কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন ইমদাদ সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। তাঁর সেই স্বপ্ন চূর্ণীভূত হলো ভাষার ওপর পাকিস্তানিদের হামলায়। ভাষার ওপর হামলার অর্থই হচ্ছে সংস্কৃতির ওপর হামলা। বাঙালিকে পঙ্গু করে রাখার সুদূরপ্রসারী নীল-নকশা। ইমদাদ সেটা অনুধাবন করেছিলেন। সেই ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর এই উপলব্ধি তাঁকে উজ্জীবিত করেছিল এই ভূখণ্ডের জনগণকে সংস্কৃতিসচেতন করার বাসনায়। ভাষা আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। আমাদেরও জড়িয়ে নিলেন সঙ্গে।
আর্ট স্কুলে ইমদাদ আমার সহপাঠী ছিলেন। দুই বছর প্রাথমিক কোর্স শেষ করার পর আমি বেছে নিলাম ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং। ইমদাদ নিলেন গ্রাফিক ডিজাইন। গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা অনেক সহজ এবং তাতে জনগণকে সচেতন করে তোলার সুবিধা পাওয়া যাবে ষোলোআনা। হয়তো এ ধারণার বশবর্তী হয়েই তাঁর ওই বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন। অনুমান আমার মিথ্যা নয় যখন দেখেছি অন্যের প্রয়োজনের দাবি ইমদাদ অকাতরে মেটাচ্ছেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে। সেই থেকে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি শহীদ দিবস হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শহীদ স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ছবির প্রদর্শনী ও অসংখ্য সংকলনের প্রকাশনা ছিল অবধারিত। ইমদাদ অন্তর দিয়ে এসব কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতেন। সংকলনের অনেক অর্থবহ সুদৃশ্য প্রচ্ছদ ইমদাদের হাতে সৃজিত হয়েছে সেই সঙ্গে আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছি। স্কুলজীবনে সে সময়ে আমাদের সাদাসিধে চলাফেরা, ছবি আঁকা, আড্ডায় ইমদাদের সান্নিধ্যে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তাঁর অনাবিল হাস্যরসে। আমরা সতীর্থ ছিলাম রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর, হুমায়ুন কাদির, আখতারুজ্জামান, আলী রেজা, জুনাবুল ইসলাম প্রমুখ।
এর মধ্যে সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন রশীদ চৌধুরী। দুপুরের টিফিন কীভাবে রশিদকে পটিয়ে পটিয়ে সারা যায়, আমাদের চেষ্টা ছিল নিরন্তর। ইমদাদ কীভাবে যেন এ কাজে সর্বদাই সফলকাম হতেন। আমাদের আগের ব্যাচের মানে আর্ট স্কুলের প্রথম ব্যাচের সবার সঙ্গেই ইমদাদের অন্তরঙ্গতা ছিল। আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, বিজন চৌধুরী, রহমান ভূঁইয়া, শামসুল কাদির, লোকনাথ ধর—সবার সঙ্গেই ইমদাদের সমান সখ্য। শিক্ষকদের মধ্যে কামরুল হাসান, তাঁর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ইমদাদের। গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের প্রধান ছিলেন কামরুল হাসান। আর্ট স্কুলের শিক্ষা সমাপ্তির পর গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজনে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গেই কমার্শিয়াল কাজে জড়িয়ে যাওয়া। বিজন চৌধুরী, আবদুস সবুর ও কামরুল ভাই মিলে ভিবজিওর নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলা হলো কমার্শিয়াল কাজের জন্য। ইমদাদও ছিলেন সঙ্গে। আর ছিলেন সরদার জয়েন উদ্দীন কথাসাহিত্যিক, কামরুল ভাইয়ের বন্ধু। তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল কাজ সংগ্রহের জন্য। সরদার ভাই তখন সংবাদ পত্রিকার বিজ্ঞাপনকর্তা। শিল্পসৃজনের প্রতি ইমদাদের যতটা না মনোযোগ, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ওই সময়ের সমাজে সংস্কৃতিচর্চার ঘাটতির প্রতি। সঙ্গে পেয়েছিলেন আরেক চিন্তাবিদ সংগীতপ্রেমী ওয়াহিদুল হককে। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে দুজনের অন্তরঙ্গতা তাঁদের স্বপ্নকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করেছিল। দুজনেই বুঝেছিলেন সমাজে সংস্কৃতিচর্চার পরিধি বাড়াতে হলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। শিল্পীদের একমঞ্চে আনার জন্য তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হলো চারুশিল্পী সংসদ। কামরুল হাসানকে সভাপতি করে তাঁর ভিত্তিকে শক্ত করার জন্য নিজে দায়িত্ব নিলেন সম্পাদকের। বাংলাদেশের সব শিল্পী হলেন এর সদস্য। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চারুশিল্পীদের সে সময়ের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবজনক। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের চারুশিল্পীদের অবদান অনস্বীকার্য।
ওয়াহিদুল হক অকৃত্রিম বন্ধু ইমদাদের। ইমদাদও ছিলেন সংগীতপ্রেমী। তাঁর সংগ্রহে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের উল্লেখযোগ্য রেকর্ড। সে সময় খুব সম্ভব রিগ্যাল রেকর্ডস, ৭৮ আরপিএস চেয়ে বেশ বড় তাতে ধ্রুপদি সংগীত ধারণ করা হতো। ইমদাদের প্রিয় ছিল আবদুল করিম খাঁ সাহেবের ঠুমরী, বড়ে গোলাম আলী, ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের কণ্ঠ। মাঝেমধ্যে গুন গুন করত বড়ে গোলাম আলীর ‘আয়ে না বালম’ নয়তো ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের ‘ঝন ঝন পায়েল বাজে’। আমাকেও সে রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে। এখানে একটা তথ্য খুব উল্লেখযোগ্য। ইমদাদ খুব সুন্দর প্যারোডি তৈরি করতে পারতেন যেকোনো গানের। আমাদের শোনাতেন। আমরা হেসে কুটিপাটি হতাম।
বাঙালি মুসলমান সমাজে সংগীতের প্রচলন নেই। মানে জীবনে আনন্দও নেই এটা প্রতীয়মান হয়েছিল দুই বন্ধুর মনোজগতে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের দুজনেরই ধ্রুবতারা। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছিল যখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের গান বেতারে প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬১ সালে পালিত হলো রবীন্দ্র জন্মশততম বার্ষিকী। তার পরই তোড়জোড় শুরু হলো একটি সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠালগ্নে ইমদাদের সম্পৃক্ততা স্মরণযোগ্য। রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গেও ইমদাদ জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশের মফস্বল শহরে সংগীত সম্মেলনে ওয়াহিদুল হকের সঙ্গী হতেন ইমদাদ।
ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনেও ইমদাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ইমদাদ। আমার চলচ্চিত্রপ্রীতির খবর ইমদাদ ও ওয়াহিদুল হক দুজনেই রাখতেন। আমাকেও টেনে নিয়েছিলেন সোসাইটিতে।
মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে চাকরি নিয়েছিলেন ইমদাদ। সঙ্গে ছিল নিতুন কুন্ডু। তথ্যকেন্দ্র তখন ছিল তোপখানা রোডের মোড়ে, প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে। অনেক সুন্দর সুন্দর উইন্ডো ডিসপ্লে হতো সেখানে কোনো অনুষ্ঠানের বা তথ্যকেন্দ্র প্রকাশিত মার্কিন ধ্রুপদি সাহিত্যের কোনো বইয়ের। সে সময় এটা নতুন ছিল ঢাকায়। ইমদাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা সব সময় বিরাজ করত। হুটহাট তুলি চালনা তাঁর স্বভাবজাত।
তুলি না ধুয়েই রঙের কৌটায় তুলি ডোবানো ছিল তাঁর সহজাত। যার জন্য কোনটা কোন রঙের কৌটা, বিশেষ করে সাদা রং বোঝাই যেত না। নিতুন যার জন্য রঙের সেট আলাদা করে দিতেন ইমদাদকে।
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের নকশাকেন্দ্রেও চাকরিতে ছিলেন ইমদাদ। কামরুল হাসানের অধীনে আমিও তাঁর সহকর্মী ছিলাম। গ্রামীণ শিল্পের প্রতি অনুরাগ ইমদাদের আগে থেকেই ছিল। নকশাকেন্দ্রে এসে লোকশিল্পের প্রতি ভালোবাসা আরও প্রগাঢ় হলো। কার্যব্যপদেশে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন কামরুল হাসানের সঙ্গে। রূপগঞ্জের জামদানিপাড়া, ফরিদপুরের লক্ষ্মীসরার কারিগর, কিশোরগঞ্জের টেপাপুতুলের আস্তানা, বাবুরহাটের তাঁতের শাড়ি, রাজশাহীর সখের হাঁড়ির শিল্পীর সঙ্গে মোলাকাত ইমদাদের দেশপ্রেমকে আরও গভীর করে তুলেছিল। এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তখন আমরা ডিজাইন সেন্টারে কর্মরত। ইমদাদ এক দিন আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর গ্রামের বাড়ি রুহিতপুরে। গ্রাম্যমেলা দেখতে। মেলার বিশেষত্ব হচ্ছে, মেলাটি বসে নৌকার ওপরে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই নৌকায়। বিকিকিনি চলছে নৌকায় ঘুরে ঘুরে। এমন অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। মেলায় সব রকমের পণ্য রয়েছে। মুড়িমুড়কি থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, শাড়ি, লুঙ্গি সব। নৌকা করে গেছি বুড়িগঙ্গা দিয়ে একটা ছোট খালে ঢুকেছি। খুব সম্ভব সেটা শুভাঢ্যার খাল। পরিষ্কার টলটলে বুড়িগঙ্গার পানি। নদীর তলদেশ অবধি দেখা যায়। সেই বুড়িগঙ্গা আজ মৃতপ্রায়।
এই ঐতিহ্য ইমদাদকে আরও গর্বিত করে তুলেছিল। জনসমক্ষে এই ঐতিহ্যকে তুলে আনার জন্য পরবর্তী সময়ে ইমদাদের ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলার আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে কাজে লাগিয়ে আমজনতাকে ঐতিহ্যের প্রতি মুখ ফেরানোর কাজে ইমদাদ ছিলেন অগ্রগণ্য। বলাই বাহুল্য, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের লোগোটি ইমদাদের সৃষ্টি। যেমনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগো। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনেক নাটকের খুব দৃষ্টিনন্দন সেট তৈরি করেছিলেন ইমদাদ।
ইমদাদের আর একটি স্মরণীয় অবদান শহীদ মিনারের পেছনে রক্তিম সূর্যের পরিকল্পনা। ইতিপূর্বে শহীদ মিনারে রক্তিম সূর্যের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল বিভিন্ন দলের স্লোগানসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানোর প্রতিযোগিতা। মিনারটিও দেখতে আকর্ষণহীন মনে হতো। ইমদাদের পরিকল্পনামাফিক সূর্যের উদয় মিনারকে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমদাদের পদচারণ তাঁর স্বপ্নপূরণের একেকটি অধ্যায়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সংস্কৃতিই পারে চেতনাকে উজ্জীবিত করতে। রাজনীতিকেও তিনি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন সংস্কৃতির মাধ্যমে। রাজনীতি যেন সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে না পারে, সে চেতনাও তাঁর ছিল। রাজনীতিবিদ অনেকেই তাঁর বন্ধু ছিলেন। তাঁদের সহায়তায় চেষ্টা করেছেন এগোবার। কিছুটা হলেও আমরা এগিয়েছি। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর মন্ত্রণা ইমদাদ আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখন দায়িত্ব আমাদের। লক্ষ্য পূরণের সংগ্রাম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। তবেই ইমদাদের আত্মা শান্তি লাভ করবে। ইমদাদের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা।
ইমদাদ হোসেন, (২১ নভেম্বর ১৯২৬—১৩ নভেম্বর ২০১১)
প্রতিকৃতি: নিসার হোসেন (শিল্পী ইমদাদ হোসেনের পুত্র)
কাইয়ুম চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০১১
Leave a Reply