০৬-১০. বাঁধন হারা

০৬. বাঁধন হারা

এক শ্রেণীর যুবক আছে। তারা খুব যে বড়লোক তা নয়। এমন কি তাদের পিতা-মাতা হয়তো খুব কষ্ট করেই সংসার চালাচ্ছেন, পরিবারস্থ নির্ভরশীলদের অন্ন-বস্ত্র দিচ্ছেন। এইসব পরিবারের দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবকেরা সিঁথি কেটে, ছেঁড়া কাপড়খানি কুঁচিয়ে ছিন্নপথ ঢেকে, পথে পথে দলবদ্ধ হয়ে, বাড়ি বাড়ি খেলা করে, গল্প করে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খাবার সময় খেতে আসে, বাকি সময় ইয়ার্কি দিয়ে বেড়ায়, তাস খেলা, জটলা বেঁধে বেড়ান এদের কাজ।

সংসারের কোনো ধার এরা ধারে না। উপায় উপার্জনের কোনো চেষ্টা নাই। যেন পরম নির্ভরশীল সাধু দরবেশ! ভবিষ্যৎ চিন্তা এদের মোটেই নাই।

পরস্পরে এদের বন্ধুত্ব খুব বেশি–একজন আর একজনের জন্য প্রাণ দিতে পারে।

পিতা-মাতার ভর্ৎসনা, কোনো গুরুজনের উপদেশ, এদেরকে সজাগ সতর্ক করে না। বৃদ্ধ তার পীড়িত পিতা এদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। মা কথা বলে ছেলের কাছে অপমানিতা হন। এরা লেখাপড়া বিষ চোখে দেখে।

এইসব যুবকের ভবিষ্যৎ যে কত ভয়ানক তা বলা যায় না। চিরদিন এ সুখের দিন থাকে না, ক্রমশ দুঃখের দিন ঘনিয়ে আসে। পিতা-মাতার অন্তর্ধানে সংসারের সু-কঠিন চাপে এদের দুর্দশার সীমা থাকে না–তখন ঘোর অনুতাপ ও মর্ম যন্ত্রণায় এরা অস্থির হয়ে ওঠে–কিন্তু সে অনুতাপ ও অস্থিরতায় কোনো লাভ হয় না। বড় বড় শহরে এই শ্রেণীর যুবকেরা বাড়ি ঘর ছেড়ে চুরি, লাম্পট্য, জুয়াচুরি এবং অতি মন্দ পথ অবলম্বন করে। ক্রমশ এইভাবে কিছুকাল চলতে থাকে, কেউ জেলে যায়। এদের যতই আঘাত করা যায়, ততই এরা যেন ভয়ানক এবং হিংস্র হতে থাকে।

আলস্যে যৌবন কাটিয়ে দিলে জীবনে দুঃখের অন্ত থাকে না। যদি লেখাপড়া না হয়ে থাকে, তবে অনুতপ্ত হও, কুসঙ্গ ত্যাগ কর। আকাশ ভেঙ্গে গুড়ো করবো, পাহাড় ভাঙ্গবো–এইসব আস্ফালন ত্যাগ কর। কোনো শিল্প শিক্ষা কর, তাহলে জীবনে সুখী হতে পারবে। ইতর লোকদের হাতে বহু লাভজনক শিল্প আটকা পড়ে আছে। সেগুলি যদি ভদ্র সন্তানেরা নিজ হাতে গ্রহণ করে, তবে অর্থের অভাব থাকবে না।

নীচ-হীন পন্থা, চুরি, দুষ্কার্য, প্রতারণা, ছলনা, ঘুষ, পল্লী গ্রামের লোকদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে, নারী বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা বড়ই ঘৃণিত কথা। যদি শরীরে শক্তি থাকে, তবে কৃষি কাজও করতে পার। বন্ধুদের সঙ্গ লাভে জীবনটা নষ্ট করো না। বিপদকালে কোনো বন্ধু তোমার কাছে আসবে না। পরম আত্মীয় যারা, তারাই তোমার দুঃখ-বিপদের সময় সহায় হবে। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে জীবনকে মূল্যবান করে গড়ে তুলতে চেষ্টা কর। কাজে লেগে যাও। কারো সঙ্গে জল্পনা কল্পনা, পরামর্শ করে সময় নষ্ট করো না–কাজে লেগে যাও। পথে পথে ঘুরে বেড়ান, সংসারের কোনো ধার না ধারা, গুরুজনদের অবাধ্য হওয়া, গুরুজনদের সঙ্গে তর্ক করা, এসব বড়ই খারাপ।

যৌবনকালে ছেলেরা কুসঙ্গে পড়ে নেশা করতে শেখে। শহরের ছেলে হলে এমন কি বেশ্যাবাড়ী যেতে শেখে। যুবকেরা গুরুজনের অগোচরে সর্বনাশের পথে হাঁটে। একবার পাপের পথে যাওয়া আরম্ভ করলে সেই অভ্যাস আর কাটে না। এক নারী ছেড়ে আর এক নারী, এক বেশ্যা ছেড়ে আর এক বেশ্যার কাছে যেতে প্রাণ চায়! বেশ্যাদের ব্যাধিপূর্ণ শরীরের সংস্রবে এসে সোনার শরীর ধ্বংস হয়–গণোরিয়া, উপদংশ প্রভৃতি পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয়! দূর থেকে মনে হয় বেশ্যাদের কাছে যেন কী স্বর্গীয় বস্তু আছে–কিন্তু অমন সর্বনেশে ভয়ানক বিপদ-উৎস আর নাই। দূর থেকে বেশ্যাদের রূপ, আগুন মনে করে পালিয়ে আসবে।

কতগুলি যুবক মনে করে, চাকরি করলে জীবনের হীনতা প্রকাশ পায়। সেবার দ্বারা জগৎ চলবে। যে কোনো চাকরি কর–উপরের কর্মচারীকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি কর। চাকরিতে কখনও জীবনের হীনতা মনে কারো না। তুমি সামান্য চাকরি করেও যদি ঐখানে তোমার কর্তব্য পালন করতে পার, তা হলে তুমি মহৎ এবং শ্রেষ্ঠ বলে গণিত হবে। ইতালীর যে নগরদ্বয় আগ্নেয়গিরির ভস্মপাতে ধ্বংস হয়েছিল, সেই ভস্ম মধ্যে অনেককাল পরে দেখা গিয়াছিল, এক কর্তব্যনিষ্ঠা সৈনিক বন্দুক হস্তে শেষ পর্যন্ত আপন কর্তব্য পালন করে জীবন দিয়েছেন। তিনি সামান্য সৈনিক হয়েও মহৎ এবং নমস্য।

একজন সামান্য পিয়ন হয়েও তুমি জীবনের মহত্ত্ব বজায় রাখতে পার। উপরের কর্মচারীর অবাধ্য হওয়া, তাকে অশ্রদ্ধা করা প্রকৃত সজ্জন ব্যক্তির কার্য নহে। যুবকদের মনে অবাধ্যতা, ঔদ্ধত্য একটা বিশেষ আদরের জিনিস।

অপরিচিত গুরুজন, বয়োজ্যেষ্ঠ নরনারীকে ‘তুই তুই’ করে কথা বলা, হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্বল নর-নারীকে অপমান করা, প্রহার করা বড়ই অসভ্যতা। যৌবনকালেই অধিকতর বিনয়ী, সভ্য ও ভদ্র হওয়া উচিত। গায়ের জোর চিরদিন সমান থাকে না। যৌবন-শক্তি দুর্বলকে রক্ষা করে, সাহায্য করে সার্থক ও সুন্দর হয়। মারামারি ও অত্যাচারে যদি যুবকের ঐ মুষ্টির অপব্যবহার হয়, তাতে ঈশ্বরের দানের ঘোর অপচয় হয়–যুবকেরা তা বিশ্বাস করবে কি?

মুসলমান সমাজে কুসঙ্গের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। সৎ কথা, সদালাপ, সৎ উপদেশ যেন . একেবারেই সমাজ হতে উঠে গিয়েছে।

পরমুখাপেক্ষী না হয়ে, স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করে যৌবনকে সার্থক কর। যৌবন যদি বৃথা নষ্ট করে ফেল–হঠকারিতা, প্রগলভতা, বাচালতা, বিলাসিতা, চরিত্রহীনতা প্রভৃতি দ্বারা জীবন নষ্ট করে ফেল, তা হলে শেষকালে অনুতাপ করেও কোনো ফল হবে না।

০৭. যুবকদের কর্কশ কণ্ঠ ও অন্ধবুদ্ধি

যুবকেরা যৌবনকালে সাধারণত অসহিষ্ণু হয়ে কর্কশ ঝাঝালো কথা বলে। ভদ্রতা, বিনয়, ধীরতার মূল্য তারা আদৌ অনুভব করে না। কি গৃহে, কি বাহিরে সর্বদাই অপেক্ষাকৃত হীন পদস্থ বা দুর্বল-শক্তি নর-নারীকে, এমন কি স্নেহ রসাÉ গুরুজনকেও কঠিন কণ্ঠে কথা বলে। সময়ে সময়ে এজন্য তারা যথেষ্ট অপদস্থ হয়। সময়ে শিক্ষা হয়, সময়ে শিক্ষা হয় না–উত্তরোত্তর রূঢ়তা ও স্বভাবের উগ্রতা বাড়তে থাকে।

অযথা আস্ফালন করাও তাদের স্বভাব। আত্ম-গৌরব, বংশগৌরব করে অপরকে হীন ও ছোট প্রতিপন্ন করতে তারা কোনো লজ্জাবোধ করে না। নিজের সম্বন্ধে অযথা একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করে। ফলে বহুস্থানে, জীবনের অনেক কাজে ঠকতে হয়।

বৌকে প্রহার করাও তাদের এ বয়সের একটি রোগ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে উপহাস করা, পেছনে দাঁড়িয়ে বিদ্রূপ করা, মানুষের গ্লানি করা, দুই চারজন যুবক এক জায়গায় বসে–লাটকে ফকির করা, ফকিরকে লাট বাহাদুর করা, মানুষের চরিত্র সমালোচনা করা পথে পথে ঘুরে বেড়ান, নিজের ভবিষ্যৎ ভাবনা ভুলে যাওয়া, দুর্বল মাকে উপেক্ষা করা, তাস, পাশা খেলা, সর্বত্র হঠকারিতার পরিচয় দেওয়া, বিচারশূন্য হয়ে মানুষকে মারা এবং অপদস্থ করা, তাদের দৈনিক স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। যুবকদের নিয়ে কাজ করা, বড়ই বিপদ। অসংযত চরিত্র, উদ্ধত স্বভাব, নিয়ম-বিদ্রোহী যুবকদের নিয়ে চলা এক সমস্যার বিষয়।

জায়গার বলে আস্ফালন করা, অগোচরে প্রতাপের পরিচয় দেওয়া, কোনো বিষয় ডিক্রি দেওয়া, ডিসমিস করা, তিন তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়া, অন্তসারশূন্য পদ গরিমা এবং শক্তিমত্তার পরিচয় দেওয়া যুবক জীবনের মস্ত বড় বোকামি। লাট সাহেবের চাইতে বেশি নবাবি চাল মারা কোনো কোনো যুবকের প্রকৃতি। ঘরের মধ্যে তেজস্বিতার পরিচয় দেওয়া, আপন স্ত্রীর কাছে মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, দাম্ভিকতা প্রকাশ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অগোচরে মানুষকে সম্মানের সঙ্গে লোক সমক্ষে ধরাই ভদ্রতা এবং মনুষ্যত্ব। কোনো কোনো লজ্জাহীন যুবক সারাজীবনেও এই অযথা আস্ফালন বর্জন করে না। জীবনে যতই তারা ছোট হতে থাকে; ততই দাম্ভিকতার পরিচয় দেয়। যে যত হীন সেই অগোচরে মানুষকে তত অসম ও তাচ্ছিল্য করে কথা বলে। তাদের নিজ পুত্রকেও এইভাবে কথা বলতে শিক্ষা দেয়। উচ্চ গরিমাব্যঞ্জক হাসিও এই বয়সের স্বভাব। কোনো কোনো যুবক অন্তরকে সুন্দর করার ইচ্ছা বর্জন করে এই বয়সে বাইরের সাজ-সজ্জা নিয়ে অতি মাত্রায় ব্যস্ত হয়। শেষকালে হয়তো তাদের মাথায় তেল জুটে না। নিজের সম্বন্ধে অযথা মিথ্যা গর্বিত ধারণা, অতিরিক্ত শঠতা ও বাচালতা যুবকদের সর্বনাশ করে।

.

০৮. পরের বুদ্ধি

যে যুবক পরের বুদ্ধি গ্রহণ করে, সে মরে। অথচ এই বয়সে যুবকদের অসংখ্য পরমার্শদাতা, যদিও হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু জুটে না। যার যা ইচ্ছা তাই বলুক–নিজে মুক্তি ও জয়ের পথ ভেবে নিয়ে অবিচলিতভাবে সে পথে চলা উচিত। কেউ কারো জীবনের গুপ্ত রহস্য অনুভব করে না। জীবনের কল্যাণ-সন্ধানের পথে এদেশে প্রজ্ঞাবান স্নেহের গুরু, পিতা ছাড়া কাউকে গ্রাহ্য করা উচিত নয়। পিতার কাছে জ্ঞানে না হলেও, স্নেহ ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতায় নত হতে হয়। তাতে ক্ষতি হলেও। আত্মশক্তি নিজের ব্যক্তিত্ব এবং নিজের স্বাধীন বিবেকবুদ্ধিতে বিশ্বাস চাই–বহু মত বহু সমালোচনায় জীবনের সমস্ত কার্যে সর্বনাশও হয়। নিজের গলায় ফাঁসি দিয়ে কোনো ব্যক্তিবিশেষের হাতে, তিনি যতই মহৎ হউক না কেন, তুলে দেওয়া আদৌ ঠিক নয়। ওতে যুবকের মনুষ্যত্ব একেবারে পশু হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ, সম্মানী, ধনী, শিক্ষিত সাধু এবং গুরুজনকে সম্মান করা অন্যায় নয়। দেশের ও সমাজের রীতি অনুযায়ী তাদের আনুগত্য স্বীকার করা উচিত–ওতে মানুষ কখনও ছোট হয় না। ভিতরে যদি গুণ গরিমা থাকে–তবে মানুষ তোমাকে আপনাআপনি উচ্চস্তরে টেনে নেবে। মানুষের কাছে নত ও বিনয়ী হলে, কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। দুবৃত্ত, শয়তান কদাচারী মানুষকে অন্তর দিয়ে কখনও শ্রদ্ধা করা উচিত নয়। এইখানে যুবকের সত্য-সন্ধানী বিদ্রোহী-চিত্তের আরও বিদ্রোহী হওয়া উচিত। অযথা ভয়ে যুবক যেন অস্থির না হয়। তার নমস্য ও উপাস্য একমাত্র আল্লাহ্ সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের ভাবব্যঞ্জনা, অক্ষর দু’টিতে মিলিত হয়েছে। আলাদাভাবে ঐ অক্ষর দু’টির কোনো মূল্য নেই–ঐ শব্দেরও কোনো সম্মান নেই। তা যেন যুবকের মনে থাকে।

মনের সংকল্প কাউকে বলতে নেই। সংকল্প ঠিক করে কাজে লেগে যাও। ঘরকুণোর কখনও জীবনে উন্নতি হয় না। অত্যধিক গৃহপ্রীতি, বিদেশে যেতে ভয় করা–বড়ই দোষের। অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মানুষের জন্য সাহায্য এবং বিপদ সব জায়গাতেই আছে। শরীরে যতদিন শক্তি সামর্থ্য আছে ততদিন বিদেশ করতে ভয় করতে নেই। মানুষের জন্যে চিরদিন বাঁধা পথ থাকে না।

গৃহ এবং বিশ্রাম বার্ধক্যের আশ্রয়। যৌবনকালে পৃথিবীর সর্বত্র ছুটে বেড়াও, রত্ন মাণিক্য আহরণ করে গৃহে সঞ্চিত কর, যাতে বৃদ্ধকালে সুখে থাকতে পার। যৌবনকালে যেমন আয় তেমনি ব্যয় করা সংসারী লোকের কাজ নয়। এ হচ্ছে নিতান্ত অপদার্থ লোকের কাজ। চিরজীবন পরিশ্রম করে যদি বৃদ্ধকালে অনাহারে মরতে হয়, তবে আর যৌবনে এত পরিশ্রম কেন করলে? বৃদ্ধকালে কি কাজ করবার ক্ষমতা থাকে? তখনকার জন্যে পূর্ব হতে সতর্ক হতে হয়–যে হয় না তার অনুতাপই হয় সার। আপন বাহু যখন শেষকালে বাধ্য থাকে না, তখন অপরের কথা, আপন সন্তানদের কথা কি বলা যায়?

মানুষের উপদেশের অন্ত নেই। কতজন যে কত রকম কথা বলে তা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। নিজেই ভেবে-চিন্তে যা ভালো বোঝ, সমস্ত শক্তিতে তাই করতে থাক। যা হয় তাই হবে, হয় জয়ী হবে না হয় ঠকবে। জায়গায় বসে কেবল চিন্তা করা, লাভ-লোকসানের কথা ভাবা মূর্খ লোকের কাজ। এরূপ লোক কোনো কাজ করতে পারে না। জীবনের সব সময়ে যে জয়ী হবে, তার কোনো মানে নাই। হারতেও হয়।

.

০৯. যুবকের ভবিষ্যৎ চিন্তা

আজিকার প্রচুরতায় শান্ত হয়ে থাকা ঠিক নয়। সংসারে ক্রমশ জনসংখ্যা বাড়ে, লোক লৌকিকতা বাড়ে সুতরাং খরচ বাড়তেই থাকে। রাজা হবো, বাদশা হবো, বড়লোক হবো–কখনও জীবন এরূপ দুরাশা পোষণ করতে নেই। এরূপ লোকের ভাগ্যে ভস্মও জোটে না। যৌবনকালে বৃথা বসে না থেকে অর্থ সঞ্চয়ের দিকে মনোনিবেশ কর। অবশ্য জমাজমি থাকলে, ক্ষেত-খামার থাকলে, সেগুলি দেখে-শুনে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করতে চেষ্টা করাও মন্দ নয়। দিন-রাত্রি তাস পিটান, সংসারের কোনো কাজ না করা, দিন-রাত্রি ঘুমান আর বছর বছর পুত্র-কন্যার পাল বাড়ান অলক্ষ্মী লোকের কাজ। এ সুখের দিন চিরকাল থাকবে না। পূর্ব হতে সতর্ক হও।

মুসলমান ছেলেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা মোটেই নাই। পরের ঘাড়ে চেপে বসে খেতে পারলে, যেন এরা আর নড়তে চড়তে চায় না। বয়স্ক হয়েই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হয়ে নিজের আর্থিক উন্নতির পথ সন্ধান করবে। যে সমস্ত যুবকের সঞ্চয়ের বুদ্ধি নাই, যারা কোনো কাজকর্ম করে না বা শিখতে চেষ্টা করে না, শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, যারা ঘোর আলস্যপরায়ণ–তাদেরকে নির্মমের মতো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়াও মন্দ নয়। যে তাকে অন্ন দেয়, সেই তার ক্ষতি করে। এই সমস্ত যুবকদের প্রতি কোনো রকমে দয়ার্দ্র হবে না। অভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে না–তার জীবনে দুঃখের অবধি থাকে না। অভাব ও দারিদ্র্যকে পাপ বলা যায়। এহেন অভাব দুঃখে যে সতর্ক হয় না, তাকে গৃহ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। পিতামাতাকে সুখী না করুক সে নিজে সুখী হোক। ১৩ নং শিব নারায়ণ দাস লেনে সিদ্ধিশ্বর মেশিন প্রেস এবং সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরীর মালিক একদিন বলেছিলেন–”আমি বাড়ি থেকে মাত্র এক টাকা পাঁচ আনা নিয়ে যাত্রা করি। এক্ষণে আমার ব্যবসার মূল্য এক লক্ষ টাকা। যে বাড়িতে বসে থাকে সেই মরে। বহু টাকা নিয়ে কেউ কখনও জীবনে উন্নতি করতে পারে না! আঘাত, অভিজ্ঞতা, সহিষ্ণুতা, বিনয়, সততা ব্যতীত কোনো কালে কারো উন্নতি হয় না।

যুবকদের আর একটা দোষ হচ্ছে অসহিষ্ণুতা। কোনো কাজেই ধৈর্য নাই। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হলেই স্বভাবে সহিষ্ণুতা থাকে না। যার স্বভাবে সহিষ্ণুতা নাই সে কোনোকালে কোনো কাজে উন্নতি করতে পারে না। লোকের সঙ্গে কলহ, ঝগড়া, কচকচি, চাকর বাকরদের প্রতি কাজে ভুল ধরা, মানুষকে সর্বদা গালি দেওয়া, সর্বদা মত বদলান, এ কাজ ছেড়ে ও কাজ করা, রাতারাতি মানুষ হবার ইচ্ছা করা, গুরুজনে অবাধ্য হওয়া, সম্মানী লোককে সম্মান না করা–এসব যুবক জীবনের মস্ত বড় দোষ।

যা হয় হবে, না হয় ভিক্ষা করে খাব, আল্লাহ মুখ দিয়েছেন, আহার দেবেন, এসব দরবেশী কথা অপদার্থ যুবকদের মুখে শোভা পায়। এ কাজ ভালো নয়, ও কাজ ভালো নয়, ওতে মান যায়, এসব কথা ভাবতে নেই। যতক্ষণ লজ্জা, মান, ভয়, আছে ততক্ষণ উন্নতির কোনো আশা নেই। আপন দেশে কাজের কোনো সুবিধা হয় না–দূরদেশে চলে যাওয়াই ঠিক।

ইতর জীবের ভবিষ্যৎ চিন্তা নেই। মানুষের সর্বদা ভবিষ্যৎ চিন্তা আছে। আজিকার যৌবনের একটি দিনের মূল্য বার্ধক্যের এক বত্সরের সমান, অতএব হেলায় যৌবনকাল নষ্ট করা উচিত নয়। উপায় করতে না শিখে বিবাহ করা যার পরনাই বোকামি, ওতে জীবনের জঞ্জাল বেড়ে ওঠে। বিবাহ যদি করেই থাক তা হলে অধিক জঞ্জাল বেড়ে ওঠবার আগে উপার্জনের জন্যে বিদেশে ছুটে পড়। অভাবে পরিবারসুদ্ধ মরবার চাইতে একজনের মরাই ভালো।

কোথায় স্কটল্যান্ড, ইংল্যাণ্ড, আয়ারল্যান্ড–সেখানকার যুবকেরা বাঙলার বুকে অর্থ উপার্জনের জন্যে চলে আসেন। ময়মনসিংহ জেলায় স্কটল্যাণ্ডবাসী দুটি যুবকের পাশাপাশি দুটি সমাধি দেখেছিলাম, যেন দুটি পুষ্প-আপন-আত্মীয়-পরিজনের সুখের জন্যে জীবনের মায়া ত্যাগ করে কোনো দূর দেশে এসে চিরদিনের জন্যে চিরদ্রিায় অভিভূত হয়ে অন্তরের জন্য শ্যামল সমাধি শয্যা গ্রহণ করেছেন। ঘরকুনো মুসলিম যুবকের এ দৃশ্য দেখে কি শেখবার নেই। কলকাতা ব্রিস্টল হোটেলের মালিক প্রথম জীবনে এক অতি দরিদ্র ব্যক্তি। ছিলেন! পরিশ্রম, সহিষ্ণুতা এবং অধ্যবসায় গুণে তিনি ক্রমে কোটিপতি হয়ে প্রাসাদতুল্য হোটেলের স্বত্বাধিকারী হতে পেরেছিলেন।

১০. যুবকদের নীতিহীনতা

যুবকেরা ধর্মের ধারও ধারে না। ঈশ্বর-ভক্তি, ঈশ্বর-ভীতি, ধর্ম-ভাব যদি যৌবনকালে না থাকে, তবে সে জীবনের কোনো উন্নতি সম্ভব নয়। সততা, নীতিনিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা, ঈশ্বর প্রেম এসব যদি যৌবনকালে না হয় তবে কি আর বুড়াকালে হবে?

যৌবনকালে যুবকেরা অন্যায়, অধর্ম, জুয়াচুরি, প্রতারণা করতে যেন বাহাদুরী বোধ করে। ঈশ্বর কী, ধর্ম জিনিসটা কী, ভুলেও ভেবে দেখে না। গায়ের জোরে গর্জে বেড়ায়–এ যে কতবড় অন্যায়, তা বলবার নয়। যেন যুবকদের ধর্ম-কর্ম এবং ঈশ্বরের কোনো সংশ্রব নেই–যেন ওটা বুড়োকালের জিনিস।

সততা, বিনয়, সত্যনিষ্ঠা, ঈশ্বর-ভক্তি, ঈশ্বর-ভীতি এই-ই ধর্ম জীবনের সার বিষয়। রোজা-নামাজেই ধর্ম পালন হয় না। সারা জীবন অসম্ভবে যাপন করে বুড়াকালে রোজা নামাজ করে ক্ষতি পূরণ করে দেব–এইরূপ ইচ্ছাই অধিকাংশ যুবক পোষণ করেন। এরা

যে কত বড় নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক তা বলবার নয়। যে অভ্যাস যৌবনে হয় নাই। বার্ধক্যে তা হবে না। যার জীবন একবার কদর্য হয়েছে, সে কি আর বুড়াকালে ভালো হয়? বুড়াকালে সে আরও পাকা শয়তান হয়। তার জীবন ও স্বভাবে শয়তানী ভাব পাষাণের দাগের মতো বসে যায়–তার জীবনের আর পরিবর্তন হয় না–হাজার বার নামাজ পড়লেও না। সততাই মনুষ্য জীবনের ধর্ম–নামাজ তার বাহ্যিক পরিচয়–একটি সামাজিক ধর্ম। আসল ধর্মের সঙ্গে ওর কোনো সংশ্রব নাই। যুবক জীবনে বিচার চাই, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান চাই। স্বভাবে বিনয় চাই। গুরুজনের প্রতি ভক্তি চাই। নীতি, নিষ্ঠা, সততা, সাধুতা, ন্যায়নিষ্ঠা আমাদের দেশে স্বপ্নের বিষয়। কি হিন্দু, কি মুসলমান এদের ধর্মের যেন নীচতা, মিথ্যা, ছলনা, প্রতারণা করতে লজ্জা বোধ করে না। জীবনের সংস্কারের সঙ্গে যেন ধর্ম জীবনের কোনো সংশ্রব নেই। এদের ধর্ম হচ্ছে নতুন কাপড়, ঢাক-ঢোল, মুখস্থ পড়া এবং উঠা-বসা করা। আত্মার সঙ্গে ধর্ম জীবনের কোনো সংশ্রব নেই। লেখাপড়া শিখেই ছেলেরা কোনো ফাঁকে চুরি করে, বাটপাড়ি করে দুপয়সা অর্জন করবে–সেই হয় এদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা। বিচার, বিবেক, মিথ্যার সঙ্গে জীবনের সংগ্রাম–এদের ধর্মে লেখে না। এদেরকে সুসভ্য জাতিরা বর্বর ছাড়া আর কী বলবে! ছিল সবই, আছেও সব–দেশের নিকৃষ্ট শ্রেণীর হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সংখ্যা বাড়িয়েছে মাত্র। ইসলাম ধর্ম অনুভব করে নাই। ইসলাম ধর্মের প্রথম বিশ্বাস মন্ত্রের অর্থ প্রভাব এদের আত্মায় কাজ করে নাই। ফলে এরা জোর অধর্মের নরককুণ্ডে পড়ে মানব সমাজকে দূষিত করছে। নিজেরা তো সুখী নয়ই–পরিবার, গ্রাম, সমাজ সকলকে দূষিত করে চলেছে। যে জাতি বা যে মানুষের পাপ ও মিথ্যার সঙ্গে বিরোধ নেই, তার কোনো ধর্ম কর্ম নেই। তার ধর্ম কর্ম একটা তামাসা মাত্র। এক নামাজি নারীকে ডিম চুরি করতে দেখেছি, হুবহু মিথ্যা কথা বলতে শুনেছি–অথচ এই নারী জীবনাবধি কোনোদিন নামাজ অর্থাৎ উপাসনা ত্যাগ করে নাই। ঈশ্বর অর্থাৎ আল্লা কি, কোরান কি, কোরানে কি লেখা আছে, পরকাল কি–এ-সব এরা কিচ্ছু জানে না। এরা জীবন একভাবে যাপন করতে যায়। বুড়া কালে বার্ধক্যে নামাজ-রোজা করে। অর্থ হলে হজ্ব করে, কোরবানি করে, ছেলেদের খাত্তা দেয়–এই হচ্ছে এদের ধর্ম। জগতের উন্নতি, দশজনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা, বাড়িতে দালান-কোঠা তোলা, পুকুর কাটা–এই হল এদের জল্পনা-কল্পনা। অবস্থাশালী হলে মুসলমানেরা প্রায়ই অত্যাচারী হয়। মনুষ্য জীবনের কর্তব্য কি, তা এরা জানে না। কেউ যদি খুব বেশি ধার্মিক হয়, সে কোনো পীরের কাছে মুরিদ হয়। পীরের কাছে পরকালের মুক্তির চাবি আছে, এই বিশ্বাসে এরা মাঝেমাঝে পীরকে টাকা দেয় এবং আশ্বস্ত হয়ে বসে থাকে। কি নর কি নারী আত্মার দিক দিয়ে এরা একেবারে মৃত। অতি হীন আলাপই হচ্ছে এদের প্রাত্যহিক কথার বিষয়। ‘ যৌবনকালে কি বিবাহিত কি অবিবাহিত, পাঁচজন একস্থানে জমা হয়ে অতি জঘন্য অতি কুৎসিত আলাপ করা যুবকদের বড়ই প্রিয় অভ্যাস। নারীর অঙ্গ নিয়ে এরা যে জঘন্য আলাপ করে, তা প্রকৃত মনুষ্য সন্তান শুনলে তাদেরকে একপাল বিষ্ঠাভোগী কুকুর বলবেন। কতভাবে, কত রকমে যে এরা নারী অঙ্গের সমালোচনা করে তার ইয়ত্তা নাই। হায়, নারীদেহে কী আছে? মূত্র–বিষ্ঠাপূর্ণ, কুৎসিত দর্শন মূত্রস্থান নিয়ে কী উৎসাহপূর্ণ গবেষণা। হায়, মনুষ্য! তুমি না দেবতার পুত্র? তুমি কি কুকুর-শাবক? তোমার এই প্রবৃত্তি? কী জিনিসে তুমি এত মুগ্ধ? ওরে অন্ধ যুবক! তুই এত পাগল? ইন্দ্রিয় লালসা তৃপ্তিতে কতটুকু সুখ! এই তুচ্ছ সুখের জন্যে তোর সোনার যৌবনকে কীভাবে মাটি করে দিস! হায়, পাগল! একবার ভালো করে বুঝে দেখ। ঐ পাপ আলোচনা করে জীবনের সর্বনাশ করিস নে। দেহস্থ পবিত্র শক্তির আধার বীর্যকে নষ্ট করে জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করিস নে। ঐ বীর্যের মতো মূল্যবান জিনিস আর নাই-ওর মূল্য রাজার রাজত্ব থেকে অনেক বেশি। তুই কি অবোধ পাগল দলের একজন হবি? শয়তানের প্রলোভনে পড়ে তোর চোখে-মুখে দুর্গন্ধ পুরীষ মাখাস নে। আঃ ছিঃ ছিঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *