• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

নতুন পাগল – বিশ্বজিৎ চৌধুরী

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » নতুন পাগল – বিশ্বজিৎ চৌধুরী

নতুন পাগল
বিশ্বজিৎ চৌধুরী

গল্পটা আমার কাছ থেকে শুনুন; কারণ, আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি।
সুন্দর একটা নাম ছিল গ্রামের। আরশিছড়ি। গ্রামের পাশে যে খাল, তার পানি ছিল আয়নার মতো স্বচ্ছ, তাই আরশিছড়ি। এখন নামটা পাল্টে গেছে। খালে পানি কমে গেছে। পানিও ঘোলা। তবে নাম পরিবর্তনের এটাই কারণ নয়। গ্রামের মানুষের জীবিকার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন নাম হয়েছে ‘চোরাইয়ার টেক’। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান মিলে ত্রিশ-বত্রিশটা পরিবার। এসব পরিবারের শ খানেক পুরুষ সদস্যের প্রায় সবাই চোর। চোর, কিন্তু মানুষ ভালো। চুরি তাদের পেশা। চুরি করেও তারা গরিব। চোরাইয়ের টেকের মানুষকে দেখে হয়তো আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—চুরি করে মানুষ বড়লোক হয় না। কিন্তু হয় কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। এ নিয়ে তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে হয়। সেদিকে না যাওয়াই ভালো, তাতে মূল গল্পের স্রোত বাধা পাবে।
খালের পাড়ে প্রাচীন একটি অশ্বত্থগাছ অনেক দূর পর্যন্ত ছায়া বিস্তার করেছে। সেই গাছের নিচে সপ্তাহে এক দিন, শনিবার, একটি অদ্ভুত হাট বসে। চোরাই মালের হাট। কী পাওয়া যায় না সেখানে! কাপড়চোপড়, তৈজসপত্র, কানের দুল, হাতের চুড়ি, সোনার আংটি, জুতা, চামড়ার বড় ব্যাগ, ছোট পার্স, হাতঘড়ি, দেয়ালঘড়ি, শিশুর খেলনা থেকে অ্যালুমিনিয়ামের বদনা পর্যন্ত। তবে যত না পাওয়া যায়, তার চেয়ে প্রচার অনেক বেশি। সেই প্রচার শুনে সস্তায় দামি জিনিস কেনার লোভে এক বন্ধুর সঙ্গে প্রথমবার এখানে এসেছিলাম বছর দুয়েক আগে।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা শেষ করেও হল ছাড়িনি। ঠেলে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়ার উপায় নেই। বাড়ি থেকে টাকা আসে না। পরীক্ষা শেষ মানে ছেলের ওপর বিনিয়োগ শেষ। সেই বিনিয়োগের টাকা আদৌ উঠে আসবে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর সংশয়। নিজের পেনশনের টাকা আর স্ত্রীর স্কুলমাস্টারির বেতন (চাকরির মেয়াদ অবশিষ্ট আছে আরও দুই বছর) নিয়ে আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি আহমদুল হক। বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। কেননা, একমাত্র মেয়েকে নিরাপদে পার করলেও তাঁর আরেকটি পুত্রসন্তান এখনো কলেজছাত্র।
ভাবতে পারেন, চোরাইয়ের টেকের গল্পে আমার কথা আসছে কেন? আসছে, কারণ, ঘটনাচক্রে আমিও এ গল্পের একটি চরিত্র। প্রধান চরিত্র হতে পারতাম, কিন্তু নিয়তি আমার জন্য পার্শ্বচরিত্রই নির্ধারণ করেছেন।
দুটো মাত্র টিউশনির টাকায় আমার দিন চলছিল না। চলছিল না বলেই কম দামে চোরাই জিনিস কেনার লোভ আমাকে টেনে এনেছিল চোরাইয়ার টেকের শনিবারের হাটে। বলা ভালো, প্রচারের সঙ্গে বিস্তর গরমিল। হাটের মালপত্র দেখে আমি ও আমার বন্ধু যারপরনাই হতাশ। সাত-আট কিলোমিটার পথ বাসে, আরও প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে এসে এসব জিনিস দেখার বা কেনার কোনো মানে হয় না। আমরা এই লোকগুলোর রুচি ও সাহস দুটোরই অভাব সম্পর্কে একমত হলাম। ভালো জিনিস চুরি করার জন্য ওই দুটি গুণই লাগে। নিরুপায় হয়ে দু-একটি পুরোনো ও প্রায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে জীবনে আর কোনোদিন এমুখো হব না বলে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন নিয়তি আড়ালে হেসেছিলেন। বোধ করি, বিরাট-বিস্তৃত অশ্বত্থগাছের ডাল-পাতার আড়াল থেকে। শনিবারের হাটে নানা রকমের লোকের ভিড়। আমার মতো দূরদূরান্ত থেকে সস্তার লোভে ক্রেতা যেমন আসে, তেমনি আশপাশের এলাকা থেকেও আসে। কেউ আসে নিজেরই চুরি যাওয়া জিনিসের খোঁজে, পাওয়া গেলে কিনে নেবে বলে। মাঝেমধ্যে পুলিশ আসে, মুচকি মুচকি হাসে, এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে দেখে, কিন্তু ঝামেলা করে না কোনো। ঝামেলা না করার জন্য কিছু বন্দোবস্ত আছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, হাটের বিক্রেতারা প্রায় সবাই নারী। ঘরের পুরুষের চুরি করে আনা মালপত্তর বিক্রি করতে বসে তারা হাসিমুখে। ক্রেতাদের সঙ্গে দরদস্তুর, রদ্দিমালকে মূল্যবান প্রমাণের নানা কিসিমের কসরতকে উন্নত মানের সেলসম্যানশিপ বলা যেতে পারে। নিজের চুরি যাওয়া পণ্য শনাক্ত করে হঠাৎ কোনো ক্রেতা বচসা শুরু করলে তা সামাল দেওয়ার ব্যাপারে এদের দক্ষতা বিস্ময়কর।
এ দক্ষ বিক্রেতাদের ভিড়েও একজন আনাড়ি তরুণীকে চোখে পড়েছিল আমার। তার কাছ থেকে, বলা চলে দরকষাকষির ব্যাপারে ছাড় দিয়ে, আমি কিনেছিলাম একটি বিছানার চাদর। কিনেছিলাম, কারণ, চাতুর্যের ভিড়ে মেয়েটির আনাড়িপনা আমার মধ্যে করুণা জাগিয়েছিল। কিংবা হতে পারে এটি একটি অজুহাত মাত্র। কেননা, মেয়েটিকে দেখে আমি কথা বাড়ানোর মতো প্রয়োজনীয় ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অকপটে বলি, ইহজীবনে এত সুন্দর মুখ আমি আর কখনো দেখিনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে না, ফিল্ম-ম্যাগাজিন বা ফেসবুকেও না। কমদামি সুতির একটি সবুজ ডুরে শাড়ি আর লাল ব্লাউজ—দীর্ঘাঙ্গীর এমন বাঁকতোলা শরীর মেয়েদের জিমে টাঙানো পোস্টারেও কখনো দেখা যায়নি। দীর্ঘ কালো চুলের গোছা পেছন দিকে টেনে একটিমাত্র রাবারব্যান্ড দিয়ে আটকানো। মুখে কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নেই, শুধু দুই চোখের তীর ঘেঁষে কাজল টানা। বিশ্বাস করুন, রবীন্দ্রনাথের ‘বিধি ডাগর/আঁখি যদি দিয়েছিলে…’ ধরনের হাহাকারকে আদিখ্যেতা মনে হয় না আর। হাতে কয়েকটি বেমানান প্লাস্টিকের চুড়ি আর পায়ে এক জোড়া সরু নূপুর পরেছে। সোনালি ফরসা পায়ে রুপা রঙের নূপুর। কেন যে মনে হলো, এই মেয়েকেই আমি এতকাল খুঁজছি!
প্রেম সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। নিজের অনিবার্য সর্বনাশ সম্পর্কে ভেবে যখন আমি অতলে হারিয়ে যাচ্ছি, তখন পুরোনো খবরের কাগজে মুড়ে চাদরটি আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘আবার আসবেন।’ আমার যে আবার আসতে হবে সে তো আমি জানি। এর পর থেকে শনিবার এলে কেউ আমাকে শেকল দিয়েও বেঁধে রাখতে পারত না। চোরাইয়ের টেক গ্রামের অশ্বত্থগাছ, খালপারের হাট আমাকে বেদেনির বশীকরণ বাঁশির সুরে ফণা নামানো সাপের মতো টেনে আনত।
শুরুর দিকে শনিবার হাটের দিনে ছিল যাওয়া-আসা। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। আমার বাড়তি আগ্রহ-কৌতূহল দৃষ্টি এড়ায়নি ওর। দৃষ্টিতে চটুলতা নেই, বরং একটু প্রশ্রয়ের আভাস পাওয়া গেল। আমি দিন বদলালাম। হাটের দিনে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় ও ব্যস্ততার মধ্যে অকাজে ঘুরঘুর করার বিড়ম্বনা অনেক। বরং অন্য দিনগুলোতে গ্রামটি অনেক বেশি সুন্দর। দেখা হলো, কথা হলো আরশির সঙ্গে। আরশিছড়ি গ্রামের মেয়ের নাম আরশি। এত সুন্দর নামকরণের ভাবনা সোনা মিয়ার মাথায় কী করে এল কে জানে! আবার এমনও হতে পারে, অত ভাবাভাবির মধ্যে না গিয়ে হাতের কাছে আড়শিছড়িকে পাওয়া গেল বলে এই নাম। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সম্পর্কটা, আপনারা যাকে বলেন প্রেম, সে পর্যন্ত গড়াল। ভাবুন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করা যুবকের সঙ্গে চোরের মেয়ের প্রেম।
আরশি অবশ্য বলেছিল, ওর বাবা চুরি করে না, চাকরি করে; সে নিজে অল্প কিছু কমিশন পেয়ে অন্যদের চুরি করা মাল বেচে। কথাটা তখন বিশ্বাস হয়নি। পরে ওদের ঘরে গিয়ে বিশ্বাস হলো। সোনা মিয়া গ্রামের বাইরে গঞ্জের হাটে মুদি দোকানে কাজ করে। আগে চুরি করত। কিন্তু বেচারা বিপাকে পড়েছে ছেলেকে স্কুলে পড়াতে গিয়ে। এ গ্রামের ছেলেরা স্কুলে পড়ে না। সোনা মিয়া গ্রামের লোক হাসিয়ে ছেলেকে দিয়েছিল স্কুল পড়তে। খালেদা বেগমের পিতা—মানে সোনা মিয়ার শ্বশুর—প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মেয়ে চোরাইয়ার টেকের লোকের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল তাঁর মানসম্মান। সেটা পুনরুদ্ধারের ক্ষীণ বাসনা থেকেই ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন খালেদা বেগম। বুলবুল স্কুলে যায়। গ্রামের ছেলে-বুড়ো টিটকারি দেয়, স্কুলের সহপাঠী এমনকি শিক্ষকেরাও সুযোগমতো বিদ্রূপ করতে ছাড়ে না। একবার এক শিক্ষক তো কলিকালে শিক্ষকদের অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে চোরের ছেলেকেও পাঠদানে দুর্ভাগ্যের কথা তুলে ধরেছিলেন। এসব কথা বুলবুলের কাছেই শোনা। ছেলেটির মন শক্ত বলতে হবে; তবু স্কুলে যায়, নিয়মিত পাস করে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পৌঁছানোর পর সোনা মিয়া যখন ছেলেকে নিয়ে মোটামুটি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, তখনই একদিন বাবাকে তার পেশা ছাড়ার আবদার করেছিল বুলবুল। এক দিনে হয়নি, বাপের আমলের পেশা ছাড়তে নিজের সঙ্গে, পাড়া-প্রতিবেশির সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল সোনা মিয়ার। শেষতক যুদ্ধে সাফল্য এল, কিন্তু দারিদ্র্য বাড়ল সংসারে। এই গল্পের বাঁকবদল হয়েছিল আসলে সেখানেই।
আমি নিয়মিত চোরাইয়ার টেকে যাই আরশির জন্য। কিন্তু নিয়মিত যাওয়া-আসার একটা যুক্তি হিসেবে বুলবুলকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। ছেলেটা মেধাবী, পড়াশোনায় মন আছে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে হিন্দুপাড়ার মন্দিরের পাশের পুকুরঘাটে। সেখানে আরশি আমার জন্য অপেক্ষা করে। পুকুরের ঘাট কখনো চাঁদের আলোয় ভেসে যায়, কখনো অমাবস্যার অন্ধকার। আমি আরশির হাত ধরি, চুমু খাই, কখনো আরেকটু এগোতে চাইলে আরশি বাধা দেয়। আমি ছটফট করি, আর অপেক্ষা করি। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে গ্রামে ফিসফাস হয়। তবে এখানকার লোকজন ভালো, কোনো ঝামেলা হয় না। আমার ডাকনাম নয়ন, পুরো নাম মাহমুদুল হক। ‘আরশি-নয়ন’ একটি বাংলা ছবির নাম হিসেবে কতটা সম্ভাবনাময়, ভেবে আমি পুলকিত হই। কিন্তু একটি বাঁকবদলের কারণে গল্পের এ রকম নামকরণ আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।

২.
দু-তিন কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামটি। এখানকার একজন ইউপি চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়েছিল। সরকারি চাকরিসূত্রে এখানে এসেছিলেন তিনি। এখানে এসে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয়। চেয়ারম্যানের বাড়িতে দাওয়াত রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর উপযুক্ত কন্যাটিকে দেখে থাকবেন। কর্মকর্তা এখন চট্টগ্রামে বদলি হয়েছেন। কিন্তু উভয়পক্ষের সম্মতিতে আবার তাঁকে আসতে হলো বিয়ে করতে। এসব কথা আমাদের জানা হতো না, যদি না বিয়ের রাতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডাকাতি হতো।
বিয়ের রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে স্থানীয় অতিথিরা ফিরে গেছেন। শুধু বন কর্মকর্তার সঙ্গে জনা কয়েক শহুরে অতিথির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে দোতলা বাড়িতে। শেষ রাতের দিকে বাড়িতে ডাকাত পড়ল। বাড়ির বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ছুরি-চাপাতি-দা আর দোনলা বন্দুক নিয়ে চড়াও হয়েছিল মুখোশ পরা ১০-১২ জন ডাকাত। আতঙ্কিত লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগে বিয়ের সব অলংকার আর ঘরে টাকা-পয়সা যা ছিল নিয়ে চলে গেছে ডাকাতেরা। কেউই তেমন বাধা দেয়নি, তবু হয়তো নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাউকে ছুরি দিয়ে সামান্য গুঁতো, কাউকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে গেছে ওরা। বিয়ের বর বন কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন। কেউ বলছে, ডাকাতেরা মাথায় মেরেছিল বন্দুক দিয়ে; কারও কারও মতে, মারেনি, বুকে দোনলা বন্দুক তাক করতেই ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি।
পরদিন হইচই পড়ে গেল এলাকাজুড়ে। চেয়ারম্যানের লোকজন খুব চোটপাট করল থানায় গিয়ে। থানার দারোগা খুবই শরমিন্দা হলেন, তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন বিয়েতে। তিনি ঘোষণা দিলেন, নো মার্সি, কঠিন অ্যাকশন নেওয়া হবে।
এই ঘটনা নিয়ে যখন ব্যাপক আলোচনা চলছিল চোরাইয়ার টেকে, তখনো তাদের কোনো ধারণাই ছিল না অ্যাকশন সম্পর্কে। অ্যাকশনের প্রথম টার্গেট যে এই গ্রামের লোকজন, তা বুঝে ওঠার আগেই মুরব্বি গোছের দুই-তিনজনকে থানায় ডেকে নিয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো, হয় মাল ফেরত দাও, নইলে মরার জন্য তৈরি হও। চোরাইয়ার টেকের লোকজন তো ডাকাত না; ডাকাতি দূরে থাক, সাহস করে দামি জিনিসও চুরি করতে পারে না। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে! পুলিশের এককথা, মাল ফেরত দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হলো দুই দিন।
সেই দুই দিন শেষ হওয়ার আগেই পালিয়ে গেল চোরাইয়ার টেকের লোকজন। গ্রাম পুরুষশূন্য। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও ‘য পলায়তি স জীবতি’—এই জ্ঞান চোরাইয়ার টেকের মানুষের ছিল, ছিল না শুধু দুপাতা পড়াশোনা করা ছেলেটার। সোনা মিয়া ও তার ছেলে বুলবুল থেকে গেল বাড়িতে। এমনকি চুরিও তো তাদের পেশা নয় এই ভরসায়। বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার আগেই সন্ধ্যায় পুলিশ এল গ্রামে। ঘরে ঘরে তল্লাশি হলো। কোথাও কোনো আলামত নেই। অবশেষে অন্তত একটি ঘরে দুজন পুরুষকে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল পুলিশ। অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ আর বলা যাবে না। কোনো যুক্তিতর্কের সুযোগ না দিয়ে বাপ-বেটাকে একই দড়িতে বেঁধে থানায় নিয়ে গেল ওরা।
আরশি ছুটে এসেছিল আমার কাছে। শিক্ষিত মানুষ, আমি কিছু করতে পারি কি না। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছিল, এতে বিপদের ঝুঁকি বাড়বে। এ গ্রামে আমি আগন্তুক, আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া পুলিশের জন্য আরও সহজ। আরশির মাথায় একটা হাত রেখেছিলাম। তাতে আমার অসহায়ত্ব বুঝে নিয়েছিল।
থানায় দারোগা আটক দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হাসলেন। এবার সবকিছু ধীরে ধীরে খোলাসা হবে—এমনই একটা বক্তব্য ছিল সেই হাসিতে। তিনি অনুচ্চস্বরে অধস্তনদের বললেন, ‘ঢোকাও।’ দুজন পুলিশ তাদের দুজনকে পাশের একটি কক্ষে (এটিকে হাজত বলা হচ্ছে) ঢোকাল, এবং কোনো মানসিক প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই বেধড়ক পেটাতে শুরু করল। জিজ্ঞাসাবাদের আগে এ রকম একটা ব্যাপার ঘটে গেলে নাকি প্রশ্নোত্তর-পর্ব অনেক সহজ হয়ে যায়। সোনা মিয়ার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল, সেটা কোনো ব্যাপার না; এ রকম মারধর জীবনে অনেক জুটেছে। কিন্তু ছেলেটা ফুলে যাওয়া ডান চোখটা আর খুলতে পারছে না দেখে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল তার।
পরদিন সকালে দারোগার সামনে যখন হাজির করা হলো, তখন সোনা মিয়ার দুই চোখ এবং বুলবুলের এক চোখের দৃষ্টি বিস্ময়-বিহ্বল। দারোগা ঠান্ডা গলায় তাদের ওপর চোটপাটের জন্য আফসোস করলেন; পাশাপাশি এ-ও স্মরণ করিয়ে দিলেন, গত সন্ধ্যায় যা হয়েছে তা দোজখের বিজ্ঞাপনমাত্র, আসল দোজখ দেখা হয়ে যাবে, আজই যদি সব কথা তারা খুলে না বলে।
কী কথা খুলে বলবে, কী জানা আছে তাদের? তারা বরং প্রকৃত দোজখের রূপ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সোনা মিয়া শুধু মিনমিন করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, পেশায় সে চোর নয়, একজন মুদিদোকানি, তার ছেলেটা স্কুলে পড়ে। শুনে দারোগা হাসে। সেই হাসির বক্তব্য, এমন কথাও বিশ্বাস করতে হবে?
হঠাৎ কী মনে হতে দারোগা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, বুলবুলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন স্কুলে?’
‘মতলব-মোমেন উচ্চবিদ্যালয়,’ কঁকিয়ে উত্তর দেয় ছেলেটা।
‘চল, শালা! দেখি তুই কিসের স্কুলছাত্র! চোরাইয়ার টেকের ছেলে আবার স্কুলছাত্র…চল…।’
সোনা মিয়াকে হাজতে রেখে বুলবুলকে নিয়ে পুলিশ রওনা হলো স্কুলে। তিন-চারজন পুলিশ আর হাতে দড়ি বাঁধা সহপাঠীকে গেট দিয়ে ঢুকতে দু-একজন ছাত্র ক্লাসরুম থেকে দেখতে পেয়েছিল। তাতে শিক্ষকদের আর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা সম্ভব হলো না। দলে দলে ছেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল তামাশা দেখতে। এতগুলো কৌতূহলী ও কৌতুকপ্রিয় সহপাঠীর চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল বুলবুলের। এমনকি এইটুকু জীবনে এই প্রথমবার মরে যেতেও ইচ্ছে করছিল তার।
প্রধান শিক্ষক স্বীকার করলেন, এই ছেলে স্কুলের ছাত্র। তাতে দারোগা সাহেব বিস্মিত ও বিরক্ত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই ছেলে যে চোর না এমন কোনো গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন কি না।
প্রধান শিক্ষক মাথা নাড়লেন, তিনি অপরাগ। শুধু জীবন স্যার—গণিতের শিক্ষক জীবনকৃষ্ণ মুহুরি —বললেন, ‘আমার মনে হয় এই ছেলে চোর না।’
‘আপনার তো মনে হবেই, মনে হওয়া তো খুব সোজা। আপনি তো পুলিশে চাকরি করেন না, চুরির মাল তো আর আপনাকে উদ্ধার করতে হবে না…’ ইত্যাদি অনর্গল বাক্যবাণে জীবনবাবুকে প্রায় ধরাশায়ী করে দিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলেন দারোগা সাহেব। বুলবুলকে সঙ্গে টানতে টানতে তাঁকে অনুসরণ করল বাকি পুলিশরা। পেছনে তখন বুলবুলের সহপাঠীরা নানারকম বিশ্রি আওয়াজ করছে, টিটকারি দিচ্ছে। পুরো পথেই সেই শব্দগুলো মাথার চারপাশে উড়তে থাকা মৌমাছির মতো গুনগুন করেছিল তার মনে।
আরও এক দিন রাখা হলো থানা-হাজতে। কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া গেল না সোনা মিয়া ও তার ছেলের কাছ থেকে। দারোগা সাহেব নিশ্চিত হলেন, ঘটনার বিন্দুবিসর্গও জানে না এ দুজন। কিন্তু তাতে রাগ কমল না তাঁর। মনের ঝাল মেটাতে নাপিত ডাকিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দিলেন দুজনের। ন্যাড়া মাথা ও মুখে চুন মাখিয়ে দিয়ে বিকেলের দিকে ছেড়ে দেওয়া হলো তাদের।
বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে গ্রামে ফেরার পথে লোকজন ব্যস্ততা ফেলে তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। বোঝা যাচ্ছিল, তাদের বদলে যাওয়া চেহারাটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। যারা বাজারের অন্যদিকে ছিল, খবর পেয়ে তারাও ছুটে এসেছিল দেখতে। তবে তাদের নানামুখী মত ও মন্তব্য কানে যাচ্ছিল না দুজনের।
চোরাইয়ার টেক তখনো পুরুষশূন্য। গ্রামের মহিলা ও শিশুরা এ দুজনকে দেখে ব্যথিত, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলে না কিছুই। শুধু ছুটে এসে বাপ-ভাইকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠেছিল আরশি।
জীবনে অপ্রত্যাশিত কোনো দুর্ভোগ এসে হাজির হলে মানুষ বোধহয় উদাসীন হয়ে পড়ে। সোনা মিয়া ও তার ছেলের চেহারায় সে রকম একটা উদাসীনতা ভর করেছিল। সন্ধ্যার কিছু পরে দুজন এসে চুপচাপ বসে ছিল খালের ধারে। চারপাশের সুনসান নীরবতার মধ্যে নীরব দুটি প্রাণী। সমবেদনা জানানোর ভাষা ছিল না সামান্য দূরে বসে থাকা আরও একজনের মুখে।
কী ভেবে হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে সোনা মিয়া বলল, ‘মনে দুঃখ নিস না, বাপ। তুই আর এট্টু লেখাপড়া কইরা বড় অইলে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব।’
বাবার কথা বিশ্বাস হয় না বা পছন্দ হয় না বুলবুলের। বলল, ‘না, বাবা, আমি আর পড়ালেখা করব না। তুমি আমারে চুরি করাটা শিখায়া দাও।’
কথা শুনে ছেলের দিকে তাকায় সোনা মিয়া। খালের পানির ওপর তখন হঠাৎ হু হু করে হাওয়া বয়ে যায়।

৩.
ভাবছি, আমি কী করব। দুটো টিউশনি দিয়ে দিন চলে না। নিকট ভবিষ্যতে চাকরির কোনো সম্ভাবনাও দেখি না। নাকি চুরিবিদ্যাটা শিখে এই গ্রামেই ঘর তুলব একটা?
অবশ্য, এখন আমার সম্পর্কে আপনারা কী ভাবছেন, তা-ও ধারণা করতে পারছি আমি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ: ভূঁইয়া ইকবাল
Next Post:সৃজনানন্দের অন্তর্দহন

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑