২.৩ খেতে বসতে গিয়ে মেঘনাদ বলল

খেতে বসতে গিয়ে মেঘনাদ বলল, চালিস না কি সেই ছোঁড়ার নাম। গেল কোথায়। খাবে তো?

এতক্ষণে খোঁজ পড়ল চালিসের ! তিলি এসে দেখল, পিপুলতলা খালি। বলল, এখানেই তো ছিল।

চেঁচিয়ে উঠল বিজয়, সে শালাকে যে আমি বড় রাস্তার দিকে যেতে দেখেছি গো। ঠিক আছে, ওরটা রেখে দাও। এসে খাবেখন লবাবজাদা।

বিজয়ের খাওয়া হয়ে গেল আগেই। তার আবার তাড়াতাড়ি। ওয়ার্নিং বাঁশি বেজে গেছে। সে উঠে পড়ল। উঠে পড়েই চিৎকার করে গান ধরে দিল।

কালো বলে মোরে
চেয়ে দেখলে না,
ফের সোহাগ করলে,
রা কাড়ব না।

তিলি বলে উঠল, বেহায়া কোথাকার।

বিজয় বলল, লে লে, শালা পেট ভরে খেয়ে উঠেও গাইব না, তবে গাইব কখন? বলেই আবার হাঁক, কই মাহীরদা, হল?

জবাব এল আর এক ঘর থেকে, এই যে, পাতলুনটা পরে নিচ্ছি।

বিজয় খেয়ে ঘরে এল। নকুড় চান করতে গেছে। মা কোণের ঘরে। ওখানে খেতে বসেছে। মেঘনাদ। মিটিমিটি হাসছে সে বিজয়ের গান শুনে। তুমি ঝুমি বারান্দায়। বারান্দাটাই অবশ্য সারাদিনের মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। বউ বসে আছে ঘরে। এবার সে চান করতে যাবে। তারপর খাবে। কতই বা বেচারির বয়স। আঠারো থেকে উনিশে পড়েছে হয়তো। এর মধ্যেই জট পাকিয়েছে চুলে। তেল জোটে না রীতিমতো। তা ছাড়া, কেমন যেন দিশেহারা সব সময়। কখন যে কী করবে ভেবে পায় না। খালি বিজয়কে চেয়ে চেয়ে দেখবে। ফাঁক পেলেই দেখবে চেয়ে আর ঠোঁট ফোলাবে। এদিকে শান্ত শিষ্ট। দশ চড়ে রা নেই মুখে। কিন্তু বিজয়কে কাছে পেলেই চোখ মুখের চেহারা বদলে যায়। যেন মমি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

বিজয় ঘরে এসে তেলচিটে হাফ প্যান্টটা পরতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল, তুই চান করিসনি?

বউ নিরুত্তর। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। বিজয় কাছে এসে একেবারে বুকে টেনে নিল। বলল, রাগ হয়েছে বুঝি আমার উপর। আরে লে, লে, বনুই এসেছে, তাই অমন দশটা কথা বলেছি।

বউয়ের তাতেও মুখে কথা নেই। কথা সে বলেই কম। চেয়ে থাকে বেশি। বড় বড় শান্ত দুটি চোখ। খরতা নেই, তীব্রতা নেই। মাঝে মাঝে বিজয়ের পাল্লায় পড়ে চোখে ঝিকিমিকি করে ওঠে বিচিত্র আলো। বিজয় জাপটে ধরতে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল সে। ফিস ফিস করে একবার বলেও ফেলল, কী হচ্ছে, বা রে?

চকিতে একবার বারান্দার দিকে দেখে, জাপটে ধরে বউকে চুমু খেয়ে ফেলল বিজয়। এটি বিজয়ের যেন স্বভাব দোষের মধ্যে পড়ে। ফাঁক পেলেই হল। চুমু খেয়ে ঠেলে দিয়ে বলল, যা, যা, নাইতে চলে যা। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে এখন।

হাত দিয়ে ঠোঁট মুছে ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকাল বউ, ঠোঁট ফুলে উঠল অভিমানে। তবু গতি পেল এতক্ষণে। চোখ নামিয়ে, গামছা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

বিজয় আবার এক হাঁক ; মাহীন্দরদা, হল?

জবাব এল রাস্তা থেকে, অনেকক্ষণ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি য্যা।

কারখানার জামা কাঁধে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বিজয়।

জংলা পুকুরে যাওয়ার পথে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়েছিল বউ। তাকিয়েছিল রাস্তার দিকে। বিজয়কে দেখবে বলে। একটু পরেই বিজয়কে দেখা গেল মহেন্দ্র মিস্তিরির সঙ্গে।

অনেকখানি দূরে। সে দেখতে পাচ্ছে। ওদের নজরে আসার কথা নয়। তবু আনমনে খসা ঘোমটা টেনে দিল বউ। ভু বেঁকে উঠল। ঠোঁট ফুলল। যেন দেয়লা করছে। তবু ঠোঁটের কোণে কোণে একটু হাসির আভাস।

বিজয় চলেছে বিড়ি খেতে খেতে, বকবক করতে করতে। হঠাৎ বাঁশি বেজে উঠল কারখানার। গাছতলায় চমকে উঠল বউ। বিজয় ততক্ষণ দৌড়তে আরম্ভ করেছে।

বউ তবু দাঁড়িয়ে রইল। বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক। অনেক দুঃখ, দৈন্য।

উপবাসের যন্ত্রণাও ভোগ করেছে এ দু বছরের মধ্যে। সে যে অষ্টপ্রহর বিজয়কে কাছে চায়, তা নয়। তবু দিবানিশি যেন প্রেমে থরোথরো। যেন গুপ্ত প্রেমলীলায় মেতে আছে সে। নিজের মনকে সে চেনে কম! যে বাড়িতে সে বউ হয়ে এসেছে, সে বাড়ির কাউকে সে মন দিতে পারেনি। মাঝে মাঝে তিলিকে ভাল লাগে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। কোথাও তার কোনও অভিযোগ নেই। রাগ অভিমান যা কিছু, সব বিজয়ের উপর। তাও যে সে কখন করে, কী ভাবে করে, সেটুকু বিজয় বোঝে শুধু। বলতে হয় না। তার চলা দেখলে বিজয় বোঝে। অনেক সময় বউ নিজেও বোঝে না।

উনিশ বছরের দেহ তার ভেঙেছে অনেক। উনিশ বছরের মনটুকু বাঁধা তারের মতো টং টং করে বাজে। ওইটুকু সে দিয়েছে বিজয়কে। দিয়ে, সব হারিয়ে বিজয়ের ধ্যানে মগ্ন। যে ভালবাসাকে বলে মরণ, এ সেই ভালবাসা। হৃদয়ে তার বিচিত্র তীব্রতা। রক্তে রক্তে তার অনেক সুরের আগুন। কিন্তু তাকে দেখে যেমন তা বোঝা যায় না, সেটুকু বোঝে না সে নিজের সম্পর্কেও।

আর বিজয়, সেও যেন এক তীব্র-গতি সর্পিল নদী। অদ্ভুত তার প্রাণচাঞ্চল্য। বুদ্ধিতে খুব দড়ো নয়। হৃদয়ের দরজাটা ভেতরে বাইরে হাট করে খুলে রেখেছে। সেখানে এক কোলাহলমুখর হাট বসিয়ে রেখেছে। চলতে ফিরতে হাঁক ডাক। সবাইকে, মা বাবা বন্ধু বউ, কেউ বাদ নেই। আবার, কারখানা থেকে ফিরে, হাত ধুতে যাওয়ার ফাঁকেও, সুযোগ পেলে একটু সোহাগ করে যাবে বউকে। বউ বেচারি ভয়ে ও লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে থাকে। যেন, চালাক ছাগলছানাটা এদিক ওদিক দেখে, আর বেড়া ডিঙিয়ে টুকটাক ঘাস খায়। এমনি তার ভাবখানা। ওটা তার প্রাণচঞ্চল প্রবৃত্তি। বউ ভয় পায়, রাগ করে। তারপর কেন যেন ভাল লাগে।

চলতে ফিরতে এত । লোকের চোখে কি আর পড়ে না। এ বাড়িসুদ্ধ সবাই বিজয়ের বউ-সোহাগ নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। রাগ করে কেউ। সুকুমারী তো জ্বলে যায়। সেই জন্যও বউয়ের উপর বড় বীতরাগ সে। ঘৃণাও করে। ৮৬

কেবল তিলি বলে, মাগো ! কী রাক্ষুসী তুই। সোহাগ খেতেও পারিস। তিলি বোঝে। ব্যাপারটা। কিন্তু বউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে সে! সে কী করবে? তখন কাঁদে।

বিজয় বলে সব কথার শেষে, লে লে…।

বিজয় চলে গেছে। বউ দাঁড়িয়ে রইল তেমনি। মনটা যেন দৌড়চ্ছে বিজয়ের পায়ে পায়ে। এতক্ষণে সে কোথায় গেল। কারখানার গেটে গেছে কি?

কে গো !

পেছনে গলার স্বরে চমকে ঘোমটা টেনে দিল বউ। পাড়ার এক বুড়ো চান করে ফিরছে। বুড়ো বলল, বিজের বউ? দাঁড়িয়ে কেন?

জবাব নেই। কথা বলবে নাকি বউমানুষ? তা নয়। বলল বুড়ো, বলতে হয়। বলে চলে গেল। বউ তাড়াতাড়ি পুকুরের পথ ধরল। ছেলেটা আবার জেগে উঠবে।

জলে নেমে তার মনে পড়ে নতুন অতিথিদের কথা। ভাবনাটা আপনি মনে এসে পড়ল তার। কেমন যেন ভয় ভয় করছে তার সকাল থেকে। বিশেষ করে লীলাকে দেখে। কেন তা সে জানে না। আর মেঘনাদ যে কেমন, তা এখনও সে চোখেই দেখেনি। এই আসা, কথা, হাসি, ব্যস্ততা সব মিলিয়ে তার কেমন একটা ভয় ভয় ভাব। তার মনে হচ্ছে, এক বিজয় ছাড়া আর সকলে যেন বদলে গেছে। বিশেষ শ্বশুর, শাশুড়ি।

.

ঘুম ভেঙে গেল মেঘুর। সেই কোণের ঘরটায় শুয়েছিল। দিনের বেলাও ঘরটা কেমন অন্ধকার থাকে। যদিও দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। খোলাও রয়েছে সবই। তবু তার সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে ঘামে।

ঘুম ভেঙে হতচকিত হয়ে তাকাল সে। এ কোন ঘর! কার ঘর! কোথায় এসেছে সে?

সব যেন ভুলে গেছে। মনে নেই কোথায় এসেছে। চোখ রগড়ে তাকাল। নজর গেল জানালা গলিয়ে। অপরিচিত একটি উঠোন। সর্বাঙ্গ উন্মুক্ত, শুধু গামছা-পরা একটি মেয়েমানুষ। কাঠের পাটাতনের উপর কাপড় আছড়াচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক একবার একটু দাঁড়াচ্ছে, হাঁপাচ্ছে। আবার আছড়াচ্ছে। খোঁপাটা ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের কাছে। বুক দুলছে তালে তালে। কাছের বারান্দাটিতে শুয়ে আছে কয়েকজন মেয়ে আর শিশু। রোদ নেই। কিন্তু তাত আছে। কোথা থেকে যেন গলে গলে পড়ছে তাত। রুদ্ধশ্বাস গুমসোনি।

পাশের ঘরের সঙ্গে টিনের পার্টিশন দিয়ে আলাদা এই ঘর। পাশের ঘরে রকমারি মেয়ে গলা শোনা যাচ্ছে। কথার সঙ্গে কিছু হাসি। প্রথমে লীলার গলাটাই চিনতে পারে মেঘু। তারপর মনে পড়ে বিজয়কে। মনে পড়ে কোথায় এসেছে সে।

বুকের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা হঠাৎ জেগে উঠল ফিক ব্যথার মতো। এই নতুন জায়গায় এসে, দেখা শোনায়, কথায় কথায় একটু যেন বাতাস লেগেছিল প্রাণে। দুঃস্বপ্নের মতো এ ঘুমের মাঝে সে বাতাসটুকু উধাও হয়েছে কখন। সেই বিষের বাঁশিটা বেজে উঠেছে আবার। সে গালে হাত দিয়ে বসল।

বাবা মারা যাওয়ার পর একদিন এমনি করেই গালে হাত দিয়ে বসেছিল সে। পেছনে ছিল বাতাসে দোলা ঘন বেত-বন। সামনে প্লাবিত মাঠ আর অসীম আকাশ। মনটা হাত-পা ছড়াবার জায়গা পেয়েছিল। আজ মনে হল, এখানে হাত-পা ছড়াবার জায়গাটুকুও নেই।

ভাগ্য যেন এক গোলকধাঁধার সিঁড়ি। কোথাও অন্ধকার অতল গহ্বরে সে নেমে গেছে। কোথাও উঠেছে একেঁবেঁকে। সেই ওঠার মুখের, দু ধারের চাপা দেওয়ালে ঘুলঘুলিতে আলোর রেশও দেখা যায় থেকে থেকে। মনে হয়, এবার সেই অবাধমুক্ত আলোর রাজ্যে এসে জুড়িয়ে যাবে মনপ্রাণ। না জুড়োক, কপালের ঘাম মুছে বলা যাবে, কত সুখ আছে জীবনে জানিনে। বড় স্বস্তি পেলাম।

কিন্তু তারপরে দেখা যায় সিঁড়ি সোজা ওঠেনি। সোজা ওঠা তার প্রকৃতি বিরুদ্ধ। কখন বাঁক নিয়ে সুদীর্ঘ চোরা উতরাইয়ের মতো সে আবার নেমে গেছে এঁকেবেঁকে।

আজ সেই চোরা উতরাইয়ের পথে পড়েছে সে। সে দিনের কিশোর আর আজকের মেঘনাদের মধ্যে তফাত নেই। আবার শুরু। আবার শুরু এই রুদ্ধশ্বাস ছোট্ট ঘরটির মধ্যে। যেখানে হাত-পা। ছড়াবার জায়গা নেই। এই অন্ধকারে, এখানে বসে কোনও আশা মনে আসে না। চোখে পড়ে না। এক কণা আলো। শুধু পেছনের ফেলে-আসা সিঁড়িগুলির জন্য প্রাণটা মাথা খোঁড়ে অসহ্য যন্ত্রণায়। চোখের সামনে ভাসে শুধু ধলেশ্বরীর তীর। পালতোলা নৌকার সারি। সিরাজদিঘার হাট, গদি, কারখানা, বাড়িঘর, নৌকা।

আজ সে সত্যি ধনপতি সদাগর। তার সব ছিল। সব ডুবেছে। কোথায় মুখ লুকিয়ে বসে আছে লক্ষ্মী। খুঁজতে যেতে হবে তাকে। তার বর পেলে, আবার ভেসে উঠবে সব। ভেসে উঠবে নতুন চেহারায়। সামনের ময়ূরপঙ্খী গলুই সোনা হয়ে উঠবে। সোনা হয়ে উঠবে পেছনের হাঙ্গরমুখো গলুই। পাশে খেলবে সোনালি জেল্লা।

কিন্তু আবার কোন ঘাট থেকে যাত্রা করবে সে? কোন পথে খুঁজবে? একদিন অনস্তির ঘাট থেকে যাত্রা করেছিল। ডেকে নিয়ে গেছল তার বাবা। অনেক খুঁজে খুঁজে সিরাজদিঘার সপ্তসিন্ধুপারে ডিঙা মিলেছিল।

আজ কোন ঘাট থেকে যাত্রা শুরু হবে ! পাশের ঘরে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েরা, চমকে উঠল সে। অনেকদিন আগের লক্ষ্মণ সা’র অন্দরমহলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কুমির গলাটি সবচেয়ে চড়া।

নজর পড়ল সামনের জানালায়। কাপড় কাঁচছে না। মেয়েমানুষটি উবু হয়ে পড়েছে পেটে হাত দিয়ে। পেটের পাশ থেকে একটা শীর্ণ পেশি কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক পর্যন্ত। শুন্যে দোলা বুক ব্যথায় কুঞ্চিত বিস্তৃত হচ্ছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ। জন্ম থেকে জীবনবৃত্তান্তটুকু লেখা রয়েছে যেন সারা দেহে। অনাহার, খাটুনি, প্রসব ও অতৃপ্তি। আজ ভারবাহী বৃদ্ধা গর্দভী। রক্তহীন শিরায় শিরায় শুধু ব্যথা। একটু কমবে, আবার কাজ।

দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেঘনাদ। কী অসম্ভব ছোট্ট ঘর ! দম বন্ধ হয়ে আসছে। দাঁড়ালে মাথা ঠেকে যাবে। আকাশ জোড়া স্বরপড়া মেঘের গুমসোনি। গুমসোনি মনের মধ্যে।

আধো অন্ধকারে হাতড়ে দেখল সে পাকানো বিছানাটা। তার আড়ালে স্টিলের একটি মাঝারি ক্যাশবাক্স। মেঘনাদের সর্বস্ব আছে ওই বাক্সে। সপ্তসিন্ধু পারের পারানি। আর এই দেহ তো আছে। আর একটি পেতলের বাক্স আছে। সেটি ঝুমির। ওইটিতে আছে ঝুমির অলঙ্কার। কত টাকার অলঙ্কার আছে, তার সঠিক হিসাব নাই মেঘনাদের। গদির বাইরে, নিজ ব্যয়ের খতিয়ানে তার হিসাব আছে। দুর্দিনে, এটুকু পাওয়া যাবে কি না, তা জানে ঝুমি। দেওয়া না-দেওয়া তার ইচ্ছা। দেওয়া না-দেওয়া যে একদিন মেঘনাদেরও ইচ্ছা ছিল।

স্টিলের ক্যাশবাক্সটি সরিয়ে রাখল সে। মনে পড়ল, চালিসের কথা। চালিসের সঙ্গে একটু গল্প করার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল। গুনোহাটির বদরুদ্দিনের সংবাদ একটু শোনা যাবে ওর কাছে। গুনোহাটির বন্দরের কথা, কাজের কথা, দেশের মিস্তিরিদের কথা। তবু ভয় হয়। বদরুজিনের ডুবে যাওয়ার কথা সে শুনবে কী করে? ডুবে যাওয়ার সংবাদ যে বড় ভয়ঙ্কর। সে। পাড়ি দেয়, অতল জলরাশি তাকে হাতছানি দেবে শুধু ডোবার জন্য। খালি মনে হবে, এই পথে, এমনি করে বদরুদ্দিন ডুবেছে। যাক সে কথা থাক। অন্য কথা শুনবে সে। গুনোহাটির মহাজনদের গল্প। তবু একবার চালিসকে দেখবার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। যেন ওকে দেখলে, একটু শান্তি পাবে সে।

উঠোনের মেয়েমানুষটি আবার উঠেছে। কোমর থেকে খসা গামছাটি জড়িয়েছে। বুকে এক চিলতে ন্যাকড়া ঢেকেছে। কাঁচা কাপড়গুলি সব তুলে নিয়েছে ঘাড়ে। কাকে যেন ডাকছে, একটু সঙ্গে চল জংলা পুকুরে। ধুয়ে ধুয়ে দেব, নিয়ে আসবি।

মেঘু বাইরে এসে পাশের ঘরে গেল। নিছক মেয়েদের জটলা বসেছে। মৌচাকের মতো। মক্ষীরানির মতো বসেছে লীলা। সবাই পাড়ার বউ ঝি।

নকুড় এক পাশে ঘুমোচ্ছে। অন্য পাশে বিজয়ের বউ ও সুকুমারীও নিদ্রামগ্ন।

মেঘনাদকে দেখে জটলা থতিয়ে গেল একটু। তিলি বলে উঠল, একী, ঘুম হয়ে গেল?

মেয়েদের সামনে মেঘনাদ-একটু বিব্রত বোধ করে চিরদিন। একটু বেশি বোকা হয়ে ওঠে যেন।

হাসবার চেষ্টা করে বলল, বড় গরম।

তিলির ভেজা চুল এলানো। আড্ডায় বসে বেশবাস একটু অগোছাল। লীলার দিকে একবার তাকিয়ে হেসে বলল, ডাকলেই পারতেন। বাতাস করতাম গিয়ে।

মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলে মেঘনাদ। ভেবে বলে না। আপনি এসে পড়ে মুখে। বলল, চিরদিন গাছতলার বাতাসে আরাম করেছি। পাখার বাতাসের কথা মনে থাকে না।

সবাই হেসে উঠল। লীলা আশ্চর্যরকম লজ্জাভরে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে একটু। বোধ হয় নতুন জায়গায়, নতুন মানুষের মধ্যে রয়েছে বলে। সে গলা নামিয়ে বলল, তিলিকে উদ্দেশ করে, তা নয়। হুতাশে ঘুমোতে পারেনি। সে তোরা বাতাস চালিয়েও দূর করতে পারবি নে।

কথাটা সত্য। হুতাশ যদি দুর্ভাবনা হয়, তবে তিলির হাতপাখার ভালবাসার বাতাস মাত্রে তা যাবে । মেঘনাদ বলল, সে ছোঁড়া এসে খেয়েছে?

তিলি বলল, কে, তোমার চালিস?

হ্যাঁ?

তিলি প্রায় বিজয়ের মতোই বলে উঠল, সে শালার পাত্তা-ই পাওয়া যায়নি।

তিলির কথার ঢঙে হেসে উঠল সবাই। কিন্তু মেঘনাদের মনটা খচ করে উঠল। আসেনি ছেলেটা। ওই ছেলেটাই তাকে প্রথম সান্ত্বনা দিয়েছিল এখানে। কোনও কথা না বলে, কেন চলে গেল ছেলেটা। মন তার সংশয়ে ভরে উঠল। হয়তো কেউ কিছু বলেছে। তাড়িয়ে দিয়েছে।

পথের ছেলে, সে তো পথেই চলে যাবে একদিন। তবুও মনটা বড় চেয়েছিল তাকে। সে মনের কথা ঠুমিরা বুঝবে না, বোঝানোও যায় না। দুয়েতেই ওদের হাসি পাবে শুধু। মনটা বিমর্ষ হয়ে উঠল। সিরাজদিঘার মেঘুসাকে কোনওদিন না দেখে সে মিছে কথা বলেছিল। তার একটুও রাগ হয়নি তাতে। অহঙ্কারশূন্য আনন্দবোধ হয়েছিল।

চালিসের মধ্যে শৈশবের মেঘুর কোনও ছাপ নেই। চালিস মুক্ত বাতাস। ওর গুনগুনানির মধ্যে। অপর্যাপ্ত বিচিত্র কথার ঝুরি। তার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বাদ আছে। সেই স্বাদটুকু পাওয়ার বড় সাধ । ছিল মেঘনাদের। তা ছাড়া, ধলেশ্বরী, পদ্মা, বুড়িগঙ্গা আর গঙ্গার ধারে ধারে অনেক ঘুরেছে সে। তার কাছে অনেক সংবাদ ছিল।

তিলি বলে উঠল, আর কী মিথ্যুক মাইরি ছোঁড়াটা ! বোনাইয়ের এমন চেহারা বললে আমাকে, আমি তাজ্জব।

লীলা হেসে উঠে বললে, আর কী গল্প করতে পারে ! আমাকে তো সারাটা গাড়ি জ্বালিয়েছে। ছোড়ার রস আছে প্রাণে।

মেঘনাদ দরজার দিকে গেল। তিলি বলল, যাচ্ছ কোথা?

মেঘনাদ বলল, বাইরে গাছতলায় বসি একটু।

লীলা বলল, ঠুমি, ঘরে তালাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়।

তিলি উঠল। হঠাৎ তারও মনটা একটু ভিজে উঠল। বলল, সত্যি, মুখের ভাত ফেলে চলে গেল ছেলেটা।

লীলাও ভোলেনি। কালকে রাত্রে গাড়িতে প্রথম তার সঙ্গেই চালিসের ভাব হয়েছিল। কেন জানিনে, চালিসের সঙ্গে সে খুব মেতে উঠেছিল প্রথমে। চালিস যেন যুবক ভক্ত প্রেমিকের মতো লেপটে এসেছিল তার দিকে। তাই সে ছেলেটার সঙ্গে গল্প করেছে খানিকক্ষণ। আবার ভুলে গেছে কখন। ভোরবেলা চালিস তার পায়ের কাছে শুয়েছিল। তার টার্কি পাখির মতো বহুরূপী মনে একটু স্নেহ ও করুণার রং ধরেছিল।

মেঘনাদ যে তাকে ডেকে এনেছিল, তাতে খুশি হয়েছিল সে। তারপরে আবার ভুলে গেছে কখন। এখন আবার মনে পড়ল। মনে পড়লে, কথা বলতে আর মিশতে ইচ্ছা করে ছেলেটার সঙ্গে। সে হঠাৎ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ও সব রাস্তার ভূত, মরবে রাস্তায়। ঘর কি ওদের ভাল লাগে।

প্রতিবেশিনীদের একজন বলল, তাই না বটে।

.

বিকেল হল। পাঁচটার পরে ফিরে এল বিজয়। চালিস এল না। বিজয় বলল, সেও তাকে দেখতে পায়নি আর। বলল, ঘরের ভাতে ওদের মন ওঠে না। মেঘনাদকে বলল, চলল, এ দেশটা একটু ঘুরে দেখবে।

সেটুকুই চাইছিল মেঘু। সে তৈরি হল। তার চেয়ে অনেক বেশি তৈরি হল বিজয়। হাতে পায়ে সাবান দিয়ে কালো চামড়া ছাইপড়া ধূসর করে ফেলল। মাথায় দিল জবজব করে একমাথা তেল। পাঞ্জাবি পরল, মালকোচা মেরে ধুতি পরল। পাঞ্জাবি ঘাড়ের কাছে তেল ঘামে বেশ খানিকটা রং বদলাচ্ছে। তাতেও তৃপ্তি কম নেই। তার উপরে বিয়ের সময়ের সযত্ন রক্ষিত পামশু। বিবর্ণ হয়েছে রং। তালি তাপ্লিও পড়েছে দু-চারটে। কিন্তু কারখানা থেকে এসে এ সব না করলে তার মন ভরে না। জাম ছাড়ে না। চটকলের মিস্তিরি জীবনটুকু মাপে মাপে আয়ত্তে এসে গেছে তার।

ওদিকে লাঠি টুক টুক করে নকুড়ও বেরুল। সে মেঘনাদকে নিয়ে বেরুবার ইচ্ছা করেছিল। বিজয়ের উপর কথা বলা যাবে না জেনে প্রাত্যহিক পথে যাত্রা করল সে। সে যাবে এখন অনন্তর কাছে। অনন্ত থাকে ঠাকুরগলির বাঁকে। যেখানে, বাঁকের পরে বস্তিতে কারখানার মানুষের ভিড়। ঠাকুরগলি বেশ্যাপল্লী। অনন্তর কাছে যাবে টাকা-পয়সার জন্য। রোজই পায় না। কোনও কোনও দিন পায়। আর যাবে, ঠাকুরগলির মোড় থেকে খানিক দুরে, সিনেমার সামনে একটা দশকর্ম ভাণ্ডারে। সেখানে নকুডের জমজমাটি। ঘণ্টা চারেক বসে, বারকয়েক গাঁজা টানবে। একটু চা খাবে। তারপর ফিরে আসবে।

আজ নকুড় অনন্তর কাছে চলল নতুন সংবাদ নিয়ে।

বিজয় বেরুল মেঘনাদকে নিয়ে। ওদিকে লীলা তিলিরও যেন সাজো সাজো ভাব। কেবল সুকুমারী লীলার পাশে পাশে ঘুরতে লাগল। বউ তাকিয়ে রইল বিজয়ের পথের দিকে। প্রায় বিজয়ের ডবল একটা মানুষ মেঘনাদও যে পাশে পাশে যাচ্ছে, সেটুকু যেন তার নজরে পড়েও পড়ে না। তার কোল থেকে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে কপচাতে লাগল, বাব্বা! ওম বাব্বা!

খেয়াল থাকলে বিজয়, শালার ব্যাটা বলে আদর করে যেত। কিন্তু এখন তার খেয়ালই নেই। আশ্চর্য ! ফিরে তাকাল মেঘনাদ। বিচিত্র হাসি হেসে ছেলেটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, হুঁঃ, হুঁ !

বউ চমকে ঘোমটা টেনে দিল।

মেঘ সরে যাচ্ছে একটু একটু। বাতাস বইছে রাস্তায়। বড় রাস্তায় অনবরত গাড়ি চলাচল। দু পাশের দোকানে দোকানে এখন কারখানার মানুষের ভিড়। বিশেষ চা আর হোটেলখানাগুলিতে। পরিচিত মানুষ বিজয়। সকলের সঙ্গেই তার জানাশোনা একটু বেশি। সবাই ডেকে ডেকে কথা। বলে।

চলো সেলুনে।

সৌভাগ্যবশত নামটা জানে মেঘু। মুখটাও কাঁটাবন হয়ে আছে। বলল, চলো।

মেঘুকে গদিতে এসে কামিয়ে দিয়ে যেত নরসুন্দর প্রাণনাথ। কখনও কখনও কারখানায় আসত। কাজের ভিড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কামিয়ে নিত। এখন সেলুনে কামাতে হচ্ছে।

সেলুনের বাইরে এসে বিজয় বলল, তোমার তো আবার চা চলবে না।

মেঘনাদ বলল, তুমি খাও। আমার বড় ভয় করে। গরম কি না! তা ছাড়া কেমন যেন গা পাক দেয়।

বিজয় হো হো করে হেসে উঠল। হঠাৎ বলল, মালটাল চলে?

মেঘনাদও হাসছিল। বলল, মাল, মানে মদ বলছ তো! তা একটু আধটু খাই।

বিজয় একেবারে চিৎকার করে উঠল, গুড! শালা ভেরি গুড।

কে একজন বলে উঠল, কীসের ভেরি গুড মিস্তিরি।

বিজয় বলে উঠল, আমার বোনাই।

অমনি রাস্তার দু পাশ থেকে অনেকগুলি চোখ এসে পড়ল মেঘনাদের উপর। বেশ একটু বিস্মিত

শ্রদ্ধাপূর্ণ সেই দৃষ্টি। বোধ হয় চেহারাটা দেখে। মেঘনাদ লজ্জা পেল। লজ্জা পেলে তার গোঁফজোড়া একটু বেঁকে যায়।

চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়াল মেঘনাদ। একটা দোকানের সামনে তন্দুরে রুটি সেঁকছে একটা লোক। ছোট তন্দুর। ঢাকায় বাকরখানির দোকানগুলিতে এরকম তন্দুরই থাকে। তন্দুর নয় তণ্ডল।

লালমিঞা বলত, আসলে তন্দুর। বাঙালির মুখে তরল হয়ে গেছে। এক সময়ে এরকম ছোট তন্দুরেও কাজ করেছে মেঘনাদ। টিনের পাত তন্দুরে আতিয়ে নিয়ে, মাল বসিয়ে দিয়েছে। বড় ক্ষতির কারবার। তবে, এখানে শুধুই রুটি হচ্ছে।

বিজয় বলল, দাঁড়ালে যে?

রুটি সেঁকা দেখছি।

তোমার তো আবার এ সব দেখলেই কাজের কথা মনে পড়ে যায়।

মেঘু হাসল। বিজয় বলল, চলো তবে এখানেই চা খাই।

দু জনে ঢুকল তারা। বিজয় চা আর নিমকি বিস্কুট চাইল। চা-খানা আর হোটেল, এক সঙ্গে চলে এখানে।

বিজয়কে চা নিমকি বিস্কুট দিতেই, মেঘনাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। একটা নিমকি বিস্কুট নিয়ে টিপে ভেঙে ফেলল। বলল, যা ভেবেছি। খামিটা ভাল হয়নি। বেকায়দার মাল হয়ে গেছে।

বিজয় অবাক হয়ে বলল, খামি আবার কী?

একটু বিব্রত হয়ে উঠল মেঘনাদ। আশপাশ পরিবেশ ভুলে গিয়েছিল সে। বলল, কিছু নয়। মাখা ময়দার নামই খামি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

বিজয় বলল, তাই বলো। ভাবলাম, কী আবার বলছ। তা চোখে দেখলেই মাল ঠাওর করতে পারো? বাঃ! তা কী দেখলে? বাজে মাল? তা হলে বলো খাব না। এখন তো আর শালা ঠকাতে পারবে না।

মেঘনাদ বলল, না তা নয়। কারবারির ক্ষতি হয়েছে। আনাড়ির হাতের কাজ, ময়দা বেশি লেগেছে। ঠিক হলে, ময়দা কম লাগত, মালটা আরও খাস্তা হত।

বিজয় বলল, ওঃ তাই। ময়দা যখন বেশি আছে, তখন তো শালা লাভই হল। খেলে পেটে গহে থাকবে কতক্ষণ। ঘরে গিয়ে হামলাতে হবে না। আর দুখানা নিই কী বলল?

মেঘনাদ বলল, খিদে পেলে নেও না।

বিজয় খেতে খেতে বলল, খিদে পেলেই নেওয়া যায়? তা হলে আর ভাবনা কী ছিল। প্রথম বুঝতে পারল না মেঘু কথাটা। পরমুহূর্তে নিজেই বলে উঠল, এই, আর দুখানা নিমকি দেও তো।

বিজয় বলল, থাক না। তুমি খাবে?

আমি? বদলে গেল মেঘনাদের মুখটা। নত চোখ দুটি নিমকি বিস্কুটের দিকে থাকলেও দৃষ্টি চলে গেছে শুন্যে। গোঁফের ফাঁকে করুণ হাসিটুকু কেমন যেন বিদ্রুপাত্মক হয়ে উঠল। কারখানার খারাপ মাল, অর্থাৎ ভাঙাচোরা পুড়ে যাওয়া কিংবা ঠাস অর্থাৎ কাঁচা কাঁচা, এমনি কত পড়ে রয়েছে হাতের কাছে। সেই সব মুখে দেয়নি। কোনওদিন কখনও বা মাল বাজারে ছাড়ার আগে একবার চেখে দেখেছে। তাও ওটা বিপিনের কাজ ছিল। কিন্তু আস্ত মাল ভেঙে তাও আবার কিনে, খাওয়া হয়নি এ জীবনে কোনওদিন। তবে বিজয় বলছে। খেলে যদি ওর প্রাণটা খুশি হয়।

তবু গলার স্বরটা চেপে এল তার। বলল, নেও দুটো, খাওয়া যাক।

নেওয়া হল। বিস্কুট মুখে দিয়ে হঠাৎ বুকের কাছে আটকে গেল মেঘুর। যদি আজ বিপিন দেখত। যদি তার কারখানার কেউ দেখত! ভূত দেখার মতো হয়তো চমকে উঠত। গলা দিয়ে যেতে চায় না। বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল। শক্ত চোয়ালের দু পাশে আটকে রইল বিস্কুট।

বিজয় চা খেতে খেতে হঠাৎ বলল, বনুই, তোমার মনটা খারাপ আছে।

মেঘু একটু চমকে উঠল। তারপর বলল, তা বুঝতেই তো পারছ, বিজয়।

বিজয় বলল, তা বুঝতে পারছি। তোমার অত বড় কারবার। সব ফেলে ছোড়ে…। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, আমি আদার ব্যাপারি , তোমার জাহাজের কারবার। একটা কথার কথা বলছি। আমি তোমার সব বুঝব না।

মেঘনাদ বলে ফেলল, কেন?

বিজয় বলল, কেন? বলে হেসে ফেলল। বলল, শুনেছি তোমার নাকি অনেক টাকা। বেশি টাকার কথা শুনলে আমি শালা ভিরমি খেয়ে যাই, মাইরি। যা পাব না, ওতে আমার টান নেই। ক্যাশিয়ারবাবু মাইনে দেয়, বাবুর বাকসের দিকে চাওয়া যায় না। এত নোট থিকথিক করে। যোলো টাকার জায়গায় যেদিন কুড়ি টাকা হপ্তা পাব, চার টাকার এপিঠ ওপিঠ বাজিয়ে নেব। ফুর্তির ঠেলায় ওই চার টাকার মাল-ই খেয়ে ফেলব হয়তো। কিন্তু বেশি টাকার ব্যবসা, আমি কী বুঝব, বলো?

মেঘনাদ নীরব। মুখের চামড়া টান টান শক্ত হয়ে উঠল তার। গোঁফজোড়া তীক্ষ্ণ দেখাতে লাগল কিন্তু সে একটি কথাও বলল না।

বিজয় একটু মুষড়ে গেল। বলল, কী হল? কথা বলছ না যে?

মেঘনাদ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

দোকানে ভিড় জমে উঠেছে আরও। আকাশের অবস্থা সেই একই রকম। মেঘের কম বেশি নেই। সন্ধ্যার ঘোর লেগে গেছে সর্বত্র। দোকানে দোকানে বাতি জ্বলছে।

মেঘনাদ হঠাৎ বিজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বেশি টাকার ব্যবসা বোঝে না। কম টাকার বোঝো?

বিজয় বলল, ব্যবসাই বুঝিনে।

তবে? মেঘনাদের গলার স্বর তীক্ষ্ণ শোনাল। ভূ দুটো নেমে এল চোখের মণির উপর। বলল, ব্যবসা-ই বোঝো না। তবে? আজ বুঝতে পারছি, আমিও বুঝি না বোধ হয়। খাটতে পারি। আমি ভাল মিস্তিরি ছিলাম, আজও আছি। ব্যবসা চালাতে যে বুদ্ধির দরকার, সেটুকু বোধ হয় নেই। নইলে, আজ নিজেকে এত একা একা মনে হবে কেন? আজ লালমিঞা নেই..।

সে থেমে গেল। বিজয় ভাবল, তার উপর রেগে গেছে মেঘু। কিন্তু সে তো রাগাবার জন্য বলেনি কিছু। সে নিজে তো রাগেনি।

মেঘু আবার বলল, টাকার কথা বলছ? এটুকু বুঝি, কারবারির টাকা হল হাল। নৌকা বাওয়ার যন্তর। হাল যে পানিতে বইবে, সেই পানির নাম বুদ্ধি। হালে পানি পেলে নৌকা চলে।…বলছ আমার অনেক টাকা। কত টাকা। ফুসমন্তর। কারবার যখন করব ভেবেছি, তখন টাকা নিয়ে তো আর চিতায় উঠব না।

বিজয় বলল, যাঃ বাবা। তুমি যে চটে গেলে।

মেঘুর খোলা বুকটা রাঙা দেখাচ্ছে। সেখানে হাত দিয়ে সে বলল, চটলাম কোথায়।

তবে বলছ এসব। হাল পানি, আমি তো এসবই বুঝিনে।

বিজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘু বোধ হয় হাসবার চেষ্টা করল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, না, তুমি বলছ আমার অনেক টাকা। অনেক না থাক, কিছু আছে। অনেক বড় আশা আমার, বুঝলে? তল পাচ্ছিনে।

অনেক কথা হুড়মুড় করে ছুটে এল তার মুখে। কিন্তু নীরব রইল সে। অনেক কথার বন্যা তার নিজের মধ্যেই আবর্তিত হতে লাগল। আবর্তের ধাক্কাটা ফুটে উঠল তার সারা দেহে, চোখে মুখে।

বিজয়ও নীরব। টাকাওয়ালা মানুষকে সে চিরকালই সংশয়ের চোখে দেখে এসেছে। ওটাই তার জীবনের অভিজ্ঞতা। সে নিজেও এক সাহা ঘরের ছেলে। চিরকাল অলক্ষ্মী ঘুরেছে তার পিছনে পিছনে। আজকে সে জীবনের এক গাঙ থেকে আর এক গাঙে গিয়ে পড়েছে। সেখানেও জীবন কঠিন, নিষ্পেষিত। বাঁচিয়ে কেউ রাখে না। জোর করে বেঁচে থাকাটাই জীবন। তার এই শরীরটুকু মূলধন

যেখানে মূলধনেরই তফাত, সেখানে একজন আর একজনকে বুঝবে কী করে। তবু, মেঘনাদকে দেখে বিজয়েরও মনটা বিমর্ষ হল। টাকা আছে কিছু। কিন্তু সুখ নেই। টাকা নিয়ে সে ভোগের রথে বসেনি চাবুক নিয়ে। ঝড় ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে দিতে হবে পাড়ি। মেঘনাদ যেন চটকলেরই মিস্তিরি। টাকার বিষ ফুটে ওঠেনি তার কথার ব্যাপারে।

দু জনেই বেরিয়ে এল রাস্তায়। রাস্তা নয়, বাজার। মেঘুর চোখের সামনে ভেসে উঠল ঢাকা শহরের রাজপথের কথা। বিশেষ করে নবাবপুর ইসলামপুরের কথা। গাড়ি ঘোড়া মানুষের মিছিল সঙ্কীর্ণ পথে পথে । মানুষ ঠেলাঠেলি করে চলেছে রাস্তায়।

বিজয় হঠাৎ বলল, তা হলে তো একটু কিছু করতে হয়। তোমার মিস্তিরিগিরিও শালা আবার আলাদা। আমি শুধু চটকলের মিস্তিরিগিরিই জানি।

আসলে, মেঘনাদের জন্য বিজয়ের মনে একটু ভাবনা আছে। কী ভাবে কাজ আরম্ভ করতে চায়। সেটা জানতে চায় সে।

মেঘনাদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে বলল, কারখানা চাই, লোক চাই, তার আগে চাই ময়দার পারমিট । এতদিন ধরে যে কাজ করেছি, তা আবার নতুন করে আরম্ভ করতে হবে।

বিজয় খালি বলল, আরে বাপরে বাপ। এ তো শালা একটা রাজ্যি চালাবার ব্যাপার।

তারপরেই দেশবিদেশের আলোচনায় এসে পড়ল তারা।

বিজয় বলল, আমার তো শালা কিছু মাথায়ই ঢোকে না। দেশ ভাগ হলেই নাকি স্বাধীন।

মেঘনাদেরও প্রায় সেই অবস্থা। সে বলল, স্বাধীন হয়ে কী হবে, আমি কিছুই বুঝতে পারিনে।

বিজয় বলল, স্বাধীনতা সবাই চায়। মানে, এই যে তোমার ইংরেজ ছেড়ে চলে যাবে বলছে, সেটা সবাই চায়। কিন্তু দেশ ভাগাভাগি হলে, ওদেশের হিন্দুরা কী করবে? সব শালা লোটা বাটি নিয়ে চলে আসবে?

মেঘু বলল, তা তো আসতেই হবে। সব তো আসবে আসবেই করছে। বিলেত থেকে নাকি কোন সাহেবরা এসেছে। তারাই সব ঠিকঠাক করে দেবে। কিন্তু আমি বলছি, ইংরেজরা চলে যাবে বলছে। ওদের কারখানাগুলিও ছেড়ে যাবে?

বিজয় বলল, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজীবদাকে।

: রাজীবদা কে?

: আমাদের ইউনিয়নের নেতা। মানে মজুর ইউনিয়নের। আমাদের বাড়িতে আসে প্রায়ই। রাজীবদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার মতো। বললে, আজকে না যাক দশ বছর বাদে যাবে। তা ছাড়া, ওরা গেলে কারখানা চালাবে কে। সব তো বেকার হয়ে পড়বে।

: কেন, দেশের লোক চালাবে? দেশের লোক কি কারখানা চালাতে পারে না?

: বাঃ, ওদের জিনিসপত্র কারখানা, ওরা এমনি দেবে নাকি? টাকা চাইনে?

: কেন? ওরা কি সব বিলেত থেকে নিয়ে এসেছিল?

কথাটা বলে ফেলে নিজেকে কী রকম বোকা-বোকা মনে হল মেঘনাদের। এ আবার কী বলে। ফেলল সে। বিজয় নিশ্চয় হেসে উঠবে। নিয়ে না আসুক, তৈরি তো করেছে।

কিন্তু বিজয় হাসল না। চিন্তান্বিতভাবে বলল, হু। তুমি বলছ মানে, একটা পুরো স্বাধীনতার কথা। ঠিকই। রাজীবদা বলে, আস্তে আস্তে হবে সব।

আস্তে আস্তে হবে। দু জনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল।

মেঘনাদ খালি বলল, তাই তো বলছি। তবে দেশ ভাগ করে কী হবে? আমরা সব মরে যাব। পূর্বদেশের লোকগুলি জ্যান্তে মরব সব।

: তবে দাঙ্গাটা থেমে যাবে।

: কেন?

: ভাগাভাগি নিয়ে তো দাঙ্গা। সেটা হলেই, সব শান্ত।

মেঘনাদ চুপ করে রইল। দাঙ্গা থেমে যাবে তাতে? তা থামুক। তারপর এদেশে ওদের লোকগুলি করবে কী !

হঠাৎ জলের ছলছল শব্দে মনটা অন্য জগতে ফিরে এল। সামনেই মস্ত বড় মাঠ। উঁচু মাঠের নীচেই গঙ্গা। গঙ্গার দু পাশে দূরে আলোর মালা। যেন দেওয়ালির দীপ সাজিয়ে দিয়েছে দু পারে। জলে তার স্বর্ণরেখা কাঁপছে ঝিকিমিকি। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে। স্রোতের টানে গলে গলে ছুটে চলেছে।

জলের আলোতেই তাদের মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠল অন্ধকারে। তাদের দুজনেরই মুখে একটা অস্পষ্ট ব্যথার ছাপ। দেশ বিভাগ কিংবা স্বাধীনতা, এর সঠিক অর্থ তারা কিছুই বোঝে না। অথচ দুই ভিন্ন। পথে, তাদের দু জনের জীবনেই অনেক সংকট, সমস্যা, ব্যথা ও বেদনা। যেন, দেশের এত ব্যাপারের সঙ্গে, তারা তাদের জীবনের কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।

বিজয় খালি বলল, গঙ্গা।

তারপর দুজনেই বিড়ি ধরাল। অনেকক্ষণ পর বিজয় বলল, হয়ে যাবে, বুঝলে বোনাই। দু চারদিন যাক, তারপর আরম্ভ করতে পারবে।

মেঘনাদ ফিরে তাকাল বিজয়ের দিকে। বিজয় দেখল, একটা পাথরের মতো মুখ মেঘনাদের। তারপর আবার বলল সে, তবে একটা কথা। তোমার টাকা পয়সা সব সরিয়ে ফেলতে হবে।

মেঘনাদ অবাক হয়ে বলল, কোথায়?

: পোস্ট অফিসে। খোলামেলা বস্তি বাড়ি। কখন কী হয় বলা তো যায় না। কিছু একটা হলে তখন মাথা কুটতে হবে।

মেঘনাদ আর একবার দেখল বিজয়ের মুখের দিকে। যেন বিপিন কথা বলছে। বলল, আচ্ছা।

আকাশে দুটি একটি নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। বাতাস নেই। তবু গঙ্গার ধারটা ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে।

অনেকক্ষণ বসে থেকে বিজয় আবার বলল, হয়ে যাবে, তুমি ভেবো না।

গঙ্গা ছলাৎ ছলাৎ করে ঘা খেতে লাগল পাড়ে। ধলেশ্বরীও বাজত এমনি করে। তার হাসি শুধু অন্ধকারে নক্ষত্রের ঝিকিমিক। এখানে সে হাসির বান ডেকেছে, কিনারে আলোর প্রতিবিম্ব। নিরলস বাহিত গঙ্গার নীচের হাসিটুকুও যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে আলোকময় ঢেউয়ের মাথায়। সেও যেন বিজয়ের কথারই প্রতিধ্বনি করতে লাগল, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে।

.

দিন চলে গেল।

সেইদিন গঙ্গার ধার থেকে, বিজয়ের সঙ্গে ফিরে এসে মনটা আবার শান্ত হয়ে এল মেঘুর। ঘরে ঢোকবার আগেই দেখা হল তিলি আর লীলার সঙ্গে। পিপুল তলায় বসে আছে দুই বোন। ঠিক বসে নেই। অল্প অল্প ঘাসের উপর এলিয়ে আছে যেন। গলিটাতে কয়েকটা ইলেকট্রিক আলো । আছে। নিষ্প্রভ ম্লান আলো। সামনের অন্ধকারটুকুকে কেবল খানিকটা গা ছমছমে কুহেলিকাপূর্ণ করে তুলেছে, কোথায় ঢোল করতালের সঙ্গে তীব্র উচ্চ গলায় পশ্চিমি নামগান চলছে। গলিটার উপরে এখানে সেখানে খাঁটিয়া পেতে বসেছে ছোটখাটো জটলা। কোথায় নারীকণ্ঠের কলহের কলরব। কান পাতলে আরও অনেক কাহিনী শোনা যেতে পারে। বিচিত্র কাহিনী। ব্যথা, জ্বালা, অতি গোপন ও অশ্লীল কাহিনী।

এখানে এই পিপুল তলায় দুই বোন। গলি রাস্তা থেকে কাঁচা নর্দমার সীমান্ত পেরিয়ে এই এক ফালি জায়গা। রাস্তার আলোর একটু রেশ এসে পড়েছে এখানে। সেই আবছায়াতে, কচক করছে। দুই বোন। হঠাৎ সাপ দেখার মতো চমকে দাঁড়াতে হয়। লীলার কালো রঙটাই অমনি। তিলিকেও। তাই দেখাচ্ছে এখন। দু জনেই তারা সেজে আছে। লীলা তার নিজের একখানি পোশাকি ভাল শাড়ি দিয়েছে তিলিকে পরতে। কানে সোনার দুল পরিয়ে দিয়েছে। গলায় দিয়েছে হার। তার। অনেক সোনা থেকে এক চিমটি তুলে দিয়েছে বোনের গায়ে। তার নিজের গায়েও জরির কাজ করা তাঁতের শাড়ি। কাছে আসতেই, একটা অদ্ভুত সুগন্ধ নাকে এসে লাগে। চাপা চাপা গন্ধ।

মেঘু চেনে এ গন্ধ । লীলা অনেক আতর সেন্ট কিনেছে। এ গন্ধ তারই একটি। মেঘনাদ বলল তিলিকে, বাসরে, খুব যে সেজেছ বেড়িয়ে এলে না চললে?

মেঘুর ছায়া পড়েছে তাদের গায়ে। তিলি বলল, চললাম।

মেঘু বলল, কোথায়?

তিলি চাপা হাসি হেসে বলল, কোথায় আবার? রাত করে, সেজেগুঁজে যেখানে যাওয়া যায়।

চাপা হাসির শব্দটা হঠাৎ ঠুং করে একবার বেজে উঠল।

আবার বলল, দিদিও যাবে।

মেঘুও হাসল। বলল, গেলে আর কী করতে পারি, বলল।

লীলা বলে উঠল তিলিকে, কাকে বলছিস? বউ যাবে, সে ভয় ওর আছে? গেলই বা যা খুশি তা করলই বা। তাতে কী। সে হত অন্য কিছু গেলে…

তিলি দিদির গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, তা বলে তোমরা ঝগড়া লাগিয়ো না বাপু। প্রসঙ্গটা পালটে নিয়ে বলল তিলি, দেখো, দিদি আমাকে কী দিয়েছে। শাড়ি সোনা, সবই দিয়েছে। দেখো; বউকে আবার খুসো না যেন তার জন্যে। খুসবে কেন? এইটুকু তো চেয়েছিল মেঘনাদ। কেউ কিছু পেয়ে, নিয়ে, হাসবে খুশি হয়ে। লীলা ছাড়া কাউকে সে কিছু দেয়নি কোনওদিন। ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে শূন্য তার ঘর। দিয়ে ভরে দিয়েছে লীলাকে। কিন্তু লীলা কাউকে কোনওদিন কিছু দিয়েছে বলে সে শোনেনি। তার জন্য ঘরের ব্যথাটা কেউ কোনওদিন বোঝেনি । যে তার বোঝে অনেকখানি, সেই বিপিনও এটুকু ঠিক জানে না। ঘরে অনেক মানুষ, সবাইকে নিয়ে, দিয়ে, ডেকে হেঁকে জীবন কাটাতে চেয়েছিল সে।

একটি শিশু যদি বা এসেছিল, সে রইল না। লীলা কোনওদিন কেঁদেছে কি না, তাও সে জানে । লীলার ওইটি প্রথম সন্তান। আশঙ্কা ছিল প্রসব হতে নাকি তার বিপদ হতে পারে। সেই বিপদ পার হলে, অনেক যন্ত্রণার মধ্যে যাকে পেয়েছিল, সে রইল না। রুক্ষ নোংরা বেশে, কয়েকদিন প্রেতিনী সেজে বসেছিল লীলা একলা। যেন রাগটাই তার প্রধান। চোখ জ্বলেছে ধিকি ধিকি। বৃথা কষ্ট ভোগ। অকারণ শুধু যন্ত্রণা দেওয়া। এ বিদ্বেষের মধ্যে কোনও ক্ষুধার অন্তঃস্রোত ছিল কি না, কেউ জানে না।

সে রইল না। থাকলে তাকে হয়তো লীলা দিত অনেক কিছু। আজ লীলা দিয়েছে তার বোনকে। দেয়নি, পরতে দিয়েছে হয়তো। তবু মনটা ভরে উঠল মেঘুর। সত্যি, আজ লীলার সব লীলাই অন্যরকম। আজ সে দিদি, ননদ, মেয়ে। সে যদি আরও দিত, তাতেও দুঃখিত হত না মেঘু।

খুশি হয়ে তাকাল সে লীলার দিকে। তার সে চাউনি দেখা যায় না। একে অন্ধকার, তার উপরে ভুর ছায়া। সে বলল, খুসবো কেন? যার জিনিস সে দিয়েছে। আমার হলে খুসতাম।

: এ বুঝি তোমার নিজের নয়?

: যা দিয়ে দিয়েছি, তা কি আর নিজের থাকে?

তিলি বলল, আচ্ছা, দেখা যাবে।

উঠে পড়ল দু জনেই। হেসে ফেলল পরস্পরের দিকে চেয়ে। বলা হল না, কোথায় গেছল তারা। সুকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে গেছল তারা। সামনেই গঙ্গার ধারে এক রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে। সেখানে গেছল তারা।

ওদিকে বিজয় নিয়ে পড়েছে তার ছেলে বউকে। নকুড় তন্দ্রাচ্ছন্ন। নেশা করে এসেছে। সুকুমারী অন্ধকারে বসে শুধু দেখছে সবাইকে। বাড়িটার উঠোনে মেয়েপুরুষের জটলা।

রাত্রে, কোণের ঘরে শুতে গেল মেঘু। কিছুক্ষণ পর এল লীলা। পান ঠাসা দুই ঠোঁট টিপে রয়েছে। যেন আগুন লেগেছে ঠোঁটে। এসে, এক টানে জামাটি খুলল আগে। বেশি ঢাকাঢাকি নেই তার কোনওদিনই। পাতলা তাঁতের শাড়িটা টেনে দিল একটু। গরমও তেমনি। মেঘুর সামনেই সায়া খুলে রেখে দিল।

মেঘু সে সব দেখছিল না। সে লীলার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ধরে কাছে টেনে নিয়ে এল তাকে।

লীলা ভ্রূ কুঁচকে ফিরে তাকাল। ভ্রূ কোঁচকালে তার একটি ভ্রূ নেমে আসে। আর একটি ভ্রূ উঠে যায়। যেন বিরাগ ও বিদ্রুপের লক্ষণ। একটু যেন অবাকই হয়েছে ! বলল, কী হল?

লীলার কথা, ভাবভঙ্গির কাছে মেঘুকে খানিকটা স্কুল মনে হয়। হৃদয়ে প্রেম থাকলেই তার রীতিনীতি আচার ব্যবহার রপ্ত করা যায় না। এ ব্যাপারে মেঘু চিরদিনই একরকম। বলল, কিছু নয়। তোমাকে বড় ভাল লাগছে। 

লীলার ভ্রূ জোড়া আরও বেঁকল। মনে পড়ল হঠাৎ সিরাজদিঘার কারবারি পীতাম্বর সা যে দিন পয়সা লাভ করত, সে দিন কীর্তন গাইত সারা রাত। লোকে বলত, পীতাম্বর আজ দু পয়সা পিটেছে। মেঘুর খুশির মধ্যে লীলা শুধু ওই জাতীয় কিছু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। তাই তেমনি বিদ্রূপভরেই বলল, হঠাৎ কেন?

হঠাৎ কোথায়। বউকে তো মেঘুর ভালই লাগে। ভাল লাগাটুকু মাঝে মাঝে বড় বিষিয়ে দেয় লীলা। কেন, মেঘু তা জানে না। সে বলল, কেন আবার। ভালই তো লাগে।

লীলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঘুর চোখের দিকে তাকাল। বলল, সত্যি নাকি?

তারপর হঠাৎ গলার স্বরটা পরিবর্তন করে ফেলল, কারবারের কিছু হল?

ভাল লাগার কারণ অনুসন্ধান করছে লীলা। মেঘু বুঝতে পারেনি। সে হতাশায় ঘাড় নেড়ে বলল, না, কিছুই না। বিজয় এ সবের তো কিছুই বোঝে না।

যুগপৎ বিস্ময়ে আশায় চকচক করে উঠল লীলার চোখ। তার বহুদিনের আকাঙক্ষা যেন মূর্তি ধরছে। মেঘুর এই হতাশা আর লীলাকে ভাল লাগা। একই সঙ্গে, এই দুটি জিনিস। লীলার মনে হল, এমনটিই বুঝি চেয়েছিল সে। অখণ্ড হৃদয়ের নিরঙ্কুশ রাজ্য বিনা তার সুখ নেই। আজ কি সেই রাজ্যের দরজা খুলছে তার সামনে। শুধু তারই মাঝখানে ছড়িয়ে দেবে মেঘু নিজেকে।

তবুও সংশয় যায় না। সন্দেহ ঘোচ না। আজ আশা। কাল আবার নিরাশা। শীলা দূরে সরে যাবে আবার তখন।

কিন্তু লীলাকে কেন্দ্র করে মেঘুর অত ভাবনার ঘোর্যাচ নেই। তার মন খারাপ। লীলাকে ভাল লাগছে। সেইটুকু তার বদ্ধ হৃদয়ে বাতাসের মতো। ভাল লেগেছে, তাই সোহাগ উথলে উঠেছে তার। লীলা সন্তর্পণে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গ্রহণ করছে সেই আদর। বহু বছর আগে ফেলে-আসা। সোনাদুলি চরের সেই প্রাণে যেন টান লাগল একটু।

এই ঘরের-ই টিনের বেড়ার ওপাশে, টিন ঘেঁষে শুয়ে আছে তিলি। তার পাশে সুকুমারী। তাদের মাথার দিকে উলটো করে শুয়েছে নকুড়। ঘরের মাঝখানে সামান্য দু একটা কাঠের বাকস, বালতি, থালা বাসন। এক টুকরো কাপড় ঝোলানো দড়িতে। সব মিলিয়ে পাটিশন হয়ে গেছে। পার্টিশনের ওপাশে বিজয়, বউ আর ছেলে।

শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে শুধু তিলি। ওধারে বিজয় আর বউ থাকে খানিকক্ষণ। তারপর ওদের ঘুমন্ত নিশ্বাস শোনা যায়। সুকুমারী একবার ঘুমোয় আবার জাগে। নকুড় সারারাত্রি কাশে, কী যেন বকবক করে গোঙানির মতো। সুকুমারী ধমকালে থামে। এই হয় সারারাত। শুধু অনেকক্ষণ জেগে থাকে তিলি।

আজও জেগে আছে। নিজেও জানত না, লীলার ঘরের টিনে কেন অতখানি কান চেপে শুয়েছে সে। কিছুই শোনা যায় না। একটু আধটু খুট খাট ছাড়া। ইঁদুরেরা করতে পারে সেরকম। মনে হয়, চিরকাল ইঁদুরের খুট খাট টুক টাক শব্দই শুনেছে সে৷ কোনও কণ্ঠস্বর, কিংবা কোনও পদশব্দ কোনওদিনই বাজেনি বুঝি কানে। যা বাজবে কানে, তা যে হৃদয়ে বাজবে।

এইখানে সে শুয়ে থাকে। তার পাশে শুয়ে থাকে এক বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের বিড়বিড় করার অর্থ সে বোঝে না। এ বয়সের ভালবাসার ভাষাও জানা নেই। কেবল মাঝে মাঝে হয়তো সুকুমারী বলে নকুড়কে, দেখি, একটু হাত পা ছড়িয়ে শোও, আমি বাতাস করি।

সেটুকু এমন করে বলে সুকুমারী, যেন তিলির ঘুম না ভাঙে। ওদিকে, বিজয়ের অস্ফুট কণ্ঠ পরিস্ফুট হয় কোনও কোনওদিন রাত্রে। উভয়ের গলাও শোনা যায়। ছেলেটাও ঘুম ভেঙে মাঝরাত্রে কোল ধামসায় বাপ মায়ের। বিচিত্র মিষ্টি স্বরে হেসে ওঠে। বিজয় বলে, চাপা হেসে, চুপ কর শালার ছেলে। ওদের ঘুম ভাঙবে। সুকুমারী জেগে থাকলে শব্দ করে ওঠে খানিকক্ষণ বাদে। যাতে ওরা সত্যি চুপ করে। সবাই ভাবে, তিলি শুধু ঘুমোয়।

এত দিন তার শিয়রের এধারে ওধারে বয়সের উত্তর দক্ষিণ নিয়ে থাকত দুই জোড়া। পাশের ঘরে আজ আর এক জোড়া। তিন দিক থেকে তিন জোড়া ঘিরে আছে তাকে। সবাই ভাবে, তিলি বুঝি শুধু ঘুমিয়ে থাকে। জেগে থাকে শুধু ওরা।

তিলি ঘুমোতে চায়। পারে না। চব্বিশ বছরের চব্বিশটা ফণা মেলে এক অজানা সূতাশঙ্খ হিসহিস করে তার শিয়রে। ছোবলায়, বিষ ঢালে। সারা অঙ্গে বিষ নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। সে ঘুমিয়েছে কবে। ভাবে, ঘুম আসবে কবে। ওদের মতে, এ ঘুমন্ত সংসারটার মতো গাঢ় নিদ্রা কবে বসবে এসে তার চোখের পাতা জুড়ে।

আজ কানের পাতা দুটিও টনটন করছে। কানে দুল পরেছে। ছিদ্র দুটি বন্ধ হয়নি। সঙ্কীর্ণ হয়েছে আরও। দুলের আংটাটা তার চেয়ে মোটা লাগছে। মাঝে মাঝে চমকে গলায় হাত দিচ্ছে। কী যেন ছপাৎ করে গলার এপাশে ওপাশে যাচ্ছে। গলায় হার রয়েছে।

তারপর লীলার কথা মনে হয়। কোথায় যেন খচ খচ করে লাগে তার মনে। স্বামীর কথা বললেই ঠোঁট উলটায়। তার চব্বিশ বছরের চেয়েও দিদির আগুনের হলকা যেন আরও তীব্র। বিতৃষ্ণা ও বাসনার যুগপৎ লীলায় দিদি প্রতিমুহূর্তে যেন ক্রুদ্ধ ও হিংস্র। কেন? জামাইবাবুকে ভালবাসে না নাকি? ওই রকম একটা ভাল মানুষ। সারাদিনে অনেকবার লক্ষ করে দেখেছে সে। মেঘুর দিকে। কেমন ভাবে মানুষটা তাকাচ্ছিল দিদির দিকে। পুরুষ অমনি করে তাকালে আর বুঝতে কি বাকি থাকে!

 রাত্রি যেতে থাকে। তিলি এক সময়ে ওঠে। বারান্দায় গিয়ে বালতি থেকে জল নিয়ে দেয় চোখে মুখে। দিয়ে, পা ছড়িয়ে বসে বাইরে।

একটু পরেই, অন্যদিকের অন্ধকার কোলে জ্বলে ওঠে বিড়ির ফুলকি। মহেন্দ্ৰমিস্তিরির ভাই হরেন্দ্র। বাইরে শোয় রাত্রে। সারা রাত জেগে থাকে কিনা কে জানে। তিলি যখনই বাইরে আসে, তখনই বিড়ির ফুলকি জ্বলে ওঠে। তারপর চাপা শিস কেঁপে কেঁপে ওঠে। তিলি উঠে পড়ে। সবই ইঁদুরের খুটখাট। কী হবে শুনে।

শেষ পর্যন্ত কিন্তু জেগে থাকে একজন। অসহ্য গরমে ঘামে, কোনও কিছুতেই তার খেয়াল নেই। সে মেঘনাদ। চোখের উপর ভাসছে শুধু সিরাজদিঘির হাট। আর ভবিষ্যতের বিচিত্র সব পরিকল্পনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *