০৪৭. কুম্ভ ও নিকুম্ভাদির যুদ্ধ ও পতন

রাবণ বলে নাহি সহে প্রাণে অপমান।
থাকিলে কপাট দিয়া নাহিক এড়ান।।
কপাট দিলে পোড়ায় ঘর যুদ্ধ হৈল সার।
যুদ্ধ বিনা নিস্তার নাহিক দেখি আর।।
কুম্ভ ও নিকুম্ভ কুম্ভকর্ণের নন্দন।
ডাক দিয়া আনাইল রাজা দশানন।।
দুই ভাই আসিয়া রাজাকে নোঙায় মাথা।
রাবণ বলে, দেখ বাপু লঙ্কার অবস্থা।।
বিক্রমেতে অতুল, তোমরা দুটি ভাই।
ত্রিভুবন পরাভব তোমা দোঁহার ঠাঁই।।
আমি জয়ী তোমার পিতার বাহুবলে।
কুম্ভকর্ণ-শোকে আমি ভাসি অশ্রুজলে।।
কুম্ভকর্ণ বিনা লঙ্কাপুরী শূন্যাকার।
নর বানরের হাতে নাহিক নিস্তার।।
ইন্দ্রযুদ্ধে উদ্ধারিল তোমাদের পিতে।
তোমরা রাখহ নর-বানরের হাতে।।
সেই পুত্র জন্ময়ে কুলের অলঙ্কার।
পিতৃশত্রু মারিয়া শোধে পিতার ধার।।
রাজাজ্ঞা পাইয়া দোঁহে রথে গিয়া চড়ে।
হস্তী ঘোড়া ঠাট সৈন্য নড়ে মুড়ে মুড়ে।।
সৈন্যের পায়ের ভরে কম্পিতা মেদিনী।
দুই ভায়ের সঙ্গে ঠাট আট অক্ষৌহিণী।।
সংগ্রাম করিতে যাত্রা করে দুই বীর।
দেখাদেখি হৈল গিয়া গড়ের বাহির।।
দুর্জ্জয় শরীর যেন পর্ব্বত আকার।
পশ্চিম দুয়ারে গেল করি মার মার।।
রাক্ষস বানর ঠাট মিশামিশি হৈল।
গাছ পাথর লয়ে বানর যুঝিবারে এল।।

তবে দুই দলে,                     কোপেতে পাগল,
পরস্পরে দেয় গারি।
অনল নিকরেম                    বিরল তিমিরে,
করিতেছে মারামারি।।
যত নিশাচর,                    ধরি ধনুঃশর,
কঠোর কুঠার ফিরি।
বানর উপরে,                    সম্প্রহরি করে,
চক্র গদা অসি ধরি।।
তাহে কারো মুণ্ড,                    কারো ভুজদণ্ড,
কারো বুক ফাটে বলে।
কারো ঊরু-মূল,                    কাহারো লাঙ্গুল,
কারো হস্তপদ গলে।।
কোন জনে শর,                     বিন্ধিয়া জর্জ্জর,
করিতেছে কোন জন।
কারো গদাঘাতে,                    ভাঙ্গে বুক হাতে,
খড়্গে করি বিদারণ।।
তাহে কপি সব,                    করি ঘোর রব,
গিরি তরু শিলাগণ।
ফেলি ফেলি মারে,                    রাক্ষস উপরে,
করে উল্কা নিক্ষেপণ।।
তাহে চূর্ণ করে,                    কত রাত্রিচরে,
কারো ভাঙ্গে শির বুক।
কারো উল্কানলে,                    দহে মুণ্ড গলে,
কারো মুখ সকৌতুক।।
কেহ মুষ্টিঘাতে                     ভাঙ্গে কারো মাখে,
বুক ভাঙ্গে পদাঘাতে।
দশন নখরে,                    বিদারণ করে,
বুক পাশ পেট মাথে।।
কাহারো ঘোড়ারে,                     আছাড়িয়া মারে,
কোন কপি কারো গজে।
কেহ মারি লাথে,                    ভাঙ্গে কারো রথে,
সসারথি হয় ধ্বজে।।
কত নিশাচর,                     ত্যজি অসি শর,
হাতাহাতি রণ করে।
কেহ মারে চড়,                    কেহ বা চাপড়,
কেহ মুটকী প্রহারে।।
পাঁচ সাত জন,                    রাক্ষস মিলন,
ধরি এক কপিবরে।
অস্ত্রাদি প্রহারে,                    ছিন্ন ভিন্ন করে,
কাহারো পরাণ হরে।।
সেই অনুসারে,                    এক নিশাচরে,
অনেক বানর ধরি।
মারে চড় কীল,                     বহুতর শিল,
বিদারয়ে নখে করি।।
এরূপ তুমুল,                    সমরে ব্যাকুল,
কান্দে কপি জাম্ববান।
মোলরে মোলরে,                     গেলরে গেলরে,
আর না রহিল প্রাণ।।
যত বীর সব,                    করি ঘোর রব,
কহিতেছে বার বার।
ধর ধর ধর,                    মার মার মার,
না রাখিব রিপু আর।।
এইত প্রকারে,                    তুমুল সমরে,
মাতিয়া কোপের ভরে।
কবিবর ভণে,                    রাম দশাননে,
সেনা হানাহানি করে।।

তার মধ্যে বজ্রকণ্ঠ নামে নিশাচর।
মারিলেক গাঢ় গদা অঙ্গদ উপর।।
কিছুকাল কাঁপি তাহে কপীন্দ্র-কুমার।
সুস্থ হৈয়া শীঘ্র পুনঃ কৈল আগুসার।।
করে ধরি একখান শিখরি-শিখর।
মারিলেক বজ্রকণ্ঠ-মস্তক উপর।।
তাহার প্রহারে প্রাণ পরিত্যাগ করি।
বজ্রকণ্ঠবীর পড়ে বসুধা উপরি।।
তাহা দেখি কোপেতে কম্পিত সকম্পন।
রণে প্রবেশিল করি রথে আরোহণ।।
সেহ বেগে বৃষ্টি করি বাণ বহুতর।
অঙ্গদের অঙ্গগণে করিল জর্জ্জর।।
শত্রুসুত-সুত সহি যে সকল শরে।
লাফিয়া উঠিল বীর রথের উপরে।।
তার কর হৈতে কোদণ্ড কাড়ি লৈয়া।
চরণ-চাপণে তারে ফেলিল ভাঙ্গিয়া।।
পদাঘাতে রথখান করি প্রমথন।
নাশিলা নখরে করি তুরঙ্গমগণ।।
স্যন্দন ছাড়িয়া তবে সেই সকম্পন।
আকাশে উঠিল খড়্গ করিয়া ধারণ।।
তাহা দেখি মহাবল বালির নন্দন।
লম্ফ দিয়া তার পাছে করিল ধাবন।।
কিঞ্চিৎ দূরেতে তারে বলে করে ধরি।
কাড়িয়া লইল তার খড়্গ আর ফরী।।
তবে সিংহনাদ করি অতি কুতূহলে।
সেই খড়্গ ধরি কোপ দিলা তার গলে।।
তাহে ছিন্ন হয়ে সেই যেন উপবীত।
আকাশ হইতে হৈল ভূতলে পতিত।।
তবে সিংহনাদ করি বালির কুমার।
ভূতলে নামিয়া শব্দ করে মার মার।।
তবে শোণিতাক্ষ বীর লৌহ-গদা ধরি।
উপস্থিত হইল অঙ্গদ বরাবরি।।
প্রজঙ্ঘ যূপাক্ষ নামে আর দুই জন।
রথে চড়ি তার কাছে করিল ধাবন।।
শ্রীমৈন্দ দ্বিবিদ দুই বীর তা দেখিয়া।
অঙ্গদের দুই পাশে দাঁড়াল আসিয়া।।
তবে সেই নিশাচর তিন জন সঙ্গে।
তিন কপিবীর যুদ্ধ আরম্ভিল রঙ্গে।।
নানা বৃক্ষ উপাড়িয়া কপি তিন জন।
করিতেছে তিন নিশাচরে নিক্ষেপণ।।
তাহা দেখি খড়্গ ধরি রাক্ষস প্রজঙ্ঘ।
খণ্ড খণ্ড করি কাটে সেই বৃক্ষসঙ্ঘ।।
তবে সেই তিনজন শাখা-মৃগবর।
নিক্ষেপ করিলা রথ তুরঙ্গ কুঞ্জর।।
নিরীক্ষণ করিয়া যূপাক্ষ রনে দক্ষ।
কাটিল সে সব ছাড়ি শর লক্ষ লক্ষ।।
তবে পুনঃ শ্রীমৈন্দ দ্বিবিদ বালি-সুত।
বর্ষণ করিল বৃক্ষ বহুত বহুত।।
শোণিতাক্ষ সে সকল সত্বর হইয়া।
চূর্ণিত করিল গুরু গদা ঘুরাইয়া।।
পরেতে প্রজঙ্ঘ খরশান খড়্গ ধরি।
বালিপুত্রে মারিবারে আসে বেগ করি।।
নিকটে নিরখি তারে তারায় তনয়।
সন্ধান করিলা শালশাখী অতিশয়।।
সেইত তরুতে তারে তাড়ন করিল।
আর তার বাহুমূলে মুটকি মারিল।।
প্রজঙ্ঘের বাহু তারে বিষণ্ণ হইল।
হস্ত হৈতে খড়্গখান খসিয়া পড়িল।।
স্থির হয়ে প্রজঙ্ঘ পরেতে কিছুকালে।
মারিল মহৎ মুষ্টি অঙ্গদ-কপালে।।
তাহে দুই দণ্ডকাল হয়ে অচেতন।
চেতন হইয়া পুনঃ বালির নন্দন।।
সুগভীর সিংহ-শব্দ করি কোপভরে।
প্রজঙ্ঘ-মস্তকে মুষ্টি মারিল নির্ভরে।।
তাহাতে বিদীর্ণ হৈল মহামুণ্ড তার।
পড়িল সে যেন বজ্রহত শৈল-সার।।
ক্ষীণশর হইয়া যূপাক্ষ খড়্গ ধরি।
মারিবারে ধায় তথা রথ পরিহরি।।
তবে সে যূপাক্ষ মুটকি মারিয়া।
ধরিল শ্রীমৈন্দ তাহে বাহুতে বেড়িয়া।।
হেনই সময়ে শোণিতাক্ষ মহাসার।
দ্বিবিদের বক্ষে কৈল গদার প্রহার।।
তাহে ঘাত হয়ে সেই অশ্বীর-নন্দন।
কিছুকাল হইল কাতর অচেতন।।
পুনঃ শোণিতাক্ষ যবে ঘুরায় গদারে।
সেই কালে ধরি কাড়ি লইল তাহারে।।
তবেত যুপাক্ষ শোণিতাক্ষ দুই জন।
শ্রীমৈন্দ দ্বিবিদ সঙ্গে করে বাহু-রণ।।
কেহ কোন জনে কভু করে আকর্ষণ।
কেহ কোন জনে করে দৃঢ় আলিঙ্গণ।।
কেহ কোন জনে কভু ঠেলি লয়ে যায়।
কেহ কোন জনে কভু বলেতে ঘুরায়।।
কেহ কোন জনে কভু তোলে উপরেতে।
কেহ কোন জনে কভু ফেলে ধরণীতে।।
মধ্যে মধ্যে মুষ্ট্যাঘাত করাঘাত করে।
কভু বিদারণ করে দশন নখরে।।
এইরূপে কিছুকাল হৈল তুল্য রণ।
পরে অতি কুপিল কপীন্দ্র দুইজন।।
তার মধ্যে শোণিতাক্ষে দ্বিবিদ বানর।
নখে বিদারণ করি করিল জর্জ্জর।।
আর তার দুই ভুজ ধরি ঘুরাইয়া।
মারিল তাহাকে ভূমিতলে আছাড়িয়া।।
শ্রীমৈন্দ যূপাক্ষ সনে করি বহুরণ।
পরে তারে ভুজে ধরি করিল চাপন।।
তাহাতে যূপাক্ষ করি শব্দ ঘোরতর।
চলি গেল দেখিবারে প্রেত-পুরীশ্বর।।
তবে বিরূপাক্ষ নামে এক নিশাচর।
কপি-সৈন্য উপরে বর্ষণ করে শর।।
তার শর প্রহার সহিতে না পারিয়া।
পলায় বানর সব সমর ত্যজিয়া।।
তাহা দেখি মৈন্দ এক মহীধর ধরি।
নিক্ষেপিল বিরূপাক্ষ-মস্তক উপরি।।
তাহে হত হৈয়া বিরূপাক্ষ নিশাচর।
ভূতলে পড়িল যেন ছিন্ন ধরাধর।।
তবে মৈন্দ মহাঘোর সিংহনাদ করি।
বধিতে লাগিল মুষ্টি মারি সব অরি।।
তাহা দেখি বিদ্যুন্মালী নামে যাতুধান।
রথে থাকি বৃষ্টি করে বহুতর বাণ।।
দশদিক আচ্ছাদন করি সেই শরে।
বিন্ধিতে লাগিল যত ভল্লুক বানরে।।
তার শরাঘাতে কেহ স্থির হৈতে নারে।
বাসনা করয়ে রণ ছাড়ি পলাবারে।।
তাহা নিরখিয়া নল লয়ে তরু শিলা।
বিদ্যুন্মালী বধিবারে বর্ষিতে লাগিলা।।
সেহ শত শত শর করিয়া বর্ষণ।
সেই সব শাখী শিলা করিলা কর্ত্তন।।
পুনশ্চ নলের প্রাণ বিনাশ করিতে।
কোদণ্ড কর্ষিয়া কাণ্ড লাগিল এড়িতে।।
যে সকল শরে বিশ্বকর্ম্মার নন্দন।
শাল শিলা ফেলাইয়া করিল বারণ।।
এইরূপে নল বৃষ্টি করে বৃক্ষগণ।
বিদ্যুন্মালী করে তাহা বাণেতে ছেদন।।
বিদ্যুন্মালী যাবতীয় শর-বৃষ্টি করে।
নল তাহা নিবারয়ে পাদপ প্রস্তরে।।
এইরূপে ক্ষণকাল সেই দুই জন।
করিলেক সমভাবে ঘোরতর রণ।।
তবে সেই নিশাচর নিঃশর হইয়া।
কহিতেছে নল প্রতি চাতুরী করিয়া।।
বিশ্বকর্ম্মা-পুত্র আমি তোমা সঙ্গে রণে।
বড়ই আনন্দ পাইলাম আজি মনে।।
দেখিয়া তোমার বল বিক্রম অপার।
ইচ্ছা হয় বাহু-যুদ্ধ করিতে আমার।।
বলিতেছে বিশ্বকর্ম্মা-নন্দন তাহারে।
আমার বাসনা এই অন্তর মাঝারে।।
তাহা শুনি রথ হৈতে রাক্ষস নামিল।
তবে দুই বীর বাহু-যুদ্ধ আরম্ভিল।।
হাতে হাতে ভুজে ভুজে কপালে কপালে।
বুকে বুকে প্রহার করয়ে দুই শালে।।
উন্মত্ত মাতঙ্গ যেন দশনে দশনে।
যুদ্ধ করে হেন শব্দ হয় ঘনে ঘনে।।
বজ্রের সমান অঙ্গ উভয়েরি হয়।
কাহারো প্রহারে কোন জন ব্যগ্র নয়।।
কভু বাহু প্রহার করয়ে কোন জন।
বজ্রে সে করয়ে যেন বিকট নিঃস্বন।।
কভু নলে ঠেলি লয়ে যায় বিদ্যুন্মালী।
কভু বিদ্যুন্মালীরে সে নল বলশালী।।
কভু আকর্ষয়ে, কভু করে উত্তোলন।
কভু চাপি ধরে কভু করয়ে পাতন।।
মুষ্টি দন্ত নখ কভু করয়ে প্রহার।
দুই সিংহে করে যেন যুদ্ধ অনিবার।।
এইরূপে দুই দণ্ড কাল দুই জন।
করিলেক ন্যূনাধিক্য শূন্য বাহু-রণ।।
তবেত নলের বল না পারি সহিতে।
বিদ্যুন্মালী তার হস্ত ছাড়াল শ্রান্তিতে।।
পুনর্ব্বার রথে শীঘ্র করি আরোহণ।
অতি ঘোর শক্তি এক করিল ধারণ।।
তাহা দেখি নল এক গিরিশৃঙ্গ ধরি।
বিদ্যুন্মালী উপরে ছাড়িল ক্রোধ করি।।
সেই শৃঙ্গে পাড়ে রথ সারথি সহিত।
বিদ্যুন্মালী প্রাণ ত্যজি হইল চূর্ণিত।।