১১. সীতা হরণ করিতে রাবণকে মারীচের নিষেধ

আর দিন দশানন আইল বাহিরে।
বুঝিয়া রাজার মন সারথি সত্বরে।।
আনিল পুষ্পক রথ অপূর্ব্ব গঠন।
সে রথের সারথি আপনি সমীরণ।।
হীরা মুক্তা মাণিক্য প্রভৃতি রত্নগণে।
খচিত রচিত কত মাণিক কাঞ্চনে।।
মনোরথে না আইসে রথের সৌন্দর্য্য।
অষ্ট অশ্ব বদ্ধ তাহে, দেখিতে আশ্চর্য্য।।
সেই রথে আরোহণ করে লঙ্কেশ্বের।
বিদ্যুতের প্রায় রথ চলির সত্বর।।
নানা দেশ নদ নদী ছাড়িয়া রাবণ।
সাগর লঙ্ঘিয়া যায় শতক যোজন।।
শ্যামবট পাদপ যোজন শত ডাল।
অশীতি যোজন মূল গিয়াছে পাতাল।।
চারি ডাল দেখিল যেন পর্ব্বতের চূড়া।
সত্তর যোজন হয় সে গাছের গোড়া।।
তপ করে বালখিল্য আদি মুনিগণ।
মারীচ উদ্দেশে তথা চলিল রাবণ।।
যথা তপ করে সে মারীচ নিশাচর।
রথে চাপি তথা গেল রাজা লঙ্কেশ্বর।।
মারীচ আইল ভয়ে রাবণেরে দেখি।
সর্প যেন ভীত হয় গরুড় নিরখি।।
ত্রাস পায় লোক যেন যম দরশনে।
পাইল মারীচ ত্রাস দেখিয়া রাবণে।।
রাবণ বলিল, তুমি অমাত্য প্রধান।
লঙ্কায় না দেখি পাত্র তোমার সমান।।
অযুত হস্তীর বল তোমার শরীরে।
দেবতা গন্ধর্ব্ব সদা ভীত তব ডরে।।
বড় দুঃখে আইলাম তোমার গোচর।
সাগর লঙ্ঘিয়া আসি বনের ভিতর।।
দণ্ডাকারণ্যেতে ছিল যত নিশাচর।
সবাকারে সংহারিল রাম একেশ্বর।।
ত্রিশিরা দূষণ খর আদি যত ভাই।
সবারে মারিল রাম, কেহ আর নাই।।
ধিক্ ধিক্ আমারে তোমারে ধিক্ ধিক্।
তুমি আমি থাকিতে কলঙ্ক কি অধিক।।
সূর্পণখা ভগিনীর কাটে নাক কাণ।
হইয়া মুনষ্য-কীট করে অপমান।।
আপনি রাবণ আমি, পুত্র মেঘনাদ।
ঘটাইল ক্ষুদ্র রাম এতেক প্রমাদ।।
না করি ইহার যদি আমি প্রতিকার।
ত্রিলোকের আধিপত্য বিফল আমার।।
আজি লইলাম আমি তোমার শরণ।
পাত্রকার্য্য কর পাত্র শুনহ বচন।।
শুনি তার পরমা সুন্দরী এক নারী।
তার রূপ-গুণ-কথা কহিতে না পারি।।
তাহারে হরিব করি তোমারে সহায়।
শুনিয়া মারীচ কহে করি হায় হায়।।
অবোধ রাবণ একি তোমার যুকতি।
কে দিল এ কুমন্ত্রণা তোমারে সম্প্রতি।।
প্রাণাধিক রামের সে জানকী সুন্দরী।
হরিলে তাঁহারে কি রহিবে লঙ্কাপুরী।।
রাম সহ বিবাদে যাইবে যমপুরী।
শ্রীরামের নিকটে না খাটিবে চাতুরী।।
কুম্ভকর্ণ বিভীষণ হইবে বিনাশ।
মরিবে কুমারগণ, হবে সর্ব্বনাশ।।
লঙ্কাপুরী মনোহর, নাহিক উপমা।
সৃষ্টি নষ্ট না করিহ, চিত্তে দেহ ক্ষমা।।
পায়ে পড়ি লঙ্কানাথ, করি হে মিনতি।
রক্ষা কর, রক্ষা কর লঙ্কার বসতি।।
আনহ যদ্যপি সীতা করহ বিবাদ।
সবাকার উপরেতে পড়িবে প্রমাদ।।
কুমন্ত্রীর বচনেতে রাজলক্ষ্মী ত্যজে।
সুমন্ত্রী মন্ত্রণা দিলে, লক্ষ্মী তারে ভজে।।
যেমন ছুটিলে হস্তী, না রহে অঙ্কুশে।
লঙ্কাপুরী তেমনি মজিবে তব দোষে।।
বিদিত রামের গুণ আছে সর্ব্বলোক।
প্রাণ দিল দশরথ রাম পুত্রশোকে।।
সীতা বিনা রামের না যায় অন্যে মন।
সীতার শ্রীরাম পদে মন সমর্পণ।।
কুমার তোমার সব থাকুক কুশলে।
জ্ঞাতি পাত্র তোমার থাকুক কুতূহলে।।
বহুভোগ করিবে হইবে চিরজীবী।
আনিতে না কর মনে শ্রীরামের দেবী।।
রাম বিনা সীতাদেবী অন্যে নাহি ভজে।
তবে তারে রাবণ হরিবে কোন্ কাজে।।
পরস্ত্রী দেখিলে তুমি বড় হও সুখী।
স্বংশে মরিবে রাজা পাছু নাহি দেখি।।
রাজা বলে, মারীচ হরিণ হও তুমি।
ভাণ্ডাইয়া রামেরে হরিব সীতা আমি।।
মারীচ বলে মৃগবেশে যাব তাঁর কাছে।
আগেতে আমার মৃত্যু, তব মৃত্যু পাছে।।
কার্য্যসিদ্ধি না হইবে পড়িবে সঙ্কটে।
অপরাধ না করিহ রামের নিকটে।।
পরিণাম ভাল মন্দ বিভীষণ জানে।
জিজ্ঞাসা করিও সে ধার্ম্মিক বিভীষণে।।
ধার্ম্মিক ত্রিজটা আছে, বুদ্ধিতে পণ্ডিতা।
যদি বলে আনিতে সে, তবে আন সীতা।।
নহেন মনুষ্য রাম স্বয়ং নারায়ণ।
নতুবা অন্যের কার এত পরাক্রম।।
মনে না করিও সূর্পণখার অবস্থা।
মরিল রাক্ষস বহু, তাহাতে কি আস্থা।।
দূষণ ত্রিশিরাদির না ভাবিহ দুঃখ।
আপনি বাঁচিলে হে ভুঞ্জিবে কত সুখ।।
চতুর্দ্দশ সহস্র রাক্ষস যেই মারে।
স্বংশে মরিবে রাজা, নারিবে তাহারে।।
তোমার বিক্রম জানি, শুন লঙ্কেশ্বর।
শ্রীরামে তোমায় দেখি অনেক অন্তর।।
আপন বিক্রম তুমি বাখান আপনি।
তোমা হেন লক্ষ লক্ষ জিনে রঘুমণি।।
ছাড়িলাম ভার্য্যা পুত্র স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী।
তপস্বী হইয়া তবু শ্রীরামেরে ডরি।।
তথাপি তোমার স্থানে নাহিক এড়ান।
পাঠাও রামের কাছে নাশিতে পরাণ।।
আমার বচন তুমি শুন লঙ্কেশ্বর।
সীতালোভ ছাড়িয়া চলিয়া যাহ ঘর।।
যত বলে মারীচ, রাবণ তত রোষে।
রচিল অরণ্যকাণ্ড দ্বিজ কৃত্তিবাসে।।