০১-০৫. মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়

মহা জীবন – ডা. লুৎফর রহমান

০১. মহামানুষ মহামানুষ কোথায়

শুভ্র সুন্দর গৌরবের কিরণমালায় যেখানে পৃথিবী হাসিয়া ওঠে সেখানেই মানুষ জাগে–অগৌরবের অন্ধকারে মানুষ নেই।

বজ্র-বিদ্যুৎ যেখানে পৃথিবী শঙ্কিত হয়ে ওঠে সেখানেই মানুষ জাগে-মৌন প্রকৃতির শান্ত মৃত্যুতে মানুষ নাই।

অশ্রু, ক্রন্দন, বেদনার ভিতর দিয়ে মানুষের জাগরণ। সে চঞ্চল বিদ্যুৎ সাগরের তরঙ্গলীলা, যুগ যুগের ক্রন্দন সে, সে স্থির-মৌন নয়। মানুষ মৃত্যুর নীরবতা নয়। শান্ত নয়–সে উল্কা, উচ্ছ্বসিত আবেগ। মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কোথায়? কেঁদে যখন সে বসে পড়ল, লজ্জায় অনুতাপে যখন সে অশ্রু ফেলল, ক্রোধ বহ্নিতে যখন সে ক্ষিপ্ত সিংহের রোষে যাত্রা করল, যখন সে প্রিয়তমের জন্য কাঁদল, সন্তান শোকে যখন হাহাকার করে উঠল, যখন সে দুর্জয় জলপ্রপাতের মতো দিগ্বিজয়ে বের হল; শান্তির নীরবতার মধ্যে মানুষকে খুঁজে বের করা কঠিন। মেঘভরা আকাশের উৎসবে মানব-চিত্ত নৃত্য করে উঠেছে, বাতাসের সকরুণ সঙ্গীতে চিত্তে তার ব্যথা বেজেছে। মানবাত্মার অগৌরব দেখে সে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছে। মানুষের ব্যথায় যে ঘর ছেড়ে বের হয়েছে, জীবনের সর্বসুখ বর্জন করে যে ধুলোর আসন গ্রহণ করেছে, যে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করেছে, লাঞ্ছনা সয়েছে, গর্বিতের পদাঘাত সয়ে যে আশীর্বাদ করেছে, ব্যথিতের মর্মবেদনায় তার আঁখিতে ধারা বয়েছে–ওহঃ মানুষ কত বড়!

সহজ নির্বিকার জীবনে মানুষকে পাওয়া যায় না। স্বার্থ সংগ্রামে যখন সে পশুর হীনতায় পথে পথে ঘুরেছে, মানুষকে ব্যথা দিয়েছে, আত্মার চরম অগৌরব করেছে; তখন আমি ঘৃণায় তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছি।

তোমায় মৃত অনুভূতিহীন উপাসনায় রত দেখে আমি সুখী হই নি। পাপ অগৌরবের লজ্জায় যখন তুমি অনুতাপের অশ্রু ফেলেছ তখন আমি তোমায় সম্মান করেছি–এখানেই তুমি জাগ্রত সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ।

তোমায় তীর্থযাত্রীর বেশে দেখে আমার নয়নে ভক্তিপূর্ণ অশ্রু দেখা দেয় নি। হৃৎপিণ্ডের রক্ত দিয়ে যখন তুমি ধরণী রাঙিয়েছ, তখন আমার হৃদয় গলে পানি হয়েছে, সভয়ে শ্রদ্ধায় করজোড়ে আমি তোমার শোণিত-বিন্দু পূজা করেছি। বাঁশি কেঁদে উঠে তোমার হৃদয়ের মহাগান আমায় শুনিয়েছে; তোমার স্বরূপ আমায় জানিয়েছে। বজ্র ধ্বনিতে তোমার মহিমা আমি অনুভব করেছি তোমার প্রেম-বিহ্বল, বেদনা-কাতর মূর্তিকে জীবিত দেবতা জ্ঞানে আমি পূজা করেছি। সহজ মৃতের জীবনে তোমায় পাই নি।

সহজ জীবনে তোমার প্রকাশ হয় নি। তুমি ঘৃণিত ছোট হীন ও নীচাশয়; ক্ষণে ক্ষণে যে উল্কার আলোক বিদ্যুতের চির-চঞ্চল রুদ্র মধুর সৌন্দর্য, প্রেমের ক্রন্দন তোমার মধ্যে দেখা দিয়েছে–সেখানেই তুমি জেগেছ।

মানব-ভাগ্যে এক সান্ত্বনার জগৎ আছে। মানুষের অপরিণাম দুঃখ, তার শত বেদনার অভিযোগ একদিন সান্ত্বনা লাভ করবে। এই যে বিশ্বজোড়া কলহ-বিবাদ, রক্তারক্তি, কাটাকাটি, হানাহানি–এর শেষ এক চির-অশান্তি ও জ্বালাভরা ভবিষ্যতে, কোনো উন্নত মহাজীবনে ওর আনন্দময় পরিসমাপ্তি হবে না; যেখানে এক অনির্বচনীয় মহাশান্তি মানবাত্মাকে পরম সুখ দান করবে, মানুষের কত আশা, কত বেদনা অমীমাংসিত রয়ে গেল। কত নির্যাতিত আত্মার বেদনা-ঘন অশ্রু বায়ুমণ্ডলকে সন্তপ্ত করে দিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেছে–তার কি কোনো সান্ত্বনা নেই? জাতের গর্বকে মর্যাদা দিতে, মানুষের ঔদ্ধত্যকে শান্তি দিতে কত অবহেলিত বীর অগ্নিসমুদ্রে রক্তের বুকে প্রাণ দিয়েছে–কোথায় তারা? কোন অনন্ত মহাশূন্য সাগরে মিশে গেছে তারা? তাদের বুকে কি কোনোদিন কোনো সান্ত্বনার হাত পড়বে না? আর যারা জগতে এই দুঃখ সৃষ্টি করেছে তাদের কি কোনো বিচার হবে না? হবে হবে, নিশ্চয়ই হবে।

পীড়িত, ব্যথা-কাতর মানুষ দিবারাত্র হায় হায় করে একদিন শেষযাত্রা করে। সংসার সুখ বঞ্চিত কত দুঃখী একদিন মৃত্যুর কবলে চিরআশ্রয় পেলেন। তাদের জীবনে কি কোনোই পুরস্কার নেই?

এই পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্যে যেমন অনন্ত দুঃখ, তেমনি অনন্ত ঐশ্বর্য সম্পদও জুটে থাকে। শত ঐশ্বর্যের পার্শ্বে, নিঃস্ব দুর্বল এবং জগতের কাঙ্গাল ভিক্ষুক হয়ে কত নরনারী পৃথিবীর সর্বত্র পথে পথে কেঁদে মরছে। শক্তিহীন দুর্বল তারা, অযোগ্য তারা, শুধু জগতে হায় হায় করতেই এসেছিল। এতটুকু বাঁচবার অধিকার যেন তাদের নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে জগতের ফেলে-দেওয়া অনের আকাঙ্ক্ষা করা, জীর্ণ মলিন বস্ত্রকে মূল্যবান রেশমি বস্ত্র ভাবা, কুকুরের ন্যায় ধনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাই এদের জীবনের গৌরব বাসনা। হায়! মানব জীবনের এই দুর্গতি ও অপমান! জীবনের উন্নতি ও উচ্চতম চিন্তা এদের হৃদয়ে প্রবেশ করে না কোনো আশার আলোক এদের জীবনকে ক্ষণিকের জন্য উৎসাহিত ও প্রফুল্লিত করে না। বেঁচে থাকাই এদের জীবনে মস্ত বড় সমস্যার বিষয়। বেশি দিনের কথা নয়–মানব-সমাজ কিছুকাল আগে এদেরকে গরু-ঘোড়ার মতো বিক্রি করতো। মানব জীবনের কোনো মর্যাদা মানুষের কাছে ছিল না। আজ যে স্বাধীন, সৌভাগ্যের সন্তান–কাল হয়তো সে কোনো যুদ্ধে বন্দি হয়ে ধনীগৃহের ক্রীতদাসরূপে বিক্রিত হতো। আজ যে নারী ভাগ্যবতী–বহু গুণী এবং ধনী সন্তানের মাতা, যিনি পরম সুখে সংসারে বাস করেছেন–কালই হয়তো গুরুতর ভাগ্য বিপর্যয়ে তিনি মানুষের ক্রীতদাসী এবং সর্বসুখ, জীবনের সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত, ভাবহীন, চিন্তাহীন, বেদনা অনুভূতিহীন কাঠের মানুষ তাকে হতে হতো। যে সম্পদশালী যে চিরসুখী সে কি দুঃখীর বেদনা বুঝতে পারে? যে অনাহারে থাকে নি, সে কি ক্ষুধিত গরীবের দুঃখ অনুভব করতে পারে? যারা সুখী, অভাব মুক্ত, তাদের কাছে এই পৃথিবী এক হাসি-তামাসার বিষয়–তাই দুঃখীর ভগবান-আল্লাহ্ বল্লেন, তোমরা আমার নামে রোজা থাক–যে রমজান মাসে উপবাস করে সে আমার প্রিয় দাস। কারণ দুঃখীর দুঃখ বোঝবার জন্য, মুহূর্তে মুহূর্তে আল্লাহর সর্বগুণ যুক্ত অস্তিত্ব বুকে অনুভব করবার জন্য সে দিবসে অন্ন পানি কিছুই গ্রহণ করে না। সারাদিন উপবাস করেও যদি মানুষ দরিদ্রের বেদনা না বোঝে, তবে সে আর কী উপবাস করে! ধিক তাকে!

যে দরিদ্রকে কৌশলে ফেলে তার কাছ থেকে অর্থ কেড়ে নেয়, যে ডাক্তার হাসপাতালের গরিব রোগীর কাছ থেকে টাকা না পেলে তাকে ভালো করে চিকিৎসা করে না, যে উকিল বা আমলা বিচারপ্রার্থী মানুষের অর্থ ছলনা করে গ্রাস করে, যে নিত্য মানুষের অমঙ্গল ইচ্ছা করে, যে স্বার্থের জন্য মানুষকে নমস্কার করে, যে আপনার ক্ষমতার দাবিতে দরিদ্রের নমস্কার কামনা করে, ধিক তাকে!

আমি বলি তার কোনো ধর্ম নেই। সে দাড়ি ফেলুক আর না-ই ফেলুক তাতে কী আসে যায়! সে বাঙালি বা আরবি নাম রাখুক তাতেই-বা কী আসে যায়! তার কোনো ধর্ম নেই। তার কোনো ঈশ্বর নেই। তার রোজা-নামাজ দেখে আমি ভুলি না, তার পূজা-অর্চনা, তার বর্বর যুগের ধর্মশালা দেখে আমি সুখী হই না।

মানুষ নিজেকে কতটুকু ঈশ্বরের করতে পেরেছে–প্রতিদিন কার জীবনে, মানুষের সঙ্গে প্রতি কাজে ও ব্যবহারে ঈশ্বরের কতটুকু ইচ্ছা সে পালন করতে পেরেছে–আমি তাই জানতে চাই।

তোমরা কাফের আর কাফেরের মুখ দেখেছ কি? তোমরা মানুষের চোখে-মুখে তার প্রাণের ছবি দেখেছ কি? আমি দেখেছি। ও সেই দুরাত্মার, দানবের সৃষ্টি আমার বুকে ঘৃণার আগুন জ্বলেছে–আমি নিত্য প্রভাতে তার ধ্বংস কামনা করেছি। সেই চির-আবুজেহেল কোন দাবিতে জগতে বেঁচে আছে?

সেই দুৰ্বত্তের জীবনে সত্যের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। সেই দুবৃত্ত কাফেরের স্পর্শিত পানি খেলেই মানুষের জাত যায়। সে মানুষের পাকঘরে উপস্থিত হলে গৃহস্থের সমস্ত খাদ্য নষ্ট হয়।

সেই কাফের মিথ্যা কথা বলতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। তার চোখে দানবের ভীষণতা সদাই লেগে থাকে। তার দাড়িভরা মুখে পিশাচের কলঙ্ক কালিমা সদাই প্রতিভাত হতে থাকে।

সেই শয়তানের বুকে কখনও অনুতাপ জাগে না। পাষাণ গলে, তার হৃদয় গলে না। আল্লাহর মন্দিরে প্রবেশ করলে আল্লাহর ঘর তাকে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে।

.

০২. মহিমান্বিত জীবন

এই বিশ্বের যারা কল্যাণ কামনা করে, ঈশ্বরের রাজ্য ও মহিমা বিস্তারের জন্যে নিজের যাবতীয় শক্তি, অর্থ ও জ্ঞান উৎসর্গ করে–তাদেরই জীবন মহিমান্বিত। জেলখানায় দেখতে পাই, অপরাধী দুবৃত্তের প্রতি মানুষ কত হিংসা পোষণ করে। মধ্যযুগে ইউরোপে কয়েদিদের ওপর যে ভীষণ অত্যাচার হতো, তা চিন্তা করতে আমরা ভয় পাই। যে খ্রিস্টান জগতে প্রেমের ধর্ম প্রচার করে, তাদের ভিতর মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মম ব্যবহার। নিতান্তই আশ্চর্য বলে মনে হয়।

মানুষ কি এখনও বোঝে নি, মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ঈশ্বর মানুষের কাছে কী চান? স্বার্থান্ধের স্বার্থ-বাসনা জড়িত উপাসনা ও তোষামোদ ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। মানব সংসারের কল্যাণ কামনা ত্যাগ করে যারা নিরন্তর ঈশ্বর উপাসনায় ব্যস্ত থাকে, তারা। নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব। হৃদয়কে প্রেম উদ্বুদ্ধ করবার জন্যেই, আত্মার মহাজ্ঞানের আশীর্বাদ লাভ করবার জন্যেই মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করবে। উপাসনার আর কোনো বড় সার্থকতা। নেই। জগতে জীবনের উন্নততর, মহিমান্বিত প্রেমের ব্যবহার ত্যাগ করে নিরন্তর উপাসনার। কোনো মূল্য নেই।

মানুষের প্রতি হিংসা বর্জন কর। মানুষকে ঈশ্বরের পথে, মঙ্গল ও কল্যাণের পথে, সুখ ও শান্তির জীবনে আহ্বান কর। গায়ের বল, অর্থসম্পদ, উচ্চ রাজপদের গর্ব ত্যাগ কর। তুমি কি জান না, ঈশ্বরের শান্তি মুহূর্তের মধ্যে তোমাকে দুর্বল ও শক্তিহীন করতে পারে?

জীবনে সুখ-সম্পদে, বলে-গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হবার আকাঙ্ক্ষা তুমি কর?–যদি তোমার চিন্তায় মনুষ্য সমাজ, এই পৃথিবীর মঙ্গল তোমার গৌরব প্রতিষ্ঠার কোনো মূল্য নেই। তুমি কি পশুদের রাজা সিংহের প্রতাপ লাভ করতে চাও? তুমি কি উচ্চতরের পশু হতে চাও?

না–না–ঈশ্বর তোমার কাছে সে আশা করেন না। তিনি গভীর রাতে, পীড়িতের আর্তকণ্ঠে তোমাকে ডেকেছেন পৃথিবীর সেবায়, ব্যাধিগ্রস্ত পীড়িত মৃতকল্প মানব সেবার কার্যে, পাপী, পতিত, দুঃখী নরনারীর উদ্ধারের জন্য।

জীবনের দান পেয়েছো কী জন্য? এর সার্থকতা কী? ঈশ্বরে তুমি মহিমান্বিত হও। ঈশ্বরকে বর্জন করে, সুখ-লালিত বিরাট বপুতে, সমুদ্রের গভীর রত্নভাণ্ডারে, চামচিৎকার অট্টালিকা বাসে, কুকুরের তৃপ্তিতে তুমি আত্মতৃপ্তি অনুসন্ধান করছো! মানুষের জীবনে ওতে তৃপ্তি নেই। মানুষ ঈশ্বরের অংশ–যে বেদনা ও অশ্রুর সৃষ্টি, সে দেবতা। সে পশু নয়, রক্তপিপাসু সিংহ নয়, জীবনহীন রত্নময় সমুদ্রগর্ভ নয়, তুচ্ছ চামচিকাও নয়, নিকৃষ্ট কুকুরও নয়। তার প্রার্থনা অতি মহান–সে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে–ওগো মহারাজ! মানুষের জন্যে আমায় কাঁদতে দাও। মানব কল্যাণে আমায় চিন্তা করতে দাও। বিশ্বের পাপ ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমায় যুদ্ধ করতে দাও। তোমার রাজ্যে যেন অসত্য ও মিথ্যা জয়যুক্ত

হয়। যারা জগতে অশ্রু সৃষ্টি করে, যারা জগতে অন্ধকারের সংবর্ধনা করে, যারা সত্যের অপমানে লজ্জিত হয় না, তাদেরকে তুমি লজ্জিত কর। প্রভু আমার জাতিকে কাঙ্গাল করিও, তোমার বর্ণ ও গন্ধে আমাদের জীবন মহিমান্বিত কর। অত্যাচারীর বজ্ৰসৃষ্টিতে, অবিচারের নির্মম দণ্ডে, উদ্ধতের নির্লজ্জ দাম্ভিকতায়, মানুষের অবহেলায় যারা দগ্ধ হয়েছে, যারা অকালে শুকিয়ে গেছে তাদেরকে তুমি আশীর্বাদ কর। প্রভু! তুমি চিরকাল আছ, তোমার ধর্মও চিরকাল আছে। মানুষ যে নামেই তাকে অভিহিত করুক। তোমার ধর্ম কী? তা মানুষ

বুঝুক, আমি বুঝেছি। তুমি পাপ, মিথ্যা অন্ধকার নও। তুমি আনন্দ, শান্তি সত্যময়, নির্মল নিপ সত্তা। তুমি মানুষকে তার স্বরচিত অসীম দুঃখ হতে রক্ষা করতে চাও। তোমার রাজ্যে দুঃখ নেই, তাপ নেই, জ্বালা নেই, কুৎসিত নেই। তুমি মানব-সন্তানকে প্রেমের আহ্বান জানিয়েছ। মানুষ তোমার কাছে না এসে অনন্ত দুঃখ ও জ্বালার পথে ছুটেছে। মানুষের দুর্গতিতে, হে প্রভু, তুমি পথে পথে কেঁদেছ–আকাশের বারিধারায় তোমার হৃদয়ে বেদনা উছলে উঠেছে। সারা রাতের শিশিরপাতে তোমার বেদনা অশ্রু ঝরেছে। হায়! বাঁশি বেজেছে তোমারই প্রেম ও মমতার গান গেয়ে। ওগো জননী! নরনারী যখন তোমাকে ভুলে বিপথে ছুটে চলল, যখন মানুষ তোমার মেঘে মেঘে ঝঞ্ঝা-ব্যাকুল সমুদ্রতরঙ্গের ভৈরব শাসন-গর্জনকে উপেক্ষা করে পাপ করল, হায় হায় দুঃখে তখন তুমি কাঁদলে। সে কাঁদন অনন্ত কালেও শেষ হবে না। ওরে মানুষ ওরে অবোধ প্রভুর ভুবন ভোলানো প্রেমের আহ্বান আসছে চিত্তে। জাগ, ওরে মন জাগ। ডাক এসেছে, বিলম্ব করো না। শয়তানের ছলনায় পড়ে পথহারা হয়ো না। প্রভুর পথ ভুলো না। ধন্য সেই, যে তোমাতে মহিমান্বিত হয়। ধন্য সেই–যে তোমার গৌরবে গৌরব বোধ করে, যে দিবাকর প্রতি কাজে তোমার গৌরব রক্ষা করে, তোমার ইচ্ছা পালন করে, যে মানুষকে কোনো রকমে তুচ্ছ ও রূঢ় ব্যবহারে বেদনা, দেয় না, যে তোমার পতাকা ধারণ করে, যে তোমাতে মহৎ ও মহিমান্বিত।

কোন্ পাগল তোমাকে বর্জন করে নিজের বলে অর্থ ও জগতের প্রতাপে জীবনে মহিমার অন্বেষণ করছে?

যে মাথা তোমার কাছে নত করেছি, তা যেন মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে নত না হয়। আমার রক্ত-মাংসের মাথা নয়, আমার মাংসের শরীর নয়, আমার হৃদয় তোমাকে দিয়েছি। যে হৃদয় তোমার আসন হল, তাতে শয়তান কী প্রকারে কর্তৃত্ব করবে? অসত্য, অন্ধকার ও অন্যায়ের সাথে মুসলমানদের চিরজীবনের যুদ্ধ। আমি কি তোমাকে ভুলে জীবিকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করব? শয়তানি ও নিষিদ্ধ (হারামি) পথের পথিক হব? তবে আর কী নামাজ পড়লাম? জীবনভরই কি তোমার সাথে আমার প্রতারণা চলবে? আমার ভূমিষ্ঠ হবার কালে যে মহাগান তোমার ভক্তেরা আমায় শুনিয়েছে–সেই মহা আল্লাহে আকবার ধ্বনি (আল্লাই শ্রেষ্ঠ সত্য ও ন্যায়ই শ্রেষ্ঠ) আমি ভুলি নি। আমি তোমাকে জীবন ভরে সেজদা করলাম। যেন জীবনে, প্রতিদিনকার জীবনে, কার্যক্ষেত্রে মানুষের সাথে ব্যবহারে শয়তানের কাছে মাথা নত না করি।

হায় পৃথিবীতে কত মানুষ পথহারা হয়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য আমি কী করেছি? তোমার সমাচার আমি কারো কাছে বহন করি নি-ব্যর্থ আমার জীবন। শুধু নিজের মুক্তির জন্যই কেঁদেছি। কত পৌত্তলিক, কত পাপী, কত মানুষ মহাপাপে বিনাশের পথে চলেছে, তাদের জন্য আমি কিছুই করলাম না। শুধু আত্মসুখেই তৃপ্ত রইলাম, শুধু নিজেকে বাঁচাবার জন্যই ব্যস্ত রইলাম। প্রভু, আমাকে জ্ঞান দাও, শক্তি দাও, স্বাস্থ্য দাও, যৌবন দাও, রূপ দাও, ঐশ্বর্য দাও, যেন তোমার পথে যুদ্ধ করবার যোগ্য হই। আমাকে সিংহের বিক্রম দাও, যেন তোমার শত্রু যারা, তাদের হৃদয়ের রক্তপান করতে পারি। আমায় ঘৃণা দাও, যেন অধৰ্মচারী দুবৃত্তদেরকে আন্তরিক ঘৃণা করতে পারি, আমায় লজ্জা দাও, যেন পাপের পথে লজ্জা বোধ করি, আমায় আত্মমর্যাদা জ্ঞান দাও, যেন কোনোরূপে জীবনের অগৌরব না করি, আমায় সংযম দাও, যেন লোভে পড়ে পাপের পথে না হাঁটি। মিথ্যা সেবার জন্য কোমরে সোনা ও রূপা ধারণ করে আমি অপেক্ষায় দাঁড়াব না, স্বাধীন কৃষক হয়ে আমি বৈধ অন্ন খাব, পর্ণকুটিরে বাস করব, নিজ হস্তে বস্ত্র বয়ন করব, তথাপি চাকচিক্যময় পাপেভরা জীবনে মিথ্যা পদলেহন করব না। আমার ও আমার মুসলিম ভ্রাতার প্রাণে প্রেম দাও, যেন আমরা পরস্পরকে রোগে-শোকে, দুঃখে-বেদনায়, অভাব-দৈন্যে প্রেম ও সেবা করতে পারি। আমাদেরকে ঐশ্বর্য দাও, মুসলমানকে হতভাগ্য গরিব করো না, যেন দরিদ্র ভ্রাতার সেবার জন্য প্রচুর দান করতে পারি। ধিক, ধিক সেই জীবনে, যে জীবন তোমার গৌরব আকাক্ষা করে না, যে জীবনের একটি দিনও তোমাকে বর্জন করে চলে, তোমাকে ভুলে থাকে, অত্যাচারীকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা কর, সেখানে মিথ্যা ও অত্যাচার সম্মানিত হয়, ওরে অবোধ উপাসকের দল, তোমরা কী জান, সেখানে তোমাদের নামাজ সিদ্ধ হয় না। বন্ধুদের সাথে মিশে সারাদিন হেসে-খেলে সারাটা দিনই চলে গেল, একটিবারও প্রভুর কথা তোমার মনে হল না। নিজের ক্ষমতার বড়াই তোমার মনে খুব বেশি। যে মানুষের জীবন, যে জাতির জীবন ঈশ্বরবর্জিত, তারা জগতে কোন্ কাজ করতে সক্ষম? তারা জগতে কখনও শক্তির উত্তরাধিকারি হবে না, কখনও তারা মহিমান্বিত হবে না।

জীবনে ঈশ্বরের বশ্যতা চাই–ঈশ্বরের বশ্যতার অর্থ সত্য, ন্যায়, জ্ঞানের বশ্যতা। এজন্য আলখেল্লা ধারণ করবার দরকার নেই। তিলক কেটে সন্ন্যাসী সাজবারও প্রয়োজন নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো মুসলমান ধর্মের আদর্শ নয়।

সংসারে সংসারী সাজ   কর নিত্য নিজ কাজ
ভবের উন্নতি যাতে হয়।

এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ।

মহিমান্বিত জীবনের আদর্শ কী–তার নমুনা দুই-একটি মাত্র এখানে দিচ্ছি। মানুষ নিজ থেকেই বুঝতে পারে অমানুষের স্বরূপ কী, জীবনে অপবিত্রতা কী, কদর্য জীবন কী? জেনেশুনেও মানুষ জীবনে মন্দ হয়। হয়তো সমস্ত সমাজের মন অপবিত্র ও পতিত, তাই মানুষ কদর্য জীবন বরণ করতে লজ্জাবোধ করে না। ঈশ্বরের কাছে কিন্তু মানুষের পাগ সমানভাবে সমাজকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। কারণ মানুষ তাদের পাপের জন্য শুধু নিজেই দায়ী নয়। বেশ্যাকে যদি মানব সমাজ না চাইত, তবে কি নারী এই মহাপাপের পথে হাঁটত? নারী দেখে এই পথে ধিক্কার নেই, অভাব নেই, লজ্জা নেই, মানুষ তাকে এইভাবে চায়। তা হলে তার আর একার দোষ কী? বেশ্যা জীবনের লজ্জা তাকে অন্তজ্বালা দেবে কেন? সে তত বেশ থাকে!

এক আমলা দরিদ্রের সন্তান–তার এক বিঘা জমি বলতে ছিল না। সে চাকরি পেয়ে জীবনে কঠিন পাপ ও অন্যায়ের সেবা করে বড় মানুষ হয়েছে। সেজন্য মানুষ তাকে প্রশংসাই করে, তার বুদ্ধির প্রশংসা করে–তা হলে তার পাপের জন্য শুধু সেই কি দায়ী?

আমাদের জাতির জীবন এবং মানসিকতা কদর্য হয়েছে। তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও কদর্য। জীবনের মহিমা কীসে হয়–একথা কেউ তাকে শোনায় নি। কার্যক্ষেত্রে মানুষের জীবন মন্দ বলে সে জানতেও চায় না।

মহিমান্বিত জীবনের সমস্ত আদর্শের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। উচ্চ মহাজীবনের ধারণা মানুষ করতে শিখলে, জাতির চিন্তাধারা বদলাতে জাতির ভিতর মহৎ চরিত্রের আবির্ভাব হবে। মানুষ সবই জানে, সবই বুঝে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার চাপে সে পশু, মূঢ় ও হীন হয়ে থাকে। কতদিন বাঙালি মুসলমান গৌরবময় জীবন সম্বন্ধে ধারণা করতে শিখবে? সমস্ত অন্তর দিয়ে জীবনে যা কিছু কদর্য ও হীন তাতে লজ্জা বোধ করবে? নিজের

শক্তিকে পশুর মতো নয়, মানুষের মতো ব্যবহার করবে? . জনৈক মূঢ় ভদ্রলোক আপন প্রাচীরবেষ্টিত বাগানে বসে আল্লাহর মহিমা অনুভব করছিলেন। এমন সময় জনৈক খ্রিষ্টান বাইরে থেকে প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। খ্রিষ্টান যুবক নতজানু হয়ে মূঢ় ভদ্রলোকের সম্মুখে পতিত হয়ে নিবেদন করল–মহাশয়, আমি বড়ই বিপদগ্রস্ত। যদিও আমি খ্রিষ্টান তবুও আমি আপনার ন্যায় মূঢ় মুসলমান আমীরের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে কিছুমাত্র সন্দেহ পোষণ করছি না। আমি আপনার আশ্রিত। আশ্রিতকে রক্ষা করে মহত্ত্বের পরিচয় দিন। আমি এইমাত্র জনৈক মুসলমান যুবককে হত্যা করেছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে ধরে এখনই শক্তহস্তে অর্পণ করতে পারেন। ইচ্ছা করলে জীবন রক্ষা করতেও পারেন। আমার বাঁচবার কোনো উপায় ছিল না, সে জন্য আপনার এ বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।

মূঢ় ভদ্রলোক বলেন, তোমার কোনো ভয় নেই। যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, ততক্ষণ তোমার শরীরে কেউ সামান্য আঘাতও করতে পারবে না। মুসলমানের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা সম্ভব নয়।

যুবক হৃষ্টচিত্তে এক গুপ্তঘরে আবদ্ধ রইল। ইত্যবসরে বাইরে কাঁদের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা গেল। যুবককে সেই স্থানে নিরাপদে থাকতে বলে ভদ্রলোক সদর দরজায় এসে দেখলেন, যে যুবককে তিনি এইমাত্র আশ্রয় দিয়েছেন সে তারই একমাত্র যুবক পুত্রকে হত্যা করে এসেছে। ভদ্রলোকের ললাট শোকে মলিন হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কাউকেও কিছু বললেন না। গভীর রাত্রিতে সেই জ্বলোক আশ্রিত যুবকের নিকট এসে বল্লেন,-বন্ধু তোমাকে আমি আমার আস্তাবলের সর্বাপেক্ষা বলবান অশ্বটি এবং একখানি তরবারি দিচ্ছি। যে যুবককে তুমি গত সন্ধ্যায় হত্যা করেছ, সে আমারই পুত্র। কী জানি, পিতার মন যদি দুর্বল হয়, এজন্য আত্মরক্ষার্থে তোমাকে অশ্ব ও তরবারি দিলাম। তুমি সত্বর এই স্থান হতে পলায়ন কর।

খ্রিষ্টান যুবক তনুহূর্তে তরবারিখানি নিয়ে সেই অশ্বপৃষ্ঠেই পলায়ন করল। এই মহত্ত্ব–এর কি তুলনা আছে? মানব-সমাজে এর মূল্য কত বেশি! এটা কি মহান আদর্শ! কতবড় মহাপ্রাণ এই মূঢ় ভদ্রলোকের। এই ক্ষমাশীলতা, এই ক্রোধসংযম, এই প্রেম–স্বর্গীয়। শত্রুর প্রতি এতদৃশ্য ব্যবহার কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব হয় কি?

মহিমায় জীবন-জগতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় মানব হৃদয়ে বিস্ময় ও আনন্দ উৎপাদন করে।

একদা জনৈক সেনাপতি তার সৈন্যগণের রসদ সংগ্রহের জন্য এক পল্লীতে এসে এক কৃষকের দরজায় আঘাত করলেন। কৃষক দরজা খুলে দেখল, সেনাপতি তার দুয়ারে দণ্ডায়মান। কৃষক সেনাপতিকে আসন গ্রহণ করতে বলে তার এতদৃশ আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সেনাপতি বল্লেন–হে কৃষক! আমার সৈন্যদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। কোনো ভালো শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে দাও আমাকে। ক্ষেতের শস্য আমরা কেটে নেব।

বলাবাহুল্য সৈন্যরা যে সব খাদ্য সংগ্রহ করে, তা জোর করেই নেয়। সেজন্য মালিককে কোনো দাম তারা দেয় না। জাতির মহাবিপদকালে নাকি বিনামূল্যে লুট করে নিলে কোনো দোষ হয় না।

বৃদ্ধ কৃষক বল্লেন–”আসুন আমার সঙ্গে” এই কথা বলে কৃষক সেনাপতি আর তার সৈন্যগণকে নিয়ে এক মাঠের ভিতর দিয়ে চলতে লাগলেন। পথে বহু উত্তম শস্যের ক্ষেত। দেখা গেল কিন্তু কৃষক সেসব ক্ষেত উপেক্ষা করে দূরে একখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখিয়ে বল্লেন; এই ক্ষেত থেকে আপনার শস্য সংগ্রহ করুন। সেনাপতি সেই ক্ষেত থেকে সমস্ত ফসল কেটে নিতে আপন সৈন্যগণকে আদেশ দিলেন। তারা কৃষককে জিজ্ঞেস করলেন–এর আগেও কয়েকখানি উত্তম শস্যের ক্ষেত দেখলাম। সেগুলি বাদ দিয়ে তুমি এ পর্যন্ত আমাদিগকে ডেকে আনলে কেন? কৃষক বলেন, সেনাপতি, সেগুলো আমার নিজের ক্ষেত নয়, এইটা আমার নিজের ক্ষেত।

সেনাপতি কৃষকের মনুষ্যত্বে চমৎকৃত হয়ে তাকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। বল্লেন, যে দেশে এমন মহানুভব কৃষক বাস করেন, তাদের পরাজয় কখনও হবে না। মনুষ্য জীবনের এইসব মহত্ত্বপূর্ণ পরিচয় বাস্তবিকই প্রাণকে মুগ্ধ ও আনন্দিত করে। মানুষ সাধারণত নীচ, নিজের কাজের চিন্তায় সে বেশি পাগল। যখন সে পরের কথা ভাবে অপরের সুখের পথে সে আঘাত করে না, তখন সে দেবতা।

আমি আশা করি, মনুষ্যত্ব জয়যুক্ত হোক। মানুষের মনে উন্নত মহাজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগুক। সে নিজের এবং পরের হীনতাকে ঘৃণা করতে শিখুক। মানুষ যেন তার নির্মম পেষণে দুঃখ পেয়ে খোদাতালার কাছে ফরিয়াদ না জানায়।

মানুষকে কোনো রকমে দুঃখ দিও না, জীবনকে মহাগৌরবের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা কর। মানুষ তো অনেকেই জগতে জন্মে। যারা হীন কুকুরের জীবন জগতে কাটিয়ে গেল, যারা অত্যাচারে জগতের বুকে হাহাকার ধ্বনি জাগিয়ে গেল, তাদের শেষ মাটি, আর যারা দরিদ্র, অশ্রু পূজাই যাদের জীবনের শেষ পূজা, দরিদ্র, অবহেলিত, অপমানিত–তাদেরও শেষ মাটি।

এই পৃথিবীই আমাদের শেষ নয়। মানুষের জন্য এক মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ আছে–যেখানে আমাদের জীবনের অবস্থা আমাদের কৃতকর্মের ফল অনুসারেই হবে।

জেনোয়াতে (Genoa) যখন গণ-শাসনতন্ত্র একটি সামান্য বণিকের সন্তান একটি গৃহস্থ ঘরের যুবকের হাতে এল, তখন জেনোয়ার ধনী ও কুলীন সম্প্রদায় মর্মে মর্মে চটে গেলেন। উবাটো (Uberto) নামক জনৈক যুবক আপন স্বভাবের অমায়িকতা, মহত্ত্ব ও আত্মশক্তিতে দেশের সমস্ত ক্ষমতা অধিকার করলেন। .

কিন্তু এ কর্তৃত্ব বেশি দিন তিনি করতে পারলেন না। দেশের আমীর সম্প্রদায় এই নীচ নিম্নশ্রেণীর লোকটার কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারলেন না। তারা সত্বরই সংঘবদ্ধ হয়ে উবার্টো (Uberto)-কে দূরদেশে নির্বাসিত করলেন। তার প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হতো, কিন্তু নগরের বিচারক এডর্নো (ইমরভম) দয়া করে তাকে মাত্র নির্বাসন দণ্ড দিলেন।

উবার্টো (Uberto) আপন দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে বিদেশে বহু বৎসর আপন প্রিয়জন বিচ্ছেদ দুঃখের মর্মযাতনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন। কিন্তু বিদেশেও আপন মহৎ স্বভাবের গুণে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ধনী বলে পরিগণিত হলেন। পরিশ্রম, সৎ-সাহস, সততা, মহত্ত্ব এসব গুণই মানব জীবনকে সর্ব অবস্থায় উন্নত করে। উবার্টের অর্থাভাব নেই, কিন্তু স্বদেশের বিরহ যাতনা সদাই তার বুকে লেগে থাকত। একদিন বিদেশে টিউনিস (Tunis) নগরে হঠাৎ তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ এক যুবককে দেখতে পেলেন। যুবককে সদ্বংশজাত বলে মনে হল। কুলির কঠিন জীবন তাকে বহন করতে হচ্ছে। কাছে যেয়ে অনুসন্ধানে জানতে পারলেন–যুবক জেনোয়া শহরের প্রধান বিচারপতি এডর্নোর (Adorno) সন্তান। বন্দি হয়ে দাসরূপে বিক্রিত হয়ে বর্তমানে এই কঠিন দুঃখের জীবন যাপন করছে। এডর্নো!–যিনি পদ ও বংশ মর্যাদার গর্বে দরিদ্র নীচ বংশের উবার্টোকে চিরনির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন, সেই এডর্নোর পুত্রের এই দুরবস্থা! এই অপমানের জীবন! উবার্টো যুবকের মালিককে বহু মিলিয়ন (Million) ক্রাউন মূল্য দিয়ে যুবককে উদ্ধার করলেন। যুবক এই অপরিচিত ব্যক্তির মহানুভবতায় অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি উবার্টোর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। উবার্টো বল্লেন, আপনাকে শীঘ্র দেশে পাঠাবো। আপনার পিতার কাছে আমার পরিচয় পাবেন। কিছুদিনের মধ্যে বহু উপঢৌকন সহ উবোটো নিজ জীবনের পরম শত্রু পুত্রকে স্বদেশে পাঠিয়ে দিলেন। এডনো বহুঁকাল পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পুত্রকে পেয়ে হাতে স্বর্গ পেলেন। উবার্টোর পরিচয় তিনি পুত্রের কাছে পেয়ে তার গত কৃতকর্মের জন্য বহু অনুশোচনা করলেন। এবং দেশে বহু আন্দোলন করে উবার্টোকে দেশে ফিরিয়ে আনবার পূর্ব আদেশ প্রত্যাহার করলেন। মহিমার কাছে বংশ গৌরবের কোনো মূল্য নেই। বংশ গৌরবের অর্থ দাম্ভিকতা, অত্যাচার, অপ্রেম ও . নিষ্ঠুরতা–তা অহঙ্কারের মতো মানুষের হৃদয়কে তাপিত করে তা কখনও দরিদ্র, পতিত ও মূঢ়কে স্বর্গের আলো দেখাতে সমর্থ নয়। যে আপনাকে ভুলেছে, জীবনের বা বংশের গৌরব-গর্ব যার প্রাণে স্বপ্নেও জাগে না, সেই জগতে আদর্শ মহাপুরুষ হয়ে মানুষের অন্তরকে স্বর্গের অমৃতধারায় অভিষিক্ত করে দুর্বলকে পথ দেখায়, দুঃখীকে সান্ত্বনা দেয়, পতিতকে উন্নত করে, অপরিচিতকে পরম আত্মীয় করে।

মানুষ অহঙ্কারকে ভালবাসে না, যা অগ্নির ন্যায় দূর হতে সুন্দর দেখায় সুশীতল বারির মতো তা তৃষিত, তাপিত মানুষের জীবন ঠাণ্ডা সরস করে না। আমরা চাই দরিদ্রের আদর্শ-মহামহিমার জীবন।

“হে প্রভু, কাফেরদিগের উপর আমাদিগকে কর্তৃত্ব দাও।” (কোরান) যারা কদাচারী, নীচ, ধর্মহীন, বিধর্মী, তাদের কাছে নত হবার মতো লজ্জা আর নেই। যারা জ্ঞানে, দৃষ্টিতে হীন এবং সঙ্কীর্ণ, তাদের কাছে জ্ঞানীর মতো দৃষ্টি মানুষের মনে শোক সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও সত্যের স্বাধীনতা চাই, সম্মান চাই। মানুষ কি কখনও অমানুষের জুতা বহন করতে পারে? কখনও না–তার আগে তার মৃত্যুই ভালো।

ক্ষমতা অধিকারের যোগ্য কে? যে জ্ঞানী, যে মানুষ, যে সাধু, যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। প্রতাপের রাজা কে?–যে ঈশ্বরের পতাকা বহন করে। জগতের ধন-সম্পদের অধিকারী কে হবে? যে ঈশ্বরের শক্তিতে বলবান, সেই। হিন্দু-চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ নমস্য চিত্র মা আদ্যাশক্তির দুই কন্যা-লক্ষ্মী (ধনৈশ্বর্য) আর সরস্বতী (জ্ঞান)।

সর্ব দুঃখ সয়ে যাও, প্রভুর পতাকাই ধরে থাক; তথাপি অসত্যের কাছে, মিথ্যার কাছে। ভয় পেয়ে ধৈর্যহীন হয়ে পতাকা ফেলে দিয়ে পালিও না। সব দুঃখ সহ্য করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। জয়ের দিন আসবে। মহাজীবনের মহিমা জাগবে। এইভাবে তো মহিমার। জয় হয়।

.

০৩. মহামানুষ

নিজে মহামানুষ হতে ইচ্ছা করি নে। সে তো দুরাশা। এ যুগের মুসলমান সমাজের কাউকেও মহামানুষ হতে বলি না। কারণ তা অসম্ভব। শুধু মহাজীবনের অনুভূতিকে, মহাজীবনের হৃদয়তলে কোন চিন্তাধারা সদা জাগ্রত থাকে, মহাজীবনের স্বাদ কী, সেটুকু জানাতে ও জানতে চাই। যদি কোনোদিন কোনো যুবকের মনের সম্মুখে মহাজীবনের স্বর্গ দ্বার খুলে যায়, সেই দিন সে অজানিতের প্রেরণায় জাগবে, নামের জন্য নয়, কর্তব্যের আহ্বানে মহাচেতনা লাভ করে মহাকাজের আহ্বানে সে ছুটে চলবে। সে তো নিজের শক্তিতে হবে না, নিজের ইচ্ছাতেও না।

মহামানুষ কারা? যারা ঈশ্বরের বাণী লাভ করে জগতের মেষদলকে ঈশ্বরের বাণী শুনিয়েছেন। সত্যের জন্য বলি হয়েছেন, দুঃখ সয়েছেন, তারাই মহামানুষ। এতদ্ভিন্ন আর কে মহামানুষ। আর কে মহামানুষ হতে পারে? এরূপ আকাক্ষা করাও পাপ। কারণ জীবনে নামের জন্য, যশের জন্য মানুষের কোনো সাধনা সিদ্ধ নয়। মানুষ কর্তব্য করবে, ঈশ্বরের আদেশ শিরে বয়ে জীবনের পথে চলবে–তাতে তার জীবনের আসন যেখানে হয় হোক, বড় এবং ছোট হওয়ায় তার কী আসে যায়! আমরা ক্ষুদ্র, সামান্য মাটির মানুষ। জীবনের দিনগুলো সাধুকার্যে যদি রঙিন করে তুলতে পারি যদি বাতুলের ন্যায় মানুষের সঙ্গে আলাপে প্রলাপ বকে সময় নষ্ট না করি, সামান্য কিছু অর্থলাভ করেই দাম্ভিক সেজে না বসি–তাই-ই আমাদের পক্ষে মহাজীবন। দোকান ঘরে অংশীদার বন্ধুর আগোচরে যদি একটি পয়সাও না লই, লজ্জা ত্যাগ করে সেবা ও সত্যের জন্য যদি পথের মজুর সাজতে কুণ্ঠাবোধ না করি, বৃদ্ধ, রুগ্ন পিতা-মাতার জীবনে যদি আনন্দ দিতে পারি, তাই আমাদের পক্ষে মহাজীবন। যদি চাকরি করে প্রত্যহ ঘুষের লোভ সংবরণ করতে পারি, প্রতিবেশীর দুঃখ বেদনায়, তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করি, জীবনে অশিক্ষিত ও মূঢ় চিত্ত থাকতে লজ্জাবোধ করি–তাই-ই আমার পক্ষে যথেষ্ট গৌরবের জীবন। পৃথিবীকে ওলট-পালট করবার সাধনা আমার না, নোবেল পুরস্কার পাবার আশাও আমি করি না; যৌবনগর্বে যদি জিহ্বাকে সংযত রেখে মূল্যহীন-কুতর্ক হতে রক্ষা করতে পারি, দরিদ্র ইতর লোকদের সন্তানগণকে আপন অজানিত অবজ্ঞার জীবনে, জীবনের গান শোনাতে পারি, তাদেরকে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার আলো দান করতে পারি–সেটাই আমার পক্ষে মহাজীবন।

আমি মূল্যবান পোশাক চাই না, অট্টালিকা-কোঠাবাড়ি চাই না; শুধু সহজ জীবনে শান্ত নির্বিকার দৈনন্দিন আনন্দে জীবনকে সুরভিত করে তুলতে চাই–দেশের মানুষকে প্রিয়তম জ্ঞান করতে চাই–আপন দেশ ও স্বাধীনতাকে ভালবাসতে চাই–উদ্ধত, গর্বিত, অত্যাচারী, স্বাধীনতা অপহরণকারী দুবৃত্ত শত্রু-গুধারী নামাজিকে পদাঘাত করতে চাই–এটাই আমার জন্য গর্বের জীবন।

নারীর সম্মান যেন আমার জন্য ক্ষুণ্ণ না হয় নারীকে যারা বিপথে নেয় তাদের রক্ত আমি পান করতে চাই। জীবনে মিথ্যা চাই না, প্রতারণা চাই না, প্রবঞ্চনাও ভালবাসি না, প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষা করতে চাই। আমি ধনী হতে চাই নে। যা প্রয়োজন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোক হতে চাই নে, সচ্ছল অবস্থায় কৃষক হতে চাই, এটাই আমার জন্য মহাজীবন। কামুকতা চরিতার্থ করবার জন্য বিবাহ করতে চাই নে, তা তো পশুতেও করে। আমি শুকর, না বৃষ? আমার স্ত্রী আমার মানস-স্বর্গের দেবী হবে। আমার গৃহ ঋষির আশ্রম। আমার পুত্র-কন্যারা হবে দেব-শিশু। আমার স্ত্রী জীবনে কখনও কঠিন কথা বলবে না–সেই হবে আমার পার্থিব জীবনের স্বর্গ। এটাই আমার জন্য মহাজীবন।

যে মাথা মহাসত্যকে পূজা করেছে, প্রণাম করেছে, তা দাসের হীন স্বার্থে অন্য কাউকেও শ্রদ্ধা জানাবে না, অথচ সেবায় আমি মাটি অপেক্ষা ছোট হবো, -,নুষের পদধূলি মাথায় নিয়ে ধন্য হবো, এটাই আমার মহাজীবনের ধারণা। আমি দরিদ্রকে উপেক্ষা করে ডেপুটি বাবুর সঙ্গে হেসে মিশে জীবনের মান বাড়াতে চাই নে। আমি আকাশে উঠতে চাইনে, বাতাসে উড়তে চাই নে। সাগর সেচতেও চাই নে। গিরিশীর্ষ ধরে আছাড় মারতেও চাই নে–অতবড় কাজ আমার দ্বারা হবে না! আমি নিজ জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে আমার দীন জীবনের শান্ত আলো ছড়াতে চাই। তাই আমার জন্যে মহাজীবন।

.

০৪. যুদ্ধ

সর্বনাশ! এভাবে মানুষকে মানুষ হত্যা করতে কে শিক্ষা দিয়েছে? আমি ভাববাদী নই, মহামানুষও নই–তথাপি প্রাণ আমার কেঁদে জিজ্ঞেস করেছে–মানুষ এত নিষ্ঠুর হল কী প্রকারে? তোমরা জীবনে কোনো না কোনো ধর্ম মান নিশ্চয়ই। এই কী তার পরিচয়? আমি বলি, তোমাদের কোনো ধর্ম নেই। সবই যেন তোমাদের পাগলের খেলা। জাত এ কি ঈশ্বরের ব্যবস্থা? হায়, হয়তো ছোঁয়াছুঁয়ি তোমাদের ধর্ম। প্রেম তোমাদের জন্য নেই। পোশাক, গীর্জা ও মসজিদই তোমাদের ধর্ম। প্রেম তোমাদের ধর্ম নয়। হায়, তোমাদের প্রাণে দরদ কই, মানুষের জন্য মমতা কই?

দিনের মধ্যে শতবার অজু করছ যাতে শুদ্ধ ও পবিত্র হতে পার। স্নান করছ, যাতে পাপ ধৌত হয়। কতবার ভগবান-ভগবান, (Lord-Lord) আল্লা-আল্লা করছ, এতেই কী ঈশ্বর তুষ্ট হন? আলখেল্লা পরা ধার্মিকগণ! সারা রাত উপাসনা করছ–প্রাণে কিন্তু দরদ নেই, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠা নেই। বাঃ বেশ তোমাদের ধর্ম! সন্ধ্যায় কুকুরের মতো ক্রোধে মানুষের বুকের মাংস খেতে উদ্যত হচ্ছ! তোমরা সত্যই ধার্মিক। হায়! দরদহীন, প্রেমহীন, মমতাহীন ধর্ম!

উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ মানুষকে মারাত্মক ভীষণ অস্ত্র ত্যাগ করতে বল্লে কে তা আর শোনে? একটা মানুষকে শান্ত করা যায় না, জগৎকে কী করে বুঝান যাবে? যুদ্ধে সঙ্গীন, বন্দুক, কামান, তীর, গ্যাস, বর্শা এসব ব্যবহার বড়ই নিষ্ঠুরতা। মানুষ এত নিষ্ঠুর, তার প্রাণে দরদের এত অভাব যে তারা উত্তেজিত পশুর মতো অতি নিষ্ঠুরভাবে তার ভ্রাতাকে হত্যা করে।

প্রাচীনকালে মানুষ নিজ নিজ শরীরের শক্তি দ্বারা শত্রুকে পরাজিত করতে চেষ্টা করতো। যুদ্ধে তরবারি এবং মুগ্ধার ছাড়া আর কোনো কিছু ব্যবহার করা মহাপাপ। মানবপ্রাণে দরদই যদি না জাগল, ভ্রাতাকে দুঃখ দিতে যদি তার অন্তরে মমতাই না হল, তবে আর সে জগতে ধর্মের মানে কি আর পালন করে? এরই নাম কি মানব সভ্যতা? কার শরীরে কতখানি শক্তি আছে, সম্মুখ সময়ে তারই পরীক্ষা হোক। তিন ক্রোশ দূর থেকে কামান দেগে মানুষকে হত্যা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। দূর থেকে মানুষের বুকে তীর ছোঁড়া, সঙ্গীন দিয়ে তার বুক ফেঁড়া, গুলি করে তার হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করা হয়, কতখানি নির্মমতা! কীসের জন্য মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়? মানুষ জীবনে কদিন বাঁচে। মানুষের মধ্যে শক্তির পরীক্ষা হোক, তার শৌর্য-বীর্যের পরীক্ষা হোক, হাতাহাতি-ধাক্কাধাক্কি লাঠালাঠি হোক। নিষ্ঠুর যুদ্ধ কেন?

মানুষ মানুষের বুকে কীভাবে সঙ্গীন চালিয়ে দেয়–ও দৃশ্য আমি দেখতে পারি নে, সহ্য করতেও পারি নে, ভাবতেও পারি নে। থাক তোমাদের রাজত্ব আমার জীবনের সঞ্চিত। সমস্ত ধন তুমি নিয়ে যাও, তথাপি তোমার বুকে আমি বর্শা চালাতে পারবো না।

মানুষ হত্যা কী পাপ নয়? আত্মরক্ষার জন্যে মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করুক, মানুষের মতো মনে দরদ দিয়ে সে যুদ্ধ করুক। হায়, মানুষ মানুষকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে! এমন জঘন্যভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ হয়!। আমার সঙ্গে কুস্তি কর, দেখি তোমার কেমন শিক্ষা, কেমন তোমার গায়ে বল? দূর থেকে চোরের মতো আমার হৃদয়ে গুলীবিদ্ধ করে তোমার কী আনন্দ? তুমি কি মানুষ? তোমার কি মৃত্যু নেই। তোমার কাজের কি কোনো কৈফিয়ৎ নেই? এই কামান-বন্দুকের ব্যবহার কতদিন থেকে শিখেছ? মহাপুরুষ বুদ্ধদেব তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত পাখিকে কোলে করে কেঁদেছিলেন। আর তোমরা মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পর্যন্ত ফেল না। আমাকে ফাসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মার, কুঠার দিয়ে আমার মাথা কেটে ফেল, শুধু নিষ্ঠুর বর্বরের মতো যাতনা দিয়ে, অপরিসীম দুঃখ দিয়ে মের না।

যিশুখ্রিষ্টকে কতবার তোমরা ক্রুশকাষ্ঠে ঝুলাবে? খ্রিষ্টের রক্তাক্ত দেহ, তার যাতনাক্লিষ্ট মুখ দেখে কি তোমাদের মায়া হয় না? ও দৃশ্য কি চোখে দেখা যায়? হায়! ধর্মহীন মানুষ!

যারা এত অধার্মিক, তারাই জগতে কর্তৃত্ব করবে। হাজার হাজার, কোটি কোটি মানুষ! খ্রিষ্টের মৃত্যু তোমরা চোখে দেখে শান্ত হয়ে আছ? তোমাদের ভিতর ক্রোধ জাগে না, অভিমান জাগে না?

আমি বলি তোমরা যুদ্ধনীতি বর্জন কর। সমস্ত বন্দুক, কামান, তীর, বর্শা সাগরজলে ফেলে দাও। যারা শুনবে না পৃথিবীর সমস্ত ঈশ্বরের মানুষ, সর্ব জাতির শান্তিকামী মানুষ মিলিত হয়ে সেই মনুষ্যহন্তা অত্যাচারী মনুষ্য দলের সঙ্গে সত্যাগ্রহ কর। তাদের সঙ্গে কারও কোনো সংশ্রব নেই; এইভাবে আমরা ঈশ্বরের রাজ্য স্থান করি। শয়তানের অনুচরেরা যারা নিষ্ঠুর ঈশ্বরবিদ্রোহী, তারাই কি জগতের ক্ষমতার অধিকারী হবে? কার কথায়, কোন লাভে, কার স্বার্থে, কার আদেশে তোমরা দলে দলে যেয়ে ভ্রাতার বক্ষভেদ কর, নিজের বক্ষ বিদ্ধ হতে দাও? ও পাপের জন্য দায়ী কে? এই মনুষ্য হত্যার জন্য তোমরা জগতে কি রাজত্ব পেয়ে থাক? যারা তোমাদেরকে যুদ্ধ হানাহানি করতে বলে, তারা তো সুখেই ঘরে বসে থাকে। মর তোমরা শুধু। বিভিন্ন দেশের মানুষ আপন ইচ্ছামত যার যেখানে ইচ্ছা, বাস করুক। কেন মারামারি হয়? আর যদি মারামারি হয় তবে কি অমন নির্মম মারামারি! সম্মুখ সমরে প্রবৃত্ত হও। কেন মেঘের ভিতর থেকে মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে দশ মাইল দূর থেকে বাণ নিক্ষেপ কর? বাণ যখন শত্রুর দেহ বিদ্ধ করে, তখন তার কত যন্ত্রণা হয়, তা কি একটুও ভাবতে পার না? কীভাবে মানুষকে অত ব্যথা দিয়ে তোমরা বেঁচে থাক? কুঠার দিয়ে কাছে এসে বরং এক আঘাতে তার শির দেহ হতে বিভক্ত করে ফেল।

একজনের দোষে নয়, পরস্পরের দোষে জগতে-যুদ্ধ, নৃশংসতা ও ভীষণতা বেড়ে গেছে। একজন যদি যুদ্ধে নৃশংস বধের পন্থা অবলম্বন করে, আত্মরক্ষার জন্যে আমাকেও তেমনি করতে হয়। এইভাবে মানব সমাজে মহাপাপ আসন পেতে বসেছে। যে ভালো সেও মন্দ ও বর্বর হয়েছে। বরং যথাসম্ভব ক্ষতি স্বীকার করতত্রাচ নৃশংস আচরণ করো না। দেশে দেশে মানুষ সমস্ত ভীষণ যুদ্ধাস্ত্র তৈরি বন্ধ করে দিক, তা হলেই জগতে বর্বরতার অবসান হবে। যুদ্ধে নৃশংস আচরণের শেষ হবে।

দস্যু ও শয়তানের বুকে দানব রাজত্ব করে, যেখানে দয়া-মমতার নাম-গন্ধ নেই। তাদেরকে দমন করতে হলে হত্যা করতে হয়। তারা যেমন অস্ত্র ব্যবহার করে, আমাদেরকেও তার চেয়ে ভীষণ অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়।

এভাবেই জগতে পাপ বেড়েছে। প্রাচীনকালের মানুষ, যাদের কোনো ধর্ম ছিল না, কিংবা পশু দুরাত্মাদের মধ্যে এমন হতে পারে–সত্য মানুষ, যাঁরা যিশু, আব্রাহাম, বুদ্ধ, মুহাম্মদের শিষ্য, তাদের মধ্যেও কি পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে তেমনি হবে?

আগে বাংলাদেশের নদী-নালা দস্যুতে ভর্তি ছিল। মানুষের জীবন, ধনরত্ন নিরাপদ ছিল না। দস্যুরা নিরীহ পথিকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করত। একবার বরিশালের এক নদীতে এক ভদ্রলোক তাঁর পত্নীসহ নৌকায় কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারে একদল দস্যু এসে তাদেরকে আক্রমণ করল। ধনরত্ন তো নিলই, ভদ্রলোকটিকে নদীগর্ভে ফেলে দিল। নারীর ক্রন্দনে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে তার মাথা কুঠার দিয়ে দুভাগ করে ফেল্ল। গহনাগুলো জীবিত অবস্থায় নাক-কান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিল। হাত-পা’র গহনা খুলতে টানাটানি না করে হাত-পা কেটে ফেল্ল। খুলে দেবার দেরি সহ্য করল না। এমনই নির্মম পিশাচ এরা। এদেরকে দমন করবার জন্যে অস্ত্র আবশ্যক। দুষ্টের দমনের জন্যে অস্ত্রের প্রয়োজন হবেই। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগীজ দস্যুর অত্যাচার-কাহিনী সর্বজনবিদিত। মুসলমান সেনাপতিরা এদেরকে সমূলে দমন করেন। মানুষকে শান্তি দাও, নিষ্ঠুরের মতো নয়–বর্বরের মতো নয়। যারা জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র ধারণ করেন–তাঁরা মহাপুরুষ। গত জার্মান যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদলের করাচী হতে পল্টনে যোগ দিবার সময় কম্যান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ. এল. ব্যারেট সৈন্যদলের মাঝে বক্তৃতায় বলেছিলেন–সিপাহী লোককা য্যায়সা ইজ্জত হ্যাঁয়, এ্যায়সা আওর কিসিকা নেহি হ্যাঁয়। অর্থাৎ জগতে সৈনিকের যেমন মর্যাদা, এমন আর কারো নয়। একথা সত্যি। লেখক কয়েক বছর আগে ‘মোস্লেম ভারতে’ লিখেছিলেন : সৈনিকের মর্যাদার কথা। দুর্বলকে দানবের অত্যাচার লীলা হতে বাঁচাতে, বিশ্বের কল্যাণ স্থাপনের জন্য যে আপন প্রাণ দেয়, সে কী সহজ? সে নমস্য, সে নমস্য, সে নমস্য। কতকাল আগে অবজ্ঞা, অসম্মানিত অবস্থায় এক সৈনিক আপন বুকের রক্ত দিয়ে মাটি রঞ্জিত করেছিল–আজ তিনশত বছর পরে সেই রক্তধারা ফুল হয়ে আমার বিছানার চারপাশে পড়ে আছে।

বড়ই দুঃখের বিষয়, ভারি বেদনার কথা, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে, মানব কল্যাণের নামে অস্ত্র ধারণ করেছে–তারা যদি ঘুষ খায়, চরিত্রহীন হয়, দুর্বল, নিরপরাধীর উপর অত্যাচার করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে। দেশের অনেক কর্মচারী সম্বন্ধে সাধারণের মধ্যে নানা অপবাদ শোনা যায়। যারা জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পবিত্র নামে আপন কার্যের অবমাননা করে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। যারা হবে বেশি ভালো, তারাই যদি হয় অধিক মন্দ, তবে আর সে অবস্থায় মীমাংসা কী? ফরাসি সেনাপতি বেয়ার্ড আদর্শ সেনাপতি ছিলেন। তিনি মহাপ্রাণ, নিষ্পাপ এবং মহামানুষ ছিলেন। তিনি নির্ভীক, দোষশূন্য ছিলেন। অবিচার তাঁর কাছে ছিল না। যোদ্ধা হলেও তাঁর হৃদয় ছিল দয়ার আঁধার। তিনি সত্য ছাড়া মিথ্যা জানতেন না। দুঃখ-বিপদ যত হত, তার সাহসও তত বেশি বাড়ত। বড়লোককে তিনি ঘৃণা করতেন, যদি তারা সজ্জন না হতেন। তিনি সমস্ত অর্থ দরিদ্রদের মধ্যে দান করে দিতেন। তিনি সর্বদা গোপনে এবং নিরহঙ্কারচিত্তে প্রতিবেশীদেরকে সাহায্য করতেন। তিনি শত শত নিঃসহায় বালিকাকে মাসিক বৃত্তিদান করতেন। বিধবারা কখনও তাঁর সাহায্য হতে বঞ্চিত হত না।

কত সাদা কাপড়পরা ভদ্রলোক নির্মমভাবে দরিদ্রের অভাব দেখলে সেখান থেকে সরে যান, বেয়ার্ড তাদেরকে সাহায্য করা কর্তব্য বলে মনে করতেন। তিনি অধীনস্থদেরকে অতিশয় স্নেহের চোখে দেখতেন। বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, পীড়িতকে ঔষধ দেওয়া, ঋণীর ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া ছিল তার স্বভাব। তিনি প্রশংসা তোষামোদ ঘৃণা করতেন। বাল্যকালে যে-সব মহৎ গুণ তার চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছিল, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আরও বেড়েছিল। অনেক সময় দেখা যায়, যুবক বয়সে মহৎ ও সাধু থাকে, শেষে তারাই নিষ্ঠুর এবং অসাধু হয়ে উঠে। ডিউক অব ওয়েলিংটনও আদর্শ সেনাপতি ছিলেন। তিনি পরাজিত দেশবাসীর প্রতি অতিশয় দয়াপূর্ণ ব্যবহার করতেন। একবার তার সৈন্যগণ কতকগুলো কাঠ তার গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। সেনাপতির কাছে অভিযোগ করা মাত্র তিনি কড়ায় গণ্ডায় তাদের প্রাপ্ত দাম বুঝে দেন। তিনি অত্যাচারকে আন্তরিক ভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি ঘুষ গ্রহণ করা অতিশয় হীন কাজ বলে মনে করতেন। তার হৃদয় দয়ার সাগর ছিল। একবার যুদ্ধে যখন তাঁকে মৃতের সংখ্যার তালিকা দেওয়া হয়, তখন তিনি বালকের ন্যায় শোকে ক্রন্দন করেন। এই দয়ার সাগর সেনাপতি ক্ষমা করতে পারলে কখনও শাস্তি দিতেন না। নিম্নপদস্থদের সঙ্গে অতিশয় ভদ্র ও মধুর ব্যবহার করতেন। যুদ্ধে লুণ্ঠন-কার্যকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন! আহত সৈন্যদের রক্ষার জন্য তাঁর আন্তরিকতা ছিল অসীম-স্বজাতি, বিদেশী যেই সে হোক।

অন্যেরা যাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে এসেছে তিনি তাকে কুড়িয়ে এনেছেন। নেপোলিয়নের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ করতে যেয়ে তিনি বলেন–সেনাপতি জল্লাদ নয়। নেপোলিয়ন কিন্তু মৃত্যুকালে, ডিউককে যে ব্যক্তি হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল, তাকে দশহাজার ফ্রাঙ্ক পুরস্কার দিয়ে যান। এই ব্যক্তিও সৈনিক, কিন্তু দুজনের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান। প্রাচীনকালে বর্বর গথ এবং জার্মানের হন জাতি.ল্যাটিন সভ্যতা ধ্বংস করেছিল–আগুন, রক্ত, ধূম, হাহাকার ক্রন্দন তাদের গমন পথকে কলঙ্কিত করেছিল। এরা হচ্ছে আল্লাহর গজব। আল্লাহর অভিশাপ হয়ে এরা জগতে রক্তস্নাত করেছে।

আলেকজান্ডার প্রাচীন সিনিসিয়ার রাজধানী টায়ার ধ্বংস করতে গিয়ে রাজপথসমূহে রক্তের নদী সৃষ্টি করেছিলেন। আলেকজান্ডার, চেঙ্গীস খ, হালাকু খাঁ, সুলতান মাহমুদ, নাদিরশাহ্ পবিত্র তরবারির অপমান করেছেন। অনন্ত মানুষের বুকে আগুন জ্বেলে এরা। জগতে রক্তনদী সৃষ্টি করে আনন্দ পেয়েছে। এরা সেনাপতি, না দস্যু?

তরবারি ধারণ করবার যোগ্যতা কার আছে?–যিনি মহাজন, যিনি প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ, যিনি মানুষের রক্ষাকর্তা–বন্ধু, যিনি দুর্বলের বল, মানব জাতির পরম হিতাকাক্ষী, সহায়।

.

০৫. স্বাধীন গ্রাম্যজীবন

রোমান সেনাপতি সিন-সি-নিটাস সমস্ত জগতের কাছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান জাতির কাছে আদর্শ মহাপুরুষের স্মৃতি হয়ে মানব ইতিহাসে বেঁচে আছে।

চাকরি ছাড়া মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়–এ ধারণা বাঙালি মুসলমান ছাড়া আর · কারো নেই। ইসলাম ধর্মের প্রথম বিশ্বাস মন্ত্র (কলেমা শাহাদাত) মানুষের জীবনে কতখানি স্বাধীনতার ভক্ত করেছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ বাঙালি মুসলমান জীবনের স্বাধীনতাকে কতখানি অমর্যাদা করে, তা বলা যায় না। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মানুষের নমস্য ও ভক্তির যোগ্য নয়–এই হচ্ছে মুসলমানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস। সত্য জীবনযাপনেই যে মানুষের গৌরব বেশি, মুসলমানের সে মহাচিন্তাধারা প্রাণে আজ জাগে না, তার কারণ সে প্রকৃত মুসলমান নয়। সে নিজের ধর্মের ভাব ও রস গ্রহণ করতে পারে। না। না বুঝে সে কোরান পড়ে এবং স্বর্গের আশা করে। তার জীবনের মহৎ ভাব, গৌরবের ধারণা কোনোমতে আসে না। গ্রামের দারোগা ফকু মিয়া ছুটি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি আসেন, সাধারণকে ধরে এনে গালি দেন, অপমান করেন–তা দেখে অশিক্ষিত প্রতিবেশী মুসলমান মনে করে এই উচ্ছল প্রতাপের জীবনই হচ্ছে গৌরবের জীবন। অনেক বছর আগে কলকাতার কোনো ছাত্রাবাসে যশোহরের কোনো জাম্বিল-পরা কাজী সাহেব একদিন গল্প করছিলেন আমার বাপ-দাদা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে ধরে এনে জুতা মারেন, এমনই সম্ভ্রান্ত আমরা। আমরা মাঠে গরু-ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে শস্য নষ্ট করলে কারো সাহস হয় না প্রতিবাদ করে। জীবনের গৌরব সম্বন্ধে বাঙালি মুসলমানের ধারণা কত ছোট, তারই নমুনা মাত্র এই একটি।

চাকরি করা, অত্যাচার করা, অসাধু পথে অর্থ উপার্জন করা আমাদের বাপ-মা ভাই বোনের কাছে একমাত্র গৌরবের জীবন। সত্য স্বাধীন জীবনে আর মনুষ্যত্বেই যে মানুষের গৌরব, একথা জগতের সকল জাতিই বুঝেছেন, বোঝেন নাই বাঙালি মুসলমানেরা। যদিও এরা দিনের মধ্যে শতবার আল্লাহর কাছে মাথা নত করছেন। প্রকৃত সত্যজীবনের সঙ্গে বা ধর্মের সঙ্গে এদের জীবনের গভীর যোগ নেই। কোন্ জাতি থেকে এঁরা মুসলমান হয়েছে কে জানে! নইলে জীবন সম্বন্ধে এদের ধারণা এত কদর্য কেন? ধর্মজীবন এত সংকীর্ণ কেন? জীবনে এরা শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর হতে চায় না। এঁদের ধর্ম শুধু মুখে, কেতাবে–”জীবনে নয়। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ। কী আমাদের অভাব? এমন সোনার দেশ জগতে আর কোথায়? এমন অহিংসার দেশ আর কোথায়? খ্রিষ্টের জন্মের বহু বছর আগে এখানে অহিংসা ও প্রেমের মন্ত্র প্রচারিত হয়েছে। প্রত্যেক গৃহই আমাদের এক একটি পোবন, এক একটি ঋষির আশ্রয়।

মাঠ ভরা শ্যামল শস্য, বাড়ি ভরা খাদ্যদ্রব্য, নদী ভরা মাছ–এত আশীর্বাদ জগতের বুকে আর কারা পেয়েছে? তবুও আমাদের অভাব গেল না। রত্নভাণ্ডার ফেলে আমরা পরপদ লেহন, অত্যাচার, মিথ্যা প্রচারণার জীবনযাপন করতে ছুটেছি। ভ্রান্ত : দেশকে নমস্কার কর, মাঠের দিকে ফিরে চাও, লাঙ্গল আর কোদাল ঘাড়ে কর, গাভীর পরিচর্যা কর। বুকভরা স্বাস্থ্য জেগে উঠুক। জীবনে যথার্থ গৌরব সম্বন্ধে তোমরা চিন্তা করতে শেখ।

লেখাপড়া, বিদ্যাচর্চা, ধর্মজীবন, কোরানপাঠ, রোজা-নামাজ এগুলোর উদ্দেশ্য মানুষকে শুদ্ধ ও সুন্দর করে তোলা। মুসলমানের জীবনে বিদ্যা এবং ধর্মের কোনো প্রভাব দেখি না–এ আমাদের গভীর লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়! মহজ্জীবনের কথা দূরে থাক, মুসলমানের পল্লীজীবন, তার পারিবারিক জীবন ভয়ানক গ্লানিপূর্ণ। কুকথায়, অশ্লীলতায় ভরা। তার জীবনে বিবেকের কোনো আসন নেই। তার জীবনে কোনো লজ্জা নেই। যা ইচ্ছা বলে, যা ইচ্ছা গায়ের জোরে করে। তার কথার কোনো ঠিক নেই। তার মহত্ত্বের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। যা আছে তা মৌখিক। তার গোপন জীবনে অসত্য, মিথ্যা ও অন্যায়ের পূর্ণ প্রভাব। অবস্থা সচ্ছল হলে, গায়ে জোর থাকলে, একটা বন্দুক বা ভালো ঘোড়া কিনতে পারলে তার দাম্ভিকতার অন্ত নেই। জাল টাকার মতো জাল মুসলমানে দেশ ছেয়ে গেছে। হায়, কবে এদের ভালোর দিকে যাত্রা শুরু হবে!

রোমের দেশপতি (Consul) মিনিউনিয়াজ একোয়ানদের হাতে বন্দি হয়েছেন। রোমীয় সৈন্যদল পরাজিত, বন্দি। শত্রুর গৌরব গর্বের সীমা নেই। রোমের নরনারী সর্বদা ভীত, তটস্থ। এ অবস্থায় রোমবাসীকে রক্ষা করবার ক্ষমতা মাত্র একজনের ছিল। জাতির মান-সম্মান এবং জীবন ছিল একজন কৃষকের হাতে। তিনি অট্টালিকায় বাস করেন না। তার সঙ্গে অগ্রপশ্চাতে শত শত দাস-নফর চলত না। তাঁর সঙ্গে হীরা-মাণিক্যের তারকাচিহ্ন জ্বলজ্বল করত না। তার যাত্রা পথে ব্যাণ্ড বাজত না। সঙ্গীনযুক্ত বন্দুক তার কোমরে সর্বদা ঝুলানো থাকত না। মানুষ তাকে দেখে সভয়ে শংকায় পথ ছেড়ে দিত না। মুসলিম জগতে আর একজন দেশনায়ক মহামান্য মহামানুষ ছিলেন। তৃণশয্যা ছিল তাঁর সিংহাসন। ক্লান্ত ভৃত্যকে অশ্বে তুলে দিয়ে যিনি নিজে বল্পা ধরে নিয়ে যেতে লজ্জাবোধ করেন নি। আঃ মরি! কী নয়নাভিরাম দৃশ্য! কী স্বর্গীয় মধুর মহাজীবনের ছবি! ইনি হচ্ছেন মহাপ্রতাপান্বিত সম্রাট ওমর। রোমীয় মহাপুরুষ তখন মাঠে কৃষকরূপে, কৃষক ভ্রাতাদের সঙ্গে হলকর্ষণ করেছিলেন। জাতি তাকে মহামান্যেস্পদ ডিটেটর (রোমীয় গণতন্ত্রের সামরিক দেশপতি বা রাজা) করে ডেকে পাঠিয়েছেন! একোয়ানদের হাত থেকে রোম রক্ষা না করলে আর উপায় নেই। এ কাজ আর কারো যোগ্য নয়–আপনারই যোগ্য। জাতির এই সমাচার দূতেরা সসম্মানে এই বরেণ্য কৃষককে দিলেন। সিন-সি-নিটাসের আর গৃহে যাওয়া হল না। তিনি স্ত্রীর কাছে তার দীর্ঘ জামাটি চেয়ে পাঠালেন এবং সেখান থেকেই হল ছেড়ে তরবারি ধরে দেশবৈরীর বিরুদ্ধে যাত্রা করলেন।

এঁরাই জেনেছিলেন মানব জীবনের গৌরব কীসে হয়। কাপুরুষ ও দাস শত পোশাক পরলেও তার জীবনের গৌরব নেই। রোমীয় জাতির যখন প্রকৃত মহত্ত্ব ও গৌরবের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল, তখনই তারা আদর্শ জাতি হয়েছিলেন। পরে যখন তারা বিলাসী হয়ে উঠলেন, দাম্ভিক ও আত্মসর্বস্ব হয়ে উঠলেন, অর্থপ্রতাপই হল তখন তাঁদের গৌরবের আদর্শ, তখন তাঁরা পর্যদস্ত হয়ে জগতে মাটির আসন গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। তাঁদের সমস্ত সম্মান নষ্ট হয়ে গেল। রোমের আর একজন সেনাপতি (মনিয়াস কিউরিয়াস) নিজ হাতে তাঁর শস্য সংগ্রহের গোলাবাড়িতে একটা মাত্র গাজর পুড়িয়ে খাদ্য তৈরি করছিলেন, পার্শ্বে আবার একখানি মাত্র কাষ্ঠের থালা ছিল। এমন সময় স্বর্ণমুদ্রার ভেট দিয়ে এক বিদেশী দূত সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ না করে বলেন, যাদের স্বর্ণমুদ্রা আছে তাদের উপর কর্তৃত্ব করাই বেশি সম্মানজনক। উন্নতির সময় জন্মভূমির প্রতি রোমবাসীদের প্রেম ছিল অফুরন্ত। সমস্ত জাতিটা ছিল যেন এক বিরাট দেহ। হিন্দু মুসলমান সমস্ত বৈষম্য ভুলে যেদিন আমরা একদেহ হতে পারব, সেদিনই আমাদের উন্নতির যাত্রা হবে, তার আগে নয়। স্বাধীন সত্যানুরাগী জীবনে তোমরা গৌরব বোধ কর–দাসের চাকচিক্যভরা মিথ্যা জীবনে নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *