৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) প্রায় নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন। তাঁর ৩০ বছরের দিনলিপির সংকলন হিসেবে ডায়েরি ১৯৭৮-২০০৮ শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে।
মান্নান সৈয়দের কন্যা জিনান সৈয়দের সৌজন্যে প্রাপ্ত তাঁর ২০০৮-২০০৯ কালপর্বের অপ্রকাশিত এই দিনলিপি বৈচিত্র্যে ভরপুর। এই দিনলিপিতে যেমন পাওয়া যাবে কবিতার খসড়া, পরিকল্পিত বইয়ের ছক, সাহিত্যপত্রিকাবিষয়ক ভাবনা, তেমনি আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের অম্লমধুর চিত্রও এখানে অনুপস্থিত নয়। বইয়ের দোকান থেকে কেনা গ্রন্থতালিকা থেকে যেমন লেখকের পাঠবৈচিত্র্য অনুধাবন করা যায়, তেমনি খণ্ড খণ্ড ব্যক্তিক অনুভূতির সূত্রে পৌঁছানো যায় নৈর্ব্যক্তিক বোধে।
সংগ্রহ ও ভূমিকা: পিয়াস মজিদ
২৮ আগস্ট ২০০৮
তক্ষশীলা থেকে কিনলাম
আগুনের পরশমণি (সম্পাদনা)
একা নৌকার যাত্রী: নবেন্দু ঘোষ
বাংলার সেরা প্রবন্ধ: অরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
কবীর: ক্ষিতিমোহন সেন।
সহেব বিবি বণিক হারেম (ফ্যানি পার্কস): অনু: মীনাক্ষী দত্ত।
রক্তকরবীর নন্দিনীর খোঁজে: মৃদুল শ্রীমানী
রবীন্দ্রসংগীত অনুধ্যান: শচীন্দ্রনাথ সান্যাল
গায়ত্রীকে: বিনয় মজুমদার
বৈকালিক (পত্রিকা) রনে ক্লোর/ জাঁ রেনোয়া/ জাঁ লুক গদার
রনে শার: একটি কবি, কয়েকটি কবিতা: পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
স্কেচের খাতা: সুধীন মৈত্র
মেয়ের মতো: লীলা মজুমদার
২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮
সম্পাদকের বৈঠকে
রাম না জন্মাতেই রামায়ণের মতো সম্পাদকের বৈঠকে বই লিখে সম্পূর্ণ করার আগেই সূচীপত্র’র সর্বাধ্যক্ষ প্রচ্ছদ তৈরি করে ফেললেন ৩ জুন বুধবার রাতে। আর সেদিন দুপুরবেলাতেই ধানমন্ডির এআর প্লাজার খোলা রেস্তোরাঁয় মেক্সিকো থেকে কয়েকদিনের জন্য দেশে আসা কবি-সমালোচক রাজু আলাউদ্দিন আর তিতাস (রফিক উম মুনীর চৌধুরী, কবি বেলাল চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র)-এর সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে রাজুর আকস্মিক প্রস্তাব, আলোকচিত্রী হিসেবে আমার কোনো বইয়ে অবতীর্ণ হবে। এই আকস্মিক বইটির প্রচ্ছদ ও আলোকচিত্র এরকম হঠাৎ সম্পন্ন হলো। পৃথিবীতেও খুব ভেবেচিন্তে এসেছি কি?
বছর পঞ্চাশ হয়ে এল লিখে চলেছি। নিজের নামে তো লিখেছিই, অন্য নামেও লিখেছি। আর কোথায় না লিখেছি, সাহিত্যপত্রিকায়, বিনোদনপত্রিকায়, যৌনপত্রিকায়, গবেষণাপত্রিকায়। প্রথম প্রথম যত লেখা পাঠাতাম তার বেশির ভাগই হতো অমনোনীত। একসময় পত্রিকা অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। তারপর নিজেও পত্রিকার পর পত্রিকা বের করে গেছি। পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করা আবাল্য আমার নেশা। শুধু নিজে লিখেই আনন্দ পাই না। অন্যকে দিয়ে লিখিয়েও অসম্ভব পুলক অনুভব করি। আবার, এম্নিতেও সাময়িকপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালো লাগে আমার। যেমন নতুন পত্রিকা, তেম্নি পুরোনো পত্রিকাও। সর্বার্থে আমি একটু পত্রিকা-পাগল মানুষ। তারই একটি ইতিকথা এই বই।
(সম্পাদকের বৈঠকে নামে এই বইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশিত হয়নি।)
কণ্ঠস্বর
কণ্ঠস্বর-এর মতো পত্রিকাকে আমাদের একজন অগ্রজ অধ্যাপক প্রাবন্ধিক ‘সবচেয়ে রুচিশীল যৌনপত্রিকা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। হায়, তিনি অনেকদিন ধরে অনেকরকম পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন, এখনও কিন্তু সম্পাদক হিশেবে তাঁর ভূমিকা শূন্য: আশা করি, এতদিনে তিনি বুঝে গেছেন। কণ্ঠস্বর এবং সমকাল মোটামুটি এই দুই বিরোধী পত্রিকাতেই একসময় আমি দুহাতে লিখতাম। আমাদের এক অগ্রজ কবি আমার সামনেই অভিযোগ করলেন জাফর ভাইকে। লাভ হলো না কোনো। আমি দুটি কাগজেই লেখা চালিয়ে গেলাম। কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আমার সামনেই ইনি একদিন তাঁর লেখা ছাপাবার জন্যে বলেছিলেন, সম্পাদক আমলে নেননি, কেননা প্রথম পর্যায়ে কণ্ঠস্বর ছিল কেবল সদ্যোজাত তরুণদের মুখপত্র—অগ্রজদের মধ্য শহীদ কাদরী বোধহয় একবারই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু শহীদ কাদরী জীবনে ও সাহিত্যচর্চাতে ছিলেন ব্যতিক্রমী। সায়ীদ ভাইয়ের মতো সুভদ্র মানুষকে অগ্রজ একজন কবি ‘বেয়াদব ছোকরা’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
একটি বিনোদনপত্রিকায় কুৎসিত ভাষায় আমাদের এবং আমাদের দলনেতার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছিল। অগ্রজ একজন কবি আমাদের উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তার প্রথম লাইনটি এ রকম: ‘এইসব বাছুরেরা একদিন, ষাঁড় হবে জানি’। বুদ্ধিমান কবি কবিতাটি কোনো বইয়ে নেননি।
সাম্প্রতিক ধারার গল্প
সাম্প্রতিক ধারার গল্প নামে আমাদের ছোটগল্পের একটি সংকলন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখনি সম্পাদনা করেছিলেন। স্বনামেই একজন লেখক যদ্দুর মনে হচ্ছে নাগরিক পত্রিকায় এই বইটার একটি বিধ্বংসী আলোচনা লিখেছিলেন। তাঁর আলোচনার মূল পাত্র ছিলাম অকালপ্রয়াত গল্পকার শহীদুর রহমান আর আমি। বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক ভানুমতীর খেল দেখা যায়।
১৮ জুন ২০০৯
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
কলকাতায় ১৯৭৮ সালে কয়েকদিনের জন্যে গেছি। তার মধ্যেই যার সঙ্গে দেখা, সেই দেখি কোনো না কোনো পত্রিকা ধরিয়ে দিচ্ছে। দু-একজনের কথা মনে আছে: প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর সম্পাদিত অলিন্দ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা উপহার দিলেন। শিল্পী মনীন্দ্র মিত্র উচ্চারণ পত্রিকার বহুকাল আগের কয়েকটি সংখ্যা। এরকম আরো কেউ কেউ। একদিন পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁকে একটি পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে দিতে বললাম। সানন্দে রাজি হলেন।
১৪ আগস্ট ২০০৯
কবি-সমালোচক মনজুরে মওলা শ্রাবণ নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। ১৯৮৬-৮৭ সালে। আমার কাছে পত্রিকাটির তিনটি সংখ্যা আছে। আর বেরিয়েছিল কিনা, মনে নেই। উৎকৃষ্ট, বৃহদায়তন লিটল ম্যাগাজিনটির বিশেষতা ছিল অজস্র বইয়ের ছোট ছোট রিভিউ। ঠিক এ রকম কোনো পত্রিকা দেখিনি আগে পরে। যাইহোক, সম্পাদক প্রথম সংখ্যায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৮৬) একটি প্রবন্ধ ছেপেছিলেন কবিতা ও গদ্যের দ্বন্দ্বসমাস বিষয়ে। আমার ধারণা, এই প্রবন্ধের রচয়িতা মনজুরে মওলা ভাই স্বয়ং। পত্রিকাটি পাঠিয়ে তিনি আমাকে অনুরোধ করেন লেখার জন্য। লিখেছিলাম, শ্রাবণ-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় (জানুয়ারি-মার্চ ১৯৮৭) আমার মতামত জানিয়েছিলাম। তৃতীয় সংখ্যায় (এপ্রিল-জুন ১৯৮৭) একই বিষয়ে তাঁর অভিমত জ্ঞাপন করেছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ভাবনাসঞ্চারী এই রচনাত্রয় মনজুরে মওলা ভাই কোথাও যদি সংকলন করেন, তাহলে তো ভালো হবে বলে মনে হয়।
১৫ আগস্ট ২০০৯
আনা,
সারারাত মুষলধার তলোয়ারধার বৃষ্টি হয়েছে। এখন বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে, তবু হচ্ছে। আর সারিবদ্ধ রেলিংগুলোতে বৃষ্টির স্মৃতিবাহী ফোঁটা ফোঁটা জলকণা মুক্তোদানার মতো জ্বলছে। আমার হূদয়ের আবেগের মতো বলব কি? শেষ পর্যন্ত এই তুলনাও চলবে না।
তাহলে কেনবা ভেতরে ব্যথা আমার পারাপারহীন, প্রাণ একটানা নিদ্রাহীন জাগরণমুক্ত। আমি ওকে নিয়ে কী করি, বলো তো?
বৃষ্টি কমে যাবে একসময়, কিন্তু ব্যথার কোনো উপশম হলো না আমার, এমনকি মৃত্যু-আমৃত্যু ভেদ করেও চলতে থাকবে। তুমি আমার একলা চলার পথটিকে একটুখানি রমণীয় করে রেখেছ, সেজন্যে ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। কোথায় ছিলে তুমি, জানি না। কোত্থেকে এসে পড়লে আমার যন্ত্রণাদীর্ণ জীবনে! একটুখানি শান্তিপ্রলেপ মাখিয়ে দিলে। ক্ষতবিক্ষত হলেও আমার অন্তর্গত ছুটে চলাকে থামাতে পারি না—বোধহয় এই আমার বিধিলিপি। ওই বৃষ্টি, ওই আলো হয়ে ওঠা—ওরাই আমাকে প্রতিমূহূর্তে সঙ্গ দেবে।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯। সন্ধ্যা। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ
কথাসাহিত্যবিষয়ক বইয়ের সূচিপত্র
রবীন্দ্রনাথ
শরৎচন্দ্র: গৃহদাহ
নজরুলের উপন্যাস
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
জগদীশ গুপ্ত
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাদেশের ছোটগল্প
ছোটগল্প নিয়ে আরও লেখা
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
শহীদুল জহির
জীবনানন্দের ‘মাল্যবান’
জীবনানন্দের গল্প
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
অমিয়ভূষণ মজুমদার
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
(ওপরের উল্লেখিত বিষয় নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির বইটি)
২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (দুপুর)
খোরশেদ আলম
খোরশেদ আলম এসেছিল কাল এফতারের পরে।
তখন ড্রয়িং রুমে আমি সোফায় আসীন।
ওকে বসতে বললাম।
একটু ইতস্তত করে ও কার্পেটে বসল।
জিজ্ঞেস করলাম, কবে দেশে যাবে?
ও জানাল, চাঁদরাতে।
অর্থাৎ ঈদের আগের দিন পর্যন্ত কাজ করবে।
চাঁদরাতে নোয়াখালীতে যাবার জন্যে
একটা বাস রিজার্ভ করা হয়েছে।
টঙ্গী থেকে আসবে।
সেখান থেকে উঠবে কয়েকজন।
পঁচিশ-ছাব্বিশ জন উঠবে আমাদের পাড়ার বাজার থেকে।
বাজারের ব্যবসায়ী, দোকানদার, চাকুরে, বাড়ির কাজের লোক—
এ রকম সবাই মিলে ওরা বাসটা রিজার্ভ করেছে।
ভেতরে বসলে আড়াই শ টাকা।
ছাদে দু শ টাকা।
ও ছাদে বসে যাবে।
—দু শ টাকা?
ছাদে?—আমি ভাবছিলাম।
বাজারের জিনিসপত্র বাড়িতে নিয়ে গেলে
লোকে দশ-বিশ টাকা দেয় ওকে।
যেতেই লাগবে ওর দু শ টাকা।
আবার আসতেও তো তাই।
বউ-বাচ্চার জন্যে কিছু নিয়ে যেতে হবে না?
কত দিন পরে যাচ্ছে, কিছু টাকা দিয়ে আসতে হবে না?
রানু খেজুর এনে দিয়েছিল
খেল
পানি খেল
আমাদের বাজারের মিনতিদের মধ্যে নবাব মরে গেছে
বাদশাকে দেখেছি শেষ দিকে অথর্ব
এখন আর দেখি না।
মানে লুপ্ত হয়েছে।
যা ঘরপোড়ো হয়ে আছে
এখন শুধু দুজন মিনতিকে দেখি।
খোরশেদ আলম আর বোবা
ওরা এক বিলীয়মান প্রজাতির শেষ দুই বংশধর
শেষ কি? নাকি অশেষ?—ভাবছিলাম
ভাবতে পারছিলাম না।
সম্পাদকের বৈঠকে নামে এই বইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুলমান্নান সৈয়দ; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটি বের হয়নি।
এখানে উল্লিখিত প্রবন্ধগুলো নিয়েমান্নান সৈয়দের মৃত্যুর পর বেরিয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির শীর্ষক বই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply