২. জাহ্নবী

জাহ্নবী গাড়ি চালাতে শিখে গিয়েছিল মাত্র পনেরো বছর বয়সে। রঘুবীর সিং শিখিয়েছিল। ম্যাডামের হুকুমে। সবে যখন ষোলোয় পা তখন একদিন ম্যাডাম নিয়ে গেল তার ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে। বয়সের গড়বড় তো ছিলই, কিন্তু ম্যাডাম কলকাঠি নেড়ে বয়স বাড়িয়ে লাইসেন্স বের করে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তুই আমার গাড়ি চালাবি।

জাহ্নবীর বুক ধড়ফড়, ওরে বাবা! কলকাতার রাস্তায় আমি চালাব?

ভয় পেলে থাক। কিন্তু সাহস করলে পেরে যাবি। আমি তোর চেয়েও অল্প বয়সে গাড়ি চালিয়েছি।

জাহ্নবীর সাহসের অভাব ছিল না। প্ৰথম কয়েকদিন ম্যাডাম সামনের সিটে তার পাশে বসে একটু-আধটু গাইড করত। মাসখানেকের মধ্যে হাত-পা সব সেট হয়ে গেল। সেই থেকে সে ম্যাডামের ড্রাইভার।

ওখানেই থেমে থাকতে দেয়নি ম্যাডাম। বাড়িতে ম্যাডামের যে সব বিউটিশিয়ান আসত তাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে ক্ৰ প্লাক, ম্যানিকিয়োর, পেডিাকিয়োর, মাস্ক তৈরি করা এবং কয়েক রকমের চুলের ছাঁট দিতেও শিখেছে সে। ম্যাডামের একটাই কথা ছিল, ট্রেনিং থাকলে ঝি খেটে মরতে হবে না, বুঝলি?

জাহ্নবীর এখন সতেরো বছর বয়স। ছিপছিপে জোরালো চেহারা। ম্যাডাম নিজের সঙ্গে তাকে জিম করাত, ওয়েট ট্রেনিং আর যোগা। জাহ্নবী বুঝতে পারছিল, ম্যাডাম তাকে তৈরি করে দিচ্ছেন। ম্যাডামের পারফিউম ল্যাবেও সে কাজ করে। ভারী মজার কাজ। কনসেনট্রেটেড নিৰ্যাস থেকে ব্যবহারযোগ্য পারফিউম তৈরি করা, খুব বড় ব্যাবসা নয়। মাত্র কয়েকজন বাঁধা খদের। তৈরি হতে না হতে বিক্রি হয়ে যায়। দাম খুব চড়া।

সতেরোতে এসে সব উলটেপালটে গেল। ম্যাডাম হাসপাতালে আইসিইউ-তে। বাঁচেন কিনা সন্দেহ। নন্দিনী ম্যাডাম খুন। পুলিশের জেরায় জেরায় বাঁঝরা হয়ে সে এখন বাধ্য হয়ে তাদের হাজরার বস্তিতে নিজের সংসারে এসে উঠেছে। ব্যাঙ্কে তার অ্যাকাউন্টে টাকা কম নেই। মাসের বেতন ব্যাঙ্কে জমা হয়ে যেত। কিন্তু এখন তার ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত। কী হবে কে জানে! তবে জাহ্নবীর ভয়ডর বিশেষ নেই।

তার মোটামুটি ভয়হীন জীবনে অনেকদিন বাদে হঠাৎ একটু যেন ভয়ের ব্যাপার ঘটল। খুন-জখম হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের হুজতে হয়রান হয়েও ভয়টয় বিশেষ হয়নি তার। কিন্তু সোমবার সকালে জিনস-এর প্যান্ট আর সাদা হাওয়াই শার্ট পরা যে লোকটা তার সঙ্গে কথা বলতে এল তার চোখের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুকটা ধড়ধড় করে উঠল। তার। অথচ লোকটা তেমন লম্বাচওড়া নয়। বরং একটু ছোটখাটো চেহারাই। পালোয়ানি শরীরও নয়। তবে গড়নটা মজবুত। কিন্তু চোখ দুটোই হাড় হিম করা। কাল রাতে মোবাইলে বড়বাবু তাকে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন, সকালে সে যেন কোথাও না যায়, একজন গোয়েন্দা তাকে প্রশ্ন করতে আসবে।

যে এল তার নাম শবর দাশগুপ্ত। জিপ থেকে নেমে গলির রাস্তায় পা দিতেই বাচ্চু ছুটে এসে খবর দিল জাহ্নবীকে, কে এসেছে জানিস? শবর দাশগুপ্ত। সুপার কপ।

শবর দাশগুপ্তকে একটা চেয়ার দেওয়া হল। গোমরামুখো নয়। আবার বোকা বোকা হাসিও নেই মুখে। চারদিকে চেয়ে তাদের ঘরদোর একটু দেখল, তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, এখানে কবে এসেছ?

ছয় তারিখে।

শিবাঙ্গীর বাড়িতে কতদিন আছ?

তেরো বছর বয়স থেকে।

তেরো বছর।

হ্যাঁ।

তেরো বছর বয়সের কাউকে কাজে রাখা বে-আইনি তা জানো?

বাঃ রে! আমি যখন আমার মায়ের কাছে থাকতাম তখনও তো ঘরের কাজ করতে হত। সাত-আট বছর বয়স থেকেই জল আনা, বাসন মাজা, ঘর ব্যাটানো, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করা, সব। সেটা বে-আইনি নয়?

শবর এবার হাসল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। তাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। তুমি ষোলো বছর বয়স থেকেই গাড়ি চালাও।

হ্যাঁ। ম্যাডাম আমাকে সব কাজে পাকা করতে চেয়েছিলেন। আমি এক বছর যাবৎ গাড়ি চালাচ্ছি। কখনও কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করিনি। কোনও কেস খাইনি।

হ্যাঁ। আমি তোমার রেকর্ড চেক করেছি।

আপনি কি আমার লাইসেন্স ক্যানসেল করে দেবেন?

না। ওটা মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আর তুমি যখন গাড়ি ভালই চালাও তখন আমার গরজ কীসের?

থ্যাঙ্ক ইউ।

তুমি পুলিশের জেরায় বলেছ, ঘটনার সময়ে তুমি বাড়িতে ছিলে না।

না। পুলিশকে আমি তো বলেইছি যে সেই রাতে আমি ম্যাডামের বোন শ্যামাঙ্গীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম বড় গাড়িটা নিয়ে। রাত বারোটায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা ছিল।

রাতের ফ্লাইটে রিসিভ করতে তোমাকে পাঠানো হয়েছিল কেন?

ওটা ইমার্জেন্সি ছিল। রঘুবীর সিং-এর মায়ের দয়া হয়েছিল সেদিনই। সকালে। তাই ম্যাডাম আমাকে পাঠান।

তুমি একা?

না। সঙ্গে বুম্বা ছিল।

বুম্বা মানে ইস্তিরিওয়ালা? নীচে যার গুমটি আছে?

হ্যাঁ। শ্যামাঙ্গী ম্যাডামের ফ্লাইট আধঘণ্টা লেট ছিল। রাত একটায় আমি ওঁকে পিক আপ করি। তারপর সোজা বারুইপুর। ফেরার সময় অবশ্য বুম্বা বাইপাসে সায়েন্স সিটির কাছে নেমে ফিরে আসে।

তুমি রাতে বারুইপুরে শ্যামাঙ্গীদের বাড়িতেই ছিলে?

হ্যাঁ। অত রাতে ওঁরা ফিরতে দিলেন না।

তুমি কখন খবর পাও?

খবর পাইনি। শ্যামাঙ্গী ম্যাডাম অনেকবার আমাদের ম্যাডামকে ফোন করেন। নন্দিনী ম্যাডামের নম্বরেও ফোন করা হয়। নো রিপ্লাই। আমরা ভাবলাম ম্যাডামরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। শোওয়ার সময় ম্যাডাম ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখে শুতেন। ওঁর ঘুমের প্রবলেম ছিল।

ওখান থেকে কখন ফিরে এসেছিলে?

সকালে ব্রেকফাস্টের পর। রাতেই আমি ম্যাডামকে একটি মেসেজ করে রেখেছিলাম যে, সকালে ফিরব। আমি সাড়ে আটটায় পৌছাই এসে। তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বাইরেও খুব ভিড়।

তুমি কি শিবাঙ্গীর সঙ্গে ফ্ল্যাটের মধ্যেই থাকো?

সবসময়ে নয়। সারভেন্টস কোয়াটারে আমার ঘর আছে। তবে অনেক সময়েই ম্যাডাম রেখে দিতেন।

নন্দিনী ম্যাডাম সম্পর্কে কিছু বলবে?

সব বলা হয়ে গেছে। তিন-চারবার করে। আর কী শুনবেন?

যা বলা হয়নি। ধরে যদি জিজ্ঞেস করি বিষাণ রায়ের সঙ্গে নন্দিনীর সম্পর্কটা কেমন ছিল। বা তুমি ওই দু’জনের মধ্যে কিছু লক্ষ করেছ কিনা।

না, কিছু ছিল না। দাদা ভীষণ ভাল লোক। ভীষণ ভাল।

বিষাণ রায়কে কি তুমি দাদা বলে ডাকো?

হ্যাঁ।

তা হলে শিবাঙ্গীকে বউদি নয় কেন?

উনি বউদি ডাক পছন্দ করেন না।

তুমি বিষাণ রায়কে পছন্দ করো?

কেন করব না? দাদা খুব ভাল।

বিষাণ মদ খায়, জানো তো!

ধুস। আজকাল কে না খাচ্ছে! ম্যাডাম খেতেন, নন্দিনী ম্যাডাম খেতেন, আমিও কতদিন খেয়েছিা।

বুঝলাম। বিষাণের কী কী গুণ আছে বলতে পারো?

আমি তো অতি জানি না। তবে দাদা কখনও মিথ্যে কথা বলে না, কখনও চোঁচামেচি করে না, কখনও কাউকে অপমান করে না, ম্যাডাম দাদাকে যা খুশি বললেও দাদা কখনও উলটে কিছু বলে না। মদ খাওয়া ছাড়া দাদার মধ্যে আমি কখনও কোনও বেচাল দেখিনি। আর ম্যাডাম ইচ্ছে করলেই দাদাকে মদ ছাড়াতে পারতেন।

কীরকম?

দাদা তো ম্যাডামকে ভীষণ ভয় পায়।

ভয় পায় কেন?

ম্যাডামের সব ভাল, কিন্তু বড্ড রিগচটা। খুব সামান্য কারণেই ভীষণ রেগে যান। দাদা ওই রাগকেই বোধহয় ভয় পায়।

শিবাজীর সঙ্গে নন্দিনীর কীরকম ভাব ছিল?

দু’জন তো বন্ধু। ভােব তো ভালই ছিল।

দু’জনের কখনও ঝগড়া হত না?

ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া। পাগল নাকি? ম্যাডামের চোখে চোখ রেখে কেউই কথা বলতে পারত না।

তুমিও কি ম্যাডামকে ভয় পাও?

ও বাবা। সাংঘাতিক। তবে হ্যাঁ, ম্যাডাম আমাকে খুবই ভালবাসেন।

অথচ ম্যাডামের চেয়ে বিষাণ রায়ের প্রতিই তোমার পক্ষপাত বেশি। তাই না?

জাহ্নবী হেসে ফেলল। তারপর বলল, কী করব, দাদা যে বড্ড বেচারা মানুষ। দেখলেই মায়া হয়।

যদি প্রমাণ হয় যে বিষাণ রায়ই নন্দিনী আর শিবাঙ্গীকে খুন করার পিছনে রয়েছে?

মরে গেলেও বিশ্বাস করি না। আপনি তো দাদাকে চেনেন না। একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় একটা বড় নীল মাছি চলে এসেছিল টেবিলের ওপর। রাঁধুনি নিতাইদা সেটাকে একটা ফ্লাই স্নাটার দিয়ে মারে। দাদা তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল, কেন মারলি? কেন মারলি? বলে চোখ ছলছল। ভাল করে খেলই না সেদিন।

তুমি তো দেখছি বিষাণ রায়ের ডাই হার্ড ফ্যান!

হ্যাঁ তো। দাদাকে আমি ভীষণ ভালবাসি।

দাদাও কি তোমাকে ইকোয়ালি ভালবাসে?

দাদা। নাঃ, দাদা তো বাড়িতে কারও সঙ্গে কথাই বলে না। কারও দিকে তাকিয়েও দেখে না। খুব চুপচাপ থাকে। আমার তো মনে হয় রাস্তায়-ঘাটে আমাকে মুখোমুখি দেখলে দাদা চিনতেও পারবে না।

বিষাণ রায় কি এতটাই অন্যমনস্ক?

ভীষণ। কিন্তু গভীর মানুষ নয়। রাশভারী মানুষকে দেখলে যেমন ভয় ভয় করে, দাদাকে দেখলে তেমনটা হয় না।

তোমার সঙ্গে কখনও কথাটথা বলে না?

খুব কম। দাদা ফাইফরমাশ করতে পছন্দ করে না। তবে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ঘরটা একটু গুছিয়ে দিতাম।

ড্রাঙ্ক অবস্থায় বমি করলে তুমি কি কখনও ওঁকে অ্যাটেন্ড করেছ?

বমিটমি খুব একটা করে না তো! একবার বা দু’বার গিয়ে ধরেছিলাম। অনেকদিন আগে। আর একবার জ্বর হয়েছিল, তখন জোর করেই মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম।

জোর করে কেন?

তখন ওঁর একশো চার ডিগ্রি জ্বর। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই। আমি মাথা ধোয়াতে চাইলে খুব আপত্তি করতে লাগলেন। কিন্তু আমি দেখলাম, মাথা না ধোয়ালে জ্বর হয়তো আরও বাড়বে। তাই নিতাইদাকে ডেকে এনে অয়েল ক্লথ বিছিয়ে একরকম জোর করে। অনেকক্ষণ ধরে মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম। তাতে খুব খুশি ছিলেন। জ্বর ছাড়বার পর একদিন আমাকে ডেকে দুশো টাকা দিয়ে বললেন, শাড়িটাড়ি কিছু কিনে নিয়ো। আমি টাকা নিলাম না। বললাম, বাড়ির লোক সেবা করলে কি বখশিশ দিতে হয়? কথাটা ওঁর ভাল লেগেছিল।

বিষাণের সঙ্গে তোমার শেষ কবে দেখা হয়েছে?

রোজই তো হয়। কালও গিয়েছিলাম। আজও যাব। নার্সিংহোমে ম্যাডামকে দেখতেও যাই দু’বেলা।

তোমার তো ও বাড়িতেই থাকার কথা।

সেটা তো ভাল দেখাবে না। শত হলেও আমি তো বয়সের মেয়ে, দাদার সঙ্গে একা বাড়িতে থাকি কী করে? সকালে গিয়ে গাড়িটার স্টার্ট দিই। ডাস্টিং করি। দাদার ঘর, ম্যাডামের ঘরাও ডাস্টিং করতে হয়।

বিষাণবাবুর সঙ্গে মার্ডার নিয়ে কোনও কথা হয়েছে?

মার্ডার নিয়ে এত কথা হচ্ছে যে আর ওসব নিয়ে কথা কইতে ইচ্ছে করে না। দেখছি দাদা আজকাল ড্রিঙ্ক করছেন না, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করছেন না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকেন, না হলে কম্পিউটারে কাজ করেন। দাড়ি বড় হয়ে গেছে। ওঁর খেয়াল রাখার তো কেউ নেই। আমার খুব কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু বলতে সাহস হয় না। শুনছি পুলিশ নাকি ওঁকে অ্যারেস্ট করবে?

হ্যাঁ, তা পারে।

কিন্তু সেটা খুব ভুল হবে। দাদা ওরকম লোক নয়।

তা হলে খুনটা কে করেছে বলে তোমার মনে হয়?

আমি জানি না তো!

নন্দিনীর সঙ্গে বা তোমার ম্যাডামের সঙ্গে কারও শক্ৰতা ছিল জানো?

না। নন্দিনী ম্যাডাম তো সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর কাজের লোকদের দিয়ে কাজ-করিয়ে নেওয়াটাও ওঁর কাজ ছিল। ফ্ল্যাটটা ছয় হাজার স্কোয়ার ফুটের। টুইন ফ্ল্যাট। অন্য ফ্ল্যাটটা তো ফাকাই পড়ে থাকে। তবু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়।

তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?

বয়ফ্রেন্ড। নাঃ, আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই।

কেন নেই?

কেন থাকবে? আজিকালিকার ছেলেগুলোকে দেখেছেন? সারাদিন ছোঁক ছোঁক করে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন একা গাড়ি চালাই প্ৰায় সময়েই কিছু পয়সাওলা ছেলেছোকরা গাড়ি করে পিছু নেয়। পাশাপাশি এসে জানালা দিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। আপনিই বলুন, এদের কাউকে বয়ফ্রেন্ড বলে ভাবা যায়?

তুমি তো খুব চুজি দেখছি।

একটু আছি।

বলতে পারো নন্দিনী ম্যাডামের কোনও অ্যাফেয়ার ছিল কিনা।

ঠিক জানি না, উনি তো খুব আপনমনে থাকতেন।

ওঁর বয়স সাতাশ-আঠাশ, চেহারা ভাল। ওঁর তো কোনও বয়ফ্রেন্ড থাকারই কথা। কখনও কারও সঙ্গে ওঁকে দেখেছ?

না।

নন্দিনী ম্যান্ডামের সঙ্গে তোমার কেমন ভাব ছিল?

ছিল না স্যার। উনি আমাকে পছন্দ করতেন বলে আমার মনে হয় না।

কেন, তুমি কী করেছ?

কিছুই তো করিনি।

অপছন্দটা কীভাবে বুঝতে পারতে?

ওসব বোঝা যায়। আমাকে দেখলেই মুখটা আঁশটে হয়ে যেত।

ব্যস? ওটুকুই?

না। আরও অনেক ব্যাপার ছিল। ছোটখাটো ব্যাপার। তবে আমাকে ম্যাডাম তো বাইরের কাজেই বেশি পাঠাতেন, তাই আমাকে নন্দিনী ম্যাডামের মুখোমুখি বেশি হতে হত না।

তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। শুনে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না।

কী কথা?

আমার সন্দেহ নন্দিনী ম্যাডামের সঙ্গে বিষাণ রায়ের একটা অ্যাফেয়ার চলছিল।

অসম্ভব!

অসম্ভব কেন? বিষাণবাবুর সঙ্গে শিবাঙ্গীর সম্পর্ক ভাল ছিল না। বিষাণবাবু একজন অ্যাট্রাকটিভ মানুষ এবং প্রচুর টাকার মালিক। নন্দিনী যথেষ্ট সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। অ্যাফেয়ার তো হওয়াই স্বাভাবিক।

দাদা নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তাই দিত না।

কী করে বুঝলে?

বুঝব না কেন? আমার কি ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ নেই?

আছেই তো! এবং চোখ দুটো খুব সুন্দর। কথাটা নিশ্চয়ই তোমাকে অনেকেই বলেছে।

জাহ্নবী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে একটু হাসল। তারপর বলল, ছাই সুন্দর।

জানতে চাইছি, ওই দুটো সুন্দর চোখ দিয়ে তুমি ঠিক কী কী দেখেছ, যাতে মনে হতে পারে যে বিষাণ রায় নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তা দিতেন না।

ইদানীং দেখছিলাম নন্দিনী ম্যাডাম সকালের দিকে প্রায়ই দাদার ব্রেকফাস্টের সময় এসে উলটো দিকে বসতেন। বেশ সেজোগুজে।

সেজোগুজে?

মানে ঠিক খুব বেশি সাজ নয়। হয়তো একটা বেশ চটকদার কিমোনো পরলেন, চুলটা একটু কায়দা করলেন, অল্প মেক-আপ, হালকা লিপস্টিক। ওসব আপনি বুঝবেন না। মেয়েরা বুঝতে পারে।

তা তো ঠিকই। কিন্তু উনি হয়তো ওই সময়ে ব্রেকফাস্ট করতেই এসে বসতেন।

মোটেই না। ম্যাডাম বা নন্দিনী ম্যাডাম তো ব্রেকফাস্ট করেনই না। শশা, দই আর কয়েক টুকরো ফল।

তবে এসে বসতেন কেন?

বুঝে নিন।

দু’জনে কথাবার্তা হত না?

নন্দিনী ম্যাডাম বা দাদা কেউই খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে মানুষ নয়। নন্দিনী ম্যাডামকে দেখেছি। টোস্টে বাটার লাগিয়ে দিতে। দরদ দেখানো আর কী। দাদা তো তাকিয়েও দেখত না।

তার মানে নন্দিনীর বিষাণের ওপর দুর্বলতা ছিল?

ছিল।

কখনও বাড়াবাড়ি কিছু দেখোনি?

বললাম তো দাদা পাত্তা দিত না।

ব্যাপারটা তোমার ম্যাডামকে জানিয়েছিলে?

বাপ রে। ম্যাডামকে কে বলতে যাবে?

তুমি কি জানতে যে তোমার ম্যাডামের একটা পিস্তল ছিল?

না। তবে ওই ঘটনার পর পুলিশের কাছে শুনেছি।

তুমি তো শিবাঙ্গীর ঘর গোছগাছ করতে, কখনও দেখোনি?

না। আমার তো ক্যাবিনেট বা লকার খোলার হুকুম নেই।

শিবাঙ্গী তো মাঝেমাঝে কলকাতার বাইরে যেত, তাই না?

হ্যাঁ। ওঁর ব্যাবসার কাজে যেতে হত। দিল্লি, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক।

ঘটনার আগে কবে শেষবার বাইরে গেছে বলতে পারো?

পারি। ম্যাডামের টুর আমায় মনে রাখতে হয়। মে মাসের ষোলো আর সতেরো তারিখে উনি বোম্বে গিয়েছিলেন। চকিবশ আর পঁচিশ তারিখে দিল্লি।

সেই সময়ে কি নন্দিনী আর বিষাণ এক ফ্ল্যাটে ছিল?

না। ম্যাডাম বাইরে গেলে আমাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে থাকতে হত। ম্যাডামের ঘরে। অনেক দামি জিনিস আছে তো, তাই।

অর্থাৎ তোমাকে পাহারা দিতে হয়?

হ্যাঁ।

ম্যাডামের বিছানাতেই কি শোও?

বাপ রে। ম্যাডামের বিছানায় কে শোবে? ম্যাডাম কেটে ফেলবে তা হলে আমার একটা ফোল্ডিং খাট আছে, সেটা পেতে শুই।

তার মানে মে মাসের ষোলো, সতেরো, চব্বিশ আর পাঁচশ তুমি ম্যাডামের ঘরেই রাতে শুয়েছিলে?

হ্যাঁ। কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? পুলিশ তো জিজ্ঞেস করেনি।

আমিও তো পুলিশ।

হুঁ। কিন্তু আপনি একটু অন্যরকম। ঠিক পুলিশ পুলিশ মনে হয় না। বাচ্চু বলছিল। আপনি নাকি সুপার কপ।

তা তো আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি যে, আমি একজন পুলিশ কর্মচারী। তুমি বোধহয় জানো সেদিন রাতে শিবাঙ্গী নিজেকে বাঁচাতে তার পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। গুলিটা খুনিদের একজনের গায়েও লাগে। ঘরের মেঝেতে তার রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।

জানি। সব শুনেছি। ম্যাডামের হেভি সাহস।

আমি শুনেছি। তুমিও খুব সাহসী মেয়ে!

জাহ্নবী কাঁধটা একটু বাঁকিয়ে একটা বখাটে হাসি হাসল। তারপর বলল, এ বাজারে সাহসী না হলে আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি চলে?

মারপিট করো নাকি?

না, শুধু শুধুমারপিট করব কেন? তবে দরকার হলে হাত-পা চালিয়ে দিই।

এরকম কোনও ঘটনা কি ঘটেছে?

জাহ্নবী আবার হাসল, কেস দেবেন না তো স্যার?

আরে না। মেয়েরা মারপিট করলে আমি খুশিই হই।

তিন-চারবার মারপিট হয়েছে। বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে।

বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে! তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে। মেরেছি, না মার খেয়েছ?

মারপিট করলে মার খেতেও হয়। কোনও হিরো তো আর আমাদের বাঁচাতে আসে না, সিনেমার মতো।

ঠিক কথা। মেয়েরা হিরোর জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবেই বা কেন? প্রত্যেকটা মেয়ের নিজেরই হিরো হয়ে ওঠা উচিত।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করো।

দাদাকে কি আপনারা অ্যারেস্ট করবেন?

সেটা তদন্তের ওপর নির্ভর করছে। খুনিরা ধরা পড়ে গেলে এবং তোমার দাদার নাম বললে অ্যারেস্ট তো হবেই।

না। স্যার, দাদার নাম বলবে কেন?

বলবে না, তুমি কী করে জানো?

দাদা ও কাজ করতেই পারে না।

বাইরে থেকে দেখে মানুষকে আর কতটুকু চেনা যায়! তবে এখনই অ্যারেস্ট করা হচ্ছে না, এটুকু বলতে পারি। কিন্তু তোমার দাদার চেয়েও তোমার ম্যাডামের বিপদ বেশি। তাঁর হেড ইনজুরি, কোমায় আছেন। বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ত্ৰিশ পারসেন্ট। তাঁর জন্য তোমার টেনশন হচ্ছে না?

হচ্ছে। খুব হচ্ছে। কিন্তু কাল ডাক্তার সেন দাদাকে বলেছেন, ম্যাডামের প্রাণের ভয় নেই। আমি নিজে শুনেছি।

তাই বুঝি?

হ্যা স্যার। কাল দাদাকে আমিই তো গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছি।

তুমি কেন? বিষাণের তো আলাদা গাড়ি আছে।

আছে। কিন্তু ওঁর মনের যা অবস্থা গাড়ি চালাতে গেলে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবেন।

হুঁ। সে-কথা ঠিক। উনি খুব নার্ভাসনেসে ভুগছেন।

খেতে চাইছেন না, ঘুমোচ্ছেন না ভাল করে। ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। গালে বড় বড় দাড়ি। আমি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে খাওয়াই।

তুমি বললে খান?

খুব বিরক্ত হন। তবে সামান্য একটু মুখে তোলেন।

কতক্ষণ থাকো ওঁর কাছে রোজ?

কাছে থাকা তো সম্ভব নয়। উনি কম্পিউটারে কাজ করেন, কাগজ বা বই পড়েন, টেলিফোনে কথা বলেন। আজ তো পুলিশের পারমিশন নিয়ে অফিসেও যাবেন শুনেছি।

হ্যাঁ, ওঁকে পারমিশন দেওয়া হয়েছে।

ওঁকে ছেড়ে দিন স্যার। উনি কিছু করেননি।

কিন্তু কেউ তো করেছে। সেটা না জানা অবধি ওঁকে তো সন্দেহের বাইরে রাখতে পারি না।

ওরকম ভাল একটা লোককে সন্দেহ করা কি ঠিক?