১৫. ব্রহ্মচারীবেশে রাবণ কর্ত্তৃক সীতা হরণ

দূরেতে রাক্ষস করে রামতুল্য ধ্বনি।
রাক্ষসের মায়ায় রামের শব্দ শুনি।।
হেথা শুনিলেন সীতা করুণ বচন।
বলিলেন, ঝাট যাও দেবর লক্ষ্মণ।।
আর্ত্তস্বরে শ্রীরাম ডাকেন যে তোমারে।
দেখ গিয়া তাঁহারে কি রাক্ষসেতে মারে।।
লক্ষ্মণ বলেন, নাহি শ্রীরামের ভয়।
মৃগ মারি আসিবেন কিসের বিস্ময়।।
শ্রীরামের মুখে নাহি কাতার বচন।
এত ব্যস্ত হও মাতা কিসের কারণ।।
রামেরে মারিতে পারে আছে কোন্ জন।
তুমি কি জান না সীতা ধনুক-ভঞ্জন।।
রামের বচন সীতা ধনুক-ভঞ্জন।
রামের বচন সীতা আমি নাহি শুনি।
প্রাণ গেলে রামের কাতর নহে বাণী।।
ঘরে রাখি, তোমার নিকটে কেবা রহে।
শূন্য ঘরে থাকা তব উপযুক্ত নহে।।
তাহা না মানেন সীতা হয়ে উতরোলী।
শিরে ঘা হানেন সীতা দেন গালাগালি।।
বৈমাত্রেয় ভাই কভু নহে ত আপন।
আমা প্রতি লক্ষ্মণ তোমার বুঝি মন।।
ভরত হইল রাজ্য, তুমি লহ নারী।
ভরতের সনে ষড় আছয়ে তোমারি।।
মনের বাসনা কি সাধিবে এই বেলা।
আমার আশাতে কি রামেরে কর হেলা।।
অপর পুরুষে যদি যায় মম মন।
গলায় কাটারি দিয়া ত্যজিব জীবন।।
লক্ষ্মণ ধার্ম্মিক অতি মনে নাহি পাপ।
সকলেরে সাক্ষী করে পেয়ে মনস্তাপ।।
জলচর স্থলচর অন্তরীক্ষচর।
সবে সাক্ষী হও, সীতা বলে দুরক্ষর।।
প্রবোধ না মানে সীতা, আরো বলে রোষে।
আজি মজিবেক সীথা আপনার দোষে।।
গণ্ডী দিয়া বেড়িলেন লক্ষ্মণ সে ঘর।
প্রবেশ না করে কেহ ঘরের ভিতর।।
স্বয়ং বিষ্ণু রঘুনাথ, তাঁর পত্নী সীতা।
শূন্য ঘরে রাখি ওহে সকল দেবতা।।
আমারে বিদায় কর সীতা ঠাকুরাণী।
আর কিছু না বলহ দুরক্ষর বাণী।।
শিরে ঘা হানেন সীতা, নেত্রজলে তিতে।
সীতা প্রণমিয়া যান লক্ষ্মণ ত্বরিতে।।
হইল বিমুখ বিধি, চলেন লক্ষ্মণ।
থাকিয়া বৃক্ষের আড়ে দেখিছে রাবণ।।
এতক্ষণে রাবণের সিদ্ধ অভিলাষ।
তপস্বীর বেশ ধরি যায় সীতা-পাশ।।
ভিক্ষাঝুলি করি কান্ধে করে ধরে ছাতি।
সকল বসন রাঙ্গা, ধরে নানা গতি।।
পরমা সুন্দরী সীতা বচন মধুর।
তাঁর রূপ দেখিয়া রাবণ কামাতুর।।
রাবণ মধুর বাখ্যে সীতারে সম্ভাষে।
কোন্ জাতি নারী তুমি, থাক কোন্ দেশে।।
কাহার ঝিয়ারী তুমি কার প্রিয়তমা।
মনুষ্য নহ ত তুমি সোণার প্রতিমা।।
সুললিত দুই স্তন শোভা করে হারে।
উত্তম বসন শোভে তোমার শরীরে।।
বিষম দণ্ডকবনে হিংস্র ব্যাঘ্র বৈসে।
এমন সুন্দরী থাক কেমন সাহসে।।
পরিচয় দেন সীতা তপস্বীর জ্ঞানে।
অমৃত সেচিল যেন মধুর বচনে।।
জনক-নন্দিনী আমি, নাম ধরি সীতা।
দশরথ-পুত্রবধূ, রামের বনিতা।।
রহ দ্বিজ, ফল আনি দিবেন লক্ষ্মণ।
সেই ফল দিব তুমি করিও ভক্ষণ।।
অতিথিরে ভক্তি রাম করেন যতনে।
বড় প্রীতি পাইবেন তোমা দরশনে।।
জিজ্ঞাসি তোমারে মুনি, শিরে ধর শিখা।
কি জাতি, কি নাম ধর, কেন কর ভিক্ষা।।
এতেক বলেন সীতা তপস্বীর জ্ঞানে।
নিজ পরিচয় দেয়, রাজা দশাননে।।
জ্যেষ্ঠ ভাই কুবের, ধনের অধিকারী।
এই বনে বহুকাল আমি তপ করি।।
রাবণ আমার নাম, জানে মুনিগণে।
বড় প্রীতি পাইলাম তোমা দরশনে।।
ফল মূল দিয়া করি উদর পূরণ।
গৃহস্থের ঘরে গেলে করায় ভোজন।।
তোমার সহিত আজি অপূর্ব্ব দর্শন।
ভিক্ষা দিলে, যাই চলে নিজ নিকেতন।।
হইল অনেক বেলা, কর যে বিধান।
তোমার পুণ্যেতে গিয়া করি স্নান দান।।
শ্রীরামের আসিতে বিলম্ব বহু দেখি।
হইল স্নানের বেলা, দেখ চন্দ্রমুখী।।
জানকী বলেন, দ্বিজ করি নিবেদন।
পঞ্চ ফল ঘরে আছে করহ ভক্ষণ।।
রাবণ বলিল, সীতা ব্রত করি বনে।
আশ্রমে না লই ভিক্ষা, জানে মুনিগণে।।
জানকী বলেন, দ্বিজ এক কথা কহি।
আজ্ঞা বিনা প্রভুর ঘরের বাহির নহি।।
রাবণ বলেন ভিক্ষা আনহ সত্বর।
নতুবা উত্তর দেহ যাই নিজ ঘর।।
জানকী ভাবেন ব্যর্থ অতিথি যাইবে।
ধর্ম্ম কর্ম্ম নষ্ট হবে প্রভু কি বলিবে।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কভু না হয় অন্যথা।
বিধির লিখন মত ঘটিলেক তথা।।
ফল হাতে বাহির হইলেন জানকী।
লইতে আইল দুষ্ট রাবণ পাতকী।।
ধরিয়া সীতার হাত লইল ত্বরিত।
জানকী বলেন হায় একি বিপরীত।।
দুরাচার দূর হ রে পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।
আমা লাগি হবে তোর স্বংশে নিধন।।
রাবণ বলিল, সীতা শুনহ বচন।
আত্মপরিচয় কহি আমি দশানন।।
রাক্ষসের রাজা আমি, লঙ্কা নিকেতন।
কুড়ি হাত, কুড়ি চক্ষ, দশটি বদন।।
তপস্বীর বেশ ধরি আসি তপোবন।
অনুগ্রহ কর মোরে, আমি দাস জন।।
ইন্দ্রের অমরাবতী জিনি লঙ্কাপুরী।
জগত-দুর্ল্লভ ঠাঁই দেখিবে সুন্দরী।।
তোমার রূপেতে আমি বড় অভিলাষী।
অন্য যত মহিষী তোমার হবে দাসী।।
সর্ব্বোপরি তোমারে করিব ঠাকুরাণী।
তুমি অন্ন দিলে, অন্ন পাবে অন্য রাণী।।
হইবে তোমার পূজা, বাড়িবে সম্মান।
সুবর্ণ মাণিক্যময় রবে তব স্থান।।
করিয়া রামের সেবা জন্ম গেল দুঃখে।
করিলে আমার সেবা রবে নানা সুখে।।
ত্রিভুবন আমার বাণেতে কম্পমান।
মনুষ্য রামেরে আমি করি কীট জ্ঞান।।
অল্পবুদ্ধি শ্রীরামের অত্যল্প জীবন।
যুগে যুগে চিরজীবী আমি দশানন।।
সীতে তুমি সুন্দরী লাবণ্য আর বেশে।
তোমা হেন সুন্দরী আমাকে অভিলাষে।।
কোমান্বিতা সীতাদেবী রাবণ-বচনে।
রাবণেরে গালি দেন যত আসে মনে।।
অধর্ম্মিষ্ঠ অগন্য অধন্য দুরাচার।
করিবেন রাম তোরে স্বংশে সংহার।।
শ্রীরাম কেশরী, তুই শৃগাল যেমন।
কি সাহসে তাহারে বলিস্ কুবচন।।
বিষ্ণু-অবতার রাম, তুই নিশাচর।
রামে আর তোরে দেখি অনেক অন্তর।।
রাম যদি থাকিতেন অথবা লক্ষ্মণ।
করিতিস্ কেমনে এ দুষ্ট আচরণ।।
একাকিনী পাইয়া আমারে বনমাঝ।
হরিলি আমারে দুষ্ট, নাহি তোর লাজ।।
করে দুষ্ট কুড়িপাটী দন্ত কড়মড়ি।
জানকী কাঁপেন যেন কলার বাগুড়ি।।
প্রকাশে রাক্ষস মূর্ত্তি অতি ভয়ঙ্কর।
অধিক তর্জ্জন করে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
কি গুণে রামের প্রতি মজে তোর মন।
বল্কল পরিয়া সে বেড়ায় বনে বন।।
দেখিবে, কেমনে করি তোমার পালন।
তাহা শুনি জানকীর উড়িল জীবন।।
জানকী বলেন, আরে পাতকী রাবণ।
আপনি মজিলি বেটা আমার কারণ।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কভু না হয় খণ্ডন।
নতুবা এমন কেন হবে সংঘটন।।
যিনি জনকের কন্যা, রামের কামিনী।
যাঁহার শ্বশুর দশরথ নৃপমণি।।
আপনি ত্রিলোক-মাতা লক্ষ্মী-অবতার।
তাঁহারে রাক্ষসে হরে অতি চমৎকার।।
ত্রাসেতে কান্দেন সীতা হইয়া কাতর।
কোথা গেলে প্রভু রাম গুণের সাগর।।
সিংহের বিক্রম সম দেবর লক্ষ্মণ।
শূন্য ঘর পেয়ে মোরে হরিল রাবণ।।
তুমি যত বলিলে হইল বিদ্যমান।
ঝাট আইস দেবর, করহ পরিত্রাণ।।
অত্যন্ত চিন্তিয়া সীতা করেন রোদন।
এমন সময় রক্ষা করে কোন্ জন।।
সীতারে ধরিয়া রথে তুলিল রাবণ।
মেঘের উপরে শোভে চপলা যেমন।।
বিপদে পড়িয়া সীতা ডাকেন শ্রীরাম।
চক্ষু মুদি ভাবেন সে দূর্ব্বাদলশ্যাম।।
সীতা লয়ে রাবণ পলায় দিব্যরথে।
রাম এল বলিয়া দেখেন চারিভিতে।।
জানকী বলেন, শুন যত দেবগণ।
প্রভুরে কহিও সীতা হরিল রাবণ।।
হায় বিধি কি করিলে, ফেলিলে বিপাকে।
এমন না দেখি বন্ধু সীতারে যে রাখে।।
বনের ভিতর যত আছ বৃক্ষলতা।
রামেরে কহিও, গেল তোমার বনিতা।।
মধুর বচনে যত বুঝায় রাবণ।
শোকেতে জানকী তত করেন রোদন।।
আগে যদি জানিতাম এ রাক্ষস বীর।
তবে কেন হব আমি ঘরের বাহির।।
হায় কেন লক্ষ্মণেরে দিলাম বিদায়।
লক্ষ্মণ থাকিলে কি ঘটিত হেন দায়।।
রাবণ বলিল, সীতা ভাব অকারণ।
পাইলে এমন রত্ন ছাড়ে কোন্ জন।।
জানকী বলেন, শুন দুষ্ট নিশাচর।
অল্পায়ু হইয়া তুই যাবি যমঘর।।
কুপিল রাবণ রাজা সীতার বচনে।
চালাইল রথখান ত্বরিত গমনে।।