পাগলকে খেপিয়েছিল লেহমা পারভীন নিশাত নিজে। বলেছিল—
এই, তোমার ল্যাপটপের ক্যামেরায় কি রেকর্ড করা যায়?
কেন?
এমনি। এবার আমি এলাম। তোমার কাছে থাকলাম, একসঙ্গে নাশতা বানালাম। ডিম পোজ করলাম, কফি বানিয়ে দিলাম। টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো কটা দিন আমার ল্যাপটপে লুকিয়ে রাখব। মাঝেমধ্যে দেখব।
কোথায় দেখবে?
নিরাপদভাবে, যেখানে মন চায়।
পৃথিবী তো আর নিরাপদ নয়।
ধ্যাৎ, রাখো তো তোমার আইডোলজি! পৃথিবী, দেশ গোল্লায় যাক, আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। আমার আমি, আমার মতো!
তুমি তো লেহমা দেশে থাকো না। তোমার চাইলেও তো কিছু আসবে-যাবে না।
কেন? আমি এ দেশের মানুষ না?
কেন যে হাসাও মাঝে মাঝে, বুঝি না।
এ্যাই ব্যাটা, তার মানে? বল শিগগিরই মানে কী?
খলিল জিবরান নিজের ঘাড় পেছনে ঠেলে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। তারপর নিজের পাঁচ-পাঁচ দশ আঙুলে নানা কিসিমের আংটি পরা হাত নিজের কাকের বাসার মতো চুলে ঢোকাল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। কী করে বোঝাবে লেহমা পারভীন নিশাতকে! যে ঘরে তারা বসেছিল, এটা লিভিং কাম ডাইনিং রুম। এক কোণে লম্বা ১০ ফুট টেবিল আর তিনটি চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। তিনটি চেয়ারের মধ্যে একটি আবার বেতের চেয়ার, অন্য দুটির চেয়ে নিচু। টেবিলে ঠাঁই নাই; রং, টিউব নানা ধরনের আঁকার সরঞ্জাম। একদিকে কিছুটা খালি জায়গা আছে, যেখান কাগজ রাখে খলিল জিবরান। এই ১০ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি, ১৩ বাই ১২ কাগজের ছবি সে টেবিলে বসে করে। এর চেয়ে বড় ছবি হলে ক্যানভাসে। খলিল জিবরান ঘরের কোণে ছড়ানো-ছিটানো চারটি ইজেলে কাজ করে। প্রতিটি ইজেলের সামনে বেশ কিছু রঙের টিউব পড়ে আছে। অনেকগুলো বড় কৌটাও আছে রঙের। বড় বড় ফুলদানিতে রাখা আছে ব্রাশ। দেয়ালে ঝুলছে এবং একেক কোণে থাক দিয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে ছোট-বড় নানা সাইজের ক্যানভাস ফ্রেম। খলিল জিবরান একমাত্র বেডরুমে কোনো রংকে ঢুকতে দেয়নি। বেডরুম মানে একটা কুইন সাইজের বেড। সাদা বেডকভার, সাদা কভারে ভরা চারটি বালিশ। বেডের মাথার কাছে একটা সাদা ফোনসেট। আর কোনো আসবাবপত্র নেই। যে কটা ড্রয়ার আছে, সব কুইন সাইজ। বেডের সঙ্গে লাগানো কাঠের ড্রয়ারে কিছু মূল্যবান, অমূল্যবান জিনিসপত্রের সঙ্গে বেশ বড় প্যাকেটে আছে কনডম। এই রুমে এসিও আছে।
লেহমা আর খলিল তাদের অতি তরুণ বয়সে প্রেমে পড়েছিল। প্রেমে পড়ার পর তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। এ এক অবাক কাণ্ড। সাধারণত প্রেমিক-প্রেমিকা হওয়ার পর আবার বন্ধুত্ব আর হয় না। তাদের হয়েছে। চরমভাবে হয়েছে। শুধু তাদের মধ্যে হয়নি বিয়ে। লেহমার বাবা ছিলেন ডাকসাইটে সচিব, ছিল খানদানের গরিমা। খলিল জিবরানের বাবা গরিব স্কুলমাস্টার। ছেলেমেয়ে ছয়জন। তার মধ্যে বড় ছেলে হয়ে দায়িত্বজ্ঞান কম খলিলের।
বাবা অন্ধভক্ত ছিলেন খলিল জিবরানের। জিবরানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত কিছু করতে না পেরে নিজের প্রথম পুত্রসন্তানের নাম দিয়েছিলেন খলিল জিবরান। ভেবেছিলেন, ছেলে হবে বড় কিছু একটা। খলিল জিবরান নামের একটা মাহাত্ম্য আছে না। টেনেটুনে সে দেশের প্রথম সারির শিল্পী হয়েছে। তার ছবির এক্সিবিশন হলে ভালো বিক্রি হয়। দেশি-বিদেশি সবাই ক্রেতা তার। এটুকুই। খলিল ভাবে, কম কিসে! খাঁটি খলিল জিবরান হতে গেলে ও রকম বাপও লাগে। নয় বছর আগে এই অ্যাপার্টমেন্ট সে কিনেছে। একাই থাকে। বাপের বাড়িটা রিনোভেট করে ভাইদের দিয়ে দিয়েছে। তার পরের দুই ভাই কয়েক বছর হয় ভালো চাকরি পেয়েছে। বিয়ে করেছে। মা অন্য ভাইবোনদের নিয়ে তাদের সেই বাপের বাড়িতেই থাকেন।
ছবির ক্রেতা ছাড়া কারও প্রতি তেমন আগ্রহী নয় জিবরান। বন্ধুদের মধ্যে লেহমা প্রায় তিন-চার মাস পর পর আসে তার কাছে। মাঝেমধ্যে রাতে থাকে।
লেহমার স্বামী কাজ করে মালয়েশিয়ায়। বছরে একবার আসে দেশে। অথচ তিন মাস হতে না হতে ফিরে আসে লেহমা। শুধু তার দাড়ি-গোঁফে অগোছালো বন্য মানুষের মতো বন্ধুর জন্য। তার সঙ্গী বলতে এখন মাত্র একজন, সে হচ্ছে লেহমা পারভীন নিশাত। তাদের এই তীব্র সম্পর্ক হয়তো লেহমার খালা জানেন কিংবা জানেন না। ঠিক বুঝতে চায় না, বুঝতে পারেও না।
লেহমা প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিল খলিল জিবরানের চুল-দাড়ি একটু ট্রিম করিয়ে দিতে। খলিল রাজি হয়নি। লেহমাও ভেবেছে থাকুক, যে-যেভাবে সচ্ছন্দ থাকে থাকুক। খলিলকে শুধু লেহমা বোঝাতে চেয়েছিল—
তোমাকে দেখলে অনেকের অস্বস্তি লাগে, এই অগোছালো দাড়ি-গোঁফ আর লম্বা চুলে। মাঝেমধ্যে দেশি-বিদেশি করপোরেটের বড় কর্তা আসে, মাল্টিন্যাশনালের লোকেরা আসে। মিডিয়ার লোকেরা আসে, একটু গুছিয়ে থাকলে ক্ষতি কী?
যাদের কথা বললে, তারা সবাই আমার কাছে আসে। আমি যাই না তাদের করপোরেট প্লাস্টিক ওয়ার্ল্ডে। কারও অসহ্য লাগলে আসবে না।
লেহমা পারভীন নিশাত ভাবে, কে বোঝাবে এই পাগলকে। লেহমা ভাবল তার কোনো অসুবিধা হয় কি না। তেমন কিছু না। তিন-চার মাস পর ঢাকায় আসার প্রথম সপ্তায়, মাঝেমধ্যে তিন ঘণ্টায় তিনবার বাঁধভাঙা চরম আদরে উপনীত হয় লেহমা এই পাগলের সঙ্গে। তখন দয়া করে মেয়েদের রাবার ব্যান্ড দিয়ে টাইট করে পনিটেল করে নিজের লম্বা চুলকে জিবরান, তারপর করে খোঁপা। আবার খোঁপার ওপর শ্রীলঙ্কা থেকে আনা নেট লাগায়। দাড়িগুলোও তাই রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে টান-টান করে গিট্টু দিতে হয়। তবু দীর্ঘ চুমুর মধ্যে বেরসিক গোঁফের কিছু লোম লেহমার মুখে ঢুকে গেলে থামতে হয়। প্রথম দিকে একটু কেমন লাগত, পরে ঠিক হয়ে গেছে।
লেহমা তার স্বামী তো নয়ই, মাঝেমধ্যে কখনো-সখনো ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেলে যে সহবাস হয়, তাতে মাত্র ১০০ ভাগের ১০ ভাগ তৃপ্তি পায়। একমাত্র এই জগতে, এই জীবনে যেন একজন পুরুষ খলিল জিবরান আছে, যে তাকে নিয়ে যায় সাত আসমানে।
এখন তো অন্য কারও সঙ্গে প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি স্বামীর সঙ্গেও ফর্মালিটিজ রক্ষার্থে মাসে বা দুই মাসে সাড়া দেয়। দিন-রাত লেহমা শুধু ভাবে, কবে ঢাকা যাবে। দু-একবার এমনও হয়েছে, একা কুয়ালালামপুর থেকে এসেছে ঢাকায়। তার শ্বশুরবাড়িতে গাড়ি পাঠাতে ফোন করেনি, সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেছে খলিল জিবরানের অ্যাপার্টমেন্টে। ছয় ঘণ্টা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে কিংবা কোনো বান্ধবীকে ফোনে ডেকেছে ড্রপ করে দিতে। লেহমা শুধু নয়, খলিলও ভেবেছে এই তীব্র আকর্ষণের কথা। কেন এমন হয়?
সম্ভবত তাদের তরুণ বয়স থেকে জানাশোনা। সম্ভবত তারা একসঙ্গে থাকতে তীব্রভাবে চেয়েছিল, কিন্তু হয়নি বলে। সম্ভবত প্রধান কারণ বডি কেমিস্ট্রি ম্যাচ করেছে ১০০-তে ১০০ ভাগ।
খলিলও বিয়ে করেছিল। মাত্র নয় মাসে বউ ইয়াল্লাহ! ইয়াল্লাহ রে বলে পালিয়েছে। আর বিয়ে নামক ভয়াবহ সম্পর্কের কথা খলিল জিবরান স্বপ্নেও দেখে না। যারা দেখে, তাদেরও তার ঘেন্না লাগে। যেহেতু শুধু ভাত দিয়ে মাছ ঢাকা খেলা মনে হয় বিয়েকে। তার জানাশোনা দশজনের মধ্যে আটজনই হ্যাপি না একসঙ্গে থাকতে। তবু তারা থাকে, দামি গয়না-শাড়ি পরে অন্যদের বিয়ের পার্টিতে যায়। মুখ ঝুলন্ত করে কেউ মারা গেলে একত্রে যায়। সন্তানের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতেও একত্রভাবে যায়। বাসায় শুধু দুই বিছানায় আলাদা থাকে কিংবা একই বিছানায় থাকে দুজন দুই জগতে। তবু তাদের দেখাতে হয়, আমরা বিবাহিত।
খলিলের আরও একটি ভয়াবহ বদঅভ্যাস হচ্ছে অসুস্থ রুচি বন্য যৌনতা। নানাভাবে, বিচিত্র কায়দায় আধঘণ্টা পর পর তাকে তিনবার, কোনো নারী সহ্য করতে পারে না। পারে শুধু লেহমা পারভিন নিশাত।
লেহমা যেমন মাবুদের ওপর ভীষণ শুকুরগুজার করে যে খলিল জিবরানের মতো মানুষে তাকে দিয়েছেন; তেমনি খলিলও ওপরঅলাকে ধন্য-ধন্য করে, লেহমার মতো পরম সুন্দরী তাকে দিয়েছেন। বাঙালি সাধারণ অর্থে লেহমাকে সবাই কতটুকু সুন্দরী বলবে কে জানে। খলিলের কাছে মনে হয়, সে এই মর্তে মানবী নয়। প্রতিমার মতো পূর্ণিমা রাতে নামে। কিছুকাল অবস্থান করে এই মর্তে। আবার শক্তি সঞ্চয় করতে উঠে যায় আকাশে। কালো শরীরের রং যে এত অপরূপ মানুষকে মানায়, তা লেহমাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। একধরনের আলো বের হয় এই কালো থেকে। অন্ধকারে যখন খলিল জিবরান সম্পূর্ণ উলঙ্গ লেহমা পারভীন নিশাতকে তার অ্যাপার্টমেন্টে হাঁটতে-চলতে কফি বানাতে দেখে, তার মনে হয় এক মাদি ব্ল্যাক প্যান্থার। কীভাবে যেন এসে পড়েছে তার কাছে। কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো চুল লেহমার। কী যে মানিয়েছে! আজ থেকে নয় বছর আগে যে অপরূপ স্তন ছিল লেহমার, এখনো তেমনি কালো পাথরবাটির মতো আছে। একটুও ঝুলন্তমুখী নয়। নিয়মিত জিমে যাওয়ায় লেহমার সারা শরীরে এই প্যান্থার ভাব। কোমর আর পেট নাভি নিয়ে চিতার মতো ঢুকে আছে ভেতরে। হালকা মাসল ভীষণ মানিয়েছে তাকে। এই জগতে খুব কম বাঙালি রমণী আছে, যার দুটি সন্তান হওয়ার পরও এত আকর্ষণীয়।
অন্য নারীতে চলে না খলিলের। সাত বছর আগের এক ঘটনা, তার থেকে ১৩ বছরের ছোট যুবতী ঘন ঘন তার কাছে আসত, এমএর থিসিস ছিল খলিলের পেইন্টিংস। দীর্ঘ ছয় মাস আসা-যাওয়ার কারণে টেনেছিল পরস্পরের শরীর। সেই একবারের পরেই মনে হচ্ছিল যুবতী মারা যাবে। কেমন যেন মুখ খুলে ডাঙায় তোলা মাছের মতো শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে। মুখে শুধু একটি শব্দ—ব্যথা! ব্যথা!
খলিল জিবরান কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল, না তা নয়। তবে ডাক্তার বন্ধু হানিফকে জিজ্ঞেস করায় বলল, মাথায় আর যেখানে ব্যথা, আধঘণ্টা বরফ দাও বন্ধু, ফ্রিজ থেকে বের করে। আর কর্মসাধনের পর নেজাদ পাওয়া দোয়া আছে। জানলে পড়তে থাকো।
ডাক্তার নামী হানিফ, তার কথামতো বরফে কাজ হলো। ট্যাক্সি ডেকে মেয়েকে ধরে ধরে তুলে দিল। তুলে দিয়ে নিচ থেকে ওপরে ওঠার লিফটের দিকে পা বাড়াতে দেখে, তাদের তিনজন সিকিউরিটি গার্ড, একজন আবার এক হাত দাড়িধারী গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে। খলিলও তো মধ্যবিত্ত মাস্টারের ছেলে, সদা বুদ্ধি খেলে মাথায়। সিকিউরিটি গার্ডদের সিরিয়াসভাবে জিজ্ঞেস করল—হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পড়া আর দাঁত-মুখ খিঁচুনিকে যেন কী বলে? মৃগী ব্যারাম স্যার।
হ্যাঁ! ঠিক মনে পড়ছিল না।
আপার মৃগী থাকলে, স্যার, আমাদের কামরাঙ্গীর চরে মওলানা বদর আলী শাহ বেপারী খানকায় একটা পানিপড়া দেয়। একবার দিলে আর হয় না।
তাই নাকি! যে মওলানা দেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে আইসেন!
না স্যার, উনি তো কোথাও যান না।
ঠিক আছে, আপা যদি আবার আসে বলব।
আপা আর আসেনি।
খলিল জিবরানের ফেসটি চমৎকার। একটুও চর্বি নেই। বডিবিল্ডারদের মতো সারা শরীর গুটলা-গুটলা নয়। তবে চমৎকার চাপা মাসল দেখলেই বোঝা যায়, যোগী। সকাল-বিকেল ইয়োগা করলেই মানুষ এ রকম থাকে। তার রান্না একবার করে যান আম্বরীর মা। বয়স ৬০। ব্যাকবোনে চোট পাওয়ায় কবে যে কুঁজো হয়েছেন, তিনি জানেন না। কুঁজো অবস্থায় আম্বরীর বাপ তাঁকে বিয়ে করে তিন সন্তান পেটে দিয়ে ভেগে অন্য নারীর কাছে চলে যান। আর আছে ইসলাম ড্রাইভার। তাঁর টয়োটা স্টেশনওয়াগানে সে চড়ে খুবই কম। সে বাসা থেকে বের হয় ১৫ দিনে একবার। ইসলামই বাজার করে, যখন যা লাগে নিয়ে আসে। পেইন্টিংস ডেলিভারি দিয়ে আসে।
খলিল জিবরান প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার আগে ছাদে যায়, ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর একটা বড় মানুষসমান ড্রামে পানি ভরা থাকে, সেটির ভেতরে ডুব দিয়ে চুপ করে বসে থাকা। প্রথম শুরু হয়েছিল মাত্র ১০ সেকেন্ড পানির নিচে থাকা। এখন এক মিনিট ১০ সেকেন্ড চলছে। খুব ধীরে-সুস্থে দু-তিন সেকেন্ড করে বাড়াচ্ছে সময়। সারা বিল্ডিংয়ের প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে মানুষের কৌতূহল—কী করে এই পাগল! বিল্ডিং হাইফাই, থাকেনও হাইফাই। নব্য দুই নম্বর তিন নম্বর করা বড়লোক। যাদের সাহেবদের দেখা যায় না। সেইম আয়ের বা ভাইজানদের দেখলে বোঝাই যায়, কোন বৃন্তের ফুল এরা। ১০-১৫ বছর আগে ছিল কারওয়ান বাজারের আলু সাপ্লায়ার, এখন চড়ে প্রাডো জিপে। ভাবিরা বেশি কৌতূহল জাহির করে খলিল জিবরান সম্পর্কে। মোটাসোটা হুদোলকুদকুত কিছু ভাবি ছাদে ধ্যানরত খলিল জিবরানের শরীর দেখে আকৃষ্টই শুধু নয়, অনেকটা কামে ভোগে।
লেহমা খলিলের সবকিছুই সহ্য করে ফেলেছিল, শুধু একটা অভ্যাস তার অসহ্য লাগত খলিল জিবরানের। তা হলো পর্নো ছবির দর্শনপ্রীতি। খলিলের চরিত্রের সঙ্গে যা একেবারেই যায় না। হাজার চেষ্টা করেও তা ওকে বোঝাতে পারেনি লেহমা।
তার সঙ্গে চমৎকার কোনো সময়ে আবেগে মত্ত খলিল, হঠাৎ ফোন এল। ওর সোর্স খবর জানাল, এইমাত্র ইন্টারনেটে প্রভা-রাজীব এক্সক্লুসিভ আপলোড করা হয়েছে। অমনি খলিল তাকে আদর করে বলবে, জাস্ট টু মিনিট ডার্লিং। চলে যাবে ল্যাপটপ খুলতে। ইন্টারনেটের মহাসমুদ্রে হারিয়ে যেন না যায়, তার আগেই ডাউনলোড করে ফেলতে হবে। লেহমা সব ফেলে এই যে আসে, একসঙ্গে থাকে, পরে ফেরার পর সবকিছু খুব মিস করে। তাই জিজ্ঞেস করেছিল খলিলকে, তার ল্যাপটপে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা আছে কি না।
খলিল বলল, তার ছোট্ট হ্যান্ডিক্যাম ক্যামেরাই আছে। সেই যে ক্যামেরা অন করে রাখা শুরু করল খলিল, লেহমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল।
একি শুরু করলে খলিল! কফি বানাচ্ছি, পরোটা ভাজছি, বসে তোমার সঙ্গে কথা বলছি—সব কি রেকর্ড করে রাখতে হবে?
থাক না। পরে ডিলিট করে দেব। এত সব রেকর্ড করা মানে, আমাদের প্রতি মুহূর্তকে ধরা, যা ইচ্ছা রাখব। ভালো না লাগলে ফেলে দেব।
তবু কেমন অস্বস্তিকর লাগে আমার। লেহমা বিরক্ত হয়ে বলে।
তুমি তো বললে রেকর্ড করতে।
আমি তো বলেছিলাম মাত্র দুই মুহূর্ত। তুমি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা শুরু করে দিয়েছ।
খলিল সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল লেহমাকে—
চিন্তা কোরো না। এ তো কোনো ক্যাসেটের ব্যাপার নেই, ক্যামেরার হার্ডডিস্কে হচ্ছে। দেড় শ গিগা তার ক্যামেরার জায়গা। লেহমা রাগে বালিশ নিয়ে মারতে শুরু করেছিল খলিলকে।
অ্যাই ব্যাটা! আমি ক্যাসেটে আছে কি না! খরচের কথা বলছি? আমার খারাপ লাগে, নিজে স্বাভাবিকভাবে কোনো আচরণ করতে পারছি না। ভয় লাগে। মনে হয় একটা চোখ হরদম তাকিয়ে আছে।
এ রকম যেখানে অবস্থা, সেখানে খলিল জিবরান লেহমাকে না জানিয়ে তাদের দুজনের চরম আদরের মুহূর্ত রেকর্ড করল। লেহমা পারভীন নিশাতের এমন রাগ আর দেখেনি খলিল।
আমার পারমিশন ছাড়া কেন করলে?
খলিল যতই বোঝায়, এমন কী! তার কাছেই তো থাকবে। মাঝেমধ্যে যখন লেহমা থাকবে না, সে দেখবে শুধু তার ভেতরে স্পিড বাড়াতে। পেইন্টিংয়ের সময় তার হাতে স্পিড বাড়বে। সে তো আর ইন্টারনেটে তা আমজনতার জন্য ছেড়ে দিচ্ছে না।
তুমি করলে কেন? কেন আমাকে জানালে না। আমার একটাই জায়গা ছিল, যেখানে এলে আমি মনে করতাম আমার একান্ত আপন জায়গা। যেখানে আমি নিরাপদ।
খলিল রেগে যাচ্ছিল ক্রমশ। কেন তুমি বারবার নিরাপদ শব্দ ব্যবহার করছ লেহমা? আমি কি আমাদের একান্ত সময় বাজারে ভাসিয়ে দিচ্ছি নাকি!
যদি দাও, পুরুষদের কী বিশ্বাস!
ঠিক আছে, তাহলে আমি বলে দিলাম, যা করেছি তা আমি ডিলিট করব না। আমার একান্ত সম্পত্তি হিসেবে থাকবে। আমার কাজে প্রেরণা হিসেবে যখন লাগবে, আমি শুধু দেখব।
গুষ্টি মারি তোমার কাজের প্রেরণা। এতে শুধু তুমি একা নও। আমিও আছি। আমার রাইট আছে এটা শেষ করে মুছে চিরতরে শেষ করে দেওয়া।
আমি তা করতে দেব না।
তাহলে আজই শেষ। এই মুহূর্তে আমাদের সম্পর্ক শেষ। আমি আর তোমার এখানে আসব না।
লেহমা পারভিন নিশাত আর একটাও কথা বলেনি। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেছে। এমনকি যাওয়ার সময় খলিলকে ‘বাই’ পর্যন্ত বলার দরকার মনে করেনি।
আরও চার দিন পর ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে লেহমা যখন মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজ ধরতে ঢাকা এয়ারপোর্টে যাচ্ছে, তখন কেউ তাকে দেখলে চিনতে পারত কি না সন্দেহ। চার দিন সে ঘুমায়নি। তেমন কিছু খায়নি। কেমন একটা ঘোরে আছে। দীর্ঘদিনের তাদের সম্পর্ক খলিল জিবরান এই সামান্য তুচ্ছ কারণে শেষ করে দিল। তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। ওকে বিশ্বাসের কথা বলছিল খলিল। তারও ইগোতে লেগেছিল। শেষ করতে বলেছি। শেষ করো! ডিলিট করো। ব্যস তাই চাই।
শেষ মুহূর্তে লেহমার হাতে একটা বক্স দিয়ে গেল। ওপরে লেখা ‘লেহমা উইথ লাভ’ খলিল।
হাতে নিয়েই প্লেনে চড়ে বসল লেহমা। প্লেন টেকঅফ করার বেশ কিছুক্ষণ পর কোলে রাখা খলিলের বক্সটির কাগজ ছিঁড়ে র্যাপ খুলল। আরে! এ তো খলিল জিবরানের ক্যামেরা। আর ছোট্ট একটি চিঠি, ক্যামেরাসহ যা ছিল দিয়ে দিলাম। আর কিছু আমার কাছে নেই। এমনকি আমার ওপর বিশ্বাসও সঙ্গে দিয়ে দিলাম। বিশ্বাস না থাকলে কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাই আর যোগাযোগ থাকল না। আমার জীবনে একমাত্র তুমি আমাকে বুঝে দীর্ঘদিন থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। গুডবাই অ্যান্ড গুডলাক। খলিল জিবরান।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১১
Leave a Reply