ছোট ছেলের বউ লুৎফা গরম গরম মিষ্টি চায়ে মুঠো খানেক মুড়ি ভিজিয়ে গোছগাছ করে দিয়ে গেছে। আবুল আকন্দ তৃপ্ত হয়ে গতকালের ব্যথা-কাতর ডান হাত ছেড়ে বাঁ হাতে চামচে তা মুখে তুলে নেন। কিছুটা আয়েশি হয়ে। হাত ওঠানামা করার একপর্যায়ে বাঁ হাতটা তাঁর শার্টের বুক পকেটে লাগে। তখন তিনি বুক পকেটে রাখা তাঁর বড় ছেলে আফজালের চিঠিটার কথা মনে পড়ে। সে লন্ডন থেকে লিখেছে। চিঠিটা তাঁর পকেটে কয়েক দিন ধরে।
আয়েশি ভেজা মুড়ি খাওয়ার আস্বাদনে তাঁর ভাটা পড়ে খানেক। মিষ্টির সঙ্গে মুখে তেঁতো জমে। নিজেকে নিজের কাছে অসহায় মনে হয়। তখন আবুলের একটু আগে চলে যাওয়া লুৎফার যাত্রাপথের দিকে চেয়ে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী কোহিনূরের কথা মনে পড়ে।
আফজালের চিঠিটা তাঁকে মানসিকভাবে অস্থির করে রেখেছে। তাঁর যত দূর মনে পড়ে, কম লিখলেও আগের চিঠিতে বরাবর সে তাঁকে ‘বাবা বলে সম্বোধন করত’। এবার লিখেছে, ‘আব্বাজান’।
যদিও তিনি তা এরই মধ্যে বার কয়েক পড়েছেন। পড়ে বিব্রত হয়েছেন। আবার চিন্তিতও হয়েছেন। চিঠিটা আবার তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরেন।
‘আব্বাজান,
আশা করি আল্লার রহমতে ভালো আছেন। আমি যত দূর জানি, আপনি কাজে লেগে আছেন। এটা খুব ভালো কথা। এ দেশিরাও তাই বলে, বয়সের কথা ভুলে যাও। যত দিন পারো কাজ নিয়ে থাকো, এতে আয়ু বাড়ে। শরীর ভালো থাকে। এ ছাড়া দু-চার পয়সা আয়ও তো হয়।
ইংল্যান্ডে এসে লেখাপড়ায় খুব একটা এগোতে পারিনি। হয়তো তা আর হবেও না। ৮-১০ বছর হয়ে গেল। দেশেও আসতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুতেও না। কারণ কাগজপত্র ঠিক ছিল না। এখন আল্লার রহমতে সেই অসুবিধা দূর হয়েছে। আমি ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়েছি।
পরের গোলামি তো অনেক করলাম। এবার ভাবছি, নিজে একটা কিছু করব… ব্যবসা-বাণিজ্য। মূলধন লাগবে। সেটা না হয় আমি দেখব…কিন্তু ভাবছিলাম কি…এখানে আমার যদি নিজস্ব একটা বাড়ি থাকত খুব ভালো হতো। লন্ডন শহরে বাড়িভাড়া দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যায় না।
আমি ভাবছিলাম কি…ঢাকার আশপাশে আমাদের তো কিছু জমিজমা আছে। যত দূর জানি, সেগুলো এখন অগ্নিমূল্যে বিকোয়…কোটি…কোটি…। এর কিছু বেচেটেচে আমাকে যদি হাজার তিরিশেক পাউন্ড দিতে পারতেন…লন্ডন সাব-আর্ভ-এ ভালো একটা বাড়ির সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু ডাউন পেমেন্ট একটু বেশি…। ভেবে দেখেন, আপনারও বয়স হয়েছে। একা মানুষ। কে দেখবে এসব জমি-সম্পত্তি।…টাকা জোগাড় হয়ে গেলে হুন্ডির ব্যবস্থা আমি করতে পারব। অসুবিধা হবে না…।’
গতকাল জয়দেবপুর-ঢাকা বাস ধরে ফার্মগেট নেমে আবুল হোসেন বরাবরের মতো রাস্তা ক্রস করেন। মেইন সড়ক ধরে। নানা ধরন, নানা জাতের যানবাহন, রিকশা-সাইকেল-ভ্যান পথচারীর অনিয়ন্ত্রিত ছোটাছুটি এড়িয়ে, পাশ কাটিয়ে রাস্তার পশ্চিম পাড়ে আসতে হয় তাঁকে। দীর্ঘ বসা জার্নির পরে ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামাতে তাঁর পা আজকাল আগের মতো আর সমর্থন দেয় না খুব একটা; বরং আজকাল পা দুটির গিঁট জোড়া অপারগতাই জানাতে চায়। তার বয়সও তো কম হলো না। মাস কয়েক হয় সত্তরের ঘর ছুঁয়েছেন তিনি। সেরিকালচার ইনস্টিটিউট, রাজশাহী থেকে ঢাকা অফিসে বদলি হয়েছেন অনেক দিন। এখান থেকে অবসর নেন। অবসরের বছর খানেক পরে পথে একদিন তাঁর বাল্যবন্ধু আতিকের সঙ্গে দেখা। সেদিন থেকে তাঁর বেকারত্বের অবসান ঘটে। পরের দিনই তাঁকে আতিকের জয়দেবপুরের কলেজ-কাম স্কুল, স্কুল-কাম কোচিং সেন্টার-এ যোগ দিতে হয়।
আজ ফার্মগেটের পশ্চিম পাড়ে এসে আবুল অগণিত দোকানপাটে দখল কোনার ওয়াকওয়েতে উঠে পড়েছিলেন প্রায়। তখনই বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে একটি মোটরসাইকেল এসে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে যায়। তিনি পাশে দাঁড়ানো একটা রিকশার গা ঘেঁষে মাটিতে পড়ে যান। আপ্রাণ উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু চোখে চশমা না থাকায় কাছে-কিনারের কোনো সাপোর্ট ধরে উঠে পড়ায় খুব সফল হতে পারছিলেন না। কেউ একটু সাহায্যে এগিয়ে এলে তিনি উঠে দাঁড়ান। কিন্তু চোখে দেখছিলেন না কিছুই। অবস্থা দেখে কেউ একজন তাঁকে চশমা খুঁজে দেয়। তখন তিনি দেখেন, তাঁর ডান পায়ের পাজামা তাজা রক্তে সপসপে ভেজা। বাঁ চোখের পাশ দিয়েও দু-চার ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে নামছে তাঁর বাদামি পাঞ্জাবির জমিনে।
এসব ক্ষেত্রে রাস্তাঘাটে তাৎক্ষণিকভাবে একটা হইচই, অস্থিরতার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, এখানেও তা-ই হলো। অল্প বিরতিতে জমে ওঠা বেশির ভাগ লোকজন যার যার কাজ বা দিকনির্দেশনার দিকে এগিয়ে কেটে পড়ার তাগিদ অনুভব করলেও দু-একজন দরদি হতে তৎপর হয়। এর মধ্যে একজন মাঝ বয়সী ও অন্য জন তুলনামূলকভাবে যুবকগোছের। যুবক ছেলেটি পালিয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলওয়ালাকে গালিগালাজ করে গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলে। বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁকে থামান। ‘কথায় তো কাজ হবে না… তাঁকে ডাক্তারখানায় নিয়ে চলেন। বেচারা তো দাঁড়াতে পারছেন না।’
তখন আবুল মুখ খোলেন।
‘ভাইসাব…আপনারা একজন একটু সাহায্য করলে আমি বাড়ি পৌঁছতে পারি। আমার ছেলে ডাক্তার…।’
কম বয়সীজন এগিয়ে আসে।
‘আপনার বাড়ি?’
‘বেশি দূরে নয়। মোহাম্মদপুর টাউন হল। শেরশাহসূরি রোড…।’
‘ও, আমিও তো ওই দিকেই থাকি। … তাজমহল রোড।’
ছেলে রিকশা ডাকে।
মোহাম্মদপুর টাউন হলের কাছেই জহীরকে দেখতে পান তিনি। আর গলা ফটিয়ে ডাকেন তাকে। জহীর ডাক্তার। বাবার চেহারা-অবস্থা দেখে সে আর দেরি করেনি। সোজা পঙ্গু হাসপাতালের আউটডোর। ভাগ্য ভালো, সেখানে তার এক সহপাঠী ডাক্তার-বন্ধু ডিউটিতে ছিল। ঝটপট এক্স-রে, ফার্স্টএইড, একাধিক প্রতিরোধক ইনজেকশন-ওষুধ দিয়ে সম্ভাব্য সব সমস্যার নিশ্চিত সমাধান দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
সকাল সকালই দুজনের সঙ্গে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতে হলো। একজন আবুলের সহকর্মী আতীক, অন্য জন তাঁর এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়। দুই সূত্রেই তাঁর বক্তব্যটা ছিল এ রকম: দুর্ঘটনা নয়। বরং এটাতে একটু ব্যথা পেয়েছি। টাল সামলাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, বুড়ো হলে যা হয়।
কিন্তু আবুলের ছোট ছেলে ডেনটিস্ট জহীর ব্যাপারটা সহজভাবে নেয়নি। যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তার বক্তব্য: আছাড় খাওয়া চশমার ডাণ্ডিটা আর একটু বেশি ডান চোখে ঢুকে গেলেই তো তা বাঁচানো যেত না। এ ছাড়া বাঁ পায়ের জখমটাও কম নয়। কিছুদিন ব্যথা নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হবে। তাঁর ডাক্তার স্ত্রী লুৎফা অবশ্য জহীরকে আশ্বস্ত করেছে। জটিল কিছু নয়।
ছেলের এসব সাবধানী মর্মবাণী তাঁকে বিচলিত করেনি। কিন্তু জহীর যখন কিছুটা কষ্টবোধ চেপে রাখার চেষ্টা করে বলে গেল, ‘বাবা, …তুমি আর কাজে যেয়ো না। বয়স তো কম হলো না। আর কত খাটবে…এবার বিশ্রাম নাও। আমার তো লেখাপড়া এ পর্যায়ে শেষ। চাকরিও একটা পেয়ে যাব। আর সন্ধ্যার দিকে না হয় একটা ডেন্টাল চেম্বারে বসার কথা ভাবা যাবে…। এ ছাড়া লুৎফাও তো ক্লিনিকে যোগ দিয়েছে।’
ছোট ছেলের কাছ থেকে এমন সিরিয়াস কথা শোনার জন্য আবুল প্রস্তুত ছিলেন না। সকাল সকাল জহীর কাজে চলে গেলে তাঁর চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ছেলের কথাগুলো তাঁর কানে ঘুরেফিরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। একটু পরে জহীরের বউ লুৎফা ট্রেতে চা সাজিয়ে নিয়ে আসে।
‘আব্বা, …নাশতা খেতে তো দেরি আছে। একটু চা…।’ ট্রেটা তাঁর সামনে রেখে চলে যায় লুৎফা।
এমনিতে জহীরের কথাগুলো তাঁকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল খানিকক্ষণ। ট্রের দিকে চেয়ে তিনি বাস্তবতায় ফিরে আসেন। লুৎফাকে ডাকেন।
‘বউ-মা, মুড়িটা চায়ে ঢেলে দিয়ে যাও। ডান হাতটা নাড়তে কষ্ট হয়। বাঁ হাতে চামচ তুলে নিয়ে খেতে পারব। দাঁতগুলোর অবস্থা ভালো নেই। শক্ত কিছু চিবোতে গেলে…।’
লুৎফা চা-মুড়ি গুছিয়ে দিয়ে গেলে আবুল আড়ষ্ট হয়ে ভাবেন, যাক আজকালকার অনেক বউ-ঝিদের মতো বাড়িতে বসে যাওয়া বুড়োদের অনাদার-অসম্মান করেনি। জহীরের কথাগুলো যেন আবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাঁর চারপাশ ঘিরে। ‘… কাজে যেয়ো না…বয়স তো কম হলো না।’ কথাগুলোতে আবেগমিশ্রিত ছিল। তখন আবুলের চার-পাঁচ বছর আগে তাঁকে ছেড়ে যাওয়া তাঁর জীবন সঙ্গিনী কোহিনূরের কথা মনে পড়ল। তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়ে তাঁকে ল্যাপটে-আঁকড়ে জড়িয়েছিলেন কোহিনূর। তাঁর আগে-পিছে, সুখে-দুঃখে, তাঁর অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে।
কোহিনূর তাঁর জীবনে এসেছিলেন অল্প বয়সে। সেই অবধি তিনি মুখ ফুটে কথা খুব একটা বলেননি। যাওয়ার সময়ও তিনি তেমনি নীরব ছিলেন। তাঁর রোগ ধরা পড়েছিল তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে। ছাত্র ডাক্তার ছেলে রক্তে ভেসে থাকা মাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন জানা গেল মায়ের জরায়ু ক্যানসার ছড়িয়ে গেছে সারা দেহে। সেই জ্ঞান আর ফিরে আসেনি।
আজ আবুলের কোহিনূরের কথা খুব মনে পড়ছে। তাঁর স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অবসরের জীবনে তাঁকে যেন তাঁর পাশে থাকা খুব দরকার ছিল। তাঁদের সারা জীবনের কত কথা, পাশাপাশি বসে স্মৃতিচারণা…। অথচ তা আর হলো কই! মুহূতে তাঁর চারপাশটা বড় শূন্য হয়ে যায়।
আবুলের মনে পড়ে, কোহিনূর শুধু একবারই মুখ ফুটে দু-চারটা কথা বলেছিলেন: ‘ভাড়াবাড়িতেই কি আমরা সারা জীবন কাটিয়ে দেব? দেখো না ছোটখাটো একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করা যায় কি না? আল্লার মাল দুটো ছেলে আছে আমাদের…।’
কোহিনূরের এই সহজ-সামান্য কথা কয়টি আবুলের কাছে খুব ওজনদার হয়ে উঠেছিল। তাঁকে সেদিন তিনি সামান্য সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘দেখা যাক’।
সেই ‘দেখা যাক’ থেকে তাঁদের আজকের মোহাম্মদপুরের এই তিন রুমের ছোট্ট স্থায়ী ঠিকানা। তাঁদের এর বেশি লাগেও না। কোহিনূরের বিয়ের গয়না বন্ধক দিয়েও সামান্য ঋণ করতে হয়েছিল তাঁকে। শুধু তাই নয়…এরপর থেকে আবুল কিছুটা সময় ধান্দাবাজ হয়েও রইলেন। সীমিত সামর্থ্যে আর কি সঞ্চয়, অর্জন করে রাখা যায়? সেটা ছিল সত্তরের দশকের কথা। তখন ক্যাশের অভাব সর্বত্র। লোকজনের মধ্যে জমি ছেড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা দিল। জমি বিক্রি হতো পানির দরে। ঢাকা শহর ছাড়িয়ে টঙ্গী-জয়দেবপুর-সাভার গেলে তো কথাই সেই। নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি হতো। বছর দু-একের মধ্যে আবুল হস্তগত করলেন কিছু চালা-ধানি জমি। বর্তমান কর্মচঞ্চল আশুলিয়া, টঙ্গী ও সাভারের ইপিজেড এলাকায়। সেসব সফল উদ্যোগে কোহিনূর হেসেছিলেন শুধু: ‘এত কি আমাদের দরকার? ছেলে দুটো মানুষ হলেই…।’
আফজাল-জহীর কেউ-ই মেধাবী ছাত্র বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু ছিল না। তবে আফজাল ছেলেটি বেশ করিতকর্মা ও চালাক-চতুর ছিল। অন্যদিকে জহীর ছিল ধীরস্থির, পরিশ্রমী।
আফজাল ঢাকার পুরোনো এক প্রাইভেট কলেজে গ্র্যাজুয়েট করার সময় কী সব ফন্দিফিকির করে ইংল্যান্ডের এক কলেজে আংশিক বৃত্তিসহ অ্যাডমিশন জোগাড় করে ফেলে।
খবরটা শুনে আবুল প্রথমটার কোনো মন্তব্য করেননি। বরং তাঁকে চিন্তিত দেখায়। রাতের খাবারের পরে শোবার ঘরে বসে ঘণ্টা খানেক পত্রপত্রিকা পড়ে আবুলের ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস। সেদিন এর ব্যতিক্রম হলো। মৃদু স্বরে স্ত্রী কোহিনূরকে ডাকেন আবুল।
‘শুনছ।’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘুমাওনি?’
‘না।’
‘আমিও আজ পড়ায় মন বসাতে পারলাম না।’
‘আমাদের ছেলে লন্ডন পড়তে যাবে।’ আমতা আমতা করেন কোহিনূর।
‘আমিও তো এতটা ভাবিনি।’
‘তবে এখানে কিন্তু আর্থিক বিষয়ও জড়িত।’
‘তাই তো শুনলাম। কিন্তু যেভাবেই হোক জোগান তো দিতে হবে। ধারকর্জ করে হলেও…। অন্তত প্লেনের টিকিট…।’
‘তাই…।’
যাওয়ার দিনও ঘনিয়ে এল। সকাল নয়টায় রিপোর্টিং। খুঁজে পেতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো। সবাই যাবে এয়ারপোর্টে। সারা রাত মা রান্নাঘরেই কাটালেন। সকাল আটটার মধ্যে খাবারের টেবিলে পোলাও-কোরমা, জর্দা-ফিরনি থেকে নিয়ে কী না ছিল!
এয়ারপোর্টে গিয়ে আবুল খন্দকারের মনে পড়ল, জীবনে একবারই তিনি বিমানে চড়েছিলেন। চাকরির প্রথম ধাপে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনে (পিআইএ)। ঢাকা-ঈশ্বরদী। ভাড়া ৩৫ টাকা। ঈশ্বরদী থেকে রেলে রাজশাহী। তাঁর দৌড় তো ছিল ওইটুকুই। তাঁর প্রথম চাকরি রাজশাহী সেরিকালচার ইনস্টিটিউটে। পরিসংখ্যান কর্মকর্তা।
সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিল টিনের স্যুটকেস। আরেকটা বাধ্যবাধক প্রচলন ছিল। বালিশ-কম্বলসহ বেডিং বহন করা। দড়ি বাঁধা। আবুলও তা-ই করেছিলেন। তা তখন মোটেই অশোভনীয় মনে হয়নি তাঁর।
অথচ তাঁরই ছেলে আফজাল সুট-টাই পরে হুইল লাগানো হাতলটানা স্যুটকেস হাতে বুক ফুলিয়ে এয়ার কাউন্টারের দিকে হেঁটে যায়। হাতে পাসপোর্ট-টিকিট। গর্বে আবুল ঘোমটা টানা কোহিনূরের দিকে চেয়ে সুখের মৃদু হাসি বিনিময় করেছিলেন সেদিন।
রাতে শোয়ার আগে কোহিনূর আবুলকে পান বানিয়ে দিতে দিতে বিনম্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।
‘সবই আল্লার ইচ্ছা…আমাদের ছেলে বিলাত যাবে! কে ভেবেছিল?’
বাবার চোখেমুখে অপার সন্তুষ্টি ফুটে ওঠে।
‘তাই…।’ চোখ বুজে মুখে পান পুরে দেন তিনি।
মায়ের চোখ-মুখ আরও উজ্জ্বল হয়।
‘বিলাত পাস দিয়ে দেশে ফিরলে তার জন্য তো আবার রাজকুমারী খুঁজতে হবে। বড়লোকের দুলালিরা তো এগিয়েই থাকবে…কী বলো?’
আবুল চোখ না খুলেই বলেন।
‘দেখা যাক…আল্লার কী ইচ্ছা? ধৈর্য ধরো। আগাম কথা…।’
চিঠি হাতে বসে থাকেন আবুল। তাঁর তখন মনে পড়তে থাকে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে আফজাল বলেছিল, ‘বাবা, আপনি ভাববেন না…একবার যখন বিলাতের এন্ট্রি পেয়ে গেছি…আমি লেখাপড়াটা শেষ দিয়েই জহীরকে নিয়ে যাব। সে যখন ডাক্তারি পড়তে চায়…দেশে তো ব্রিটিশ ডিগ্রিরই কদর বেশি।’
পরবর্তী সময়ে জহীরের ব্যাপারে আফজাল আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আবুল দু-একবার তাঁর বড় ছেলেকে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তার উত্তর পাননি তিনি।
এ ব্যাপারে তিনি আক্ষেপ করে জহীরের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সে কায়দা করে পাশ কাটিয়ে গেছে।
‘থাক বাবা, ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না। সবার বিদেশ যেতে হবে কেন?’
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপের তলানিতে লেগে থাকা ভিজে ফুলে ওঠা মুড়ি চামচে আঁচড়ে নিয়ে মুখে তুলে দিতে দিতে আবুলের মনটা বিষিয়ে ওঠে। আফজালের একেবারে বিবেকবর্জিত ধান্দাবাজি তাঁকে বিতৃষ্ণ করে তোলে। তখন তিনি চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান। কষ্ট হলেও অস্থির হয়ে পায়চারি করার চেষ্টা করেন।
পাকের ঘর থেকে ততক্ষণে দৌড়ে আসে লুৎফা।
এ কী করছেন আব্বা… আপনার তো ফুল রেস্টে থাকার কথা।’
‘না…,এই একটু টয়লেটে…।’
‘আমাকে ডাকতেন…। আমি কাছে না থাকলে একটা কথা ছিল।
কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছি কিসের জন্য?’
‘কত বিরক্ত করব মা?’
‘কিসের বিরক্ত! আমি ডাক্তার না…এটাই তো আমার পেশা। বেডপ্যান এনে রেখেছি। আপনি বিছানায় বসুন।’
লুৎফা চৌকির নিচে উঁকি দিয়ে বেডপ্যান বের করে দরজা ভেজিয়ে চলে যেতে যেতে বলে যায়।
‘আব্বা, আমি নাশতা দিচ্ছি…। এ বয়সে অপনাকে ডিমের কুসুম দেব না। দুটো ডিমের সাদা অংশ দেব। একটা আপনার জন্য কম হয়ে যায়। আপনার প্রোটিন ইনটেক বাড়িয়ে দিতে হবে…এ বয়সে…।’
লুৎফার নিখাদ মমতা জড়ানো কথায় বড় ছেলে আফজালের প্রতি সীমাহীন বিরক্তি ছাপিয়ে আবুলের মনে এক অভিনব সুখের আবেশ খেলা করে যেতে থাকে। তাঁর চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। চোখের সামনের আবছায়ায় ভেসে ওঠে কোহিনূরের ছবি। তাঁর মনটা তখন আরও করুণাসিক্ত হলো এই ভেবে যে, সে তো দেখে যেতে পারল না তার গড়ে তোলা সংসার কী সুন্দর আগলে ধরেছে, আনন্দময় করে রেখেছে ছোট ছেলে আর তার বউ লুৎফা!
লুৎফাকে ‘মা’ বলে ডাকতে গেলে আবুলের প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ভালো লাগার শত ডালপালা মেলে ভরে যায় তাঁর চারপাশ। আর বড় বেশি করে মনে পড়ে অকালে-নীরবে চলে যাওয়া কোহিনূরের কথা।
সাবধানে বাঁ হাতে ভর রেখে বিছানায় বসেন আবুল। পাশে পড়ে থাকা আফজালের চিঠিটা হাতে তুলে নেন। আহত ডান হাতের দুই আঙুলে চেপে ধরে বাঁ হাতে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেন চিঠিটা। ফেলে দেন বেডপ্যানের জলীয় গহ্বরে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply