• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

প্রুফরিডার – শামসুজ্জামান

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » প্রুফরিডার – শামসুজ্জামান

ঘিঞ্জি গলি ঘেঁষে দাঁড়ানো পুরোনো আমলের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় প্রকাশনা সংস্থাটির অফিস। শ্যামলামতো, ছিপছিপে, ঢ্যাঙাগোছের লোকটি সিঁড়ি ভেঙে তৃতীয় তলায় উঠে বেশ কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নেয়। উসকোখুসকো একমাথা চুল। সারা মুখে ব্রণের দাগ। গলার চামড়ায় ভাঁজ। কপালজুড়ে অসংখ্য বলিরেখা। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি, ছাইরঙা সোয়েটার, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। বয়স কত, দেখে বোঝা ভার; হয়তো ৬০, হয়তো বা ৬৫। দরজা ঠেলে অফিসে ঢুকতেই বিদেশি টোব্যাকোর পোড়া গন্ধ ওর নাকে এসে লাগে।
খোশমেজাজে সিগারেট ফুঁকছে আর সামনে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করছে প্রকাশক—বিমল কুমার দত্ত। তাঁকে দেখে উচ্ছ্বাসভরা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে বিমল: কী কাণ্ড দেখো! বলতে না-বলতে এসে গেছেন! ওনার কথাই তো বলছিলাম তোমাকে। আজাদ সাহেব, পত্রিকা অফিসে কাজ করেন—প্রুফরিডার। অবসর সময়ে বইয়ের প্রুফ দেখা, সম্পাদনা—এসবও করেন, দারুণ হাত বটে!
ঈষৎ ঝুঁকে উভয়ের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় আজাদ—আবুল কালাম আজাদ।
বসুন। আর এ হচ্ছে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেহরাব হাসান। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করে, ভালোই লেখে। তো, যা বলতে চাচ্ছিলাম, একটা উপন্যাস লিখেছে মেহরাব। একুশের বইমেলায় বের করার শখ। বইটা আপনি দেখে দিলে ভরসা পেতাম।
নিঃশব্দে মাথা নাড়ে আজাদ। ব্যাগটা চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রেখে বসে পড়ে।
‘বোঝেনই তো, বইমেলায় ক্রেতাদের যা ক্রেজ! আমার তো ব্যবসা, লাভ না হোক আসলটা তো উঠে আসা চাই, নাকি?’ বলে বিমল।
‘তা তো বটেই।’ সায় দেয় আজাদ।
‘পুরি আর চা চলুক, কী বলেন?’ উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পিয়নকে হুকুম হাঁকে বিমল, আমাদের জন্য গরম গরম পুরি আর চা; এক কার্টন বেনসনও এনো, দেরি কোরো না। পিয়ন বেরিয়ে যেতেই সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, বহু চেষ্টা করে আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে। ওনার একটা বই পাওয়া মানে সারা বছরের ব্যবসা। খালি হাতে যাই কী করে—বেনসন ওনার ফেভারিট ব্র্যান্ড।
‘বই পেলেন তাহলে শেষ পর্যন্ত?’ খসখসে গলায় বলে আজাদ।
‘কম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ভেবেছেন? অ্যাডভান্স রয়্যালটি দিয়ে রেখেছিলাম এক বছর আগে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট যখন মিলেছে, মনে হয় একখানা পাব। তার পরও পাণ্ডুলিপি হাতে না-পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নেই (মেহরাবের দিকে তাকিয়ে) বোঝো…!’
‘আর আমার মতো লেখকেরা তোমাদের পেছন-পেছন ঘোরে বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে।’ ঠোঁটে একচিলতে হাসি টেনে বলে মেহরাব।
‘ভেরি ন্যাচারাল। সবকিছুই কমার্শিয়ালাইজড্, কি শিল্প-সাহিত্য, কি সিনেমা-নাটক—সবকিছুই; লোকের চাহিদামাফিক পরিবেশন করতে হয়; বুঝলে হে?’ অ্যাশট্রেতে আঙুলের টোকায় সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বিশেষ ভঙ্গিতে মেহরাবকে লক্ষ করে কথাগুলো আওড়ায় বিমল।
আলাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মেহরাব হাসানের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা ব্যাগে পুরে উঠে পড়ে আজাদ।

প্রুফ দেখা আর পত্রপত্রিকা সম্পাদনা, এসব করেই কেটে গেল আজাদের জীবনের এতগুলো বছর। কত বছর? তা বছর চল্লিশেক তো হবেই। কলেজজীবনে বেশ কয়েকজন বন্ধুতে মিলে গড়ে তুলেছিল একটি সাহিত্যগোষ্ঠী। চাঁদা তুলে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দু-চারটে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে প্রকাশ করত সাহিত্য-সাময়িকী, স্মরণিকা। সেই সঙ্গে চুটিয়ে লেখালেখি এবং সম্পাদনার কাজ। বন্ধুরা তারিফ করত ওর লেখার, বিশেষ করে ওর ছোটগল্পের।
সে সময়ে বেশির ভাগ ছাপার কাজ ট্রেডল মেশিনেই হতো। হাতেগোনা কয়েকটি অফসেট প্রেস। খরচের ভয়ে ওমুখো মাড়াতে সাহস পেত খুব কম লোকই।
কিন্তু ট্রেডল মেশিনে ছাপার যা ঝক্কি! [ছোট ছোট কাঠের খোপ থেকে সিসার হরফ খুঁজে নিয়ে সাজাও পেতলের স্টিকে। লেড, এম, স্পেস, কোয়ারেড আরও কত কী; নিখুঁতভাবে বসাতে থাকো শব্দ আর লাইনের ফাঁকে ফাঁকে। এক পৃষ্ঠা কম্পোজ হলো তো তাতে কোটেশন সাজিয়ে মেকআপ দাও কাঠের একখণ্ড তক্তা—মানে গ্যালির ওপর। কালির রোলার ডলে তার ওপর কাগজ চেপে ছাপ তোলো—গ্যালি প্রুফ; পাঠোদ্ধার করা যার-তার কাজ নয় বাপু! ভুল বেরোল তো আবার আঁটুনি ঢিলে দাও। ভুল সিসাগুলো চিমটে দিয়ে তুলে নিয়ে সঠিকগুলো বসাও। ফের ঠক ঠক শব্দে আঁটুনি, মেশিনে তুলে লাগানো—ঘট ঘট ঘটাং—মেশিন চালু করে তারপর ফাইনাল প্রুফ। ফাইনাল প্রুফে ভুল বেরোলে মেশিন থেকে পুরো ম্যাটারটা ফের নামাও—আবার কারেকশন।] আট ফরমার ডবল-ডিমাই সাইজের একটা পত্রিকা বের করতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ত!

অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে এলে কেমন জানি হয়ে পড়ে আজাদ। কাগজ বের করার আগে দিনমান প্রেসে কাটানো, কখনো বা রাত; কখনো নির্ঘুম, কখনো বা পুরোনো কাগজ বিছিয়ে তাতে শরীর এলিয়ে দিয়ে ক্ষণিকের জন্য চোখ বোজা। কী এক দুর্নিবার নেশায় পেয়ে বসেছিল ওকে। অবসর সময়ে লেখক-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, রাতে ঘুমানোর জন্য শুধু হোস্টেলে ফেরা। পরিবার-পরিজন থাকত গ্রামে। অবস্থাপন্ন কৃষক ছিলেন ওর বাবা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। পাকিস্তানি পশুরা পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওদের ঘরদোর, সহায়-সম্বল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কপর্দকশূন্য বাপের পক্ষে ওর পড়াশোনার খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা ছাড়া পড়াশোনায় সময়টাই বা দিয়েছে কতটুকু? কোনোমতে টেনেটুনে বিএ। কী আর করা, অগত্যা চাকরির খোঁজ।
মেহরাব হাসানের উপন্যাসের কলেবর বেশ বড়সড়। এ-ফোর সাইজের কাগজে চৌদ্দ ফন্টে কম্পোজ; ২০০ পৃষ্ঠা। কয়েক পৃষ্ঠা পড়তেই বুঝতে পারে, বেশ সময় লাগবে ঠিকঠাক করতে। সংস্কারের ব্যাপারটা পরে দেখা যাবে—পুরোটা একবার পড়ে নেওয়া যাক।
‘কী দেখছ, অত মন দিয়ে? ভালো কোনো কাজটাজ পেলে?’ কাঁধের পেছন থেকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে আজাদের স্ত্রী।
‘দেখা যাক, পড়ে তো দেখি আগে।’ অন্যমনস্ক আজাদের জবাব।
সংসার বলতে আজাদের ওই এক স্ত্রী। বউটা বন্ধ্যা হলে কী হবে, ভারি লক্ষ্মী। যা রোজগার, তা দিয়ে এ বাজারে দুজন লোকের ভদ্রভাবে চলাও দুরূহ। শহরতলিতে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে টেনেটুনে কোনোমতে দিন পার করে দিচ্ছে আজাদ।

প্লট যথেষ্ট ভালো। নতুন লেখকের কলম থেকে এত সরেস কাহিনি বেরোনো কিছুটা আশ্চর্যের ব্যাপার বৈকি। তবে ভাষার ব্যবহার, সঠিক শব্দ-প্রয়োগ, গল্পের গাঁথুনির ক্ষেত্রে দুর্বলতা চোখকে বেশ পীড়া দেয়। বইটা যে অবস্থায় আছে, শুধু বানান শুধরে দিলেই বিমল তা প্রকাশ করবে বলে মনে হয় না। প্রতিষ্ঠানের সুনাম—তা ছাড়া বাজার পাওয়ার একটা ব্যাপারও তো আছে। বোঝা হয়ে যায় আজাদের; যথেষ্ট শ্রম তাকে দিতে হবে, তাহলে যদি জাতে তোলা যায় উপন্যাসটিকে।
‘আপনার বইটা পড়ে দেখলাম। সুন্দর প্লট। তবে প্রেজেন্টেবল করতে হলে বেশ কিছু কাজ করতে হবে। মুখোমুখি আলাপ হলে ভালো হয়। কখন বসা যায়?’ মোবাইলে কথা বলে আজাদ।
‘আপনি যখন বলেন।’ অপর প্রান্ত থেকে মেহরাব জানায়।
পরদিন সন্ধের আগমুহূর্তে বিমলের অফিসে গিয়ে হাজির হয় আজাদ।
‘কেমন দেখলেন, চালানো যাবে?’ সিগারেটের একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করে বিমল।
‘খুব যাবে। ভালোই এঁকেছেন চরিত্রগুলো। তবে খাটতে হবে একটু বেশি, মানে ঘষামাজা, এই যা। পাঠক খাবে। বেস্ট না হোক, গুড সেলার যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই।’
‘তা যত পারেন ঘষামাজা করেন, মানা করছে কে;’ কী বলো মেহরাব?
‘প্রথম বই, তাও আবার সাহস করলাম উপন্যাস দিয়ে। খুব কি খারাপ হয়েছে?’ কিছুটা বিচলিত দেখায় মেহরাবকে।
‘খারাপ বলল কে? কে বলবে প্রথম বই, পড়ে তো বিশ্বাসই হয়নি। তবে খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন, পড়লেই বোঝা যায়। তাড়াহুড়ো করে আর যা-ই হোক সাহিত্য হয় না।’ কথাগুলো বলে একটু থতমত খায় আজাদ, সাহিত্য হয় না বলাতে মাইন্ড করেননি তো ভদ্রলোক!
‘আসলে আপনি বড্ড খুঁতখুঁতে। আজকাল পারফেকশনিস্টদের দাম দেয় কে, অ্যাঁ? বছরে অন্তত একহালি বই না বেরোলে লেখকের খাতায় নাম ওঠে কারও? পাঁচ বছর পর শেষ বইয়ের শুরুতে লেখা থাকবে, লেখকের অন্যান্য গ্রন্থ…২০টির নাম; কী খারাপ লাগছে শুনতে? আমরাও এদের পেছনেই দৌড়াই, অ্যাডভান্স দিই।’ বলে বিমল।
‘কিছু মনে করবেন না; সাহিত্যের ওপর ভালোই তো দখল আপনার; লেখেন না কেন?’ মুখ খোলে মেহরাব।
প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই যে কারও মনে জাগতে পারে। একসময় ও যে চুটিয়ে লেখালেখি করত, তা এদের জানার কথা নয়। সৃজনশীল যেকোনো কাজের জন্য দরকার গভীর অভিনিবেশ, আর সে জন্য প্রয়োজন অবসর। দুই বেলা অন্ন জোটাতে যাকে হিমশিম খেতে হয়, সে করবে সাহিত্য!
হ্যাঁ, কথাবার্তা পাকাপাকি হয়; ইচ্ছামতো কলম চালাতে পারবে আজাদ। পারিশ্রমিকের বিষয়টিও স্থির হয়। এত বড় অঙ্কের অফার পাবে ভাবতেও পারেনি ও। সমস্যা হলো সময়। হাতে সময় মাত্র দুই মাসের মতো। দুই মাসই বা কোথায়; প্রিন্টিং-বাইন্ডিংয়ের জন্য ১৫-২০ দিন বাদ দিলে দেড় মাসও টেকে না। সংক্ষিপ্ত এই সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারবে তো কাজটা? ৪৫ দিনে ২০০ পৃষ্ঠা!
সকাল থেকে বিকেল অবধি অফিস। সন্ধ্যার পর থেকে চলে উপন্যাস নিয়ে কাজ। মেহরাবের বইয়ের গায়ে পেনসিলের ছোটাছুটি চলতে থাকে—কাটাকাটি, লেখালেখি। একবার করা সংশোধন পছন্দসই না হলে, ইরেজারের ঘষায় মুছে ফেলে আরেকবার ঠিক করে নেওয়া। অনেক রাত পর্যন্ত চলে কাজ; কখনো বা রাত কাভার। বউটার বাড়তি কাজ দাঁড়াল রাত জেগে কিছুক্ষণ পরপর চায়ের জোগান দেওয়া।
দিন তিনেক যেতে না-যেতেই ফোন আসে মেহরাবের, ‘কী খবর, কদ্দুর এগোলেন, অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘নাহ্, অসুবিধা হলে আমিই জানাব আপনাকে।’ বলে আজাদ।
যতটা দুশ্চিন্তায় ছিল, কাজে লেগে যাওয়ার পর ক্রমেই তা কেটে যেতে থাকে। মজা পেয়ে যায়—কাঁচা হাতে তৈরি একটা মূর্তিকে যেন চেঁছে-কুঁদে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে ধকল একটা গেল বটে; কয়েক রাত যে চোখের দুই পাতা এক হয়নি—ইয়ত্তা নেই। অফিস থেকেও সাত দিনের ছুটি নিতে হয় অসুস্থতার অজুহাতে। আসলে কিছুটা অসুস্থ তো ও হয়েই পড়েছিল রাতজাগা, অতিরিক্ত চা-খাওয়া আর মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার কারণে। কাজটা যে সময়মতো শেষ করা গেল, সেটাই হচ্ছে বড় কথা।
বিমলের অফিসে গিয়ে হাজির হয় আজাদ। মেহরাবের হাতে উপন্যাসটি তুলে দিয়ে একটু কাঁচুমাচু করে বলে, দেখেন, কেমন হলো। বেশ কিছু জায়গায় ভালোই কাটাকাটি করতে হয়েছে। বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে মাইন্ড করবেন না…।
‘কী যে বলেন, আমি তো বলেইছি, যা করার দরকার করবেন। প্রথম বই, বাজার পেতে হবে না? এর পরে লিখলে অনেক কিছুই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’
‘আপনি একবার পড়ে দেখেন কেমন দাঁড়িয়েছে; সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব করেছি।’ বলে আজাদ।
পরের দিনই ফোন আসে, ‘বইটা যে আমি লিখেছি বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না। খোলনলচে পাল্টে দারুণ এক জিনিস বানিয়ে ফেলেছেন দেখছি! কী বলে যে ধন্যবাদ দেব আপনাকে…।’ গদগদ গলা মেহরাবের।

বইমেলার শুরুতেই নামকরা প্রকাশনা সংস্থা সমতট প্রকাশনীর স্টলে শোভা পায় মেহরাবের উপন্যাস। প্রখ্যাত শিল্পীর আঁকা আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ, নিখুঁত বাঁধাই—সব মিলিয়ে নজর কাড়ার মতো বই। আশাতীত সাড়া মেলে পাঠকদের কাছ থেকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটির সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

দুই মাসের কঠিন পরিশ্রমের ধকল কাটাতে টানা বেশ কয়েক দিন বিশ্রাম না নিলেই নয়। মেহরাবের উপন্যাসের পেছনে খাটনি এবং ওটার সাফল্য আজাদের মধ্যে কেমন এক পরিবর্তন বয়ে আনে। এমনিতেই চাপা স্বভাবের, আরও যেন বেশি অন্তর্মুখী হয়ে পড়ে ও। ওর এই পরিবর্তন স্ত্রীর নজর এড়ায় না। কিছুটা উদ্বেগমাখা কণ্ঠে শুধোয়, ‘কী গো, কী যেন খুব ভাবো তুমি; খারাপ কিছু ঘটেছে?’
‘না, এমনি।’ মাথা ঝাঁকায় আজাদ।
বহু বছরের পুরোনো নেশাটা আবার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে থাকে ওর। লেখো আজাদ, লেখো; তোমার কলমের ধার ফুরোয়নি এখনো: ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে অবিরত। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা। ঘুণে ধরা শরীর; অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অনিয়মে যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। হালকা হওয়ার জন্য মনের ভেতর আঁকুপাঁকু করা ইচ্ছেটার কথা বলেই ফেলে বউকে, ‘ভাবছি, নিজেই একটা বই লিখে ফেলি, কী বলো?’
‘ভালোই তো হয়। ওই যে, কী যেন নাম ভদ্রলোকের, ওর বইয়ের পেছনে কী খাটনিটাই না দিলে; ওটুকু খাটলে নিজেই একটা লিখে ফেলতে পারো।’
দেয়ালের গায়ে সেঁটে থাকা একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে, টিক্ টিক্ টিক্…
‘ওই দেখো, ঠিক কথাই বলেছি আমি…!’ একগাল হেসে স্ত্রী বলে।
স্ত্রীর উৎসাহ ইচ্ছেটাকে আরও উসকে দেয়। বাড়তি আয়ের ধান্দা ততটা না করলেও চলে এখন। মেহরাবের বই সম্পাদনার পারিতোষিক বাড়তি রোজগারের চাপ কমিয়েছে অনেক। মাথাজুড়ে এখন শুধু প্লটের চিন্তা। কয়েক দিনের মধ্যেই জুটে যায় চমৎকার প্লট।
চার-পাঁচ মাসের ভেতর মাঝারি আকারের একটা উপন্যাস দাঁড়িয়ে যায়। বেশ হয়েছে। অন্তত মেহরাবের বইটার চেয়ে তো ভালোই। আনন্দের সূক্ষ্ম এক অনুভূতি ওর মনের প্রান্তরে ঢেউ তোলে! রাতারাতি প্রতিষ্ঠা পাওয়া যে যায়, তা তো গত বইমেলাতেই দেখল। লেখক হিসেবে একবার পাঠক-মনে স্থান করে নিতে পারলে আর ঠেকায় কে!
এখন যা জরুরি, তা হলো প্রকাশক জোগাড় করা। বিমলের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এ বছরও একটা বই লিখেছে মেহরাব। বিমল বারবার ওকে অনুরোধ করেছিল দেখে দিতে। শারীরিক অসুস্থতার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছে।
কার কাছে যাওয়া যায়? আরও কয়েকজন পাবলিশারের সঙ্গে কাজের সূত্রে পরিচয় আছে ওর। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের বেশির ভাগই বিমলের ঘনিষ্ঠজন। হঠাৎ মাথায় আসে, ওর অপরিচিত কিন্তু বেশ খ্যাতিকুড়ানো প্রকাশক এহসানুল হকের নাম। নতুন লেখকদের দুয়েকটা ভালো বই প্রতিবছরই প্রকাশিত হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকে।
তাড়াহুড়ো করে অফিসের কাজ সেরে একদিন এহসানের ঠিকানায় সরাসরি রওনা হয় আজাদ—সঙ্গে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। পথে যা জ্যাম; ১৫ মিনিটের পথ পেরোতে লেগে যায় প্রায় ঘণ্টা খানেক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এহসানের অফিসে পৌঁছাতে। পাবে তো এহসানকে! দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতায় হাত কচলাতে থাকে আজাদ। নাহ্, ভাগ্য ভালোই বলতে হয়। পাওয়া গেল; একাকী বসে কী যেন দেখছিল সে গভীর মনোযোগে।
বইটার পাণ্ডুলিপি এহসানের হাতে তুলে দিয়ে একরাশ বিনয় মেশানো সুরে বলে আজাদ, আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। দেখা হয়নি, এই যা। নতুন লেখকদের আপনিই একমাত্র ভরসা। একটা উপন্যাস; ছোটখাটো—সাহিত্য নিয়ে তো আর তদবির চলে না, বুঝি, তবুও…
‘যা বলার বলে ফেলুন ঝটপট…খুব ব্যস্ত…।’ কিছুটা অধৈর্য এহসান।
‘বইটা ছাপানো যাবে কি না যদি একটু, মানে দয়া করে যদি একটু দেখতেন।’
একজন কর্মচারীকে ডেকে তার হাতে পাণ্ডুলিপিটা তুলে দিয়ে নির্লিপ্ত গলায় এহসান বলে, ‘ঠিক আছে, ও পড়ে দেখুক, কয়েক দিন পরে এসে জেনে যাবেন।’

বাসায় ফিরে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটা বিছানায় ঢেলে দেয় আজাদ। বউ এসে বসে সিথানের কাছটাতে। শরীর খারাপ করল না তো! মাথায় আলতোভাবে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হলো, কী বললেন প্রকাশক? বইটা ছাপবেন?’
‘কী করে বলি? ছাপতেও পারেন।’ ক্ষীণ কণ্ঠে জানায় আজাদ।
আশ্বস্ত হয় স্ত্রী। না ছেপে পারে? কালামের অলক্ষে কোনো এক ফাঁকে পাণ্ডুলিপিটা ওর পড়া সারা। এর চেয়ে ভালো উপন্যাস আর কজন লিখতে পারে? দু-একটা যে পড়ে না, তা তো নয়। লেখার কী ছিরি, আর কী সব বস্তাপচা কাহিনি!

কয়েক দিন পর এহসানের অফিসে গিয়ে হাজির হয় আজাদ। এহসান নেই। কখন ফিরবে, বলতে পারল না কেউ। কী আর করা। অবশেষে পাণ্ডুলিপিটা যাকে দেখতে দিয়েছিল, যায় তার কাছে। লোকটা কাস্তের মতো কুঁজো হয়ে বসে কী যেন লিখেই চলেছে আপন মনে। আজাদের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায়।
‘আমার বইটা কি দেখা হয়েছে?’
‘হুঁ, স্যার কিছু বলেননি আপনাকে?’
‘কই, না তো! কী বলবেন?’
‘আসলেই তো, কী আর বলবেন! ছাপা যেত, কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’ শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা আজাদের।
‘না, মানে, ইয়ে…বিদেশি লেখকের লেখার স্টাইল কপি করলে কথা ছিল না; অনেকেই কম্মোটি করে; কিন্তু দেশি লেখক, তাও আবার একেবারে আনকোরা; গত বইমেলায় বেরোল মোটে তার প্রথম বই! আপনার বইটায় শুধু কাহিনির হেরফের; লেখার স্টাইল হুবহু এক! প্লটটা তো যথেষ্ট ভালোই ছিল; নিজের মতো করে লিখলেই তো পারতেন; ছাপা যেত…অবশ্যই ছাপা যেত…।’
টিক্ টিক্ টিক্…; দেয়ালের দিকে চোখ ফেরায় আজাদ। একটা টিকটিকি লেজ নেড়ে চলেছে অনবরত; ধীরে ধীরে টিকটিকিটা আকারে বড় হতে থাকে—বড় হতেই থাকে; একসময় হঠাৎই টুপ করে খসে পড়ে তার আন্দোলিত লেজ!
কাগজের স্তূপ থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করে কালামের দিকে বাড়িয়ে ধরে লোকটা।

Category: গল্প
Previous Post:১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া: হাসান ফেরদৌস
Next Post:বাতাসে বাতাসে মানুষের দীর্ঘশ্বাস – সোহরাব হাসান

Reader Interactions

Comments

  1. hyder

    June 18, 2014 at 12:14 am

    Bhalo hoini

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑