০৪. অবৈদিক সংশয়

অবৈদিক সংশয়

যজ্ঞ তার সমস্ত কিছু আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান নিয়ে ভারতবর্ষের মাটিতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে অন্তত দু-হাজার বছর ধরে প্রচলিত। যখন আর্যরা ভারতবর্ষে আসে তখন তারা প্রধানত পশুচারী, তবে কিছু কৃষিও জানত; পশুচারী স্বভাবত যাযাবর বলেই স্থায়ী ভাবে কোথাও বসবাস করে চাষ করার সময় কখনও কখনও পেলেও, পশুপাল নিয়ে দীর্ঘপথ পরিক্রমার সময় পেত না। সেই যাযাবর-জীবনে যজ্ঞ ছিল স্বভাবতই সংক্ষিপ্ত ও সরল, যদিও জীবনের মূল প্রশ্নগুলো এক রকমেরই ছিল। তারা যখন আর্যাবর্ত দখল করে কৃষিকাজ পাকাপাকি রকমে করতে শুরু করল তখন সেই সব প্রশ্নই অনেক জটিল চেহারা নিল। যজ্ঞ দীর্ঘায়ত হল; পুরোহিতের সংখ্যা বেড়ে সতেরো (যাগবিশেষে আরও অনেক বেশি) হল; যজ্ঞের উপকরণের তালিকা ও পরিমাণ বাড়ল; দক্ষিণা বাড়তে লাগল চক্রবৃদ্ধি হারে, যজ্ঞের কালসীমাও বাড়তে বাড়তে সোমযাগের সত্র বারো বছর পর্যন্ত বিস্তৃত হল (শাস্ত্রে এক হাজার বছর ব্যাপ্ত সোমযাগের কথাও আছে!)। ফলে যজ্ঞের মহিমা গরিমা বেড়েই চলল। অবশ্য এ সব অল্প সময়ে বা হঠাৎ হয়নি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতিতে কয়েকশো বছর ধরে এর প্রস্তুতি চলছিল। আমরা প্রথমে এর কারণ নির্ণয় করব, পরে এর তাৎপর্য, ফল ও এ অবস্থা থেকে উদ্ভুত সংশয়গুলির আলোচনা করব।

খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকে ভারতবর্ষে প্রথম লোহা দেখা যায়, কিন্তু তখন তা পরিমাণে অল্প ছিল বলে প্রথম শ-তিনেক বছর অলংকার ও অন্যান্য অকিঞ্চিৎকর কাজেই লোহা ব্যবহার করা হত। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে প্রথম বেশি পরিমাণে লোহা দেখা গেল, তখন মানুষ লোহার লাঙলের ফলা তৈরি করতে শুরু করল। এর আগে চাষের জন্যে লাঙলে কাঠের ফলা লাগানো হত। কাজেই পরিশ্রম বেশি করতে হত, আর তাতে অল্প জমি চাষ করতে বেশি সময় লাগত। লোহার ফলার লাঙলে অল্প পরিশ্রম ও সময়ে অনেক বেশি জমি চাষ করা যেত। এর ফল হল সুদুরপ্রসারী; বেশি ফসল উৎপন্ন হলে প্রয়োজনের বেশিটা উদ্বৃত্ত হত। অবশ্যই সেটা জমা হত মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে; তারা এই উদ্বৃত্তের বিনিময়ে কুটিরশিল্পের সামগ্রী তৈরি করাতো গরিব শিল্পীদের দিয়ে, কিছু ফসল সরাসরি রপ্তানিও করত। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আরব, পারস্য, মিশর হয়ে দক্ষিণ ইউরোপ পর্যন্ত প্রাগার্যদের যে-বাণিজ্য ছিল, যা আর্যরা এখানে আসার পরে বন্ধ হয়েছিল, সে-পথে আবার বাণিজ্য শুরু হল। ফসল বা শিল্পবস্তু রপ্তানি থেকে— এবং দেশের মধ্যে অন্তর্বাণিজ্য থেকে যে-সম্পদ আসত তা জমত ওই মুষ্টিমেয় একট শ্রেণির হাতে। ফলে দেশে বেশ স্পষ্ট একটা শ্রেণিবিভাজন হল, যেখানে অল্প কিছু লোক বিত্তবান এবং অধিকাংশ লোকই বিত্তহীন। যে-চাষি অন্যের জমিতে খাটত, যে-মজুর ধনীর ব্যবসার জন্য শিল্পবস্তু নির্মাণ করত— তারা সে কাজ করত পেটভাতায়। ফলে ব্যবসার লাভের বড় অংশটাই মুনাফা হয়ে জমত ওই অল্পসংখ্যক ধনিকের হাতে।

এ ছাড়া দেশে ঋগ্বেদের আমল থেকেই বর্ণবিভাগ তো ছিলই। চারটি বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও ধনী বৈশ্যই ছিল বিত্তবান: ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য এবং আচার্যত্বে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষাকর্মে এবং রাজার প্রসাদে, বৈশ্য কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যে। ধনী ব্রাহ্মণ হত পুরোহিত ও আচার্য। ধনী ক্ষত্রিয় হত যজমান, যজ্ঞের পৃষ্ঠপোষক, যাদের নামে যজ্ঞগুলি করা হত এবং যারা যজ্ঞের সমস্ত খরচ জোগাতো। এই সময়ের মধ্যে যজ্ঞের সংখ্যা বিস্তর বেড়ে গেছে এবং প্রত্যেকটা যজ্ঞেই অনেক পশু বধ করতে হত, অথচ এখন লোহার লাঙলের ফলার প্রচলন হওয়ার ফলে অল্প সময় ও পরিশ্রমে অনেক বেশি জমি চাষ করা যাচ্ছিল। ফলে লোকে দেখল যজ্ঞে যদি শ-য়ে শ-য়ে পশুহত্যা করা হয় তা হলে হালের বলদে টান পড়বে। তাই পশুধনের অনাবশ্যক অপচয় বাঁচাবার জন্যে মানুষ সচেষ্ট হল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকের রচনা শতপথ ব্রাহ্মণে শুনি যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, এই সব কারণে গোমাংস ভক্ষণ ঠিক নয়। শুধু তাই নয়, ষষ্ঠ শতকে মহাবীরের প্রবর্তিত জৈনধর্মে এবং গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মে অহিংসাকে ধর্মের একটি মৌলিক উপাদান বলে ঘোষণা করা হল। যজ্ঞে পশুবধ অপরিহার্য, এ দিকে চাষের জন্যে গোধন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও সম্ভবত একটা বিতর্ক চলেছিল, যার চিহ্ন রয়ে গেছে মহাভারত-এ। এখানে ঋষিদের সঙ্গে তর্ক হয় দেবতাদের: যজ্ঞে গো-বধ করা উচিত কি না। দেবতারা তো যজ্ঞের হব্য পেতেন, কাজেই তাঁরা গোমাংসের পরিবর্তে ছাগ ও মেষ মাংসের সপক্ষে মত দেন এবং ঋষিরা শস্যজাত হব্যের সমর্থন করেন। দু-পক্ষই বসু উপরিচরকে মধ্যস্থতা করতে বললে তিনি পশুহত্যার পক্ষে মত দেন, তবে সেটা ছাগ ও মেষ মাংস হতে হবে। এখানে দেখা যায়, চাষের ক্ষতি সকলেই এড়াতে চেয়েছেন। তাই বিকল্প হয় শস্য অথবা ছাগ বা মেষ, যেগুলো দিয়ে চাষ হয় না। এদিকে বহু যজ্ঞে বলদ, মোষ, ইত্যাদি জন্তু বধ করার নির্দেশ আছে। ফলে সত্যকার একটা সমস্যা দেখা দিল এবং ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ নিয়ন্ত্রিত হল অর্থনীতির দ্বারা। গো-বধ অপ্রচলিত অথবা অল্প প্রচলিত হল, বিকল্প পশু এবং শস্য ক্রমে প্রাধান্য পেল।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে শ্রেণিবিভাজনের সঙ্গে শ্রমবিভাজনও কঠোরতর হল। যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় (এর শ-খানেক বছর আগেকার রচনা মনে হয়) বহু কর্মবৃত্তির নাম পাই। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের শ্রমবিভাজন ছাড়াও জীবনযাত্রার উন্নততর মান রচনার চাহিদায় বহুবিধ শিল্পের ও বৃত্তির উদ্ভব হয়েছিল। স্বভাবতই এরা কৃষিগ্রামে বাস করত না। বরং বিভিন্ন বৃত্তির ছোট ছোট দলে (শ্রেণি বা পূগ) ভাগ হয়ে এক-একটি বৃত্তির মানুষ এক-একটি অঞ্চলে একত্র হয়ে কাজ করত; সে সব শিল্পপ্রধান অঞ্চল গ্রামের বাইরে থাকত, যেখানে রাজা, রাজন্য ও বণিক তাদের বৃত্তি (= মাইনে) দিয়ে কাজে নিযুক্ত রাখতেন। এই রকম বহু শিল্পের গোষ্ঠী যেখানে রাজন্য ও বণিকদের সান্নিধ্যে থাকত, সেগুলির চরিত্র গ্রাম থেকে ভিন্ন: জনসংখ্যা ও কর্মব্যস্ততা বেশি, চাষ কম, কারণ তাদের খাদ্য জোগান দিত কৃষিগ্রামগুলি। এই নতুন জনাকীর্ণ অঞ্চলগুলি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতাব্দীর নগর; এক-একটি নগর এক-একটি জনপদের কেন্দ্র। এই সময়ে ষোলোটি বিখ্যাত জনপদের উদয় হয়। ইতিহাসে এগুলির নাম শুনি, মগধ, কোশল, বৎস, অবন্তী, বজ্জি, লিচ্ছবি, কাশী, মল্ল, কুরু, পাঞ্চাল, অঙ্গ, চেদি, গান্ধার, অশ্মক, শূরসেন ও কম্বোজ— ষোড়শ মহাজনপদ। এই হল ভারতবর্ষের দ্বিতীয় নগরায়ণ (প্রথমটি সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন)। আর্যরা যে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ-পূর্বের দিকে এগোচ্ছিল, উত্তরের অঞ্চল জয় করে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল সে-কথা জৈমিনীয় ব্রাহ্মাণে পাই (৩:১৪৬); আর তাদের পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে এগোনোর কথা পাই কাঠক ব্রাহ্মণে (২৬:২)। এই অগ্রগতির ফলে ধীরে ধীরে প্রায় পাঁচশো বছরে আর্যাবর্তের অধিকাংশই আর্যদের অধিকারে আসে এবং ক্রমে বহির্বাণিজ্যের ফলে যখন সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে নগরায়ণ ঘটে তখনই ভারতবর্ষে মুদ্রার প্রচলন ঘটে। আগে জিনিসের দাম নিরুপিত হত গরু দিয়ে। এখন থেকে শুরু হল মুদ্রা দিয়ে। এই সময়ে তাই লেখারও প্রচলন ঘটে, লেখা ছাড়া বাণিজ্য হতে পারে না, হিসেব ও বিবরণ লেখা দিয়েই হয়।

তা হলে দেখতে পাচ্ছি, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতবর্ষে কতকগুলি বড় বড় পরিবর্তন দেখা দিল, যেগুলির ফল সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, লোহার লাঙলের ফলার প্রবর্তনের সঙ্গে স্বল্পতর পরিশ্রম ও সময়ে বিস্তৃততর জমি চাষ করা সম্ভব হল, ফলে ফসলে উদ্বৃত্ত দেখা দিল। এ উদ্বৃত্ত সঞ্চিত হল অল্প কিছু ধনীর হাতে যারা পেটভাতায় লোক খাটিয়ে জমিতে ফসল উৎপাদন এবং কুটিরশিল্পজাত বস্তু নির্মাণ করাতে লাগল। উদ্বৃত্ত ফসল ও শিল্পদ্রব্য দেশের মধ্যে এবং নৌবাণিজ্যের দ্বারা বিদেশে রপ্তানি করে ধনিকরা অনেক ধন অর্জন করতে লাগল। এই বাড়তি সম্পদ ভোগ করতে ও জমাতে লাগল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। এদের তুলনায় শতকরা আশি-নব্বই ভাগ মানুষ খুবই গরিব, যাদের অধিকাংশ‍ই পেটভাতায় খাটত, জমিতে বা শিল্পের কারখানায়। ফলে সমাজ স্পষ্টত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেল ধনী ও দরিদ্রে, শ্রেণিবিভাজন প্রকট রূপে দেখা দিল। মুদ্রা ও লিপির প্রচলন এ সবের সঙ্গে সম্পৃক্ত— এ দুটির মধ্যেও সমাজের অগ্রগতি সূচিত হল এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ল। শ্রেণিবিভাজনের একটা তাৎক্ষণিক ফল হল, বাড়তি টাকায় ধনিক শ্রেণি বেশি বেশি যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে লাগল। ফলে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত পুরোহিত- শাস্ত্রকারশ্রেণির উদ্ভব হল। এরা নিজেদের ভরণপোষণের জন্যে কোনও পরিশ্রম করত না, সম্পূর্ণ পরোপজীবী ছিল। বাকি সমাজ এদের অন্নবস্ত্র, বাড়িঘর, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যয় বহন করত, সমাজে এদের খাতির প্রতিপত্তি ছিল সর্বোচ্চ স্তরে। ফলে আর-একটি বিভাজনও দেখা দিল— কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রমের তারতম্য।

সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত যারা মাথার কাজ করে সমাজ তাদের উন্নততর মানুষ বলে গণ্য করে, এবং যারা গা-হাত-পা খাটিয়ে পরিশ্রম করে খায়, তারা নিচু শ্রেণির মানুষ বলে গণ্য হয়। কায়িক শ্রম থেকে ছুটি পাওয়া এই পুরোহিতশ্রেণি অধ্যাপনা, শাস্ত্র নির্মাণ এবং বহু প্রকারের দীর্ঘস্থায়ী জটিল প্রকরণের বহু যজ্ঞ উদ্ভাবন ও অনুষ্ঠান করতে লাগল। প্রথম দিকের রচনার চেয়ে পরের দিকে রচিত ব্রাহ্মণগুলিতে আমরা অনেক বেশি নামের নানা যজ্ঞের কথা শুনি, যেগুলিতে বহু সংখ্যক পুরোহিতের কাজ থাকে। স্বভাবতই পুরোহিতরা তাদের স্বশ্রেণির মানুষকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করবেনই, বিশেষত দেশে যেখানে উদ্বৃত্ত বিত্ত আসছে— রাজা, রাজন্য, ধনী ক্ষত্রিয় বৈশ্যদের হাতে। পুরোহিতরা বিভিন্ন সংকটের জন্যে বিভিন্ন যজ্ঞ উদ্ভাবন করেই চলল। এ সব যজ্ঞে শুধু বেশি সংখ্যায় পুরোহিতই নিযুক্ত হল না, যজ্ঞের উপকরণ সামগ্রীর বহু প্রকারভেদ দেখা গেল; হব্যের পরিমাণ বাড়তে লাগল, যজ্ঞের কালগত ব্যাপ্তি বাড়ল। আর বাড়ল দক্ষিণার সামগ্রীর প্রকারভেদ ও পরিমাণ। ফলে এখন শুধু ধনীরই সাধ্য রইল যজ্ঞ করবার।

সাধারণ মানুষ যাদের সংখ্যা সমাজে যজ্ঞকারীদের তুলনায় শতকরা পঁচানব্বই ভাগ, তারা দূর থেকে দুটো জিনিস দেখল। প্রথমত, যা তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল তা হল যজ্ঞের আড়ম্বর, প্রাচুর্য, ধূমধাম, ঘটা। যজ্ঞান্তে দেওয়া পুরোহিতকে ও ঋত্বিকদের প্রচুর দান ও দক্ষিণা। এরা দূরের দর্শক হিসেবে ষোড়শ মহাজনপদের নানা স্থানে যুগ যুগ ধরে এই সব সাড়ম্বর যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে দেখছিল। সম্ভ্রম, বিস্ময়, মুগ্ধতার সঙ্গে কি কিছু বিরুপতাও মিশত না— যেটা ঘটা খুবই স্বাভাবিক বাইরের দরিদ্র দর্শকের পক্ষে? দ্বিতীয়ত, শতকের পর শতক সাধারণ মানুষ জন্ম-পরম্পরায় শুনে শুনে মেলাতে লাগল যজ্ঞ ও যজ্ঞফল। বলা বাহুল্য, রাশিবিদ্যার নিয়ম অনুসারেই কোনও কোনও যজ্ঞে কাকতালীয়বৎ ফল দেখা যেত এবং অনেক সময়ে কোনও কোনও যজ্ঞ নিষ্ফলও হত। এটাই স্বাভাবিক। স্বভাবতই যজ্ঞে অভীষ্ট ফল পাওয়া না গেলে পুরোহিতরা যজমানের কিংবা ঋত্বিকদের ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা অথবা দৈবদুর্ঘটনাকে দায়ী করত, যেমন এখনও মানুষ করে থাকে। কাকতালীয়বৎ যে সব যজ্ঞে প্রার্থিত ফল মিলত, সেগুলি দিয়ে পুরোহিতরা সমর্থন করত সমস্ত যজ্ঞবিধানকে, আর যেগুলি মিলত না সেগুলো প্রকরণগত ত্রুটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হত।

এখন প্রশ্ন হল, মানুষ কি এই ত্রুটির ব্যাখ্যাগুলিকে অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করত? কোথাও, কখনও কি করে? না করেনি। তার প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। অন্তত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে দেশে ব্রাহ্মণ্যবিরোধী মত ও সেই সব মতাবলম্বী দলের প্রবল প্রাদুর্ভাব ঘটে আর্যাবর্তে। কারণ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতমবুদ্ধ যে সব ব্রাহ্মণ্যবিরোধীদের দেখা পান, তখনই তাঁরা প্রত্যেকেই নিজস্ব শিষ্যসহচর নিয়ে দল গড়েছেন। তাই মনে হয়, যজ্ঞ সম্বন্ধে ঔদাসীন্য, অনীহা সেই অষ্টম শতক থেকেই সমাজে বেশ স্পষ্ট হচ্ছিল। গৌতমবুদ্ধ তাঁর সাধনার সময়ে আনাড় কালাম, রুদ্রক রামপুত্র, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্ৰ, মস্করী গোশাল, ককুদ কাত্যায়ন, সঞ্জয় বৈরাটীপুত্র, এঁদের দেখা পান। এঁদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন মত, কিন্তু এঁরা সকলেই বেদবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী, অনেকেই কর্মফলবিরোধী, কেউ কেউ নিয়তিবাদীও। এঁরা নিজেদের দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে ঘুরে বেড়াতেন, এঁদের কথা শুনে নতুন নতুন লোক দলে যোগ দিতেন, দল ভারী হত। এমন করেই নানা বিরুদ্ধবাদ সমাজে প্রসারলাভ করেছিল।

এই সব দলের উৎপত্তি কিন্তু সংশয়ে: বেদ, যজ্ঞের অনুষ্ঠান, দেবতা পুরোহিতদের ভূমিকা— এ সবের যথার্থতা সার্থকতা নিয়ে সংশয়। এ মতগুলির উৎপত্তির ইতিহাস আলাদা করে জানা না গেলেও এটা জোর করেই বলা চলে যে, ব্রাহ্মণ্যযুগের ধর্মাচরণে এঁরা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থায় তখন প্রথম তিন বর্ণের পুরুষকে বাল্যকৈশোরে ব্রহ্মচর্য পালন, অর্থাৎ গুরুগৃহে গিয়ে বেদাধ্যয়ন করতে হত। যজুর্বেদীদের সম্ভবত যজ্ঞ করার পাঠও নিতে হত, ঋগ্বেদীদের স্বরে মন্ত্র আবৃত্তি এবং সামবেদীদের সুরে বেদগান করার তালিম নিতে হত। প্রায়োগিক দিকটা হয়তো পরে যজ্ঞের পুরোহিতদের অধীনে শিক্ষানবিশির ভিতর দিয়ে করত, কিন্তু বেদপাঠটা ব্রহ্মচর্যের আবশ্যিক কার্যক্রম ছিল। অবভূথস্নান অর্থাৎ স্নাতক হওয়ার পরে বিবাহ এবং তার পর বাকি জীবনটা গার্হস্থ্য; তার মধ্যে গৃহীর অন্যান্য করণীয়ের মধ্যে ছোটখাটো যজ্ঞ সম্পাদন করাও ছিল।

সংহিতাব্রাহ্মণযুগে এই দুটি আশ্রমই চলিত ছিল, অর্থাৎ সমাজের উচ্চ ত্রিবর্ণের প্রত্যেককেই যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হত; বড় বড় যজ্ঞ অবশ্য ধনী যজমান নৈমিত্তিক ভাবে, অর্থাৎ বিশেষ প্রয়োজনে অনুষ্ঠান করতেন। তার মানে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে এবং একাদশ-দশম শতক থেকে বিস্তারিত ভাবে সমাজে যজ্ঞ চালু ছিল। প্রত্যক্ষ ভাবে যজ্ঞের সঙ্গে যোগ ছিল ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের। ফলে সমাজের নিরানব্বই ভাগেরও বেশি মানুষ— ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র, নারী ও প্রাগার্যরা যজ্ঞ-অনুষ্ঠান বাইরে থেকে দেখত। এই দেখা স্বাভাবিক ভাবেই দূরের থেকে দেখা, সমালোচকের চোখে, অর্থাৎ কারণের সঙ্গে কার্যকে মিলিয়ে দেখা: এ ক্ষেত্রে কারণ হল যজ্ঞ, কার্য যজ্ঞফল। এ দুটো যখন মিলত না তখন স্বভাবতই সংশয় আসত। অনেক যজমান নিশ্চয়ই বিস্তর খরচ করে যজ্ঞ করেও ফল পায়নি, অনেক পুরোহিতও একান্ত বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে যজ্ঞ করেও সে যজ্ঞকে নিষ্ফল হতে দেখেছে। শুধু কি এরাই? জাঁকজমকে একটা যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হলে চারপাশের সাধারণ মানুষও তা দেখে এবং সে যজ্ঞ থেকে প্রত্যাশিত ফল যে পাওয়া গেল না সেটাও লক্ষ্য করে। বারে বারে এ ঘটনা ঘটলে লোকের মনের সংশয় দৃঢ় হতে বাধ্য। কতকগুলো যজ্ঞ যেমন পুত্রকামনায় অনুষ্ঠিত পুত্রেষ্টি যজ্ঞ বা বৃষ্টিকামনায় করা কারীরী ইষ্টি, এগুলোর ফল তো মানুষ সদ্য সদ্যই মিলিয়ে দেখে। না পেলেই জাগে সংশয়। না পাওয়া সত্ত্বেও সমাজে যজ্ঞের অনুষ্ঠান চলতে থাকে। প্রথমত, যজ্ঞ ছাড়া প্রকৃতিকে বশীভূত করার বা ইষ্টসিদ্ধির কোনও পন্থাই তাদের জানা ছিল না। দ্বিতীয়ত, কাকতালীয়বৎ কয়েকটা যজ্ঞের পরে ইষ্টসিদ্ধি হত এবং তাতে যজ্ঞ সম্বন্ধে বিশ্বাস দৃঢ় হত। তৃতীয়ত, পুরোহিতশ্রেণি যজ্ঞ নিষ্ফল হলে তার ব্যাখ্যা দিত, অন্য ভাবে অন্য যজ্ঞ করার বিধান দিত। সমাজে এই পরগাছা পুরোহিতশ্রেণির কাম্যই ছিল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতে থাকুক, এর সঙ্গে তাদের জীবিকা ও সামাজিক প্রতিপত্তি দুই স্বার্থই সম্পৃক্ত ছিল।

তা সত্ত্বেও যে যজ্ঞ বারে বারে নিষ্ফল হত, মীমাংসাশাস্ত্রের ভাষ্যেও এ কথা আছে। অতএব সাধারণ নিষ্ক্রিয় দর্শকের মনে সংশয় জাগত ও দৃঢ় হত। এদেরই মধ্যে কিছু বুদ্ধিমান চিন্তাশীল মানুষ সমগ্র যজ্ঞক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে যজ্ঞকে অস্বীকার করে নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠা করত। তখন অন্যান্য সংশয়ীরা তার সহচারী হত। এমন বহু প্রস্থানের অনুসারী— যাঁদের পরস্পরের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু বেদ ও যজ্ঞের বিরোধিতায় যাঁদের মিল ছিল— তাঁরা যজ্ঞ ছেড়ে নিজেদের মতের অনুশীলন করতেন। দুটি ব্যাপারে এঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধিতা করতেন, বেদ ও যজ্ঞকে অস্বীকার করে এবং নিজেরা গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ানোর ফলে গৃহীর করণীয় যজ্ঞগুলিও না করে। এ সব প্রস্থানের অনেকগুলিই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল, কিন্তু অনেকগুলিই থেকে গেল; তাদের মধ্যে প্রধান হল নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্রের প্রবর্তিত জৈনধর্ম, গৌতমবুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম এবং মস্করী গোশালের নিয়তিবাদ। এই সব বেদবিরোধীদের কথা বৌদ্ধগ্রন্থে বেশ খানিকটা পাওয়া যায়। এখানে জাতকগুলির ৫২৮ নং ‘মহাবোধি জাতকে’ ২৪ নং শ্লোকের পরে ‘উচ্ছেদবাদী’ বলে সাধারণ ভাবে এদের সকলের কথার সারসংগ্রহ দেওয়া হয়েছে:

‘দান নেই, যজ্ঞ নেই, হোম নেই, ভালমন্দ কর্মের ফলের পরিণাম নেই, মাতা নেই, পিতা নেই, ইহলোক নেই, পরলোক নেই— ন অত্থি দিন্নং, ন অত্থি ষিট্‌ঠং অত্থি হতং, ন অত্থি সকটদুক্‌কটকমনং ফলং বিপাকো, ন অত্থি মাতা ন অত্থি পিতা, ন অত্থি অয়ং লোকো ন অত্থি পরলোকো।’

এখানে প্রথমেই কর্মকাণ্ডকে অর্থাৎ যজ্ঞ ও দানদক্ষিণা, ইত্যাদি যজ্ঞসংশ্লিষ্ট তথাকথিত পুণ্যকর্মকে অস্বীকার করা হচ্ছে। তার পরে তত দিনে সমাজে যে মতবাদটি প্রতিষ্ঠালাভ করেছে সেই কর্মফলকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সমাজে অবশ্যকরণীয় সৎকর্মের মধ্যে পিতামাতার পরিচর্যা নির্দিষ্ট ছিল, তাকেও অস্বীকার করা হচ্ছে, এবং শেষ অস্বীকার ইহলোক-পরলোক। ইহলোককে অস্বীকার করা যায় না কারণ তা প্রত্যক্ষ, কিন্তু পরলোকের পরিপ্রেক্ষিতে যে ইহলোক, অর্থাৎ যেখানে জীবনের অন্ত ঘটলে আত্মা পরলোকে যায় সেই ইহলোককে— পরলোকের সঙ্গে যুক্ত ইহলোককে, পরলোকের সঙ্গেই অস্বীকার করা হয়েছে। প্রথমেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভিত্তি, যজ্ঞ ও দানদক্ষিণাকে নিষ্ফল বলা হয়েছে এবং শেষ জীবনের অন্তে মানুষের স্বপ্ন যে পরলোক, তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয়, জাতকে এই মতবাদগুলিকে সামগ্রিক ভাবে ‘উচ্ছেদবাদী’ বলা হচ্ছে; এরা উচ্ছেদ করছে বেদের ধর্মকে।

বুদ্ধের সময়েও সমাজের যজ্ঞানুষ্ঠান হত। প্রাচুর্যের মধ্যে লালিত বুদ্ধের যৌবনের তিনটি অভিজ্ঞতা তাঁকে বৈদিক ধর্মাচরণের প্রতি বিমুখ করে তুলল। যজ্ঞ সব কাম্যবস্তু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়: সুখ, বিজয়, ধন ঐশ্বর্য মানুষ ভোগ করবে তো শরীর দিয়েই? সেই শরীরের তিনটি সবচেয়ে বড় সংকট— ব্যাধি, জরা ও মৃত্যু— এগুলি নিবারণের তো কোনও বিধান বেদে নেই। তখনকার সমাজ জন্মান্তরে বিশ্বাস করত, অতএব জন্মান্তরেও মানুষকে এ তিনটি সংকটের সম্মুখীন হতে হবে? সংশয় জাগল সিদ্ধার্থের মনে: তা হলে, বেদের নির্দেশিত পথে যখন এ তিনটি মহাসংকটের কোনও আত্যন্তিক প্রতিবিধান নেই, তখন বেদের পথে স্থায়ী সুখের কোনও পথনির্দেশ নেই। বুদ্ধের সংশয়ের প্রায় অনুরূপ সংশয় ছিল মহাবীরের, এবং সম্ভবত অন্য বেদবিরোধী মতের প্রবক্তাদেরও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *