২২. উত্তরদিকে সীতা অন্বেষণে বানরগণের প্রেরণ

সুগ্রীব বলেন, শুন বীর শতবলী।
তব সৈন্য চলিলে গগনে লাগে ধূলি।।
বানরের মধ্যে তুমি মুখ্য সেনাপতি।
চলিবে উত্তরদিকে আমার আরতি।।
কুমুদ দ্বিবিধ দধি-বদন ভূধর।
আর আর আছে তব প্রধান বানর।।
শতবলী বলি যে উত্তর তব দেশ।
যাত্রা কর শুভক্ষণে, আমার আদেশ।।
যত দেশ জানি আমি কহি তব স্থান।
তথা সীতা অন্বেষিহ হয়ে সাবধান।।
তাহার উত্তরে পাবে দেশ যে বর্ব্বর।
হিমালয় গিরি যাবে যথা হিমঘর।।
সূর্য্যের কিরণ যেন জন্তু সব বৈসে।
ভাগীরথী গঙ্গাদেবী তথা হৈতে আসে।।
তাহার উত্তর অংশে ব্রহ্মার বসতি।
তথা হৈতে ভগীরথ আনে ভাগীরথী।।
এমন পুণ্যের স্থান নাহি ত্রিভুবনে।
ভগীরথ গঙ্গারে পাইল সেইখানে।।
নারায়ণী গঙ্গাদেবী আসিয়া ভুবন।
পাপীরে করেন মুক্ত দিয়া দরশন।।
কি বলিতে পারে লোক গঙ্গার মহিমা।
চারি বেদে বিচারিয়া দিতে নারে সীমা।।
আছিল সৌদাস দ্বিজ রাক্ষস হইয়া।
গেল সে বৈকুণ্ঠপুরী গঙ্গাজল পাইয়া।।
সূর্য্যবংশে ভগীরথ নামে মহীপাল।
গঙ্গাহেতু তপস্যা করিল বহুকাল।।
আরাধনা ব্রহ্মার করিল বারে বারে।
তারপর বিষ্ণুর তপস্যা অনাহারে।।
ভগীরথ নানাবিধ তপস্যা করিল।
গঙ্গার জন্মের তত্ত্ব কেহ না বলিল।।
শিব সেবা করে দশ হাজার বৎসর।
তবে শিব আইলেন তারে দিতে বর।।
ভগীরথ বলে শুন দেব পঞ্চানন।
গঙ্গা দিয়া রক্ষা কর এই নিবেদন।।
মম পিতৃলোক ভস্ম হয়েছে পাতালে।
গঙ্গা দরশন হৈলে স্বর্গবাসে চলে।।
গঙ্গাধর বলেন না জানি সে গঙ্গায়।
কি জাতি ধরেন গঙ্গা, থাকেন কোথায়।।
ভগীরথ শুনিয়া ভাবেন দুঃখ মনে।
আমি কি বলিব প্রভু তোমার চরণে।।
অষ্টাবক্র মুনি কহিলেন মোর স্থান।
আপনি করিবে প্রভু গঙ্গার বিধান।।
বসিলেন ধ্যানে শিব মুদিত নয়নে।
গঙ্গার জনম-তত্ত্ব জানিলেন মনে।।
ভক্ত জ্ঞানে মহাদেব তুষ্ট হয়ে তায়।
গঙ্গা দিয়া ভগীরথে করেন বিদায়।।
আগে যান ভগীরথ করি শঙ্খধ্বনি।
হিমালয়ে উঠিলেন দেবী তরঙ্গিনী।।
সবে বলে সাধু সাধু ভাল ভগীরথ।
গঙ্গা আনি করিলেন তরিবার পথ।।
ভুবনের মধ্যে ভগীরথ পুণ্যবান।
ত্রিভুবনে কেবা ভগীরথের সমান।।
সংসার পবিত্র হৈল পরশে গঙ্গার।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল ত্রিলোকের উদ্ধার।।
আইলেন গঙ্গা ভগীরথের কারণে।
মহাপাপী স্বর্গে যায় গঙ্গা পরশেনে।।
রামনাম স্মরণেতে পাপের বিনাশ।
গঙ্গার মাহাত্ম্য গীত রচে ‍কৃত্তিবাস।।
হেন হিমালয় গিরি বহু আয়তন।
তথা যত্নে অন্বেষিহ জানকী রাবণ।।
তথা যদি জানকীর না পাও উদ্দেশ।
তাহার উত্তর দেশে করিহ প্রবেশ।।
বিষম দুর্গম অতি ভয়ানক স্থল।
বৃক্ষ নাহি, গিরি নাহি, নাহি তাতে জল।।
দুই শত যোজনের পথ সেই দেশ।
পাইবে অত্যন্ত ভয় করিতে প্রবেশ।।
সকল বানর তথা হইও সাবধান।
ঝাট যাবে আসিবে তবে সে পরিত্রাণ।।
কৈলাস পর্ব্বতে যাইও তাহার উত্তর।
যেই দিক আলো করে সহস্র-শিখর।।
যোজন সহস্র নয় তার আয়তন।
উভেতে পর্ব্বত লক্ষ গণিত যোজন।।
তাহাতে অপূর্ব্ব পুরী অতি শোভা পায়।
সতত করেন লীলা পার্ব্বতী তথায়।।
আর এক অদ্ভুত অলকা নামে পুরী।
ধনেশ্বর কুবের তাহার অধিকারী।।
তাহার উপরে নদী, নামেতে বিমলা।
তার জল রাঙ্গা বর্ণ যেন রত্নপলা।।
ধনেশ্বর কুবের করেন স্নান তায়।
সুগন্ধি-চন্দন-বৃক্ষ তীরে শোভা পায়।।
সীতা লৈয়া যদি থাকে তথা দশানন।
চতুর্দ্দিকে তাহার করিও অন্বেষণ।।
তথা যদি জানকীর না পাও উদ্দেশ।
ত্রিশৃঙ্গ পর্ব্বতে গিয়া করিবে প্রবেশ।।
ত্রিশৃঙ্গ পর্ব্বত সেই তিন মূর্ত্তি ধরে।
চমৎকার হবে তথা সকল বানরে।।
এক শৃঙ্গ, রূপ তার যেন চন্দ্র-কলা।
দ্বিতীয় শৃঙ্গের রূপ যেন মণি-পলা।।
অন্য শৃঙ্গ রাঙ্গা বর্ণ সর্ব্বত্র প্রকাশ।
ত্রিশৃঙ্গ পর্ব্বত গিয়া যুড়েছে আকাশ।।
সেখানে করিহ তত্ত্ব শিখরে শিখর।
যত্ন করি অন্বেষিহ সকল বানর।।
তথা যদি নাহি পাও সীতা লঙ্কেশ্বর।
তাহার উদ্দেশে যাবে তাহার উত্তর।।
তাহার উত্তরে এক অদ্ভুত আকার।
জম্বুবৃক্ষ দেখিবে সে অতি চমৎকার।।
স্বর্ণ-জম্বুবৃক্ষ সেই সোণার আকার।
তার নামে জম্বুদ্বীপ হইল প্রচার।।
সকলের মুখ্য সেই জম্বুদ্বীপ কয়।
অন্য যত জম্বুদ্বীপ তুল্য তার নয়।।
তার তলে দেবগণ নিত্য করে কেলি।
তাহার কারণে এই জম্বুদ্বীপ বলি।।
চারি ডাল ধরে, যেন পর্ব্বতের চূড়া।
লক্ষ যোজনের বেড়া সে গাছের গোড়া।।
সীতা লয়ে থাকে যদি তথায় রাবণ।
চারিদিকে সেখানে করিবে অন্বেষণ।।
তথা যদি নাহি পাও সীতা লঙ্কেশ্বর।
করিবে গমন আরো তাহার উত্তর।।
মন্দর পর্ব্বত জম্বুদ্বীপের উত্তর।
এক হ্রদ আছে তথা পরম সুন্দর।।
সর্ব্বস্থলী বলিয়া সে হ্রদের খেয়াতি।
আইসেন দেখিতে সে হ্রদ প্রজাপতি।।
স্বর্গ হৈতে সেই হ্রদে পড়ে গঙ্গানীর।
কৌশিকী নামেতে নদী বহে সেই তীর।।
আমার বচন শুন সর্ব্ব কপিগণ।
সাবধানে অন্বেষিবে সীতা দশানন।।
তথা যদি নাহি পাও সীতা লঙ্কেশ্বর।
তাহার উত্তরে যাবে মহেশ-সাগর।।
মহেশ-সাগরে জন্মে বহুমূল্য ধন।
আড়ে দীর্ঘে সাগর সে শতেক যোজন।।
অস্তাচল-পর্ব্বত সাগরের ভিতর।
জল হৈতে গিরি উঠে সহস্র শিখর।।
দেখিয়া হৈইবে সবে সভয় অন্তর।
অন্বেষিহ সাবধানে মহেশ-সাগর।।
সোণার পর্ব্বতে দশ দিক্ সুপ্রকাশ।
সহস্র শিখর উঠে যুঢ়িয়া আকাশ।।
সোণার গঠিত গোড়া দেখিতে সুঠাম।
শিবলিঙ্গ আছে তাহে যেন শিবধাম।।
রাবণ সে মহেশ্বর পূজে সর্ব্বক্ষণ।
মহেশের কাছে গিয়া থাকেন রাবণ।।
অন্বেষণ করিও হে শিখরে শিখর।
পাইতে পারিবে তথা সীতা লঙ্কেশ্বর।।
কিন্তু মায়া জানে সে পাপিষ্ঠ দশানন।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল জিনিল ত্রিভুবন।।
সেবিয়া শিবের পদ দিগ্বিজয় করে।
ত্রিভুবন জিনে বেটা শঙ্করের বরে।।
দেবগণ যার ডরে এক পাশ হয়।
সবে মাত্র বালি-স্থানে তার পরাজয়।।
তথা যদি নাহি পাও সীতার উদ্দেশ।
মহীধর ক্রৌঞ্চে গিয়া করিহ প্রবেশ।।
ক্রৌঞ্চ পর্ব্বত দেখি লাগিবেক ভয়।
বিষম পর্ব্বত সেই অন্ধকারময়।।
দূর হৈতে পর্ব্বত করিবে দরশন।
তাহার মধ্যেতে গেলে অবশ্য মরণ।।
সে পর্ব্বত রাখিয়া দক্ষিণে কিম্বা বামে।
তাহার উত্তরে যাবে গিরি দ্রোণ নামে।।
দ্রোণগিরি দেখিলে হইবে বড় সুখী।
দেব গন্ধর্ব্বের আছে যত চন্দ্রমুখী।।
বালখিল্য আদি করি যত মুনিবর।
বাস করে সকলে সে পর্ব্বত উপর।।
চন্দ্র-তেজ নাহি তথা, সূর্য্যের প্রকাশ।
নক্ষত্র নাহিক দেখি, না দেখি আকাশ।।
কামিনীগণের তেজে তথা আলো করে।
পুণ্যদা নামেতে নদী তাহার উপরে।।
দুই কূলে আছ তার বংশ অগণন।
উত্তর তীরের বংশ দক্ষিণে মিলন।।
ম্লেচ্ছ জাতি আছে তথা দেখি ভয়ঙ্কর।
নদী পার হয় তারা বাঁশে করি ভয়।।
তাহার উত্তরে যাবে সীতার উদ্দেশে।
সেই দেশে বহু লোক হরষিতে বৈসে।।
যাহা চাবে, তাহা পাবে মিষ্ট বৃক্ষফল।
স্বর্ণদ্রব্য জন্মে তথা সোনার উৎপল।।
নানা রত্ন মাণিক সে জলেতে উপজে।
রক্ত-বর্ণ নদী-জল মাণিকের তেজে।।
নানা রত্ন অলঙ্কার পুরুষেতে পরে।
কি বর্ণিব অলঙ্কার স্ত্রীলোকে যা ধরে।।
অহঙ্কারে নারীগণ ইন্দ্রে না মানিল।
ক্রোধ করি ইন্দ্রদেব অভিশাপ দিল।।
অহঙ্কারে যেমন না মানিলি আমায়।
জীবিত হইবি দিনে, রাত্রে মৃতপ্রায়।।
সেই শাপে মৃত থাকে সকল রজনী।
প্রভাহ হইলে বাঁচে সকল সজনী।।
রজনীতে থাকে তারা হয়ে অচেতন।
প্রভাতে উঠিয়া করে সঙ্গীত নর্ত্তন।।
বহুরত্না পৃথিবী বলেন সর্ব্বজন।
কত ঠাঁই কত সৃষ্টি, না হয় গণন।।
সাবধান হৈয়া যাবে যত কপিগণ।
যত্নেতে খুঁজিবে তথা জানকী রাবণ।।
তাহার উত্তরে যাবে অনন্ত সাগর।
তথা হৈতে হেমগিরি নাম গিরিবর।।
সকল পর্ব্বত মধ্যে হেমগিরি সার।
সকল পর্ব্বত জিনি শিখর তাহার।।
আকাশেতে যার শৃঙ্গ লাগে সারি সারি।
হেমগিরি সম গিরি জগতে না হেরি।।
তাহার উত্তরে নাহি ভাস্করের গতি।
অন্ধকার ময় তথা নাহিক বসতি।।
তাহার উত্তরে নাহি আমার গমন।
সে পর্য্যন্ত খুঁজিয়া ফিরিবে সর্ব্বজন।।
এই কহিলাম জম্বুদ্বীপের উৎপত্তি।
এই অবধি আছে জীব জন্তুর বসতি।।
হিমগিরি যাইতে আসিতে একমাস।
মাসের অধিক হৈলে সবার বিনাশ।।
মাসেকের মধ্যে যেই ফিরে না আইসে।
সবংশে মরিবে সেই আপনার দোষে।।
সকল দেশের করা কহিনু সবাকে।
যে দেশে থাকেন সীতা, উদ্ধারিবে তাঁকে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল যে এই তিন স্থান।
ইহা বিনা সৃষ্টি নাহি, শাস্ত্রের বিধান।।
যত দেশ কহিলাম যাইবে সাহসে।
সীতাদেবী আনি দিবে শ্রীরামের পাশে।।
আনিতে না পার যদি সীতা ঠাকুরাণী।
আমি গিয়া তাহারে করিব হানাহানি।।
মাসেকের মধ্যেতে আসিবে বীরগণ।
অধিক হইলে তার অবশ্য মরণ।।
অগ্নি সাক্ষী করিয়া করেছি অঙ্গীকার।
প্রাণপণে আমি সীতা করিব উদ্ধার।।
সর্ব্বস্থানে যাব আমি যতদূর সংখ্যা।
তারপরে প্রবেশিব স্বর্ণপুরী লঙ্কা।।
মালসাট মারে বহু দেয় করতালি।
মেঘের গর্জ্জনে গর্জ্জে বীর শতবলি।।
কি কার্য্যে পাঠাও রাজা এত সেনাগণ।
আমি আনি দিব সীতা মারিয়া রাবণ।।
পাতালে থাকে সীতা, পাতালে প্রবেশি।
সাগরে থাকেন যদি, তাহা আমি শুষি।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ কেন হও বিদ্যমান।
সীতা উদ্ধারিব আমি হয়ে যত্নবান।।
কি হেতু শ্রীরাম তুমি মনে ভাব আন।
একলা রাবণ মোর না ধরিবে টান।।
আসিতে যাইতে মোর যে হউক ব্যাজ।
অবিলম্বে দেখা দিব সিদ্ধ করি কাজ।।
শুনি শতবলির সে বিক্রম-বচন।
ভরসা পাইল মনে সুগ্রীব রাজন।।
চলিল সকল ঠাট ‍সুগ্রীব আদেশে।
উত্তরদিকের যাত্রা রচে কৃত্তিবাসে।।