০৩. ক্রীতদাসী

ক্রীতদাসী

বিবাহ মানে এখন আমরা বুঝি ঐক্যদাম্পত্য (monogamy) – এক স্বামী, এক স্ত্রী। কিন্তু বহুপতিকতা আঞ্চলিক ভাবে এখনও আছে, প্রাচীন কালেও ছিল। আর বহুপত্নীকতা তো সে দিন অবধি বেশ জমাট ভাবেই ছিল, আইন করে বন্ধ করা হল। প্রাচীনকালে বিত্তবান ব্যক্তির বিজ্ঞাপন ছিল পশুসম্পদ আর পত্নীসংখ্যা। শাস্ত্রে যখন বলে, সেই ব্যক্তিই ভাগ্যবান যার পশুর সংখ্যা তার স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশি।[১] তখন সহজেই বোঝা যায় স্ত্রীর সংখ্যা কত ছিল। সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁঝে আজ বলা হয়ে থাকে মুসলমানের দুর্নীতির একটা প্রমাণ হল, সে চারটে বিয়ে করতে পারবে, যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখি, খুব কম মুসলমানই চারটি স্ত্রীর স্বামী। এই সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট উক্তি শুনলে প্রথমেই মনে হয়, কুলীন ব্রাহ্মণের তো চার স্ত্রীতে কুলোতই না। বাঁধানো খাতা তল্পিবাহকের হাতে দিয়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ভিন্ন ভিন্ন স্ত্রীর বাড়িতে একরাত্রির অতিথি হয়ে শ্বশুরবাড়ির আতিথ্য, স্ত্রী-সম্ভোগ এবং যথাসম্ভব দক্ষিণা আদায় করে পরবর্তী স্ত্রীর ঠিকানা খুঁজে সেখানে হাজির হওয়া— এই ছিল কুলীন ব্রাহ্মণের জীবিকা। আইনের বলে এবং আর্থিক কারণে ঐক্যদাম্পত্যই এখন সমাজে বিবাহের একমাত্র রূপ।

[১. সমৃদ্ধং যস্য কনীয়াংসো ভার্যা আসন ভূয়াংসঃ পশবঃ। শতপথব্রাহ্মণ (২:৩:২:৮)]

গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে এল ‘কুল’ অর্থাৎ বৃহৎ যৌথ পরিবার, যেখানে একটি বিস্তৃত গৃহে বেশ কয়েক পুরুষ একত্র বাস করত, মনে হয় তখনই ঐকবিবাহ প্রবর্তিত হয়। তার বহু আগে বহু পুরুষ ও নারী একত্র বাস করত, দাম্পত্য ছিল ক্ষণস্থায়ী; সকল পুরুষেরই অধিকার ছিল কৌমের সকল নারীতে। পিতৃপরিচয় নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না; এমনকী প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যৌনমিলনের সঙ্গে সন্তান-জন্মের বৈজ্ঞানিক সম্পর্কটাই জানা ছিল না। এরই একটা রেশ থেকে গেছে মাতৃধারায় প্রবাহিত পরিবারের গঠনতন্ত্রে, যেখানে সন্তান মাতৃপরিচয়ে অভিহিত হত। যেমন মহাভারতের যুগেও দেখি কৌন্তেয়, মাদ্রেয়, গাঙ্গেয়, রাধেয়, ইত্যাদির মধ্যে। মানুষ যখন সন্তান-উৎপত্তির বৈজ্ঞানিক কারণটা জানত না তখন যেটা চোখে দেখতে পেত সেটা হল মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তান আসে। কাজেই পিতৃপরিচয় তখন ছিল অনুমানসাপেক্ষ, মাতৃপরিচয় একেবারেই স্পষ্ট, তাই মাতার পরিচয়ে পুত্রের অভিহিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তার অনেক পরে, সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কৃষিবাণিজ্যজাত সম্পত্তি সঞ্চিত হতে লাগল। তখন সম্পত্তিমান পিতার পরিচয়ে পুত্রের পক্ষে অন্য একটি তাৎপর্য বহন করতে শুরু করল।

ঐতিহাসিক ভাবে আদিম সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ছিল যৌথ: একটি প্রজন্মের সব নারী ও পুরুষেরই অধিকার ছিল সেই প্রজন্মের সব নারীর ও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে সম্পৃক্ত হওয়ার। পরের ধাপে বাদ যায় ভাই বোনের যৌন মিলন।[২] তার পরে, অনেক পরে এল ঐক্যদাম্পত্য; অন্য স্তরগুলির মতো এই স্তরেও সম্পর্কের নির্ণায়ক ছিল অর্থনীতি। সাধারণ যৌথ গোষ্ঠী কৌমের সমবেত পশুধনে গোষ্ঠী এবং/বা কৌমের সাধারণ অধিকারের স্তরে এক প্রজন্মের নারী পুরুষের সাধারণ সম্পর্কে ছিল। পরে ভ্রাতা ভগিনীর যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়। তার পরে যখন সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল, তখন ধীরে ধীরে ‘কুল’ ভেঙে ঐক্যদাম্পত্য দেখা দেয় এক স্বামী ও এক বা বহু স্ত্রীর সংসার। এর পেছনে ক্রীতদাস বা দাসদের ভূমিকাও সক্রিয়। শ্রমসাধ্য কাজের ভার নারীর বদলে এসে পড়ল দাসের ওপরে। এতে নারী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরে এসে পরিবারে ক্রীতদাসীর ভূমিকা নিতে বাধ্য হল। মিল বলেন, ‘কোনও ক্রীতদাসই ততদূর পর্যন্ত এবং সম্পূর্ণ ভাবে ঠিক সেই ভাবে ক্রীতদাস নয় যেমনটা স্ত্রী।[৩] অন্যত্রও এমন কথা পাই; একশো বছরেরও বেশি আগে এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘সমবেত উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিতাড়িত হয়ে স্ত্রী প্রথমে গৃহদাসীতে পরিণত হল। গার্হস্থ্য দ্বারা প্রকাশ্যে বা ছদ্ম ভাবে নারীকে দাসীতে পরিণত করার ওপরেই বর্তমান ক্ষুদ্র পরিবার প্রতিষ্ঠিত।’[৪]

[২. সম্ভবত ঋগ্বেদের যম-যমী সংলাপের মধ্যে এই নিষেধের একটি ইঙ্গিত বিধৃত আছে। ঋগ্বেদ (১০:১০)

৩. ‘No slave is a slave to the same lengths and in so full a sense of the word, as a wife is.’ The Subjection of Women, p. 148

8. ‘The wife becomes the first domestic servant pushed out of participation in social production… the modern individual family is based on the open or disguisded enslavement of the woman. Origin of Family, Private Property and the State. p. 211]

ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাবের পরে সমাজে যে সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে লাগল তার মধ্যে একটা হল এই যে, সম্পত্তিমানের নতুন একটা শিরঃপীড়া দেখা দিল; তার সঞ্চিত সম্পত্তি সে তার বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্যে রেখে যাবে। বৈধ মানে ঔরস পুত্র। অবস্থার বিপাকে অন্য নানা রকম পুত্রও সম্পত্তিতে কম বেশি অধিকার অবশ্য পেত।[৫] পুত্র নানা রকম হতে পারে। প্রধানত ঔরস: পিতার বীর্যে মাতার গর্ভে জাত। কানীন: কন্যাটির প্রাকৃবিবাহ জীবনের সন্তান, যেমন কর্ণ। সহোঢ়: যে সন্তানকে গর্ভে নিয়ে কন্যার বিবাহ হল। গূঢ়োৎপন্ন : বিবাহের পরে গোপনে অন্য পুরুষের দ্বারা সঞ্জাত সন্তান। জারজ: স্বামীর জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের সন্তান। পুত্রিকাপুত্র: অপুত্রক পিতা এই শর্তে কন্যার বিবাহ দিতেন যে প্রথম পুত্রটিকে কন্যার পিতা আপন পুত্র বলে গ্রহণ করবেন। ক্রীত: অর্থ দিয়ে অন্যের যে সন্তানকে ক্রয় করা হয়েছে। দত্তক: অন্যের সন্তানকে তার অনুমতিক্রমে আপন সন্তানের পরিচয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা। স্বয়মুপাগত: যে বালক নিজেকে অন্যের কাছে বিক্রয় করে। পৌনর্ভব: নিয়োগের দ্বারা জাত বিধবার বা নিষ্প্রজ স্বামীর স্ত্রীর সন্তান এত রকমের সন্তানকে সমাজ স্বীকার করেছিল, কারণ সমাজ চাক বা না চা’ক, এ সব সন্তান ছিল। কাজেই একটা সংহতির ব্যবস্থা করলে এদের সমাজের অভ্যন্তরে স্থান দেওয়া যায়। তা ছাড়া এ সবই পুত্রসন্তান এবং সমাজে পুত্রসন্তানের চাহিদা বরাবরই প্রবল।

[৫. মহা. (১:১১১:২৮-২৯)]

এর মধ্য যে ছবিটা পাই তা হল দাম্পত্যের ভেতরে এবং বাইরে নানা ব্যতিক্রম। তথাকথিত নিষিদ্ধ সম্পর্কে যে সন্তান জন্মাত, তাকেও সমাজ নির্বাসন দেয়নি— যেমন কানীন, জারজ, সহোঢ় বা গূঢ়োৎপন্ন। কখনও বা আর্থিক কোনও কারণে ঐক্যবিবাহের সন্তান অন্যত্র স্থান পেত, যেমন, পুত্রিকাপুত্র, দত্তক, ক্রীত, স্বয়মুপাগত, ইত্যাদি। মনে হয়, এতগুলি ব্যতিক্রমকে সমাজ যখন স্বীকার করছিল তখন তার মধ্যে কিছু সজীব স্থিতিস্থাপকতা ছিল। বিবাহিত জীবনের মূল ছকটা বহুপত্নীক অথবা একপত্নীক যাই হোক, তার বাইরে যে সন্তান এল তাকেও প্রয়োজনে ঠাঁই দিয়েছিল সমাজ। অর্থাৎ বিবাহই যৌনসম্পর্কের একমাত্র আশ্রয় ছিল না। নারীর ক্ষেত্রে কানীন, সহোঢ় এবং গূঢ়োৎপন্ন সন্তানকে মেনে নেওয়াতে সমাজ নারীর তথাকথিত ‘পদস্খলনকেই যেন কতকটা মেনে নিয়েছিল। প্রশ্ন উঠবে, কুন্তি তাঁর কানীন পুত্রকেও প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারেননি। এখানে তাঁর অল্পবয়স এবং রাজকন্যা পরিচয়ই হয়তো প্রধান অন্তরায় ছিল। সূর্য কর্ণের জনক এ কথা আক্ষরিক ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়; তা হলে দাঁড়ায় প্রাসাদে দ্বিতীয় কোনও পুরুষের সংসর্গে জাত এই সন্তান— তাকে নিয়ে অপরিণতবয়স্কা তরুণী জননীর বিব্রত বোধ করাই স্বাভাবিক। ওই কুন্তিই কিন্তু বিবাহের পরে স্বামী পাণ্ডুর নির্দেশে পাণ্ডুর অন্য তিনটি পুরুষের সংসর্গে তিনটি সন্তান ধারণ করলেন। এ চিত্রটা অন্য রকম: পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম এবং সন্তানকামী, তাই এই নিয়োগ প্রথার ব্যবস্থা। এ প্রথা সে সমাজে প্রচলিত ছিল; ব্যাস সত্যবতীর বিধবা পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাতে নিয়োগ প্রথা অনুসারে পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।

যে কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, বিবাহ ও যৌনসম্পর্ক একাশ্রয়ী ছিল না। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ভিন্ন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে সম্পৃক্ত হওয়ার কতকটা অবকাশ ছিল। একটা সময় তো নিশ্চয়ই ছিল, যখন কামনার বশে মিলনটা বিবাহ-সম্পর্ক-নিরপেক্ষ ছিল :

উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু। একদিন এক ব্রাহ্মণ এসে উদ্দালকের স্ত্রীকে হাত ধরে সবলে টেনে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে শ্বেতকেতু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল। তখন উদ্দালক তাঁকে বলেন, এতে রাগ করার কিছু নেই। এ সনাতন ধর্ম; সকল বর্ণের নারীই অনাবৃতা— যে কেউ তাকে ভোগ করতে পারে। তখন থেকে নাকি শ্বেতকেতু নিয়ম করলেন, স্বামী বর্তমান থাকলে তার স্ত্রীকে কেউ যথেচ্ছ ভোগ করতে পারবে না।

সেই থেকেই পত্নী পতিভোগ্যা অর্থাৎ সমাজের বিশেষ কোনও অবস্থায় কোনও শাস্ত্রকার বা সমাজপতির অথবা ক্রমে ক্রমে বহু শাস্ত্রকারের নির্দেশে সমাজে ঐক্যদাম্পত্য যৌনসম্পর্কের একমাত্র সমাজস্বীকৃত বিধান হয়ে উঠল। ব্যতিক্রম হলে ভ্রুণ হত্যার পাপ হবে।[৬] তা হলে গোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ ভাবে গোষ্ঠীর সকল নারী পুরুষের সম্ভোগ অবাধ ছিল। এমন যুগ ক্রমে অচলিত হলেও এ প্রথার বেশ কিছু অবশেষ বর্তমান ছিল পরবর্তীকালে, দীর্ঘকাল পর্যন্ত। পরে ‘কুল’ যখন প্রধান হয়ে উঠল, তখন বহুপত্নীকতা ও ঐক্যবিবাহ প্রচলিত হল। এইটিই মোটামুটি দাম্পত্যের ছক হিসেবে চলে এসেছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে।

[৬. মহাভারত (১:১১৩:৯-১৮)]

কোনও সমৃদ্ধিমান পুরুষের সমৃদ্ধির একটি বিজ্ঞাপনই হল বহুপত্নীকতা। এই বোধের অন্তরালে সক্রিয় নারীর ভোগ্যবস্তু পরিচয়। ধনরত্ন, পশুপালের সংখ্যা যেমন সমৃদ্ধির বিজ্ঞাপক, তেমনই বহুসংখ্যক স্ত্রীও সমাজে আর্থিক প্রতিষ্ঠার একটি পরিচয়। প্রাচীন শাস্ত্রে শুনি, পত্নীরা হল সমৃদ্ধির রূপ।[৭] এ দেশে কুলীন ব্রাহ্মণের বহুপত্নীকতার পেছনে সমৃদ্ধির বিজ্ঞাপন ছাড়াও সমৃদ্ধি উপার্জনেরও একটা দিক ছিল, এবং কৌলীন্য সম্বন্ধে বাকি ব্রাহ্মণকুলের অসুস্থ, বিকৃত লোলুপতা এই অমানবিক প্রথাকে দীর্ঘজীবন দিয়েছিল। বৃদ্ধ শ্মশানযাত্রী কুলীনের সঙ্গে বালিকা কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া, কুলীন জরৎকুমারীর বিবাহ দিয়ে কন্যার পিতা পুণ্য অর্জন করতেন। মনে রাখা ভাল, নারী এ ধরনের বিকৃত সমাজবোধের বলি অন্য দেশেও হত। ইউরোপে যাকে ‘রাজপরিবারের বিবাহ’ (dynastic marriage) বলা হত তার বলি হত অনেক অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরী। তফাৎ শুধু একটাই, শাস্ত্রে তার সরাসরি সমর্থন মিলত না; এখানে এই নৃশংস প্রথার পেছনে শাস্ত্রীয় সমর্থন ছিল। তবে সুখের বিষয়, এ সব শাস্ত্রও অর্বাচীন, মোগল যুগের শেষ দিকের রচনা এবং এ প্রথার পরমায়ুও কয়েকশো বছর মাত্র। কিন্তু এই ধরনের বহুবিবাহ ও অসম-বয়সের বিবাহ এবং নামমাত্র বিবাহ, এগুলি পুরুষের অনুকূলে সৃষ্ট প্রথা, এর মধ্যে নিহিত আছে দাম্পত্যের এবং নারীর অপমান। এগুলি শুধু শাস্ত্রসমর্থিত নয়, ওই কয়েকশো বছর ধরে ব্রাহ্মণ সমাজে বহুল আচরিত প্রথা। সহমরণ প্রথায় বহু নারীর তাৎক্ষণিক মৃত্যু যেমন এক অমানবিক নৃশংস প্রথা ছিল, কৌলীন্য ও বহু বিবাহেও তেমনই ছিল নারীর সত্তার সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি এবং তার ওপরে অন্যায় অত্যাচার। এগুলি যদি দাম্পত্যের প্রহসন না হত তা হলে এ প্রসঙ্গই এখানে উঠত না। এ কথা ভুললে চলবে না যে, বেশ কয়েক শতক ধরে, কৌলীন্যপ্রথার অন্তর্নিহিত নারীর অপমান সমাজ মেনে নিয়েছিল। কুলীন কন্যার পিতা পরলোক সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হত তার কন্যাকে যখন বৃদ্ধ, মুমূর্ষু, পঙ্গু, বহুবিবাহিত, লম্পট, কামুক, অর্থলোভী কুলীনের হাতে সমর্পণ করে নিজের পরলোক নির্বিঘ্ন করত; কন্যাকে তখন সে দায় ও বস্তু বলেই গণ্য করত। সে কন্যার যে নিজের দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে কোনও প্রত্যাশা থাকতে পারে এমন চিন্তা কদাপি তার পিতাকে পীড়িত করত না। এ দেশে দাম্পত্যের অবনমনের এ একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। এমন কোনও বিবাহ-সম্পর্কিত প্রথা এখানে ছিল না যাতে পুরুষের পুরুষত্ব এ ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। সমস্ত কুপ্রথার দণ্ড দিতে হয়েছে নারীকে, সুখী দাম্পত্যে যার সহজাত অধিকার ছিল।

[৭. শ্রিয়া বা এতদ্রূপং যৎ পত্ন্যঃ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ (৩:৯:৪:১৯)]

এখন বহুপত্নীকতার বিরুদ্ধ আইন থাকায় একবিবাহই দাম্পত্যের প্রচলিত চেহারা। আমাদের আলোচনার বিষয় এই বিবাহ। মনে রাখা দরকার, এখন সমাজে বিয়ে হয় আনুষ্ঠানিক ভাবে অথবা রেজিস্ট্রি করে; আনুষ্ঠানিক বিয়েতেও আজকাল রেজিস্ট্রেশন চালু হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে। যে ভাবেই হোক, এখনও শতকরা নব্বইটি ক্ষেত্রে বিয়ে ঠিক করে কন্যাপক্ষ ও পাত্রপক্ষ। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কৃষিজীবী পরিবারে প্রায় সর্বদাই এ ভাবে বিয়ে ঠিক হয়। শ্রমিকের ক্ষেত্রে এবং একবারে নিম্নবিত্ত চাষির ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম থাকে। ব্যতিক্রম কিছু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রেও ঘটে, মাঝেমাঝেই পাত্রপাত্রী নিজেরা বিয়ের ঠিক করে, কখনও প্রেমের জন্যে, হয়তো তার চেয়ে বেশি সংখ্যাই হবে যাদের কাছাকাছি আসার ভিত্তি শুধু ভাল-লাগা। ভাল-লাগা থেকেও প্রেম জন্মাতে পারে, নাও পারে। আবার প্রেম দিয়ে যার শুরু বিরূপতা বিদ্বেষ দিয়েও মাঝে মাঝে তার শেষ হয়। সম্বন্ধ করে যে বিয়ে তাতেও ভালবাসা জন্মাতে পারে, জন্মায়ও অনেক ক্ষেত্রে; আবার দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের প্রান্তে এসে দু’পক্ষই পরস্পরের কাছে স্বল্প পরিচিত দুটি ব্যক্তি থেকে যায় মাত্র, একে অন্যের প্রেম পায় না, চিত্তের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। অর্থাৎ দুটি মানুষের কাছাকাছি আসা বা একত্র বাস করার মধ্যে বিবাহিত দুটি মানুষের মধ্যেও ঘনিষ্ঠতার, আবেগের ও অনুরাগ-বিরাগের নানা স্তর থাকে। তারা যে পরস্পরকে কতটা জানবে, মানসিক ভাবে কতটা আপন করে পাবে সে বিষয়ে কোনও স্থির নিশ্চয়তা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *