১.০১-০৫ কারখানার বাঁশি

মা – উপন্যাস – ম্যাক্সিম গোর্কি
অনুবাদ : বিমল সেন

প্রথম খণ্ড

১.০১

রোজ ভোরে কারখানার বাঁশি বেজে ওঠে তীক্ষ্ণ তীব্র ধ্বনিতে মজুর-পল্লির ধূম্র-পঙ্কিল আর্দ্র বাতাস কম্পিত হয়, আর ছোট ছোট কুঠরি থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় বেরিয়ে আসে দলে দলে মজুর। অপ্রচুর নিদ্রায় আড়ষ্ট দেহ, কালো মুখ। ঊষার কনে হাওয়া…সংকীর্ণ মেটো পথ…তারই মধ্য দিয়ে চলে তারা গিয়ে ঢুকে পড়ে সেই উঁচু পাথরের খাচাটার মধ্যে, যেটা তাদের গ্রাস করবার জন্য কাদা-ভরা পথের দিকে চেয়ে আছে শত শত হদে তৈলাক্ত চক্ষু বিস্তার করে। পায়ের তলায় কাদা চট চট করতে থাকে কাদাও যেন তাদের ভাগ্য নিয়ে বিদ্রুপ করছে; কানে আসে নিদ্রাজড়িত কণ্ঠের কর্কশ ধ্বনি, ক্রুদ্ধ তিক্ত গালাগালির শব্দ…তারপর সে-সব ডুবে যায় কলের গম্ভীর ধ্বনিতে, বাষ্পের অসন্তোষ-ভরা গর্জনে। কালে কঠিন চিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় পল্লির বহু ঊর্ধ্বে। সন্ধ্যায় কারখানা তাদের ছেড়ে দেয় দগ্ধ-সর্বস্ব ছাইয়ের মতো। আবার তারা পথ বেয়ে চলে…ধোয়া-মলিন মুখ… মেশিন-তেলের বোটকা গন্ধ: ক্ষুধার্ত সাদা দাঁত কিন্তু সজীব, আনন্দপূর্ণ কণ্ঠ। সেদিনকার মতো কঠিন শ্রম-দাসত্ব হ’তে তারা মুক্তি পেয়েছে, এখন শুধু বাড়ি ফেরা, খাওয়া এবং ঘুম।

গোটা দিনটা হজম করে ওই কারখানা। কল মানুষকে ইচ্ছামতো শোষণ করে জীবন থেকে একটা দিন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়…মানুষ অজ্ঞাতসারে এগোয় তার কবরের দিকে। তবু তারা খুশি… তাড়ি আছে, আমোদ আছে।…আর কি চাই।

ছুটির দিনে মজুরেরা ঘুমোয় দশটা তক…তারপর উঠে সব চেয়ে পছন্দসই পোশাকটি পরে গিজায় যায়…যাবার আগে ধর্ম-বিমুখতার জন্য ছোটদের একচোট ব’কে নেয়। ফিরে এসে পিরগ খায়; তারপর সন্ধ্যাতক ঘুমোয়। সন্ধ্যায় পথের ওপর আনন্দের মেলা বসে। পথ শুকনো হ’ক, তবু ওভার- যাদের আছে পরে বেরোয়…বর্ষা না থাকলেও ছাতা নিয়ে পথে নামে! যার যা আছে তাই নিয়ে সে স্যাঙ্গাতদের ছাড়িয়ে উঠতে চায়। পরস্পর দেখা হলে কল-কাৰখানার কথাই বলে, ফোরম্যানকে গালি দেয়, কল-সংক্রান্ত কথা নিয়েই মাথা ঘামায়। ঘরে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কলহ করে, মাঝে মাঝে তাদের নির্মমভাবে মারে। যুবকেরা মদ খায়, এর-ওর বাড়ি আড্ডা দিয়ে ফিরে, অশ্লীল গান গায়, নাচে, কুৎসিৎ কথা উচ্চারণ করে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আসে… নোংরা গ, ছেঁড়া পোশাক, ছিন্ন মুখ…কাকে মেরেছে তারই বড়াই, কার কাছে পিটুনী খেয়েছে তারই অপমানের কান্না। কখনো কখনো বাপমা-ই তাদের তুলে আনেন এথ কিংবা তাড়িখানা থেকে, মাতাল অবস্থায়। কটুকণ্ঠে গালমন্দ করেন…স্পঞ্জের মতো মদসিক্ত শরীরে দু’দশ ঘা বসান…তারপর রীতিমতো শুইয়ে দেন…পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে কাজে পাঠান।

বহু বছর ব্যাপী অবসাদের ফলে ক্ষুধা-শক্তি তাদের লোপ পেয়েছে… ক্ষুধা উদ্রেক করার জন্য তারা গ্লাসের পর গ্লাস মদ চালায়। ক্রমে মদের মাত্রা চড়ে যায় প্রত্যেকের প্রাণেই মাথা তুলে দাঁড়ায় একটা অবোধ্য পীড়াদারক অসন্তুষ্টি, যা ভাষায় ফুটলতে চায়। এই অশান্তিকর উদ্বেগের

বোঝা হালকা করার জন্যই তারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়টি নিয়েও হানাহানি করে হিংস্র পশুর মতো…কখনো আহতাঙ্গ হয়, কখনো মরে। এই প্রচ্ছন্ন হিংস্রতা ধীরে ধীরে বেড়ে চলে জীবনে। তারা জন্মে আত্মার এই পীড়া নিয়ে। এ তাদের পিতৃধন। কালো ছায়ার মতো কবর পর্যন্ত লেগে থাকবে সঙ্গে…জীবনকে করবে উদ্দেশ্যহীন, নিষ্ঠুরতা এবং … পাশবিক উত্তেজনায় কলঙ্কিত!

চিরকাল বছরের পর বছর…জীবন-নদী বয়ে এসেছে এমনি ধারায়। মন্থর, একঘেয়ে তার গতি-পঙ্কিল তার স্রোত। দিনের পর দিন তারা একই কাজ করে চলে রুটিনের মতো জীবনের এ ধারা বদলাবার ইচ্ছে বা অবসর যেন কারো নেই।

নতুন কেউ যখন পল্লিতে আসে, নতুন বলেই দু’চারদিন সে তাদের কৌতুহল উদ্রেক করে। তার কাছে ভিন্মুলুকের গল্প শোনে, সবাই বোঝে, সর্বত্রই মজুরের ঐ এক অবস্থা। নবাগতের ওপর আর কোন আকর্ষণ থাকে না।

মাঝে মাঝে কোন নয়া লোক এসে এমন-সব অদ্ভুত কথা বলে যা’ মজুর-পল্লিতে কেউ কখনো শোনেনি। তারা তার কথা কান পেতে শোনে…বিশ্বাসও করে না, তর্কও করে না। কারো মধ্যে জেগে ওঠে অন্ধ বিক্ষোভ, কেউ হয় ভীত বিব্রত, কেউ হয়ে ওঠে এক অজানা লাভের ক্ষীণ সম্ভাবনায় চঞ্চল। তারা পানের মাত্রা চড়িয়ে দেয়, যাতে এই অনাবশ্যক বিরক্তিকর উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলতে পারে। নবাগতকে যেন তারা ভয়ের চোখে দেখে…সে হয়তো তাদের মধ্যে এমন-কিছু এনে ফেলবে যা তাদের সহজ জীবন-স্রোতে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি করবে। তারা আশাই করেনা যে তাদের অবস্থার ও আবার উন্নতি হতে পারে। প্রত্যেক সংস্কারকে তারা সংশয়ের চোখে দেখে…ভাবে, শেষপর্যন্ত এ শুধু তাদের বোঝা বাড়াবে মাত্র। তাই তারা নবাগতদের এড়িয়ে চলে।

এমনি করে মজুরদের পঞ্চাশ বছরের জীবন কেটে যায়।

.

কামার মাইকেল ভ্লাশভের জীবনও কেটে যায় এমনি ধারায়। গম্ভীর কালো মুখ, সন্দেহ-তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ছোট ছোট চোখ, অবিশ্বাস-ভরা হাসি, উদ্ধত ব্যবহার, কারখানার ফোরম্যান এবং সুপারিন্টেণ্ডেন্টকেও কেয়ার করে না, কাজেই কামায় কম। ফি ছুটির দিনে কাউকে মারা চাই; কাজেই পাড়ার সবাই তাকে ভয় করে, অপছন্দ করে। মারতে গিয়েও ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে। শত্রুর সাড়া পেলেই ভ্লাশভ হাতের কাছে গাছ, পাথর, লোহা যা পায় তাই নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। সব চেয়ে ভয়ানক তার চোখদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যেন লোহার শলাকার মতো শত্রুকে বিদ্ধ করে…সে চোখের সামনাসামনি যে পড়ে সেই বোঝে কী এক হিংস্র ভয়-ডরহীন নিষ্ঠুর জল্লাদের কবলে সে পড়েছে। মুখের ওপরে-এসে-পড়া ঘন চুলের ফাঁকে ফাঁকে তার হলদে দাঁত ভয়ংকরভাবে কম করতে থাকে। দুরহ নারকী কীট-বলে সে তর্জন করে ওঠে…শত্রুদল চকিতে রণে ভঙ্গ দিয়ে গালি দিতে দিতে পালায়। মাথা খাড়া করে সঁতের মধ্যে ছোট গোটা একটা চুরুট চেপে সে তাদের পিছু নেয়, আর চ্যালেঞ্জ করে, কোন্ ব্যাটা মরতে চাস, আয়। কেউ চায়না।

এমনি সে খুব কম কথা বলে, শুধু ‘নারকী কীট’ এই কথাটা তার মুখে লেগেই আছে। কারখানার কর্তাদের থেকে শুরু করে পুলিসদের পর্যন্ত সে ঐ বলে ডাকে। বাড়িতে গিয়ে বউকে পর্যন্ত বলে, ‘নারী কীট’ আমার পোশাক যে ছিঁড়ে গেলো দেখতে পাস না?

তাঁর ছেলে পেভেলের বয়স যখন চৌদ্দ, তখন একদিন তার চুল ধরে টানতে গেলো। পেভেল পলকে একটা হাতুড়ি তুলে নিয়ে বললো, দুয়োনা বলছি।

কী!-পিতা কৈফিয়ৎ তলবের সুরে গর্জে উঠলো।

পেডেল অবিচলিত কণ্ঠে বললো, যথেষ্ট হয়েছে, আর আমি পড়ে পড়ে মার খাচ্ছি না। বলে হাতুড়িটা সে একবার সদর্পে মাথার ওপর ঘোরালো।

পিতা তার দিকে চাইলেন, তারপর লোমবহুল হাত দু’খানা ছেলের পিঠে রেখে হেসে বললেন, বহুৎ আচ্ছা! ধীরে ধীরে তার বুক ভেঙে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো, বলে উঠলেন, নারকী কীট…

…এর কিছুকাল পরে বউকে একদিন ডেকে বললেন, আমার কাছে আর টাকা চেয়োনা, ছেলেই এবার থেকে তোমায় খাওয়াবে।

স্ত্রী সাহস করে প্রশ্ন করলো, আর তুমি বুঝি মদ খেয়ে সব ওড়াবে?

সে কথায় তোর কাজ কি, ‘নারকী কীট’ কোথাকার!

সেই থেকে মরণ অবধি তিন বছর ছেলেকে সে চোখ চেয়ে দেখেনি, ছেলের সঙ্গে কথা বলেনি।

মরলো সে ভীষণ যন্ত্রণা পেয়ে। পাঁচদিন ধরে বিছানায় গড়াচ্ছে… সমস্ত অঙ্গ কালো হয়ে গেছে দাঁত কটমট করছে…চোখ বোজা! মাঝে মাঝে ব্যথা যখন বড়ই অসহ হয়, বউকে ডেকে বলে, আর্সেনিক দাও, বিষ খাও।

বউ ডাক্তার ডাকলো। ডাক্তার পুলটিশের ব্যবস্থা করলেন, বললেন, অচিরে একে হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্র করা দরকার।

মাইকেল গর্জে উঠলো, গোল্লায় যাও। আমি নিজে নিজেই মরতে পারব ‘নারকী কীট’ কোথাকার।

ডাক্তার চলে গেলে বউ সজল চোখে জেদ করতে লাগলো, অস্ত্র করাও।

সে হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ করে বউকে ভয় দেখিয়ে বললো, কোন্ সাহসে ওকথা বলি; জানিস, আমি ভালো হয়ে উঠলে তোর বিপদ।

ভোরে কারখানার বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা গেলো। বউ একটু কঁদলো, ছেলে মোটেই না। পাড়া-পড়শীরা বললো, বউটার হাড় জুড়িয়েছে, মাইকেল মরেছে। একজন বলে উঠলো, মরেনি, পশুর মতো পচতে পচতে জীবনপাত করেছে।

গোর দিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলো… দীর্ঘকাল বসে রইলো শুধু মাইকেলের কুকুরটা…কবরের তাজা মাটির ওপর বসে নীরবে সে কার স্নেহ-কোমল পরশের অপেক্ষা করে।

.

১.০২

দু’হপ্তা পরে এক রবিবারে পেভেল বাড়ি ফিরলো মাতাল হয়ে…টলতে টলতে পড়লে গিয়ে ঘরের এক কোনায়-পিতার মতো

টেবিলের ওপর ঘুষি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, মা, খাবার।

মা উঠে গিয়ে তার পাশটিতে বসলেন, হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ছেলের মাথাটা বুকে টেনে নিলেন। ছেলে মাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো, জৰি খাবার!

‘বোকা ছেলে!’ দুঃখ-ভরা মেহ-সজল কণ্ঠে মা তাকে সঙ্গত করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কোনো মতে জিভটাকে টেনে জড়িতস্বরে পেভেল বললো, আমি তামাক খাবো, বাবার পাইপটা এনে দাও।

এই প্রথম সে মাতাল হয়েছে। মদে তার শরীর নিস্তেজ হয়েছে কিন্তু জ্ঞান লোপ পায়নি। বারে বারে একটা প্রশ্ন তার মগজে এসে ঘা খেতে লাগলো, ‘মাতাল? মাতাল?…মা যত আদর করেন, তত তার অস্থিরতা বাড়ে…মায়ের করুণ দৃষ্টি তাকে ব্যথা দেয়…সে কাঁদতে চায় কিন্তু পারে না।…মাতলামি দিয়ে উদ্যত ক্রন্দনকে রোধ করতে যায়। মা তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে ধীরে ধীরে বলেন, কেন এ কাজ করিস্ বাবা? এ তো তোর কর্তব্য নয়!

সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি করে মা তাকে বিছানায় শুইয়ে দেন… ভিজে তোয়ালে দিয়ে উষ্ণ কপাল ঢেকে দেন। সে একটু সুস্থ হয়… কিন্তু তার চারপাশে সব-কিছু যেন দুলছে…তার চোখের পাতা ভারি… মুখে নোংরা টক আস্বাদ। চোখের পাতার মধ্য দিয়ে মায়ের বড় মুখখানির দিকে চায় আর এলোমেলো চিন্তা করে, হয়তো আমার এখনো মদ খাবার বয়স হয়নি। অন্য সবাই খায়, তাদের তো কিছু হয় না… আমি শুধু ভুগি।

দূরে কোনো স্থান থেকে মায়ের কোমল কণ্ঠ ভেসে আসে, তুই মাতাল হলে তোর এ বুড়ো মাকে কি করে খেতে দিবি, বাবা?

চোখ বুজে সে বলে, সবাই তো খায়।

মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। ছেলে মিথ্যে বলেনি। তিনি নিজেই জানেন, শুঁড়িখানা ছাড়া আর কোনো স্থান জোটেনা মজুরদের আনন্দ করার…মদ ছাড়া আর কোনো বিলাসিতা তাদের কপালে নেই…তবু বলেন, খানি, খানি, বাবা! তোর বাবা মদ খেয়ে আমাকে জীবন-তোর দুঃখ-দুর্দশায় ডুবিয়ে রেখে গেছেন…তুই তোর মায়ের ওপর দয়া কর। করবিনি, বাবা?

পেভেল মায়ের কোমল-কাতর কথাগুলি কান পেতে শোনে। পিতার জীবদ্দশায় মা ছিলেন নির্যাতিত, উপেক্ষিত, ভীতা…সে কথা মনে পড়ে। পিতার ভয়ে বাইরে বাইরেই ঘুরতো বলে মা যেন তার কাছে প্রায় অপরিচিতই রয়ে গেছেন। আজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাইলো। লম্বা, ঈষৎ নম্র দেহ দীর্ঘবর্ষব্যাপী শ্রমে এবং স্বামীর নির্যাতনে তা যেন ভেঙে পড়েছে…চলেন নিঃশব্দে, একদিকে ঈষৎ হেলে সর্বদা যেন কোন কিছু থেকে আঘাত পাবার ভয়। প্রশস্ত গোলগাল মুখ…কপালে চিন্তার রেখা…বাধক্যে চর্ম লোল…এক জোড় কালো চোখ উদ্বেগ এবং বিষাদে ভরা…ডান ভুরুতে একটা গভীর কাটা দাগ, ফলে ভুরুটা যেন একটু উঁচুতে ঠেলে উঠেছে… ডান কানটাও একটু লম্বা বাম কানটার চাইতে দেখলে মনে হয়, কান যেন কি শুনবে এই আতঙ্কে উন্মুখ! গভীর কালো চুলের মাঝে মাঝে সাদা সাদা গুচ্ছ, যেন সেগুলি আঘাতের চিহ্ন। কোমল, করুণ বাধ্য…এই মা। দু’চোখ দিয়ে তার জল গড়ায় ধীরে ধীরে।

ছেলে কোমল অনুনয়-ভরা কণ্ঠে বললো, চুপ কর, মা, কেঁদোনা, আমায় জল দাও।

মা উঠলেন, বললেন, বরফজল এনে দিচ্ছি।

কিন্তু মা যখন ফিরলেন তখন সে নিদ্রিত।

পান-পাত্র টেবিলের ওপর রেখে মা নীরবে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

বাইরে মজুরদের মাতলামি-ভরা সঙ্গীত, গালাগালি এবং চীৎকার।

আবার দিন বয়ে চললো তেমনি একটানা সুরের মতো…শুধু এ বাড়ি থেকে আগের সে মাতলামি, সে অশান্তি লোপ পেতে লাগলো। পল্লির অন্যান্য বাড়ি থেকে একটু স্বতন্ত্র হয়ে উঠলো।

বাড়িখানি পন্সির এক-প্রান্তে, একটু ঢালু জায়গায়। তিনটি কামরা, …একটি রান্নাঘর, একটি ছোট কুঠরি…মায়ের শোবার ঘর, রান্নাঘর থেকে একটি ছাদ পর্যন্ত উঁচু পার্টিশনে ভিন্ন করা…ঘরের মাত্র এক তৃতীয়াংশ জুড়ে এই দুটো কামরা। বাকিটা একটা চৌকো কামর, তাতে দু’খানা জানালা, কোনায় পেভেলের বিছানা, তার সামনে একটা টেবিল, দু’খানা বেঞ্চি, কয়েকখানা চেয়ার, একটা ছোট আরশিওয়ালা হাত-পোয়র পাত্র, একটা ট্রাঙ্ক, একটা ঘড়ি এবং দু’টো আইকন।

অন্যান্য সবাই যেমন দিন কাটায়, পেভেলও চেষ্টা করেছিলো তেমনি ভাবে দিন কাটাতে। একজন যুবক যা’ করে থাকে, সব-কিছু সে করলো…একটা বেহালা কিনলো, সার্ট, রঙীন নেকটাই, জুতো, ছড়ি-কোন কিছুই আর তার বাদ রইলো না। বাহ্যত সে সমবয়সী অন্যান্য ছেলেদেরই তো…সান্ধ্যভোজে যায় …নাচে…মদ খায়, তারপর মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে, বুক জ্বলে, মুখ-চোখ মলিন হয়, আবার মা প্রশ্ন করেন, কালকের দিন ভালো কাটলো, বাবা?

ক্ষুব্ধ বিরক্ত হয়ে সে বলে ওঠে, ও গোরস্থানের মতো নীরস সবাই যেন এক-একটা মেশিন…তার চেয়ে মাছ ধরতে কি শিকার করতে যাবো।

কিন্তু তার মাছ ধরাও হয়ে উঠলোনা, শিকার করাও হয়ে উঠলো না।

ধীরে ধীরে সে সকলের চলা-পথ ত্যাগ করে অন্য এক পথে এসে দাঁড়ালো। মজলিসে যাওয়া তার ক্রমশ কমে এলো। ছুটির দিন যদিও সে কোথাও বেরিয়ে যায়, কিন্তু আর কখনো মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে না। মা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেন, ছেলের চোখ-মুখ যেন কি একটা অনুপ্রেরণায় ক্রমশ গম্ভীর, কঠিন, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে যেন সবসময়ই তার মন জ্বলছে কোনো কিছুর ওপর ক্রোধে …অথবা যেন একটা গোপন ক্ষত অহর্নিশ তাকে খোঁচাচ্ছে। বন্ধুরা আসতো প্রথম প্রথম…কিন্তু কোনোদিন তাকে বাড়ি না পেয়ে আসা ছেড়ে দিলো। মা ছেলের এই স্বাতন্ত্র দেখে খুশিও হলেন, শঙ্কিতও হলেন। ছেলে এদিকেও টলছে না, ওদিকেও টলছে না, রুটিন-বাঁধা জীবনও তার নয় সে চলেছে দৃঢ় নিষ্ঠায়, অটুট সংকল্পে কোন এক গোপন পথে…তাই মায়ের শঙ্কা।

বাড়িতে সে বই নিয়ে আসতে লাগলো। প্রথম প্রথম সে লুকিয়ে পড়তো, পড়ে লুকিয়ে রাখতো… মাঝে মাঝে বই থেকে অংশবিশেষ কাগজে নকল করে কাগজখানাও লুকিয়ে ফেলতো। মা-ছেলেতে কথাবার্তা বড় একটা হত না। দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় হাত-মুখধুয়ে খাওয়া শেষ করে ছেলে বই নিয়ে বসতে, অনেক রাত পর্যন্ত পড়া চলতে। ছুটির দিনে ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো, ফিরতে অনেক রাতে। তার ভাষা মার্জিত হতে লাগলো, মা তার মুখে নতুন অজানা শব্দ শুনে অবাক হয়ে যেতেন। মায়ের শঙ্কা বাড়তো। ছেলে বই আনে, ছবি আনে, ঘর সাজায়, ফিটফাট হয়ে থাকে। মাতলামি নেই, গালাগালি নেই। ছেলে কি সন্ন্যাসী হল?…খুব সম্ভব শহরের কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তাই বা কি করে হবে? তাতে তো মা টাকা দরকার…ছেলে প্রায় সব টাকাই তো এনে মায়ের হাতে দেয়।…

এমনি করে দু বছর কাটলো।

.

একদিন সান্ধ্যভোজের পর পেভেল ঘরের এক কোনে বসে পড়ছে… মাথার ওপর কেরোসিনের ল্যাম্প ঝুলছে…রান্নাঘরের বাসন-পত্র মুক্ত করে মা সন্তর্পণে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ছেলে মাথা তুলে নিঃশব্দে প্রশ্ন-ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাইলো।

কিছু না পাশা! এমনি এলুম,-তাড়াতাড়ি চলে গেলেন না এই কথা বলে, কিন্তু চোখে তার উদ্বেগের সুস্পষ্ট ছাপ। এক মুহূর্ত রান্নাঘরে স্থির, চিন্তামগ্ন, অভিনিবিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফেলে আবার ছেলের কাছে এলেন, বললেন মৃদু-কোমল সুরে, একটা কথা জিগ্যেস করতে চাই, বাবা, দিনরাত সব সময় কেবল পড়িস কেন?

বইথানা একপাশে সরিয়ে রেখে পেভেল বললো, মা, বোসো। মা ছেলের পাশে বসলেন তার দেহ ঋজু হয়ে উঠলো, ভীষণ একটা-কিছু শোনার বেদনাময় উৎকণ্ঠায়। তার দিকে না চেয়েই পেভেল ধীরে কিন্তু দৃঢ়তা-মাখনো সুরে বলতে লাগলো, আমি নিষিদ্ধ বই পড়ছি। এ বই নিষিদ্ধ-কারণ এতে মজুর-জীবনের খাটি ছবি আঁকা। এ বই ছাপা হয় গোপনে…আর আমার কাছে এ বই আছে, এ যদি প্রকাশ পায়, তাহলে আমার জেল হবে—আমার জেল হবে আমি সত্যি জানতে চাই এই অপরাধে।

মার যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো বড় বড় চোখ মেলে ছেলের দিকে তিনি চাইলেন…মনে হল, এ যেন সে ছেলে নয়, এ নতুন… অপরিচিত। ছেলের জন্য দরদে তাঁর বুক ভরে উঠলো, কেন এমন কাজ করিস, বাবা?

মার দিকে চেয়ে শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে পেভেল বললো, আমি সত্য জানতে চাই, মা।

ছেলের শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠস্বরে রহস্য-সংকুল ভীষণ কি একটা সংকল্পের সাড়া পেয়ে মা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তার চোখে নীরব অশ্রু দেখা দিলো।

কেঁদোনা মা।-পেভেলের মৃদু দরদ-ভরা কণ্ঠ মার কানে এসে ঠেকলো বিদায়-বাণীর মতো। পেভেল বলতে লাগলো, মা, ভেবে দেখ দেখি, এ কি জীবন কাটাচ্ছ তুমি! তোমার বয়স চল্লিশ বছর…কিন্তু বাঁচার মতে বাঁচা কি একটা দিনও বেঁচেছ তুমি? বাবা তোমাকে মারতেন। আমি আজ বুঝি, তাঁর জীবন-ভরা দুঃখের ঝাল ঝাড়তেন তোমার গায়ে…দুঃখ তাকে পিষ্ট করে ফেলতো, কিন্তু সে দুঃখের মুল কি, তা তিনি জানতেন না। তিরিশ বছর খেটে গেছেন। কারখানায় যখন সবেমাত্র দু’টি দালান, তখন থেকে তিনি খাটতে শুরু করেন… এখন সেখানে সাত-সাতটা দালান। কল সমৃদ্ধ হয়, কিন্তু মানুষ মরে…কলের জন্য খাটতে খাটতে মরে।…

আতঙ্ক এবং আগ্রহে উন্মুখ হয়ে মা শুতে লাগলেন। ছেলের চোখ জ্বলছে এক অপরূপ সুন্দর দীপ্তিতে। টেবিলের ওপর ঝুকে পড়ে, মার আরো কাছে মুখ নিয়ে তাঁর সজল চোখের দিকে চেয়ে বললো, আনন্দ তুমি কি পেয়েছে জীবনে? তোমার অতীত জীবন মনে রাখার মতো কতটুকু ছিল তাতে?

মা করুণভাবে ঘাড় নাড়তে লাগলেন…দুঃখ এবং আনন্দ মেশানো এক অজ্ঞাত নতুন ভাব তার ব্যথিত উদ্বিগ্ন অন্তরের ওপর ছড়িয়ে পড়লো শান্তি-প্রলেপের মতো। নিজের সম্বন্ধে, নিজ জীবন সম্পর্কে এমন কথা এই প্রথম কানে এলে তাঁর। যৌবনে তার মনেও একদিন আকাঙ্ক্ষা, অতৃপ্তি, বিদ্রোহ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তা বহুদিন হল নিঃশেষে চাপা পড়ে গেছে। আজ যেন সেই আগুন নতুন করে উসকে উঠছে। চিরদিন তারা শুধু দুঃখের অভিযোগই করে এসেছে কিন্তু এ দুঃখের কারণ কি, প্রতিকারই বা কি…তা’ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। আজ সে সমস্যার সমাধান করবার মহৎ সংকল্প নিয়ে দাঁড়িয়েছে তার ছেলে… গৌরবে, আনন্দে তাঁর বুক ভরে উঠলো…ছেলের বক্তৃতার মাঝখানে বলে উঠলেন, তা, কি করতে চাও তুমি?

পাঠ করতে হবে এবং পড়ে অন্যকে শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের মজুরদের পাঠ করা অত্যন্ত দরকার আমাদের শিক্ষা করতে হবে, বুঝতে হবে, জীবন কেন আমাদের পক্ষে এত দুর্বহ।

মার বলতে ইচ্ছা হ’ল বাছা, তুমি কি করবে? ওরা যে তোমায় পিষে ফেলবে! তোমার প্রাণ যাবে। কিন্তু ছেলের আনন্দের উচ্ছ্বাসে বাধা দিতে সাহস হল না। ছেলে অগ্নিগর্ভ ভাষায় মনের জ্বালা ব্যক্ত করে যায়, মা সচকিত হয়ে নিম্নস্বরে সুধোন, তাই নাকি, পাশা?

হাঁ, মা-ছেলে দৃঢ়স্বরে জবাব দেয়। তারপর মাকে সে বলে সেই সব লোকের কথা, যারা চান শুধু মানুষের মঙ্গল, যারা চান শুধু মানুষের … অন্তরে সত্যের বীজ বপন করতে…এবং এই অপরাধে তারা পশুর মতো হত হন…জেলে যান, নির্বাসন-দণ্ড ভোগ করেন, সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন…মানুষের দুশমন যারা তাদের হাতে। আবেগের সঙ্গে বলে, এমন সব লোক আমি দেখেছি, মা…এঁরা দুনিয়ার সেরা লোক।

মা আবার বলতে যান, তাই নাকি, পাশা? কিন্তু বলা হয় না। তার ছেলেকে এমন সব বিপজ্জনক কথা বলতে শিখিয়েছে যারা, তাদের গল্প শুনে শঙ্কিত হতে থাকেন। ছেলে মার হাত ধরে প্রগাঢ় স্বরে ডাকে, ‘মা!’ মা বিচলিত হন। বলেন, আমি কিছু করবনা বাছা, শুধু তুই সাবধানে থাকিস…সাবধানে থাকি।

কিন্তু কি হতে সাবধানে থাকবে, তা খুঁজে না পেয়ে বলে ফেলেন, তুই বড় রোগা হয়ে যাচ্ছিল। তারপর তার স্নেহ-ভরা দৃষ্টি দিয়ে পুত্রের সুগঠিত দেহখানি যেন আলিঙ্গন করে বলেন, তুই যেমন খুশি চল, আমি বাধা দেবো না, বাবা। শুধু একটা কথা মনে রাখিস আমার, অসতর্ক হয়ে কথা বলিস না…লোকদের নজরে নজরে রাখিস …ওরা সবাই পরস্পরকে ঘৃণা করে অন্যের অনিষ্ট করে খুশি হয়…নিছক আমোদর লোভে মানুষকে পীড়া দেয় যেই তাদের দোষ দিতে যাবি, বিচার করবি, অনি তারা তোকে ঘৃণা করবে,তোর সর্বনাশ করবে।…

দুয়ারের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পেভেল মায়ের এই বেদনাময় অভিজ্ঞতার উপদেশ শুনলো। তারপর মার কথা শেষ হলে বললো, জানি, মা, কী শশাচনীয় এই মানুষের দল! কিন্তু যেদিন উপলব্ধি করলুম, পৃথিবীতে একটা সত্য আছে, মানুষ আমার চোখে নতুনতর, সুন্দরতর শ্রীতে দেখা দিলো। শৈশবে আমি মানুষকে শিখেছিলুম ভয় করতে, একটু বড় হয়ে করেছি ঘৃণা…আজ নতুন চোখে দেখছি সবাইকে…সবার জন্যই আজ আমি দুঃখিত। কেন জানিনা, আমার হৃদয় কোমল হয়ে এলো যখন আমি বুঝলুম, মানুষের ভিতর একটা সত্য আছে, পাপ এবং পঙ্কিলতার জন্য সকল মানুষই দায়ী নয়।…

বলতে বলতে পেভেলের কণ্ঠ নীরব হয়… কান পেতে যেন শোনে প্রাণের ভিতরের কি এক অস্ফুট বাণী, তারপর চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলে ওঠে…এমনি করেই সত্য বেঁচে থাকে।

পেভেল ঘুমোয়, মা তাকে আশীর্বাদ করে নিজের ঘরে চলে যান।

.

১.০৩

মাঝ হপ্তায় এক ছুটির দিনে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেভেল মাকে বলে, মা, শনিবার জনকয়েক লোক আসার কথা আছে এখানে।

কারা?

দু’চারজন এ পল্লিরই লোক…বাকি আসবে শহর থেকে।

শহর থেকে? মাথা নেড়ে মা বললেন, পরক্ষণেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

পেভেল ব্যথিত হয়ে বললো, এ কি মা, কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?

জামার হাতায় ছোখ মুছে মা বললেন, জানি না, কান্না পাচ্ছে।

ঘরের এদিক-ওদিক পায়চারি করে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে পেভেল প্রশ্ন করলো, ভয় পাচ্ছ, মা?

মা ঘাড় নাড়লেন, শহরের লোক, কে জানে কেমন!…

পেভেল নীচু হয়ে মার দিকে চাইলো, তারপর ঈষৎ আহত এবং ক্রুদ্ধভাবে বললো, এই ভয়ই আমাদের সর্বনাশের মুল যারা কর্তা তারা এই ভয়কে ষোলো-আনা কাজে লাগায়…আমাদের উত্তরোত্তর ভীত করে তোলে। শোন, মা…মানুষ যতদিন ভয়ে কাঁপবে, ততদিন তাকে পচে পচে মরতে হবে…আমাদের সাহসী হতে হবে, আজ সেদিন এসেছে।

তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ভয় খাও, আর যা কর, তারা আসবেই।

মা করুণভাবে বললেন, রাগ করিসনি বাবা, কি করে ভয় না পেয়ে থাকি বল…চিরটা জনম আমার ভয়ে ভয়েই কেটেছে।

ছেলে আরও নরম হয়ে বলে, ক্ষমা কন, মা, কিন্তু আমি বন্দোবস্ত বদলাতে পারব না।

.

তিনদিন ধরে মার প্রাণে কাঁপুনি…ভাবেন, যারা আসছে বাড়িতে, না জানি তারা কী ভয়ংকর লোক…তার গা শিউরে ওঠে।

শেষে শনিবার এলো। রাত্রে পেভেল মাকে বললো, মা, আমি একটু কাজে বেরুচ্ছি, ওরা এলে বসিয়ে, বলল, এক্ষুণি আসছি। আর ভয় খেয়ো না; তারাও অন্য সবারই মতো মানুষ।

মা প্রায় মূর্ছিত হয়ে চেয়ারে বসে পড়েন।

.

বাইরে জমাট-বাঁধা অন্ধকার। কে যেন তার মধ্য দিয়ে শিষ দিতে দিতে এগোচ্ছে শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হয়ে জানালার কাছে এসে পড়লো… পায়ের শব্দ শোনা গেলো…মা ভীত চকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন…দোর খুলে গেলে প্রথমে দেখা গেলো, একটি প্রকাণ্ড হ্যাট, তলায় অবিন্যস্ত কেশগুচ্ছ…তারপরে ঢুকলো একটি ক্ষীণ আনতদেহ…দেহকে ঋজু করে ডান হাত তুলে আগন্তুক অভিবাদন করলো, নমস্কার।

মা নীরবে প্রত্যভিবাদন জানিয়ে বললেন, পেভেল ফেরেনি এখনো।

নবাগত নিরুত্তরে নিরুদ্বিগ্নভাবে লোমের কোটটা ছেড়ে রেখে গা থেকে পুঞ্জিত তুষার ঝেড়ে ফেলতে লাগলো। তারপর চারদিক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে টেবিলের ওপর আরাম করে বসে মার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো, এটা কি ভাড়াটে-বাড়ি, না আপনাদের নিজেদের?

ভাড়াটে।

বাড়িটা তো বিশেষ ভালো না।

পাশা এক্ষুণি আসবে, বসো।

বসেছি তো। আচ্ছা, মা, তোমার কপালে ও দাগটা কে করে দিলে?

প্রশ্নকর্তার ঈষৎ হাস্য এবং প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে আহত হয়ে মা একটু কঠিন সুরে বললেন, তা দিয়ে তোমার দরকার কি?

রাগ করো না, মা। আমার মার কপালেও অমন একটা দাগ ছিল;…তাঁর মুচি স্বামী লোহার ফর্মা দিয়ে আঘাত করেছিল কি না…ইনি ছিলেন ধোপানি, উনি ছিলেন মুচি…মাকে যে কী মার মারতেন…ভয়ে আমার গায়ের চামড়া যেন ফেটে যেতে চাইতো।

মা’র রাগ জল হয়ে গেলে এ কথায়। এরপর দুজনের আলাপ জমে উঠলল। মা ভাবলেন, এর মধ্যে যদি আর সবাই হয়!

আগন্তুকের নাম এণ্ড্রি।

এণ্ড্রির পর এলো একটি মেয়ে–ন্যাটাশা। মাঝারি চেহারা, মাথাভরা ঘন কালো চুল, সাধারণ পোশাক, হাসিমুখ, মধুর স্পষ্ট কণ্ঠ, স্বাস্থ্য নিটোল দেহ, নিবিড় নীল দুটি চোখ…মার প্রাণ খুশিতে, স্নেহে ভরে উঠলো…মনে হল, এ যেন তারই হারিয়ে-যাওয়া মেয়ে আবার তার কোলে ফিরে এসেছে।

এর পরে এলো নিকোলাই–মজুর-পল্লির নামজাদা চোর বৃদ্ধ দানিয়েলের ছেলে। মা অবাক হয়ে বললেন, তুমি, এখানে?

পেভেল বাড়ি আছে?

না।

নিকোলাই তখন ঘরের দিকে চেয়ে বললে, সুপ্রভাত কমরেড।

ন্যাটাশা হাসিমুখে নিকোলাইর করমর্দন করলেন।

মা অবাক হয়ে গেলেন, নিকোলাইও তবে এই দলে আছে।

এর পরে এলো ইয়াকোভ–কারখানার পাহারাদার শোমোভের ছেলে। তার সঙ্গে আর একটি ছেলে—সেও অপরিচিত কিন্তু ভীষণ-দর্শন নয়।

সব্বার শেষে এলো পেভেল–কারখানার দু’জন মজুরকে সঙ্গে নিয়ে।

মা ছেলেকে প্রশ্ন করলেন ধীরে ধীরে, এরাই কি তোর সেই বেআইনী সভার লোক?

হাঁ, বলে পেভেল কমরেডদের কাছে চলে গেলো। মা মনে মনে বলতে লাগলেন, বলে কি, এরা তো দুধের ছেলে!

ঘরের মধ্যে ততক্ষণ মজলিস বসে গেছে। আগন্তুকদল টেবিলের চারদিকে উন্মুখ হয়ে বসেছে। এককোনে ল্যাম্পের নীচে ন্যাটাশা একখানা বই খুলে পড়ছে, মানুষ কেন এমন হীনভাবে জীবন-যাপন করে বুঝতে হলে…

—এবং মানুষ কেন এত হীন হয় বুঝতে হলে…এণ্ড্রি জুড়ে দিলো।

আগে দেখতে হবে, কেমন ভাবে তারা জীবন-যাত্রা শুরু করেছিল…

বই থেকে ন্যাটাশা সেই আদিম অসভ্যদের জীবন-যাত্রা-প্রণালী, তাদের গুহাবাস, পাথরের অস্ত্রে শিকার প্রভৃতির সরল বর্ণনা পড়ে যেতে লাগলো। মা ভাবলেন, এতে বুনো লোকদের গল্প, এতে আবার বে-আইনী কি আছে!

হঠাৎ নিকোলাইর অসন্তুষ্টি-ভরা কণ্ঠ বেজে উঠলো, ওসব যাক। মানুষ কেমন করে জীবন কাটিয়েছে তা শুনতে চাইনা…শুনতে চাই, মানুষের কি রকম ভাবে বাঁচা উচিত।

হাঁ, তাইতো।—লাল-চুলওয়ালা একটি লোক সায় দিলো।

ইয়াকোভ প্রতিবাদ করে বললো, যদি আমাদের সামনে এগোতে হয়, তবে আমাদের সবকিছু জানতে হবে।

নিশ্চয়ই–কোকড়া চুলওয়ালা একজন ইয়াকোভকে সমর্থন করলো।

পলকে বিষম তর্কাতর্কি শুরু হ’ল, কিন্তু অশ্লীল অন্যায় ভাষা কারু মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না। মা ভাবলেন, ওই মেয়েটি আছে বলেই ওরা সামলে চলছে।

সহসা ন্যাটাশা বলে উঠলো, থামো, শোন ভাইসব।

পলকে সবাই নীরব, ন্যাটাশার দিকে নিবদ্ধ-চক্ষু।

ন্যাটাশা বললো, যারা বলে আমাদের সবকিছুই জানা উচিত, তারাই ঠিক বলছে। যুক্তির দীপ-শিখায় চলার পথ আলোকিত করে নিতে হবে আমাদের–অন্ধকারে যারা আছে, তারা যাতে আমাদের দেখতে পায়। প্রত্যেকটি প্রশ্নের সাধু এবং সত্য জবাব দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের থাকা চাই। যা কিছু সত্য এবং যা-কিছু মিথ্যা,…সবার সঙ্গেই আমাদের পরিচয় থাকা দরকার।

ন্যাটাশা চুপ করলে পেভেল উঠে বললো, আমাদের একমাত্র কাম্য কি পেট বোঝাই করা?

তারপর নিজেই জবাব দিল, না। আমরা চাই মানুষ হতে। যারা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আমাদের চোখ ঢেকে রেখেছে, তাদের আমরা দেখাবো, আমরা সব দেখি, আমরা বোকা নই, পশু নই, শুধু আহার করতে চাই না, আমরা বাঁচতে চাই মানুষের মতো মানুষ হয়ে। আমাদের শত্রুদের আমরা দেখাব যে, বাইরে আমরা কুলিমজুর, শ্রমদাস যা হই না কেন, বুদ্ধিবৃত্তিতে আমরা তাদের সমান, আর প্রাণশক্তিতে, তেজে, বীর্যে আমরা তাদের চাইতেও ঢের বেশি শ্রেষ্ঠ।

মার বুক ছেলের বাগ্মীতায় স্ফীত হয়ে উঠলো।

এণ্ড্রি, বললো, দেশে আজ ভুড়ির ছড়াছড়ি, সাধু লোকেরই আকাল। এই পচা জীবনের জলাভূমি থেকে এক সেতু গড়ে আমাদের যাত্রা করতে হবে মঙ্গলময় ভবিষ্যতের অভিমুখে। বন্ধুগণ, এই আমাদের ব্ৰত,—এই আমাদের করতে হবে।

দুপুর রাতে মজলিস ভাঙলো, যে যার ঘরে চলে গেলো।

মা বললেন, এণ্ড্রি, লোকটি কিন্তু বেশ। আর ওই মেয়েটি, কে ও?

জনৈক শিক্ষয়িত্রী।

আহা হা, গরম কাপড়চোপড় একদম নেই, ঠাণ্ডা লাগবে যে। ওর আপনার জনেরা কোথায়?

মস্কোতে। ওর বাবা বড়লোক, লোহার কারবার, মেলাই টাকা। ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এই দলে ভিড়েছে বলে। বড়লোকের আদরিণী মেয়ে, সুখ-সম্পদে লালিত। যা চাইতো তা পেত, কিন্তু আজ সে একা, অন্ধকার রাতে পায়ে হেঁটে চার মাইল পথ চ’লে যায়।

মার প্রাণ পলকে ভারি হয়ে উঠলো, বললেন, শহরে যাচ্ছে?

হাঁ।

ভয় করে না ওর?

না।

কেন গেলো? এখানে তো থাকতে পারতো, আমার সঙ্গে শুতে।

তা হয় না। কাল সকালে উঠে সবাই দেখতো। আমরা তা চাই না, ও-ও চায় না। …

মার মনে সেই আগেকার উদ্বেগ জেগে উঠলো, বসলেন, কিন্তু আমিতো বুঝতে পাচ্ছিনা পেভেল, এর ভিতর বিপজ্জনক বা অন্যায় কি আছে? তোরা তো আর খারাপ কিছু কচ্ছিস না।

শান্তভাবে মায়ের দিকে চেয়ে স্থির কণ্ঠে পেভেল জবাব দিলো, আমরা যা করছি, তাতে খারাপ কিছু নেই, খারাপ কিছু থাকবেও না; কিন্তু তবু আমাদের জেলে যেতে হবে।

মার হাত কেঁপে উঠলো। বসা গলায় তিনি বললেন, ভগবান তোমাদের যে ক’রে হ’ক রক্ষা করবেনই।

না, মা, তোমায় আমি মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারি না; রক্ষা আমরা কিছুতেই পাবোনা।…

মাকে শুতে বলে ছেলে চলে গেলে নিজের কামরায়।

মা একা জানালার কাছটিতে এসে বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন। তুষারে-ছাওয়া পথ, ঝড়ে-হাওয়ার অবিরাম মাতামাতিতারপরেই একটা খোলা মাঠ…সাদা তুষার রাশি,…তার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে শিমুল তুলোর মতো ঘন ধারায় বাতাস প্রলয়-বাঁশি বাজিয়ে যায়। মা দেখলেন, তারই মধ্য দিয়ে একা চলেছে ন্যাটাশা…তার পোশাক বাতাসে দাপাদাপি করছে, পা ব’সে যাচ্ছে, মুখে-চোখে কে যেন মুঠো মুঠো তুষার ছুঁড়ে মারছে–ন্যাটাশা এগোতে পারছে না, ঝড়ের মুখে একগাছি কুশের মতো সে নুয়ে শুয়ে পথ বেয়ে চলেছে। ডানে তার কৃষ্ণাভ অরণ্য-প্রাচীর, নগ্নপত্রহীন গাছগুলি যেন বাতাসে ব্যথিত হয়ে আর্তনাদে চারিদিক পূর্ণ করে তুলেছে। দূরে… শহরের ক্ষীণাতিক্ষীণ আলো।

কী এক অভূতপূর্ব আতঙ্কে শিউরে উঠে’ মা ঊর্ধ্বে চেয়ে প্রার্থনা জানান, ভগবান, রক্ষা করো।

.

১.০৪

এমনি ক’রে দিন কাটে। ফি শনিবারে দলের লোকেরা পেভেলের বাড়িতে এসে মজলিস করে আর এক-এক ধাপ ওপরে ওঠে…কিন্তু কোথায়, কতদুরে গিয়ে এ সিঁড়ি শেষ হয়েছে, কেউ তা জানে না। রোজ নয়া-নয়া লোক আসে, পেভেলের কামরায় আর তিলধারণের স্থান থাকেনা! ন্যাটাশাও আসে, তেমনি শ্রান্ত, ক্লান্ত কিন্তু যৌবনমদে তেনি জীবন্ত, পরিপূর্ণ। মা তার জন্য মোজা বোনেন, নিজের হাতে তার পায়ে পরিয়ে দিয়ে মাতৃস্নেহে তাকে অভিষিক্ত করেন। ব্যাটাশ প্রথমটা হাসে, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কি ভাবে। স্নিগ্ধ ধীর কণ্ঠে মাকে বলে, আমার এক ধাই…সেও আমায় এমনি ভাসতে।…কী আশ্চর্য মা, কুলি-মজুরের এতো দুঃখ-সংকুল অত্যাচারিত জীবন…তবু তাদের মাঝে যেটুকু প্রাণ আছে, যতটুকু সাধুতা আছে, তা ওদের মধ্যে নেই—বলে হাত তুলে সে দুরদুরান্তরের কাদের নির্দেশ করে।

মা বললেন, কিন্তু, মা, কেন তুমি নিজের আত্মীয়স্বজন সুখ-সাধ সব ত্যাগ করে এসেছে?

ম্লান হাস্যে ন্যাটাশা বলে, আত্মীয়স্বজন, সুখ-সাধ…কিছু নয় মা! শুধু মার কথা ভেবে কষ্ট হয়…তোমারই মতো সে…মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তাঁকে দেখি।

মা মাথা নেড়ে দুঃখিত কণ্ঠে বলেন, আহা, বাছা আমার!

ন্যাটাশা কিন্তু জবাবে খিলখিল করে হেসে ওঠে, বলে, না, মা, দুঃখ কোথায়! মাঝে মাঝে এতো আনন্দ, এতো সুখ আমি পাই…বলতে বলতে তার মুখ প্রশান্ত হয়, তার নীল চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মার কাঁধে হাত রেখে স্বপ্নবিষ্টর মতো শান্ত, আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষায় বলে, যদি জানতে, মা, যদি বুঝতে কী মহা কী আনন্দময় কাজ আমরা করে যাচ্ছি—একদিন বুঝবে!

মার যেন ঈর্ষা হয় স্যাটাশার ওপর, বলেন, আমি বুড়ো, বোকা, কিই বুঝি।

পেভেলের বক্তৃতা ক্রমশ বাড়ে। আলোচনার সুর ক্রমশ চড়তে থাকে…আর তার শরীর হয় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সে যখন ন্যাটাশার সঙ্গে কথা কয়, মা দেখেন যেন তার কণ্ঠ মধুর, তার দৃষ্টি কোমল, তার সমস্ত চেহারা সহজ সরল হয়ে আসে। ন্যাটাশাকে পুত্রবধুরূপে কল্পনা করে মা অন্তরে অন্তরে পুলকিত হয়ে ভগবানকে বলেন, তাই কবরী ঠাকুর।

আলোচনার সুর যখন সপ্তমে ওঠে, এণ্ড্রি সটান দাঁড়িয়ে তাদের কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

তর্কাতর্কি বাঁধাবার প্রধান পাতা নকোলাই। তার দলে শ্যামোয়লোভ, আইভান বুকিন এবং ফেদিয়া মেজিন। ইয়াকোভ, পেভেল, এণ্ড্রি অন্য দলে।

মাঝে মাঝে ব্যাটার বদলে আসেন অ্যালেক্সি আইভানোভিচ। তার আলোচ্য বিষয় অতি সাধারণ—পারিবারিক জীবনযাত্রা, ছেলেপিলে, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিস, রুটি ও মাংসের দাম, এইসব…প্রত্যেকটা জিনিসে তিনি দেখতে পান জাল-জুয়াচুরি, বিশৃঙ্খলা, বোকামি। মাঝে মাঝে তা নিয়ে ঠাট্টাও করেন, কিন্তু সবসময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, মানুষের জীবন এসবের ফলে কতো অসহজ এবং অসুবিধাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আর একটি মেয়েও প্রায়ই আসে শহর থেকে। নাম তার শশেংকা, লম্বা সুগঠিত দেহ, পাতলা গম্ভীর মুখ, সমস্ত অঙ্গ দিয়ে যেন একটা তেজ ফুটে বেরুচ্ছে, কী এক অজ্ঞাত রোষে যেন তার কালো ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। যখন কথা বলে, পাতলা নাকের পাতা কাঁপতে থাকে, সে-ই প্রথম উচ্চারণ করলো, আমরা সোশিয়ালিস্ট। রুদ্র, রুক্ষ তার কণ্ঠ।

মা শুনেই নির্বাক আতংকে মেয়েটির দিকে চাইলেন, কিন্তু শশেংকা চক্ষু অর্ধ-মুদ্রিত করে দৃঢ়-কঠিন কণ্ঠে বললো, এই নবজীবন গঠন-ব্রতে আমাদের সমগ্র শক্তি দান করতে হবে-আর আমাদের একথাটা বুঝতে হবে যে, এ দানের কোনো প্রতিদান আমরা পাবো না।

সোসিয়ালিস্ট কথাটার সঙ্গে মা পরিচিত। বাল্যে গল্প শুনতেন, চাষাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়ায় জমিদাররা জারের ওপর রেগে গিয়ে পণ করেন, জারের মুণ্ডচ্ছেদ না করে চুল ছাঁটবে না। এরাই নাকি সোশিয়ালিস্ট, এরাই তখন জারকে খুন কয়ে। তবে তাঁর ছেলে এবং এর সব সেই সোশিয়ালিস্ট হল কি করে?

সব চলে গেলে ছেলেকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, রে, তুই কি সোশিয়ালিস্ট?

হাঁ। কেন বলতো, মা?

দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে চোখ নামিয়ে মা বললেন, পাভলুশ, তোর জারের বিরুদ্ধে কেন? একজন জারকে তারা খুন করেছিলো।

পেভেল পায়চারি করতে করতে হেসে বললো, কিন্তু আমরা ও করতে চাই না, মা। মাকে বহুক্ষণ ধরে ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বোঝালো। মা তার মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলতে লাগলেন, পেভেল কোনো খারাপ কাজ করবে না—করতে পারে না।

কিন্তু শশেংকার ওপর মা তেমন খুশি নন। কথা প্রসঙ্গে এণ্ড্রিকে একদিন বললেন, শশেংকা কি কড়া মেয়ে, বাবা! খালি হুকুম, এ করে, ও করো।

এণ্ড্রি, হেসে বললে, তুমি ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছ, মা।

পেভেল নীরস কণ্ঠে বললো, কিন্তু সে মেয়ে ভালো।

এণ্ড্রি বললো, একশোবার…শুধু সে এইটে বোঝে না যে…

তারপরেই দু’জনের মধ্যে যে তর্কাতকি শুরু হল, মা তার খেই ধরতে পারলেন না।

মা লক্ষ্য করতেন, শশেংকা পেভেলের সঙ্গে এত রূঢ় ব্যবহার করে, এমনকি মাঝে মাঝে তিরস্কারও করে, তবু পেভেল কিছু বলে না, চুপ করে থাকে, হাসে, গাটাশার দিকে যেমন করে চাইতে তেমনি করে তার দিকে চায়। এটা মা সইতে পারতেন না।

মজলিসের বৈঠক ঘন ঘন, হপ্তায় দু’দিন করে চলতে লাগলো। নতুন নতুন গানের আমদানি হল…সুরের মধ্য দিয়ে ফুটে বেরুতে লাগলো এক দুর্দমনীয় শক্তি। নিকোলাই গম্ভীরভাবে বলতে, এবার রাস্তায় বেরিয়ে এ গান গাইবার সময় এসেছে।

মাঝে মাঝে তারা আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে বিদেশী শ্রমিক ভাইদের জয়-যাত্রার সংবাদে। তাদের নামে জয়ধ্বনি করে, তাদের অভিনন্দিত করে চিঠি পাঠায়, দুনিয়ায় যেখানে যত শ্রমিক আছে, তাদের সঙ্গে নিজেদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বদ্ধ মনে করে, তাদের সঙ্গে আত্মীয় স্থাপন করে।

মার চিত্তও ধীরে ধীরে এইভাবে উহুদ্ধ হয়ে ওঠে! এণ্ড্রি কে সম্বোধন করে একদিন তিনি বলেন, কি মজার লোক তোমরা! কোথাকার কোন্ অর্মেণিয়ান, ইহুদী,অস্টিয়ান…সব তোমাদের কমরেড…সবাইকে বল তোমরা বন্ধু সবার জন্য দুঃখ কর, সবার সুখে উৎফুল্ল হও।

এণ্ড্রি বললো, সবার জন্যই আমরা দাঁড়িয়েছি, মা! এই দুনিয়াটা আমাদের শ্রমিকদের…আমাদের কাছে কোন জাতি নেই, কোন বর্ণ নেই—আমাদের কাছে আছে শুধু মিত্র এবং শক্র। দুনিয়ার নিখিল শ্রমিক আমাদের কমরেড। ধনী এবং কর্তারদল আমাদের দুশমন… দুনিয়ার দিকে যখন চেয়ে দেখি, শ্রমিক আমরা কতো অসংখ্য, কী বিপুল আমাদের প্রাণশক্তি, তখন হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে, সুখে উদ্বেল হয়, বুকের মধ্যে উৎসবের বাঁশি বাজতে থাকে। ঐ ফরাসী শ্রমিক, জার্মান শ্রমিক, ইতালিয়ান শ্রমিক জীবনের দিকে যখন চায়, ওরাও এমনিভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। একই মায়ের সন্ততি আমরা, বিশ্বের সকল দেশের সকল শ্রমিকের ভ্রাতৃবন্ধনে আমাদের নবজন্ম। এই বন্ধন ক্রমশ প্রবল হচ্ছে, সূর্যের মতো আমাদের দীপ্ত করে তুলছে—এ যেন ন্যায় গগনে সমুদিত নবসূর্য এবং এ গগন শ্রমিক হৃদয়েরই অভ্যন্তরে। সে যেই হক না, যা-ই তার নাম হক, সোসিয়ালিস্ট মাত্রেই আমাদের ভাই—আজ, চিরদিন, যুগ-যুগান্ত ধরে।

মা তাদের শক্তি-দীপ্ত আননের দিকে চেয়ে অনুভব করেন, সত্যি সত্যিই বিশ্বাকাশে তার চোখের আড়ালে এক নব দীপ্তোজ্জল জ্যোতির আবির্ভাব হয়েছে…আকাশের সূর্যের মতোই যা মহান।

এমনি করে তাদের চাঞ্চল্য বেড়ে চলে। পেভেল মাঝে মাঝে বলে, একটা কাগজ বের করা দরকার।

নিকোলাই বলে, আমাদের নিয়ে কানাঘুষো চলছে পাড়ায়। এখনই সরে পড়া ভাল।

এণ্ড্রি, জবাব দেয়, কেন এতো ধরা পড়ার ভয়!

মা এণ্ড্রিকে ভালবেসে ফেলেছেন নিজের ছেলের মতো। কাজেই তিনিই একদিন প্রস্তাব করলেন পেভেলের কাছে, এণ্ড্রি এখানেই থাকুক না। তাহলে আর তোদের ওর বাড়ি ছুটাছুটি করে হয়রান হতে হয় না।

পেভেল বললে, ঝঞ্চাট বাড়িয়ে লাভ কি, মা।

ঝঞ্চাট…তাতে চিরটা জনমই পুইয়ে এসেছি… অমন ভালো ছেলের জন্য পোহানো তো বরঞ্চ সার্থক!

পেভেল বললো, তাই হক মা, এণ্ড্রি, এলে আমি সুখীই হ’ব।

কাজেই এণ্ড্রি এসে মার আর একটি ছেলে হয়ে বসলো।

.

১.০৫

নিকোলাই কিছু মিথ্যা বলেনি,–পেভেলের বাড়িটা সমস্ত পল্লির ভীতি, আতঙ্ক এবং সন্দেহের কেন্দ্র হয়ে পড়লো। চারপাশে সময়েঅসময়ে নানান প্রকৃতির লোক নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়-বাড়ির গোপন রহস্য ভেদ করবে বলে। তাড়িখানার মালিক বুড়ো একদিন মাকে পথে পেয়ে বললো, কেমন আছো গো? তোমার ছেলের খবর কি? বিয়ে দিচ্ছ না কেন? বিয়ে দিয়ে দিলেই তোমাদের পক্ষে মঙ্গল। আর বিয়ে হলে মানুষ ও সামাল থাকে। আমি হলে কবে বিয়ে দিয়ে দিতুম। কী দিন-কাল পড়েছে বোঝতে…‘মানুষ’ নামধেয় পশুটির ওপর এখন কড়া নজর রাখা দরকার। মানুষ এখন মগজ খাটিয়ে বাঁচতে চায়, চিন্তা করে করে তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এমন-সব কাজ করছে, যা দস্তুরমতো অন্যায়। গির্জায় যায় না, মেলায়-মহোৎসবে যোগ দেয় না, খালি আনাচে-কানাচে ব’সে দল পাকায় আর ফিসফাস করে। এতে ফিসফাস কেন বাপু?

ফিসফাস না করে খোলাখুলি তাড়িখানার লোকেদের সামনে দাঁড়িয়ে বলুক না—সে সাহস নেই। আমি জানতে চাই, কি এ? গোপনীয়? গোপনীয় স্থান একমাত্র পবিত্র গির্জা…অন্য-সব কোনায় ব’সে কানাঘুষ, ঘুষি ভ্রান্তি, মায়া, বুঝলে…

লম্বা বক্তৃতা শেষ করে বুড়ো চলে গেলো। মা বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপরে সাবধান করে গেলে এক পড়শী বুড়ি। মা বাড়ি এসে ছেলেদের সব খুলে বললেন—তোরা বিয়ে করছিস না, মদ খাচ্ছিস না, অথচ সন্দেহজনক মেয়েদের সঙ্গে মিশছিস…তাই পাড়ার সব, বিশেষত, মেয়েরাও তোদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

পেভেল বিরক্ত হয়ে বললো, বেশ, যাক।

এণ্ড্রি, দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললো, আস্তাকুঁড়ে সবকিছুতেই পচা গন্ধ। বোকা মেয়েগুলোকে তুমি কেন বুঝিয়ে দিলে না, মা, যে, বিয়ে কী চিজ। তাহলে তারা হাড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেবার জন্য এতে ব্যস্ত হয়ে উঠতো না।

মা বললেন, তারা সবই দেখে, বাবা, সবই জানে, জানে তাদের ভবিষ্যত কতো দুঃখময়। কিন্তু কি করতে পারে তারা? আর কোন পথ নেই তাদের।

পেভেল বললো, বুদ্ধিই তাদের মোটা, নইলে পথ তারা খুঁজে পেতো। –

মা বললেন, তোরাই কেন তাদের বুদ্ধি শোধরাস, বাবা? বুদ্ধিমতী যারা তাদের ডেকে দুটো কথা বা!

কিছু হবে না তাতে–পভেল জবাব দিল।

এণ্ড্রি, বললো, আচ্ছা, চেষ্টা করেই দেখা যাক না।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে পেভেল বললো, হাঁ, আজ কাজের নাম করে মেয়েদের সঙ্গে মিশবে, কাল হাত ধরাধরি করে জোড়ায় জোড়ায় বেড়াবে, তারপর হবে বিয়ে। বাসব শেষ জীবনের। মা ছেলের এই বিবাহ-বিমুখতায় চিন্তিত হয়ে উঠলেন।

একদিন মা শুয়েছেন ঘুমুবেন বলেও কামরায় এণ্ড্রি পেভেল কি কথা বলছে শুনতে পেলেন।

এণ্ড্রি বলছে, তুমি জাননা ন্যাটাকে আমি পছন্দ করি?

জানি।

ন্যাটাশা কি এটা লক্ষ্য করেছে?

পেভেল নিরুত্তরে ভাবতে লাগলো। এণ্ড্রিস্বর আরো নীচু করে বললো, কি মনে হয় তোমার?

লক্ষ্য করেছে, আর সেই জন্যই সে মজলিসে আসা ছেড়ে দিয়েছে।

এণ্ড্রি নীরব উদ্বেগে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বললো, যদি আমি তাকে একথা বলি?

কি কথা?…বন্দুকের গুলির মতো পেভেলের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে পড়লো।

চাপা গলায় এণ্ড্রি বললো—যে আমি…।

পেভেল বাধা দিয়ে বললো, কেন?

এণ্ড্রি, বাধা পেয়ে মুহূর্তেক স্তব্ধ থেকে একটু হেসে বললো, দেখো বন্ধু, কোন মেয়েকে যদি তুমি ভালোবাসে, তাকে সেটা বলা চাই; নইলে ভালোবাসাটাই বৃথা।

সশব্দে পাঠ্য বইখানা বন্ধ করে পেভেল বললো, কিন্তু তাতে ফয়দা হবে কি বলতে পারে?

অর্থাৎ? এণ্ড্রি জিগ্যাসুনয়নে পেভেলের দিকে চাইলো।

পেভেল ধীরে ধীরে বললো, এণ্ড্রি, কি তুমি করতে যাচ্ছ, সে সম্বন্ধে তোমার মনে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। ধরে নিলুম, সেও তোমাকে ভালোবাসে, যদিও আমি তা বিশ্বাস করিনা, তবু ধরে নেওয়া গেলো। তারপর বিয়ে হ’ল। চমৎকার মিলন—পণ্ডিতের সঙ্গে মজুরানির সংযোগ। তারপর এলো পুত্রকন্যার বা…পরিবারের জন্যই তোমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে …সংসারের শতকরা নিরানব্বই জন যেমন ক’রে জীবন কাটায়, তোমারও তেমনি কাটবে। তোমাদের এবং ছেলে-মেয়েদের জন্য আহারের রুটি এবং বাসের কুটিরের সংস্থান করতে করতে জীবন কাটাবে। যে ব্রত নিয়ে আমরা নেবেছি, তার পক্ষে তোমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকবেনা–তোমার এবং ন্যাটাশার।

এণ্ড্রি চুপ করে রইলো। পেভেল এবার সুর নরম করে বললো, এসব, ছেড়ে দাও এণ্ড্রি। একটা মেয়েকে নিয়ে মজে যেয়োনা, স্থির হও,–এই হচ্ছে একমাত্র শ্রেষ্ট পথ।

এণ্ড্রি, বললো, কিন্তু আলেক্‌সি আইভানোভিচ কি বলেছিলেন মনে আছে? মানুষকে পরিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে হবে…দেহের এবং আত্মার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে,—মনে আছে পেভেল!

পেভেল সোজা জবাব দিলো, সে আমাদের জন্য নয়, এণ্ড্রি? পরিপূর্ণ জীবন কি করে লাভ করবে তুমি যে তোমার নাগালের বাইরে। এণ্ড্রি, যদি ভবিষ্যৎকে ভালোবাসো, ভবিষ্যৎকে চাও, তবে বর্তমানের সব-কিছু তোমায় ত্যাগ করতে হবে—সবকিছু।

মানুষের পক্ষে তা শক্ত—এণ্ড্রি বললো।

কিন্তু আর কি করার আছে? ভেবে দেখো।

এণ্ড্রি, আবার চুপ…ঘড়ির টিক টিক শব্দে যেন জীবন থেকে এক একটা মুহূর্ত কেটে নিচ্ছে।…শেষে এণ্ড্রির কথা ফুটলো, আদ্দেক প্রাণ বাসে ভালল, আদ্দেক করে ঘৃণা!–এই কি প্রাণ?

আমি জিগ্যেস করি, তোমার আর কি করার আছে?…বলে পেভেল বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো।

তা হলে আমার চুপ করে থাকতে হবে?

হাঁ, তাই উচিত।

বেশ, তাই হবে। এই পথেই চলবে আমরা, কিন্তু পেভেল তোমার বখন এদিন আসবে তখন তোমার পক্ষে শক্ত হবে এ আদর্শ।

শক্ত এখনই হয়েছে, এন্ড্রি।

বলো কি!

হ্যাঁ!

এণ্ড্রি, চুপ করে গেলো, বুঝলো পেভেলও কোন মেয়েকে ভালোবেসেছে…কিন্তু ব্রতের খাতিরে প্রেমকে সে দমন করে রেখেছে। পেভেল যা’ পেরেছে, সে কেন তা পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে।

.

পল্লিময় হুলস্থুলু–সোসিয়ালিস্টরা লাল-কালিতে-ছাপা ইস্তাহার ছড়াচ্ছে মজুরদের মধ্যে। তাতে কারখানার মজুরদের শোচনীয় অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো করে লেখা, কোথায় কোন্ ধর্মঘট হচ্ছে তার ফিরিস্তি,…সর্বশেষে মজুদেব সংঘবদ্ধ হয়ে স্বার্থরক্ষাকল্পে লড়াই করবার জন্যে উত্তেজনাপূর্ণ আবেদন।

মোটা মাইনে যারা পায়, তারা সোশিয়ালিস্টদের গাল দিয়ে ইস্তাহার নিয়ে তাদের কাছে জমা দেয়। তরুণরা সাগ্রহে প্রত্যেকটি কথা গেলে, উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে বলে, সত্যিই তো তাই। কিন্তু বেশির ভাগই শ্রমক্লান্ত–নিরাশ হৃদয়। ঘাড় নেড়ে বলে, হুজুগ, হুজুগ–ওতে কিছু হবে না, হবার জো নেই। সে যা’ বলুক সবার প্রাণেই কিন্তু একটা চাঞ্চল্য…একদিন যদি দেরি হ’ল ইস্তাহার বের হতে অমনি আলোচনা আজো বেরুলোনা, ছাপা বন্ধ হয়ে গেলো বুঝি! তারপর সোমবারে ইস্তাহার বেরুলে আবার আন্দোলন।

মা জানতেন, এসবের মুলে তাঁরই ছেলে। তার আনন্দও হত, শঙ্কাও হত। একদিন সন্ধ্যায় এসে সেই পড়শী বুড়ি খবর দিয়ে গেলো, নাও এইবার, ঠ্যালা সামলাও; আজ রাতেই পুলিস আসছে, তোমাদের বাড়ি আর নিকোলাইদের বাড়ি, আর মেজিনদের বাড়ি…

মা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন,–তাঁর মাথা ঘুরছে, সমস্ত শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের আসন্ন বিপদের কথা মনে পড়তেই সাহসে তাকে বুক বেঁধে উঠতে হল। প্রথমেই তিনি মেজিনকে খবরটা দিয়ে এলেন,–মেজিন বলে দিলো, তুমি যাও, মা, ওদের আমি খবর পাঠাচ্ছি। পুলিস বেড়ায় ডালে ডালে, আমরা বেড়াই পাতায় পাতায়।

মা বাড়ি ফিরে এসে সমস্ত কাগজপত্র বই বুকে গুঁজে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন…মনে করলেন, পেভেল এক্ষুণি কাজ ফেলে ছুটে বাড়ি আসবে। কিন্তু পেভেল এলো না। মা অবসন্ন হয়ে রান্নাঘরের বেঞ্চের ওপর বসে পড়লেন—পেভেল ও এণ্ড্রি কারখানা হতে ফিরে এলো…মা তখনো সেই অবস্থায় বসে। জিগ্যেস করলেন, জানো সব?

হাঁ। তোমার কি ভয় হচ্ছে, মা?–পভেল জিগ্যেস করলো।

এণ্ড্রি বললো, ভয় করে লাভ কি? ভয় করলে কি বিপদ উদ্ধার, হয়? হয় না, তবে?

পেভেল বললো, উনটিও বুঝি ধরাওনি, মা!

মা বইগুলি চেপে বসেছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তা দেখিয়ে বললেন, ঐগুলো নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলাম, সারাক্ষণ…

এণ্ড্রি পেভেল হেসে উঠলো…মা যেন এতে আশ্বস্ত হলেন। পেভেল খানকয়েক বই বেছে নিয়ে উঠানে লুকিয়ে রাখলো। এণ্ড্রি, মাকে সাহস দেবার জন্য গল্প জুড়ে দিলো, কিছু ভয় নেই, মা। ওদের জন্য আমার আপসোস হয়, মা, ইয়া হোমরা চোমরা প্রবীণ অফিসার, তলোয়ার ঝুলিয়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে এসে কাজটা কি করেন? এ কোন খোঁজেন, ও কোন খোঁজেন, বিছানাটা ওলটান, মুখে কালি-ঝুল মাখেন–তারপর বিজয়ী বীরের মতো চলে যান। একবার ওদের পাল্লায় পড়েছিলুম, মা। জিনিসপত্র তছনছ করে আমায় ধরে নিয়ে গেলো। তারপর জেলে রাখলো চার মাস। সে কী জীবন…কেবল বসে থাকা, আসে হয়ে…তারপর ডেকে রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলো। দু’দিকে পাহারা…আদালতে গেলুম…যা-তা জিগ্যেস করলো…তারপর আবার জেলে পাঠালো। তারপর এ জেল থেকে সে জেল, এখান থেকে সেখানে। এমনি ধারা। কি করবে? মাইনে খায়, বেচারীদের যা’, হক একটা-কিছু করে দেখাতে হবে তো!

মার মনে যতটুকু ভয় জমে উঠেছিল তা নিঃশেষে মিলিয়ে গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *