০১-০৫. যৌবনের ঔদ্ধত্য

যুবক জীবন – ডা. লুৎফর রহমান

০১. কথা আরম্ভ–যৌবনের ঔদ্ধত্য

যৌবনকালে যুবকদের মনে অহঙ্কার এবং ক্রোধ সর্বদাই লেগে থাকে। নিজে যেন সে একটা মস্ত বড় দরের মানুষ। পরের সামান্য প্রতিবাদে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠা তার স্বভাব।

একবার একটা যুবক টাকা ভাঙ্গাবার জন্য এক সরকারি অফিসে যেয়ে উপস্থিত হন। সরকারি অফিসে কখনও টাকা পয়সা দেওয়া হয় না। তথাপি যুবক যখন টাকা পয়সা পেলেন না তখন তার ক্রোধের সীমা রইলো না, তিনি সমস্ত রাজকর্মচারী সমাজকে গালি দিতে আরম্ভ করলেন। যুবকের যে এটা অন্যায় জিদের দাবি, সে কথা ভাববার সহিষ্ণুতা কী তার ছিল?

ধীরচিত্তে বিবেচনা করবার স্বভাব যুবকদের মোটেই নাই। এক সভায় কতকগুলি যুবক ছিলেন। তারা একত্রে দশ-বার জন ছিলেন। ভাব প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছিল, বোধ হয় তারা কোনো রাজ্য জয় করতে বেরিয়েছে বা কোনো পাহাড় ভেঙ্গে গুড়ো করতে যাচ্ছেন। সেই রাস্তা ধরে অপর দিক থেকে এক পথিক আসছিল-যুবকদের নিকটে আসতেই একজন ধাক্কা মেরে ক্লান্ত পথিককে পার্শ্বের ড্রেনের ভিতর ফেলে দিল। পথিক ক্রুদ্ধ হয়ে বল্ল”তোমরা কি কানা? অমনি যুবকেরা সমস্বরে আগুন হয়ে বল্লে–ব্যাটার তো ভারি তেজের কথা। নিজে এসে গায়ের উপর পড়লেন,–এখন উল্টো দাবি করছেন। পথিক যদি আর একটু প্রতিবাদ করতেন, তা হলে যুবকদের হাতে তাকে অপদস্থ হতে হত নিশ্চয়।

যুবকদের গায়ের জোরে আস্থা খুব বেশি। বিচার-বুদ্ধি, বিবেকের দাবি তাদের কাছে নাই। ঔদ্ধত্য প্রকাশ তাদের স্ব-প্রকৃতি।

যুবকেরাই যুদ্ধের যোগ্য।–লড়াই করা, নিজের জীবনের মায়া না করা ওদের স্বভাব। নিজে ছোট বা দুর্বল, পরাজয়ের বিপদ তার ভাগ্যেও ঘটতে পারে একথা সে মোটেই বিশ্বাস করে না।

যুবকের ঔদ্ধত্যের সম্মুখে যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে চায়, তারা বড় ঠকে। যুবক কোনোমতে দমে না। যৌবনের শক্তি অতি প্রচণ্ড। যৌবন শক্তির কাছে কত সেনাপতিকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে।

যুবকদের মনুষ্যত্বের কাছে নিবেদন কর–তার সঙ্গে প্রেমের ব্যবহার কর, তার কাছে নত হও–তার বিচারবুদ্ধির আশ্রয় নাও,–তার দয়া ভিক্ষা কর,–তা হলেই তাকে জয় করতে পারবে। সে তোমার হবে দাস এবং অনুগত বন্ধু।

মধুর ব্যবহার করাই যুবককে জয় করবার প্রধান অস্ত্র। সে সম্মান চায় না–সে চায় ভালোবাসা; সদ্ব্যবহার এবং প্রেম প্রেম ও সদ্ব্যবহার তাকে লমিতো করে।

যুবক জীবনে দুর্বলতা কোথায়? মধুর ব্যবহারের সম্মুখে, সহানুভূতিতেই সে দুর্বল। আর কোনো ক্ষেত্রে সে দুর্বল নয়। তরবারি দেখে, আগুন দেখে, কারাগারে, ফাঁসিতে–কিছুতেই তার দর্পিত প্রাণ কাবু হয় না–যদি বাঁচতে চাও, তবে তার সঙ্গে সন্ধি কর;–তবে কখনও তার সঙ্গে নীরস কঠিন ব্যবহার করো না।

যুবকেরা পাগল, বারুদের মতো সহজেই যুবকপ্রাণে আগুন ধরে। এদেরকে জননীর মতো বাবা’ বলে স্নেহ করাই উচিত। কারণ এদের মধ্যে স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, ধর্মভয়, বিনয়,জ্ঞান বলতে কিছু নাই।ওরা সত্যিই পাগল–যুবককে বাষ্পীয় ইঞ্জিন–আবদ্ধ শক্তি বলা যয়। বুদ্ধিমান যিনি তিনি যৌবনশক্তিকে সুপথে চালিত করেন এবং তার সাহায্যে জগতে আশ্চর্য আশ্চর্য কাজ করেন। জাতির যৌবনকে ব্যবহার করতে শেখ–তুমি জাতির পরম কল্যাণ করতে পারবে। যুবকের প্রাণ বড় সুন্দর, বড় মধুর–যে ওকে ব্যবহার করতে শিখেচ্ছ, সেই জগতের রাজা হতে পেরেছে।

যৌবনের পরম দানকে কামুকতায়, শুক্রক্ষয়ে, পাপের পথে নষ্ট করে ফেল না। স্থবির হয়ে জীবনের পরম সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়ো না। যৌবনের বলহারা যে হল; সে রাজ্য হারা হল। যৌবন শক্তির সদ্ব্যবহার করো।–মহাকালে, ঐশ্বরিক কার্য্যে তোমার যৌবনকে ব্যবহার করো। তোমার জীবনে বসন্ত জেগেছে, এ বসন্ত কি বৃথা হয়ে যাবে তোমার কাছে? বসন্তকে পূজা করে ঘরে তুলে নাও! —

যৌবন ছাড়া জীবনে দুঃখ হাসিমুখে আর কে অত সইতে পারে? প্রচণ্ড টাইবার নদীর বুকে অসীম সাহসে কে লাফিয়ে পড়তে পেরেছিল–সে যৌবন।

যৌবনশক্তির অপব্যবহার দেখলে আমাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। যে যৌবন পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণের মন্ত্র প্রচার করবে, তাই যদি দানবের মূর্তিতে পৃথিবীতে অশান্তি ও দুঃখ সৃষ্টি করে তবে সে কথায় অভিযোগ মানব ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।

অনেক দিন আগে, দুই হাজার বছরেরও বেশি দিন আগে সমস্ত পৃথিবী জয় করবার ইচ্ছায় মেসিডেনের রাজা আলেকজাণ্ডার সুদূর ভারতবর্ষ অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তাকে এশিয়া মাইনর, আরব, পারস্য ও আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষে উপস্থিত হতে হবে। এশিয়া মাইনরে অতীতের পরাক্রমশালী ফিনিসীয় জাতির বাস। তাদের রাজধানী টায়ারের ধারে আলেকজাণ্ডার সসৈন্যের উপস্থিত হয়ে নগরের প্রতিষ্ঠিত দেবতাকে পূজা দিতে ইচ্ছা করে প্রধানদের কাছে সংবাদ পাঠালেন। উপকূল হতে পশ্চিমে অনেক দূরে সমুদ্রের ভিতর রাজধানী টায়ার অবস্থিত। সর্বদেশের, সর্বজাতীয় লোক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগর ও ক্রয়-বিক্রয়ের কেন্দ্র স্থান বলে, এখানে বাস করে। অতীতকালে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ফিনিসীয় জাতির এই নগরের মতো সমৃদ্ধিশালী নগর আর ছিল না। পৃথিবীর অফুরন্ত সম্পদ এখানে সঞ্চিত হয়েছিল, অন্তহীন মানুষের বাস এখানে ছিল।

এই সময় কার্থেজের কাউবার সম্ভান্ত অতিথি রাজধানী টায়ার নগরে এসেছিলেন। কার্থেজ টায়ার নগরের অন্যতম বিশাল সমৃদ্ধিশালী উপনিবেশ যেমন আজকাল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইংরেজ জাতির উপনিবেশ। তেমনি প্রাচীন পরাক্রমশালী ফিনিসীয় জাতির উপনিবেশ ছিল আফ্রিকার উত্তরকূলে অবস্থিত মহানগরী কার্থেজ। কার্থেজের অতিথিরা বল্লেন–আলেকজাণ্ডার কখনও শুভ অভিপ্রায় নিয়ে নগরে প্রবেশ করবেন না। দেবীর পূজা দেওয়া তার একটা ছল মাত্র। যদি এজন্য অস্ত্রধারণ করতে হয়, তবে কার্থেজবাসী তার জন্মদাতা টায়ার নগরকে অবহেলা করবে না। আলেকজাণ্ডার দিগ্বিজয়ী রাজ্য-লোলুপ সম্রাট। তাকে নগরে প্রবেশ করতে দেওয়ার অর্থ তার কাছে আত্মসমর্পণ করা, তার ক্ষমতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করা। মানুষের প্রতি যৌবনশক্তির কী দারুণ অপব্যবহার হতে পারে, তাই বোঝাবার জন্যে আলেকজাণ্ডারের টায়ার ধ্বংসের কাহিনী এখানে দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত রাজ্য জয় করেও গর্বিত যৌবনের রক্ত দমে না। এর মতো আক্ষেপ আর কী? মানুষ চোর ও দস্যুকে ঘৃণা করে। কারণ তার শক্তি কম। সে বাধা দিতে সমর্থ হয় না। সে আপনার ক্ষমতাকে অপরাজেয় করে রাখতে সমর্থ নয়। অত্যাচারী সম্রাট আর দস্যুতে পার্থক্য নাই। আলেকজাণ্ডার টায়ারের উদ্ধত অস্বীকারে অতিশয় বিরক্ত হলেন–তিনি। রামের মতো সমুদ্র বন্ধন করে টায়ারে প্রবেশ করতেই স্থির করলেন। যে অজেয় মনুষ্য শক্তি মনুষ্য হিতে ব্যয় হতে পারত, তাই প্রযুক্ত হল মনুষ্য হনন আশায়। আজ্ঞামাত্র সহস্র সহস্র সৈন্য সাগর বন্ধনে শক্তি নিয়োগ করলো। সহস্র সহস্র বিশালাকার পাষাণ খণ্ড, বৃহৎ বৃহৎ বিশাল বৃক্ষরাজির জলমধ্যে নিক্ষিপ্ত হল, তার উপর পর্বত প্রমাণ মৃত্তিকাক্কুপ স্থাপিত হল। টায়ারবাসী তখন নিরাপত্তা আশঙ্কা করে সম্রাটের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য। বিরুদ্ধ চেষ্টা করলেন। তারা শত শত বিশাল তরী সেতুর পাশে আনয়ন করে ডুবুরি পাঠিয়ে সেতুকে ভগ্ন ও শিথিলমূল করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। উভয় পক্ষে সমানভাবে চল্লো। একদল মানুষের হৃদয় রক্ত পান করবার দুরাশায়, আর একদল আত্মরক্ষার বেদনায়। নগরের বহু নারী এবং প্রাচীন ব্যক্তি পূর্বেই কার্থেজে প্রেরিত হল।

টায়ারবাসী ভীষণ বাধার সম্মুখে যখন সম্রাট ভ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়লেন–তখন তিনি কাউবার নৌযুদ্ধবিশারদ জাতির সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তারা রোষ উৎপাদনের ভয়েই আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে যোগ দিলেন।

অতঃপর টায়ার প্রবেশের পূর্বেই সেতু বন্ধন ব্যাপার অবলম্বন করে উভয় দলে সুতীব্র যুদ্ধ চলতে লাগলো। বহুদূর হতে তীর নিক্ষেপ, অগ্নিবর্ষণ, গলিত তপ্ত লৌহ এবং উত্তপ্ত বালুকারাশি পরস্পরের গায়ে বর্ষিত হতে লাগল। আলেকজাণ্ডার মাত্র চতুর্বিংশ বর্ষকাল জগতে বেঁচেছিলেন, এরই মধ্যে জগতে তিনি যে নৃশংস লোমহর্ষক কাণ্ড করে গেছেন, দেশে। দেশে রক্তের অক্ষরে তা চিরদিন লেখা থাকবে। এই কী যৌবনশক্তির যোগ্য ব্যবহারঃ

অবশেষে বহু শত্রু-পরিবেষ্টিত, অভিশাপ, অত্যাচার ও দানব শক্তির প্রতীক আলেকজাণ্ডারের হাত থেকে টায়ার আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হল না। টায়ারের রাস্তাসমূহ নররক্তে ধৌত হয়ে চল্লো। একই দিনে ক্রুদ্ধ সম্রাটের আজ্ঞায় ত্রিশ সহস্র ব্যক্তির শিরচ্ছেদ হল, পনের হাজার ব্যক্তিকে দাসরূপে বন্দি করা হল। এই তো মানুষের পৌরুষ!

মানুষের প্রতি মানুষের কী ভয়াবহ রোষ আর হিংসা! মানুষ কি সত্যিই কুকুর নয়?

এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বহুভাষাবিদ উইলিয়াম জোনক নাদির শাহের জীবনী ফরাশি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। নাদিরের শৌর্য-বীর্য না তার অমানুষিক অত্যাচার কাহিনী তিনি জগদবাসীকে জানাতে চেয়েছেন, তা তিনিই জানেন। রক্তলোলুপ নাদির শাহ মনুষ্য হত্যায় যেরূপ আনন্দ লাভ করতেন এমন অতি অল্প লোকই করে! মনুষ্য-জীবন এদের কাছে কীটের জীবন অপেক্ষা তুচ্ছ।

মোগল–শক্তি তখন ধ্বংসের পথে। প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সিংহাসনে দুর্বল শক্তি মুহম্মদ শাহ্ সমাসীন। নাদির দিল্লীতে প্রবেশ করে মোগল রাজ-প্রসাদে বাস করেছেন। কে বা কারা তার মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ বর্ণনা করে, তার কতিপয় সৈন্যকে হত্যা করে। ফলে নাদির দিল্লীর নিরপরাধ অধিবাসীবৃন্দকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শিরচ্ছেদের আদেশ দিলেন। বিচার নেই–সৈন্যগণ একদিক থেকে দিল্লীকে শ্মশানে পরিণত করলেন।

নর-শার্দুল আহমদ শাহের তরবারি ধারণ–যৌবনশক্তির নিতান্ত অপব্যবহারেরই পরিচয় দিচ্ছে। লুণ্ঠনই যেন এদের ব্যবসা নরহত্যাই যেন এদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। ধর্মহীন, মায়াহীন এইসব অর্থলোভী দস্যুর দল কী জন্যে জগতে এসেছিলো, জানা যায় না। খোদাতালা হয়তো মানব জাতির শাস্তির জন্যে অভিশাপরূপেই এদেরকে জগতে পাঠিয়েছিলেন। নাদির শাহ্ সাধের দিল্লী নগরকে মহাশ্মশানে পরিণত করলেন। তৃতীয়বার পানিপথ ক্ষেত্রে মারহাট্টা এবং আহমদ শাহের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, উক্ত যুদ্ধে দুই লক্ষ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। কী উদ্দেশ্যে, কোন কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব হতভাগ্য একই দিনে প্রাণ বিসর্জন করে? ব্যক্তিবিশেষের হত্যা ও লুণ্ঠন স্পৃহাই বিরাট হোলিখেলার কারণ। এইসব ভয়াবহ চিত্রের পার্শ্বে ফরাশি সাধু দামিয়ানের চিত্র স্থাপন করা যাক। মানবপ্রেমিক দামিয়ান, চিরকুমার হাজী মহসীন, ক্লার্কসন, উইলিবার ফোর্স প্রভৃতি মহামানবের জীবনচিত্র পূর্বকথিত ভয়াবহ জীবনচিত্রের পার্শ্বে কত মহৎ, কত উজ্জ্বল। একটি যেন ঊর্ধ্বে নক্ষত্র বিখচিত দেবতোক আর একটি যেন নিম্নে আঁধার মরণ-শঙ্কাপূর্ণ জ্বালাময় প্রেতপুরী। একটিতে আনন্দময় জীবন আর একটিতে ভয়াবহ মৃত্যুর অভিশাপ।

কুষ্ঠব্যাধির মতো মহাব্যাধি আর নাই। যে কুষ্ঠী সেই জানে এই রোগের বেদনা। কুষ্ঠীর জীবনের সকল সাধ আকাঙক্ষা চিরতরে বিলুপ্ত হয়–জীবন চরম দুঃখময় হয়। এর উপর কুষ্ঠীদেরকে মানব সমাজের ঘৃণা ও উপেক্ষা মাথা পেতে নিতে হয়। কুষ্ঠীর কাছে কোনো মানুষ যেতে চায় না–কারণ তার সংস্পর্শে এলে, তার সঙ্গে ওঠা-বসা করলে স্বাস্থ্যবান মানুষেরও কুষ্ঠ ব্যাধি হয়। কী কারণে বিধাতা মনুষ্য সমাজে এই ভয়াবহ ব্যাধি দ্বারা পীড়িত করেন, তা জানি না। তবে এ কল্পনা-সাধ্য মহাপাপের অনুরূপ একটা মহাব্যাধি। এই মহাব্যাধির অনন্ত দুঃখ যার শিরে পড়েছে তার চিরদিনের জন্য সর্বনাশ হয়েছে।

পূর্বকালে ইউরোপ মহাদেশে আইন দ্বারা কুষ্ঠীদেরকে নির্বাসন দেওয়া হতো। যার কুষ্ঠ হয়েছে তাকে মনুষ্য সমাজ থেকে ছিন্ন করে বহুদূরে সমুদ্রের মাঝে রেখে আসা হতো। সেখানে সামান্য খাদ্য দেওয়া হতো। কুষ্ঠী নর-নারীর জীবন ছিল চরম দুঃখের জীবন। অভাব, দৈন্য, মারামারি, কাটাকাটি, অবিচার, ব্যভিচার, দুঃখ–এই সব ছিল তাদের নিত্য সহচর।

কুষ্ঠীর প্রতি মনুষ্য সমাজের দয়া বড় ছিল না। কুষ্ঠীকে দেখে ভয়াবহ শার্দুল জ্ঞানে মানুষ তার কাছ থেকে পালাত। কিন্তু সত্যি কি কুষ্ঠীদের মনুষ্য সমাজের দয়া থেকে বঞ্চিত থাকা উচিত? এই হতভাগ্যদের জীবনের দুঃখ-লাঞ্ছনার প্রতি মানুষ মুখ তুলে চাইবে না? এত বড় দুঃখ লাঞ্ছনার জীবন দেখে কি মানুষ কাঁদবে না? মানুষ এতদিন বোঝে নাই–করুণা সেবা ও প্রেমই ঈশ্বরের পূজা। নিষ্ঠুর শুষ্ক উপার্জনা, গোবিন্দ’ বলে চিৎকার, পাপ জয়ের সংগ্রাম বর্জিত রোজা-নামাজ–এসব ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু না। মনুষ্য সমাজের কাছে বাহবা নেবার প্রচেষ্টা মাত্র। এইসব মূর্খের দল প্রাণে অনুভব করতে পারে না–ঈশ্বর কী! পরকাল ও স্বর্গের লোভে, অপ্সরী সঙ্গ-সুখাশায় অথবা শান্তির ভয়ে এরা মুখে আল্লা আল্লা’ করেন মাত্র। দুঃখী, পীড়িত আর্তের সেবা, অবোধকে জ্ঞানদান করা–এসবই হচ্ছে মানব-জীবনের বড় উপাসনা। উপাসনা আসলে ধর্ম-জীবনের একটা দিক মাত্র। উপাসনার বলে মানুষ কি স্বর্গের দাবি করতে পারে? রোজা নামাজ করলেই মানুষ এক লম্ফে বেহেস্তে যেয়ে বসবে, এও কি সম্ভব? মানুষের জন্য দরদ চাই–প্রেম চাই–আল্লার গুণ জীবনে লাভ করা চাই।

মানব-প্রেমিক দামিয়ান যৌবনের ভোগ-লালসা ত্যাগ করে মালাকো দ্বীপের কুষ্ঠীদের সেবার জন্য একদিন যাত্রা করেন। কতবড় মহান জন ইনি! সার্থক এর জীবন। তাই সর্বজাতিকে আন্তরিকভাবে বলি–আপন আপন জীবনের পাপ বর্জন করে ঈশ্বরের গুণে গুণান্বিত হও, জীবের কল্যাণ কর, আর্তের সেবা কর, বুঝে প্রার্থনা কর।-–এছাড়া সমস্তই বৃথা।

দামিয়ান কুষ্ঠীদের জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের জীবনের আশা ভরসা মিশিয়ে দিলেন, তাদের মধ্যে থেকে উচ্চ জীবনের কথা বলতে লাগলেন। তাদের জন্য ভালো খাবার, ঔষধ-পথ্য উৎকৃষ্ট পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেন। তাদের মধ্যে বসে একসঙ্গে দয়াল আল্লাহ্ তালার কাছে প্রার্থনা করলেন। আহা! আল্লার একি দয়া! দশ বছর পরে। একদিন তার শরীরেও কুষ্ঠ রোগ দেখা দিল। সেই দিন যেন তার সেবার জীবন সার্থক হল–যে ভেদটুকু ছিল তা দূর করে নিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলেন। তিনি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন–”প্রভু! আজ আমার সেবা-নিবেদন তোমার আশীর্বাদের ঐশ্বর্যে রঙিন হয়ে উঠেছে। আজ আমার প্রেম সকল পরিপূর্ণতায় সফল ও সার্থক হল। তোমার এ করুণ প্রেমের নিমন্ত্রণ যেন শেষ পর্যন্ত বহন করতে পারি।” ধন্য বীর! ধন্য তোমার যৌবন! সার্থক হে মহামানুষ তোমার জীবন! কুষ্ঠীদের সেবা করতে করতে একদিন তিনি মহাপ্রস্থান করলেন।

মানুষকে শৃগাল, কুকুর, গরু, ঘোড়ার মতো এককালে ব্যবহার করা হতো। মানুষের কাছে মানুষের কোনো সম্মান ছিল না। জীবিত মানুষের গায়ে এনাটমী শেখবার জন্য অস্ত্র চালনা করা হতো। যোগিনী মাতা রাবেয়া বসরীর শরীরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের কৌতূহল নিবারণের জন্যে তীক্ষ্ণ অস্ত্র চালনা করা হয়েছিল–সে দুঃখের নির্যাতন কাহিনী হয়তো অনেকে জানেন। দেবী রাবেয়া ছিলেন এক ধনী গৃহস্থের কৃতদাসী। নিমন্ত্রিতরা বলে এই দাসীর গায়ের অস্থিবিন্যাস কেমন আমাদিগকে দেখাতে হবে। গৃহস্বামীর আদেশে রাবেয়াকে পশুর মতো ধরে তার শরীরে অস্ত্র চালনা করা হলো। চরম দুঃখ সয়ে রাবেয়া প্রভুর আদেশ পালন করলেন। এই রাবেয়া মহাতপস্বিনীরূপে, সফলময়ী মাতা রাবেয়ারূপে। অনন্ত মানুষের শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দিকে দিকে সকল দেশে ক্রীতদাস-দাসীর বেদনা উচ্ছ্বাস আকাশ-বাতাস বিষাদ অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। দাস-দম্পতির বুকের ধন কেড়ে নিয়ে প্রভু অর্থ লালসায় উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করতেন। যারা স্বামী-স্ত্রী রূপে এক সঙ্গে বহু বছর বাস করেছে, প্রভুর ইচ্ছায় একদিন তাদের একজনকে বহু দূর দেশীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হল। এ জীবনে তাদের পরস্পর আর দেখা হবে না। বেত্রাঘাতে দাস-দাসীর শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হতো–কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদেরকে ধরা হতো। প্রভু ইচ্ছা করলে তাদেরকে হত্যা করতে পারতেন। মানুষের উপর মানুষের এই অত্যাচার-মহাপ্রাণ ক্লার্কসন নামক এক যুবক চিত্তে কঠিন আঘাত করেছিল! তিনি জ্বলন্ত ভাষায় ক্রীত দাস-দাসীর কঠিন দুঃখের বর্ণনা সভ্য মানুষের কাছে সর্বত্র নিবেদন করলেন। সেই মর্মস্পশী বেদনা কাহিনী পড়ে মানুষ বিচলিত হল। সর্বত্র ঘরে ঘরে এই মহাপাপ প্রথার বিরুদ্ধে কঠিন মন্তব্য প্রচারিত হতে লাগলো। মানুষের যৌবন গরিমা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি ক্লার্কসনের আন্দোলনে বিচলিত হল। দেশের সমবেত বিদ্রোহবাণী দাসপ্রথার মূলে কুঠারাঘাত করলো। বৃটিশ সাম্রাজ্যে দাস ব্যবসা বেআইনী বলে ঘোষিত হল। কালে সমস্ত সভ্য জগত বৃটিশ জাতির পদাঙ্ক অনুসরণ করল, জগতের সবাই মানুষ। সবাই মানুষের ব্যথা মুখ তুলে চেয়ে দেখে–কই একজনও তো একটা কথা কয় না! বিলাতের জনৈক ডাক্তার সমাজ পরিত্যক্ত মানবশিশু, গৃহহারা নারী, অন্ধ খঞ্জ কুষ্ঠীদের জন্যে প্রায় শতাধিক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে যে আর্দশ স্থাপন করে গেছেন, তার তুলনা কোথায়? সর্ব, দেশের যৌবন কি পৃথিবীর পাপ বেদনা দুঃখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হবে?–জাতি জাতিতে রেষারেষি কেন? পুণ্যে এবং পাপে, আলোকে এবং আধারে, সত্যে এবং মিথ্যায় যে মহাসংগ্রাম জগৎ জুড়ে চলেছে সেই মহাসগ্রামে হে মনুষ্য যৌবন, তোমার সমস্ত গরিমায় তুমি জেগে ওঠ। জগতে পুণ্যের আলোক এবং সত্যের জয় হোক। অন্যায়, অত্যাচার, মিথ্যা, পাপ, দুঃখ লজ্জ্বিত হোক।

মানব-প্রেমিক হাজী মহসীন, চিরকুমার হাজী মোহসীন তার জীবন যৌবনকে সার্থক করেছেন বাঙলার মুসলমান যুবকদের আত্মোন্নতির কল্যাণ অনুষ্ঠানে। এতকাল চলে গেল, আর দ্বিতীয় কোনো হাজী মোহসীনের আবির্ভাব বাঙলায় হল না। করটিয়ার জমিদার চাঁদ মিয়া তার বিস্তীর্ণ জমিদারি নিয়ে শুধু এই যৌবন পূজার মঙ্গল উৎসবে দ্বিতীয় মোহসীনরূপে যোগদান করেছেন। বাঙলার মুসলমান সমাজে মনুষ্যত্ব মরে গেছে। যৌবন চিরসমাধি লাভ করেছে। সুখ-অন্বেষী যুবক স্থবিরেরা স্বার্থের দেউল প্রতিষ্ঠিত করে মৃত্যু ও অধঃপতনের পূজা আরম্ভ করেছে। হায় যৌবন! বাঙলার ঘরে ঘরে বৃথাই তোমার জীবন! নিরর্থক তোমার অস্তিত্ব। সকল জাতিই যৌবন গরিমায় জেগে উঠেছে, তুমি শুধু রইলে ঘুমিয়ে। জীবনহীন, প্রাণহীন, আবৃত্তি হল তোমার এবাদত! লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী শয্যায় শায়িত-জীবনের কোনো চিহ্ন নাই, যৌবন তো দূরের কথা।

.

০২. নরহত্যা

প্রাচীন বর্বর যুগের অবসান হল না। বৃথাই সভ্যতার দাবি। সে পশু ছাড়া আর কী? তার আবার ধর্ম!

মানব-যৌবনের স্বভাব সদাই বিদ্রোহী হওয়া ন্যায় ও বিচারের মাথায় পদাঘাত করে যৌবন তার উচ্ছলতা নিয়ে দুর্দম ব্যক্তিত্বে খেয়ালী জীবন যাপন করতে চায়। তার কাছে বিচার, শৃঙ্খলা, মনুষ্যত্ব ও বিবেকের কোনো মর্যাদা থাকে না। সে বেতাল তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবীতে, মনুষ্য সমাজে আপনার উদ্দাম বেগে চরণ ফেলে চলতে চায়। তাই তার শাসন প্রয়োজন। তরবারি ও অগ্নিবাণের ভীতিতে তার সকল উচ্ছলতাকে শাসন করে রাখতে চায়। যৌবনের স্বভাবই বিদ্রোহ–সে চির অশান্ত, উন্মাদ, পাগল।

যদি জগতে রাজা না থাকতেন, শাসন না থাকত, তা হলে মনুষ্য সমাজ আপন যৌবন তেজে বিদীর্ণ হয়ে যেত। রাজার শক্তি দেশ ও জাতিকে, মনুষ্য সমাজকে প্রতাপপূর্ণ শাসন ক্ষমতায় বাঁচিয়ে রেখেছে। জগতে পিতার মতো রাজারও আবশ্যকতা আছে। যেখানে পিতা দুর্বল, সেখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সবাই বিদ্রোহী–যেখানে রাজা শক্তিহীন দুর্বল, সেখানে প্রজার মধ্যে অরাজকতা বিরাজ করে–জাতি বিশৃঙ্খল গতিতে ধ্বংসের পথে যায়।

মানব সমাজের জন্য শাসনের আবশ্যকতা আছে স্বীকার করি, কিন্তু কথায় কথায়। রাজ্য-লোভে বক্ষের রক্ত-পিপাসায় প্রচণ্ড উন্মাদন হাতিয়ার নিয়ে বের হওয়া–বড়ই বেদনার কথা।

Battle; Battle; Battle; এছাড়া যেন আর বীরত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্র নাই। যে জাতি যত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, তার তত সুনাম। কী করে মানুষ তার নিজের দ্বিতীয় মূর্তির বুকে বর্শা বিদ্ধ করে? বড় বেদনার কথা। জাতির বিরুদ্ধে জাতি তীর ধনুক, কামান নিয়ে, আগুন নিয়ে কেমন করে ছোটে! মানুষের ঘরে কি মা, বোন, সন্তান, পিতা নাই–কেমন করে মানুষ একটা শান্তিনিষ্ঠ জাতিকে খুন করতে অগ্রসর হয়। মানুষ কয়দিন বাঁচে? কয়েক দিনের জীবনের জন্য, কীসের জন্য মনুষ্য হত্যা? এই ছাই মাটির পৃথিবীর জন্য? বাংলার শেষ নবাব মীর কাসিম, বান্দ রাজবল্লভ, মহাতাপ চাঁদ, জগৎশেঠ, কৃষ্ণ দাসকে নিজের নিরাপত্তার জন্যে নিশিথ রাত্রে গঙ্গা নদীতে জীবন্ত অবস্থায় গলায় মাটির থলি বেঁধে ডুবিয়ে মারেন। মহাপ্রাণ বৃদ্ধভমতো চুনী সহানুভূতিতে প্রভুদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় গঙ্গার পানিতে নিজ প্রাণ দিল। মানুষের প্রতি এই নির্মমতা, মানুষের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা কী প্রকারে মনুষ্য সহ্য করে? এ পাপের শাস্তি মানুষকে ভোগ করতেই হবে। এই ছার রাজত্বের জন্যে মানুষ এতবড় নৃশংস আচরণ করতে পারে?

হে বন্ধু, তোমার পায়ে ধরি! মনুষ্য বুকে বর্শা চালিও না। এ মহা-পাপ করো না। কীসের জন্যে মানব প্রাণের অভিশাপ, তাঁর আঁখিজলের বিষবাণ বুক পেতে নিচ্ছ? দেখ দেখি কেমন করে তোমার বর্শাঘাতে আহতের চোখ দু’টি চিরদিনের জন্যে মুদিত হয়ে যায়, আর কথা বলে না–অভিযোগ করে না।

দস্যু, নর হন্তাকে মানুষ ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলায়–এ সমর্থন করা যায়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ রোষবশত নিজের পার্থিব সামান্য সুবিধার জন্যে; রাজ্য লোভে মানুষ খুন করে কেন, জাতি বিশেষকে সমূলে চূর্ণ করে ফেলে কেন? এতো জরদস্তি। জোর যার, মাটি তার–এ বর্বর নীতির অনুসরণ।

কথায় কথায় মনুষ্য হত্যার যুগ, রাজনৈতিক অপরাধে মানুষকে ফাঁসি দেবার যুগ, সভ্য জাতিদের ভিতর থেকে বর্তমানে হয়ত চলে গেছে। কিন্তু মানব জাতির যুদ্ধসজ্জা, জাতিতে জাতিতে মারামারি, রক্তারক্তি, কাটাকাটি–এ তোমার কী?

এই সেদিনের কথা–বিশ্ব জয়ের দুর্বার বাসনায় সুসভ্য জার্মান জাতি যৌবন গর্বে ন্যায়-ধর্মকে পদদলিত করে নিরপরাধ বেলজিয়ামকে চূর্ণ করে দিল। ফরাশি সীমান্তে যে ভীষণ অগ্নি তারা প্রজ্বলিত করেছিল–জগতের ইতিহাসে তার তুলনা নাই। ধন্য ফরাশি জাতি! শক্তির অসাধারণ পুত্র ফরাশি, ইংরাজ ও মার্কিনের সাহায্যে নিজের ও পৃথিবীর অবস্থা রক্ষা করেছে। যদি ফরাশি রাজ্য জার্মান হস্তে বিধ্বস্ত হতো, তা হলে না জানি আজ পৃথিবীর অবস্থা কী হতো। হায়, মানুষ ক্ষমতার গর্বে এত অন্ধ হয়! মানুষের শান্তি সুখ সে সহ্য করতে পারে না–এমনই তার হিংসাভরা প্রাণ। সে দেবতা না পিশাচ তা কে জানে? পৃথিবীতে কি পুনঃপুনঃ রক্তারক্তি হতে থাকবে? কি জানি কি কারণে গাজী আবদুল করিমের শান্তিপুর্ণ রাজ্যে ইতালী অশান্তির আগুন জ্বেলে দিল। একটা নিরীহ জাতিকে ইতালী অযথা চূর্ণ করে দিল। হায় রাজ্যলোভ! হায়, মানুষের অবিচার। জোর যার রাজ্য তার। জগতে বিচার কোথায়? ধর্মই বা কোথায়!–মনুষ্য হত্যার বিচার নাই। মনুষ্য হৃদয়ে দয়া কই? মনে হয় পরাভব স্বীকার করাও ভালো, তত্রাচ সমর-প্রবৃত্তি ভালো নয়। রাজ্য ত্যাগ করে বনে গমনও ভালো, তত্রাচ মানুষের বুকের রক্ত দেখতে ভালো লাগে না। জগতের সকল মানুষই কি নিষ্ঠুর ধর্মহীন বর্বর? মানুষ মাত্রেই মানুষের দয়ার পাত্র, মানুষ মাত্রেই মানুষের নমস্য। মনুষ্য হত্যা না করলে কি মানুষের কল্যাণ করা যায় না? সভ্যতার প্রচার হয় না? আঘাত না করলে কি মানুষের সুবুদ্ধি জাগে না? মানুষ কি এতই অন্ধ? সে নাকি ঈশ্বরজাত? মানুষ জাতি নাকি ঈশ্বরের অংশ? আপন আত্মা হতে নাকি ঈশ্বর আদি পিতা আদমকে সৃষ্টি করেছেন? তার পরিচয় কি এই? তার কাজ দেখে তো মনে হয় সে শয়তানের অংশ।

মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে দিয়ে, তার শিরচ্ছেদ করে জনসাধারণের মনে ভীষণ ভীতি সৃষ্টি করা রাজধর্ম হতে পারে–আমরা রাজা নই, রাজত্ব করি নি, রাজধর্ম বুঝতে পারি না। আমাদের কাছে পিতার বিরুদ্ধে পিতাকে বন্দি করা, সিংহাসনের জন্যে ভ্রাতৃহত্যা–এসব ভালো লাগে না। অথচ মোগল সম্রাটগণ এই সমস্ত জঘন্য কলঙ্কে কলঙ্কিত। জীবনে একটি মানুষ হত্যা করলে জীবনের সমস্ত পুণ্যে তার প্রায়শ্চিত্ত হয় না। আর যারা অর্থ সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে সহস্র সহস্র নর রক্তে ধরণী রঞ্জিত করেছে, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী করে হবে? কেমন করে তারা এত মানুষের শোণিত পাতে আপন মস্তিষ্ক ঠিক রাখে? রাজধর্ম যদি স্বতন্ত্র হয়, তবে ঈশ্বরের গ্রন্থসমূহে তার উল্লেখ দেখি না কেন?

.

০৩. পাপ প্রবৃত্তি

যুবক বয়সে যুবকদের শিরায় এক মহাপাপ প্রবৃত্তি জাগে। ব্যভিচার লিপ্সা ছাড়া আর এক রকম পৈশাচিক ক্ষুধা যুবকচিত্তে জাগে যা মনুষ্য ভাষায় বলা অসম্ভব। যে মহাপাপে সডম ও গমোরা (Sodom and Gomora) নামক দুই প্রাচীন নগরী ধ্বংস হয়েছিল, তিক্ত লবণ সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল–সেই পাপ ক্ষুধা মনুষ্য সমাজ হতে এখনও অন্তর্নিহিত হয় নাই–এ আমাদের সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। এখানে একটি সত্য ঘটনা দিচ্ছি।

একটি যুবক–একদা এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আসা-যাওয়া আরম্ভ করলেন। সেই ভদ্রলোকের একটি সুদর্শন পুত্র ছিল। পুত্রটি নিজমুখে তার জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে হাসপাতালে শয্যায় শুয়ে বলেছেন–যাতে–তার গোপনীয় জীবনকাহিনী শুনে দেশের অন্যান্য ছেলেরা এবং তাদের অভিভাবকগণ সাবধান হতে পারেন। তিনি বল্লেন–তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর। কেবল যৌবন দ্বারে উপনীত হয়েছি। এমন সময় আমাদের গ্রামের আজিজ মিয়া আমাদের বাড়ি আসা-যাওয়া আরম্ভ করলেন। আজিজ মিয়া এখন খুব উন্নতি করেছেন, আমি বিবিধ পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েছি। ইনি মনুষ্য মূর্তি ধারণ করলেও ইহাকে নরপিশাচ বলা চলে। এর জীবনের পাপময় ঘটনা জগতের কাছে প্রকাশিত হলে জগতের মানুষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হবে নিশ্চয়। আমি এক এক করে সব কথা বলছি। –আজিজ মিয়ার পিতা সম্রান্ত মানুষ। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। আজিজ মিয়াই এখন সংসারের কর্তা। প্রথমা স্ত্রীর উপর আসক্তি না জন্মায় দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছেন। প্রথমা স্ত্রী মাতার বোনের মেয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রী নিকটবর্তী কোনো এক গ্রামের কোনো এক সাধারণ গৃহস্থের বিধবা কন্যা। এই যুবকের পিতা উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন। রাজ কর্মচারীকে খুব সম্মানের চোখে দেখা গৃহস্থ শ্রেণীর লোকের স্বভাব। সুতরাং আজিজ মিয়ার আগমনে আমার পিতা-মাতা খুব খুশি হতেন। আজিজ নিজে শিক্ষিত ভদ্রলোক, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। বয়স ত্রিশ।

আজিজ মিয়া অনেক সময় আমার সঙ্গে কাটাতেন। পার্শ্বে বসে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে হঠাৎ তার বাম হাত খানি আমার বস্ত্রাবমতো লজ্জাস্থানের উপর প্রায়ই রাখতেন। আমি তাতে তাকে অতিশয় সরল এবং নিষ্পাপচিত্ত মনে করতাম। হঠাৎ তিনি একদিন আমায় একখানা চিঠি দিলেন। পত্রখানি এইরূপ–

“যেদিন বিদেশ হইতে বাড়ি আসিয়া তোমাকে দেখলাম, সেইদিন তুমি আমার হৃদয়ে রাজার আসন লইলে। শয়নে স্বপনে দিন রাত্রি নয়নে তোমারই মধুর মূর্তি দেখি, এ জগতে কাহাকেও তোমার মতো সুন্দর দেখি না। মজনু যেমন লাইলীকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছিল, আমিও তেমনি তোমাকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। তোমার মধুর নাম সর্বদা আমার জপমন্ত্র হইয়াছিল। এ ভালোবাসা রোজ কেয়ামতো পর্যন্ত থাকিবে। এ ভালোবাসা স্বর্ণময়, পবিত্র! এ পবিত্র প্রেমের পুণ্যে আমরা যে উভয়ে বেহেস্তে যাইব, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। ইচ্ছা হয় সর্বদা তোমায় বুকে করিয়া রাখি। দিন রাত্রি ২৪ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১৮ঘণ্টাই তোমার কাছে বসিয়া থাকি। ইহার কারণ কি এখনও বুঝিতে পার নাই? একবার বল, প্রাণ ভরিয়া বল, তুমি আমায় ভালোবাস, নইলে আমি বাঁচিব না তোমার মোহন মধুর ছবি যেদিন হইতে দেখিয়াছি সেদিন হইতে …।”

আমি এসব রঙের কথা কিচ্ছু বুঝি না, তবে মনে মনে এতবড় একজন লোকের এইসব ভালোবাসার কথা মনে করে খুব গর্ব এবং গৌরব অনুভব করলাম। তার ভিতর যে গরল ছিল, তা মোটেই টের পাই নি।

আমার পিতা-মাতা তাঁর নিত্য আগমনে খুব গৌরব বোধ করতেন। ভদ্রলোকের ছেলে, নিজেও শিক্ষিত। সুতরাং তার আগমনে আমাদের মতো লোক গৌরব বোধ করবেই তো। আমি যেন একটা মস্ত বড় লোক হয়ে পড়লাম। ইত্যবসরে কোনো কাজে আমার পিতার খরচে তার সঙ্গে আমার”দার্জিলিং ভ্রমণের দরকার হল।

সেই শহরে যেয়ে একদিন রাত্রে আমার মুখে তিনি অজস্র চুম্বন করলেন। এবং আমি যেন তাঁর পত্নী সেই ভাবে ব্যবহার করলেন। আমি তাকে মৌলবী সাহেব বলে ডাকতাম। –মৌলবী সাহেবের ব্যবহারে আমি যেন মনে কত দুঃখ পেলাম, তা বলবার নয়। আশ্চর্যের বিষয় তিনি তাঁর দুষ্কৃতির জন্য কিছু মাত্র লমিতো হলেন না। যেন কিছুই হয় নি, এইভাবে কথা বলতে লাগলেন। আমি আশা করেছিলাম, তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারবেন না। পবিত্র বন্ধুত্বের নামে একটি ভদ্রলোকের নিষ্পাপ বালকের বুকে তিনি এইভাবে পাপের কীট হয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি এরপর ২/১ দিন পর পর আমার সহিত সেইরূপ পাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। আমি লজ্জায় মানব সমাজের কাছে এই নির্দয় পাপের কথা প্রকাশ করতে পারলাম না। বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, তাকে কোনোদিন অনুতপ্ত হতে দেখলাম না। তিনি একটি চাকরি পেলেন এবং আমার গুরুজনকে বলে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। আমি বহু প্রকারে তার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে চেষ্টা করলাম। তাকে বেত দিয়ে প্রহার করলাম। তাতে তিনি অধিক আগ্রহে আমার উপর পত্নীর। ন্যায় ব্যবহার শুরু করলেন। আপন যুবতী স্ত্রীকে ফেলে তিনি আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। আমাকে অবিশ্রান্ত চুম্বন করতেন এবং আমার জিহ্বা টেনে বার করে চুষে চুষে খেতেন। এতে যে আমার কী কষ্ট হতো তা বলবার নয়। তিনি এইভাবে ৪/৫ বছর ধরে আমার উপর অত্যাচার করলেন। আমার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল। সৌভাগ্যক্রমে এই সময় তিনি দূরদেশে চলে গেলেন এবং পূর্ব পত্নীদের মৃত্যুর পর এক বিত্তশালী ধনী কন্যাকে। বিবাহ করলেন। ইত্যবসরে সংসারের বহু দুঃখে নির্যাতিত হয়ে সান্ত্বনার জন্যে আমিও বিবাহ করলাম। এইভাবে তার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। শরীর ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে লেখাপড়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, তাকে কোনোদিন অনুতাপ করতে দেখলাম না। দূরদেশ থেকে কত পত্র আমাকে লিখতেন। চিঠির উত্তর না পাওয়াতে কত বিশিষ্ট ভদ্রলোকের কাছে আমার নামে স্নেহের অনুযোগ করে পাঠাতেন। বাহিরের লোক ভাবতে তিনি আমাকে সরল প্রাণে শুধু ভালোবাসেন, কিন্তু আমি জানতাম তিনি আমাকে কী প্রকার ভালোবাসেন। সেসব অনুযযাগের কোনো উত্তর আমি দিতাম না!”

বাংলাদেশে এইভাবে শত স্থানে যুবকেরা নিজেদের উপর অত্যাচার করে। এর কোনো প্রতিকার হয় না।

আমাদের সমাজ জীবনে কত দিক দিয়ে কত গলদ আছে তার ঠিকানা নেই। জ্ঞান শিক্ষার ও চরিত্র উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সব ত্রুটির অবসান হবে, এমন আশা করা যায়। তবে মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে দ্রুত উন্নতির আশা করা যায় না। মুসলমান সমাজ শিক্ষার জন্যে শিক্ষা করতে চান না। ধর্মের জন্যে, মনুষ্যত্বের জন্যে যদি মুসলমান সমাজ লেখাপড়ার চর্চা করতেন তা হলে এতদিনে নারীশিক্ষা প্রচার হতো। এই অসভ্য সমাজ যেখানে আর্থিক লাভের আশা নেই, সেখানে বিদ্যাচর্চা করতে চায় না। ভালো চাকরি লাভ এদের বিদ্যা চর্চার প্রধান আকর্ষণ। যেখানে সে আশা নেই, সেখানে এদের চেষ্টাও দুর্বল। চাকরির আশা ক্রমশ দেশে কমে আসছে। এ অবস্থায় শিক্ষা লাভের উৎসাহও সমাজ থেকে কমে যাচ্ছে। নামাজ-রোজা করেই এরা পরকালের পাথেয় অর্জন করেন, জীবনের গ্লানি ও 3টি সম্বন্ধে এদের সুতীক্ষ অনুভূতিই নেই। তবে সমাজের উচ্চস্তরের লোক যারা, তাদের উন্নতির প্রতি, জীবনের প্রতি সুতীব্র শ্রদ্ধাবোধ আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

এই পার্থিব জীবনে, নিজের এবং অপরের যেখানে যে দুঃখ, যে গ্লানি ও ত্রুটি আছে–সে সব দূর করা সভ্য এবং ঈশ্বর মনোনীত সমাজের কাজ। তাই আশা ও উৎসাহে মানব সমাজের ত্রুটি এবং কল্যাণের চিত্র অঙ্কিত করতে সাহিত্যিকেরা সদা সচেষ্ট। তাদের বিদ্যালাভ সার্থক হয়, যারা এসব সাহিত্যিকের চিন্তা ও কল্যাণকে জীবনে গ্রহণ করেন।

.

বাড়িতে হোক, বিদেশে হোক, ছেলেমেয়েদের এক প্রকোষ্ঠে একাধিক ব্যক্তির রাত্রি যাপন উচিত নহে। যে যার প্রকোষ্ঠে দরজা দিয়ে শুয়ে থাকবে। রাত্রির অন্ধকারে অসভ্য সমাজে বহু পাপ অনুষ্ঠিত হয়। যদি সে সুযোগ না থাকে, তবে পাপের অনুষ্ঠানও কমে।

রাত্রিকালে যুবকেরা পার্শ্ববতী সুপ্ত বালক-বালিকাদিগকে আক্রমণ করে। তাদের তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সরলচিত্ত মাতাপিতা এবং বয়োজ্যেষ্ঠরা যুবকদের পাপ সন্দেহ করেন না। যৌবনকালে অপরিমিত এবং অন্যায় শক্তি ব্যয়ে মানব-জীবনের আয়ুমূলে যে ভীষণ কুঠারাঘাত হয়, তার সংশোধন জীবনে হয় না।–মানব সমাজের এ অতি সাংঘাতিক পাপ। আশা করি, অভিভাবকেরা এ সম্বন্ধে যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করবেন এবং আপন আপন নিষ্পাপ পুত্র কন্যাদেরকে অকাল মৃত্যু এবং জীবনের ভবিষ্যৎ মরণ যন্ত্রণা হতে রক্ষা করতে চেষ্টা করবেন। এ পাপের শেষ ফল আছেই–সেই দুঃসহ দুঃখের হাত হতে কোনোমতে এড়ান নাই।

.

০৪. কঠিন যুদ্ধপ্রিয় জীবন

মনে হয়, যৌবনের একটা আকর্ষণ আছে–জীবনের রুদ্র ভয়াল শোণিত উৎসবের প্রতি! মৃত্যুর সঙ্গে, জীবনের অতি ভীষণ কঠিন অবস্থার সঙ্গে সে খেলা করতে চায়। পৃথিবীর এই সুখ-শান্তি যেন তার ভালো লাগে না। যায় যাবে প্রাণ–এই মানবিক ভাব নিয়ে সে জীবনের ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল খেলায় যোগ দিতে চায়। এই প্রচণ্ড রক্ত-উৎসবের মাঝেও সে গৌরবের মুকুট শিরে ধারণ করতে আকাঙক্ষা করে। জীবনের অনন্ত সমস্যা মাঝে যুবকের প্রাণ অনেক সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে–পৃথিবীর কিছুই ভালো লাগে না। সে মৃত্যুর জন্যে যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হয় পৃথিবীর অফুরন্ত ঐশ্বর্যের প্রতিপালক হয়ে অপার সুখে সে বাস করবে, নয় এই দুঃখ-দীর্ণ জীবনের বন্ধন হতে সে চিরবিদায় নেবে–এই হয়ে দাঁড়ায় তার। মনোভাব। গৃহের সুখ আর সহ্য হয় না–যেন কণ্টকের মতো বিধে। সে চলে যেতে চায় রণাঙ্গনে, মরণকে বরণ করতে, অথবা মরণকে জয় করতে।

জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হয়। ন্যায় অন্যায় নিয়ে। অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার জন্যে, যৌবন ক্ষিপ্ত সিংহের বিক্রমে রণক্ষেত্রে ছুটে যায়। প্রচণ্ড উল্লাস তার হৃৎপিণ্ডের রক্তে তরঙ্গিত হতে থাকে। এই রক্তের উল্লাস, যৌবনের এই ক্ষুধা মানুষের জীবনে এক পরম স্বর্গীয় দান। মানুষ কি চিরদিনই বেঁচে থাকে? কত যৌবন অকালে জীবনের সাধ আকাঙক্ষা পূরণ না হতেই ব্যাধি, পীড়ায়, দুর্ঘটনায় কোথায় চলে যায়? এর চেয়ে মানব হিতে, সত্য প্রতিষ্ঠায়, ন্যায় যুদ্ধে গৌরবের মৃত্যু বরণ করাই তো ভালো। যারা মৃত্যুকে ভয় করে তারাই হয়তো বেশি মরে। ঈশ্বরের অনন্ত রহস্য অনুভূতির অতীত। তিনি কোনো অজ্ঞাত নীতি সূত্রে সৃষ্টি শাসন করছেন তা মানুষ কি বুঝতে পারে? যা একটু বোঝে, তাতেই তার বুদ্ধি অবাক এবং বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়।শ্ৰদ্ধার করজোড়ে সে প্রভুকে প্রণাম করে। মনুষ্য মরণের পর কোথায় যায়, তাই বা কে জানে? কে বিশ্বাস করে মানুষের জন্য এক কল্যাণের ভবিষ্যৎ আছে, যেখানে মানুষের সকল দুঃখের চির মীমাংসা হবে। যৌবন সময়ে ভবিষ্যৎ জীবনের পুরস্কার লোভে গৌরবের মরণ বরণ করে। মরণের সঙ্গে খেলা করতে করতে জাগে, হাসিমুখে অনন্তের শয্যায় লুটিয়ে পড়ে।

এ পিপাসা পশুর রক্ত পিপাসা নয়। এ স্বর্ণময় পিপাসা তার মনের কাছে অন্তরের আহ্বান। দূরে কোনো স্বপ্নরাজ্যের মোহন ধ্বনির মতো প্রিয়া অভিসারের নিমন্ত্রণ। স্বর্গচ্যুত বিরহী আত্মার বেদনা-ব্যাকুল, অশু ভরা আহ্বান অথবা সন্তান-হারা জননীর ‘আয় আয়’ ধ্বনির মতো আত্মার কাছে এক শাশ্বত আর্তনাদ।–সে ছুটে যায় এই অসীমের নিমন্ত্রণে–পিপাসা-কাতর আত্মার তৃপ্তির জন্যে। যে দুর্বলা নারী, নিঃসহায় শিশু, পদানত শত্রু, শক্তিহীন বৃদ্ধা, শিল্পী কৃষক, নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিক্ষেপ করে সে কখনও যোদ্ধা নয়। শাস্তির পাত্রকে শাস্তি দাও। সৈনিকের প্রাণে অসীম দরদ।–সে মনুষ্য হত্যা করে ন্যায়ের আহ্বানে, ব্যক্তিগত স্বার্থের বা হিংসা-ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নয়। নিরাপরাধের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করা তার পক্ষে মহাপাপ। সে নরভুক শার্দুল নয়, সে শান্তি প্রতিষ্ঠাতা দেবতার সন্তান।-দুঃখের ও অবিচারের শত্রু। সে দুঃখী এবং নিঃসহায়ের রক্ষাকর্তা। তার কাছে কোনো অবিচার নাই।

কৌশলের রাজা দুঃখীর বন্ধু হয়ে, দুঃখীকে দরদ করে দেশের সকল মানুষের পরম আত্মীয় হয়েছেন। তার নাম শুনে রাখাল বালক, ঘরের বধূ এবং পথের ভিক্ষুকও হাত তুলে ভক্তি জানায়। দাম্ভিক কাশীরাজ কোশল-রাজের এই প্রতাপ ও আধিপত্য দেখে জ্বলে পুড়ে মরছেন। কোশল-রাজকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত করা চাই-ই। কোশল রাজের রাজ্য বড় নয়–তার সৈন্য সংখ্যাও বেশি নয়, কাশীর অধীনস্থ একটি সামান্য রাজ্য–অথচ তার নামই বেশি। কাশী-রাজ মন্ত্রীকে আদেশ করলেন, ‘মন্ত্রীবর, আপনি সৈন্য প্রস্তুত করুন। কোশল-রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব। তাকে যুদ্ধে পরাজিত করে, রাজ্য। থেকে তাড়িয়ে দেব। দেখি তার নাম থাকে কোথায়?’ মন্ত্রী মনে মনে হাস্য করলেন। ভাবলেন, যে দয়াগুণে এবং মনুষ্যত্বে মনুষ্যের হৃদয় অধিকার করেছে তাকে জব্দ করা কঠিন। বাহিরে রাজাদেশ পালনের আয়োজন করলেন।

যথাসময় কোশল-রাজ সংবাদ পেলেন–কাশী রাজ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান করেছেন। হায়, তার জন্যে কত মানুষের জীবন হানি হবে কত পবিত্র রক্ত মাটি সিক্ত করবে। তার চাইতে রাজ্য ছেড়ে পরাজয় স্বীকার করে, রাজ্য ছেড়ে বনে পালিয়ে গেলেন। কাশী-রাজ আনন্দে প্রচার করলেন–যে এতবড় কাপুরুষ, যে প্রাণ ভয়ে এত ভীত, সে কি সিংহের সম্মুখে বুক টান করে দাঁড়াতে পারে? তার সভাসদেরা সে কথা শুনে কোনো উত্তর দিল না মাথা নত করে রইল।

পুরবাসী গোপনে গোপনে কোশল-রাজের জন্যে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে। পরাজিত হয়েও তিনি মানুষের ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলেন না। পুরবাসীর প্রাণ সহানুভূতি ও বেদনায় কোশল-রাজের সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কী বিপদ রে! সে-সব প্রশংসা বিষের মতো কাশী-রাজের কানে লাগে। তিনি যুদ্ধে জিতেও কোশল-রাজকে জব্দ করতে পারছেন না।

ক্রোধে প্রচার করে দিলেন, যে কোশল-রাজের মাথা কেটে এনে দেবে, তাকে লক্ষ মুদ্রা দেব। সে কথা শুনে কাশীর রানীরা পর্যন্ত জিভ কেটে বল্লেন–কী সর্বনাশ, কী অধর্মের কথা!

.

এক কাভালো বন-পথে কোশল-রাজকে দেখে বল্লে-ফকির, দুঃখীর বন্ধু কোশল-রাজের বাড়ির পথ আমায় দেখিয়ে দিতে পারেন। আমি সর্বহারা। দুঃখী কাঙাল। আমার যা কিছু ছিল, সব হারিয়েছি। সাগরে তরী ডুবে গেছে। ভূমিকম্পে ঘর-দুয়ার ভেঙে গেছে। সন্ন্যাসী কাঙালকে ইচ্ছে করে কাশী-রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে করজোড়ে নিবেদন করলেন–মহারাজ দয়া করে আমায় দান করুন। সে বিপন্ন, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বড় দুঃখে পড়েছে। আমি আপনার শত্রু-কোশলের হতভাগ্য রাজা। কাশী রাজ হেসে বল্লেন–ওগো মরণ বিজয়ী বীর। এই আপনার কৌশল। আজ হতে আপনার রাজ্য আপনাকে দিলাম। আপনাকে মরে। অমর হতে দেব না।

যৌবন অন্যায় রক্তপাতে কখনো উল্লসিত হয় না। সে পরাজয় স্বীকার করে, তবু। মনুষ্য বুকে তরবারি হানে না। ছার রাজ্যে, সিংহাসন দিয়ে কী হবে! যৌবনের বজ্র-বাহু দীন-দুঃখীকে পালন করে। তাকে চূর্ণ করবার জন্য কি সে এ শক্তির দান পেয়েছে? না, না, না।

.

০৫. প্রেম ও যৌবন

যৌবন উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে যুবকের সম্মুখে হয়তো কোনো এক প্রভাতে এক নূতন জীবনের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়। এক নব উন্মাদনা বর্ষার প্রচণ্ডতায় তার হৃদয়-সাগর বন্যাবিক্ষুবন্ধকরে তোলে। তার মনের অনুভূতির সঙ্গে কাম ও পাপের কোনো সংস্রব নাই। কাম তার পশু ভাব–প্রেম তার দেব ভাব।

কাম জীবনকে উন্নত করে না-বাসনার তীব্র পিপাসা উত্তরোত্তর বেড়ে তাকে সর্বনাশের গভীর গুহায় টেনে নিয়ে যায়। প্রেম তাকে সংযমী এবং মহৎ করে। দুঃখের বিষয় যুবকেরা এই বয়েসে প্রেমের নব উন্মাদনায় প্রায়ই পাপ পথে ধাবিত হয়–উন্মত্ত নারী সঙ্গ হতে বঞ্চিত থেকে এদেশে যুবকেরা প্রায়ই কুচরিত্রা রমণীর গৃহে আসা-যাওয়া করতে থাকে। ফলে তার পতন ও সর্বনাশ আরম্ভ হয়। এই জন্য আমাদের দেশের লোকেরা প্রেমকে অতি ঘৃণার চোখে দেখেন। প্রেমের অর্থ তারা বোঝেন–বেশ্যালয়ে গমন, পাপ এবং ব্যভিচারের পথে বিচরণ। আমাদের দেশে বিবাহের পূর্বে শতের মধ্যে ৯৯ জনই অবৈধ নারী সংস্রবে একবার না একবার জীবনকে পতিত করে। বাঙলার হাজার হাজার বেশ্যাকে রাজকন্যার হালে যারা রাখে তারা আমাদের যুবকেরা। এই বেশ্যার দল কোনো কাজে পরিশ্রম, কোনো পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করে না–অথচ সংসারে খুব উচ্চ অবস্থায় জীবন যাপন করে। এদের অন্নদাতা সংসারের শত শত যুবক যাত্রী। যাদেরকে সমাজ ধরতে পারে না, চোখে দেখে না, যারা প্রকাশ্যে সাধু! যুবক-যুবতাঁকে বৈধ ও ভদ্রভাবে অভিভাবকদের দৃষ্টির সম্মুখে কেন মিশতে দেওয়া হয় না, তা বলা যায় না। নারীকে একেবারে যুবকের দৃষ্টি হতে গোপন করে রেখে, দেশের নৈতিক আরও দূষিত করা হবে না? গোপনে অভিসারের পথে কে বাধা দেবে? মানব জীবনে প্রেমের যে একটা অতি মহৎ সার্থকতা আছে, সাধারণ শ্রেণীর মানুষ তা অনুভব করে না। প্রেম মানুষকে সংযমী, চরিত্রবান, বলবান, সাধনায় দৃঢ়বান করে–যুবককে সগ্রামশীল, মহৎ ও গৌরবশীল করে।

অশিক্ষিত সমাজ যুবক-যুবতাঁকে হাটের গরুর মতো বিক্রি করে জীবনে তাকে পঙ্গু অলস পশু করে ফেলে। ফলে তার জীবনে কোনো রসানুভূতি থাকে না। বলহীন, সাধনাহীন, পশু সে কামনা করে। গোবেচারী বোকা সহজ মানুষ যারা,–তারা জীবনকে অবস্থার সঙ্গে মানানসই করে নেয়। আত্মায় যাদের আগুন আছে তারা এ জগতের আশা, বাসনা, আনন্দ, আকাঙক্ষা ত্যাগ করে মহত্ত্বের শান্তি পেতে পরকালের জন্য সহিষ্ণু হয়ে অপেক্ষা করেন। অথবা একটা বৃহৎ ত্যাগ ও বৈরাগ্য তাদের জীবনকে কঠিন যন্ত্রণা দেয়। না হয় সে উচ্ছৃঙ্খল, বেশ্যাসক্ত, পথহারা, বাঁধনহারা যথেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে। শেষকালে হয় পথে, না হয় ঘরে সান্ত্বনাহীন, আনন্দহীন, দুঃখের জীবন যাপন করে, দুঃখের মরণ মরে।

কবি মধুসূদন শেষ জীবনে কৃতকর্মের ফলে শোচনীয় ভাবে মরণ বরণ করেছিলেন। জনৈক সহৃদয় বান্ধব স্বীয় লাইব্রেরির গৃহে পীড়িত কবি, তার পত্নী এবং ছেলেপেলেগুলিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সাহায্য করে করে সবাই সরে গেছে। আর এখন কেউ সাহায্য করে না। সেবাকারিনী যখন ঔষধ-পথ্য নিয়ে তার পত্নীর কাছে উপস্থিত হলেন, মহৎ হৃদয় প্রেমিকা পত্নী বললেন–আমার জন্যে কোনো সেবাযত্নের প্রয়োজন নাই–আমার স্বামীর জীবন রক্ষা করুন। এই কথা বলেই তিনি প্রাণত্যাগ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *