১৩. বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধে মালীর মৃত্যু এবং সুমালী ও মাল্যবানের পাতালে পলায়ন

বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধে মালীর মৃত্যু এবং সুমালী ও মাল্যবানের পাতালে পলায়ন

মাল্যবান রাক্ষস লঙ্কায় রাজ্য করে।
ত্রিভুবন জিনিল সে পিতামহ-বরে।।
মনে করে আমি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর।
সকল দেবতা মেরে ঘুচাইব ডর।।
তবে দেবগণ গেল শিবের গোচর।
কহিল বৃত্তান্ত সদাশিব বরাবর।।
সুকেশের সন্তান দুরন্ত নিশাচর।
বড়ই দৌরাত্ম্য করে স্বর্গের উপর।।
বিশ্বনাথ বলেন শুনহ দেবগণ।
মারিতে আমার সাধ্য নহে কদাচন।।
হইয়াছে দুর্জ্জয় ব্রহ্মার পেয়ে বর।
মরিবে আপন দোষে দুষ্ট নিশাচর।।
দেব দেবী বিপ্র-হিংসা করে যেই জন।
আনার দোষে মরে বেদের লিখন।।
এক উপদেশ বলি শুন দেবগণ।
রাক্ষসে মারিতে পারে দেব নারায়ণ।।
রাক্ষসের কথা গিয়া কহ নারায়ণে।
অবশ্য বিহিত হবে শুন দেবগণে।।
মহেশের আজ্ঞা পেয়ে যতেক অমর।
উপনীত হৈল গিয়া বৈকুণ্ঠ-নগর।।
সম্ভ্রমে দেবতাগণ হয়ে প্রণিপাত।
রাক্ষসের কথা কহে করি যোড়হাত।।
সুকেশ রাক্ষস এক ছিল অবনীতে।
তিন পুত্র হৈল তার বুদ্ধি বিপরীতে।।
দেব দ্বিজ হিংসা করি ফিরে অনুক্ষণ।
স্বর্গপুরে থাকিতে না পারে দেবগণ।।
মারে শেল শূল জাঠা, লোটে সব নারী।
ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছে অমর-নগরী।।
ব্রহ্মার বরেতে তারা কারে নাহি মানে।
যক্ষ রক্ষ কিন্নরাদি নাহি আঁটে রণে।।
সংসারের কর্ত্তা তুমি দেব গদাধর।
রাক্ষসের মারিয়া রক্ষা করহ অমর।।
দেবতার ত্রাস দেখি শ্রীহরির হাস।
সুখেতে অমরপুরে কর গিয়া বাস।।
তোমা সবে হিংসে যদি দুষ্ট নিশাচর।
সেইক্ষণে রাক্ষসে পাঠাব যমঘর।।
আশ্বাস করিল যদি দেব নারায়ণ।
নির্ভয়ে অমরপুরে গেলা দেবগণ।।
জানিয়া নারদ মুনি এ সব সংবাদ।
চলিলেন লঙ্কাপুরে পরম আহ্লাদ।।
বসেছেন তিন ভাই রত্ন-সিংহাসনে।
মুনি দেখি সমাদর কৈল তিন জনে।।
প্রণাম করিয়া দিল রত্ন-সিংহাসন।
জিজ্ঞাসিল কহ মুনি শুনি বিবরণ।।
লঙ্কাপুরে আগমন কিসের কারণ।
বলহ হেথায় তব কোন্ প্রয়োজন।।
মুনি বলে তোমাদের হিত চিন্তা করি।
অমঙ্গল শুনিয়া আইনু লঙ্কাপুরী।।
এক ঠাঁই মিলিয়াছে যত দেবগণ।
যুক্তি করি গিয়াছিল বিষ্ণুর সদন।।
তোমাদের কথা শুনিয়াছে নারায়ণে।
শ্রীহরি করিবে যুদ্ধ তোমাদের সনে।।
হয়েছে মন্ত্রণা এই বৈকুণ্ঠ-ভুবনে।
শুনিয়া আমার বড় দুঃখ হৈল মনে।।
আমার পিতার ভক্ত যত নিশাচর।
বিশেষ অধিক স্নেহ তোদের উপর।।
এ কারণে আইলাম দিতে সমাচার।
মঙ্গলের পথ চিন্তা কর আপনার।।
এত বলি মুনিবর হইল বিদায়।
নিশাচরগণ ভাবে কি হবে উপায়।।
একত্রে বসিয়া যুক্তি করে তিন জন।
হেনকালে ব্রহ্মা এল রাক্ষস সদন।।
তাহার পুরেতে এই শুনে সমাচার।
মনেতে অধিক দুঃখ উপজে ব্রহ্মার।।
যত নিশাচর সব ব্রহ্মার আশ্রিত।
রাক্ষসের মঙ্গল চিন্তেন অবিরত।।
শুনি অমঙ্গল-বাক্য বুঝাইতে হিত।
ক্রোধভরে লঙ্কাপুরে হৈল উপনীত।।
ব্রহ্মা দেখি সম্ভ্রমে উঠিল তিন জন।
প্রণাম করিয়া করে চরণ বন্দন।।
ভক্তিভাবে বসাইল রত্ন-সিংহাসনে।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজা করিল চরণে।।
যোড়হাতে জিজ্ঞাসা করিল তিন জন।
আজ্ঞা কর কি হেতু লঙ্কাতে আগমন।।
এত দিন পবিত্র হইল লঙ্কাপুরী।
যা মনে বাসনা কর সেই কর্ম্ম করি।।
ব্রহ্মা বলে সর্ব্বদা বাসনা করি মনে।
লঙ্কাতে করহ রাজ্য পরম কল্যাণে।।
থাকিলে আমার বাঞ্ছা হইবে কি কর্ম্ম।
ছাড়িতে নারিবি তোরা স্বজাতীয় ধর্ম্ম।।
দেব দ্বিজ হিংসা কর পাপকর্ম্মে মতি।
দুরাচার-স্বভাবেতে ঘটিবে দুর্গতি।।
তিন লোক উপরেতে অমরের পুরী।
দেবতাগণের বাস তাহার উপরি।।
হোম যজ্ঞভাগ দিয়া যে অর্চ্চনা করে।
লইতে যজ্ঞের ভাগ যান তার ঘরে।।
কারো মন্দকারী নহে দেবগণ যত।
ভক্তিভাবে যে ডাকে তাহার অনুগত।।
মুনিগণ ঋষিগণ থাকে তপস্যাতে।
দেখ মন্দকারী কেহ নহে কোনমতে।।
দেব দ্বিজ দুই তুল্য ধর্ম্মপথে মন।
তার হিংসা যে করে সে দুর্ম্মতি দুর্জ্জন।।
অতি অল্প আয়ু তোরা ধর্ম্মেতে বিহীন।
দেবহিংসা করিয়া বাঁচিবি কতদনি।।
হইয়াছে একযুক্ত যত দেবগণ।
দেবতার সহায় হয়েছে নারায়ণ।।
বিষ্ণুসনে যুঝিবেক কাহার শকতি।
একজন না থাকিবে বংশে দিতে বাতি।।
এত বলি কোপমনে ব্রহ্মার গমন।
বিরলে বসিয়া যুক্তি করে তিন জন।।
মাল্যবান বলে ভাই শঙ্কা ত্যজ মনে।
তিন জনে যুদ্ধ করি মার নারায়নে।।
মাল্যবান-কথা শুনি কহিছে সুমালী।
শুনিয়াছি নারায়ণ বলে মহাবলী।।
হিরণ্যকশিপু আদি করিছে সংহার।
হেন বিষ্ণু মারে বল শক্তি আছে কার।।
মালী বলে সংগ্রামেতে বিনাশিব তারে।
আর যেন দেবগণ যুদ্ধ নাহি করে।।
বিষ্ণু বড় কুচক্রী কুযুক্তি যত তার।
সে মরিলে দেবগণের টুটে অহঙ্কার।।
তিন ভাই মিলি আগে মারি নারায়ণ।
পশ্চাতে মারিব আছে যত দেবগণ।।
মুনি ঋষি মারিব, মারিব সিদ্ধ যতি।
ঘুচাইব দেবতার স্বর্গের বসতি।।
এত বলি তিন জনে যুক্তি কৈল সার।
ঘোড়া হাতী রথ রথী সাজিল অপার।।
তুলিল কটক-ঠাট রথের উপরে।
বৈকুণ্ঠে চলিল তারা বিষ্ণু-জিনিবারে।।
সিংহনাদ ঘোর শব্দ করে ঘনে ঘন।
বৈকুণ্ঠের দ্বারে গিয়া দিল দরশন।।
গরুড়-বাহনেতে আইলা নারায়ণ।
নারায়ণ সম্মুখেতে বাজে মহারণ।।
মহাকোপে নানা অস্ত্র মারে নিশাচর।
বাণ-বৃষ্টি করিতেছে বিষ্ণুর উপর।।
ছাইল গগন-পথ দিগ্ দিগন্তর।
পড়িছে অসংখ্য বাণ পট্টিশ তোমর।।
জাঠাজাঠি শেল শূল মুষল মুদগর।
লেখা জোখা নাহি বাণ পড়িছে বিস্তর।।
নারায়ণ বীরদাপে ত্রিভুবন নড়ে।
রাক্ষসের সৈন্য সব মূর্চ্ছা হয়ে পড়ে।।
কুপিল সুমালী মালী রণে আগুসরে।
দুহাতিয়া বাড়ি মারে গরুড়ের শিরে।।
ঝঞ্ঝনা চিকুর সম গদাবাড়ি পড়ে।
বিষ্ণু লয়ে গরুড় পলায় উভরড়ে।।
গরুড়ের ভঙ্গ দেখি মাল্যবান হাসে।
শ্রীহরি ফিরান তারে করিয়া আশ্বাসে।।
বিষ্ণু বলে গরুড় তিলেক থাক রণে।
পাঠাব রাক্ষসগণে যমের সদনে।।
তোমার সংগ্রামে ত্রিভুবন লাগে ভয়।
রাক্ষসের রণে পলাও উচিত না হয়।।
উলটিয়া গরুড় আইল মহারণে।
চক্রবাণ বিষ্ণু এড়িলেন ততক্ষণে।।
চক্রবাণে মালীর মস্তক কাটি পাড়ে।
মাল্যবান সুমালী পলায় উভরড়ে।।
পুনঃ ফিরে নিশাচর নাহি দেয় ভঙ্গ।
লোহার মুদগর হানে ভয়ে কাঁপে অঙ্গ।।
মাল্যবান বলে ‍তুমি থাকহ শ্রীহরি।
আজি রণে তোমারে পাঠাব যমপুরী।।
শ্রীহরি বলেন বেটা শুন মাল্যবান।
প্রতিজ্ঞা করেছি আমি দেবতার স্থান।।
অভয় হইয়া গেছে যতেক অমর।
তোরে মেরে ঘুচাইব দেবতার ডর।।
অবনীতে থাকিলে বধিব সবাকারে।
প্রাণ লয়ে যাহ বেটা পাতাল ভিতরে।।
মাল্যবান বলে বিষ্ণু কথা বড় টান।
রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধে হারাইবি প্রাণ।।
মালসাট দিয়া তবে গেল মূল্যবান।
যত শক্তি আছে তোর তত শক্তি হান।।
বিক্রম করিয়া রহে হরির সম্মুখে।
অগ্নিবাণ শ্রীহরি মারেন তার বুকে।।
অগ্নিবাণে রাক্ষসের সর্ব্ব অঙ্গ পোড়ে।
সহিতে না পারে বীর ধায় উভরড়ে।।
শ্রীহরির কোপেতে রাক্ষসে লাগে ডর।
পলায়ে রাক্ষস গেল পাতাল ভিতর।।
হরির ভয়েতে সবে প্রবেশে পাতাল।
কুবের লঙ্কায় বসি করে ঠাকুরাল।।
প্রথমে লঙ্কাতে রাজা মালী ও সুমালী।
পরে রাজ্য করিল কুবের মহাবলী।।
চৌদ্দযুগ রাজ্য করে লঙ্কায় রাবণ।
তোমার প্রসাদে রাজা এবে বিভীষণ।।
রাবণে বধিলে তুমি শক্তি অতিশয়।
রাবণ হইয়াছিল রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
অগস্ত্যের কথা শুনি রামের উল্লাস।
কহ কহ বলি রাম করিলা প্রকাশ।।