১৯. সকলের পছন্দসই আবেদন

উনবিংশ পরিচ্ছেদ
সকলের পছন্দসই আবেদন

আমি আমেরিকার মিসৌরীতে জেসি জেমসের খামারের কাছে মানুষ হয়েছিলাম। কিয়ারশীতে জেসি জেমসের খামার ঘুরেও আমি দেখেছি। সেখানে জেসি জেমসের ছেলে এখনও বাস করেন।

তার স্ত্রী আমাকে অনেক কাহিনী শুনিয়ে বলেছেন জেসি কেমন করে ট্রেন লুট করতেন আর ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে সেইসব টাকা পয়সা আশে পাশের চাষীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন যাতে তারা বন্ধকী সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারে।

জেসি জেমস নিজেকে একজন আদর্শবাদী বলে ভাবতেন, ঠিক যেমন ডাচ শুলজ, ‘দুই বন্দুক’ ক্রাউলে আর অল ক্যাপোন দুই প্রজন্ম পরে ভেবেছে। আসল কথাটা হলো আপনি যাকেই দেখুন–এমন কি আয়নায় যাকে দেখবেন তারই নিজের সম্পর্কে বেশ একটা উঁচু ধারণা আছে। সে নিজের সম্পর্কে ভাবতে চায় সে চমৎকার আর নিঃস্বার্থ।

জে, পিয়েরপন্ট মর্গ্যান তাঁর এক বিশ্লেষণে বলেছিলেন যে কোন মানুষের কাজ করার পিছনে দুটো কারণ কাজ করে। একটা যা শুনতে ভালো আর একটা আসল।

লোকটি কিন্তু আসল কারণটাই ভাবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেই আদর্শবাদী হওয়ায় যেটা বা যে উদ্দেশ্য শুনতে ভালো লাগে সেটাই ভাবতে চাই। অতএব মানুষকে পরিবর্তিত করতে হলে মহত্তর উদ্দেশ্যের কাছেই আবেদন রাখতে হবে।

ব্যবসায় কাজ করা কি অতি বেশি রকম আদর্শবাদী কাজ বলে মনে হয়? দেখা যাক। পেনসিলভানিয়ার গ্লেনডেনের ফ্যারেল-মিচেল কোম্পানীর হ্যাঁমিলটন জে. মিচেলের কথাই ধরুন। মিঃ ফ্যারেলের একজন অসন্তুষ্ট ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে দেবার ভয় দেখাচ্ছিলেন। ভাড়াটের মেয়াদ এখনও চার মাস ছিল, ভাড়া ছিল মাসে পঞ্চান্ন ডলার। তা সত্ত্বেও তিনি নোটিশ দেন শর্ত থাকা সত্ত্বেও। এই সব ভাড়াটে আমার বাড়িতে সারা শীতকালেই বাস করেছে-এই সময়টা বছরের সবচেয়ে খরচ সাপেক্ষ, মিঃ ঘটনাটা এইভাবেই আমার ক্লাসে বর্ণনা করেন। আমি তাই জানতাম আগামী শীতের আগে আর ভাড়া দিতে পারবো না। আমি বুঝলাম দুশ কুড়ি ডলার জলে যেতে বসেছে–বিশ্বাস করুন আমি অন্ধকার দেখলাম।

সাধারণত এমন হলে আমি ওই ভাড়াটেকে উপদেশ দিতাম লীজের চুক্তি আর শর্ত আবার পড়তে। আমি তাকে জানাতাম তিনি চলে গেলে তাকে পুরো টাকাই দিতে হবে–আর আমি আদায় করার চেষ্টা করব।

যাই হোক কোন রকম গোলমাল না করে আমি অন্য পথ ধরবো ঠিক করলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করি না আপনি চলে যেতে চান। এই ভাড়া খাটানোর ব্যাপারে আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতায় আমি মানব চরিত্র বেশ বুঝতে শিখেছি আর আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছি আপনি এক কথার মানুষ। আসলে, আমি এতই নিশ্চিত যে বাজি ধরতেও আমি রাজি।

এখন আমার প্রস্তাব হলো, আপনার মতটা কটা দিন চাপা রেখে আর একবার ভাবুন। এরপর আপনি যদি আজ থেকে মাসের প্রথমে যখন ভাড়া নেওয়া হয় তখন আসেন আর আমায় বলেন আপনি চলে যেতে চান তাহলে ধরে নেব আপনার মতটাই ঠিক। আপনি চলে যেতে চান। তাহলে বুঝবো আপনার কথাটাই ঠিক আর আমার ধারণা ভুল। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি যে আপনি এক কথার মানুষ আর চুক্তি মেনে চলবেন। তাছাড়া চুক্তি অনুসারে আমরা হয় মানুষ না হয় বাদরবেছে নেবার ব্যাপারটা আমাদেরই।

যাই হোক নতুন মাস পড়লে ঐ ভদ্রলোক স্বয়ং এসে তার ভাড়া দিয়ে গেলেন। তিনি আর তার স্ত্রী, দুজনে আলোচনা করে থেকে যাওয়াই ঠিক করেন। তারা ঠিক করেন সম্মানের কাজ হলো লীজের চুক্তিটা মেনে চলা।

প্রয়াত লর্ড নর্থক্লিফ জীবিতকালে একবার সংবাদপত্রে তাঁর একটা ছবি প্রকাশ হলো। যেটা তিনি চাননি। তিনি সম্পাদককে একটা চিঠি লেখেন। তাতে তিনি কি লিখেছিলেন : দয়া করে আমার ঐ ছবি আর ছাপবেন না, আমার ওটা পছন্দ নয়। না, তিনি মানুষের মহত্ত্বের আর মাকে ভালবাসার নীতির কাছে আবেদন রেখেছিলেন, তিনি লেখেন : দয়া করে আমার এই ছবি আর ছাপবেন না, ওটা আমার মায়ের পছন্দ নয়।

জন ডি, রকফেলার (ছোট) যখন তার ছেলেমেয়েদের ছবি কাগজে ছাপতে দেয়া পছন্দ করতেন না তখন তিনি হৃদয়ের কাছে আবেদন রাখতেন। তিনি কখনই বলতেন না, আমি চাই না ওদের ছবি ছাপা হোক।’ তিনি যা চাইতেন তা হলো ছেলেমেয়েদের যাতে ক্ষতি না হয়। তিনি বলেছিলেন : আপনারা তো জানেন, ছেলেরা কেমন। আপনাদের নিজেদেরও তো ছেলেমেয়ে আছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন তাদের বেশি প্রচার করা ক্ষতিকর।

সাইরাস এইচ কে, কার্টিস মেইনের যে দরিদ্র ছেলেটি তার উল্কাগতি জীবনে লক্ষ লক্ষ টাকা করেছিলেন ‘দি স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট’ আর ‘লেডিজ হোম জার্নালের মালিক হয়ে–তিনিও গোড়ায় যখন শুরু করেন তখন অন্যান্য কাগজের মত লেখার জন্য টাকা দিতে পারতেন না। শুধু টাকার জন্য বড় বড় লেখকদের দিয়ে তিনি লেখাতে পারতেন না। তাই তিনি তাদের হৃদয়ের কাছেই আবেদন রাখতেন। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি–তিনি অমর সাহিত্যিক লিটল উইমেনের লেখিকা লুইশা মে অ্যালক্ট যখন তাঁর খ্যাতির মধ্যগগনে তাঁকে দিয়েও লেখাতে পেরেছিলেন। তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন, অ্যালক্টের পছন্দ মত প্রিয় দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে একশ ডলার দান করে।

ঠিক এখানেই সন্দিহান মানুষেরা বলতে পারেন : ‘ওহ্ এধরনের কথা নর্থক্লিফ বা রকফেলার মত অর্থবান বা ভাবপ্রবণ উন্নাসিকের পক্ষে ঠিক আছে। তবে যে সব কাঠখোট্টা শক্ত মানুষের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে হয় তাদের কাছে এর কদর কতটা সেটাই দেখার বিষয়।’

আপনি হয়তো ঠিক। এ ব্যাপারে এটা চলবে না–আর সবক্ষেত্রেই যে কাজ হবে তাও ঠিক নয়। তবে এখন যে ফল পাচ্ছেন তাতে যদি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে বদলাবার চেষ্টা করবেন কেন? আর যদি সন্তুষ্ট না হন তাহলে পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কী?

যাই হোক, আমার একজন প্রাক্তন ছাত্র জেমস এল, টমাসের বলা সত্য কাহিনী পড়তে ভালোই লাগবে।

গল্পটা এর রকম।

কোন মোটর গাড়ি কোম্পানির ছয়জন ক্রেতা গাড়ি সাফাই বা সারানোর টাকা দিতে অস্বীকার করে। কেউই পুরো বিল ভুল তা বলেনি, তবে তারা প্রত্যেকেই দাবি জানায় কোন একটা দাবি ভুল। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রত্যেকে প্রতিটি অংশে সই করেছিল, তাই কোম্পানী জানতো বিল ঠিকই ছিল–আর তারা তাই বলে দেয়। এটাই ছিল প্রথম ভুল।

কোম্পানির টাকা আদায়কারী দপ্তর পাওনা টাকা আদায় করতে এই পথ নেয়। আপনার কি ধারণা তারা সফল হয়?

১। তারা প্রত্যেক খরিদ্দারের কাছে সোজাসুজি গিয়ে জানায় তারা টাকা আদায় করতে এসেছে, সেটা অনেক দিন বাকি পড়ে আছে।

২। তারা পরিষ্কার করে জানায় কোম্পানী সম্পূর্ণ ঠিক আর ক্রেতা অর্থাৎ তারা সম্পূর্ণ ভুল।

৩। তারা আরও জানালো, কোম্পানী গাড়ির ব্যাপারে যা জানার তার চেয়ে অনেক বেশি জানে। তাহলে তর্কাতর্কির ব্যাপার কোথায়?

৪। ফলাফল : তারা তর্ক করতে শুরু করে।

এই পথের কোনটায় কি ক্রেতা খুশি হলো আর পাওনাও মিটে যায়? সেটা নিজেই বুঝতে পারবেন।

আসলে এর ফলে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে কোম্পানি প্রায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার মনস্থ করে। ঠিক তখনই ব্যাপারটা কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজারের নজরে আসে। ম্যানেজার ওই ব্যাপারে খোঁজ নেন। তিনি জানতে পারলেন ক্রেতারা সবাই অতীতে তাদের পাওয়া ঠিক মতই মিটিয়ে দিয়েছেন। অতএব কোথাও কোন ভুল হয়েছে–আর সে ভুল আদায় পদ্ধতির মধ্যে আছে। অতএব তিনি জেমস এল. টমাসকে ডেকে টাকাটা আদায়ের দায়িত্ব দিলেন।

মিঃ টমাস নিচের পদ্ধতি গ্রহণ করেন।

১। প্রত্যেক ক্রেতার কাছে প্রথম যাওয়ার পর মি. টমাস বলেছেন, আমার মনে ছিল এ বিলটা অনেকদিনের পাওনা–আর আমাদের কথাই সম্পূর্ণ ঠিক। তবে আমি সে সম্পর্কে একটা কথাও বলিনি। আমি জানালাম আমি জানতে এসেছি কোম্পানি কি করেছে আর কি করেনি।

২। আমি আরও পরিষ্কার করে বললাম ক্রেতার মতামত আর বক্তব্য না শুনে আমি কোন মতামত দেব না। আমি আরও জানালাম কোম্পানী কোন দাবীই নির্ভুল এ কথা বলতে চায় না।

৩। আমি জানালাম তিনি গাড়ি সম্বন্ধে আমার চেয়েও অভিজ্ঞ।

৪। আমি তাকে কথা বলতে দিলাম আর সহানুভূতির সঙ্গে শুনলাম তিনি যা চান।

৫। এরপর ক্রেতা যখন কিছু যুক্তি মানার অবস্থায় এলেন তখন আমি সব ব্যাপারটি তার সামনে রাখলাম আর জানালাম ব্যাপারটা ঠিক মত চালনা করা হয়নি। আমি প্রথমে বললাম, আপনাকে আমি জানাতে চাই যে আমাদের লোক আপনার বিরক্তি উৎপাদন করেছে। তাই আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনার কথা শুনে আমি আনন্দিত। আমি আপনার কাছে ওই বিল সম্বন্ধে একটা নিবেদন রাখতে চাই। আমি অনুরোধ করতে চাই এটা দেখে যদি মনে করেন ঠিক দিয়ে দেবেন। আপনি যা বলবেন তাই হবে।’

‘তিনি কি বিল ঠিক করে দেন? অবশ্যই। অন্য সব ক্রেতারা কি টাকাটা দিয়ে দেন? হ্যাঁ ছ’জনের মধ্যে পাঁচ জনই ১৫০ থেকে ৪০০ ডলার দিয়ে দেন। একজন কিছুই দেবেন না সাফ বলেছেন। আসল কথাটা হলো দুবছরে আমরা তাদের আবার নতুন গাড়ি বিক্রি করি।’

‘অভিজ্ঞতা আমায় শিখিয়েছে, মিঃ টমাস বলেছেন যে, যখন ক্রেতাদের সম্বন্ধে কোন কিছু জানা যায় সেখানে ধরে নিতে হবে সে সৎ, সত্যবাদী আর দাম মিটিয়ে দিতে উদগ্রীব।

অতএব আপনি যদি অপরকে আপনার মতে আনতে চান তাহলে দশ নম্বর নিয়ম হলো :

 ‘অপরের মহত্বের প্রতি আবেদন রাখুন।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *