মালিনী – ২

দ্বিতীয় দৃশ্য

মন্দিরপ্রাঙ্গণে  ব্রাহ্মণগণ

ব্রাহ্মণগণ।  নির্বাসন, নির্বাসন, রাজদুহিতার
নির্বাসন!  
ক্ষেমংকর।            বিপ্রগণ, এই কথা সার।
এ সংকল্প দৃঢ় রেখো মনে। জেনো ভাই,
অন্য অরি নাহি ডরি, নারীরে ডরাই।
তার কাছে অস্ত্র যায় টুটে, পরাহত
তর্কযুক্তি, বাহুবল করে শির নত–
নিরাপদে হৃদয়ের মাঝে করে বাস
রাজ্ঞীসম মনোহর মহাসর্বনাশ।
চারুদত্ত।    চলো সবে রাজদ্বারে, বলো, “রক্ষ রক্ষ
মহারাজ, আর্যধর্মে করিতেছে লক্ষ্য
তব নীড় হতে সর্প’।
সুপ্রিয়।                          ধর্ম? মহাশয়,
মূঢ়ে উপদেশ দেহ ধর্ম কারে কয়।
ধর্ম নির্দোষীর নির্বাসন?
চারুদত্ত।                          তুমি দেখি
কুলশত্রু বিভীষণ। সকল কাজে কি
বাধা দিতে আছ?
সোমাচার্য।                   মোরা ব্রাহ্মণসমাজে
একত্রে মিলেছি সবে ধর্মরক্ষাকাজে,
তুমি কোথা হতে এসে মাঝে দিলে দেখা
অতিশয় সুনিপুণ বিচ্ছেদের রেখা–
সূক্ষ্ণ সর্বনাশ।
সুপ্রিয়।                    ধর্মাধর্ম সত্যাসত্য
কে করে বিচার? আপন বিশ্বাসে মত্ত
করিয়াছ স্থির, শুধু দল বেঁধে সবে
সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চরবে?
যুক্তি কিছু নহে?
চারুদত্ত।                      দম্ভ তব অতিশয়
হে সুপ্রিয়।
সুপ্রিয়।                প্রিয়ম্বদ, মোর দম্ভ নয়,
আমি অজ্ঞ অতি– দম্ভ তারি যে আজিকে
শতার্থক শাস্ত্র হতে দুটো কথা শিখে
নিষ্পাপ নিরপরাধ রাজকুমারীরে
টানিয়া আনিতে চাহে ঘরের বাহিরে
ভিক্ষুকের পথে– তাঁর শাস্ত্রে মোর শাস্ত্রে
দু-অক্ষর প্রভেদ বলিয়া।
ক্ষেমংকর।                         বচনাস্ত্রে
কে পারে তোমারে বন্ধুবর।
সোমাচার্য।                            দূর করে
দাও সুপ্রিয়েরে। বিপ্রগণ, করো ওরে
সভার বাহির।
চারুদত্ত।                 মোরা নির্বাসন চাহি
রাজকুমারীর। যার অভিমত নাহি
যাক সে বাহিরে।
ক্ষেমংকর।                  ক্ষান্ত হও বন্ধুগণ।
সুপ্রিয়।      ভ্রমক্রমে আমারে করেছ নির্বাচন
ব্রাহ্মণমণ্ডলী। আমি নহি এক জন
তোমাদের ছায়া। প্রতিধ্বনি নহি আমি
শাস্ত্রবচনের। যে শাস্ত্রের অনুগামী
এ ব্রাহ্মণ, সে শাস্ত্রে কোথাও লেখে নাই
শক্তি যার ধর্ম তার।

ক্ষেমংকরের প্রতি

             চলিলাম ভাই,
আমারে বিদায় দাও।

ক্ষেমংকর।                      দিব না বিদায়।
তর্কে শুধু দ্বিধা তব, কাজের বেলায়
দৃঢ় তুমি পর্বতের মতো। বন্ধু মোর,
জান না কি আসিয়াছে দুঃসময় ঘোর–
আজ মৌন থাকো।
সুপ্রিয়।                        বন্ধু, জন্মেছে ধিক্কার।
মূঢ়তার দুর্বিনয় নাহি সহে আর।
যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকর্ম ব্রত-উপবাস
এই শুধু ধর্ম ব’লে করিবে বিশ্বাস
নিঃসংশয়ে? বালিকারে দিয়া নির্বাসনে
সেই ধর্ম রক্ষা হবে? ভেবে দেখো মনে
মিথ্যারে সে সত্য বলি করে নি প্রচার ;  
সেও বলে সত্য ধর্ম, দয়া ধর্ম তার,
সর্বজীবে প্রেম– সর্বধর্মে সেই সার,
তার বেশি যাহা আছে, প্রমাণ কী তার?
ক্ষেমংকর।  স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম এক বটে,
বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে
ভিন্ন জলাশয়। আমরা যে সরোবরে
মিটাই পিপাসা পিতৃপিতামহ ধ’রে
সেথা যদি অকস্মাৎ নবজলোচ্ছ্বাস
বন্যার মতন আসে, ভেঙে করে নাশ
তটভূমি তার, সে উচ্ছ্বাস হলে গত
বাঁধ-ভাঙা সরোবরে জলরাশি যত
বাহির হইয়া যাবে। তোমার অন্তরে
উৎস আছে, প্রয়োজন নাহি সরোবরে–
তাই বলে ভাগ্যহীন সর্বজনতরে
সাধারণ জলাশয় রাখিবে না তুমি–
পৈতৃক কালের বাঁধা দৃঢ় তটভূমি,
বহুদিবসের প্রেমে সতত লালিত
সৌন্দর্যের শ্যামলতা, সযত্নপালিত
পুরাতন ছায়াতরুগুলি, পিতৃধর্ম,
প্রাণপ্রিয় প্রথা, চির-আচরিত কর্ম,
চিরপরিচিত নীতি? হারায়ে চেতন
সত্যজননীর কোলে নিদ্রায় মগন
কত মূঢ় শিশু, নাহি জানে জননীরে–
তাদের চেতনা দিতে মাতার শরীরে
কোরো না আঘাত। ধৈর্য সদা রাখো সখে,
ক্ষমা করো ক্ষমাযোগ্য জনে, জ্ঞানালোকে
আপন কর্তব্য করো।
সুপ্রিয়।                          তব পথগামী
চিরদিন এ অধীন। রেখে দিব আমি
তব বাক্য শিরে করি। যুক্তিসূচি-‘পরে
সংসার-কর্তব্যভার কভু নাই ধরে!

উগ্রসেনের প্রবেশ

উগ্রসেন।     কার্য সিদ্ধ ক্ষেমংকর! হয়েছে চঞ্চল
ব্রাহ্মণের বাক্য শুনে রাজসৈন্যদল,
আজি বাঁধ ভাঙে-ভাঙে।
সোমাচার্য।                         সৈন্যদল!
চারুদত্ত।                                   সে কী!
এ কী কাণ্ড, ক্রমে এ যে বিপরীত দেখি
বিদ্রোহের মতো।
সোমাচার্য।                  এতদূর ভালো নয়,
ক্ষেমংকর
চারুদত্ত।               ধর্মবলে ব্রাহ্মণের জয়,
বাহুবলে নহে। যজ্ঞযাগে সিদ্ধি হবে ;
দ্বিগুণ উৎসাহভরে এস, বন্ধু, সবে
করি মন্ত্রপাঠ। শুদ্ধাচারে যোগাসনে
ব্রহ্মতেজ করি উপার্জন। একমনে
পূজি ইষ্টদেবে।
সোমাচার্য।                  তুমি কোথা আছ দেবী,
সিদ্ধিদাত্রী জগদ্ধাত্রী! তব পদ সেবি
ব্যর্থকাম কভু নাহি হবে ভক্তজন।
তুমি কর নাস্তিকের দর্পসংহরণ
সশরীরে– প্রত্যক্ষ দেখায়ে দাও আজি
বিশ্বাসের বল। সংহারের বেশে সাজি
এখনি দাঁড়াও সর্বসম্মুখেতে আসি
মুক্তকেশে খড়গহস্তে, অট্টহাস হাসি
পাষণ্ডদলনী। এস সবে একপ্রাণ
ভক্তিভরে সমস্বরে করহ আহ্বান
প্রলয়শক্তিরে।

সমস্বরে

ব্রাহ্মণগণ।                 সবে করজোড়ে যাচি-
আয় মা প্রলয়ংকরী।

মালিনীর প্রবেশ

মালিনী।                          আমি আসিয়াছি।

ক্ষেমংকর ও সুপ্রিয় ব্যতীত

সমস্ত ব্রাহ্মণের ভুমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম

সোমাচার্য।  এ কী দেবী, এ কী বেশ!  দয়াময়ী এ যে
এসেছেন ম্লানবস্ত্রে নরকন্যা সেজে।
এ কী অপরূপ রূপ! এ কী স্নেহজ্যোতি
নেত্রযুগে! এ তো নহে সংহারমুরতি।
কোথা হতে এলে মাতঃ? কী ভাবিয়া মনে,
কী করিতে কাজ?
মালিনী।                       আসিয়াছি নির্বাসনে,
তোমরা ডেকেছ বলে ওগো বিপ্রগণ।
সোমাচার্য।  নির্বাসন। স্বর্গ হতে দেবনির্বাসন
ভক্তের আহ্বানে!  
চারুদত্ত।                      হায়, কী করিব মাতঃ,
তোমার সহায় বিনা আর রহে না তো
এ ভ্রষ্ট সংসার।
মালিনী।                  আমি ফিরিব না আর।
জানিতাম, জানিতাম তোমাদের দ্বার
মুক্ত আছে মোর তরে। আমারি লাগিয়া
আছ বসে। তাই আমি উঠেছি জাগিয়া
সুখসম্পদের মাঝে, তোমরা যখন
সবে মিলি যাচিলে আমার নির্বাসন
রাজদ্বারে।
ক্ষেমংকর।            রাজকন্যা?
সকলে।                          রাজার দুহিতা!
সুপ্রিয়।       ধন্য ধন্য!
মালিনী।                আমারে করেছ নির্বাসিতা?
তাই আজি মোর গৃহ তোমাদের ঘরে।
তবু এক বার মোরে বলো সত্য করে
সত্যই কি আছে কোনো প্রয়োজন মোরে,
চাহ কি আমায়? সত্যই কি নাম ধরে
বাহির-সংসার হতে ডেকেছিলে সবে
আপন নির্জন ঘরে বসে ছিনু যবে
সমস্ত জগৎ হতে অতিশয় দূরে
শতভিত্তি-অন্তরালে রাজ-অন্তঃপুরে
একাকী বালিকা। তবে সে তো স্বপ্ন নয়!
তাই তো কাঁদিয়াছিল আমার হৃদয়
না বুঝিয়া কিছু!
চারুদত্ত।                    এস,এস মা জননী,
শতচিত্তশতদলে দাঁড়াও অমনি
করুণামাখানো মুখে।
মালিনী।                          আসিয়াছি আজ–
প্রথমে শিখাও মোরে কী করিব কাজ
তোমাদের। জন্ম লভিয়াছি রাজকুলে,
রাজকন্যা আমি– কখনো গবাক্ষ খুলে
চাহি নি বাহিরে, দেখি নাই এ সংসার
বৃহৎ বিপুল– কোথায় কী ব্যথা তার
জানি না তো কিছু। শুনিয়াছি দুঃখময়
বসুন্ধরা, সে দুঃখের লব পরিচয়
তোমাদের সাথে।
দেবদত্ত।                     ভাসি নয়নের জলে,
মা, তোমার কথা শুনে।
সকলে।                            আমরা সকলে
পাষণ্ড পামর।
মালিনী।                 আজি মোর মনে হয়
অমৃতের পাত্র যেন আমার হৃদয়–
যেন সে মিটাতে পারে এ বিশ্বের ক্ষুধা,
যেন সে ঢালিতে পারে সান্ত্বনার সুধা
যত দুঃখ যেথা আছে সকলের ‘পরে
অনন্ত প্রবাহে। দেখো দেখো নীলাম্বরে
মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ পেয়েছে প্রকাশ।
কী বৃহৎ লোকালয়, কী শান্ত আকাশ–
এক জ্যোৎস্না বিস্তারিয়া সমস্ত জগৎ
কে নিল কুড়ায়ে বক্ষে– ওই রাজপথ,
ওই গৃহশ্রেণী, ওই উদার মন্দির–
স্তব্ধচ্ছায়া তরুরাজি–দূরে নদীতীর,
বাজিছে পূজার ঘন্টা– আশ্চর্য পুলকে
পুরিছে আমার অঙ্গ, জল আসে চোখে।
কোথা হতে এনু আমি, আজি জ্যোৎস্নালোকে
তোমাদের এ বিস্তীর্ণ সর্বজনলোকে।
চারুদত্ত।    তুমি বিশ্বদেবী।
সোমাচার্য।                  ধিক্‌ পাপ-রসনায়!  
শত ভাগে ফাটিয়া গেল না বেদনায়–
চাহিল তোমার নির্বাসন!  
দেবদত্ত।                            চলো সবে
বিপ্রগণ, জননীরে জয়জয়রবে
রেখে আসি রাজগৃহে।
সমবেত কণ্ঠে।                           জয় জননীর!
জয় মা লক্ষ্ণীর! জয় করুণাময়ীর!

মালিনীকে ঘিরিয়া লইয়া সুপ্রিয় ও ক্ষেমংকর ব্যতীত সকলের প্রস্থান

ক্ষেমংকর।  দূর হোক, মোহ দূর হোক! কোথা যাও
হে সুপ্রিয়?
সুপ্রিয়।                ছেড়ে দাও, মোরে ছেড়ে দাও।
ক্ষেমংকর।  স্থির হও। তুমিও কি, বন্ধু, অন্ধভাবে
জনস্রোতে সর্বসাথে ভেসে চলে যাবে?
সুপ্রিয়।      এ কি স্বপ্ন ক্ষেমংকর?
ক্ষেমংকর।                          স্বপ্নে মগ্ন ছিলে
এতক্ষণ– এখন সবলে চক্ষু মেলে
জেগে চেয়ে দেখো।
সুপ্রিয়।                         মিথ্যা তব স্বর্গধাম,
মিথ্যা দেবদেবী, ক্ষেমংকর– ভ্রমিলাম
বৃথা এ সংসারে এতকাল। পাই নাই
কোনো তৃপ্তি কোনো শাস্ত্রে, অন্তর সদাই
কেঁদেছে সংশয়ে। আজ আমি লভিয়াছি
ধর্ম মোর, হৃদয়ের বড়ো কাছাকাছি।
সবার দেবতা তব, শাস্ত্রের দেবতা–
আমার দেবতা নহে। প্রাণ তার কোথা,
আমার অন্তরমাঝে কই কহে কথা,
কী প্রশ্নের দেয় সে উত্তর– কী ব্যথার
দেয় সে সান্ত্বনা! আজি তুমি কে আমার
জীবনতরণী-‘পরে রাখিলে চরণ
সমস্ত জড়তা তার করিয়া হরণ
একি গতি দিলে তারে!  এতদিন পরে
এ মর্তধরণীমাঝে মানবের ঘরে
পেয়েছি দেবতা মোর।
ক্ষেমংকর।                        হায় হায় সখে,
আপন হৃদয় যবে ভুলায় কুহকে
আপনারে, বড়ো ভয়ংকর সে সময়–
শাস্ত্র হয় ইচ্ছা আপনার, ধর্ম হয়
আপন কল্পনা। এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশি
যে সৌন্দর্যে দিকে দিকে রহিয়াছে মিশি
ইহাই কি চিরস্থায়ী? কাল প্রাতঃকালে
শতলক্ষ ক্ষুধাগুলা শতকর্মজালে
ঘিরিবে না ভবসিন্ধু– মহাকোলাহলে
হবে না কঠিন রণ বিশ্বরণস্থলে?
তখন এ জ্যোৎস্নাসুপ্তি স্বপ্নমায়া বলে
মনে হবে, অতি ক্ষীণ, অতি ছায়াময়।
যে সৌন্দর্যমোহ তব ঘিরেছে হৃদয়
সেও সেই জোৎস্নাসম– ধর্ম বল তারে?
এক বার চক্ষু মেলি চাও চারি ধারে
কত দুঃখ, কত দৈন্য, বিকট নিরাশা!
ওই ধর্মে মিটাইবে মধ্যাহ্নপিপাসা
তৃষ্ঞাতুর জগতের? সংসারের মাঝে
ওই তব ক্ষীণ মোহ লাগিবে কী কাজে?
খররৌদ্রে দাঁড়াইয়া রণরঙ্গভূমে
তখনো কি মগ্ন হয়ে রবে এই ঘুমে,
ভুলে রবে স্বপ্নধর্মে– আর কিছু নাহি?
নহে সখে!
সুপ্রিয়।                 নহে নহে।
ক্ষেমংকর।                       তবে দেখো চাহি
সম্মুখে তোমার। বন্ধু, আর রক্ষা নাই।
এবার লাগিল অগ্নি। পুড়ে হবে ছাই
পুরাতন অট্টালিকা, উন্নত উদার,
সমস্ত ভারতখণ্ড কক্ষে কক্ষে যার
হয়েছে মানুষ।– এখনো যে দু নয়নে
স্বপ্ন লেগে আছে তব!
খাণ্ডবদহনে
সমস্ত বিহঙ্গকুল গগনে গগনে
উড়িয়া ফিরিয়াছিল করুণ ক্রন্দনে
স্বর্গ সমাচ্ছন্ন করি, বক্ষে রক্ষণীয়
অক্ষম শাবকগণে স্মরি। হে সুপ্রিয়,
সেইমতো উদ্‌বেগ-অধীর পিতৃকুল
নানা স্বর্গ হতে আসি আশঙ্কাব্যাকুল
ফিরিছেন ্‌শূন্যে শূন্যে আর্ত কলস্বরে
আসন্নসংকটাতুর ভারতের ‘পরে।–
তবু স্বপ্নে মগ্ন সখে!
দেখো মনে স্মরি,
আর্যধর্মমহাদুর্গ এ তীর্থনগরী
পুণ্য কাশী। দ্বারে হেথা কে আছে প্রহরী?
সে কি আজ স্বপ্নে রবে কর্তব্য পাসরি
শত্রু যবে সমাগত, রাত্রি অন্ধকার,
মিত্র যবে গৃহদ্রোহী, পৌর পরিবার
নিশ্চেতন। হে সুপ্রিয়, তুলে চাও আঁখি।
কথা কও। বলো তুমি, আমারে একাকী
ফেলিয়া কি চলে যাবে মায়ার পশ্চাতে
বিশ্বব্যাপী এ দুর্যোগে, প্রলয়ের রাতে?
সুপ্রিয়।      কভু নহে, কভু নহে। নিদ্রাহীন চোখে
দাঁড়াইব পার্শ্বে তব।
ক্ষেমংকর।                      শুন তবে, সখে,
আমি চলিলাম।
সুপ্রিয়।                    কোথা যাবে?
ক্ষেমংকর।                              দেশান্তরে।
হেথা কোনো আশা নাই আর। ঘরে পরে
ব্যাপ্ত হয়ে গেছে বহ্নি। বাহির হইতে
রক্তস্রোত মুক্ত করি হবে নিবাইতে।
যাই, সৈন্য আনি।
সুপ্রিয়।                        হেথাকার সৈন্যগণ
রয়েছে প্রস্তুত।
ক্ষেমংকর।                 মিথ্যা আশা। এতক্ষণ
মুগ্ধ পঙ্গপালসম তারাও সকলে
দগ্ধপক্ষ পড়িয়াছে সর্ব দলেবলে
হুতাশনে। জয়ধ্বনি ওই শুনা যায়।
উন্মত্তা নগরী আজি ধর্মের চিতায়
জ্বালায় উৎসবদীপ।
সুপ্রিয়।                        যদি যাবে ভাই,
প্রবাসে কঠিন পণে, আমি সঙ্গে যাই।
ক্ষেমংকর।  তুমি কোথা যাবে বন্ধু? তুমি হেথা থেকো
সদা সাবধানে; সকল সংবাদ রেখো
রাজভবনের। লিখো পত্র। দেখো সখে,
তুমিও ভুলো না শেষে নূতন কুহকে,
ছেড়ো না আমায়। মনে রেখো সর্বক্ষণ
প্রবাসী বন্ধুরে।
সুপ্রিয়।                    সখে, কুহক নূতন,
আমি তো নূতন নহি। তুমি পুরাতন
আর আমি পুরাতন।
ক্ষেমংকর।                       দাও আলিঙ্গন।
সুপ্রিয়।      প্রথম বিচ্ছেদ আজি। ছিনু চিরদিন
এক সাথে। বক্ষে বক্ষে বিরহবিহীন
চলেছিনু দোঁহে–আজ তুমি কোথা যাবে,
আমি কোথা রব।
ক্ষেমংকর।                   আবার ফিরিয়া পাবে
বন্ধুরে তোমার। শুধু মনে ভয় হয়
আজি বিপ্লবের দিন বড়ো দুঃসময়–
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ধ্রুব বন্ধচয়,
ভ্রাতারে আঘাত করে ভ্রাতা, বন্ধু হয়
বন্ধুর বিরোধী। বাহিরিনু অন্ধকারে,
অন্ধকারে ফিরিয়া আসিব গৃহদ্বারে–
দেখিব কি দীপ জ্বালি বসি আছ ঘরে
বন্ধু মোর? সেই আশা রহিল অন্তরে।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *