কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ। প্রথম সন্ধ্যায় ম্লান চাঁদ দেখা দিল গগনের কোণে। ক্ষুদ্র নৌকা থরথরে চলিয়াছে পালভরে কালস্রোতে যথা ভেসে যায় অলস ভাবনাখানি আধোজাগা মনে। এক পারে ভাঙা তীর ফেলিয়াছে ছায়া, অন্য পারে ঢালু তট শুভ্র বালুকায় মিশে যায় চন্দ্রালোকে— ভেদ নাহি পড়ে চোখে— বৈশাখের গঙ্গা কৃশকায়া তীরতলে ধীরগতি অলস লীলায়। স্বদেশ পুরব হতে বায়ু বহে আসে দূর স্বজনের যেন বিরহের শ্বাস। জাগ্রত আঁখির আগে কখনো বা চাঁদ জাগে কখনো বা প্রিয়মুখ ভাসে— আধেক উলস প্রাণ আধেক উদাস। ঘনচ্ছায়া আম্রকুঞ্জ উত্তরের তীরে— যেন তারা সত্য নহে, স্মৃতি-উপবন। তীর, তরু, গৃহ, পথ, জ্যোৎস্নাপটে চিত্রবৎ— পড়িয়াছে নীলাকাশ নীরে দূর মায়া-জগতের ছায়ার মতন। স্বপ্নাকুল আঁখি মুদি ভাবিতেছি মনে রাজহংস ভেসে যায় অপার আকাশে দীর্ঘ শুভ্র পাখা খুলি চন্দ্রালোক পানে তুলি— পৃষ্ঠে আমি কোমল শয়নে, সুখের মরণসম ঘুমঘোর আসে। যেন রে প্রহর নাই, নাইক প্রহরী, এ যেন রে দিবাহারা অনন্ত্ নিশীথ। নিখিল নির্জন, স্তব্ধ, শুধু শুনি জলশব্দ কলকল-কল্লোল-লহরী— নিদ্রাপারাবার যেন স্বপ্ন-চঞ্চলিত। কত যুগ চলে যায় নাহি পাই দিশা— বিশ্ব নিবু-নিবু, যেন দীপ তৈলহীন। গ্রাসিয়া আকাশকায়া ক্রমে পড়ে মহাছায়া, নতশিরে বিশ্বব্যাপী নিশা গনিতেছে মৃত্যুপল এক দুই তিন। চন্দ্র শীর্ণতর হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়, কলধ্বনি ক্ষীণ হয়ে মৌন হয়ে আসে। প্রেতনয়নের মতো নির্নিমেষ তারা যত সবে মিলে মোর পানে চায়, একা আমি জনপ্রাণী অখণ্ড আকাশে। চির যুগরাত্রি ধরে শতকোটি তারা পরে পরে নিবে গেল গগন-মাঝার। প্রাণপণে চক্ষু চাহি আঁখিতে আলোক নাহি, বিঁধিতে পারে না আঁখিতারা তুষারকঠিন মৃত্যুহিম অন্ধকার। অসাড় বিহঙ্গ-পাখা পড়িল ঝুলিয়া, লুটায় সুদীর্ঘ গ্রীবা— নামিল মরাল। ধরিয়া অযুত অব্দ হুহু পতনের শব্দ কর্ণরন্ধ্রে উঠে আকুলিয়া, দ্বিধা হয়ে ভেঙে যায় নিশীথ করাল। সহসা এ জীবনের সমুদয় স্মৃতি ক্ষণেক জাগ্রত হয়ে নিমেষে চকিতে আমারে ছাড়িয়া দূরে পড়ে গেল ভেঙেচুরে, পিছে পিছে আমি ধাই নিতি— একটি কণাও আর পাই না লখিতে। কোথাও রাখিতে নারি দেহ আপনার, সর্বাঙ্গ অবশ ক্লান্ত নিজ লৌহভারে। কাতরে ডাকিতে চাহি, শ্বাস নাহি, স্বর নাহি, কণ্ঠেতে চেপেছে অন্ধকার— বিশ্বের প্রলয় একা আমার মাঝারে। দীর্ঘ তীক্ষ্ম হই ক্রমে তীব্র গতিবলে ব্যগ্রগামী ঝটিকার আর্তস্বরসম, সূক্ষ্ম বাণ সূচিমুখ অনন্ত কালের বুক বিদীর্ণ করিয়া যেন চলে— রেখা হয়ে মিশে আসে দেহমন মম। ক্রমে মিলাইয়া গেল সময়ের সীমা, অনন্তে মুহূর্তে কিছু ভেদ নাহি আর। ব্যাপ্তিহারা শূন্যসিন্ধু শুধু যেন এক বিন্দু গাঢ়তম অন্তিম কালিমা— আমারে গ্রাসিল সেই বিন্দু-পারাবার। অন্ধকারহীন হয়ে গেল অন্ধকার। ‘আমি’ ব’লে কেহ নাই, তবু যেন আছে। অচৈতন্যতলে অন্ধ চৈতন্য হইল বন্ধ, রহিল প্রতিক্ষা করি কার মৃত হয়ে প্রাণ যেন চিরকাল বাঁচে। নয়ন মেলিনু, সেই বহিছে জাহ্নবী— পশ্চিমে গৃহের মুখে চলেছে তরণী। তীরে কুটিরের তলে স্তিমিত প্রদীপ জ্বলে, শূন্যে চাঁদ সুধামুখচ্ছবি। সুপ্ত জীব কোলে লয়ে জাগ্রত ধরণী।
পূর্ববর্তী:
« ভৈরবী গান
« ভৈরবী গান
পরবর্তী:
মানসিক অভিসার »
মানসিক অভিসার »
Leave a Reply