সত্য ও মিথ্যা

এক

পিতলকে সোনা বলিয়া চালাইলে সোনার গৌরব ত বাড়েই না, পিতলটারও জাত যায়। অথচ সংসারে ইহার অসদ্ভাব নাই। জায়গা ও সময়-বিশেষে হ্যাট মাথায় দিয়া খাতির আদায় করা যাইতে পারে, কিন্তু চোখ বুজিয়া একটুখানি দেখিবার চেষ্টা করিলেই দেখা অসম্ভব নয় যে, একদিকে এই খাতিরটাও যেমন ফাঁকি, মানুষটার লাঞ্ছনাও তেমনি বেশী। তবুও এ চেষ্টার বিরাম নাই। এই যে সত্য গোপনের প্রয়াস, এই যে মিথ্যাকে জয়যুক্ত করিয়া দেখানো, এ কেবল তখনই প্রয়োজন হয়, মানুষ যখন নিজের দৈন্য জানে। নিজের অভাবে লজ্জা বোধ করে, কিন্তু এমন বস্তু কামনা করে, যাহাতে তাহার যথার্থ দাবী-দাওয়া নাই।এই অসত্য অধিকার যতই বিস্তৃত ও ব্যাপক হইয়া পড়িতে থাকে, অকল্যাণের স্তূপও ততই প্রগাঢ় ও পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতে থাকে। আজ এই দুর্ভাগা রাজ্যে সত্য বলিবার জো নাই, সত্য লিখিবার পথ নাই—তাহা সিডিশন। অথচ দেখিতে পাই, বড়লাট হইতে শুরু করিয়া কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই বলিতেছেন—সত্যকে তাঁহারা বাধা দেন না, ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা—এমন কি, তীব্র ও কটু হইলেও নিষেধ করেন না। তবে বক্তৃতা বা লেখা এমন হওয়া চাই, যাহাতে গভর্নমেণ্টের বিরুদ্ধে লোকের ক্ষোভ না জন্মায়, ক্রোধের উদয় না হয়। চিত্তের কোনপ্রকার চাঞ্চল্যের লক্ষণ না দেখা দেয়,—এমনি। অর্থাৎ, অত্যাচার-অবিচারের কাহিনী এমন করিয়া বলা চাই, যাহাতে প্রজাপুঞ্জের চিত্ত আনন্দে আপ্লুত হইয়া উঠে, অন্যায়ের বর্ণনায় প্রেমে বিগলিত হইয়া পড়ে এবং দেশের দুঃখ-দৈন্যের ঘটনা পড়িয়া দেহ-মন যেন তাহাদের একেবারে স্নিগ্ধ হইয়া যায়! ঠিক এমনটি না ঘটিলেই তাহা রাজ-বিদ্রোহ। কিন্তু এ অসম্ভব কি করিয়া সম্ভব করি? দুইজন পাকা ও অত্যন্ত হুঁশিয়ার এডিটারকে একদিন প্রশ্ন করিলাম। একজন মাথা নাড়িয়া জবাব দিলেন,—ওটা ভাগ্য। অদৃষ্ট প্রসন্ন থাকিলে সিডিশন হয় না—ওটা বিগড়াইলেই হয়! আর একজন পরামর্শ দিলেন,—একটা মজা আছে। লেখার গোড়ায় ‘যদি’ এবং শেষে ‘কিনা’? দিতে হয় এবং এই দুটো কথা নির্বিচারে সর্বত্র ছড়াইয়া দিতে পারিলে আর সিডিশনের ভয় থাকে না। হবেও বা, বলিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া আসিলাম—কিন্তু আমার পক্ষে একের পরামর্শও যেমন দুর্বোধ, অপরের উপদেশও তেমনি অন্ধকার ঠেকিল।

লিখিয়া লিখিয়া নিজেও বুড়া হইলাম,নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক-মতই কোন একটা বিষয় ন্যায়সঙ্গত কিনা স্থির করিতে পারি, কিন্তু যাহার আলোচনা করিতেছি, তাহার রুচি ও বিবেচনার সহিত কাঁধ মিলাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় কি করিয়া যে লেখার আগাগোড়ায় ‘যদি’ ও ‘কিনা’ বিকীর্ণ করিয়া সিডিশন বাঁচাইব, ইহাও যেমন আমার বুদ্ধির অতীত, জ্যোতিষীর কাছে নিজের ভাগ্য যাচাইয়া তবে লেখা আরম্ভ করিব, সেও তেমনি সাধ্যের অতিরিক্ত। অতএব সত্য ও মিথ্যা নির্ণয়ের চেষ্টায়, ইহার কোনটাই আমি সম্প্রতি পারিয়া উঠিব না। তবে প্রয়োজন হইলে নিজের দুর্ভাগ্যকে অস্বীকার করিব না।

এই প্রবন্ধটা বোধ করি কিছু দীর্ঘ হইয়া পড়িবে, সুতরাং ভূমিকায় এই কথাটাই আরও একটু বিশদ করিয়া বলা প্রয়োজন। একদিন এ দেশ সত্যবাদিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, কিন্তু আজ ইহার দুর্দশার অন্ত নাই। সত্য-বাক্য সমাজের বিরুদ্ধে বলা যেমন কঠিন, রাজশক্তির বিরুদ্ধে বলা ততোধিক কঠিন। সত্য লেখা যদি-বা কেহ লেখে, ছাপাওয়ালারা ছাপিতে চায় না,—প্রেস তাহাদের বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইবে। লেখা যাঁহাদের পেশা, জীবিকার জন্য দেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকতা যাঁহাদের করিতে হয়, অসংখ্য আইনের শতকোটি নাগপাশ বাঁচাইয়া কি দুঃখেই না তাঁহাদের পা ফেলিতে হয়। মনে হয়, প্রত্যেক কথাটি যেন তাঁহারা শিহরিতে শিহরিতে লিখিয়াছেন। মনে হয়, রাজরোষে প্রত্যেক ছত্রটির উপর দিয়া যেন তাঁহাদের ক্ষুব্ধ ব্যথিত চিত্ত কলমটার সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করিতে করিতেই অগ্রসর হইয়াছে। তবুও সেই অতি সতর্কভাষার ফাঁকে ফাঁকে যদি কদাচিৎ সত্যের চেহারা চোখে পড়ে, তখন তাহার বিক্ষত, বিকৃত মূর্তি দেখিয়া দর্শকের চোখ দুটাও যেন জলে ভরিয়া আসে। ভাষা যেখানে দুর্বল, শঙ্কিত, সত্য যে দেশে মুখোশ না পরিয়া মুখ বাড়াইতে পারে না, যে রাজ্যে লেখকের দল এতবড় উঞ্ছবৃত্তি করিতে বাধ্য হয়, সে দেশে রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি সমস্তই যদি হাত ধরাধরি করিয়া কেবল নীচের দিকেই নামিতে থাকে, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে? যে ছেলে অবস্থার বশে ইস্কুলে কাগজ-পেন্সিল চুরি করিবার ফন্দি শিখিতে বাধ্য হয়, আর একদিন বড় হইয়া সে যদি প্রাণের দায়ে সিঁদ কাটিতে শুরু করে, তখন তাহাকে আইনের ফাঁদে ফেলিয়া জেলে দেওয়া যায়। কিন্তু যে আইন প্রয়োগ করে, তাহার মহত্ত্ব বাড়ে না, এবং ইহার নিষ্ঠুর ক্ষুদ্রতায় দর্শকরূপে লোকের মনের মধ্যেও যেন সূঁচ বিঁধিতে থাকে।

দুই-একটা দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা বোধ করি আর একটু পরিস্ফুট হইবে। (‘বাঙলার কথা,’ ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯২২)

দুই

সর্বদেশে সর্বকালে থিয়েটার জিনিসটা কেবল আনন্দ নয়, লোক-শিক্ষারও সাহায্য করে। বঙ্কিমবাবুর চন্দ্রশেখর বইখানা একসময়ে বাঙ্গালার স্টেজে প্লে হইত। লরেন্স ফস্টর বলিয়া এক ব্যক্তি ইংরাজ নীলকর অতিশয় কদাচারী বলিয়া ইহাতে লেখা আছে। কর্তাদের হঠাৎ একদিন চোখে পড়িল, ইহাতে ক্লাস হেট্‌রেড নাকি এমনি একটা ভয়ানক বস্তু আছে, যাহাতে অরাজকতা ঘটিতে পারে। অতএব অবিলম্বে বইখানা স্টেজে বন্ধ হইয়া গেল। থিয়েটারওয়ালারা দেখিলেন, ঘোর বিপদ। তাঁহারা কর্তাদের দ্বারে গিয়া ধন্না দিয়া পড়িলেন, কহিলেন—হুজুর, কি অপরাধ? কর্তারা বলিলেন, লরেন্স ফস্টর নামটা কিছুতেই চলিবে না, ওটা ইংরাজী নাম। অতএব ওটা ক্লাস হেট্‌রেড। থিয়েটারের ম্যানেজার কহিলেন, যে আজ্ঞা প্রভু! ইংরাজীনামটা বদলাইয়া এখানে একটা পর্তুগীজ নাম করিয়া দিতেছি। এই বলিয়া তিনি ডিক্রুজ, না ডিসিল্‌ভা, না কি এমনি একটা—যা মনে আসিল, অদ্ভুত শব্দ বসাইয়া দিয়া কহিলেন, এই নিন।

কর্তা দেখিয়া শুনিয়া কহিলেন, আর এই ‘জন্মভূমি’ কথাটা কাটিয়া দাও,—ওটা সিডিশন।

ম্যানেজার অবাক হইয়া বলিলেন, সে কি হুজুর, এদেশে যে জন্মিয়াছি!

কর্তা রাগিয়া বলিলেন, তুমি জন্মাইতে পার, কিন্তু আমি জন্মাই নাই। ও চলিবে না।

‘তথাস্তু’ বলিয়া ম্যানেজার শব্দটা বদলাইয়া দিয়া প্লে পাস করিয়া লইয়া ঘরে ফিরিলেন। অভিনয় শুরু হইয়া গেল। ক্লাস হেট্‌রেড হইতে আরম্ভ করিয়া মায় সিডিশন পর্যন্ত বিদেশী রাজশক্তির যত-কিছু ভয় ছিল, দূর হইল, ম্যানেজার আবার পয়সা পাইতে লাগিলেন। যাহারা পয়সা খরচ করিয়া তামাশা দেখিতে আসিল, তাহারা তামাশার অতিরিক্ত আরও যৎকিঞ্চিৎ সংগ্রহ করিয়া ঘরে ফিরিল—বাহির হইতে কোথাও কোন ত্রুটি লক্ষিত হইল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সমস্ত বস্তুটা ছলনায় ও অসত্যের কালিতে কালো হইয়া রহিল। লরেন্স ফস্টর বলিয়া হয়ত কেহ ছিল না, ম্যানেজারের কল্পিত অদ্ভুত পর্তুগীজ নামটিও মিথ্যা। ব্যাপারটাও তুচ্ছ, কিন্তু ইহার ফল কোনমতেই তুচ্ছ নয়।

স্বর্গীয় গ্রন্থাকারের বোধ করি ইচ্ছা ছিল, সে-সময়ে বাঙ্গালাদেশে ইংরাজ নীলকরের দ্বারা যে-সকল অত্যাচার ও অনাচার অনুষ্ঠিত হইত, তাহারই একটু আভাস দেওয়া। ইহারই অভিনয় ক্লাস হেট্‌রেড জাগিতে পারে, রাজশক্তির ইহাই আশঙ্কা। আশঙ্কা অমূলক বা সমূলক, এ আমার আলোচ্য নয়, কিংবা ইংরাজ নামের পরিবর্তে পর্তুগীজ নাম বসাইলে ক্লাস হেট্‌রেড বাঁচে কিনা সেও আমি জানি না,—ইংরাজের আইনে বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে—কিন্তু যে আইন ইহারও উপরে, যাহাতে ‘ক্লাস’ বলিয়া কোন বস্তু নাই, তাহার নিরপেক্ষ বিচারে একের অপরাধ অপরের স্কন্ধে আরোপ করিলে যে বস্তু মরে, তাহার দাম ক্লাস হেট্‌রেডেরও অনেক বেশী। সেদিন দেখিলাম, এই ছোট ফাঁকিটুকু হইতে ছোটছেলেরাও অব্যাহতি পায় নাই। তাহাদের সামান্য পাঠ্যপুস্তকেও এই অসত্য স্থান লাভ করিয়াছে। নূতন গ্রন্থকার আমার মতামত জানিতে আসিয়াছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলাম—এই আশ্চর্য নামটি আপনি সংগ্রহ করিলেন কিরূপে? গ্রন্থকার সলজ্জে কহিলেন—‘‘প্রাণের দায়ে করিতে হয়, মশাই! জানি সব, কিন্তু গরীব, পয়সা খরচা করিয়া বই ছাপাইয়াছি, তাই ওই ফন্দিটুকু না করিলে কোন স্কুলে এ বই চলিবে না।’’

তাঁহাকে আর কিছু বলিতে প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু মনে মনে নিজের কপালে করাঘাত করিয়া কহিলাম—যে-রাজ্যের শাসনতন্ত্রে সত্য নিন্দিত, যে-দেশের গ্রন্থকারকে জানিয়াও মিথ্যা লিখিতে হয়,—লিখিয়াও ভয়ে কণ্টকিত হইতে হয়, সে-দেশে মানুষে গ্রন্থকার হইতে চায় কেন? সে-দেশের অসত্য-সাহিত্য রসাতলে ডুবিয়া যাক না! সত্যহীন দেশের সাহিত্যে তাই আজ শক্তি নাই, গতি নাই, প্রাণ নাই। তাই আজ সাহিত্যের নাম দিয়া দেশে কেবল ঝুড়ি ঝুড়ি আবর্জনার সৃষ্টি হইতেছে। তাই আজ দেশের রঙ্গমঞ্চ ভদ্র-পরিত্যক্ত, পঙ্গু, অকর্মণ্য। সে না দেয় আনন্দ, না দেয় শিক্ষা। দেশের রক্তের সঙ্গে তাহার যোগ নাই, প্রাণের সঙ্গে পরিচয় নাই, দেশের আশা-ভরসার সে কেহ নয়—সে যেন, কোন্‌ অতীত যুগের মৃতদেহ। তাই পাঁচ শত বছর পূর্বে কবে কোন্‌ মোগল পাঠানকে জব্দ করিয়াছিল এবং কখন্‌ কোন্‌ সুযোগে মারহাট্টা রাজপুতকে মারিয়াছিল, সে শুধু ইহারই সাক্ষী, এ ছাড়া তাহার দেশের কাছে বলিবার আর কিছু নাই।

দেশের নাট্যকারগণের বুকের মধ্য হইতে যদি কখন সত্য ধ্বনিয়া উঠিয়াছে, আইনের নামে, শৃঙ্খলার নামে রাজসরকারে তাহা বাজেয়াপ্ত হইয়া গেছে; তাই সত্যবঞ্চিত নাট্যশালা আজ দেশের কাছে এমনই লজ্জিত, ব্যর্থ ও অর্থহীন। রুল ব্রিটানিয়া গাহিতে ইংরাজের বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠে, কিন্তু ‘আমার দেশ’ আমার দেশে নিষিদ্ধ। এই যে আজ আসমুদ্র-হিমাচল ব্যাপিয়া ভাবের বন্যা, কর্ম ও উদ্যমের স্রোত বহিতেছে, নাট্যাগারে তাহার এতটুকু স্পন্দন, এতটুকু সাড়া নাই। দেশের মাঝখানে বসিয়াও তাহার দরজা-জানালা ভয় ও মিথ্যার অর্গলে আজ এমনি অবরুদ্ধ যে, দেশজোড়া এতবড় দীপ্তির রশ্মিকণাটুকুও তাহাতে প্রবেশ করিবার পথ পায় নাই। কিন্তু কোন্‌ দেশে এমন ঘটিতে পারিত? আজ মাতৃভূমির মহাযজ্ঞে বুকের রক্ত যাঁহারা এমন করিয়া ঢালিয়া দিতেছেন, কোন্‌ দেশের নাট্যশালা হইতে তাঁহাদের নাম পর্যন্ত আজ এমন করিয়া বারিত হইতে পারিত! অথচ সমস্তই দেশেরই কল্যাণের নিমিত্ত। দেশের কল্যাণের জন্যই আজ দেশের নাট্যকারগণের কলমের গাঁটে গাঁটে আইনের ফাঁস বাঁধা। এবং এমন কথাও আজ সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে হইতেছে যে, দেশের কবি, দেশের নাট্যকারগণের অন্তর ভেদিয়া যে বাক্য, যে সঙ্গীত বাহির হইয়া আসে, দেশের তাহাতে কল্যাণ নাই, শক্তি নাই। বিদেশী রাজপুরুষের মুখ হইতে এ কথাও আজ আমাদের মানিয়া চলিতে হইতেছে। কিন্তু এই নির্বিচারে মানিয়া চলার লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশের আজ সময় আসিয়াছে। এবং ইহা কি শুধু একা আমাদেরই ক্ষুদ্র করিয়া রাখিয়াছে? যে ইহা চালাইতেছে, সে ছোট রয় নাই? আমরা দুঃখ পাইতেছি, কিন্তু মিথ্যাকে সত্য করিয়া দেখাইবার দুঃখভোগ সে-ই কি চিরদিন এড়াইয়া যাইবে? ঋণ-পরিশোধের দুঃখ আছে,—আজ আমাদের ডাক পড়িয়াছে, কিন্তু দেনা শোধ করিবার তলব যেদিন তাহারও ভাগ্যে আসিবে, সেদিন তাহারই কি মুখে হাসি ধরিবে না?

ব্যাপারটা কাগজে-কলমে লোকের চোখে কি ঠেকিতেছে, ঠিক জানি না। হয়ত এই বাঙ্গলাদেশেই এমন মানুষও আছেন, যাঁহাদের কাছে আগাগোড়া তুচ্ছ মনে হওয়াও বিচিত্র নয়;এবং যদি তাই হয়, তবুও আরও এমনি একটা তুচ্ছ ঘটনার উল্লেখ করিয়াই এ প্রসঙ্গ এবারের মত বন্ধ করিব।

সেদিন University Institute- এ ছেলেদের মধ্যে কবিতা আবৃত্তির একটা প্রতিযোগিতার পরীক্ষা ছিল। সর্বদেশপূজিত কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এবার ফিরাও মোরে’ শীর্ষক কবিতাটি নির্বাচিত করা হইয়াছিল। যাহারা পরীক্ষা দিবে, তাহাদেরই একজন আমার কাছে দুই-একটা কথা জানিয়া লইতে আসিয়াছিল। তাহারই কাছে দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম যে, এই সুদীর্ঘ কবিতাটির যাহা সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ,—এই দুর্ভাগা দেশের দুর্দশার কাহিনী যেথায় বিবৃত—সেই অংশগুলিই বাছিয়া বাছিয়া বাদ দেওয়া হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, এ কুকার্য কে করিল?

ছেলেটি কহিল, আজ্ঞে, নির্বাচনের ভার যাঁহাদের উপর ছিল, তাঁহারা।

মনে করিলাম, রত্ন ইঁহারা চিনেন না, তাই, এও বুঝি সেই ছোবড়া-আঁটির ব্যাপার হইয়াছে। কিন্তু ছেলেটি দেখিলাম সব জানে, সে আমার ভুল ভাঙ্গিয়া দিল। সবিনয়ে কহিল, আজ্ঞে, তাঁরা সমস্তই জানেন, তবে কিনা ওতে দেশের দুঃখ-দৈন্যের কথা আছে, তাই ওটা আবৃত্তি করা যায় না—ওটা সিডিশন।

কহিলাম—কে বলিল?

ছেলেটি জবাব দিল—আমাদের কর্তৃপক্ষরা।

যাক,—বাঁচা গেল। কর্তৃপক্ষ এদিকেও আছেন। অর্বাচীন শিশুগুলার মঙ্গল-চিন্তা করিতে এ-পক্ষেও পাকা মাথার অভাব ঘটে নাই। প্রশ্ন করিলাম—আচ্ছা তোমরা এই কবিতাংশগুলি সভায় আবৃত্তি করিতে পার না?

সে কহিল, পারি, কিন্তু তাঁরা বলেন, পারা উচিত নয়,ফ্যাসাদ বাধিতে পারে।

আর প্রশ্ন করিতে প্রবৃত্তি হইল না। দেশের যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, যিনি নিষ্পাপ, নির্মল—স্বদেশের হিতার্থে যে কবিতা তাঁহার অন্তর হইতে উত্থিত হইয়াছে, প্রকাশ্য সভায় তাহার আবৃত্তি সিডিশন—তাহা অপরাধের! এবং এই সত্য দেশের ছেলেরা আজ কর্তৃপক্ষের কাছে শিক্ষা করিতে বাধ্য হইতেছে। এবং কর্তৃপক্ষের অকাট্য যুক্তি এই যে,—ফ্যাসাদ বাধিতে পারে। (‘বাঙলার কথা,’ ২০ই মাঘ ও ৫ ফাল্গুন ১৩২৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *