০৪৮. কুম্ভ-নিকুম্ভ বধ

তবে ভীত হয়ে যত নিশাচরগণ।
কুম্ভকর্ণ-পুত্র কাছে করে পলায়ণ।।
তাহা দেখি যাবতীয় বানর-নিকর।
ঘন ঘন সিংহনাদ করে ঘোরতর।।
তাহা দেখি কুম্ভ বীর অধিক কুপিল।
স্বসৈন্যে সান্ত্বনা করি সমরে সাজিল।।
কুম্ভ বীরে দেখিয়া পলায় কপিগণ।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আর বালির নন্দন।।
সাহসে করিয়া ভর গেল তিন জন।
কুম্ভের সহিত গিয়া আরম্ভিল রণ।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র তবে দুই বীরবর।
গাছ পাথর লয়ে গেল সংগ্রাম ভিতর।।
গাছ পাথর কাটি পাড়ে চোখ চোখ শরে।
বিন্ধিয়া জর্জ্জর কৈল মহেন্দ্র বানরে।।
মহেন্দ্রে কাতর দেখি দেবেন্দ্র চিন্তিত।
ত্রিশ যোজন পর্ব্বত এক আনিল ত্বরিত।।
ত্রিশ যোজন পর্ব্বত এড়িল দিয়া টান।
কুম্ববীরের বাণেতে হইল খান খান।।
বাণেতে পর্ব্বত কেটে খান খান করে।
বিন্ধিয়া জর্জ্জর করে দেবেন্দ্র বানরে।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র দোঁহে হৈল অচেতন।
কোপেতে পর্ব্বত এড়ে বালির নন্দন।।
অঙ্গদের পর্ব্বত বাণেতে ফেলে কেটে।
শত বাণ অঙ্গদের মারিল ললাটে।।
বাণেতে অঙ্গদ-বীর ডাকে পরিত্রাহি।
সকল বানর গেল রঘুনাথের ঠাঁই।।
তিন বীর অচেতন শুনি এই কথা।
মনেতে শ্রীরামচন্দ্র পাইলেন ব্যথা।।
ঋষভ কুমুদ আর সুষেণ সেনাপতি।
তিন বীরে রঘুনাথ করিলা আরতি।।
শ্রীরামের আজ্ঞা পেয়ে চলে তিন জন।
আকাশ ছাইয়া করে বৃক্ষ বরিষণ।।
কুপিল যে কুম্ভ-বীর পূরিয়া সন্ধান।
তিন বীরের গাছ পাথর করে খান খান।।
জর্জ্জর হইল তারা কুম্ভবীরের বাণে।
ভয় পাইয়া তিন জনে ভঙ্গ দিল রণে।।
তিন বীর পলাইয়া সুগ্রীবের কয়।
রুষিল সুগ্রীব-রাজা সমরে দুর্জ্জয়।।
কুপিয়া সুগ্রীব-বীর এক লাফে যায়।
পাকল করিয়া আঁখি কুম্ভবীরে চায়।।
কুম্ভ বলে, বানরা বেড়াস ডালে ডালে।
এত তোর বিক্রম না ছিল কোনকালে।।
সুগ্রীব বলিছে দ্বন্দ্ব নাহি কারো সনে।
না জান বিক্রম তুমি এই সে কারণে।।
তোর সনে রণে করি বিক্রম পরীক্ষা।
পড়িলি আমার হাতে নাহি তোর রক্ষা।।
যমরাজা জেগে বসে আছে তোর তরে।
দেখাব বিক্রম আজি যাবি যমঘরে।।
তোর পিতা কুম্ভকর্ণ সে জানে বিক্রম।
ক্ষণেক বিলম্ব কর দেখাইব যম।।
কুপিয়া যে কুম্ভবীর তীক্ষ্ণ বাণ যোড়ে।
তিন শত বাণ রাজা সুগ্রীবেরে এড়ে।।
বাণ খেয়ে সুগ্রীব যে চিন্তিত অন্তর।
লাফ দিয়া পড়ে তার রথের উপর।।
ধনুক ধরিয়া টানে কেড়ে নিতে নারে।
রথ হৈতে কুম্ভবীর ফেলে সুগ্রীবেরে।।
আছাড় খাইয়া রাজা হৈল অচেতন।
চেতন পাইয়া পুনঃ বলে ততক্ষণ।।
তোর বাপের জাঠা যে নিলাম এক হাতে।
তোর হাতের ধনুখান নারিনু ছাড়াতে।।
বাপের সমান তুই বীর-চূড়ামণি।
ইন্দ্রজিতার সম তোর ধনুক বাখানি।।
কুম্ভ-বীর বলে, ধনু দূরে পরিহরি।
রিক্তহস্তে এস না দুজনে যুদ্ধ করি।।
অস্ত্র ফেলে দুই জনে করে হুড়াহুড়ি।
হুড়াহুড়ি ঘুচিলে লাগিল জড়াজড়ি।।
কুম্ভবীর চাপড় মারিল বাহুবলে।
পড়িল সুগ্রীব-রাজা সমুদ্রের জলে।।
রামের কিঙ্কর দেখি সাগর গভীর।
মধ্যে চড়া পড়িয়া হইল অল্প নীর।।
মাটিতে দাণ্ডায়ে ফিরে আইল এক লাফে।
কুম্ভবীরের বিক্রমে সুগ্রীব রাজা কাঁপে।।
পুনঃ কোপে কুম্ভবীর মুষ্ট্যাঘাত করে।
পড়িল সুগ্রীব রাজা দুর্জ্জয় প্রহারে।।
চৈতন্য হরিয়া মুখে রক্ত উঠে ফেণা।
সুমেরু পর্ব্বতে যেন পড়িল ঝঞ্ঝনা।।
সম্বিত পাইয়া উঠি বানরের নাথ।
কুম্ভবীর উপরে করিল পদাঘাত।।
মহাকোপে কুম্ভবীর ধরে সুগ্রীবেরে।
দুইজনে মল্লযুদ্ধ কেহ নাহি হারে।।
দুই সিংহে যুদ্ধে যেন ছাড়ে সিংহনাদ।
দুই বীর মহাযুদ্ধ নাহি অবসাদ।।
লাফেতে সুগ্রীব তার রথোপড়ি চড়ে।
দুই মাতঙ্গের দন্ত দুহাতে উপাড়ে।।
লইয়া হস্তীর দন্ত কুম্ভবীরে হানি।
দন্তাঘাতে কুম্ভের জর্জ্জর হলো প্রাণী।।
ঊর্দ্ধেতে কুম্ভেরে তুলি মারিল আছাড়।
মাথার খুলি ভাঙ্গি গেল চূর্ণ হৈল হাড়।।
দেখিয়া নিকুম্ভ বীর ভায়ের মরণ।
সুগ্রীবে রুষিয়া যায় করিয়া তর্জ্জন।।
নিকুম্ভের মুষল যে পর্ব্বত সোসর।
মুষল মারিতে যায সুগ্রীব উপর।।
দম্ভ করে মুষলেতে যন দেয় পাক।
ঘুরায় মুষল যেন কুম্ভকার-চাক।।
বিক্রম করিয়া ছুটে সংগ্রামের স্থলে।
প্রবল আগুন যেন ঘৃত পাইলে জ্বলে।।
নিকুম্ভের বিক্রম দেখিয়া লাগে ডর।
ভয়ে পলাইয়া গেল সুগ্রীব বানর।।
ভয়েতে সুগ্রীব-রাজা নহে আগুয়ান।
সুগ্রীবের ভঙ্গ দেখি রোষে হনুমান।।
সেবক থাকিতে তোর রাজা সনে রণ।
তোতে মোতে যুঝি দেখি মরে কোন্ জন।।
নিকুম্ভ কহিছে বেটা ঘরপোড়া শুন।
তোরে পাইলে আর নাহি চাহি অন্যজন।।
এত যদি দুইজনে হৈল গালাগালি।
দুই জনে যুদ্ধ বাজে দোঁহে মহাবলী।।
লোহার মুষল ছিল নিকুম্ভের হাতে।
রুষিয়া মারিল বীর হনুমানের মাথে।।
হনুমানের মাথা যেন বজ্রের সমান।
মাথায় মুষল গোটা হৈল খান খান।।
হনুমান বলে, তোর মুষল গেল তল।
মোর ঘা সহ রে বেটা তবে জানি বল।।
আপনা পাসরে কোপে বীর হনুমান।
নিকুম্ভে মারিল চড় বজ্রের সমান।।
চাপড় খাইয়া বীর কাঁপে থরথরি।
ভঙ্গ নাহি দেয় রণে বিক্রম কেশরী।।
হনুমানের পানে বীর চাহে এক দৃষ্টি।
কোপে হনুমানের বুকে মারে বজ্রমুষ্টি।।
মুষ্ট্যাঘাতে হনুমান হইল অচেতন।
হনু কোলে করি যায় ভেটিতে রাবণ।।
প্রথম বৃহন্দে যায় কোপে করি ভর।
দ্বিতীয় বৃহন্দে ফিরে চলে নিশাচর।।
উঠে ধায় নিকুম্ভ যে পরম হরিষে।
হনুমানে দেখিতে রমণী সব আইসে।।
নিকুম্ভেরে ধন্য ধন্য নারীগণ বলে।
ভাল কৈলে ঘরপোড়ায় ধরিয়া আনিলে।।
সুগ্রীবেরে বন্দী করেছিল তোমার বাপে।
ঘরপোড়া হৈল বন্দী তোমার প্রতাপে।।
ঘরপোড়া বেটা ঘর পোড়াইতে মন।
সমুদ্র লঙ্ঘিয়া আসে দুর্জ্জয় এমন।।
নিকুম্ভের কোলে হনু পাইল চেতন।
কি বুদ্ধি করিবে হনু ভাবিছে তখন।।
সর্ব্ব অঙ্গ বিদাড়িল আঁচড় কামড়ে।
দুই কাণ ছিঁড়ি নিল হাতের মোচড়ে।।
পরিত্রাহি ডাকে বীর ছাড় ছাড় বলে।
ভয় পাইয়া তুলে ফেলে গগন-মণ্ডলে।।
অন্তরীক্ষে লাফ দিল হাতে দুই কাণ।
নিকুম্ভের স্কন্ধে চড়ে বীর হনুমান।।
হাতে চুল জড়ায়ে মস্তক ছিঁড়ে ফেলি।
মুণ্ড লয়ে যায় হনুমান মহাবলী।।
সিংহনাদ শব্দে চলে পবনের বেগে।
এক লাফে উপনীত শ্রীরামের আগে।।
নিকুম্ভের মুণ্ড দেখে রঘুনাথের হাস।
নিকুম্ভের বিনাশ গাহিল কৃত্তিবাস।।