বাংলাদেশ যাঁর আত্মার সহচর
আখতার হুসেন
আমার বাংলাদেশ: তাকাশি হায়াকাওয়া \ অনুবাদক: কাজুহিরো ওয়াতানাবে \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১১ \ প্রচ্ছদের নামলিপি ও তৈলচিত্র: কাইয়ুম চৌধুরী/এইগো মাসুয়ামা \ মূল্য: এক শ ষাট টাকা
সদ্যই প্রকাশিত হয়েছে কাজুহিরো ওয়াতানাবের অনুবাদে বাংলাদেশের অকৃত্রিম জাপানি সুহূদ তাকাশি হায়াকাওয়ার আমার বাংলাদেশ নামের স্মৃতিকথার বইটি। পড়ে শেষ করার পর মনে হলো, এত দিন কোথায় ছিল এই বই? আলোচনায় যাওয়ার আগে একেবারে শুরুতেই অভিনন্দন জানাই কাজুহিরো ওয়াতানাবেকে তাঁর করা এই বইয়ের সু-অনুবাদের জন্য। কোনো বিদেশির লেখা বাংলা ভাষা যে এতটা ঘরোয়া ও মনোহারি হতে পারে, তাঁর এই বই পড়ে তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেলাম। মনেই হয়নি এ বই জাপানি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন অনুবাদক। খুবই প্রাঞ্জল তাঁর ভাষিক ভঙ্গিটি। বলে রাখা ভালো, এই বই আমরা যেভাবে আবিষ্কার করি, এই বইয়ের অনুবাদকও আকস্মিক ঘটনার যোগেই এর মূল পাঠটি আবিষ্কার করেছিলেন।
সে কথা জানাতে গিয়ে অনুবাদক কাজুহিরো জানাচ্ছেন, ‘২০০৯-এর শরৎকালের একদিন। একটি জাপানি ওয়েবসাইটের অকশন পেইজে চোখ বোলাচ্ছিলাম। বাংলাদেশের নাম লিখে সার্চ করতেই হঠাৎ তাকাশি হায়াকাওয়ার নাম কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে হায়াকাওয়ার নাম অবিস্মরণীয়। তবে এই রাজনীতিবিদ যে বাংলাদেশ নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন তা আমার জানা ছিল না। কয়েক দিন পরেই বইটি পাওয়া গেল কোনোরকম প্রতিযোগিতা ছাড়াই। সত্তর পৃষ্ঠার পাতলা একটা বই। পড়েই বুঝতে পারলাম, বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছর নতুন এই দেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক কীভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, তার পাশাপাশি সেই সম্পর্ক গড়ার কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এক ব্যক্তির সাক্ষ্য পাওয়া যায় এই বইয়ে।’ এবং এ বই পড়ে ‘অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে’ তিনি শুরু করেন তার অনুবাদের কাজ। বলাই বাহুল্য, আমার বাংলাদেশ কেবল তাকাশি হাওয়াকাওয়ার নীরস স্মৃতিকথা হয়ে ওঠেনি, হয়ে উঠেছে মানবিক মূল্যবোধেরও অতুলনীয় এক দলিল।
বইটির গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বামীর স্মৃতি’ শিরোনামে তাকাশি হায়াকাওয়ার সহধর্মিণী মোতায়ে হায়াকাওয়ার একটি অতিসংক্ষিপ্ত রচনা, যেখানে তাঁর স্বামীর পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘১৯৭০ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তখন আমার স্বামী টোকিওর রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদা সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ হন। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সূত্রপাত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি সমর্থন করেন এবং জাপান সরকার যাতে স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়, সেই উদ্দেশ্যে অধীর আগ্রহে কাজ করেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে জাপান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রথম বাংলাদেশে যান। এরপর বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আরও গভীর হয়।
‘তিনি বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করতেন। জাপানে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ভোটারদের সামনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এত বেশি বাংলাদেশের কথা বলতেন যে তাঁর সঙ্গীরা ভোট জোগাড় করার জন্য বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ভাষণে কম তুলে ধরার অনুরোধ করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু তিনি বলতেন, “বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় দেশ, আমি আমার নিজের দেশের কথা বলব না কেন?”’
ওই একই নিবন্ধের সূত্রে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘আমি ছয়বার বাংলাদেশে গিয়েছি। আমার প্রথম বাংলাদেশ সফরের সুযোগ আসে ১৯৭৪ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সে বছর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য স্বামীর সঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ জানান। এই সফরে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি দেখাও করেছিলাম।
শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, তিনি অত্যন্ত উদারমনা মানুষ এবং তিনি এই নতুন দেশকে দাঁড় করাতে পারবেন। তিনি তাঁর বুকের পকেট দেখিয়ে বলেন, “এখানে সব সময়ই আপনাদের জন্য আমন্ত্রণপত্র থাকে, কাজেই যেকোনো সময়ে বাংলাদেশে বেড়াতে আসতে পারেন।” কথাটা এখনো আমার মনে গেঁথে রয়েছে।’
বাংলাদেশ তাঁর কতটা গভীর বন্ধু বা আত্মীয় ছিল তার প্রমাণ মেলে এই ঘটনা থেকেই যে, তিনি এই মর্মে উইল করে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্মের একটা অংশ যেন বাংলাদেশে গচ্ছিত রাখা হয়। তাকাশি হাওয়াকাওয়া মারা যান ১৯৮২ সালে। তাঁর উইল অনুসারে পরবর্তীকালে তাঁর সহধর্মিণী বাংলাদেশে সশরীরে এসে তাঁর দেহভস্ম ঢাকার এক বৌদ্ধমঠে সমাধিস্থ করে যান। এ বইয়ে এ রকম কত যে ঘটনার সমাহার, তার শেষ নেই। চটি বই, কিন্তু ঘরোয়া ভঙ্গিতে তুলে ধরা বাংলাদেশে তাঁর অবস্থান ও সরকারি থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ে তাঁর অবাধ বিচরণের যে বিবরণ এতে তুলে ধরেছেন তাকাশি হায়াকাওয়া, সেটা এককথায় প্রায় বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর রূপ ধারণ করেছে। মানুষটি শেষ পর্যন্ত কূটনীতিকের পোশাক ছুড়ে ফেলে দিয়ে হয়ে উঠেছেন আর দশজন মানুষের মতো। তবে নিশ্চিতভাবেই তিনি যে বিশেষ প্রজাতির মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ রেখে গেছেন গ্রন্থের একেবারে শেষ পরিচ্ছেদে, যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন ‘কূটনৈতিক চেতনা বদলানোর ছয়টি শর্ত’, যার একটিতে তিনি এই মর্মে সুপারিশ করছেন যে, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাজার লাভের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়া চলবে না।’ এই উক্তি তাকে তাঁর নিজের দেশে কোনো ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন করেছিল কি না আমরা জানতে পারিনি। শেষে সংযোজিত ১৬টি ছবি এই বইয়ের মর্যাদা বাড়িয়েছে। আমার বাংলাদেশ-এর আমি বহুল প্রচার কামনা করি।
Leave a Reply