজন কবির দেশ। সেই দেশের পক্ষে লিখব বলেই তো আমি প্রতিজ্ঞা করে এখানে এসেছি। অন্তত একটা রাত তোমার উষ্ণতা ও আলিঙ্গনের মধ্যে কাটাতে চাওয়া কী স্বামী হিসেবে আমার অপরাধ?

বেশ একটা রাত আমি এখানে থাকব। তবে একটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে।

কী শর্ত?

আমি খুব ভোরে উঠে কাকপক্ষী জাগার আগে হোটেল ছেড়ে চলে যাব। আটকাবে না। বলো রাজি?

আমি বললাম, নন্দিনীকে দেখলে তোমার মায়া হত। হয়ত তখন এমন শত্রু ভাবতে না।

দেখো আমি শুধু তোমার স্ত্রী নই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যোদ্ধা। আমার সামনে হানাদার বাহিনী ছাড়া অন্য কোনো টার্গেট নেই। আমি চাইনা এখন কোনো মানসিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ছবি আমার রক্তে মিশে যাক। যাতে দুই শত্রুর মধ্যে দিশেহারা হয়ে আমার নিশানা পড়ে যায়। জয় বাংলা।

উত্তেজিত হয়ে বলল হামিদা। মুহূর্তের মধ্যে হামিদার লাবণ্যময়ী চেহারা পাল্টে রুক্ষ রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। এমনিতেই হামিদার কণ্ঠদেশ ও গ্রীবা অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে একটু প্রশস্ত। এখন হার বা অন্য অলংকার না থাকায় তাকে আরও প্রশস্ত ও ফর্সা মনে হল। উত্তেজনায় শুধু কণ্ঠের হাড় দুটি থির থির করে কাঁপছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে ভোরে তুমি চলে যাও। চল এখন খেয়ে দেয়ে গড়ের মাঠে গিয়ে সন্ধ্যাটা ঘুরে বেড়িয়ে আসি। জীবনকে যখন নিজেই তুমি এমন অনিশ্চিত করে ফেলেছ তখন একটা সন্ধ্যা অন্তত এই মহানগরীর ফাঁকা মাঠে স্মরণীয় করে রাখি। যাবে?

যাব।

আঙ্গুল চেটে জবাব দিল হামিদা।

আমরা সূর্যাস্তের সাথে সাথে পারুলকে বলে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। আমি ট্যাক্সি ডাকার উদ্যোগ নিতেই হামিদা বলল, গড়ের মাঠতো কাছেই। চল হেঁটেই যাই।

আমি বললাম, খুব কাছে না। তবু চল হেঁটেই যাই। তুমি আবার হাঁপিয়ে পড়বে না তো?

পড়লামই বা, তুমি ধরে তখন পাজা কোলে করে নিয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে শুইয়ে দিও।

আমি বললাম, এর মধ্যে কলকাতার অনেক কিছু চিনে ফেলেছ মনে হচ্ছে?

শুধু চিনে ফেলি নি। একদিন জয় করতে চাই।

জয় করতে?

হ্যাঁ। যদি আমাদের লড়াইটা ব্যর্থ না হয় যদি আমরা জিতি এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হয়ে যাই তবে জেনো বাংলাদেশের মুসলিম কিষাণদের রক্তে ভেজা কৃষি পণ্য, পাট আর জমিদারি খাজনার তৈরি এ শহরও আমরা একদিন জয় করে নেব। এ কলকাতা জব চার্ণকের নয় ভাটি অঞ্চলের নিপীড়িত কিষাণদের উদয়াস্ত ঘামের নুনে তৈরি। এ শহর আমাদের। একদিন আমাদেরই হবে।

হামিদার আশায় উদ্বেলিত এমন কণ্ঠস্বর আমার একেবারেই অচেনা। আমি হেসে তার একটি হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে ফুটপাত ধরে চলতে লাগলাম। আমি কোনো জবাব দিচ্ছি না। উপলদ্ধি করে হামিদা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, তুমি বোধ হয় আমার কথায় হাসছ?

আমি হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিলাম, না। তোমার কথায় ঠিক হাসছি না। তোমাকে ভালোবাসি বলে বিশেষত আজ এই মুহূর্তে তোমাকে খুব ভালো লাগছে বলে হাসছি। আমি প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তির লড়াইয়ের পরিণাম সম্বন্ধে খানিকটা হতাশ। যদিও এই যুদ্ধের হারজিতের ওপর তোমার আমার সকলেরই ভাগ্য জড়িত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, পাকিস্তান আর অখণ্ড থাকছে না। বাংলাদেশ থেকে অচিরেই পাকিস্তানী বাহিনী পরাজয়ের কালিমা নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে।

তবে আর হতাশার কথা বলছ কেন?

পাকিস্তানীরা চলে গেলেই আমরা বিজয়ী হব এমন সম্ভাবনা তো আপাতত দেখছি না। এক প্রবল পরিচিত শত্রুকে পরাজিত করতে আমরা আরেক প্রবল অপরিচিত শক্তির সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতার নিশান উড়িয়ে ঘরে ফিরতে পারব বটে তবে বিজয়ী হব কিনা জানি না।

আমার কথায় হামিদা কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে আমি নিজেই আবার তাকে আশান্বিত করার জন্যে বললাম, তবে সব কথার ওপরে সত্য হল, বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলের কিষাণ পরিবারের যুবকরা দলে দলে এই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সশস্ত্র হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্র করে কেউ মাঝ পথে যুদ্ধটা থামিয়ে না দিলে এই যুদ্ধের পরিণাম আখেরে বাঙালি মুসলমানদের জন্য সুদূরপ্রসারী এবং সুফলদায়কই হবে।

এ যুদ্ধ কোনো ষড়যন্ত্রই মাঝপথে থামিয়ে দিতে পারবে না।

কণ্ঠে কোনোরূপ দৃঢ়তার আভাস না দিয়েই বলল হামিদা। আমি হাসলাম।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গী পার হয়ে এসে মাঠের একটা খোলা জায়গায় বসলাম। জায়গাটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া উন্মুক্ত স্থান হলেও মানুষের গুঞ্জনে মুখর। জোড়ায় জোড়ায় নারীপুরুষ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প-গুজব করছে। ফেরিওয়ালা, চীনে বাদামওয়ালা ঘুরছে আশেপাশে। ওদিকে সারা চৌরঙ্গী এলাকার জন কোলাহল ও গাড়ি এবং বাস-ট্রাকের সম্মিলিত ধাতব শব্দে সারা প্রান্তরের ওপর দিয়ে একটা নাগরিক উত্তেজনার স্রোত বইছে। একটু একটু বাতাসে হামিদার আঁচল স্থানচ্যুত হয়ে কাঁধ থেকে সরে যাচ্ছে। আর হাত দিয়ে সে এখানে সেখানে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করছে। আমি হেসে বললাম, চীনেবাদাম খাবে?

না।

কিছু একটা খাও।

কিছু না।

বলল হামিদা। আমি বললাম, কি ভাবে ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছুলে সে কথা কিন্তু শোনা হল না।

শুনতে চেয়ো না। মানুষের লোভ, হিংসা আর তার পরশ্রীকাতরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলো পার হয়ে এসেছি। হত্যা আর বিশ্বাসঘাতকতা, ধরিয়ে দেওয়া ও নারীর লাঞ্ছনা দেখতে দেখতে এসে পৌঁছেছি। তবে দয়ামায়া, ভালবাসা আর বীরত্বের ঘটনাও কম দেখি নি। এর বেশি আর কী শুনতে চাও? তোমার বৌয়ের বিশ্বস্ততার প্রমাণ চাও নাকি?

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না।

চাইলেও দিতে পারব না।

হেসে বলল হামিদা।

আগে তুমি এভাবে কথা বলতে না।

কীভাবে?

এই এখন যেমন বলছ।

বললাম আমি।

হামিদা মাঠের ঘাসের ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ার ভঙ্গিতে পা দুটি মেলে দিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে হাসল, তখন আমরা একটা পরিবার ছিলাম। আমাদের যেমনই হোক একটা সংসার ছিল। আমরা দুজন দুধরনের জীবিকায় ছিলাম। যতক্ষণ ঘরে ফিরে তোমাকে না দেখতাম কিংবা তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকতাম ততক্ষণ আর কিছুতেই আনন্দ পেতাম না। প্রকৃতপক্ষে আমরা ছিলাম সুখী। আমরা রাজনীতি কাকে বলে জানতাম না। যুদ্ধ, দেশত্যাগ, কোনোকিছুর সাথেই আমাদের কোনো পরিচয় ছিল না। আমাদের পরিশ্রম আমাদের তৃপ্তি আমাদের সুখী করে রেখেছিল। এখন রাজনীতি, যুদ্ধ আর স্বাধীনতার মর্ম আমরা বুঝতে বাধ্য হয়েছি। এ যুদ্ধ জিতলে আমরা দেশে ফিরতে পারব। হেরে গেলে কিংবা মরে গেলে সেই পুরনো সংসারে ফেরার তো প্রশ্নই আসে না। জিতলেও আমরা আর আগের অবস্থায় থাকব না। তোমার আমার একদা যে চাকুরি ছিল সে চাকুরি আর পাবো না। আমাদের শাজাহানপুরের সেই ভাড়া বাড়িটায় আমার বিবাহিত জীবনের সব পুঁজি, সব সংগ্রহ আমরা ফেলে রেখে চলে এসেছি। তুমিও এক কাপড়ে আমিও এক কাপড়ে। এতদিনে আমাদের বাসাটি নিশ্চয়ই লুট হয়ে গেছে। সাবেক জীবন, সাবেক সংসার কিছুই আর আমরা ফিরে পাবো না, কবি। আর তা ছাড়া

বল, তাছাড়া কি?

আমি কথার খেই ধরিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তার কথা আমার কেন জানি না খুব ভাল লাগছিল। আমার মর্মস্পর্শ করে যাচ্ছিল আমার স্ত্রীর কথাগুলো। এ ধরনের বাস্তব সম্মত উপলদ্ধি আমার স্ত্রীর মধ্যে আমি অতীতে কখনও দেখি নি। বলা যায় আমি খুব অধীরতা নিয়ে হামিদার কথাগুলো শুনছিলাম।

তাছাড়া তখন তুমি আমাকে ভালবাসতে।

এখনও বাসি।

মিথ্যে বলে কোনো লাভ নেই কবি। এখন তোমার চোখের সামনে আমি আছি বলে আমাকে কামনা কর। অভ্যেসের টানে আমাকে চাও। আমি তোমার ধর্মপত্নী বলে। আমি না এলে কিংবা পথে কোনো দুর্ঘটনার আমি মারা পড়লে তোমার সত্যিকার কোনো ক্ষতি হত না। এতদিন হয়ও নি। হয় নি যে নন্দিনী তা তোমাকে বুঝতে দেয় নি।

একটি অসহায় মেয়ের প্রতি বিরূপ হয়ে তুমি এসব বলছ।

আমি হামিদার কথার তরঙ্গ এখন প্রতিরোধ না করে পারছিলাম না।

মোটেই না। আমার কথায় এমন ভয় পাচ্ছো কেন? কই আমি তো ভয় পাচ্ছি না? অথচ এই যুদ্ধ, এই দেশ ত্যাগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হল আমার। সবচেয়ে ভালবেসে বিয়ে করে স্বামী সংসার মুহূর্তের মধ্যে হারাতে বসেছি। বসেছি বললে অবশ্যি খানিকটা আশা আছে বোঝায় কিন্তু আমি জানি কবি আমার আর আশা নেই। তোমার ভাগ্য ভালো যে সকল দুর্ভাগ্য ও ভাঙ্গনের মধ্যে তুমি নন্দিনীকে পেয়েছ। ভালবেসেছ। একবারও আমার কথা মনে পড়ে নি। কিংবা পড়লেও তা তোমার অপরাধ বোধেরই প্রতিচ্ছবি ছাড়া অন্য কোনো কিছু নয়। তোমার একজন স্ত্রী আছে এই দ্বিধা। অথচ দ্যাখো, আমি একবারও তোমার মুখ এ কয়দিন মুহূর্তের জন্যও মন থেকে সরাতে পারি নি। অথচ কত মানুষ কতভাবে সাহায্যের ছুঁতোয় এগিয়ে এসেছে। আর কত গায়ে পড়া অসভ্যতা দেখলাম। আসলে অন্য পছন্দ আমি সম্ভবত তোমাকে পেয়ে একদা নষ্ট করে ফেলেছিলাম। এখন, কবি সত্যি আমার আর কোনো উপায় রইল না।

কথাগুলো শেষ করে হামিদা সোজা হয়ে উঠে বসল। আমি দেখলাম তার গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। হামিদা কাঁদছে। এখন কোনোরূপ আশ্বাসের বাক্যকেই সে অপমান ভাববে। হামিদাকে আমি জানি। তাছাড়া হামিদা আমার ও নন্দিনীর সম্পর্ককে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে। তার উপলব্ধিতে কোনো ভুল বা মিথ্যে ছলচাতুরী নেই। বরং মিথ্যে আছে আমার মধ্যে। হামিদার প্রতি আমার এতদিন যে উদ্বেগ ছিল তা কর্তব্যবোধ ও ভয় থেকেই। আমার একজন স্ত্রী আছে অথচ অন্য একজনের প্রতি জেগে উঠেছে প্রেম। এরই বৈধতার প্রশ্ন নানা যুক্তি হয়ে আমাকে প্রবোধ দিচ্ছিল মাত্র। অথচ কত সহজেই না হামিদা এই মিথ্যে প্রবোধের হাত থেকে আমাকে মুক্তি দিতে চাইছে।

হামিদা মাঠের পূর্ব দিকের বিশাল ইমারতগুলোর চূড়োয় প্রজ্বলন্ত আলোকস্তম্ভের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে দেখে আমি বললাম, আমাকে এখন কী করতে বল?

অন্তত আমার সম্বন্ধে অযথা দুঃশ্চিন্তা ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিচ্ছি।

এর মানে হল আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক সম্বন্ধে তুমি কোনো আশাই রাখো না। এ সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে বলে তোমার ধারণা।

ধারণা নয়। এটাই সত্য।

এখন তাহলে তুমি কী করতে চাও।

এবার আমিও তারই মতো প্রশ্ন করলাম। যে ধরনের প্রশ্ন একদা আমার মুখ থেকে হামিদার কাছে অভাবনীয় ছিল। হামিদাও চমকে আমার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি মুক্তিযোদ্ধা। দেশমুক্তি ছাড়া আপাতত আমার কোনো কর্তব্য নেই। তোমার কাছে শুধু একটা অনুগ্রহ চাইব।

বলো।

যুদ্ধের পর আমার একটা খোঁজ নিও। জান তো আমার আপন বলতে কেউ নেই। ঢাকায় ফিরে আমি কী করব, কোথায় যাব কোনো কিছু জানি না। তখন তোমার একটা সাহায্য বা অবলম্বন আমার দরকার হবে। যদি দেশে ফিরে নিজেকে চালাবার মতো কোনো অবলম্বন আমি যোগাড় করতে পারি তখন না হয় তালাকনামা পাঠিয়ে দিও। ততদিন তোমার নন্দিনীকে একটু ধৈর্যধারণ করতে হবে। এর আগে তোমাদের বিয়েতে আমার আপত্তি নেই। শুধু অনুগ্রহ করে তালাকনামাটা পাঠিও না। আমাকে কথা দাও।

ঠিক আছে, কথা দিলাম। তবে আমার ও নন্দিনীর ব্যাপারে তুমি আগাম একটু বেশি ভাবছ। নন্দিনীর সাথে আমার সম্পর্কটা যাই হোক, নন্দিনী হয়তো এ ধরনের চিন্তা করছে না। আদৌ হয়তো নন্দিনী এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা দেখছে না।

আমি একটু সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আমার প্রকৃত সন্দেহের কথা তুললাম। হামিদা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটি মুছে নিয়ে বলল, তাতেও আমার তো কোনো লাভ দেখছি না। তোমরা পরস্পরকে ভালবাস। তোমাদের ভালবাসা আমার ঘর ভেঙে দিয়েছে এতে তো কোনো মিথ্যে নেই। এখন যদি তুমি ও নন্দিনী নতুন সংসার পাড়তে না পার তাতে আমার ভাঙা সংসার কী আর জোড়া লাগবে? অমন জোড়াতালি আমি সব জেনে বুঝে কেন চাইব কবি? তোমার যে দয়াটুকু চাইলাম সেটা আমি নিরুপায় বলে। তুমি তো জান আমাকে আশ্রয় দিতে পারে এমন আপনজন আমার একজনও দেশের বাড়িতে নেই। না বাপ, না ভাই। আমি তখন কোথায় এবং কার কাছে গিয়ে উঠব? আমার অসহায়তার কথা তো তোমার অজানা নেই। মনে করে দেখো, বহু বৎসর আমরা দুজনে প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে বাস করেছি। এর একটা কৃতজ্ঞতাবোধ উভয়ের মধ্যে আছে। আজ না হয় নন্দিনীর কাছে আমি পরাজিত। প্রেম নেই যখন মানি তখন আর কিছু চাইবার নেই আমার। কিন্তু দয়ামায়া তো আছে। সেটা কী চাইতে পারি না?

আমি তো বলেছি তুমি একটু আগাম বেশি দুশ্চিন্তায় আছ। তেমন অসুবিধেয় তুমি পড়বে না।

বললাম আমি।

এধরনের একটা প্রতিশ্রুতিই আমার দরকার ছিল। এখন চল হোটেলে ফিরি। পারুলরা খাওয়ার টেবিলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

আমরা উঠলাম।

.

সকালে মিতুর চেঁচামেচিতে সকলের ঘুম ভাঙলে আমিও চোখ মেললাম। গতরাতে হামিদা আমার পাশে যেখানে শুয়েছিল সেখানে পারুলের কাছ থেকে চেয়ে আনা গত সন্ধ্যার শাড়ি ব্লাউজ ভাজ করে বালিশের ওপর রাখা। দরজাটা ভেতর থেকে খোলা থাকায় মিতু এসে ঘরে ঢুকল।

মামা জাগুন না। গোছগাছ করতে হবে না?

তোর মামি চলে গেছে?

সেই কখন। মামানিই তো আব্বা-আম্মাকে জাগিয়ে বিদায় নিয়ে তারপর ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে গেল।

বলল মিতু। তার মামানির এভাবে চলে যাওয়াটা সম্ভবত তার কাছেও একটু বিসদৃশ ঠেকেছে। আমি বললাম, আমাকে জাগিয়ে দিলে পারতি।

মামিই তো দিল না। বলল তোর মামা একটু ঘুমাক। এখন অত ভোরে জাগাতে হবে না। আমি গত রাতেই তোর মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেখেছি।

আমি কোনো কথা না বলে বিছানায় উঠে বসলাম। মিতু বলল, মামা আপনাকে চা দিতে বলি?

আমার পায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিয়ে খাট থেকে নামতে নামতে বললাম, যা বলে আয়।

মিতু খুশিতে নাচছে। নতুন বাড়িতে যাওয়ার কিশোরীসুলভ আনন্দ। সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে আমি টয়লেটে এসে ঢুকলাম। ঢুকেই চোখে পড়ল সামনের আয়নার ওপর একজোড়া খাকি রংয়ের চুলের ফিতে শুকুচ্ছে। কাল হামিদার বেণীতে এই ফিতে দুটি ছিল। যাওয়ার সময় সে হয়তো বেণী বাঁধবারও সময় পায় নি। কেন জানি না বুকের ভেতর থেকে প্রবল হু হু শব্দে একটা কান্না বেরিয়ে এল। আমি নিজেকে আর সামাল দিতে পারছিলাম না। বেসিনের কলটা ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।

.

আমরা গোছগাছ করে ট্যাক্সি ডাকার আগে নাস্তার জন্য নিচে নেমে এলাম। আমাদের সবারই মালপত্র রুমের বাইরে দোরগোড়ায় রেখে এসেছি। শুধু গৌহাটিতে পাওয়া টাকার ব্যাগটা আমি হাতে করে নিচে নিয়ে এসেছি। আমার হাতে ব্যাগটা দেখে একবার ইমাম বলেছিল, আপনি এটা কষ্ট করে টানছেন কেন? বেয়ারাই আনতে পারত।

আমি বললাম, ব্যাগটা নন্দিনীর। এটা বরং আমার হাতেই থাক।

ইমাম হেসে বলল, নন্দিনী কী সত্যি আমাদের সাথে থাকবেন?

তার আত্মীয়বাড়ি যাবার আগে নন্দিনীর সাথে এ ধরনের কথাইতো হয়েছিল। এখন অবশ্য তার আত্মীয়-স্বজনের সন্ধান পেয়ে তার মতের পরিবর্তনও হতে পারে। আমি ঠিক করে কিছু বলতে পারছি না।

বললাম আমি।

ইমাম বলল, তিনি যদি আমাদের সাথে থাকতে চান তাহলে আমার প্রতিশ্রুতি তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। এখন তো তার এখানে আসার কথা ছিল বলে শুনেছি।

তার কথা শেষ হবার আগেই নন্দিনী এসে আমাদের খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে সালাম জানাল, আমি এসে পড়েছি।

নন্দিনী একা এসেছে দেখে আমি বললাম, ভবানীপুর থেকে কেউ আসে নি?

নন্দিনী বলল, না একাই এসেছি। আমি ঠিক চিনে চলে এসেছি। মনে হয় কলকাতায় ছোটো বয়সে একবার যে এসেছিলাম সেটা এখন একটু একটু কাজে লাগছে। এখন কোনো কিছুই আর অপরিচিত মনে হচ্ছে না।

আমি বললাম, অনুপদা আর তার বোন কেমন আছে। তাদের নিয়ে এলে না কেন?

তারা আসতে চেয়েছিলেন। আমিই বরং বলেছি নতুন বাসার ঠিকানা নিয়ে গিয়ে একদিন তাদের নিয়ে আসব।

বলল নন্দিনী। তার কথায় একটা আনন্দ উচ্ছ্বল ভাব।

আমি বললাম, তোমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে নন্দিনী।

নন্দিনী হাসল।

পার্ক সার্কাসের একটা ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলা ইমামের জন্য বরাদ্দ হল। আমরা উডস্ট্রীটের আর্মেনিয় হোটেলটি সকালেই ছেড়ে এসেছি। সারাদিন বাসাটা গোছগাছ করতেই পারুল ও নন্দিনীর কেটে গেল। আমিও খানিকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যদিও গোছানোর মতো ঢাকা থেকে আমরা কিছুই নিয়ে আসি নি, এমন কী পারুলদেরও উল্লেখ করার মতো আসবাপত্র তেমন কিছু ছিল না, তবুও একটা নতুন বাসায় উঠলে ঝাড়পোছ ও ধোয়ামোছা তো করতেই হয়। তাছাড়া রান্নাবান্নার ডেগডেকচির জন্য ইমাম একজন লোককে বাজারে পাঠিয়ে সবকিছু সংগ্রহ করাল। সকালেই বাড়ির বুড়ো মুসলমান দারোয়ান কোত্থেকে যেন এক ওড়িয়া কাজের মেয়েকে জোগাড় করে আনল রান্না আর ঘর মোছার জন্য। মেয়েটি ষোল সতের বয়সের। বেশ চটপটে। এসেই দুপুরের রাঁধাবাড়ায় লেগে গেল। ঘরবাড়ি গুছিয়ে খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা। ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে গোছল সেরে এসে সকলে যখন খাওয়ার টেবিলে বসলাম বেলা তখন সাড়ে তিনটা। এতক্ষণ নন্দিনীর সাথে মন খুলে কথা বলার ফুরসৎই পাওয়া যায় নি।

আমি বললাম, নন্দিনী তোমার আমাদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত কী অনুপদা জানেন? তারা কী তোমাকে এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন?

আমি তাদের বলেছি আমার দেশ ও জাতির এই দুর্দিনে আমার একটা কর্তব্য আছে। আমি স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে আসি নি। বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি আর ততোধিক বাধ্য হয়েই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে দাঁড়াব। আমি সীমাদির মৃত্যুর ঘটনা, আমার ওপর পাশবিক লাঞ্ছনার বিবরণ খোলাখুলি আমার কুটুম্বদের বলেছি। তোমার কথা, পারুল ও ইমাম ভাইয়ের দয়ার কথা সবি বলে এদের অনুমতি নিয়ে ভবানীপুর ছেড়ে এসেছি। ফের সেখানে গেলেও ওদের গলগ্রহ হতে যে চাই না এটা অনুপদাকে বুঝিয়েছি। শুধু আমার বোনটা একটু কেঁদেছে সীমাদির জন্য। এখন ইমাম আর পারুল যদি না তাড়ায় এখানেই থাকব।

ইমাম বলল, সাবাস। আমরা আর আপনাকে বলব না যে আপনি এখানে থাকবেন কী না। জানব আমাদের মতো দেশ থেকে এসেছেন এবং আমাদের সাথেই বিজয়ী হয়ে ফিরে যাবেন।

ইমামের কথায় খাওয়ার টেবিলে খুশি আর আশ্বাসের আবহাওয়া যেন ছড়িয়ে পড়ল। মিতুর খুশিটা বোঝা যায়। সে একবার আমার দিকে মুখ তুলে হাসল। পরমুহূর্তেই পারুলের সতর্ক গভীর দৃষ্টির ইঙ্গিতে মাথা নুইয়ে খেতে লাগল।

আমি আন্দাজ করলাম এরা সকলেই হামিদার গতকালের আগমন ও একরাত হোটেলে অবস্থানের বিষয়টি নন্দিনীর কাছে চেপে যেতে চাইছে। হয়তো আমার আত্মীয়দের ধারণা এতে আমার ও নন্দিনীর সম্পর্কটা সন্দেহযুক্ত হবে কিংবা আমি অসন্তুষ্ট হব। এই দুর্ভাগ্যের দিনে ওরা আমাকে হারাতে চাইবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু গতরাতে হামিদার উপস্থিতির কথাটা গোপন রাখা যে অন্যায় এবং আমার বোন, ভাগ্নি ও বোনের স্বামীর কাছে যে আমি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি তা মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম। তাছাড়া হামিদার গতরাতের পরাজিত চেহারায় যে প্রেম ও উদারতা ছিল তাতে তো একবারও মনে হয় নি নন্দিনী বা আমার প্রতি তার সামান্যতম বিদ্বেষ আছে। মুহূর্তের জন্য গতরাতের হামিদার অশ্রুভরা কথা আমার মনে ভেসে উঠল। আর দেশের মুক্তির জন্য তার ভয়াবহ সিদ্ধান্তের কথাও। আমি নন্দিনীর মুখের দিকে না তাকিয়েই বললাম, তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি নন্দিনী।

নন্দিনী প্লেট থেকে মুখ তুলল।

আমার স্ত্রীর সাথে গতকাল আমার দেখা হয়েছে।

আশ্চর্য, এতক্ষণ একথা আমায় বল নি কেন? বৌদি কেমন আছেন? কোথায় দেখা হল, থিয়েটার রোডের অফিসে?

উপর্যুপরি একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলেও নন্দিনীর গলা ও চেহারা যে থর থর করে কাঁপছে তা আমি ধরতে পেরে একটা ঢোক গিলে সামনের পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম।

আমার অবস্থা বুঝে ইমামই অনেকটা আশ্বাস দেয়ার সূত্রে বলল, আমার সাথে থিয়েটার রোডের অফিসে ভাবির দেখা হলে আমি তাকে হোটেলে নিয়ে এসেছিলাম। ভাবি একরাত আমাদের সাথে ছিলেন। আবার সকালেই তার গ্রুপে ফিরে গেছেন। তিনি ট্রেনিং শেষ করে ফ্রন্টে আছেন। দেশের ভেতরে অপারেশনে যাবেন। এ অবস্থায় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটকানো যায় না। তাছাড়া আমার দৃষ্টিতে আটকানো পাপও।

ইমামের কথায় নন্দিনীর মধ্যে একটা হতচকিত ভাব। একবার পারুলের দিকে তাকিয়েই আমার দিকে ফিরল। পারুল ও ইমাম মাথা নুইয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। আমিও নন্দিনীর চোখের ওপর চোখ রাখার সাহস পাচ্ছিলাম না। আমিও মুখ নিচু করে খাওয়ার ভান করলাম। শুধু মিতুই এই গুমোট অবস্থাটা ভাঙার জন্য দৈবভাবে কথা বলে উঠল, মামানিকে অলিভ রংয়ের ড্রেসে যা সুন্দর লাগছিল না নন্দিনী ফুপু, দারুণ। প্যান্ট, পুলওভারে কী স্মার্ট। আর জানো আম্মা মামানির পকেটে একটা পিস্তল ছিল। একদম গুলিভরা পিস্তল। মামানি আমাকে দেখিয়েছে।

তোমার মামানিকে আরও একটা দিন ধরে রাখলে না কেন মিতু? একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে জীবন সার্থক করতাম।

নন্দিনীর কথায় মিতু ফের বলল, কত সাধলাম, থাকল না যে। মামানি বলে কিনা ফের ঢাকায় দেখা হবে।

মিতুর কাছে বোধহয় বড়দের সব ব্যাপাই একটু খাপছাড়া। কেমন যেন একটু রহস্যময়। সে আমাদের দিকে বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে নিজের খাওয়ার দিকে মন দিল।

.

খাওয়ার পর নন্দিনী হাত ধোয়ার জন্য বেসিনের দিকে উঠে গেল। আমি ভাবলাম সে বোধহয় হাতমুখ ধুয়ে আবার খাবার টেবিলে ফিরে আসবে। ডাইনিং স্পেস থেকে বেসিনটা একটা দেয়ালের আড়ালে থাকায় আমি নন্দিনীকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নন্দিনী ফিরল না। একে একে আমরা সবাই খাওয়া শেষ করে উঠলাম। ইমাম আগে হাত মুখ ধুয়ে চলে গেলে আমি ও পারুল দুজন দুটা বেসিনে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। পারুল সোপ কেস থেকে সাবান তুলে নিয়ে হাতে মাখাতে মাখাতে হাসল।

দিদির বোধহয় আজ ঠিকমত খাওয়া হল না।

হামিদা এসেছিল, একথা তো আর মিথ্যে নয়। তাছাড়া আমি একথা গোপন করতে যাব কেন? গোপন রাখলেও নন্দিনী একদিন জানতই। তখন তোদের প্রতি একটা সন্দেহ সৃষ্টি হত।

আমরা অবশ্যি বলতে যেতাম না।

কেন তোরা এরকম করতি?

ইমাম চায় না প্রবাসে আপনার মনে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হোক। তার ধারণা কবিরা সাধারণ সামাজিকতা মেনে চললে কবিতা লিখতে পারেন না। সমাজে কবি সাহিত্যিকদের সাত খুন মাফ।

বলতে বলতে পারুল একটু রহস্যময় হাসি হাসল। যেন তার শ্রদ্ধেয় ভাইয়ের অবৈধ কার্যকলাপের অযাচিত সমর্থন নিজের স্বামীর মুখ থেকে পেয়ে সে খানিকটা দায়মুক্ত।

আমি বললাম, তোর কাছে নিশ্চয়ই নন্দিনীকে এভাবে নিয়ে আসা এবং তার সাথে আমার এভাবে মেলামেশাটা একটা পাপ?

ভাইয়া আমি আপনার খুব নিকট আত্মীয়া হলেও অন্যের বৌ। এদের পারিবারিক মর্যাদার কথা ও শিক্ষাদীক্ষার কথা তো আপনি জানেন। আমি খুব ভয় আর অস্বস্তির মধ্যেই ছিলাম। আপনাদের জামাই আমাকে আশ্বস্ত না করলে আমি হয়ত আপনাকে আমাদের সাহচর্য ছেড়ে যেতেই বলতাম।

মাথা নিচু করে জবাব দিল পারুল। সাবানটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

ইমাম তোকে সত্যি যা বলেছে আমাকে খুলে বলবি?

আমার কৌতূহল দেখে পারুল আবার হাসল, ইমাম বলেছে আপনি যে পরিস্থিতি ও বিপদকে তুচ্ছ করে আমাদের কাছে এসেছিলেন সেটা স্বাভাবিক সামাজিক ন্যায় অন্যায় বিচারের সময় নয়। এটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। নন্দিনী দিদিদের দুঃখে আপনি সত্যিকার কবির আচরণই করেছেন, একথা ইমামই আমাকে বুঝিয়ে অস্বস্তি দূর করে দিয়েছে। বলেছে এই অবস্থায় পড়লে ইমামও নাকি এই করত। সে বলে, একজন মহিলাকে আপনি নাকি ভয়ে বিপর্যয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

কথাগুলো বলে হ্যান্ডেল থেকে একটা সাদা তোয়ালে টেনে আমাকে দিয়ে পারুল আবার হাসল, আমি এবার আসি ভাই। আপনাদের জামাই অপেক্ষা করছে।

আমি বললাম, আমার কথা শেষ হয় নি। আর একটু শোন। হামিদাকে তুই আর ইমাম নন্দিনী সম্বন্ধে কী বলেছিস যাতে সে ভাবছে তার ঘর ভেঙে যাচ্ছে?

এমন কথা বলেছে নাকি ভাবি?

হ্যাঁ। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

আমরা নন্দিনীকে নিয়ে আসা সম্বন্ধে আপনি যা যা বলেছেন এর বেশি কিছু বলি নি। তিনি কিছু না বলে শুনে শুধু গেলেন। যাওয়ার সময় অবশ্য আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। নামার সময় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ইমামকে বললেন, কবিকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কিছু কবিতা লিখতে। কলকাতায় বসে থাকলে নাকি আপনার লেখালেখি কিছু হবে না। এসব বলে মিতুকে গেট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে একাকী গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললেন, চালাও। সম্ভবত গাড়িতে উঠেও ভাবি কাঁদছিলেন। কারণ রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মিতু দেখেছে। রাতে কী আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল?

আমি পারুলের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নিজেরই উদ্গত অশ্রুভরা চোখ দুটি লুকোবার জন্য বেসিনটা ও পারুলকে পেছনে রেখে সোজা নিজের কামরার দিকে হাঁটা দিলাম। এতে পারুল কতটা হতবাক হবে তা একবারও দেখার সাহস আমার হল না।

আমার জন্য নির্দিষ্ট কামরার তালাটা খোলার আগে নন্দিনীর কামরার ভেজানো দরজার দিকে একবার তাকালাম। নন্দিনী হয়ত ভেতর থেকে দুয়ার বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। নাকি নন্দিনীও হামিদার আগমনের কথা জেনে উপুড় হয়ে কাঁদছে?

নিজেকে খুব শ্রান্ত মনে হল আমার। দুয়ার খুলে ঘরে ঢুকেই বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। হয়ত মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়তাম। লেপটা যেই পা দিয়ে টেনে তুলে গায়ে দিতে চেষ্টা করছি এমন সময় বাইরে নন্দিনীর আওয়াজ পেলাম।

খোলো। আমি আসব।

আমি উঠে দরজা খুললাম।

পিঠের ওপর ভেজা চুল ছেড়ে দিয়ে নন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা দুর্বোধ্য। হাসি ছড়িয়ে বলল, ভেতরে যেতে দিতে কোনো আপত্তি নেই তো?

আমি জবাব না দিয়ে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে পথ করে দিলাম। ভেতরে ঢুকে নন্দিনী আমার কামরাটা দেখতে লাগল। টাকার স্যুটকেসটা খাটের নিচে রাখা ছিল। মাথা নুইয়ে সেটা দেখল।

আমি এসে আবার বিছানায় বসলাম।

ইমাম সাহেবের বদৌলতে আমরা বেশ রাজার হালেই থাকব দেখছি।

হেসে বলল নন্দিনী।

আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ করেই থাকলাম। বুঝলাম আমার ধারণা ঠিক নয়। হামিদার সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যাপারটা নন্দিনীর মধ্যে কোনো উদ্বেগই সৃষ্টি করে নি। খুব স্বাভাবিক হাসিখুশি চেহারা। একবার হাত ঘুরিয়ে তার বিপুল ভেজা কেশরাশি পেছন থেকে সামনে বুকের ওপর রেখে আমার সামনে অবলীলায় ঝাড়তে লাগল।

আমি বললাম, বসবে?

তোমার ঘুমটা মাটি করে বসতে মন চাইছে না।

সারাদিন এমন খাটাখাটনি করলে এখন একটু বিশ্রাম নিলে তো পারতে।

বিশ্রাম নিলে তোমার এখানেই একটু শোব।

নন্দিনী খাটের ওপর আমার পাশে এসে বসল।

আমি ভাবলাম হামিদার কথায় রাগ করে তুমি বুঝি পেট ভরে ভাতও খেতে পারলে না।

তার ওপর মিছেমিছি রাগ করতে যাব কেন? তিনি তো আমার কোনো ক্ষতি দূরে থাক একনজর দেখার জন্যও থাকলেন না।

সে থাকলে বুঝি তুমি খুশি হতে?

তা অবশ্য হতাম না। তবে বেদখল জায়গা ছেড়ে দিতাম।

এখন বুঝি আর ছাড়তে মন চাইছে না?

কেন চাইবে, যখন তিনিই হেরে ছেড়ে দিয়ে গেলেন?

হেসে বলল নন্দিনী। হাত দিয়ে আবার কেশরাশি বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে শব্দ করে হেসে উঠল, আমি সত্যি আজ পরিশ্রান্ত। তোমার পাশে শুয়ে শুয়ে কিছু কথা বলব। তুমি শোবে না?

মিতু হঠাৎ এ ঘরে এলে কেমন হবে?

কী আর হবে? ভাববে তার নতুন মামি মামার সাথে খুনসুটি করছে। লজ্জা পেয়ে পালিয়ে বাঁচবে।

এবার আমিও হেসে ফেললাম।

তোমার এমন উল্লসিত হওয়ার কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না তো। বলবে নাকি

কেন বলব না? আমার বলার মানুষ জগতে তুমি ছাড়া আর কে আছে? তবে তোমার পাশে একটু শুতে দাও, এক্ষুনি বলছি।

আমি বিছানায় উঠে দুটো বালিশের একটি আলাদা করে রাখা মাত্রই আমার শোয়ার তোয়াক্কা না করেই সে শুয়ে পড়ল। মুখে আঁচল চাপা হাসি। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বললাম, দরজাটা বন্ধ করে আসি।

দরজায় ছিটকিনি এঁটে ফিরে এলে নন্দিনী উঠে বসল।

এত ভয় পাচ্ছ কাকে? তোমার স্ত্রী তো সব কথা জেনে শুনেই পালিয়েছে।

পালিয়েছে বলো না। বল দেশের প্রতি দায়িত্ববোধই তাকে লড়াই-এর ময়দানে ডেকে নিয়ে গেছে। হামিদার সাথে তোমার আমার কোনো তুলনা চলে না নন্দিনী। হামিদা ধর্ষিতা বাংলাদেশের প্রতীক। হামিদা দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ ও ইজ্জত সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করে মৃত্যুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। হামিদাই এখন বাংলাদেশ নন্দিনী, হামিদাকে দেখে আমার লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে এক ধরনের কাপুরুষতার মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি।

আমার নিজের গলা নিজের কাছেই উত্তেজিত শোনাল। নন্দিনীর দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না আমি। মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে চেয়ে থাকলাম। নন্দিনীও কোনো কথা বলছে না। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকলে আমি কেঁদে ফেলতে পারি এই ভয়ে আমি তার দিকে না ফিরেই বললাম, তুমি শোও, আমি টয়লেট থেকে আসি।

আমি উঠে দুয়ার খুলে বাইরে এলাম। আমার কামরাটায় এটাচড কোনো বাথরুম না থাকায় আমি ডাইনিং স্পেসের পাশে একটা বাথরুমে এসে নিজেকে সংবরণ করলাম। আমার এখন প্রকৃতপক্ষে টয়লেটের কোনো প্রয়োজনই ছিল না শুধু নন্দিনীর সামনে আবেগে-উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত কেঁদে না ফেলি এ ভয়েই এখানে পালিয়ে এলাম।

মিনিট দশেক পার হলে আমি মুখের উপর ঠান্ডা পানির ঝাপটা লাগিয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের কামরায় ঢুকে দেখি নন্দিনী বালিশের উপর তার অফুরন্ত চুলের সিক্ত গোছা ছড়িয়ে দিয়ে ময়ুরীর মতো চোখ মুদে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে অপূর্ব রূপসী মনে হল নন্দিনীকে। তার সপ্রতিভ শূন্য গলায় কোনো কণ্ঠহার বা অলংকার না থাকায় গাত্রবর্ণকে সকালের আকাশের মতো স্নিগ্ধ মনে হল।

ঘুমিয়ে পড়লে মনে হচ্ছে?

না।

ঘুমাও না কেন, ঘুমাতে তো চেয়েছিলে?

আমি যথাসমভব গলাটা নিচু রেখে কথা বলতে চাইলাম। একটু আগে এমন উত্তেজিতভাবে হামিদার প্রসঙ্গ উত্থাপন যে ঠিক হয় নি এটা বুঝতে পেরেই যেন আমার গলার আওয়াজ অস্বাভাবিকভাবে খাদে নেমে এল।

নন্দিনী চোখ মুছে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই আমার কথার জবাব দিল।

তুমি কাঁদছিলে?

না তো।

বৌদির জন্য তুমি কাঁদছিলে। কান্না লুকোবার জন্য টয়লেটে পালালে।

আমি কথার জবাব দিলাম না। চুপচাপ বিছানায় নন্দিনীর গা ঘেসে খাটের ওপর বসলাম।

হামিদা বৌদির এভাবে চলে যাওয়াটা তোমাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। অনুতাপ ও প্রেম তোমার হৃদয়কে খুবলে খাচ্ছে আমি জানি। আমি এসেছিলাম তোমার পাশে শুয়ে তোমাকে সান্ত্বনা দিতে। খুনসুটি করতে নয়।

নন্দিনী উল্টো দিকে পাশ ফিরলে তার বালিশের একাংশকে খালি হতে দেখে আমি আর কথা না বলে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। আমাকে আরও একটু জায়গা ছেড়ে দেবার জন্য নন্দিনী বিছানার আরও ভেতর এগিয়ে গেল। চুল সরিয়ে অন্য বালিশটা মাথার নিচে খুঁজে পাশ ফিরে কথা বলতে লাগল।

হামিদা বৌদি বীরনারী। বাংলাদেশের সাহসের প্রতীক। আমি তাকে হৃদয় থেকেই শ্রদ্ধা জানাই। সাক্ষাৎ হলে একথা অবশ্যই বলতাম। তবে তিনি ধর্ষিতা নন। ধর্ষিতা দেশমাতৃকার প্রতীক আমি। কবি তুমি তো জানো বাঙালি নারীর চরমতম লাঞ্ছনার কালিমা নিয়ে আমি এখনও বেঁচে আছি। কারো জন্যে সত্যি যদি কোনো মহৎ রচনা কবিরা সৃষ্টি করেন তবে আমার চেয়ে বড় উপমা অন্তত তোমার অভিজ্ঞতায় আর কেউ আছে কি? আমার জানা মতে নেই। কোনো শহীদের কথা বলতে গেলে সীমাদির মৃত্যুর যে ছবি তুমি চোখের সামনে দেখলে এর চেয়ে মর্মান্তিক বিষাদমাখা কী কোনো কবি কোনোদিন চাক্ষুস দেখেছে?

সেসব কথা এখন আমাকে কেন মনে করিয়ে দিচ্ছ নন্দিনী?

আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। অতীত দুঃস্বপ্নের দিন ও রাতগুলো যেন এখন নন্দিনীর কথায় আমার মানসপটে চলচ্চিত্রের মতো ভাসতে লাগল।

তুমি বলছিলে না তুমি কাপুরুষতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছ? প্রকৃতপক্ষে প্রেমে কোনো কাপুরুষতা নেই। প্রেম-ভালবাসা অযৌক্তিক আকর্ষণ বলেই কবিরা এতে ডুবে যায়। তুমি আমাকে ভালবাসো বলেই যন্ত্রণা ও অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হচ্ছ। হামিদা বৌদিকেও তুমি একদা প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, কিন্তু তার বীরমূর্তি ও ভয়াবহ বিহ্বল প্রতিজ্ঞা তোমার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি, আমি কেউ হামিদা বৌদির মতো সাহসী নই। তবে কাপুরুষও নই। আমরাও দেশের প্রতি আমাদের কিছু কর্তব্য পালন করতে পারি।

কি রকম কর্তব্য?

আমরাও খানিকটা স্বার্থত্যাগ করে দেশের ভেতরে গিয়ে দুর্ভাগা মানুষের আর মুক্তিবাহিনীর সেবা করতে পারি। যুদ্ধে না হয় আনাড়ি বলে এগোতে পারব না। অন্য কাজ তো করতে পারি। পারি না কি?

নন্দিনীর কথায় আমি একটু চমকে গেলাম।

আমরা দেশের ভেতর গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও সেবা করতে পারি? সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম।

তোমার কথা একটু খুলে বল নন্দিনী, আমরা কীভাবে আবার দেশের ভেতরে ঢুকতে পারি? কীভাবে, কোনো পথে কার কাছে আমরা যাব? কে আমাদের বিশ্বাস করবে?

আমি আবার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেও নন্দিনী চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। এখন তাকে একটা নিস্তরঙ্গ রহস্যময় সরোবরের মত লাগছে। আমিই আবার কথা বললাম, তোমার পরিকল্পনাটা আমাকে বল নন্দিনী, সাধ্যে কুলালে আমি তা করব।

সত্যি করবে কবি?

এবার সে লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। আমার কথা শুনবে। তুমি তো কবি।

আমি হেসে বললাম, আগে তোমার প্রস্তাবটা শুনি তো?

এই তিন লক্ষ টাকা ও স্যুটকেসের সমস্ত কাগজপত্র আমরা প্রকৃত মালিকদের ফেরত দিয়ে কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গায় বিপ্লবীদের সাথে সম্পর্কিত মেয়েটির কাছে যাব। তার হাতে স্যুটকেসটা পৌঁছে দিয়ে আমাদের ভুল ও লোভের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আমাদের একটু শেলটার দিতে বলব।

গলায় দৃঢ়তা মিশিয়ে কথা বলছে নন্দিনী। তার চোখের ভেতর যেন বাংলাদেশের এক বিশাল ছায়ামেদুর দীঘির টলমলানি।

আমি বললাম, নন্দিনী তুমি আরও ভেবে দেখো। এই টাকার স্যুটকেসটা তুমিই এনেছ। এর ওপর সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তোমারই, আমি মানি। তবুও বাংলাদেশের এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বাস্তু। এই স্যুটকেসের টাকায় আমরা বাঁচতে পারি। এমনকি সুখীও হতে পারি। এটা হেলায় হারানোর বোকামী না করাই সঙ্গত। একটু ভেবে দ্যাখো।

আমার কথা আমি তোমাকে খোলাখুলি বললাম কবি। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্ধেকটা অধিকার তোমার। টাকাটা ফেরত দিই বা না দিই। আমাদের ভাগ্য আমাদেরকে এক জায়গায় বহুদিন পর্যন্ত বেঁধে রাখার অবস্থায় এনে ফেলেছে। বরং আজ রাতটা তুমি চিন্তা করে দেখো। তবে যাই করতে হয় একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। সময় ও সুযোগ আমাদের জন্য অনন্তকাল দুয়ার মেলে রাখবে না।

নন্দিনীর কথার প্রতিটি শব্দই যেন পাথরের খণ্ডের মতো আমার লোভ ও অকর্মণ্যতার ওপর বৃষ্টি বর্ষিয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *