৩৬. লোমপাদ রাজ্যে অনাবৃষ্টি নিবারণার্থ ঋষ্যশৃঙ্গকে আনয়ন

বশিষ্ঠের বচন হইল অবসান।
সুমন্ত্র বলেন রাজা কর অবধান।।
লোমপাদ রাজা অঙ্গদেশের ঈশ্বর।
ঋষ্যশৃঙ্গে আনিয়াছিলেন নিজ ঘর।।
দশরথ বলে পাত্র কহ বিবরণ।
লোকপাদ আনাইল কিসের কারণ।।
সুমন্ত্র বলেন, দশরথ নৃপবর।
সেই দেশে অনাবৃষ্টি দ্বাদশ বৎসর।।
লোমপাদ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে জিজ্ঞাসিল।
মম রাজ্যে অনাবৃষ্টি কি হেতু হইল।।
কহিল পণ্ডিতগণ করিয়া বিচার।
কিঞ্চিৎ তোমার রাজা আছে দুরাচার।।
তব রাজ্যে কুমারী হইল ঋতুমতী।
এই পাপে বৃষ্টি নাহি হয় নরপতি।।
বিভাণ্ডক পুত্র যদি ঋষ্যশৃঙ্গ আসে।
পাপ দূর হয় আর দেবতা বরষে।।
নগরেতে লোমপাদ দিলেন ঘোষণা।
ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে আনিবে কোন্ জনা।।
তাহারে আনিয়া মোরে যেবা দিতে পারে।
অর্দ্ধবাজ্য আমি দিব অবশ্য তাহারে।।
ডাকিয়া কহিল তথা বুড়ী একজন।
আমি আনি দিব সেই মুনির নন্দন।।
স্ত্রী-পুরুষ ভেদ সেই মুনি নাহি জানে।
ভুলাইয়া আনিব সে মুনির নন্দনে।।
নৌকা এক সাজাইয়া দেহ ত আমারে।
ফলবান বৃক্ষ রোপ তাহার উপরে।।
চৌদ্দ বৎসরের সেই মুনির সন্ততি।
কৌতুকেতে ভুলাইবে যতেক যুবতী।।
বৃত্তান্ত শুনিয়া রাজা লোমপাদ হাসে।
ভাল যুক্তি বলিয়া সে বুড়ীরে সম্ভাষে।।
সুবর্ণের নৌকা রাজা করিয়া গঠন।
বিচিত্র পতাকা তাহে করিল সাজন।।
নৌকার উপরে করে স্বর্ণে দুই ঘর।
পরমা সুন্দর নৌকা অতি মনোহর।।
উপরেতে শোভা করে সুবর্ণের বারা।
চারিভিতে শোভে গজ মুকুতার ঝারা।।
সন্দেশ দিলেন নানা খাইতে রসাল।
নারিকেল ফল আর কাঁঠাল ও তাল।।
গঙ্গাজলে শীতল শর্করা মিশ্র করি।
কর্পূর-বাসিত দিল পাত্র পূরি পূরি।।
বাছিয়া বাছিয়া দিল পরমা সুন্দরী।
চেনা ভার অপ্সরী কি অমরী কিন্নরী।।
কান্দিতে লাগিল সবে মুখে নাহি হাসি।
মুনি-কোপানলে আজ হৈব ভস্মরাশি।।
বুড়ী বলে কেন ভয় করিছ যুবতী।
তোমরা সকলে চল আমার সংহতি।।
যখন আমার ছিল নবীন যৌবন।
কত শত ভুলায়েছি মহামুনিগণ।।
নর্ম্মদা বাহিরা যায় পরম হরিষে।
উপস্থিত হয় ঋষ্যশৃঙ্গ যেই দেশে।।
যেখানে তপস্যা করে বিভাণ্ডক মুনি।
সেই বনে তরুণীরা রাখিল তরণী।।
বিভাণ্ডকে দেখিয়া সকলে ভয়ে কাঁপে।
ভস্মরাশি করে পাছে শাপ দিয়া কোপে।।
তপোবনে আছে যথা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।
আসিয়া মিলিল তথা সকল রমণী।।
তরী হৈতে উত্তরিলা সকল নবীনা।
কেহ বংশী পূরয়ে বাজায় কেহ বীণা।।
বুড়ীকে বেড়িয়া গান করে নারীগণ।
মুনির নিকটে গিয়া দিল দরশন।।
কামিনীর মুখে গীত কোকিলের ধ্বনি।
শুনি মুনি বেদধ্বনি ছাড়িল অমনি।।
স্ত্রী-পুরুষ ভেদ সেই মুনি নাহি জানে।
স্বর্গের অমরগণ মুনি মনে মানে।।
ব্যাকুল হইয়া মুনি দ্বার হৈতে উলে।
প্রণিপাত করিল বুড়ীর পদতলে।।
মুনিপুত্র পায়ে পড়ে ধরি করে কোলে।
বারম্বার চুম্ব দিল বদন-কমলে।।
এস এস বলি মুনি তা সবারে বলে।
আনন্দে গদগদ সে আসন দিতে চলে।।
একখানি কুশাসন ছিল মাত্র ঘরে।
বৈস বলি আনিয়া দিলেন যে বুড়ীরে।।
ফল মূল জল ঘরে ছিল সে সকল।
বুড়ীর ভক্ষণ হেতু দিলেন সকল।।
শ্রীবিষ্ণু বলিয়া বুড়ী ছুঁইল দুই কান।
বিষ্ণুপূজা বিনা নাহি করি জলপান।।
ইতর যেমন করে আমি কি তেমন।
বিষ্ণুর প্রসাদ বিনা না করি ভক্ষণ।।
মুনি বলে হক মোর সফল জীবন।
এইখানে কর আজি বিষ্ণু-আরাধন।।
দিব্য কুশাসন পাতি দিলেন বুড়ীরে।
পূজা করিবারে বৈসে তাহার উপরে।।
চক্ষু উলটিয়া বুড়ী নাকে দিল হাত।
মুনি বলে বিষ্ণু আজি করিল সাক্ষাৎ।।
কতক্ষণে নাসিকার হাত ঘুচাইল।
এ প্রসাদ লহ বলি মুনিরে ডাকিল।।
মুনি বলে আজি মোর সফল জীবন।
বিষ্ণুর প্রসাদ দেহ করিব ভক্ষণ।।
ফল বলে হাতে দিল গঙ্গাজল নাড়ু।
জল বলে খাওয়াইল মধু গাড়ু গাড়ু।।
মুনি বলে এই ফল কোথা গেলে পাই।
সঙ্গে করে লয়ে গেলে তব সঙ্গে যাই।।
খাওয়াইল কামেশ্বর খাইতে সুস্বাদ।
কামেশ্বর খাইয়া সে হেইল উন্মাদ।।
কন্যাগণ বলয়ে খাইল যে সন্দেশ।
ইহার অধিক আছে চল সেই দেশ।।
মুনি বলে ইহার অধিক যদি পাই।
তোমরা চলহ দেশে আমি সঙ্গে যাই।।
মদনে ভুলিল যদি মুনির নন্দন।
অঙ্গের বসন খসাইল কন্যাগণ।।
আসিয়া মুনির পুত্রে কেহ করে কোলে।
কেহ কেহ চুম্ব দেয় বদন-কমলে।।
মুনি লৈয়া করে সবে হাস্য-পরিহাস।
দেখিয়া মুনির পুত্র হইল উল্লাষ।।
কোন নারী ভুলাইল স্তন-পরশনে।
কেহ বা ভুলায় তাঁকে ভক্ষ্যদ্রব্য দানে।।
কেহ বা হরিল মন চাহিয়া নয়নে।
কেহ বা করিল মত্ত গাঢ় আলিঙ্গনে।।
বুড়ী ভাবে, আজি যদি লয়ে যাই ঘরে।
পাছে বিভাণ্ডক মুনি কোপে ভস্ম করে।।
আজি পিতা পুত্রেতে থাকুক এক স্থানে।
কহিবে এ কথা মুনি পিতা বিদ্যমানে।।
পুত্র প্রতি যদি স্নেহ করে তপোধন।
তবে কালি তপস্যায় না যাবে কখন।।
পুত্র এড়ি যায় যদি তপস্যার তরে।
তবে কালি লইয়া যাব মুনির কুমারে।।
এই যুক্তি সে বুড়ী ভাবিয়া মনে মনে।
কহিতে লাগিল সেই মুনির নন্দনে।।
তপোবনে বৈস হে তোমারে ভালবাসি।
অন্য এক শিষ্যের আশ্রম দেখে আসি।।
বলিতে লাগিল তবে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষি।
তোমার সেবক হয়ে তব সঙ্গে আসি।।
আমারে এড়িয়া যদি যাবে কোন দেশে।
ব্রহ্মহত্যা হবে, তবে মরিব হুতাশে।।
বুড়ী বলে এইক্ষণে ঘরে থাক ‍তুমি।
সন্ধ্যাকালে তোমারে লইয়া যাব আমি।।
এতেক বলিয়া তারে থুয়ে নিজ ঘরে।
সকল কামিনী চড়ে নৌকার উপরে।।
দিবাকর অস্তগত হইল যখন।
মুনি বলে না আইল কেন ঋষিগণ।।
শিরোমণি হারাইনু অন্ধলের নিধি।
বুঝিলাম আমারে বঞ্চিত কৈল বিধি।।
কান্দিতে কান্দিতে মুনি বৈসে বৃক্ষতলে।
বিভাণ্ডক তপ করে এল হেনকালে।।
পুত্রেরে দেখিয়া মুনি বিচলিত মন।
জিজ্ঞাসিল কেন বাপু করিছ ক্রন্দন।।
ঋষ্যশৃঙ্গ বলে আগে খাও ফল জল।
আজিকার বিবরণ কহিব সকল।।
ফল মূল খাইয়া হইল সুস্থ মন।
পিতা পুত্রে কথাবার্ত্তা কন দুই জন।।
তুমি যেই গেলে পিতা তপস্যার তরে।
স্বর্গ হৈতে ঋষিগণ এল মম ঘরে।।
সেইমত ফল নাহি খাই এ জীবনে।
এত রূপ দেখি নাই এ তিন ভুবনে।।
কত বা ছন্দেতে জটা ধরেছে মাথায়।
কত কুসুমের মালা দিয়াছে তাহায়।।
কি জাতি মৃত্তিকা ফোঁটা কপালে শোভিত।
গগন-মণ্ডলে যেন ভাস্কর উদিত।।
কি জাতি বৃক্ষের ফল সবার গলায়।
শ্বেত পীত নীল কত শোভিছে তাহায়।।
তেমন না দেখি পিতা গাছের বাকল।
শ্বেত রক্ত পীত নীল বরণ উজ্জ্বল।।
কি জাতি বৃক্ষের লতা সবাকার হাতে।
কতেক মাণিক গাঁথা আছয়ে তাহাতে।।
পরম ব্রাহ্মণ কারে লোম নাহি মুখে।
তূলার সমান কারো মাংসপিণ্ড বুকে।।
তাতে যদি হস্তটি করাই পরশন।
স্বর্গবাস হাতে পাই হেন লয় মন।।
মনে ভাবে মহামুনি পুত্রের বচনে।
স্ত্রী-পুরুষ ঋষ্যশৃঙ্গ কভু নাহি জানে।।
বিভাণ্ডক বলে বাপু তারা নারীগণ।
কামাচারী রাক্ষসী বেড়ায় বনে বন।।
মম পুণ্যে প্রাণ আজি রেখেছে তোমার।
পুনঃ পেলে ধরে খাবে না পাবে নিস্তার।।
ঋষ্যশৃঙ্গ বলে পিতা না বল এমন।
এমন দয়ালু নাই তাহারা যেমন।।
কালি যদি বিধাতা মিলায় তা সবারে।
তখনি বিদায় আমি কহিনু তোমারে।।
সারারাত্রি ছিল মুনি পুত্র লয়ে ঘরে।
বুঝাইতে তথাপি না পারিল পুত্রেরে।।
প্রভাবে হইল রাত্রি রবির কিরণ।
পুত্রের বিষয় মুনি ভাবে মনে মন।।
যদি আমি ঘরে থাকি পুত্রে করি সাধ।
ধর্ম্ম নষ্ট হবে মম হবে অপরাধ।।
কার পুত্র কার পত্নী সব অকারণ।
সংসার অসার, সব সত্য নারায়ণ।।
পুত্রেরে প্রবোধ করিলেন মহামুনি।
কারো সঙ্গে কথাবার্ত্তা না কহিও তুমি।।
তাম্রবাটী হাতে নিল, তুলিল তুলসী।
তপস্যা করিতে গেল বিভাণ্ডক ঋষি।।
বুড়ী বলে বুড়া মুনি ছাড়ি গেল ঘর।
সবে চল আনি গিয়া মুনির কোঙর।।
তাল করতাল বীণা কেহ পূরে বাঁশী।
আইল মুনির কাছে সকল রূপসী।।
দরিদ্র পাইল যেন হারান যে ধন।
ব্যস্তে মুনি কহে ধরি বুড়ীর চরণ।।
আমারে এড়িয়া কালি গেলে পলাইল।
সারারাত্রি কান্দিয়াছি তোমার লাগিয়া।।
সেই জল দেহ মোরে করিতে ভক্ষণ।
সঙ্গে করি লৈয়া যাহ করিব গমন।।
মর্ম্ম বুঝ সবে, কৃত্তিবাসের সুবাণী।
নারীর কথায় ভুলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।।