৪. শবর দাশগুপ্ত

দু’দিন পর এক ভোরবেলা পুলিশ বাদু মণ্ডলকে তুলে নিল তিলজলা থেকে। তার দু’দিন পর ভিক্টর ধরা পড়ল পার্ক সার্কাসে। দু’জনেরই প্ৰাথমিক স্টেটমেন্ট, তারা ডাকাতি করতে ঢুকেছিল। খুন করার উদ্দেশ্য ছিল না। কেউ সুপারি দেয়নি। বাধা পড়ায় গুলি চালিয়ে দিতে হয়। এই বিবরণ বার চারেক চার পুলিশ অফিসারকে দেওয়ার পর অবশেষে একদিন শবর দাশগুপ্তের মুখোমুখি হতে হল তাদের। এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝতে পারল, বিপদ।।

এই সাদা পোশাকের, সাদামাটা চেহারার লোকটা উঁচু গলায় কথা অবধি বলে না। ভারী মোলায়েম ভাষায় কথা কয়। গালাগাল দেয় না। ফালতু গরমও খায় না। একবার দুটো বাঘা চোখে দু’জনের দিকে চেয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে টেবিলের ওপর একটা পেপারওয়েট এক হাত থেকে অন্য হাতে এবং অন্য হাত থেকে ফের আগের হাতে গড়াতে গড়াতে বলল, টার্গেট একজন না দু’জন?

মাইরি স্যার, খুনখারাপি আমাদের লাইন নয়। ধরা পড়ার ভয়ে মেরে দিতে হল স্যার। শবর প্রশ্ন না করে অনেকক্ষণ দু’জনের দিকে চুপ করে চেয়ে বসে রইল। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। মিনিট দুয়েক পর একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, একটা প্রশ্নের জবাব না পেলে আমার অঙ্কটা মিলছে না। তোদের টার্গেট ক’জন ছিল, একজন না দু’জন?

দু’জনেই মুখ তাকাতাকি করে চুপ করে রইল অধোবদন হয়ে।

ভিক্টর! তুই বলবি? আমার যতদূর মনে হয় সেই রাতে তুই অপারেশনটা লিড করেছিল। বাদু নয়।

কাউকে মারার ইচ্ছে ছিল না। স্যার, বিশ্বাস করুন। গোলেমালে হয়ে গেল। আমাদের আপশোস হচ্ছে স্যার।

তুই যাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস সে একজন মাইনর। যদি ধরা পড়ে তা হলে জুভেনাইল কোর্টে ট্রায়াল হবে। বড়জোর দু-তিন বছর কারেকশনাল হোমে সাজা কেটে বেরিয়ে আসবে। তাকে বাঁচানোর চেয়ে তোর নিজের গর্দান বাঁচানো অনেক ইম্পট্যান্ট।

ভিক্টর শুকনো মুখে বলে, আমাদের গর্দান তো যাবেই স্যার। আপনি কেস নিলে কি আমরা বাঁচব?

কেস নেওয়ার আমার কী দায়? চার্জশিট দেবে লোকাল পুলিশ। কেস স্ট্রং হলে ঘষে যাবি। আর যদি দাদাফাদা থাকে তো চার্জাশিটে জল ঢুকে যাবে। কোর্টে কত ক্রিমিনাল কেস ঝুলে আছে জানিস? শুনলাম, তোদের হয়ে একজন ঝানু উকিল মাঠে নেমেছে।

দু’জনেই একটু অধোবদন। তারপর ভিক্টর মুখ তুলে বলল, কথাটা কি কোর্টেও বলতে হবে?

জিজ্ঞেস করলে বলবি, তোর যদি ইচ্ছে হয়।

আমাদের টার্গেট একজন ছিল স্যার। নন্দিনী।

তা হলে শিবাঙ্গীর ঘরে ঢুকেছিলি কেন?

কাজটা তো গ্র্যাটিসের ছিল স্যার। আমরা কন্ডিশন করেই নিয়েছিলাম। ল্যান্ডলেডির ঘর থেকে কিছু মালু কামিয়ে নেব। কিন্তু ঘুমপাড়ানি রুমাল বের করারই সময় পাইনি, উনি গুলি চালিয়ে দিলেন। মরেও যেতে পারতাম স্যার!

তারপর?

বাদু ভয় পেয়ে পালটা ফায়ার করে। আমি বারণ না করলে আবার গুলি চালিয়ে দিত। কাজটা অন্যায় হয়েছে স্যার। ব্রিচ অফ ট্রাস্ট। শিবাঙ্গীকে আমাদের মারার কথা নয়।

শবর চিন্তিত মুখে বলে, আমার অঙ্কটা তবু মিলছে না।

কীসের অঙ্ক স্যার?

তোদের হয়ে যে উকিল মাঠে নেমেছে তার নাম জানিস?

না স্যার। একজন সেপাই বলছিল। আমাদের জামিনের জন্য নাকি একজন উকিল চেষ্টা করছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। আমাদের মা-বাবারাও চায় যে, আমরা জেলে বন্ধ থাকি।

হুঁ। কিন্তু ওখানেই তো গণ্ডগোল। তোদের উকিলের নাম ব্ৰজবাসী দত্ত। কখনও নাম শুনেছিস?

দু’জনেই একসঙ্গে বলে, না স্যার।

কলকাতার টপ ক্রিমিনাল ল-ইয়ারদের মধ্যে একজন। অনেক টাকা ফি। টাকাটা কে দিয়েছে জানিস?

না স্যার।

আর ওখানেই অঙ্কটা মিলছে না।

শবর আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ঠিক আছে। আজ এই পৰ্যন্ত। দরকার হলে আবার আসব।

***

সকালে আজ অনেকদিন বাদে আয়নায় মুখ দেখল বিষাণ। নিজের দাড়িগোঁফওলা এই মুখটা তার চেনা নয়। যেন একটা অচেনা লোক তার সামনে।

অনভ্যস্ত দাড়িতে গাল কুটকুট করছে। একবার ভাবল কেটে ফেলবে কিনা। তারপর ভাবল, থাক। তার বেশ কিছু দাড়ি পেকে গেছে, এটা সে এতদিন টের পায়নি। তাকে বোধহয় এখন একটু বয়স্ক দেখাচ্ছে।

বয়স্কই। সে অনেকদিন জগিং করেনি। কোনওরকম ব্যায়াম করেনি। ফলে এখন তার শরীরের গাটে গাটে ব্যথা। বেশি পরিশ্রম করেত পারে না। সে যে একসময়ে দারুণ স্প্রিন্টার ছিল, এ তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। গত পঁচিশ দিন সে মদ খায়নি। অসম্ভব টেনশনে মদ ভাল কাজ করে। কিন্তু তার তেমন ইচ্ছে হয়নি। প্রথম চার-পাঁচদিন মদ পেটে না থাকায় ঘুম হচ্ছিল না। এখন হচ্ছে। খুব গাঢ় ঘুম নয়, তবু হচ্ছে তো।

আজ রবিবার। একা একটা ছুটির দিন কীভাবে কাটাবে সেটাই চিন্তার বিষয়। দিনটাও ভাল নয়। রাত থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কে যেন বলছিল, নিম্নচাপ। তবে এটা বর্ষাকাল, বৃষ্টি তো হওয়ারই কথা।

লিভিং রুমে এসে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে চেয়ারে বসতেই চমকে উঠল সে। মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। শবর দাশগুপ্ত।

আরে আপনি! কখন এসেছেন?

মিনিট পাঁচেক।

খবর দেননি তো!

দরজায় নক করেছিলাম, আপনার কাজের লোকদের মধ্যে একজন দরজা খুলে দিয়েছে। আমার তাড়া নেই বলে আপনাকে খবর দিতে বারণ করেছিলাম।

বাঃ! আমার তো বোধহয় সময় হয়ে এল, তাই না?

কীসের সময়?

শুনেছি খুনিরা ধরা পড়েছে এবং তদন্তও শেষের মুখে। আমার স্ত্রীও নিশ্চয়ই তাঁর ভার্সান পুলিশকে বলেছেন!! আমি তো এখন দিন গুনছি।

কেন? খুনটা কি আপনি করিয়েছেন?

না। কিন্তু সে-কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন?

পুলিশ যে আপনাকেই সাসপেক্ট ভাবছে তা কী করে বুঝলেন?

গাট ফিলিং।

আপনার ফিলিং নির্ভুল নয়।

আপনি কি কিছু বলতে এসেছেন শবরবাবু? সিরিয়াস কিছু? আপনাকে খুব গভীর দেখাচ্ছে!

আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। বিরক্ত হবেন না তো!

আরে না। আমার লুকোনোর কিছু নেই। আমি চাই তদন্তটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক।

আপনি কি কখনওই টের পাননি যে, নন্দিনী আপনার প্রতি আসক্ত?

এ প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছি।

না দেননি। আপনি এড়িয়ে গেছেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তিত মুখে রইল বিষাণ। তারপর বলল, আমার তেমন সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই।

তার মানে কী? একটু এক্সপ্যান্ড করবেন?

শুনলে আমার ওপর আপনার হয়তো ঘেন্না হবে।

আমি ক্রিমিনাল ঘেঁটে বুড়ো হলাম, আমার রি-অ্যাকশন অত সহজে হয় না।

এটাও হয়তো ক্রাইম। পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই আই ওয়াজ সিডিউসড বাই এ উওম্যান। আমার দূরসম্পর্কের এক বউদি, বয়সে সাত-আট বছরের বড়। সিডাকশনটা চার-পাঁচ বছর ধরে চলেছিল। প্রেম নয়, জাস্ট সেক্স। সেক্স অ্যান্ড সেক্স। কোনও অদ্ভুত কারণে আমি মেয়েদের ইজি টার্গেট। ওই শুরু। তারপর আরও ঘটনা। কী বলব, আই ওয়াজ অলমোস্ট ড্রেইন্ড আউট বাই উইমেন ইন দ্যাট আর্লি এজ। কাউকেই রিফিউজ করতাম না, একটা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দও তো ছিল।

তারপর? গো অ্যাহেড।

এর ফলে আমার রোমান্টিক সেন্সটাই ভোঁতা হয়ে গেল। আপনাকে তো বলেইছি আমরা বন্ধুরা অনেক সময়েই পয়সা দিয়ে মহিলা জুটিয়ে নিতাম। এখন বোধহয় আমার তেত্রিশ বছর বয়স। এখন টের পাই মহিলাদের প্রতি আমার কোনও লাগামছাড়া আকর্ষণ নেই। বড্ড বেশি ব্যবহৃত হলে বোধহয় এরকমই হয়। আপনার নিশ্চয়ই আমাকে লম্পট

বলে মনে হচ্ছো!

লম্পট নন, তা বলছি না। তবে লাম্পট্য থাকলেও আপনি বোধহয় কোনও মহিলাকে কখনও সিডিউস করেননি!

না। তার দরকার হয়নি। বরাবর আমিই সিডিউসড হয়েছি।

তার কারণ আপনার ভাল চেহারা এবং সুইট পারসোন্যালিটি।

কে জানে কী! তবে মেয়েদের কাছে অ্যাট্রাকটিভ হওয়ার জন্য আমি কোনওদিনই কোনও চেষ্টা করিনি। যা হয়েছে এমনিতেই হয়েছে। তবে ইদানীং আমি মাঝে মাঝে রিমোর্সও ফিল করি। আমার ভীষণ প্রিয় এক বন্ধু আছে, ইন্দ্ৰনীল। সে সন্তুর বাজায় এবং নানা জায়গায় প্রোগ্রাম করে। সে বিয়ে করার পর তার নতুন বিউটি যখন আমাকে ইশারা-ইঙ্গিত করতে শুরু করল এবং টেলিফোনে নানা সাংকেতিক কথা বলতে এবং মেসেজ পাঠাতে শুরু করল, তখন হঠাৎ খুব আত্মগ্লানি হল আমার। মনে হল ইন্দ্ৰনীলের স্ত্রীকে ভোগ করলে আমি আর আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারব না। জোর করে সব কমিউনিকেশন বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটা মরিয়া হয়ে অনেক পাগলামি করেছিল। ফলে শিবাঙ্গীর সঙ্গেও আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়।

তার মানে, আপনি কখনও তেমন করে কারও প্ৰেমে পড়ার সময় পাননি।

প্রবলেমটা অ্যাটিচুডের। সময়ের নয়। কিন্তু আপনি আমাকে বোধহয় নন্দিনীর বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন।

যদি আপত্তি না থাকে তা হলে বলুন।

প্রথমেই ক্ষমা চাইছি যে, আমি আপনাকে একটু মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আসলে মেয়েটি মারা গেছে, তার সম্পর্কে তাই কথাটা বলতে ইচ্ছে করেনি। আমার। এখন ভাবছি সত্য গোপন করলে হয়তো পুলিশের কাজের অসুবিধে হবে। তাই বলছি যে, হ্যাঁ, নন্দিনীও আমাকে সিডিউস করেছে। কয়েকবার।

শিবাঙ্গী পাশের ঘরেই আছে, জেনেও?

হ্যাঁ। বোধহয় মেয়েদের এসব ব্যাপারে সাহস একটু বেশিই। আর নন্দিনী বোধহয় চাইত ধরা পড়তেই। তাতে শিবাঙ্গীর সঙ্গে আমার দূরত্ব আরও বাড়বে।

শিবাঙ্গী কি টের পেয়েছিলেন?

না। ও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোয়।

আপনার ধারণাটা বোধহয় ভুল।

কেন ও কথা বলছেন?

সেটা পরে বলছি। এবার আরও একটা সেনসিটিভ প্রশ্ন।

বলুন।

নন্দিনী ছাড়া আর কেউ কি আপনার সঙ্গে উপগত হতে চেয়েছে। এ বাড়িতে?

না না! আর কে?

একটু ভেবে বলুন।

এসব কি আর ভেবে বলতে হয়?

আপনি বলতে চাইছেন না, কিন্তু আমি যে জানি।

হঠাৎ বিষাণের মুখটা লাল হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর রাখা একটা জলের বোতল থেকে খানিকটা জল খেল। তারপর কেমন যেন কুঁকড়ে গিয়ে দুহাতে মুখটা ঢেকে চাপা গলায় বলল, প্লিজ, প্লিজ মিস্টার দাশগুপ্ত, লিভ হার অ্যালেন। শিইজ এ কিড ওনলি। এ মাইনর।

শুনুন বিষাণবাবু, ভারতের সংবিধান মতে একটি মেয়ে আঠারো বছরের আগে অ্যাডাল্ট বলে গণ্য হয় না। কিন্তু মানুষের যৌবন তো সংবিধান মেনে আসে না! তেরো-চোদ্দো বছর। বয়সে একটা মেয়ের ঋতুচক্র শুরু হয়, দেহবোধ আসে। সংবিধানের নিয়মে আঠেরো বছর। বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ। কিন্তু সংবিধান তো বলেনি। আঠারোর আগে প্রেমে পড়া চলবে না।

কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে চোখ বুজে বসে রইল বিষাণ। তারপর বলল, আপনি জানেন না, আমার মেয়ের বয়সও এখন সতেরো।

আপনার মেয়ে?

হ্যাঁ। আমার যে বউদির কথা আপনাকে বলেছিলাম, মাই ফাস্ট অ্যাডভেঞ্চার, তার ফলেই মেয়ের জন্ম। যদিও অবৈধ।

কী করে শিয়োর হলেন যে, আপনারই মেয়ে। ডিএনএ টেস্ট করিয়েছেন?

তার দরকার হয়নি। সেই মেয়েকে দেখলেই আপনিও বুঝতে পারবেন। তার মুখে হুবহু আমার মুখের ছাপ। পাছে কেউ মিলটা ধরে ফেলে সেই ভয়ে আমি ওদের বাড়ির ত্ৰিসীমানাতেও যাই না। আরও একটা ভয়। মেয়ে তো জানে না যে, আমি ওর বাবা। তাই যদি বাবা হিসেবে না দেখে পুরুষ হিসেবে দেখতে শুরু করে তা হলেই সর্বনাশ!

শবর একটু হাসল, আপনার ট্রাজেডিটা আমি বুঝতে পারছি।

লম্পট হলেও বর্বর তো নই। তাই এই মেয়েটা যেদিন আমার বিছানায় ঢুকেছিল সেদিন আমার নিজের ওপরেই খুব ঘেন্না হল। ওকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। খুব রাগারাগিও করেছিলাম, মনে আছে। পরদিন এসে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল। বলল, আর ওরকম করব। না। আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আমি শুধু আপনার দেখাশোনা করব। মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?

পারছি। কিন্তু একটা মুশকিল কী জানেন?

কী?

এই পুরো ক্রাইমটার পিছনেই আপনি রয়েছেন। অথচ আপনি কিছুই করেননি। কিন্তু রয়েছেন অনুঘটকের মতো। গোটা ব্যাপারটাই ঘটেছে আপনাকে কেন্দ্র করে এবং আপনার জন্যই। কিন্তু আপনি ক্যাটালিস্ট মাত্র।

আমি বুঝতে পারছি না।

ব্যাপারটা একটু জটিল। তবে একটু কনসেনট্রেট করলে বুঝতে পারবেন। আপনি যে চেহারা এবং স্বভাব নিয়ে জন্মেছেন তাতেই আপনার চারদিকে কিছু সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে। তাতে আপনার কিছু করারও নেই। শক্ত মানুষ হলে আত্মরক্ষার কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন। কিন্তু আপনি তেমন শক্ত মানুষ নন, তাই ভেসে গেছেন। এই বাড়িতেই দুখ-দুটি অসমবয়সি মহিলা আপনার প্রতি আসক্ত হয়েছে। একজন নন্দিনী। নন্দিনীর সঙ্গে আপনার গোপন অভিসার প্রথম টের পায় জাহ্নবী। কারণ জাহ্নবীও আপনার অনুরাগিনী। তার বয়স অল্প, তাই হিংসের জ্বালাপোড়াও বেশি। সে ব্যাপারটা শিবাঙ্গীকে বলে দেয়। লক্ষ করলে দেখতে পেতেন, আপনার আর শিবাঙ্গীর ঘরের বন্ধ দরজায় খুব সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক আই বসানোর জন্য একটা ছ্যাদা করা আছে। চালাকি করে সেটা মোম দিয়ে আটকানো। দরকার মতো যন্ত্রটা বসিয়ে নিয়ে আপনার ঘরের সব দৃশ্যই দেখা সম্ভব। পুলিশ যন্ত্রটা শিবাঙ্গীর ক্যাবিনেটে খুঁজেও পেয়েছে।

মাই গড!

সুতরাং আপনার আর নন্দিনীর ব্যাপারটা শিবাঙ্গীর কাছে গোপন ছিল না। নন্দিনী শিবাঙ্গীর বন্ধু হয়েও ওকে অ্যাসেসমেন্ট করতে ভুল করেছিল। ভেবেছিল, ধরা পড়লেও শিবাঙ্গী বড়জোর রাগারগি করবে, তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের মামলা করবে। আর বড়জোর নন্দিনীকে তাড়িয়ে দেবে। শিবাঙ্গী তা করেনি। নন্দিনী যে তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিল না। এটাতেই শিবাজী বোধহয় ফিউরিয়াস হয়ে ওঠে। আমি শুনেছি শিবাঙ্গী খুবই রাগী।

ঠিকই শুনেছেন। রাগলে ওর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।

শিবাঙ্গী আর জাহ্নবী মিলে ঠিক করে নন্দিনীকে সবক শেখাতে হবে। জাহ্নবী ভিক্টরকে ঠিক করে দেয়। ভিক্টর ছোটখাটো উঠতি মস্তান। বোধহয় দু’লাখ টাকার কন্ট্রাষ্ট্রে রাজি হয়ে যায়। পুলিশ শিবাঙ্গীর ব্যাঙ্কে ক্যাশ উইথড্রয়াল চেক করে দেখেছে, জুন মাসের এক তারিখে এক লাখ টাকা ক্যাশ তোলা হয়।

তারপর?

কাহিনিটা একটু জটিল। কথা ছিল খুনটা করবে একা ভিক্টর। সিকিউরিটিকে এড়িয়ে বাড়ি ঢোকার পথ সম্ভবত ছক করে দিয়েছিল জাহ্নবী। ভিক্টর পেছনের দেওয়াল টপকে ঢোকে, গ্যারেজের গাড়ির আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ওপরে ওঠে। ওর ফ্ল্যাটে ঢোকার ব্যবস্থা শিরাঙ্গাই করে দেয়। কিন্তু একটা মস্ত গণ্ডগোল হয়েছিল।

কীসের গণ্ডগোল?

শিবাজী শত্রুর শেষ রাখতে চায়নি। ভিক্টরকে বলা ছিল সে একা আসবে, নন্দিনীকে খুন করবে, তারপর শিবাঙ্গীর কাছ থেকে বাকি এক লাখ টাকা নিয়ে সরে পড়বে। শিবাঙ্গীর প্ল্যান ছিল, ভিক্টর টাকা নিতে ঢুকলেই আগে থেকে প্ৰস্তুত শিবাঙ্গী তাকে গুলি করে মেরে দেবে।

সর্বনাশ! শিবাঙ্গী কি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?

পারে। এবং তার পিছনে আপনি এবং শিবাঙ্গীর ইগো। তার প্ল্যান মতো ঘটনাটা ঘটলে শিবাঙ্গী হয়তো উতরেও যেত। কিন্তু গণ্ডগোল হল ভিক্টর একা খুন করতে আসেনি। সঙ্গে বাদুকেও এনেছিল। হয়তো একা আসতে সাহস পায়নি। আর ওই জন্যই প্ল্যানটা ভেস্তে গিয়েছিল। নন্দিনী অনেক রাত অবধি জেগে তার ঘরে কাজ করে। সম্ভবত বাইরের দরজা খুলে কেউ ঢুকেছে টের পেয়ে সে ব্যাপারটা দেখতে আসে এবং খুন হয়ে যায়। তারপর বাকি টাকা নিতে ভিক্টর শিবাঙ্গীর ঘরে যায়। শিবাঙ্গী তৈরি হয়েই ছিল। ভিক্টর কাছাকাছি হতেই সে গুলি চালায়। কিন্তু প্রবলেম হল, ম্যাডামের শুটিং প্র্যাকটিস ছিল না। আর হ্যান্ডগানগুলোর ব্যারেল ছোট বলে বেশিরভাগ সময়েই তা হয়ে যায়। এরাটিক। গুলি লাগে। ভিক্টরের বা কঁধে। সে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায়। ম্যাডাম হয়তো তাকে ফিনিশ করতে পারত, কিন্তু বাদ সাধল বাদু। সে গুলির আওয়াজ পেয়েই ছুটে এসে ম্যাডামের হাতে পিস্তল। দেখেই ফায়ার করে।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কি একটু জল খেতে পারি?

অবশ্যই।

এবার জল খেতে গিয়ে কাঁপা হাতে জল চলকে পড়ল বিষাণের বুকে। জল খেয়ে দম ধরে বসে রইল একটু। তারপর ধরা গলায় বলল, এবার বাকিটা বলুন মিস্টার দাশগুপ্ত।

ম্যাডাম আগুন নিয়ে খেলছিলেন, বুঝতে পারেননি। বাদুর গুলিতে ওঁর মারা যাওয়ার কথা। কপালজোরে বেঁচে গেছেন।

হ্যাঁ, ডাক্তাররাও বলছিলেন, উনি খুব অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। স্কালে ঢুকলেও গুলি ভাইটিাল জায়গাগুলোকে টাচ করেনি।

জ্ঞান ফেরার পর শিবাঙ্গীর নতুন প্রবলেম দেখা দিয়েছে উনি জানেন না, নন্দিনী সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা বা খুনিরা ধরা পড়েছে কিনা। ওঁর কাছে খবরের কাগজ, মোবাইল বা টিভি নেই। ডাক্তাররা সবাইকে বলে দিয়েছে ওঁকে কোনও খবর দেওয়া চলবে না। আমাকে উনি বারবার নন্দিনীর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।

আমাকেও করেছে। জাহ্নবীকেও।

তবে মনে হয় তিন-চারদিন আগে উনি সত্যটা জানতে পেরেছেন যে, নন্দিনী মারা গেছে। এবং খুনিরা ধরা পড়েছে।

কী করে বোঝা গেল?

উনি এখন ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য প্ৰাণপণ চেষ্টা করছেন।

কীভাবে?

তিনদিন আগে উনি জাহ্নবীকে দিয়ে ওঁর অ্যাকাউন্ট থেকে এক লাখ টাকা ক্যাশ তুলে ভিক্টরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর ভিক্টরের পক্ষে ব্ৰজবাসী দত্তকে দাড় করিয়েছেন। ব্ৰজবাসী একজন ধুরন্ধর ক্রিমিনাল ল-ইয়ার। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। যাতে ভিক্টর কিছু কবুল না করে। আমার কাছে ও যা বলেছে তার রেকর্ড নেই। সুতরাং আদালতে ও বয়ান পালটাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষাণ বলল, অ্যাডভোকেট ব্ৰজবাসী দত্তকে কন্ট্যাক্ট করার জন্য শিবাঙ্গই আমাকে বলেছিল। ওঁকে আমিই কন্ট্যাক্ট করি। আমি কি কোনও অন্যায় করেছি মিস্টার দাশগুপ্ত?

না। উনি এখনও আপনার স্ত্রী। আর স্ত্রী অন্যায় করে থাকলেও আপনার কাজ হল যতদূর সম্ভব তাকে প্রোটেকশন দেওয়া।

শিবাঙ্গী সম্পর্কে যা বললেন তাতে মনে হয় ওর বিরুদ্ধে কেন্সটা খুবই স্ট্রং। ওকে যদি অ্যারেস্ট করা হয় তবে আমাদের ফেস লস হবে। দুটো পরিবারই মর্যাদা হারাবে।

দেখুন, আপনাকে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করতে চাই। এই কেন্সটা অফিসিয়ালি সিআইডি-কে দেওয়া হয়নি। আপনাদের থানার ওসি দিবাকর গুপ্ত আমার দাদার মতো। উনি কেন্সটায় একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছিলেন। ডাকাতি এবং ডাকাতি করতে গিয়ে খুন বলে ওঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। আপনার ওপর ওঁর সবচেয়ে বেশি সন্দেহ ছিল, অথচ আপনার সঙ্গে কথা বলে ওঁর দ্বিধাও হছিল। ফলে উনি আমাকে বলেন সাহায্য করতে। আমি আমার হানচ। এবং ইনফর্মেশন ওঁকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন উনি কী অ্যাকশন নেবেন তা আমি জানি না। তবে সম্ভবত শিবাঙ্গী আর জাহ্নবীর গ্রেফতার এড়ানো যাবে না।

হতাশা মাখা মুখে করুণ গলায় বিষাণ বলল, এর চেয়ে খুনের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপলেই বোধহয় ভাল ছিল। আমি তো একজন রুইনড ম্যান, বাজে লোক, মাতাল, লম্পট! প্ৰতি মুহুর্তেই তো পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

শবর হেসে বলল, এ যাত্রায় সেটা বোধহয় হচ্ছে না। তবে আপনি যতই দাড়ি-গোঁফ রেখে বিষগ্ন মুখে থাকুন না কেন আমার মনে হচ্ছে আপনার চেহারা একটু বেটার হয়েছে। মদটা আর খাবেন না।

খাচ্ছি না। কিন্তু বড্ড একা হয়ে গেলাম মিস্টার দাশগুপ্ত। একাই তো ছিলেন। কিন্তু আপনি তো নাকি মায়ের আদুরে ছেলে। কয়েকদিন মায়ের কাছ থেকে গিয়ে ঘুরে আসুন।

কোন মুখে যাব? একমাত্র মায়ের কাছেই সব মুখ নিয়ে যাওয়া যায়।