বৃত্তাবদ্ধ নারী জীবন
মিনাজ মুর
ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা—সিরাজ সালেকীন \ কথা প্রকাশ \ প্রচ্ছদ: সদল \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ ২০০ টাকা
ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা সিরাজ সালেকীনের নারীবিষয়ক একটি গবেষণাগ্রন্থ। শাস্ত্রীয় জীবনে ভারতের নারীদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান ও যাপিত জীবনের নিরালম্ব কাহিনিই আদপে বর্ণিত হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের পরম মন্ত্রে, রাজনৈতিক কাঠামোর জগদ্দলে নারী জীবন কীভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অবদমিত, অরক্ষিত ও অপমানিত হয়েছে—এ তারই কথা। শাস্ত্রের নির্মোকে পুরুষনিয়ন্ত্রিত এ ডিসকোর্স রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর দিয়ে যুগযুগান্তরের নারীসত্তাকে কলুষিত করেছে ও সমাজের প্রান্তিকে অবস্থান করাতে বাধ্য করিয়েছে। আর বৈদিক দর্শনজনিত এসব শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে নারীর ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এ গ্রন্থে তারই ভারী অবগুণ্ঠনকে উন্মোচন করার প্রয়াস পেয়েছেন উপর্যুক্ত গ্রন্থের গ্রন্থকর্তা।
ভারতীয় সমাজ বাস্তবতায় সমাজ জীবনের তিনটি লক্ষ্য নির্ধারিত বলে লেখক বিবেচনা করেছেন—যেমন ধর্ম, অর্থ ও কাম। এসব ধারণা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে শাসক ও শোষক শ্রেণী তাদের শ্রেণীস্বার্থকে বারবার রক্ষিত করতে গিয়ে নারীকে করেছে নিম্নগামী ও প্রগতিরুদ্ধ। তাই বিধিনিষেধের জাঁতাকলে পিষ্ট ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে নারীর জীবন, যৌবন, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কোমল অঙ্কুর। শাসক শ্রেণী সুকৌশলে এসব আইন ঢুকিয়ে দিয়েছে শাস্ত্রীয় পুস্তকে, যা ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং যা ধর্মতত্ত্বের অভিধা পেয়েছে। ফলে এসব শ্লোক এসেছে সরাসরি স্বর্গের দ্বারপ্রান্ত থেকে। অতএব একে অমান্য, অস্বীকার ও অবজ্ঞা করার অধিকার ও সাহস কোনো নারীর নেই—ব্যত্যয় হলেই অবধারিত শাস্তি, নির্যাতন, অপমান ও মৃত্যুদণ্ড। শাস্তির ভয়াবহ রূপ দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ এবং বর্তমান আধুনিক যুগেও। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক মিসেল ফুকোর গ্রন্থ ডিসিপ্লিন আ্যাান্ড পানিশ-এ শাস্তির ভয়াবহতা বর্ণিত হয়েছে। আজও নারীরা বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের শিকার। আজও নারীকে যৌতুকের দায়ে জীবন দিতে হয়।
এই যে রাষ্ট্রের ভেতরে নারীদের অবদমন করার বাসনা, এটা হলো ডিসকোর্স। এ ডিসকোর্সের পেছনে আছে ক্ষমতা বা শক্তি আর এ ক্ষমতার পেছনে আছে এক আদর্শিক চিন্তা, যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এ শক্তিই নারীকে শাস্ত্রীয় করে রাখে, নারী করে রাখে যুগে যুগে, তাকে মানুষ হতে দেয় না। আজ নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা নারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
গ্রন্থভুক্ত প্রথম মনুসংহিতার গুরুত্ব বেদ ও গীতার পরই বৈদিক ভাবধারাকে বজায় রাখার জন্যই মূলত ইহলোক ও পরলোকের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। এ শাস্ত্রে নারীকে বলা হয়েছে মুদ্রা। এখানে নারীর স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। পুরুষের অনুগামী হওয়ার জন্যই যেন নারীর জীবনকে সমর্পিত করা হয়েছে। নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইহলোকে মনুষ্য সকলকে দূষিত করাই স্ত্রীলোকদের স্বভাব।’ [২/২১৩]
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মূলত মৌর্যসম্রাটদের রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহের সারাৎসার। মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এ শাস্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। এ শাস্ত্রে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়া হলেও একপর্যায়ে নারী দেখতে পায় যে সে মুক্ত নয়, সে পুরুষের ক্ষমতার কাছে পরাধীন হয়ে আছে। এখানে নারীর যৌনতা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নারী হয়ে ওঠে ভোগ্যবস্তু।
চাণক্যের নীতিশাস্ত্রেও নারীকে রাষ্ট্রীয় চাহিদা অনুযায়ী গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। নারীর চরিত্র ও সৌন্দর্যের কথা বলা হলেও পুরুষের ব্যাপারে শাস্ত্র থেকেছে উদাসীন। কাজেই চাণক্যের শ্লোকের জগতে নারীর পরিসর সংকীর্ণতার দেয়াল টপকে ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
গৌতম বুদ্ধের জন্মান্তর কাহিনি হলো জাতক। এ অর্থে জাতক ধর্মশাস্ত্র। এ ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হলো নির্বাণ লাভ করা। বুদ্ধ সমকালীন জীবনাচারে ছিলেন বিতৃষ্ণ। নির্বাণের আশায় তিনি সদ্যোজাত পুত্রসহ স্ত্রীকে না জানিয়েই গৃহত্যাগ করেন। এ শাস্ত্রে ভিক্ষু জীবনকে নিষ্কণ্টক রাখার জন্য গৃহ ও নারী অস্বীকার করা হয়েছে। নারী যেহেতু গৃহের মায়া তৈরি করে, সেহেতু নারী পরিত্যাজ্য। এখানেও পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাদম্ভেরই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। আর নারী, সংসার ও সন্তানের মোহ আগের দর্শন মানবজীবনে একধরনের স্খলনের জন্ম দেয়।
অন্যান্য শাস্ত্র যেমন পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশেও নারীর প্রতি বৈষম্যের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব প্রায় প্রতিটি শাস্ত্রেই বাণীবদ্ধ হয়েছে নারী শাসন ও শোষণের ঈশ্বরীয় শ্লোক, যাতে নারীর জীবন হয়েছে বৃত্তাবদ্ধ, সংকীর্ণ, আলোবঞ্চিত ও নিষ্করুণ।
ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা এ সময়ের একটি অমূল্য সংযোজন। সময়োচিত এ গ্রন্থের প্রকাশনার মাধ্যমে গ্রন্থকার সিরাজ সালেকীন প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভ্যন্তরে আলোক্ষেপ করে তারই ভেতরের অন্ধকার জীবনের ক্লেদজ কুসুম আর নারীজীবনের সম্ভাবনার দ্বারটুকুকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এ গ্রন্থটি নারী জাগরণের জন্য আরেকটু শিখা উসকে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply