সমকালীন স্বদেশ ঘরানার আখ্যান
কামালউদ্দিন কবির
বাংলা নাট্যচর্চার এক স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট বাক্বদল লক্ষ করি ১৯৯০-৯১-এর দিকে। এই নতুন নাট্য-অভিজ্ঞানের মুখ্য রূপকার সেলিম আল দীন। কথানাট্য আঙ্গিক নামে চাকা (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১) প্রকাশিত হলে চলতি নাট্য-ধারণায় বড় এক তোলপাড় শুরু হয়। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক অভ্যস্ত মন নতুন নাট্য চাকার চলন সহজে মেনে নিতে পারেনি। সব নতুনের বেলায়, বিশেষত শিল্পাঙ্গনে, বোধ করি এ এক সাধারণ অভিজ্ঞতা। তবু শেষতক ভাগ্য আমাদের ভালো এই কারণে যে আপাত-বিরূপতা সত্ত্বেও সেলিম আল দীন একে একে উপস্থাপন করেছেন যৈবতী কন্যার মন (১৯৯২), হরগজ (১৯৯২), বনপাংশুল (১৯৯৭), প্রাচ্য (১৯৯৮), নিমজ্জন (২০০৪), স্বর্ণবোয়াল (২০০৭), ধাবমান (২০০৮) এবং সর্বশেষ পুত্র (২০০৮)। নিজস্ব নাট্যনন্দনসূত্রে এই রচনাগুলোর আঙ্গিক-নাম দেওয়া হয়েছে কখনো কথানাট্য, পাঁচালিনাট্য, কখনো আবার উপাখ্যান। পরিবেশন-বৈশিষ্ট্যের কারণে এসব থেকে নিয়ে একটা থোকনাম চালু হয়েছে বর্ণনাত্মক নাট্য। রচনা ও প্রয়োগ-স্বাতন্ত্র্যের কারণে সেলিম আল দীন প্রণীত ও প্রভাবপুষ্ট এই ধারার নাট্যকে এখন আমরা বলতে শুরু করেছি আখ্যাননাট্য। বলে রাখা ভালো, আঙ্গিকের এ ধরনের নামকরণ কিংবা শ্রেণীকরণ প্রধানত একাডেমিক প্রয়োজনেই চালু হয়েছে। সাধারণ চর্চার ক্ষেত্রে আঙ্গিক, রীতি, নাম, শিরোনাম ইত্যাদি মুখ্য হয়ে উঠলে মূল শিল্পকৃতির তাৎপর্য অনেকাংশেই অধরা থেকে যায় বলে মনে করি।
এ রকম একটি আখ্যাননাট্য রুবাইয়াৎ আহমেদ রচিত বর্ণদূত। বর্ণনা ও সংলাপের অদ্বৈত গ্রন্থনে ‘আধুনিক কালের উপন্যাস বা কথাসাহিত্যের ধাঁচে রচিত’ এ আখ্যানে বিবৃত হয়েছে স্বদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অনাচারের একটি বিশেষ অধ্যায়। ২০০১-এর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলপর্বে দেশের বিভিন্ন লোকালয়ে সংঘটিত খোলা সন্ত্রাসের আখ্যান বর্ণদূত।
আখ্যানের মূল বৃত্তের কেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত পাঠক-দর্শকের সামনে নিজের অধিকারবোধ নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে গৌরী দত্ত। আখ্যানের মধ্যে তার বসবাসের স্থানের নাম না থাকলেও বর্ণনা, কথা ও কবিতায় মগড়া ও সোমেশ্বরী নদী জড়িয়ে রেখেছে, এমন এক শহর ও আদিবাসী জনপদ মূর্ত হয়ে ওঠে। গৌরীর বালিকা-বৃত্তান্তসূত্রে কথক একে একে বয়ান করেন তাঁর বাবা এবং বাবার নিকট-বয়সী রহমানের কথা। সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িকতার শিকার বালক রহমান স্বজন হায়িয়ে আশ্রিত হয়েছিল গৌরীদের বাড়িতে। সেই থেকে দত্ত পরিবারের একজন হয়ে বেড়ে ওঠা রহমান দেশ-ইতিহাসের যত সব আলো-অন্ধকারে ডুবে গিয়ে একসময় ধীরে ধীরে বাউল হয়ে যায়; এবং একদিন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুলোকে যাত্রা করে। কথকের চকিত বর্ণনায় এভাবে উঠে আসে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ-না-লাগা সাম্প্রদায়িকতার শিকার এই মানুষগুলোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশ-ভূখণ্ডের নতুন রূপান্তর-পূর্বাপর একাত্তর পর্ব।
বর্ণনান্তরে বালিকা গৌরীর ঘোরলাগা বি্নয়ের মধ্য দিয়ে আমরা দেখা পাই ভাস্কর নিশাত চৌধুরীকে। রচয়িতা তাঁর ‘কথাপরম্পরা’য় জানান, ভাস্কর চরিত্রটির নেপথ্যে তাঁর ‘মানসপটে’ ছিল শিল্পী নভেরা আহমেদ। ভাস্কর নিশাতের অনেক কৃতির একটি হলো ‘আত্মপ্রতিকৃতি, কালিন্দী’ শীর্ষক ভাস্কর্য। এই কালিন্দীর দেখা আমরা এরই মধ্যে পেয়েছি সেলিম আল দীনের কথানাট্য যৈবতী কন্যার মন-এ। শহরের থিয়েটারকর্মী গৌরী যে মহড়াকক্ষে কালিন্দী হয়ে ওঠে, তার বিবরণ বর্ণদূত-এর কথক পেশ করেন এভাবেঃ ‘গৌরী তখন এক মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষের আঁকা নাট্যের কালিন্দী নাম চরিত্র ধারণ করে আছে।’ রুবাইয়াৎ তাঁর শিল্পগুরু সেলিম আল দীন রচিত ওই কথানাট্য থেকে দুটি চরিত্র-কালিন্দী ও আলালের কিছু বৃত্তান্ত নিজস্ব ঢঙে ব্যবহার করেছেন। ভাস্কর নিশাত চৌধুরীও কালিন্দীর মতো শিল্প, প্রেম ও বিশ্বাসে ব্যর্থ ভেবে আত্মহত্যা করে। এই দুই শিল্পীর শেষ পরিণতির বিপরীতে দাঁড়ায় বর্ণদূত-এর গৌরী। বহমান বর্ণনায় তখন দেশ-কালের নিকট-অতীতের শাসকবদলপর্ব। আখ্যানকার এখানে শ্বেতরাজা আর ধূসররাজার রূপকে চিত্রায়িত করেন জনজীবনে নেমে আসা আরেক বীভৎসতার ইতিহাস। অনিবার্যভাবে ভিটামাটি ছেড়ে পালাতে উদ্যোগ নেয় গৌরীর মা-বাবা। কিন্তু গৌরী সেখানে গভীর প্রত্যয় নিয়ে উচ্চারণ করেঃ ‘যা হয় হবে, আমার সৃষ্টি চৌদিকের এ অধিকার ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।’ লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় গৌরী; তার পাশে এসে দাঁড়ায় পাহাড়ি জনপদ থেকে উঠে আসা যুবক অবিনাশ। তিন পুরুষ আগে বিশ্বাসে যারা ছিল দেবতা তাতারারাবুগার অধীন, এখন তারা ক্রুশ ধারণ করে আছে গলায়। সমাজ-রাষ্ট্রের নানা নির্মমতার সাক্ষী আলোকচিত্রী অবিনাশ জগতের যাবতীয় বিভেদ-বিভক্তির অবসানকল্পে গৌরীর সহমর্মী হয়ে দাঁড়ায়।
বর্ণদূত-এর পাঠরূপে কোনো দৃশ্যবিভাজন নেই; আছে কেবল নানা পর্বে উপশিরোনাম। যেমন-মর্মসার, প্রাকমন্ত্র, যাত্রারম্ভ, স্বপ্নবন্দনা, আলোকিত হয় অন্ধকার, অন্তিম স্তোত্র ইত্যাদি। বর্ণাত্মক নাট্যশৈলীর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কথক কিংবা অভিনয়শিল্পী চরিত্রের ব্যাখ্যার সঙ্গে স্বীয় সংলাপের বহিভূêত অন্য চরিত্রের মনস্তত্ত্ব এবং বর্ণিত নিসর্গের আবহ, ঘটনা ও পরিবেশ বর্ণনা করেন। এ রীতির মঞ্চায়নে বর্ণনা ও সংলাপের প্রবাহ কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। বর্তমান আখ্যানে রুবাইয়াৎ বর্ণনা ও সংলাপের অন্তরঙ্গ সংস্থানে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। তবে আখ্যানটির প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাষা-শব্দ ইত্যাদির আপাত দুর্বল বিন্যাস মঞ্চায়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মীকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। বর্ণদূত-এর অন্তত প্রথমার্ধে কোনো কোনো শব্দ ও শব্দবন্ধ আখ্যান ও দর্শকের দূরত্বই বাড়াবে। ‘সময়ক্রোড়’, ‘মৃত্যুক্রীড়া’, ‘আমি ধাক্কার অভিঘাতে রাস্তায় পড়ে যাই’, ‘বিকেলোত্তরকালে পশ্চিমের জানলা গলে বাসন্তীরঙা যে রোদ···’ তার দু-একটি উদাহরণ। আখ্যানজুড়ে ‘অবয়ব’, ‘পুরান’ ইত্যাদি শব্দের বারংবার প্রয়োগ পাঠ বা পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটাতে পারে মনোযোগে।
২০০১ সালের আলোচ্য ঘটনাবলি আমাদের একটি চরম রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করে। বর্ণদূত পড়তে পড়তে রামপাল-রামশীল-মিরেরসরাইসহ দেশের বিভিন্ন জনপদের ঋতা-পূর্ণিমা-রাসমনি বাইনসহ অসংখ্য মুখ ভেসে ওঠে মনে। রুবাইয়াৎ আহমেদ বর্ণদূত লিখে ব্যক্তিগতভাবে একটা দায়িত্ব পালন করলেন। তাঁকে ধন্যবাদ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
পূর্ববর্তী:
« সংস্কৃতির রাজনীতি – অসীম সাহা
« সংস্কৃতির রাজনীতি – অসীম সাহা
পরবর্তী:
সমুদ্রের ডাক – হরিশংকর জলদাস »
সমুদ্রের ডাক – হরিশংকর জলদাস »
Leave a Reply