৩৫. শ্রীরামচন্দ্র কর্ত্তৃক সমুদ্র শাসন এবং শ্রীরামের প্রতি সাগরের সেতু বন্ধনের উপদেশ

সুগ্রীব বলেন, সিন্ধু তরিতে উপায়।
বিভীষণ প্রতি জিজ্ঞাসিতে যে যুয়ায়।।
শ্রীরাম বলেন বিভীষণ বল সার।
কি প্রকারে সাগর হইব আমি পার।।
বিভীষণ বলে, সে সগর মহীপতি।
সাগর খনিল, তুমি তাঁহার সন্ততি।।
তব পূর্ব্বপুরুষেরা সাগর প্রকাশে।
সাগর দিবেন দেখা থাক উপবাসে।।
সাগরের কূলে শর্য্য করিলেন কুশে।
তদুপরি রহিলেন রাম উপবাসে।।
তিন উপবাস গেল না দেখি সাগরে।
কহিলেন লক্ষ্মণেরে ক্রোধিত অন্তরে।।
আজি আমি সাগরেরে দিব ভাল শিক্ষা।
ধনুর্ব্বাণ আন ভাই কিসের অপেক্ষা।।
অধমে করিলে স্তব নাহি ফল দেখে।
মারিব সাগরে আজি কার বাপে রাখে।।
তিন উপবাস করি তার উপাসনে।
সাগর শুষিব আজি অগ্নিজাল বাণে।।
আজি সাগরের আমি লইব পরাণ।
অগ্নিজাল বাণে রাম পূরেন সন্ধান।।
অগ্নিবাণ প্রভাবেতে শুখায় সাগর।
পুড়িয়া মরিল মৎস্য কুম্ভীর মকর।।
চলিল পাতাল সপ্ত সাগরের পাশ।
বাণ দেখি সাগরের লাগিল তরাস।।
ভয় পেয়ে সাগর কাঁপয়ে থর থর।
মাথায় ধবল ছত্র চলিল সত্বর।।
বাণ গিয়া প্রবেশিল শ্রীরামের তূণে।
সাগর পড়িল আসি রামের চরণে।।
এত ক্রোধ মোরে কেন শুন গদাধর।
তব পূর্ব্ব বংশ এই করিল সাগর।।
তুমি মোরে নষ্ট কর এ নহে বিচার।
কোন্ অপরাধ আমি করিনু তোমার।।
শ্রীরাম বলেন, শুন নৃপতি সাগর।
তিন দিন উপবাসী আছি তব তীর।।
মোর সীতা চুরি কৈল পাপিষ্ঠ রাবণ।
লঙ্কায় যাইব তার উদ্দেশ কারণ।।
বানর কটক সব হইবেক পার।
উপবাস দিয়া দেখা না পাই তোমার।।
এই হেতু অগ্নিবাণ জলেতে ছাড়িনু।
তুমি না আসাতে আমি বাণ যে মারিনু।।
আড়ে দশ যোজন দীর্ঘে দশগুণ তার।
জল ছাড়ি দেহ তুমি বানর হউক পার।।
এত শুনি যোড়হস্তে বলেন সাগর।
মোর জল মিশিয়াছ পাতাল ভিতর।।
কেমনে হইবে পথ না দেখি উপায়।
এক যুক্তি আছে রাম কহিব তোমায়।।
বিশ্বকর্ম্মা পুত্র নল নামে যে বানর।
তোমা হেতু মুনি-স্থানে পাইয়াছে বর।।
জহ্নু মুনি তাহারে পালিল শিশুকালে।
দণ্ড কমণ্ডলু তার হারাইল জলে।।
নিত্য হারাইয়া আসে, নিত্য সৃজে মুনি।
আর দিন ধ্যান করি জানিল আপনি।।
স্বয়ং বিষ্ণু হইবেন রাম-অবতার।
সাগর বাঁধিয়া সৈন্য করিবেন পার।।
এতেক ভাবিয়া মুনি দিলা বরদান।
নল-স্পর্শে সাগরেতে ভাসিবে পাষাণ।।
সাগর বান্ধিতে সেনাপতি কর নলে।
নল-স্পর্শে পাষাণ ভাসিবে মোর জলে।।
গাছ পাথর যোড়া লাগে পরশে তাহার।
জাঙ্গাল বান্ধিয়া রাম হয়ে যাও পার।।
তোমার কারণ আমি লইব বন্ধন।
পার হয়ে কর বধ পাপিষ্ঠ রাবণ।।
আপনা না জান তুমি দেব গদাধর।
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের তুমি ত ঈশ্বর।।
বিশ্বের আরাধ্য তুমি অগতির গতি।
নিদান সৃজিতে সৃষ্টি তুমি প্রজাপতি।।
তুমি সৃষ্টি তুমি স্থিতি তোমাতে প্রলয়।
কালে মহাকাল বিশ্ব কালে কর লয়।।
তুমি চন্দ্র তুমি সূর্য্য তুমি চরাচর।
কুবের বরুণ তুমি যম পুরন্দর।।
তুমি নিরাকার সাকার রূপে তুমি।
তোমার মহিমা সীমা কি জানিব আমি।।
না জানি ভকতি স্তুতি শুন রঘুবর।
শ্রীচরণে স্থান দান দেহ গদাধর।।
তুমি হে অনাদ্য আদ্য অসাধ্য সাধন।
কটাক্ষে ব্রহ্মাণ্ড কর খণ্ড বিনাশন।।
আখণ্ডল চঞ্চল চিন্তিয়া শ্রীচরণ।
কটাক্ষে করুণা কর কৌশল্যা-নন্দন।।
জন্মিয়া ভারতভূমে আমি দুরাচার।
করেছি পাতক কত সঙ্খ্যা নাহি তার।।
বিদায় করহ আমি যাই নিজ স্থান।
এত বলি পদতলে করিল প্রণাম।।
শ্রীরাম বলেন, নল আছে মম পাশ।
সাগর বান্ধিতে জান, না কর প্রকাশ।।
আমি লঙ্কা জিনিব, তোমার করি আশ।
এত বুদ্ধি ধর, শুনি সাগরের পাশ।।
নল বলে, জ্ঞাতি ভয়ে না করি প্রকাশ।
জ্ঞাতি-শাপে হয় পাছে জীবন বিনাশ।।
সাগরের কথা শুনি সব সেনাপতি।
সাগর বান্ধিতে নলে দিল অনুমতি।।
রাম-কার্য্য সিদ্ধ হৌক, এই মাত্র চাই।
সুগ্রীব পাথর দিবে, অন্য কার্য্য নাই।।
শ্রীরামের আগে নল করে অঙ্গীকার।
সাগর বান্ধিয়া দিব প্রতিজ্ঞা আমার।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কবিত্ব রচন।
গাহিল সুন্দরাকাণ্ডে গীত রামায়ণ।।