• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৮. বৃদ্ধ ষষ্ঠীবাবু

লাইব্রেরি » শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ব্যোমকেশ সমগ্র (ব্যোমকেশ বক্সী) » ১৪. আদিম রিপু - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ০৮. বৃদ্ধ ষষ্ঠীবাবু

নীচে নামিয়া আসিয়া দেখিলাম সিঁড়ির ঘরে বৃদ্ধ ষষ্ঠীবাবু থেলো হুঁকা হাতে বিচরণ করিতেছেন‌, আমাদের দেখিয়া বঙ্কিম কটাক্ষপাত করিলেন। প্রথমদিন যে উগ্ৰমূৰ্তি দেখিয়াছিলাম এখন আর তাহা নাই‌, বরং বেশ একটু সাগ্ৰহ কৌতুহলের ব্যঞ্জনা তাঁহার তোবড়ানো মুখখানিকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছে।

ব্যোমকেশ থমকিয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার নাম ষষ্ঠীবাবু?

তিনি সতর্কভাবে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আপনি-আপনারা-?

ব্যোমকেশ আত্ম-পরিচয় দিল না‌, সংক্ষেপে বলিল‌, ‘আর বলবেন না মশায়। অনাদি হলদারের কাছে টাকা পাওনা ছিল‌, তা দেখছি টাকাটা ডুবল। লোকটা মারা গেছে শুনেছেন বোধহয়।’

ষষ্ঠীবাবুর সন্দিগ্ধ সতর্কতা দূর হইল। তিনি পরম তৃপ্তমুখে বলিলেন‌, ‘শুনেছি। কাল রাত্তির থেকেই শুনছি।–কিসে মারা গেল? শেষোক্ত প্রশ্ন তিনি গলা বাড়াইয়া প্ৰায় ব্যোমকেশের কানে কানে করিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শোনেননি? কেউ তাকে খুন করেছে। —আপনি তো কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় বসে ছিলেন শুনলাম–’

মুখে বিরক্তিসূচক চুমকুড়ি দিয়ে ষষ্ঠীবাবু বলিলেন, ‘কি করি, পাড়ার ছোঁড়াগুলো ঠিক বাড়ির সামনেই বাজি পোড়াতে শুরু করল। ওই দেখুন না‌, কত তুবড়ির খোল পড়ে রয়েছে। শুধু কি তুবড়ি! চীনে পটকা দোদমার আওয়াজে কান ঝালাপালা। ভাবলাম ঘুম তো আর হবে না‌, বাজি পোড়ানোই দেখি।–তা কি করে খুন হল? ছোরা-ছুরি মেরেছে নকি?’

ব্যোমকেশ প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া বলিল‌, তাহলে আপনি সন্ধের পর থেকে দুপুর রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় বসে ছিলেন। সে সময়ে কেউ অনাদি হালদারের কাছে এসেছিল?’

‘কেউ না। একেবারে রাত বারোটার পর ওই ছেলেটা আর তার মা এল‌, এসেই দ্বোর ঠ্যাঙাতে শুরু করল। তারপর এল ন্যাপা। তারপর কেষ্ট দাস।’

‘ইতিমধ্যে আর কেউ আসেনি?’

‘বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। তবে-অনাদি হালদারের একটা ভাইপোকে একবার ওদিকে ফুটপাথের হোটেলের সামনে ঘুর-ঘুর করতে দেখেছি।’

‘তাই নাকি? তারপর?’

‘তারপর আর দেখিনি। অন্তত এ বাড়িতে ঢোকেনি।’

‘কাঁটার সময় তাকে দেখেছিলেন?’

‘তা কি খেয়াল করেছি। তবে গোড়ার দিকে তখনও হোটেলের দোতলায় বাবুরা জানলার ধারে বসে পাশা খেলছিল। দশটা কি সাড়ে দশটা হবে।–আচ্ছা‌, কে মেরেছে কিছু জানা গেছে নাকি?’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ হেঁট মুখে চিন্তা করিল‌, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করিল‌, ‘অনাদি হালদারের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’

ষষ্ঠীবাবু চমকিয়া উঠিলেন‌, ‘অ্যাঁ! সদ্ভাব‌, মানে‌, অসদ্ভাবও ছিল না।’

‘আপনি কাল রাত্রে ওপরে যাননি?’

‘আমি! আমি ওপরে যাব! বেশ লোক তো আপনি? মতলব কি আপনার? ষষ্ঠীবাবু ক্রমশ তেরিয়া হইয়া উঠিবার উদ্যোগ করিলেন।

‘অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে আপনি জানেন না?’

‘আমি কি জানি! যে খুন করেছে। সে জানে‌, আমি কি জানি। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! আমি বুড়ো মানুষ‌, কারুর সাতেও নেই পাঁচেও নেই‌, আমাকে ফাঁসাতে চান?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া ফেলিল‌, ‘আমি আপনাকে ফাঁসাতে চাই না‌, আপনি নিজেই নিজেকে ফাঁসাচ্ছেন। অনাদি হালদারের মৃত্যুতে এত খুশি হয়েছেন যে চেপে রাখতে পারছেন না। —চল অজিত‌, ওই হোটেলটাতে গিয়ে আর এক পেয়ালা চা খাওয়া যাক।’

ষষ্ঠীবাবু্‌, থ হইয়া রহিলেন‌, আমরা ফুটপাথে নামিয়া আসিলাম। রাস্তার ওপারে হোটেলের মাথার উপর মস্ত পরিচয়-ফলক শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাস। শ্ৰীকান্ত বোধহয় হোটেলের মালিকের নাম। নীচের তলায় রেস্তোরাঁয় চা-পিয়াসীর দল বসিয়া গিয়াছে‌, দ্বিতলে জানালার সারি‌, কয়েকটা খোলা। ব্যোমকেশ পথ পার হইবার জন্য পা বাড়াইয়া হঠাৎ থামিয়া গেল‌, বলিল‌, ‘দাঁড়াও‌, গলির মধ্যেটা একবার দেখে যাই।’

‘গলির মধ্যে কী দেখবো?’

‘এসই না।’

অনাদি হালদারের বাসা ও নুতন বাড়ির মাঝখান দিয়া গলিতে প্রবেশ করিলাম। একেই গলিটি অত্যন্ত অপ্রশস্ত‌, তার উপর নূতন বাড়ির স্বলিত বিক্ষিপ্ত ইটসুরকি এবং ভারা বাঁধার খুঁটি মিলিয়া তাহাকে আরও দুৰ্গম করিয়া তুলিয়াছে। ব্যোমকেশ মাটির দিকে নজর রাখিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল।

গলিটি কানা গলি‌, বেশি দূর যায় নাই। তাহার শেষ পর্যন্ত গিয়া ব্যোমকেশ ফিরিল‌, আবার মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া চলিতে লাগিল। তারপর অনাদি হালদারের বাসার পাশে পৌঁছিয়া হঠাৎ অবনত হইয়া একটা কিছু তুলিয়া লইল।

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কি পেলে?’

সে মুঠি খুলিয়া দেখাইল‌, একটি চকচকে নূতন চাবি। বলিলাম‌, চাবি! কোথাকার চাবি?’

ব্যোমকেশ একবার উর্ধে জানালার দিকে চাহিল‌, চাবিটি পকেটে রাখিয়া বলিল‌, ‘হলফ নিয়ে বলতে পারি না‌, তবে সন্দেহ হয় অনাদি হালদারের আলমারির চাবি।’

‘কিন্তু–’

‘আন্দাজ করেছিলাম গলির মধ্যে কিছু পাওয়া যাবে। এখন চল‌, চা খাওয়া যাক।’

‘কিন্তু‌, আলমারির চাবি তো—’

‘অনাদি হালদারের কোমরে আছে। তা আছে। কিন্তু আর একটা চাবি থাকতে বাধা কি?’

‘কিন্তু‌, গলিতে চাবি এল কি করে?’

‘জানিলা দিয়ে।–এস।’ ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল।

 

শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসে প্রবেশ করিয়া একটি টেবিলে বসিলাম। ভৃত্য চা ও বিস্কুট দিয়া গেল। ভৃত্যকে প্রশ্ন করিয়া জানা গেল হোটেলের মালিক শ্ৰীকান্ত গোস্বামী পাশেই একটি ঘরে আছেন। চা বিস্কুট সমাপ্ত করিয়া আমরা নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকিলাম।

ঘরটি শ্ৰীকান্তবাবুর অফিস; মাঝখানে টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। শ্ৰীকান্তবাবু মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি‌, চেহারা গোলগাল‌, মুণ্ডিত মুখ; বৈষ্ণবোচিত প্রশান্ত ভাব। তিনি গত রাত্রির বাসি ফাউল কাটলেট সহযোগে চা খাইতেছিলেন‌, আমাদের আকস্মিক আবিভাবে একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন।

ব্যোমকেশ সবিনয়ে বলিল‌, ‘মাফ করবেন‌, আপনিই কি হোটেলের মালিক শ্ৰীকান্ত গোস্বামী মশায়?’

গোস্বামী মহাশয়ের মুখ ফাউল কাটলেটে ভরা ছিল‌, তিনি এক চুমুক চা খাইয়া কোনও মতে তাহা গলাধঃকরণ করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘আসুন। আপনারা-?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটু দরকারে এসেছি। সামনের বাড়িতে কাল রাত্রে খুন হয়ে গেছে শুনেছেন বোধহয়?’

‘খুন!’ শ্ৰীকান্তবাবু ফাউল কাটলেটের প্লেট পাশে সরাইয়া দিলেন‌, ‘কে খুন হয়েছে?’

‘১৭২/২ নম্বর বাড়িতে থাকত-অনাদি হালদার।’

শ্ৰীকান্তবাবু চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন‌, ‘অনাদি হালদার খুন হয়েছে! বলেন কি?’

‘তাকে আপনি চিনতেন?’

‘চিনতাম বৈকি। সামনের বাড়ির দোতলায় থাকত‌, নতুন বাড়ি তুলছিল। প্রায় আমার হোটেলে এসে চিপ কাটলেট খেত।–কাল রাত্তিরেও যে তাকে দেখেছি।’

‘তাই নাকি! কোথায় দেখলেন?’

‘ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বাজি পোড়ানো দেখছিল। যখনই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছি তখনই দেখেছি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কখন কোথা থেকে কি দেখলেন সব কথা। দয়া করে বলুন। আমি অনাদি হালদারের খুনের তদন্ত করছি। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’

শ্ৰীকান্তবাবু বিস্ময়াপ্লুত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি ব্যোমকেশবাবু! কি সৌভাগ্য।’ তিনি ভূত্য ডাকিয়া আমাদের জন্য চা ও ফাউল কাটলেট হুকুম দিলেন। আমর এইমাত্র চা বিস্কুট খাইয়াছি বলিয়াও পরিত্রাণ পাওয়া গেল না।

তারপর শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘আমার হোটেলের দোতলায় দুটো ঘর নিয়ে আমি থাকি‌, বাকি তিনটে ঘরে কয়েকজন ভদ্রলোক মেস করে আছেন। সবসুদ্ধ এগারজন। তার মধ্যে তিনজন কালীপুজোর ছুটিতে দেশে গেছেন‌, বাকি আটজন বাসাতেই আছেন। কাল সন্ধ্যের পর ১ নম্বর আর ৩ নম্বর ঘরের বাবুরা ঘরে তালা দিয়ে শহরে আলো দেখতে বেরুলেন। ২ নম্বর ঘরের যামিনীবাবুরা তিনজন বাসাতেই রইলেন। ওঁদের খুব পাশা খেলার শখ। আমিও খেলি। কাল সন্ধ্যে সাতটার পর ওঁরা আমাকে ডাকলেন‌, আমরা চারজন যামিনীবাবুর তক্তপোশে পাশা খেলতে বসলাম। যামিনীবাবুর তক্তপোশ ঠিক রাস্তার ধারে জানলার সামনে। সেখানে বসে খেলতে খেলতে যখনই বাইরের দিকে চোখ গেছে তখনই দেখেছি। অনাদি হালদার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাজি পোড়ানো দেখছে। আমরা তিন দান খেলেছিলাম‌, প্ৰায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত খেলা চলেছিল।’

‘তারপর আর অনাদি হালদারকে দেখেননি?’

‘না‌, তারপর আমরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম‌, অনাদি হালদারকে আর দেখিনি।’

‘যে বাবুরা আলো দেখতে বেরিয়েছিলেন তাঁরা কখন ফিরলেন?’

‘তাঁদের মধ্যে দু’জন ফিরেছিলেন রাত বারোটার সময়‌, বাকি বাবুরা এখনও ফেরেননি।’

‘এখনও আলো দেখছেন।’

শ্ৰীকান্তবাবু অধরোষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন; মনুষ্য জাতির ধাতুগত দুর্বলতা সম্বন্ধে বোধকরি নীরবে খেদ প্রকাশ করিলেন।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে কাটলেট চিবাইল‌, তারপর বলিল‌, ‘দেখুন‌, অনাদি হালদারের লাশ পাওয়া গেছে। ওই ব্যালকনিতেই‌, বুকে বন্দুকের গুলি লেগে পিঠ ফুড়ে বেরিয়ে গেছে। তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে আপনার হোটেল থেকে কেউ বন্দুক ছুঁড়ে অনাদি হালদারকে মেরেছে—’

শ্ৰীকান্তবাবু আবার চক্ষু কপালে তুলিলেন–’আমার হোটেল থেকে! সে কি কথা! কে মারবে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা আন্দাজ মাত্র। আপনি বলছেন সন্ধ্যে সাতটা থেকে আপনারা চারজন ছাড়া দোতলায় আর কেউ ছিল না। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ?’

শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘মেসের বাসিন্দা আর কেউ ছিল না। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। তবে–দাঁড়ান। একটা চাকর দোতলার কাজকর্ম করে‌, সে বলতে পারবে। হরিশ! ওরে কে আছিস হরিশকে ডেকে দে।’

কিছুক্ষণ পরে হরিশ আসিল‌, ছিটের ফতুয়া পরা আধ-বয়সী লোক। শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘কাল সন্ধ্যে থেকে তুই কোথায় ছিলি?’

হরিশ বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, ওপরেই তো ছিলুম। বাবু্‌, সারাক্ষণ সিঁড়ির গোড়ায় বসেছিলুম। আপনারা শতরঞ্চি খেলতে বসলেন–’

‘কতক্ষণ পর্যন্ত ছিলি?’

‘আজ্ঞে, রাত দুপুরে ধীরুবাবু আর মানিকবাবু ফিরলেন, তখন আমি সিঁড়ির পাশের কম্বল পেতে শুয়ে পড়লুম। কোথাও তো যাইনি বাবু।’

শ্রীকান্তবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকাইলেন, ব্যোমকেশ হরিশকে প্রশ্ন করিল, ‘বাবুরা পাশা খেলতে আরম্ভ করবার পর থেকে রাত্ৰি বারোটা পর্যন্ত তুমি সারাক্ষণ সিঁড়ির কাছে বসেছিলে‌, একবারও কোথাও যাওনি?’

হরিশ বলিল‌, ‘একবারটি পাঁচ মিনিটের জন্যে নীচে গেছলুম যামিনীরাবুর জন্যে দোক্তা আনতে।’

শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ‌, যামিনীবাবু ওকে একবার দোক্তা আনতে পাঠিয়েছিলেন বটে।’

‘সে কখন? ক’টার সময়?’

‘আজ্ঞে‌, রাত্তির তখন নটা হবে।’

‘ছ। রাত্ৰি নটা থেকে দুপুর রাত্রি পর্যন্ত দোতলায় কেউ আসেনি?

‘দোতলায় কেউ আসেনি বাবু। দশটা নাগাদ তেতলার ভাড়াটে বাবু এসেছিলেন‌, কিন্তু তিনি দোতলায় দাঁড়াননি‌, সটান তেতলায় উঠে গেছলেন।’

ব্যোমকেশ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া শ্ৰীকান্তবাবুর পানে চাহিল। তিনি বলিলেন‌, ‘ওহো‌, তেতলার ভাড়াটের কথা বলা হয়নি। তেতিলায় একটা ছোট ঘর আছে‌, চিলেকোঠা বলতে পারেন। এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন। ঘরে পাকাপাকি থাকেন না‌, খাওয়া-দাওয়া করেন। না। তবে রোজ সকাল-বিকেল আসেন‌, ঘরের মধ্যে দোর বন্ধ করে কি করেন জানি না‌, তারপর আবার তালা লাগিয়ে চলে যান। একটু অদ্ভুত ধরনের লোক।’

‘নাম কি ভদ্রলোকের?’

‘নাম? দাঁড়ান বলছি–শ্ৰীকান্তবাবু একখানা বাঁধানো খাতা খুলিয়া দেখিলেন— নিত্যানন্দ ঘোষাল।’

‘নিত্যানন্দ ঘোষাল।’ ব্যোমকেশ একবার আড়চোখে আমার পানে চাহিল-‘রোজ দু’বেলা যখন আসেন তখন কলকাতার লোক বলেই মনে হচ্ছে। কতদিন আছেন। এখানে?’

‘প্রায় ছ’ মাস। নিয়মিত ভাড়া দেন‌, কোনও হাঙ্গামা নেই।’

‘কি রকম চেহারা বলুন তো?’

‘মোটাসোটা গোলগাল।’

ব্যোমকেশ আবার আমার পানে কটাক্ষপাত কুরিয়া মুচকি হাসিল—’চেনা-চেনা ঠেকছে—‘ ‘হরিশকে বলিল‌, ‘নিত্যানন্দবাবু দশটা নাগাদ এসেছিলেন? তোমার সঙ্গে কোনও কথা হয়েছিল?’

হরিশ বলিল‌, ‘আৰ্জেজ্ঞ না‌, উনি কথাবার্তা বলেন না। ব্যাগ হাতে সটান তেতলায় উঠে গেলেন।’

‘ব্যাগ!’

‘আজেজ্ঞ। উনি যখনই আসেন সঙ্গে চামড়ার ব্যাগ থাকে।’

‘তাই নাকি! কত বড় ব্যাগ?’

‘আজ্ঞে‌, লম্বা গোছের ব্যাগ; সানাই বাঁশী রাখার ব্যাগের মত।’

‘ক্ল্যারিওনেট রাখার ব্যাগের মত? ভদ্রলোক তেতলার ঘরে নিরিবিলি বাঁশী বাজানো অভ্যোস করতে আসেন নাকি?’

‘আজ্ঞে‌, কোনও দিন বাজাতে শুনিনি।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গভীর চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল। তারপর মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘কাল রাত্রে উনি কখন ফিরে গেলেন?’

‘ঘণ্টাখানেক পরেই। খুব ব্যস্তসমস্তভাবে তরুতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।’

‘ও!— আচ্ছা‌, তুমি এবার যেতে পারো।’। হরিশ শূন্য পেয়ালা প্লেট প্রভৃতি লইয়া প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ শ্ৰীকান্তবাবুকে বলিল‌, ‘ওপরতলাগুলো একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপত্তি আছে কি?’

‘বিলক্ষণ‌, আপত্তি কিসের? আসুন।’ শ্ৰীকস্তবাবু আমাদের উপরতলায় লইয়া চলিলেন।

দ্বিতলে পাশাপাশি পাঁচটি বড় বড় ঘর‌, সামনে টানা বারান্দা। সিঁড়ি দিয়া উঠিয়াই প্রথম দু’টি ঘর শ্ৰীকান্তবাবুর। দ্বারে তালা লাগানো ছিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি কি একলা থাকেন?’

শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘আপাতত একলা। স্ত্রীকে ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। যা দিনকাল।’

‘বেশ করেছেন।’

এক নম্বর ঘরে তালা লাগানো‌, বাবুরা এখনও ফেরেন নাই। দু’ নম্বর ঘরে তিনটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক রহিয়াছেন। একজন মেঝোয় বসিয়া জুতা পালিশ করিতেছেন‌, দ্বিতীয় ব্যক্তি দাড়ি কামাইতেছেন‌, তৃতীয় ব্যক্তি খোলা জানালার ধারে বিছানায় কান্ত হইয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। জানোলা দিয়া রাস্তার ওপারে অনাদি হালদারের বাসা সোজাসুজি দেখা যাইতেছে। ব্যালকনির ভিতর দৃষ্টি প্রেরণ করিবার চেষ্টা করিলাম‌, কিন্তু ঢালাই লোহার ঘন রেলিং-এর ভিতর দিয়া কিছু দেখা গেল না।

তিন নম্বর ঘরে ধীরুবাবু ও মানিকবাবু সবেমাত্র বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছেন এবং তুড়ি দিয়া হাই তুলিতেছেন। শ্ৰীকান্তবাবু সহাস্যে বলিলেন‌, ‘কী‌, ঘুম ভাঙল?’

দু’জনে বাহু উর্ধে তুলিয়া আড়মোড়া ভাঙিলেন।

চলিল। একই সিঁড়ি ত্রিতলে গিয়াছে‌, তাহা দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। শ্ৰীকান্তবাবু ও আমি পিছনে রহিলাম।

ত্রিতলে একটি ঘর‌, বাকি ছাদ খোলা! ঘরের দরজায় তালা লাগানো।

ব্যোমকেশ শ্ৰীকান্তবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনার কাছে চাবি আছে নাকি?’

‘না। তবে—’ তিনি পকেট হইতে চাবির একটা গোছা বাহির করিয়া বলিলেন‌, ‘দেখুন। যদি কোন চাবি লাগে। ভাড়াটের অবর্তমানে তার ঘর খোলা বোধহয় উচিত নয়‌, কিন্তু বর্তমান অবস্থায়–’

চাবির গোছা লইয়া ব্যোমকেশ কয়েকটা চাবি লোগাইয়া দেখিল। সস্তা তালা‌, বেশি চেষ্টা করিতে হইল না‌, খুট করিয়া খুলিয়া গেল।

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম।। ঘরের একটিমাত্র জানালা রাস্তার দিকে খোলা রহিয়াছে। আসবাবের মধ্যে একটি উলঙ্গ তক্তপোশ ও একটি লোহার চেয়ার। আর কিছু নাই।

ব্যোমকেশ কোনও দিকে দৃকপাত না করিয়া প্রথমেই জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। নীচে প্রশস্ত রাস্তার উপর মানুষ ও যানবাহনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে। ওপারে অন্যান্য বাড়ির সারির মধ্যে অনাদি হালদারের ব্যালকনি।

ব্যোমকেশ সেই দিকে চাহিয়া কতকটা আপন মনেই বলিল‌, ‘কাল রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময়…রাস্তায় ছেলেরা বাজি পোড়াচ্ছে…চারিদিকে দুমদাম শব্দ-অনাদি হালদার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাজি পোড়ানো দেখছে..সেই সময় জানলা থেকে তাকে গুলি করা কি খুব শক্ত? গুলির আওয়াজ শোনা গেলেও বোমা ফাটার আওয়াজ বলেই মনে হবে।’

শ্ৰীকান্তবাবু বললেন‌, তা বটে। কিন্তু হোটেলে এত লোকের চোখে ধুলো দিয়ে বলুক আনা কি সহজ?

‘আপনার ভাড়াটে হাতে ব্যাগ নিয়ে হোটেলে আসে। ব্যাগের মধ্যে একটা পিস্তল কিম্বা রিভলবার সহজেই আনা যায়।’

‘কিন্তু রাইফেল কিম্বা বন্দুক আনা যায় কি? আমাকে মাফ করবেন‌, আমি অদ্বৈত বংশের সন্তান‌, গোলাগুলি বন্দুক পিস্তলের ব্যাপার কিছুই বুঝি না। তবু মনে হয়‌, পিস্তল কিংবা রিভলবার দিয়ে এতদূর থেকে মানুষ মারা সহজ কাজ নয়।’

উত্তরে ব্যোমকেশ কেবল গলার মধ্যে একটা শব্দ করিল। তারপর নিরাভরণ ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল‌, চলুন‌, যাওয়া যাক‌, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম— বলিতে বলিতে থামিয়া গেল। দেখিলাম তাহার দৃষ্টি দেয়ালের একটা স্থানে আটকাইয়া গিয়াছে।

জানালার ঠিক উল্টা পিঠে দেয়ালের ছাদের কাছে খানিকটা চুন বালি খসিয়া গিয়াছে। তাহার নীচে মেঝের উপর খসিয়া-পড়া চুন বালি পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ ত্বরিতে গিয়া চুন বালি পরীক্ষা করিল‌, বলিল‌, ‘নতুন খসেছে মনে হচ্ছে। শ্ৰীকান্তবাবু্‌, এ ঘর রোজ ঝটপট দেওয়া হয়?’

শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন‌, ‘না। ঘর খোলা থাকে না—’

ব্যোমকেশ দু’ পা সরিয়া আসিয়া উর্ধমুখে চাহিয়া রহিল।

‘দেয়ালের এই চুন-বালি কবে খসেছে আপনি বলতে পারেন না?’

‘না। এইটুকু বলতে পারি ছ। মাস আগে যখন ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম তখন প্ল্যাস্টার ঠিক ছিল। ‘

‘হুঁ। অজিত‌, চৌকিটা ধরতো‌, একবার দেখি–’

দু’জনে চৌকি ধরিয়া দেয়ালে ঘেষিয়া রাখিলাম; তাহার উপর লোহার চেয়ার রাখিয়া ব্যোমকেশ তদুপরি আরোহণ করিল। সেখান হইতে হাত বাড়াইয়া দেয়ালের ক্ষতস্থানটার নাগাল পাওয়া যায়। ব্যোমকেশ আঙুল দিয়া স্থানটা হাতড়াইল‌, তারপর একটি ক্ষুদ্র বস্তু হাতে লইয়া নামিয়া আসিল। পেন্সিলের ক্যাপের মত লম্বাটে আকৃতির একটি ধাতব পদার্থ্‌্‌, তাহার গায়ে রাইফেলের পেচানো রেখাচিহ্ন।

রাইফেলের টোটা। ব্যোমকেশ সেটি ঘুরাইয়া দেখিতে দেখিতে বলিল‌, ‘এ বস্তু এখানে এল কি করে? কবে এল?—ঘরের মধ্যে কেউ রাইফেল ছুড়েছিল? কিম্বা–’ ব্যোমকেশ জানালার দিকে চাহিল, ‘অনাদি হালদার যদি ব্যালকনি থেকে জানালা লক্ষ্য করে রাইফেল ছুঁড়ে থাকে তাহলে গুলিটা দেয়ালের ওই জায়গায় লাগা সম্ভব। অথবা–’

Category: ১৪. আদিম রিপু - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৭. পুলিস আসিতেছে
পরবর্তী:
০৯. বাসায় ফিরিতে দেরি হইল »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑