৪. অবচেতন ব্যক্তিত্ব

অবচেতন ব্যক্তিত্ব

‘প্রত্যেকের যুক্তিবাদী চিন্তার ঠিক নিচেই সম্ভবত ছড়িয়ে আছে অযৌক্তিক অনুভূতির একটা বিরাট এলাকা। এগুলি হলো বিচিত্র কিছু কিছু ব্যক্তিগত মতবাদ আর ধারণা। অদ্ভুত সহজাত চিন্তাশক্তির আর আবেগের বৈচিত্র্য; বিশ্বাস আর আকাঙক্ষা-এর সবটাই সেই মানুষের জীবনের আনন্দ আর নিরানন্দের আলোক ধারায় স্নাত। এই দৈত্যটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে বা কদাচিত তাকে মনের যুক্তিবাদী ধারণাকে আচমকা প্রভাবিত করতে দেখা যায়। কিন্তু একবার কোন অবস্থা বা ঘটনাকে ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে দিন, আসল মানুষটিকে একবার স্পর্শ করতে দিন-তাহলে অবাক হয়ে দেখবেন ভিতরের শক্তি কিভাবে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে চায়…

‘এর মধ্য থেকেই আসে গঠনমূলক, সৃষ্টিমূলক আর কর্তৃত্বব্যঞ্জনার ভাবধারা। সেই মানুষকেই প্রতিভাবান বলতে পারা যায় যিনি খুব সহজেই অবচেতনায় অবগাহন করে এর মধ্যে কি সম্পদ আছে তা খুঁজে পান-যার অন্তর কোন ভাবেই দলিত বা দমিত হয়ে মূল্যহীন বা বিকৃত হতে চায় না’ ‘আনমাক্সিং দ্য মাইণ্ড’-ডেভিড সিবেরি

.

এক. হাইপেরিয়ন ও স্যাটার

আপনাদের নিশ্চয়ই সেক্সপীয়রের নাটক হ্যাঁমলেটের কথা মনে আছে?

এটি এক তরুণ যুবরাজ হ্যাঁমলেটের কাহিনী, যে রহস্যজনকভাবে তার পিতাকে হারানোর পর সভয়ে দেখে যে তার মা ভেঙে না পড়ে বরং শোকের সময় কাটার আগেই আবার বিয়ে করে বসে। ব্যাপারটা আরও বহুগুণ খারাপ হয়ে পড়ে যখন দেখা গেল হ্যাঁমলেটের সৎপিতা তার পিতা যতখানি ভালো ছিলেন ততখানিই খারাপ। হ্যাঁমলেট তার মাকে দুজনের ছবি দেখিয়ে সেই কথাই জানিয়ে ছিলো। এটা হাইপেরিয়ন আর স্যাটারের মাঝখানের তফাতেরই মত।

হাইপেরিয়ন ছিলেন সূর্য-দেবতা–আলোকোজ্বল, জীবনদায়ী, স্বাস্থ্য প্রদানকারী সমস্ত ভালো জিনিস দাতা। আর অন্যদিকে স্যাটার হলো পশুর মতই একজন, সকলেরই সে ঘৃণার পাত্র।

আসল কথাটা হলো, এই অবস্থা আমার আর আপনার ক্ষেত্রেও সত্যি। আমরা আমাদের স্বাভাবিক সত্তার উপর উঠে হাইপেরিয়ন হতে পারি।

আমরা জানি আমরা যা প্রকাশ করি তার চেয়ে আমরা ভালো। আমরা আমাদের ভালোর খবর যেমন রাখি তেমনিই রাখি যে আমরা চরমতম মন্দও। স্যাটারের কদর্য দৃষ্টি তার গোপন আলোয় থেকে আমাদের দিতে তাকিয়ে অভ্যস্ত। আমরা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট ঐ স্যাটারের শিঙ আর খুব দেখতে পাই (প্রাচীন মতে স্যাটার হলো অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ছাগ) আমরা আরও জানি আমাদের কিছু বন্ধু অল্প সুযোগেও ঢের ভালো করেছে। আমরা তাই বোধ শক্তির অনুভূতি দিয়ে বুঝি অবস্থাটা এখানে এতই খারাপ যে আবার ভালো আমরা করতে পারছি না।

এমন হওয়ার সত্যিই কোন কারণ নেই। এটা স্যাটারের শয়তানী ছাড়া আর কিছুই না। যে শুধু এই পুষ্পশোভিত কাননকে তার খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে চলেছে। অল্প কথায় সে সবই নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে আমরা তাকে তার আসল জায়গাতেই পাঠাব।

দুঃখের কথা হলো আমরা আড়ালে এই স্যাটারকে পছন্দ করি। আমরা জানি সে আমাদের ধ্বংস করে ফেলছে। অথচ আমরা তাকে মন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না।

এ সব ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে সব দেখে নিলে আখেরে কাজ দেয়। এ সবের শেষ কোথায়? যখন কেউ তার শেষ সীমায় পৌঁছায় সে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে কি অনুভব করতে চায়?

সে তখন নিজেই দেখতে পারবে এর অর্থ? সব কিছু দেখে নেবার পরেই সে হয়তো বলতে পারে : ‘ওঃ সময়ের কি অপচয়!’

তা হলে এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী? যার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেনি সে কখনই অপচয় আর ক্ষতি সহ্য করবে না, অন্ততঃ পারলে অবশ্যই। সে অবশ্য তার মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্তের পূর্ণমূল্যই আশা করতে চাইবে। আপনি বা আমি কিন্তু কখনই আমাদের জীবনকে কোনরকমেই এলোমেলো করে ফেলতে চাইবো না। অপরদিকে, আমরা সব সময়েই নিজেদের বলি : এমন সুযোগ হয়তো আর আসবে না। এ জীবন আনন্দের রাজ্য। আসুন সবাই সেটা উপভোগ করি।

এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই বিরাট একটা কাজ।

তাহলে সে কাজকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছেন না কেন? একে তাই সূক্ষ্ম কোন কলাশিল্প করে তুলুন না কেন? আপনার সেরা ক্ষমতাই এতে লাগানোর ব্যবস্থা করুন।

জীবন সম্পর্কে একটু ভাবুন। বিশেষ করে আপনার নিজের জীবন সম্বন্ধে একটু ভাবুন। আপনি কি এর পূর্ণমূল্য পাচ্ছেন? তা যদি না পান, তা হলে এ প্রশ্ন অবশ্য করতে পারেন, ‘কেন পাচ্ছিনা?’

যখন কোথাও কোন ভুল হয়, আমরা দেখার চেষ্টা করি ভুলটা কোথায় হলো। যে কোন কলকারখানায় যেখানে কাজ হয়–নিজের কাজ জানলে লোকে এটাই জানার চেষ্টা করে।

জীবনে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রেও একই কথা। পৃথিবীর সব বড় বড় চিন্তাবিদরা, যেমন–সক্রেটিস, প্লেটো, বুদ্ধ, মহম্মদ আর যীশু, সকলেই এটা করেছেন।

আমাদের তাই নিজেদের জানতেই হবে। রহস্য হলো এটাই। আমাদের নিজেদের কাছে কোন কিছুই গোপন করা চলবে না। আর এটা করলেই আমরা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবো, কাজ ঠিক করে নিতে পারবো, ভালো ভাবে বাঁচতে পেরে লাভের আশা করতে পারবো।

এ রকম হওয়ার অর্থই হলো নেমে আসা–এরই নাম আত্মসমালোচনা। তবে এটা করতেই হবে। আজই তাহলে শুরু করে দিন।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কয়েকটা মিনিট এইভাবে কাজে লাগালে তার চেয়ে ভালো সময় কাজে লাগানো আর হয় না। আপনাকে ভুলে যেতে হবে আপনি কে? আপনাকে নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতের মতই নিজেকে দেখুন। তাই যদি পারেন তাহলে তীব্র আর কঠিন দৃষ্টিতেই নিজেকে একবার দেখুন (বন্ধুত্বের ভাব ত্যাগ করে)। এটা করাই ভালো। নিজেকে কোন রকম খাতির করবেন না।

এটাই হলো নেমে আসা। কাজটা এই চোখেই দেখবেন। সেই স্যাটারের দিকে ভালো করে তাকান। একটু লজ্জিত বোধ করুন যেহেতু এ রকম এক প্রাণী সমাজে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে!

আজ আর আপনার জীবনের প্রতিটি রাতেই এরকম করুন। এটা আপনার মনের পক্ষে ভালো। এ আপনার ইচ্ছাশক্তিকে সাহায্য করবে।

এমন অনেকে আছেন যারা নিজেদের কথা লিখে রাখেন…নিজেদের সব কর্দমতা, দুর্বলত, ত্রুটি আর নীচতা।

এতে সাহস বাড়ে, আত্মবিশ্বাস জন্মায়।

এবার তাহলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নিজেকে এই কথাগুলো বলুন : ‘আমি সব কিছু সঠিক করতে চাই। আমি প্রাণপণে সব কিছু বদল করতে চাই।‘

.

দুই. দুটি সত্তা

আমরা আমাদের নিজেদের সত্তাকে চিনি না। আমরা জানি না এই শরীর নামক যন্ত্র, আমাদের সত্তা কাজ করে চলে। তাহলে কি করে জানব একে কেমন করে ব্যবহার করতে হয়? এ ছাড়াও আমরা একে কী করে অন্যদের মতই বা করতে পারব?

এখনও পর্যন্ত যারা এটা করতে জানেন বলে জানিয়েছেন তাদের বক্তব্য হলো এটি কাজ করে আকাঙ্খার বশবর্তী হয়।

তাদের মত হলো এটাই সেই শক্তি যা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। কোন কাজ করার জন্য এই শক্তিই একটা পদ্ধতি বেছে নেয়।

ইচ্ছা বেছে নিতে পারে।

সঠিক পছন্দ, সঠিক আকাঙ্খই হলো আমাদের কাজ। তাই সঠিক আকাক্ষা করতেই শেখান। এটাই হলো মস্ত একটা ধারণা।

কিন্তু আজকের দিনে আমরা জেনেছি বস্তুত ইচ্ছা আমাদের চালনা করে না।

তাহলে একবার যারা এটা জানেন তাদের কথাই মনে করে দেখুন।

যেমন ধরুন প্রচণ্ড মদ্যপানে আসক্তি আর জুয়ার নেশা যাদের আছে তাঁদের কথা। তাঁরা কিছুতেই নিজেদের আয়ত্বে আনতে পারে না তারা অবশ্যই এটা চায় না তবুও।

তবু তাঁদের মধ্যের কোন প্রচণ্ড কিছু প্রায়ই তাদের তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে। এই ভাবেই তাদের ইচ্ছাও ছুটন্ত একটা টগবগে ঘোড়ার সামনে হাঁটতে শেখা শিশুর মতই হয়ে পড়ে।

এই প্রচণ্ড কিছু স্বয়ং শয়তানও হতে পারে। অথবা রক্ষাকারী কোন দেবদূত।

এই কিছু জিনিসটা যা আমাদের স্বপ্নেও দেখা দেয় যা আমাদের কাজে উদ্যোগী করে। এটাই আমাদের শাসন করে। এটাই হলো আসল সত্তা।

এটা থেকেই হয়তো মনে হয় মোট দুটি সত্তাই আছে।

এর একটি বেশ সুপরিচিত। আমরা তাদের চিনতে পারি যখন আমরা জাগ্রত থাকি। এই সত্তা যেন নিজের কথা চিন্তা করে।

এ যেন এক আলোকিত নাট্যমঞ্চ। মঞ্চের উপর যেন কিছু অভিনেতা অভিনয় করে চলেছে আর আমরা দর্শক হিসাবে কাছাকাছি রয়েছি।

অন্য সত্তাও কিন্তু সারাক্ষণই কাছে রয়েছে। তবে আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না। পারবোই বা কেমন করে? আমরা আসলে একটা পুতুল নাচের আসরেই রয়েছি।

অন্য সত্তার কাজ হলো আলো জ্বালানো–সে আলো লাল, নীল সবুজ কত রঙেরই না হতে পারে; তাছাড়াও সে সত্তার কাজ হলো তার টানা, পুতুল নাচানো, দৃশ্য পাল্টানো ইত্যাদি।

এই সত্তা না থাকলে কোন নাচই আর থাকবে না। অতএব এই সত্তাই হলো আসল সত্তা। এই সত্তাকেই শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

এই সত্তা যদি ঠিকঠাক কাজ করে, পুতুল নাচ ঠিক মত চলে। দর্শকরা সবাই একবাক্যে বলবেন, ‘আহা চমৎকার হয়েছে!’

এই সত্তা খুবই তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। দুনিয়ায় এরই রয়েছে তীক্ষ্ম এক দৃষ্টি, সে সবই দেখতে পায়, সবই মনে রাখতে পারে, কিছু ভুলে যায় না।

এ সব কিছু বিশ্বাসও করে। আর সে যা বিশ্বাস করে তাই বাস্তব হয়ে ওঠে, ঘটে চলে। আমাদের শরীরে আর মনের অভ্যন্তরে যা ঘটমান তার সব এই সত্তারই কৃত। এই সব কিছুই ঘটে কারণ এই সত্তা বিশ্বাস করে এসবই ঘটতে চলেছে।

ডঃ কু তাই বলেছেন আপনাকে যা করতে হবে তাহলে এই সত্তাকে সব বিশ্বাস করানো। এটা কু বলেছেন তাঁর ‘সেলফ মাষ্টারি থ্র, কনসাস অটো-সাজেশান’ বইটিতে।

এ রকম ব্যাপার আপনার নিজেরই বা অন্য যে কোন একজনের।

এরই নাম হলো প্রভাব। এটাই হলো যাকে আপনার পছন্দ তাকে প্রভাবান্বিত করার সেরা উপায়, সে আপনি নিজেও স্বয়ং হতে পারেন।

এই প্রকৃত সত্তার মাধ্যমে আপনি হতাশা, ক্লান্তি অসহায় ভাবনা আর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন।

এই প্রকৃত সত্তা আপনাকে দিতে পারে জীবন, স্বাস্থ্য, শক্তি বা যুক্তিগ্রাহ্য যা কিছু আপনি চাইতে পারেন।

তবে আপনি কিছুতেই অন্য সত্তাটিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেবেন না। তাহলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু অপর সত্তাটিকে ভুলে যান। একেবারে দূরে সরিয়ে রাখুন একে ঘুম পাড়িয়ে রাখুন। এবারে আসল সত্তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বলে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করুন :

প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তেই আমি ক্রমশ ভালো, আরও ভালো হয়ে উঠছি।

কথাটা খুব আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলুন, সে সময় আর কিছুই ভাববেন না শুধু মনে বিশ্বাস রাখুন।

হ্যাঁ। আজকের দিনে বিশ্বাস পাহাড়কেও গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে। ডঃ কু’র অনুশীলনীর মধ্যে আমরা এই অলৌকিক ব্যাপারই ঘটতে দেখি।

.

তিন. প্রকৃত সত্তা

আমরা প্রকৃত যা তার চেয়েও আমরা অনেক বড়।

আমাদের মধ্যে যা সবার সেরা (মাঝে মাঝে অবশ্য সবচেয়ে খারাপও) এমন একটা অংশ যার উপস্থিতি আমরা টের পাই না।

তাসত্ত্বেও তার উপস্থিতি কিন্তু রয়েছেই। এটাই আমাদের দশ ভাগের ন’ভাগ।

আমাদের এমন একটা ধারণা থাকতে পারে যে আমরা আমাদের ইচ্ছে মতই চিন্তা করতে পারি বা অনুভব করতে পারি। যতদূর জানা আছে আমাদের কাজ আমাদের নিজেদের। যতদূর জানি এতে বাইরের কেউ আসেন না।

তাসত্ত্বেও এমন অনেক কিছু আছে যে আমাদের করার কিছুই থাকে না।

আমরা বলি : ‘আমরা চাই, তবে অমুক অমুক কাজ করতে পারি না।’

আসলে আমরা দুটো অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ি। এক অংশ বলে :

হ্যাঁ, আপনার ওটাই করা উচিত। আবার অন্য অংশ কিন্তু নিজের সম্পর্কে ততটা নিশ্চিত না হওয়ায় সঠিক বলতে চায় না। তার সব মত হলো, সে যেহেতু অনুভব করে যে কাজটি উপযুক্ত নয়, সহজ নয়। ভালো য় বা হয়তো নিরাপদও নয়, এটাই।

আমরা সন্দেহ করতে পারি না এটা সেই অপর সত্তার কাজ।

ঐ সত্তা যেন অন্ধভাবে পর্দার আড়ালে কাজ করে যায়। এটা সারা দিন রাতই কাজ করে চলে, তার বিশ্রাম বলে কোন কিছু নেই।

আমরা অনুভবই করি না সে ওখানে আছে।

তারা যখন কোন বিষয়ে দ্বিমত হতে চায় তখনই আমাদের অনুভূতিতে তাদের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। আমরা বুঝি কোথাও ভুল হয়েছে। আমরা তখনই একটু অস্বস্তি আর ইতস্ততঃ বোধ করতে থাকি। কোন কারণ ছাড়াই আমরা মেজাজ খারাপ করেও বসি। বা আমরা অন্য আচরণ করি। আমাদের একটা দুর্বলতা জাগে। আমরা বলি আমরা যোগ্য নই। আমাদের তেমন আনন্দ জাগে না। সব কিছুই আমাদের কাছে বিরাগজনক মনে হয়। আমাদের কেবল মনে হয় সবই আমাদের বিরুদ্ধে। কোন কিছুতেই মন লাগে না। আমাদের কেবল মনে হয় এ জীবনে বেঁচে থাকার কিছু নেই। কোন মানে হয় না। আর এমন একটা ধারণার যখন জন্ম হয় তখন সবই শূন্য হয়ে যায়। আমাদের অনেকেরই বোধ হয় তখন এই জঘন্য সব কিছু শেষ করেও দিতে চাই। এক ডোজ আর্সেনিক, আফিম বা একটা পিস্তলের গুলি-ব্যাস্। এর সবই করাতে থাকে পর্দার আড়ালে সেই অন্য সত্তা। এর সবই তাঁর করা। (তবে আমরা তা জানতে পারি না।)

ডঃ কু এর নামকরণ করেছেন কল্পনা। ডঃ ফ্রয়েড, ডঃ জাং, ড: অ্যাডলএর, রয় শেরউড আর অন্যান্যরা তাকে বলেছেন অচেতন বা অবচেতন।

তাদের বক্তব্য হলো মন হচ্ছে একটা নাট্যমঞ্চ। এ মঞ্চকে আলোকিত করছে। আর সেখানেই নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে।

আমাদের আসন থেকে আমরা হাবভাব, কল্পনা, অনুভূতি, ভাবনা বা ভঙ্গী সবকিছুরই নড়াচড়া করতে দেখে চলেছি।

তবে আমরা মঞ্চের বড়জোর একদশমাংশ ভাগ দেখতে পাই। যে অভিনয় আমরা দেখতে পাই তা সম্পূর্ণ অভিনয়ের একটা অংশই মাত্র।

এমন সব অভিনেতা আছে যারা দৃষ্টির আড়ালে, অন্ধকারে আলোর বাইরে থেকে যায়। আসল অভিনয়, যেটা সত্যিকার, অন্ধকারে চোখের আড়ালেই হয়ে চলে। যে অভিনেতাদের আমরা দেখি তারা নিছক ছায়া মাত্র। সব ব্যাপারটা আসলে ঠিক এই রকমই।

আমাদের ওই অবচেতন অংশকে দেখতেই হবে–আর দেখতে হবে আমার নিজেকে, আমাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিদিন যাদের দেখি আর প্রভাবিত করতে চাই।

এবার তাই দৃষ্টিমেলে লক্ষ্য রাখুন মঞ্চের উপর কারা যাতায়াত করছে আর অন্ধকারে বিলীন হতে চাইছে।

মাঝে মাঝে আমাদের মনে হয় আমরা যেন অসহায়। আমরা তখন পারিপার্শ্বিকতাকে দোষারোপ করি। আমরা বলি এটাই আমাদের অবচেতন অংশ গড়ে তোলে।

ঠিক। তবে সর্বতোভাবে নয়, পুরোপুরিও নয়। তাহলে আসুন, যতটা পারি আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে ঠিক উন্নত করে তোলার চেষ্টা করি। এই কাজটি শিশুদের আর কাজের শর্তের জন্য একান্ত জরুরী। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, অবশ্য, আমরা কি রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি। এটা আমাদের ক্ষমতার এলাকার মধ্যেই।

আমরা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে আরও ভালো হতে পারি। আমরা এ ছাড়াও আমাদের খরচের কাজেও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারি।

একজন ভালো আর খারাপ মানুষের কথাটাই একটু ধরুন। তারা দুজনেই কিন্তু মোটামুটি সমান। যেমন তাদের স্বভাব আর সহজাত মানসিকতার ইত্যাদির ব্যাপারে।

আসুন এবার দেখা যাক যাতে কোন কিছুই অবচেতনে ডুবে না যায় যাতে আমাদের যা প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত তাতে বাধা পড়তে পারে।

.

চার. প্রবণতা ও প্রবণতা কারক

যে মানুষ ঠিকমত চলতে পারে তাকে সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষই বলা যায়।

তিনি তার নিজের কাজ জানেন। তিনি নিজের কাজে আনন্দ পান। যেভাবেই হোক কাজ তার ভালো লাগে, কাজও তার সঙ্গে মানিয়ে যায়। তিনি যার কিছু করেন সবই তার যথাসাধ্য করেন।

এটাই হলো প্রবণতা বা ঝোঁক। তিনি তাঁর প্রবণতার পথ ধরে চলেন। আর এই কারণেই তিনি উন্নতি করেন।

আপনিও এই প্রবণতা বাদ দিয়ে উন্নতি করতে পারবেন না। প্রত্যেকেই এটা আগে বা পরে যখনই হোক শিখতে বাধ্য হন। আপনাকেও চলতে হবে এই পথেই। আর কোনভাবেই আপনার এগুনোর পথ নেই। একবার চেষ্টা করে দেখুন–তাতে শুধু ঝামেলাই বাড়বে।

আপনি অযোগ্য প্রমাণিত হবেন–এটা যেন গোলাকার গর্তে চৌকো গজাল। আপনি হয়তো কাজ করে যাবেন অথচ আনন্দের স্পর্শ টের পাবেন না। ঐ দিকে যার ঝোঁক আছে তার মত দক্ষতায় কাজ সম্পন্নও আপনি করতে পারবেন না। আপনি তাই হয়তো সেটা করবার কোন চেষ্টাই আর করতে চাইবেন না। এর ফলে আপনি উঁচু মানের কোন কাজই করতে পারবেন না। আপনি হয়ে যাবেন হাজার হাজার জনতার একজন মাত্র। আপনি কখনই আর একজন বিখ্যাত মানুষ হওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারবেন না (এটাই হলো সাফল্যের আসল অর্থ)।

আপনি নিজেকে আরও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করুন।

একবার দেখুন চমৎকারভাবে কি করতে পারেন। আপনি হয়তো কিছু কিছু জিনিস করতে। ভালোবাসেন। যেগুলো করতে কাজ করছেন বলে মনেই হয় না। যেগুলো আপনার কাছে খেলারই মত। এগুলো নোট করে রাখুন।

অল্পবয়স্কদের যদি আপনি দেখাশোনার ভার পেয়ে থাকেন তাহলে তাদের প্রবণতা বা ঝোঁকের দিকে নজর রাখুন, লক্ষ্য করুন তারা মনের দিক থেকে কি করতে চায়।

ঝোঁক বা প্রবণতা হলো এমন কিছু যা আমাদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালো না করে কিছুতেই পারি না। আমাদের মধ্যের কিছু, এটা করতে বাধ্য করে আমাদের।

এর সঙ্গে অবশ্য আপনি এই মুহূর্তে যা ভাবছেন তার কোন সম্পর্ক নেই, বা আমরা যা কিছু সাধারণত অভ্যাস বশে ভেবে থাকি।

এই ‘কিছু’ শুধু আমাদের পতন ঘটায়। আমাদের মনে হয় আমাদের নিজের যেন কোন আকাঙক্ষাই নেই।

আমাদের এক অংশ আমাদের একদিকে টানতে থাকে। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি সেটাই আমাদের পক্ষে ভালো। আমাদের ‘মন’ সেই দিকেই থাকে।

তবে কাজ করা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। এটা ঠিক এই রকম।

ধরুন আমাদের চিন্তার সত্তা যেন একটা বাঁধ তৈরি করতে বা অন্য কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আমরা কাজে লেগে পড়েছি। কিন্তু দাঁড়ান, ঝামেলা আসছে। প্রচুর জল জমেছে। সামনেই রাস্তা। সাধ্য থাকে বাধা দিনতো দেখি। প্রচণ্ড বেগে বাঁধের উপর সবেগে আছড়ে পড়লো জরস্রোত। সব ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলো, কিছুরই আর চিহ্ন পর্যন্ত রইলো না। বাধটা যেন খড়কুটোর মতই ভেসে গেলো। এই বন্যার জোয়ার, সেই অবচেতন চিন্তাহীন সত্তা ঝাঁপিয়ে পড়ে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

না বাড়িয়ে বলতে গেলে সবই এই রকম। বাস্তবে আমরা নিজেদের যা ভাবি আমরা তা নই।

আমরা আসলে শুধু চূড়োটাই দেখতে পাই। হিমশৈলের দশভাগের নয় ভাগই আমাদের দৃষ্টির আড়ালে নিমজ্জিত থাকে। আমাদের ওটা দেখতে পাওয়ার বিন্দুমাত্রও আশা নেই।

যেসব কাজ আমরা না করে পারি না তাদে সম্পর্কে এই রকমই ভাবি।

এটাই আসল সত্তার কাজের ধারা। আমাদের রক্তের মধ্যে এই রকমই আমরা। আপনি কিছুতেই এই সত্তাকে এগিয়ে গিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন না। একে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখুন–আপনি তবে নিজের সত্তাকে খর্ব করবেন।

দেশের হাসপাতালগুলো রোগীতে ভর্তি–তাদের আসল সত্তাকে যেন হাত পা বদ্ধ অবস্থায় মিশরের মমীর মতই রেখে দেওয়া হয়। তারা হয়ে ওঠে স্নায়ুর রোগী-তাদের জীবনে ভাবের অভাব দেখা দেয়, স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়ে তাদের ইচ্ছা শক্তিও লুপ্ত হয়।

এতেই কেবল বোঝা যায় এই অবচেতন সত্তা কি ধরণের ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্বেও।

এসব ছাড়াও বোঝা যাবে কি ভাবে জীবনের নানা দমন-পীড়ন কাজে বাধা, চোখরাঙানি ঝামেলা, ক্রোধ আরও অজানা অনেক কিছুই আমরা না ভেঙে পড়া পর্যন্ত বুঝি না আর কেন জানি না।

এতে অবশ্য কখনই বোঝায় না আমাদের যা ইচ্ছা সেটাই কেবল করা, যাতে অস্তিত্বও বিপন্ন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

এটা একেবারেই ঠিক নয়, বরং সম্পূর্ণ অন্য।

আমাদের প্রধানতম কাজ হলো আমাদের মধ্যে সেই ঝোঁক প্রবণতাকে যথাযোগ্য ভাবে চালনা করতে পারি আর খুঁজে পেতে পারি।

এক কাজ করার অনেক পদ্ধতি আছে-এর যে কোনটাই আমাদের ঢের উপকার করতে পারে। এ আমাদের মধ্যের শ্রেষ্ঠত্বকে আবিষ্কার করতে পারে।

মনে রাখবেন আমাদের সহজাত ক্ষমতা সবসময় আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলতে চাইছে।

শুধু লক্ষ্য রাখবেন ওই গতিময়তা যেন কোন বিপদের দিকে আমাদের কখনই ঠেলে না দেয়। লক্ষ্য রাখা চাই এটি যেন সঠিক ভাবে ঠিক পথে চালককে ঘুরিয়ে নিয়ে যায়, সঠিক পথ খুঁজে পায়।

একে তাই সঠিক পথ নির্দেশ করুন।

আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম উদ্দেশ্যই হলো এই সহজাত ক্ষমতাকে ঠিক পথে কাজ করতে নিয়োজিত করা।

.

পাঁচ. স্বয়ংক্রিয় অভিভাবন

আপনার সম্ভবত ধারণা জন্মেছে সাফল্য আসে কেবল অপরকে প্রভাবিত করার ফলে। ধারণাটা ভালোই। এটা থাকলে আপনাকে তা হয়তো বহুদূরেই নিয়ে যাবে। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে। আর সেটা হলো নিজেকে কিভাবে প্রভাবিত করতে হয়। মনে রাখবেন সাফল্য লাভ করার সবসেরা পথই হলো–তার যোগ্য হওয়া।

আপনার নিজস্ব সত্বা আপনাকে যোগ্য বা অযোগ্য করে তুলতে পারে। আপনি আগামী কাল কি হবেন সেটা নির্ভর করছে ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কি ধরণের। এর প্রতিবিম্বেই সৃষ্টি হয় কারণ। আপনি যদি জটিলতার সমাধান করতে পারেন তাহলে দেখতে পাবেন কোন ফলাফল নিজে থেকেই আসে না–এটা আলাদা কিছু নয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আপনি দেখতে পাবেন ফলাফল বিশেষ কোন কারণেই অন্য ভাবে রূপ পরিগ্রহণ করেছে।

এখন, নিজের সত্বার এমন সব অংশ আছে যাকে আপনি সহজে প্রভাবিত করতে পারেন না। প্রাণপণে চেষ্টা করে দেখুন, এগুলো আপনার হাতের বাইরে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি :

ধরুন, আপনার হৃৎপিণ্ডের শব্দ…ভুলে যাওয়ার ব্যাপার…শারীরিক আর মানসিক ক্ষত নিরাময় হওয়া। এগুলো আপনা থেকেই হতে থাকে, আপনি এসব নিয়ে কিছু ভাবুন আর না ভাবুন। চিন্তায় আচ্ছন্ন হলে, সাধারণতঃ এগুলো তাড়াতাড়ি হয় না…বা আরও ধীর করেও ফেলতে পারে না। এগুলো নিছক ধারাবাহিক ভাবেই হয়ে চলে এই যা।

অবশ্য এমন অনেক কাজ আছে যেগুলোর ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহে প্রভু। সেগুলো কখনই ঘটতে পারে না আপনার যদি ইচ্ছা না থাকে, আপনি যদি আপনার ইচ্ছাকে কাজে লাগান তাহলে কিছুতেই তা ঘটতে পারে না। যেমন আপনি ইচ্ছেমত সময়ে উঠতে পারেন বা দেরীও করতে পারেন–এসবই আপনার জ্ঞাতসারেই ঘটে। আপনি ওষুধটা খেতে পারেন বা না খেয়ে ফেলেও রাখতে পারেন। এসব কাজে আপনি স্বাধীন। আপনি যেকোন দুটো ব্যাপারে একটিকে বেছে নিতে পারেন। এ ব্যাপারেও আপনি স্বাধীন। আপনি এই সব কাজে আপনার সত্বাকে প্রভাবিত করতে পারেন।

এসব ছাড়াও তারও সব বিষয় আছে যার কিছু স্বয়ং ঘটমান আর কিছু অংশ ইচ্ছার বশবর্তী। যেমন ধরা যায় শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া বা ফেলা। আবার ধরুন, দাড়িকামানোর সময় অন্য কিছু চিন্তা করে চলা। কোন মানুষ সম্পর্কে, কাজ বা ঘটনা সম্পর্কেও আপনি চিন্তা করেন। এটার অর্থ আপনার মন কাজ করে চলেছে। কিন্তু আপনি আপনার সত্ত্বাকে কাজে উদ্বুদ্ধ করেন নি। এইসব ঘটনা আপনা আপনিই হয়ে চলে বলতে পারেন হয়তো। তাসত্ত্বেও, আপনার যদি ইচ্ছা হয় আপনার ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে হাঁফ ছাড়তে পারেন, দাড়ি কামানোতেই মন দিতে-তখন সব কিছুতেই আপনি দূরে ঠেলে রাখতে পারেন।

অবশ্য, প্রত্যেকেই জানেন আমরা স্বভাবতই শরীর আর মনে টগবগ করে অহরহ চলি। এই দুটিই সম্পূর্ণভাবে আলাদা।

তাসত্ত্বেও এগুলো আপনার আর আমার মধ্যেই আছে–আছে আমাদের সকলেরই মধ্যে। এই দুটো বিপরীত মেরু পাশাপাশিই রয়ে গেছে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে। তারা কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে আদৌ আলাদা কোন চরিত্র নিয়ে নেই। তারা ঠিক একজন ব্যক্তিত্বেরই জন্ম দেয়। তাদের নিজস্ব এক কার্যধারাও রয়ে গেছে।

আমাদের যেভাবেই হোক–যতখানি আমরা সুস্থ থাকি তারা আমাদের টেনে রাখতে চায়।

আসল কথাটা হলো : আমরা নিজেরা যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যা সেই অবস্থায় থাকি আমাদের মন স্বইচ্ছায় কিছু করতে পারে না, পারে না আমাদের এই দেহও। তারা একসঙ্গে গ্রথিত থাকে। যে ভাবেই হোক দেহকে মনের সঙ্গে অনেকটাই কাজ করে যেতে হয়–আপনি যা কল্পনায় ভাবতে পারেন তার চেয়ে ঢের বেশি।

অতএব শরীর অসুস্থ হলে, সে মনকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে (একবার অসুস্থ মানুষের মনোভাবের কথা ভাবুন)।

বা, অন্যদিক থেকে দেখলে : মন যখন ঠিক থাকে না সে শরীর খারাপ করে দেয়। যেমন আপনি যখন চিন্তিত হন, বা ভয় পান বা অসুখী থাকেন, তখন শরীর ঠিক আছে মনে হয় না। মাঝে মাঝেই আপনার খিদে থাকে না। আপনি কঠিন পরিশ্রম করতে পারেন না, ইত্যাদি।

আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা মনকে প্রভাবিত করতে পারি, সেই ভাবেই আবার পারি দেহকেও।

এটাই হলো আমাদের সত্বাকে সাফল্যের জন্য সরাসরি রূপ দান করতে চাওয়া। মাঝে মাঝে একাজ দুনিয়ায় সবচেয়ে কঠিন কাজ বলেই মনে হয়। বন্যঘোড়া আর দৈত্য-আবেগ আর সুপ্ত ক্ষমতা যেন এই রকমই–এবং তাই তারা প্রায়ই ইচ্ছাশক্তির পক্ষে অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। ইচ্ছা হল অনেকটা ছেঁড়া বস্ত্রের মত। এর কোন দামই যেন নেই। সত্যিই কি তাই?

অবশ্য এই রকম অবস্থায় নিজের সত্বাকে প্রভাবিত করার একটা পথও আছে। সত্বার একটা অংশ যার শতকরা সবটাই স্বয়ংক্রিয় নয়–তাসত্ত্বেও সে সম্পূর্ণভাবে ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়।

এই অংশ সম্বন্ধে ডঃ কু অনেকখানিই বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সম্বন্ধে আমাদের কিছু ভাবনার নেই। আমরা যদি চাই এ সম্পর্কে আমাদের সচেতন না হলেও চলবে। আপনি একে ইচ্ছে করলে অচেতন বা অবচেতন বলতে পারেন।

মনের মধ্যে প্রবেশ করার এটাই হলো খোলা পথ। এইভাবেই আমরা অনেক বদল করতে পারি, তাকে সারিয়ে তুলতে পারি। শক্তিশালী করতে পারি।

তাই বলতে গেলে মন আর দেহের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়া আছে–আর সেটা করার পথ হলো অবচেতন সত্বার মধ্য দিয়ে মনের মধ্যে পৌঁছে শরীরকে প্রভাবিত করে নতুন সুস্বাস্থ্য আর শক্তি ফিরে পেতে পারি।

অবশ্য ডঃ কু’র নিজস্ব পরামর্শে যে সবই নিরাময় হতে পারে সেকথা বলতে চাওয়া খুবই বেশি বলা হবে।

এটি মনে যে পরিবর্তন আনে তাহলে আমরা যেভাবে লোকজন, জিনিস বা ঘটমান কিছুর দিতে তাকাই সেই ভাবেই। এ মনের মধ্যে বা মন থেকে যেসব শর্ত বা কারণ সরাসরি জেগে ওঠে তাদের হাত থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারে। আর যার উদাহরণ হিসেবে কল্পনার ক্ষেত্রে যেমন করার থাকতে পারে।

আত্ম-অভিভাবন বা নিজস্ব-অভিভাবন বা পরামর্শ হীনমন্যতা বা ভয়ের মত ব্যাপার বিশেষ করে স্নায়ু, দুশ্চিন্তা, চিন্তা ইত্যাদির উপস্থিতিতে দূর করে দিতে পারে। এগুলো আসলে মানসিক অবস্থা।

এই আত্ম অভিভাবনের সহায়তায় আপনি যন্ত্রণাবোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারেন, এটাই শেষ পর্যন্ত মনে দেখা দেয়।

কিন্তু–আর এটা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরী–দাঁতের যন্ত্রণাকে যদি গ্রাহ্য না করা হয় আর এইভাবেই তা দূর করাও যায় সেটা কিন্তু ঐ পচা দাঁতকে নষ্ট করে ফেলতে পারে না।

ঠিক এইভাবেই ডঃ কু’র পদ্ধতিও মানসিক পক্ষাঘাতের হাত থেকেও তার কষ্ট দূর করতে পারে। কিন্তু এটা কখনই শুকিয়ে যাওয়া বা মৃত শিকড়সম স্নায়ুগুলোকে কিছুতেই নতুন জীবন দিতে পারে।, কারণ এ রোগ অতি সংক্রামক।

এবার আসুন, ডঃ কু’র পদ্ধতিটা কেমন দেখে নিই।

বারবার অবচেতন সত্বার সঙ্গে কথা বলতে থাকুন। সবচেয়ে ভালো সময় হলো রাত্রিবেলা যখন আপনার জাগ্রতভাব ক্রমে বিলীন হতে চায় আর তার স্থান গ্রহণ করে গোপন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অবচেতন সত্বা। এই সত্বাকে জানিয়ে দিন আপনি কি হতে চান বা করতে চান। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলুন। একদম সঠিক থাকুন। তবে অপ্রাসঙ্গিক বা অসম্ভব কিছু বলবেন না। কথাগুলো যেন বেশ পরিষ্কার আর দ্রুর করে বলা হয়, আর বারবার বলবেন। অনেক চিকিৎসক বিশ্বাস করেন শুধু কথাগুলো ঠোঁট নেড়ে বলতে চাওয়াই যথেষ্ট-শব্দ করে উচ্চারণ করার দরকার হয় না।

একটা উদাহরণ হিসেবে আজ রাতেই ডাঃ কু’র পদ্ধতি প্রয়োগে করে বসুন না : ‘আমি এবার আবার কাজে মনোযোগে দেব। সব মনপ্রাণ নিয়োজিত করবো, এর মাঝখানে অনেন্দ আর সুখ খুঁজে নেব।’

প্রত্যেক সফল মানুষই এইভাবে কাজ করে থাকেন। তাহলে আপনি কেন করবেন না? আজই তবে শুরু করে দিন।

.

ছয়. পুরনোর বদলে নতুন সত্তা

আপনি হয়তো ভাবছেন : এই সাফল্যের বিষয় নিয়ে এত আলোচনা কেন? আমি এত বয়স পার হয়ে এসেছি। আমি ক্রমেই অতলে নামতে চলেছি। রাতারাতি পুরনো এই খোলসা বদলে ফেলা অসম্ভব। এটা কখনই করা যায় না। নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার মত এখন আর এসময়কে বেছে নেওয়া যায় না।

এরকম একটা ধারণা সত্যিই মারাত্মক একটা বিষয়।

লক্ষ লক্ষ স্ত্রী পুরুষকে এটাই আর এগিয়ে চলতে দিচ্ছে না। ধারণাটা হলো বয়স হয়ে গেলে আর কেউই নতুন করে কিছু শিখতে পারে না। এমন একটা ধারণা যে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরে পা রাখলেই যে কোন মানুষ একদম শীতল, পাথরে পরিণত হয়ে যায় আর কোনভাবেই তাকে গলিয়ে নতুন রূপদান করা যায় না।

আসলে, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এর বিপরীতটাই কিন্তু ঘটে চলেছে।

আপনি নিজেই হয়তো বহু মানুষের কথা জানেন বা তাদের বিষয়ে পড়ে থাকবেন যে তারা কেমনভাবে উন্নতি করে চলেছেন। শিখরে উঠছেন তাদের সারা জীবন ধরেই। তারা কোনদিনই ভাবেননি একাজ পারবেন না। তারা কখনই বলেন কি নতুন কোন কিছু ভাবতে বা নতুন আদর্শ গড়তে, নতুন ধ্যানধারণা তৈরি করতে বা পুরনো সত্বা বদল করে নতুন সত্তা তারা আর গড়তে পারবেন না।

এই কারণেই আজকের মনস্তত্ববিদরা কখনই বিশ্বাস করেন না যে কেউ বদলে যাওয়ার ক্ষমতা ত্যাগ করতে পারে।

কেউ যখন বলে; মানুষের মন একটু একটু করে মরচে ধরে শক্ত, অথর্ব হয়ে পড়ে, আর সেটা জীবনের একটা বিশেষ সময়েই হয়।

‘একদম বাজে কথা!’ মনস্তাত্ত্বিকরা প্রতিবাদ করে বলবেন।

তারা কোনসময়েই আমরা যাকে অভ্যাস বলি তার দিকে চোখ বন্ধ করে থাকেন না। তারা জানেন যে অভ্যাসই সব জিনিসকে সহজ করে তোলে। এদের নিয়েই আমরা কোন ঝামেলা ছাড়া চলতে পারি। আসলে এদের ছাড়া আমরা চলতেই পারতাম না।

আপনার নিজেকে একবার অভ্যাস বাদ দিয়ে কল্পনা করে নিন তো! মনে করুন, আপনি কোন বিষয় মনে করতে পারছেন না আর প্রতিটি ছোটখাটো কাজ করার সময় মনস্থির করতে হচ্ছে। এরকম হলে আপনি কিছুতেই আর কোন কাজই করে উঠতে পারবেন না। আপনি ছোটখাটো বিষয়ে এতই ব্যস্ত থাকবেন যে বড় বা দরকারী কাজ করার আর কোন সুযোগই পাবেন না।

অভ্যাস দারুণ দরকারী জিনিস। এটা জীবনকে সহজ করে তোলে। তাছাড়াও দ্বিগুণ কাজ করে। অভ্যাসের মজাই হলো এই।

এই অভ্যাসই মানুষের মধ্যে মনে রাখার কাজটা করে চলে। এ ছাড়া আমরা কোন কিছুই শিখতে পারতাম না, নিজেদের শেখাতেও পারতাম না।

অভ্যাস বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন, একথা বিশ্বাস করুন আর না করুন। এটা কোন রকম অচিন্তার অন্ধ কোন কিছু না।

জ্ঞানতঃ কোন অভ্যাস ত্যাগ করা বা গড়ে তোলা ব্যাপারটা একটা বিরাট কিছু।

এর অর্থ হলো কোন কিছু হয়তো বদলে যেতে পারে। আমরা ভীত নই। আমরা হারিয়ে যাই না। আমরা বেঁচে থাকতে পারি কেননা আমরাও তো বদলে যেতে পারি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বদলে যেতে পারি। আমরা নতুন নতুন অভ্যাসও গড়ে তুলতে পারি।

এই অভ্যাস তৈরি করা বা ছেড়ে দেওয়ার শক্তি ছাড়া জীবন হয়তো শেষ হয়ে যেতে পারতো বহুঁকাল আগেই। সত্যিই কি অসহায় এই জীবন।

অতএব আপনি দেখছেন অভ্যাস এক ধরণের মনে রাখার ব্যাপার। এই ভাবে আপনার শিরা উপশিরা, স্নায়ু আর মস্তিষ্ক কাজ করে। কত দ্রুতই না এরা শিখেও নেয়।

প্রথম এবার কিছু করার চেষ্টা করুন। কাজটা অবশ্য সহজ হবে না। তাই আবার চেষ্টা করুন। এটা তেমন কঠিন নয়। কোন কিছু না ভেবে আপনি অচিরেই করতে পারবেন। আপনার মস্তিষ্কের নিচের স্তর কাজটা করা সুরু করেছে।

অভ্যাস কিন্তু অচিরেই একটা কদর্যতায় পরিণত হতে পারে। এ হয়তো আপনার উপর কর্তৃত্ব করতে চেয়ে আপনাকে চালনাও করতে পারে। অভ্যাস যতক্ষণ থাকবে আপনার নিজস্ব ইচ্ছা বলে কিছু থাকবে না। এমন একটা ধারণা অবশ্যই তেমন সুখবর নয় কিছুতেই।

মনে রাখা দরকার অভ্যাস একটা ভালো দান বটে তবে অত্যন্ত খারাপ প্রভু। তাই এর জায়গাতেই একে রেখে দিন। অভ্যাসকে শেষ করতে দিন। যে কোন মূল্যেই হোক আপনাকেই প্রভুত্ব করতে হবে।

আর এই কারণেই তাই আপনি করবেন যখন বলবেন : ‘না, এখন বদল করার পক্ষে বড় দেরী হয়ে গেছে।’

এর কারণ কি জানেন? আপনি অভ্যাসকে বড় বেশি সুযোগ দিচ্ছেন। আপনি ভুলে গেছেন আসল প্রভু কে। আসলে আপনি নিজেকে বুদ্ধিহীন করে তুলছেন।

এসবের অর্থই হলো আপনার মস্তিষ্কের নিম্নস্তর বড় বেশি কাজ করতে সুরু করেছে আর এর সঙ্গে উপরের স্তর একেবারেই কিছু করছে না।

তাসত্বেও কিন্তু মস্তিষ্কের উপরের অংশই আসল প্রভু।

এই উপরের মস্তিষ্ক ছাড়া আমাদের অভ্যাস থাকা সম্ভব নয়। আমরা শিখতেও পারবো না (অভ্যাস গড়ে ওঠার ব্যাপারটাও তাই)-আর এটা সম্ভব হতো না উপরের মস্তিষ্কের অংশ না থাকলে (এটাই বুদ্ধিমত্তা)।

এর মূল বক্তব্য তাহলে কি?

নিম্ন মস্তিষ্ককে ক্ষমতা দান করলে আখেরে লাভ হয় না। এর ফলে এটা নড়েচড়ে কাজ করার শক্তি নষ্ট করে দেয়। অতএব আসুন আমরা উপরের মস্তিষ্কই কাজে লাগাই। এর সাহায্যে আমরা আরও ভালো করে আরও দ্রুত কাজ সমাধা করতে পারি! আমরা কোন কিছু নতুন আর আশ্চর্যজনক কিছুতে বদলে যেতে পারি!

আগেকার পুরনো বাজে অভ্যাস দূর হোক। নতুন আর কাজের অভ্যাসই তবে আসুক। এই ভাবেই সৃষ্টির আদি থেকে জীবন এগিয়ে চলেছে। এই কারণেই জীবন সফল হয়েছে। সাফল্যের এটাই হলো অন্যতম বিরাট একটি নিয়ম-অভ্যাসের ধারাবাহিক মৃঙ্খল গড়া আর ভেঙে ফেলার শক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *