০৫. ফাস্ট ক্লাস চা

॥ ৫ ॥

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল প্রায় সাতটায়। ফেলুদা অবিশ্যি তার আগেই উঠে যোগব্যায়াম, দাড়ি কামানো-টামানো সব সেরে ফেলেছে। কথা আছে, তড়িৎবাবু আটটায় এসে আমাদের নিয়ে জল্পেশ্বরের মন্দির দেখিয়ে আনবেন। মহীতোষবাবুর তিনজন চাকরের মধ্যে যার নাম কানাই, সে আমাদের চা দিয়ে গেল সাড়ে সাতটার কিছু পরে। ফেলুদা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কোলের উপর রাখা খোলা খাতাটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে প্রায় আপন মনেই বলে উঠল, ‘ধন্যি আদিত্যনারায়ণ। তুখোড় বুদ্ধি বলতে হবে।’

লালমোহনবাবু চকাৎ শব্দ করে চায়ে একটু চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বাঃ, ফার্স্ট ক্লাস চা। — আরও এগোলেন বুঝি?’

ফেলুদা সেইভাবেই বিড়বিড় করে বলল, ‘হাত গোন ভাত পাঁচ। ভাত হল অন্ন আর পাঁচ হল পঞ্চ। দুটোকে উলটিয়ে নিয়ে সন্ধি করে হল পঞ্চান্ন। অর্থাৎ পঞ্চান্ন হাত। বাঃ! …কিন্তু কীসের থেকে পঞ্চান্ন হাত? বুড়ো গাছ কী? তাই হবে…তাই হবে…’

ফেলুদার গলা মিলিয়ে এল। আমার মন বলছে, ও দু’দিনের মধ্যেই সংকেতের সমাধান করে ফেলবে, আর বাঘছালটা পেয়ে যাবে।

বারান্দার ঘড়িতে কিছুক্ষণ আগেই আটটা বেজে গেছে, কিন্তু তড়িৎবাবু এখনও আসছেন না কেন? ফেলুদার কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। সে একমনে সংকেত নিয়ে ভেবে চলেছে, আর মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে উঠছে।

‘ঠিক ঠিক জবাবে…ঠিক ঠিক জবাবে…। কীসের জবাব? প্রশ্নটা কই যে তার জবাব হবে? দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে…ঠিক ঠিক জবাবে…’

এবার ফেলুদার বিড়বিড়ানি বন্ধ হবার আগেই দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে একজন লোক ঢুকে পড়ল। তড়িৎবাবু নন। শশাঙ্কবাবু।

‘আপনারা—ইয়ে—চা খাচ্ছেন? ও…’

ভদ্রলোকের চেহারা দেখেই মনে হল কিছু একটা হয়েছে। ফেলুদা খাতা রেখে উঠে পড়ল।

কী ব্যাপার বলুন তো?’

শশাঙ্কবাবু গলা খাকরিয়ে কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘একটা দুঃসংবাদ আছে। তড়িৎ, মানে মহীতোষের সেক্রেটারি, মারা গেছে।’

‘সে কী? কী হয়েছিল? কাল রাত্রেও তো…’

কথাটা বলল ফেলুদা, কিন্তু আমরা তিনজনেই সমান হতভম্ব। শশাঙ্কবাবু বললেন, ‘কাল রাত্রে কালবুনির দিকে গিয়েছিল— কেন জানি না— এই একটুক্ষণ আগে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এক কাঠুরে দেখতে পায়, আর দেখেই এসে খবর দেয়।’

‘কী ভাবে মারা গেলেন?’

‘কাঁধের অনেকখানি মাংস নাকি খেয়ে গেছে। বাঘ বলেই তো মনে হচ্ছে।’

ম্যান-ইটার! আমার হাত-পা আবার ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। লালমোহনবাবু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিন পা পিছিয়ে গিয়ে টেবিলে ভর করে দাঁড়ালেন। ফেলুদার মুখের ভাব অদ্ভুত রকম গম্ভীর।

শশাঙ্কবাবু বললেন, ‘আপনারা এলেন, আর তার মধ্যে এই দুর্ঘটনা। বুঝতেই পারছেন, আমাদের এখন এই নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকতে হবে। এখনই, মানে, একবার যেতে হবে আর কী।’

‘আমরাও যেতে পারি কি?’

শশাঙ্কবাবু প্রশ্নটা শুনে ফেলুদার দিকে একবার দেখে তারপর আমাদের দুজনের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘আপনি তো গোয়েন্দা মানুষ, আপনার এসব অভ্যেস আছে, কিন্তু এঁরা…’

‘ওরা গাড়িতেই থাকবে।’

ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘তা হলে আপনারা তৈরি থাকলে চলে আসুন। দুটো জিপ আছে, একটাতে না হয় আপনারা তিনজন যাবেন।’

‘বন্দুক থাকবে কি সঙ্গে?’

প্রশ্নটা আমিও করতে পারতাম, কিন্তু করলেন লালমোহনবাবু। অন্য সময় এ ধরনের প্রশ্ন শুনলে হয়তো শশাঙ্কবাবু হেসে ফেলতেন, কিন্তু এখন গম্ভীরভাবেই বললেন, ‘থাকবে। দিনের বেলা এমনিতে ভয় নেই, তবু থাকবে।’

জিপে করে জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটার কথা ভাবছিলাম। কালই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে এত কথা বললেন, আর রাতারাতি তাকে বাঘে খেল? এত রাত্তিরে কী করছিলেন উনি জঙ্গলের মধ্যে? তা হলে কি কাল রাত্তিরে যে আলোটা দেখেছিলাম সেটা তড়িৎবাবুরই টর্চের আলো?

আমাদের জিপের সামনে আরেকটা জিপ চলেছে। তাতে রয়েছেন মহীতোষবাবু, শশাঙ্কবাবু, এখানকার বনবিভাগের একজন কর্মচারী মিস্টার দত্ত, শিকারি মাধবলাল, আর যে লোকটা তড়িৎবাবুর মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল সেই কাঠুরে। মহীতোষবাবুকে কাল রাত্রেই হই-হই করে শিকারের গল্প বলতে শুনেছিলাম, আর আজ দেখে মনে হল এক রাত্তিরে তার দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। সেটা শুধু সেক্রেটারির মৃত্যুর জন্য, না ম্যান-ইটার আছে এটা প্রমাণ হবার জন্য, তা অবিশ্যি বুঝতে পারলাম না।

জঙ্গলের ভিতরে খুব বেশি দূরে যেতে হল না। বড় রাস্তা থেকে ঘুরে মিনিট পাঁচেক যাবার পর আমাদের সামনের জিপটা থামল। রাস্তার দু’ দিকে শাল আর সেগুন গাছ, আর তা ছাড়া আমার চেনার মধ্যে শিমুল, নিম, একটা প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছ আর কয়েকটা বাঁশঝাড়। কাল রাত্রে যে বৃষ্টি হয়েছে তার ছাপ রয়েছে চারদিকে। এখানে ওখানে ছোট ছোট গর্ত আর খানাখন্দের মধ্যে জল জমে রয়েছে।

জিপ থামার সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা বলল, ‘ওই দ্যাখ।’

ও যেদিকে আঙুল দেখাল সেদিকে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থাকার পর দূরের একটা বাঁশঝাড়ের ধারে একটা ঝোপের পিছনে হাল্‌কা সবুজ রঙের যে জিনিসটা চোখে পড়ল সেটা আমার চেনা। ওটা তড়িৎবাবুর শার্ট। কাল রাত্রে ভদ্রলোক ওই শার্টটাই পরেছিলেন।

সামনের জিপ থেকে সবাই নেমেছে। কাঠুরে লোকটা এগিয়ে গেল। তার পিছনে চললেন মহীতোষবাবু ও বাকি তিনজন। ফেলুদাও জিপ থেকে নেমে বলল, ‘তোরা গাড়িতে থাক। এ দৃশ্য তোদের ভাল লাগবে না।’

যেখানে তড়িৎবাবুর মৃতদেহ পড়ে আছে সে জায়গাটা আমাদের জিপ থেকে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে। কিন্তু জঙ্গল এত নিস্তব্ধ বলেই বোধহয় সকলের কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। যার মুখে যা শুনলাম তা পর পর লিখে যাচ্ছি।

বাঁশঝাড়টার ধারে পৌঁছে প্রথম কথা বললেন মহীতোষবাবু। শুধু দুটো কথা— ‘মাই গড!’—আর সেই সঙ্গে তাঁর ডান হাতের তেলোটা দিয়ে কপালে একটা আঘাত করলেন।

এবার মিস্টার দত্ত মৃতদেহটার দিকে এগিয়ে গেলেন, আর তার পরেই তাঁর কথা শোনা গেল।

‘এই বৃষ্টিতে বাঘের পায়ের ছাপ খোঁজার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু বাঘ বলেই তো মনে হচ্ছে। তাই নয় কি?’

মহীতোষবাবু— ‘নিঃসন্দেহে।’

মিস্টার দত্ত—‘কাল বৃষ্টি থেমেছে দুটোর পর। যেভাবে রক্ত ধুয়ে গেছে তাতে মনে হয়, খাওয়ার ব্যাপারটা বৃষ্টির আগেই সেরে ফেলেছে।’

ফেলুদা— ‘ম্যান-ইটার কি যেখানে মানুষ মারে, সেখানেই খাওয়ার কাজটা সারে? অনেক সময় ওরা শিকার মুখে করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায় না?’

মহীতোষবাবু— ‘তা তো বটেই। তবে আপনি যদি আশা করেন যে, মাটিতে ঘসটে টেনে আনার দাগ থাকবে, সেটার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। এমনিতেই বৃষ্টিতে দাগ মুছে যাবে। তা ছাড়া একটা মানুষের দেহ বাঘ মুখে করে এমনভাবে নিয়ে যেতে পারে যে, সে দেহ মাটি টাচ-ই করবে না। সুতরাং তড়িৎকে কোথায় ধরেছিল বাঘে সেটা বোধহয় জানা যাবে না।’

ফেলুদা— ‘তড়িৎবাবুর চশমাটা কোথায় পড়েছে সেটা জানতে পারলে হয়তো…’

এরপর কিছুক্ষণ কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। শশাঙ্কবাবু বোধহয় বাঘের পায়ের ছাপ খোঁজার জন্য এদিক ওদিক দেখছেন। ফেলুদা এখনও মৃতদেহের কাছেই রয়েছে। মিস্টার দত্ত মাধবলালকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আবার ফেলুদার গলা পাওয়া গেল।

ফেলুদা— ‘বাঘ কি কেবল একটা মাত্র নখের সাহায্যে একটা গভীর আঁচড় দিতে পারে?’

মহীতোষবাবু—‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

ফেলুদা—‘আপনারা বোধহয় লক্ষ করেননি—তড়িৎবাবুর বুকের কাছে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শার্ট ভেদ করে একটা ধারালো জিনিস তার শরীরের মধ্যে ঢুকেছে। আপনারা এইখানে এলেই দেখতে পাবেন।’

কথাটা বলা মাত্র সকলে ব্যস্তভাবে তড়িৎবাবুর মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর মহীতোষবাবুর গলা গেলাম।

মহীতোষবাবু—‘সর্বনাশ! এ যে খুন! এ তো বাঘের আঁচড় নয়। তড়িৎকে খুন করা হয়েছিল। তারপর তার মৃতদেহ বাঘে টেনে নিয়ে আসে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!’

ফেলুদা—‘খুন বা খুনের চেষ্টা। ছুরির আঘাতেই তড়িৎবাবুর মৃত্যু হয়েছিল কি না সেটা এখনও বলা শক্ত। হয়তো তাকে জখম করে আততায়ী পালায়। জখম অবস্থাতে স্বভাবতই বাঘের কাজটা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। যে অস্ত্র দিয়ে এই কুকীর্তিটা করা হয়েছে, সেটা খোঁজার চেষ্টা করা দরকার।’

মহীতোষবাবু—‘শশাঙ্ক, তুমি এক্ষুনি পুলিশে খবর দাও।’

বন্দুক হাতে মাধবলালকে তড়িৎবাবুর মৃতদেহের পাশে পাহারায় রেখে আর সবাই জিপে ফিরে এল। ফেলুদাকে এত গম্ভীর অনেক দিন দেখিনি। ফেরার পথে ও একটাও কথা বলল না। আমাদেরও কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বনের মধ্যে একপাল হরিণকে ছুটতে দেখেও মনটা নেচে উঠল না। লালমোহনবাবু এর আগেও আমাদের সঙ্গে গায়ে কাঁটা-দেওয়া অবস্থায় পড়েছেন, কিন্তু ওকে এমন ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখিনি কখনও। কোনও জায়গায় বেড়াতে এসে আচমকা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ফেলুদার জীবনে এর আগেও ঘটেছে, কিন্তু এভাবে নয়। এখানে তো শুধু খুন নয় বা রহস্য নয়, তার উপরে আবার মানুষখেকো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *