দ্রোণ: চারিত্রিক দ্বন্দ্ব
ভীষ্মের পর কৌরব সেনাপতি হলেন দ্রোণ। পাঁচদিন সমস্ত শক্তি ও নিষ্ঠা নিয়ে তিনি কৌরব পক্ষকে নেতৃত্ব দেন। দ্রোণের চরিত্র ও ভাগ্য বুঝবার জন্যে তাঁর অতীত জীবনে কিছু সূত্র কাজে লাগবে। দ্রোণের প্রথম জীবন কেটেছে চূড়ান্ত দারিদ্র্যে। বাল্য-সুহৃদ রাজপুত্র দ্রুপদ যৌবনে রাজা হন; তাঁর সভায় এসে দ্ৰোণ ‘সখা’ বলে কথা শুরু করতেই দ্রুপদ নিম্নরুণ রূঢ়বাক্যে জানিয়ে দেন, দরিদ্রের সঙ্গে ধনীর বন্ধুত্বের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’(১) লাঞ্ছিত দ্রোণ ফিরে আসেন কঠিন সংকল্প নিয়ে: দ্রুপদের অহমিকা চুৰ্ণ করতে হবে। তিনি পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রগুরুর পদ গ্রহণ করেন এই উদ্দেশ্যেই যে, তিনি অৰ্জ্জুনের ধনুৰ্ম্মত্তাকে কাজে লাগাবেন, কৌরব সৈন্যদের পাবেন, দ্রুপদের কাছে সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। এরই জন্যে একলব্যের সঙ্গে ব্যবহারে দ্রোণ মিথ্যাচরণ করেন; যে একলব্যকে একদিনও তিনি শিক্ষা দেননি, শুধু দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তি সামনে রেখে ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করেছে। বলেই তার কাছ থেকে তিনি মর্মান্তিক নিষ্ঠুর গুরুদক্ষিণা আদায় করলেন। একলব্যের মনোভূমিতে দ্রোণ আচার্য, কিন্তু বাস্তবে দ্রোণ তো একদিনও তার শিক্ষার দায়িত্ব নেননি, সত্যকার দক্ষিণা তো তাঁর প্রাপই ছিল না। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিলেন দ্রোণ, পাণ্ডব কৌরবের শ্রদ্ধেয় আচার্য। বহু পূর্বে একলব্য একবার দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য প্রাথী হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি জাতে নিষাদ বলে দ্রোণ তাকে শিষ্য করেননি।(২) যে নিচু জাতের মানুষ শিষ্য হতে পারে না, গুরুদক্ষিণা নেওয়ার বেলায় তো প্রকােরাস্তরে তাকে শিষ্য বলে স্বীকার করাই হল।
এ সব ছলনার মধ্যে আছে অৰ্জ্জুনকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ করার প্রতিজ্ঞা, কারণ, একা অৰ্জ্জুনই রাজি হয়েছিলেন দ্ৰোণ যা চাইবেন তাই গুরুদক্ষিণা দেবেন।’(৩) তৎসত্ত্বেও নিজের ছেলে অশ্বখামার প্রতি স্নেহের বশে মাঝে মাঝেই পাণ্ডবদের কাজে পাঠিয়ে অশ্বথামাকে গোপনে কিছু বেশি বিদ্যা দান করতে চাইতেন। অৰ্জ্জুন। এ ছলন বুঝে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে এসে পড়তেন, যাতে অশ্বত্থামা ধনুর্বিদ্যায় তাঁকে ছাড়িয়ে না যান। এখানেও দেখি দ্রোণের স্বাৰ্থ বুদ্ধি তাকে মিথ্যাচরণে প্ররোচনা দিচ্ছে। দ্রোণের মধ্যে ছলনার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।(৪)
ধনসম্পত্তিতে লোভ তার ছিল না। দ্রুপদকে দণ্ড দিতে প্রথমে কর্ণ ও দুৰ্যোধন গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। পরে অৰ্জ্জুন কৃতকার্য হয়ে দ্রুপদকে বন্দি করে আনলে দ্রোণ দ্রুপদের অর্ধেক রাজ্যের রাজা হয়ে দ্রুপদকে বাল্যকালের সখ্য সম্বন্ধে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন যে, এত দিনে সমানে-সমানে অর্থাৎ রাজায় রাজায় বন্ধুত্ব পাকা হল। দ্রোণের মৰ্মস্থলে দীর্ঘকাল ধরে প্রকাশ্য রাজসভায় সেই অপমানের যে বাণ বিদ্ধ ছিল, এত দিনে তা উন্মুলিত হল। এ সব ঘটনায় পাঠকের প্রতিক্রিয়া একেবারে সহজ হয় না। রাজসভায় অপমানে সহানুভূতি দ্রোণের দিকেই থাকে; কিন্তু জন্মসত্ত্বে যিনি রাজা সেই দ্রুপদী পরাজিত শক্র রূপে কৌরব রাজসভায় এলে পাঠকের এক ধরনের অস্বস্তিও হয় সুদীর্ঘসঞ্চিত অপমানের এই তীব্র প্রতিশোধে।
ওই অর্ধেক রাজ্য দ্ৰোণ কোনও দিনই ভোগ করেননি, আমরণ কৌরব রাজসভাতেই ছিলেন। ছিলেন অস্ত্রগুরু রূপে আশ্রিত। যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে যুধিষ্ঠির যখন আচার্যদের পায়ে পড়লেন যুদ্ধ করার মিনতি নিয়ে, তখন অন্যদের মতো দ্রোণও বললেন, অর্থের জন্য তিনি কৌরবদের কাছে দায়বদ্ধ। এইখানে মনে পড়ে দ্রুপদের অর্ধেক রাজত্ব তাঁর অধিকারে ছিল। কাজেই অন্যায়কারী কৌরবদের অন্নদাস হওয়ারও তার যথার্থ কোনও প্রয়োজন ছিল না, ওই অর্ধেক রাজ্যের রাজস্ব তো তাকে আর্থিক ভাবে স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর করতে পারত; তা হলে তিনি বিবেকের প্রণোদনায় অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারতেন। পাণ্ডবরা ন্যায় পক্ষে যুদ্ধ করছে। এ কথা জেনে ও শুনে তো অন্তত তিনি যুদ্ধ বন্ধ করবার জন্য পক্ষত্যাগ করতে পারতেন। প্রথমত, তার নিজের ওই অর্ধেক রাজ্য ছিল; দ্বিতীয়ত, তিনি তো সত্যিই কৌরবদের অন্নদাস নন; আচার্যের তো শিক্ষকতার বিনিময়ে কিছু প্রাপ্য থাকে, কাজেই এ ভাবে নিজেকে আত্মবিক্রীত জ্ঞান করার তো তার সত্যি কোনও প্রয়োজন ছিল না। যে-দ্ৰোণ যথার্থ নিজের গুণে, শ্রমে ও সাধনায়। ভরণপোষণের অনেক বেশিই দাবি করতে পারতেন, তিনি কেন অন্যায় জেনেও কৌরবপক্ষ ত্যাগ করতে পারলেন না? তার ক্ষেত্রে কৌরবদের সঙ্গে দীর্ঘকালের যোগাযোগের মূল্যই কি ছিল এই আনুগত্য, যা তাকে ন্যায়-পথ থেকে সরিয়ে রাখল? এমন প্রশ্ন পাঠকের চিত্তকে ব্যাকুল করে তোলে।
যে পাঁচ দিন দ্ৰোণ সেনাপতি ছিলেন তারই তৃতীয় দিনের যুদ্ধে একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটে। বালক অভিমন্যু অৰ্জ্জুনের সন্তান, কিন্তু কৌরববীয়েরা সকলেই তাঁর আত্মীয় ও গুরুজন; চক্রবুঢ়হে প্রবেশ করে বালক যখন নিড্রমণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না, তখন যাঁরা তার পথ রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রোণও ছিলেন; চক্রবু্যহে অবরুদ্ধ কিশোরকে তিনিও অস্ত্ৰাঘাত করেন।(৫) পুত্রকল্প অৰ্জ্জুনের পুত্রকে এই রকম অসহায় ভাবে বধ করতে স্রোণের দ্বিধা হয়নি। শিষ্যও শাস্ত্রমতে পুত্রকল্প; একলব্য তাঁকে গুরুজ্ঞান করে সাধনা করছিল, অৰ্জ্জুনের প্রীত্যর্থে সেই একলব্যের ডান হাতের বুডো আঙুল দক্ষিণা চাইতেও তার দ্বিধা হয়নি। পাঠক এটা সহজে মেনে নিতে পারে না, যুদ্ধের অলঙ্খ্য নীতি হিসেবেও না। এই নিষ্ঠুরতার মূল্য তাঁকে শোধ করতে হয়েছিল।
যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে পাণ্ডবরা অধীর, দ্রোণ দুর্ধর্ষ অস্ত্রবিৎ, দুৰ্জয়পরাক্রম প্রতিপক্ষ, তাঁর মৃত্যু না হলে যুদ্ধ নিম্পত্তি হতে পারছে না, কৌরবপক্ষে কর্ণও অপেক্ষা করছেন; আসলে দ্রোণ বেঁচে থাকতে দুৰ্যোধন কর্ণকে সেনাপতি করতে রাজি হবেন না। কাজেই শৌর্যভিমানী কর্ণের উন্নতি ও গরিমার জন্যেও দ্রোণের মৃত্যু প্রয়োজন।
এই মৃত্যু ঘটে কী ভাবে? কৃষ্ণের পরামর্শে যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধরত দ্রোণকে বলতে হল, ‘অশ্বথামা হত’। কথাটা অন্য কেউ বললে পুত্রগর্বিত দ্ৰোণ উড়িয়ে দিতেন, কিন্তু বলছেন স্বয়ং যুধিষ্ঠির; শুধু ধর্মপুত্র নন, ধর্মাচরণের জন্য যিনি যশস্বী। এই সর্বৈব মিথ্যাটাতে যুধিষ্ঠিরের অন্তরাত্মাও স্বস্তি পায়নি, তাই সেটাকে শোধন করবার জন্য নিচুস্বরে যোগ করলেন ইতি, গজ’ অর্থাৎ মরেছে অশ্বখ্যামা নামে হ্যাতিটি।(৬) কিন্তু তাতেও কথাটা যে পরিশোধিত হয়ে সত্য ভাষণে পরিণত হল না তার প্রমাণ আছে। যুধিষ্ঠির সত্যনিষ্ঠ, সত্যবাদী, তাই তাঁর রথ মাটি থেকে চার আঙুল ওপরে থাকত। দ্রোণকে এই ডাহা মিথ্যে কথাটি বলার পরে ইতি গজ’ যোগ করার পরেও তাঁর রথ ভূমিস্পর্শ করল, আর কখনওই সে রথ মাটি ছেড়ে ওঠেনি।’(৭)
পুত্রকল্প দুটি বালক, একলব্য ও অভিমনু্যর ওপরে দ্রোণ নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন। একলব্যের ক্ষেত্রে, এবং অশ্বথামাকে গোপনে অৰ্জ্জুনের চেয়ে বেশি ধনুর্বিদ্যা দান করার চেষ্টার মধ্যে স্পষ্ট মিথ্যাচার ছিল, তাই যেন এক মিথ্যা উক্তিই তেঁর মৃত্যুর হেতু হল। অস্ত্রত্যাগ করে যোগাসীন হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন; প্ৰাণাধিক প্রিয় পুত্র অশ্বথামাই যখন বেঁচে নেই, তখন কার জন্যে যুদ্ধ, কার জন্যে জয়, কার জন্যে জীবন?
রামায়ণের কোনও বীরের মৃত্যুরই এত বহুমুখী দ্যোতনা নেই, সেখানে ভাগ ভাল-মন্দ, সাদা-কালোতে। কিন্তু দ্ৰোণ? রাজ্য পেয়েও যিনি রাজ্য গ্রহণ বা ভোগ করেন না, সেই আর্থিক স্বাতন্ত্র্যের জোরেও যিনি অন্যায় পক্ষে লড়ছেন জেনেও দলত্যাগ করেন না, তার মৃত্যু ঘটানো হল কৃষ্ণের প্ররোচনায় সদাসত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলিয়ে। দ্রোণ একটা মিথ্যা উক্তির জন্যে প্রাণত্যাগ করছেন এতে পাঠকের সহানুভূতি যথার্থ কারণেই দ্রোণের অভিমুখে যাবে; কারণ তাঁর মৃত্যুর নিমিত্ত একটা মিথ্যাভাষণ। কিন্তু তিনিও তো জীবনে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন একাধিকবার, কাজেই মিথ্যার দ্বারা তার নিধন যেন কোনও এক নৈতিক সুবিচারের ক্ষেত্রে পাঠক মেনেও নেয়। যুদ্ধারম্ভে যুধিষ্ঠিরের আবেদনে যিনি সাড়া দেননি, তিনি সব দায়বদ্ধতা অস্বীকার করলেন পুত্রস্নেহের বশে। এর মধ্যে একটা কারণ দিক থাকা সত্ত্বেও ক্ষত্ৰিয় বীরের পক্ষে একটা অনৌচিত্যও আছে। অভিমন্যুর মৃত্যুতে অৰ্জ্জুন যুদ্ধত্যাগ করেননি; ঘটোৎকচের মৃত্যুতে ভীমও যুদ্ধ ত্যাগ করেননি। পুত্রশোকে প্রোণের যুদ্ধত্যাগ ও মৃত্যু এ-ঘটনায় পাঠকের প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক–আবেগের দিকে এক ধরনের, আবার নৈতিকতার দিকে আর এক রকম; এবং মিথ্যাচারণের পরিণতি মিথ্যাভিত্তিক মৃত্যুতে পাঠকের উদ্যত সহানুভূতিও কোথাও বাধা পায়। জীবনের বহু অধ্যায়ে এমন প্রতিক্ৰিয়াই যথার্থ এবং ব্যঞ্জনায় অস্থির এবং সেই কারণেই অধিক পুতিময়। কিন্তু এ-কাহিনি পাঠকের গতিকে বাহিত করে, থামায়, ভাবতে বাধ্য করে এবং সংশয়ের মধ্যে ফেলে, প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার পক্ষে যা একটুও অনুকূল নয়; অথচ এই ভাবনা, যা জীবনের অর্থ বোঝাবারই এক প্রয়াস তার দ্বারাই মহাকাব্যটি নিছক কাব্যত্ব পেরিয়ে মহাকাব্যে উত্তীর্ণ হয়। এই উত্তরণের প্রক্রিয়টিকে অন্তঃস্থ করতে হয়, এবং সেটি যথার্থই আত্মিক উত্তরণের যন্ত্রণাময় একটি প্রক্রিয়া। এখানেই মহাভারতে সাড়া দেওয়ার আর্তি ও ক্লেশ।
—————
১. উদ্যোগপর্ব; (১৮৯.১৭)
২. আদিপর্ব, (১২২:৭)
৩. আদিপর্ব; (১২৩:১১)
৪. আদিপর্ব; ১২২:৪৩-৪৪
৫. দ্রোণপর্ব; (৩৬.২৬)
৬. দ্রোণপর্ব; (১৬৪.১০৬)
৭. দ্রোণপর্ব; (১৬৪.১০৭)
Leave a Reply