১.২ চমকে উঠল মেঘনাদ

চমকে উঠল মেঘনাদ। ছিঁড়ে গেল ভাবনার জাল। ট্রেন ব্রেক করেছে আর লীলা, তার বউ ঝুমি একেবারে ঢলে পড়েছে তার বুকে।

কয়েক মুহূর্ত অসাড় আড়ষ্ট নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সে লীলার দিকে। তীব্র ঝকঝকে কালো লীলার মুখ। আয়ত শাণিত চোখ। আচমকা ঘুমভাঙা, লাল ছড় ফোঁটা চোখেও তার কী অদ্ভুত চকমকানি। তার রক্তাভ ঠোঁট, সুগঠিত কাঁধ, আধখোলা পুষ্ট বুক, সবই চকচক করছে। আচমকা ঢলে পড়ে দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে মেঘনাদকে। চকিতে কাঁটা দিয়ে উঠল মেঘনাদের বুকে। ধলেশ্বরীর বুকে সেই কালনাগিনী যেন পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে।

সে ছাড়াবার চেষ্টা করল। লীলা ছাড়ল না। হাসি ও অভিমান তার ক্ষণে ক্ষণে। নিয়তই ছোটখাটো জেদ করা তার চারিত্রিক ধর্ম। খুনসুটি করা তার স্বভাব। লজ্জার বালাই কম। পরপুরুষের সামনে নেই ভয় ও সঙ্কোচ। মনের মতো মানুষ হলে হলাগলারও সীমা থাকে না। কিন্তু কতখানি, সে পরিমাপ বোধ তার নিজের। কার কতখানি অধিকার, সেটুকু নির্ভর করে তার নিজের উপর। আবার, এই হলাগলা এই রাগারাগি। অধিকার বোধ, হুকুম, চিৎকার, হাসি, কান্না ও রাগ-অভিমান, সব মিলিয়ে নিজের পরিচয়ে অদ্বিতীয়া। বিয়ে ও বিয়ের আগে, দুই জীবনের সমষ্টিগত ফলস্বরূপ আজকের এই ঝুমি।

মেঘনাদ ছাড়াবার চেষ্টা করল। সে ছাড়লে । অনেকক্ষণ থেকে সে দেখেছে মেঘনাদের এই ভাব। লীলার সঙ্গে একটা কথাও সে বলেনি। বলেনি প্রায় গত কয়েক দিন থেকে। তাতে রাগ হয়েছে, অভিমান হয়েছে কুমির। তার দাম সে খুব কমই পায় মেঘনাদের কাছ থেকে। তবুও হয়, কাছাকাছি লাগালাগি থাকতে গেলেই হয়। কে রোধ করতে পারে।

যে-ই পারুক, লীলা পারে না। তাকে যত বাধা দেবে, সে তত বাড়বে। যত চাপবে, তত উঠবে। নিজের অধিকার তার বিবেচনাহীন। আর সে অধিকারকে সে ক্ষুণ্ণ হতে দিতে চায় না। কোনও সময়েই। তবে, পেরে ওঠে না সব সময় মেঘনাদের সঙ্গে। সময়তে মেঘনাদও অবশ্য হার মানে। মানতে হয় রাগে, ক্ষোভে, যখন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তাতে অনেক সময় ক্ষতিও স্বীকার করতে হয়। তবুও লীলা প্রাণচারিণী। বুদ্ধি তার কাছে বড় জিনিস নয়। আবার মেঘনাদের জীবনে সে জড়িয়ে আছে, তবু যেন শিকড়হীন। শুধু প্রাণের আবেগে চলার গতি-ভঙ্গিই বোধ হয় এমনি।

এই যে হাত টানাটানি, একটুও খেয়াল নেই কামরার লোকেরা তা দেখছে কিনা। দেখছে অবশ্য দু একজন। কেউ নির্বিকারভাবে, কেউ বিকারগ্রস্ত বিস্ময়ে কিংবা বিরক্তিতে। কেবল, দিব্যি হাসছে সেই ছেলেটা। যেন ঘরের ছেলে, ভারী মজা পেয়েছে, এমনি তার হাসিটি। লীলা তীব্র গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার? হয়েছে কী?

আরও বিরক্ত হয় মেঘনাদ। মুখটা তার আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে জবাব দেয়, তার কিছুই হয়নি।

এই নিঃশব্দ জবাব শুধু কঠিন নয়, একটু করুণও বটে। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে বাঁকা চোখে তাকাল সে মেঘনাদের দিকে। নাকের পাটা ফুলে ঝিকমিকিয়ে উঠল নাকছাবি। তারপর দুরন্তভাবে ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। আপন মনে আঁচল গোছাল, ব্লাউজটা দিল টেনে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই বুক যেমন উদাস, তেমন উদাস হয়ে পড়ল। তারপর আবার মেঘনাদের দিকে তার বিশাল শাণিত চোখের খোঁচা দিয়ে বলল, যেন আমি একটা কিছু অপরাধ করেছি। ভাবখানা, যেন তোমাকে কেউ রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে ! মরণ ! মুখ দেখতে নেই এ সব মানুষের।

বলে আবার ঝামটা দিয়ে সরিয়ে নিল মুখ। আর বেঁকে উঠল তাম্বুলরঞ্জিত রক্তিম ঠোঁট। 

কিন্তু যাকে বলা, তার খেয়াল নেই, তার বোধ নেই। আবার চেতনহারা হয়ে পড়ছে সে।

কেবল, হে, হেকরে হেসে উঠল সেই ছেলেটা। এই নাটকের একজন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কবান দর্শক।

হাসি শুনে লীলাও তাকাল। আশ্চর্য ! অমনি তারও মুখে যেন একটা চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল।

সুযোগ বুঝে ছেলেটা আরও একটু হেসে পুরনো গল্পটা ফেঁদে বসার উপক্রম করল। কিন্তু, অবাক ! লীলাবতী ঝিমুচ্ছে। চোখের পাতা আধবোজা। চাপা হাসি সরল হাসির মতো ছড়িয়ে পড়েছে সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখে স্বপ্নের ব্যঞ্জনাতে।

ছেলেটা বিস্মিত হয়ে কয়েক মুহূর্ত লীলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে ফেলল। কেন যে হেসে ফেলল, তার সঠিক কারণ জানা নেই। লীলার ঘুম দেখে হাসি তার আপনি এসে পড়েছে। কিন্তু গান ধরবার তার সাহস হল না। খানিকক্ষণ একবার এদিক, একবার ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ ডাকল, বাবু!

মেঘনাদকে ডাকছে। কিন্তু মেঘনাদ তা বুঝতে পারেনি। সে ডুবে গিয়েছিল নিজের মনে। আবার ডাকল সে, বাবু!

মেঘনাদ ফিরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর মুখ ! মস্তবড় তামাটে মুখটাতে রক্ত ফুটে উঠেছে। গোঁফ জোড়া রয়েছে খাড়া হয়ে। সজারুর কাঁটার মতো উচিয়ে উঠেছে। কথা নেই, শুধু তাকাল ছেলেটার দিকে।

ছেলেটা সসঙ্কোচে এক গাল হাসল। হেসে বলল, রাত কাবার হতে চায় না। একটা বিড়ি দিবেন?

খুবই পরিষ্কার কথা। সহজ প্রার্থনা। তবু মেঘনাদ খানিকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। শুনেছে, তবু যেন বোধগম্য হয়নি, এমনিভাবে তাকিয়ে রইল। আর ছেলেটা ভাবল, বাবু চটে গেছে। রাগ করেছে ভীষণ। ওই মুখের দিকে, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তার। সঙ্কোচ হচ্ছে। ভয়ও যে একেবারে না করছে, তা নয়।

কিন্তু মেঘনাদ একটি কথাও না বলে পকেট থেকে বার করল এক গোছা বিড়ি। দৈনিক সে শতখানেক বিড়ি খায়। যারা চেনে মেঘনাদকে, তারা মুখে বিড়িহীন মেঘনাদের কথা চিন্তা করতে পারে না। কিন্তু সেই মেঘনাদ গতকাল থেকে বিড়ি খায়নি একরকম। খাওয়ার অবসর পায়নি, মনেও হয়নি খাওয়ার কথা।

এক গোছা বিড়ি সবই ছেলেটার কোলের উপর ছুড়ে ফেলল সে। এক রাশ ছুঁচোবাজির মতো ছড়িয়ে পড়ল বিড়িগুলি। তার সঙ্গে একটা আধছেড়া বিড়ির বান্ডিলের কাগজ। সেই কাগজে ছাপা রয়েছে একটা মেয়েমানুষের মুখ।

একটার বদলে এতগুলি! ছেলেটা বিস্ময়ে ও অস্বস্তিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল মিনিটখানেক। কিন্তু মেঘনাদ যেন ঝঞ্জাট মিটিয়ে আবার চলে গেল তার পথে। ফিরে যেতেই হবে। যেতে হবে সেই পাগল বাঁশির সুরে সাড়া দিতে। সে যে বিষের বাঁশি।

ছেলেটা তুলে নিল বিড়িগুলি একটা একটা করে।

গাড়ি থেমেছিল, আবার চলতে আরম্ভ করেছে। ভলকে ভলকে ছড়িয়ে দিচ্ছে কালো ধোঁয়ার রাশি আর কয়লার গুঁড়ো। তারই সঙ্গে জোনাকির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ।

মেঘনাদ এই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতেই আবার মনে পড়ে গেল সেই মেঘুর কথা। নদীর উত্তাল তরঙ্গে ভাসা একটা শুকনো পাতার মতো সেই ছেলে ভেসে গেছে ধলেশ্বরীর স্রোতে।

নদীতে ঝাঁপ দিতে পারল না। বরং তার আতঙ্কিত কিশোর চোখে ভেসে উঠল, বাঁকশালের খাল আর জল থেকে উদ্ধার করা নয়ন সার সেই মরা বউ। ফোলা শরীর, ছাতলা লাগা, শেওলা পড়া, কচুরিপানার শিকড়ের মতো এলানো চুল, বীভৎস মূর্তি। ডুব দিলে সেই নয়ন সার বউ তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরবে। জড়িয়ে ধরবে পানু চক্কোত্তি। বোগড়া দাঁত বের করে বলবে, আয়, তোর জন্যেই এই ধলেশ্বরীর জলের তলায় আমরা ওত পেতে বসেছিলাম।

না, না, ওদের হাতে যেতে চায় না মেঘু। মেঘু মরতে চেয়েছিল। কিন্তু মরণের চেহারা যে এমন রূপে দেখা দেবে, তা সে জানত না।

তার ছোট হৃদয়ের অসহ্য উত্তেজনা যখন কিছু কমল, তখন আবার কান্না এল তার। নিজেরই অজ্ঞাতে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল সে।

বিকাল হয়ে এসেছে। নতুন হেমন্তের লাল আকাশ উদার, গম্ভীর ও করুণ। সাপটা কখন অদৃশ্য হয়েছে। কল কল করে ধলেশ্বরী আপনমনে চলেছে গান গেয়ে। লাল আকাশের ছাপ পড়ে লজ্জারুণ হয়ে উঠেছে।

মেঘু শুনল, তার বাবা তাকে ডাকছে। ডাকছে, মেঘু, উঠে আয় বাবা ওখান থেকে। 

মেঘু ফিরে দেখল, উশকো খুশকো চুল, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত তার বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পেছনে। মেঘু বলল; কোথায় যাব?

বাবা বলল, অনস্তির ঘাটে।

কেন?

সেখান থেকে গহনার নৌকা ছাড়বে। গোয়ালাদের নৌকা যাবে। তুই সেই নৌকায় করে চলে যা। তুই বললে, ওরা তোকে বিনা পয়সায় নিয়ে যাবে।

কোথায় যাব?

যেখানে তোর খুশি। এক জায়গা থেকে আর জায়গায়, দেশ হতে দেশান্তরে। যেমন করে ঘুরেছি আমি, তেমনি করে। সাহা ঘরের ছেলে তুই লক্ষ্মীর খোঁজ না করলে তোর পাপ হবে। সাহারা কেউ অলক্ষ্মীর ছেলে নয়। তুই যা।

বাবা! আবার গলা বন্ধ হয়ে আসছে মেঘুর।

বাবা বলল, ভয় নেই। কাঁদিসনে মেঘু। যেখানে যাবি, সেখানেই দেখতে পাবি তোর বাবার চোখের জল। চোখের জলে কিছু হয় না। ভয় নেই, ভয় নেই বাপ আমার। নৌকা ছাড়ার সময়। হল। তুই বেরিয়ে পড়।

বাবার নিশ্বাসের হাওয়া লাগল মেঘুর গায়ে। ঠাণ্ডা নিশ্বাস। তাকিয়ে দেখল, বাবা নেই। কেবল দূরের অনন্তির ঘাটের আকাশে দেখা যাচ্ছে নৌকার মাস্তুল। এলানো পাল উড়ছে পত পত করে। আর একটা ডাক ভেসে আসছে, হে-ই, ফতুল্লা, চাষারা, ঢা…কা…ই। মাঝি ডাক দিচ্ছে। মেঘু এগিয়ে চলল অনস্তির ঘাটের দিকে।

ভেসে গেল মেঘু। ধনপতি সওদাগর ভেসে গেল সপ্তডিঙার সন্ধানে। প্রথমে ঢাকা শহরে। সেখান থেকে অন্যান্য জেলার শহরে শহরে। কখনও চাকরের বেশে, ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গী হিসাবে, নদীতে মাঝির সাহায্যকারী হয়ে। কখনও বন্দরের কুলি হয়ে, দোকানের কাজে, কীর্তনের দলের দোয়ারকি হয়ে, রুটি বাকরখানির কারখানায়।

প্রতিটি ধাপ এক একটি ছবির মতো। অনেক ছবি, গায়ে গায়ে অত্যন্ত ঘিঞ্জি ও ঠাসাঠাসি সাজানো। একটা দেখতে গেলে আর একটা ভেসে ওঠে।

মেঘু যেখানেই গেছে, প্রথমেই তার সুন্দর মুখের সর্বত্র জয় হয়েছে। পেয়েছে করুণা। তারপরেই এসেছে পীড়ন। এসেছে নানানভাবে।

দিন চলে গেছে। তুই, তুমি, শুনতে শুনতে আপনি সম্বোধন শুনে অবাক হয়েছে সে। সম্মানের জন্য নয়। বড় হয়েছে সে।

ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল তার শরীর। নিজের দিকে এক দিন তাকিয়ে দেখল সে। তার ডাগর হাত পা বুক। স্ফীত লোমশ শরীর। আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে, দেখল কালো গোঁফের সুস্পষ্ট রেখা।

তখন সে ঢাকা চকবাজারে একটা বিস্কুটের কারখানায় কাজ করে। দেহে তার প্রচণ্ড শক্তি। কারখানার জনা বারো লোকের মধ্যে প্রায় সকলেই তাকে ভয় ও ভক্তি করে।

এক নবতর চেতনায় তার মন আনন্দে ভরে উঠল। তার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে, সারা দিনে কাজ করেও মন ভরে না তার। বাকি লোকের কাজ করে দেয়। দরকার হলে আশেপাশের লোকের কাজেই সাহায্য করে। তার চরিত্র, দেহ ও মন, সব মিলিয়ে সকলের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

একদিকে তার দেহে ও মনে এই অপরিসীম শক্তি ও আবেগ, অন্যদিকে একটা অসহ্য বেদবোধ। কীসের বেদনা সে বোঝে না। থেকে থেকে মন ভার হয়ে ওঠে, বিষাদ ভর করে তার শরীর ও মন জুড়ে। মনে পড়ে খালি দেশের কথা। তাদের হাতছাড়া ঘর, লক্ষ্মণ সা’র গদি আর বাড়ি, সেই দেশ। আর কেবলই মনটা চমকে চমকে ওঠে লালমিঞার কথাটা মনে করে। সেই শেষ কথা, শোন তো সোনা মেঘু। কী মিষ্টি, কী আদরের ডাক ! কেন এত আদর করে ডেকেছিল লালমিঞা !

এক দিন মাঝরাত্রে এই চিন্তাটা ঘুমোতে দিল না তাকে। তার ঘুমহীন চোখে শুধু দেশের হাতছানি।

অন্ধকার টিনের ঘর। ঘরের অর্ধেক জুড়ে ইটের উনুন। উনুন নয়, সেটাও বিরাট অন্ধকুপ বিশেষ। ফোকর দিয়ে লাল আগুনের আভা দেখা দিচ্ছে। মেঘুই আগুন দিয়ে শুয়েছিল। সে উঠে পড়ল।

উঠে তার টিনের সুটকেশের তালা খুলে বার করল একটা ময়লা ন্যাকড়ার পুঁটলি। তার সঞ্চিত অর্থ।

এই চুলা ঘরের মধ্যে সে একা নয়, অনেকেই শুয়ে আছে গাদাগাদি করে। কিন্তু গোপনতার কিছু নেই। লম্ফ জ্বালিয়ে হিসাব করতে বসল সে, কত জমেছে। পাই পয়সা আধ পয়সা, পয়সা আনি দুয়ানি টাকা নোট ! সব মিলিয়ে কুল্যে শ তিনেক টাকা আর কিছু খুচরো। ছ সাত বছরের সঞ্চয়।

ধনপতি সওদাগর আর সপ্তডিঙা? কই, তেমন তো আর মনে পড়ে না। তবে, ভেতরে ভেতরে। তার একটা আকাঙক্ষা আজও মরেনি। জানায় অজানায়, ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় সেই আকাঙক্ষার চারা গাছের গোড়ায় সে মনের রস কিন্তু ঢেলে এসেছে। আজও জানে না, খোঁজও ঠিক রাখে না, সে কত বড় হয়েছে। কিন্তু বংশের সেই রক্তধারার মধ্যে আজও সেই একই মুখে স্রোতের টান। সে অহরহ ধাবিত তার পথে।

আজ এই টাকা তার জীবন মরণের সম্বল। মরলে, লোকে পোড়াবে এই টাকা দিয়ে কাঠ কিনে। বেকার হলে, এই রক্ত জমানো টাকা ভেঙেই খেতে হবে তাকে। হোক। তবু তার মন বসছে না। এখানে। তার রক্তে আবার দোলা লেগেছে। এই সামান্য টাকা মূলধন হতে পারে না। তবু ফিরে যেতে হবে একবার নিজের দেশে। কিছু না হোক, একটা নতুন কাজ জুটতেও পারে। একবার লালমিঞার সঙ্গে দেখাটাও হবে। তার তো বিস্কুটের কারখানা আছে। যদি কিছু না হয়, ফিরে আসতে কতক্ষণ।

পরদিনই সে কারখানা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এল দেশে, দেশের বাজারে। ভেবেছিল, উঠবে লালমিঞার গদিতে। কিন্তু সেখানে ঝাঁপ বন্ধ। গদির অদূরেই তার কারখানা। যেখানে । চিমনি দিয়ে সব সময়েই ভলকে ভলকে ধোঁয়া বেরুত। ছোটকালে মেঘু মনে করত, ওটাও একটা জাহাজের চোঙা। কিন্তু কই, ধোঁয়া বেরুচ্ছে না তো।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। লক্ষ্মণ সা’র গদিও নিঝুম। কিন্তু বাতি জ্বলছে। বাজারের কিছু কিছু লোক অবাক হয়ে এই অপরিচিত লোকটিকে দেখছিল। ঠিক দূর দেশের অপরিচিত মাঝির মতো নয়, লঞ্চ স্টিমারের, খালাসিও নয় যেন ঠিক। মুখখানা ঠিক চেনা নয়, অথচ যেন চেনা চেনা। কার মতো? সেই হতভাগা মদন দাশের মতো নাকি অনেকটা !

মেঘু বুঝতে পারছিল তাদের ভাবখানা। তার হাসিও পাচ্ছিল, কষ্টও হচ্ছিল। ওই তো বদরুদ্দিন, চালের আড়তের মহাজন বসে রয়েছে। এই তত জ্ঞান সা, কাপড়ের দোকানের কোণের তুলসী গাছের টবে জল ঢালছে। কিন্তু লালমিঞা কোথায়?

কারখানার কাছে এসে দেখল, সেটা শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। সামান্য কয়লার গুঁড়ো আর পোড়া কাঠ ছড়িয়ে রয়েছে শ্মশানের মতো। মস্ত বড় টিনের ঘর। ভেতরটা অন্ধকার। কিন্তু লোক কই?

কাছে এসে উঁকি মেরে দেখল, বড় উনুনটা পরিত্যক্ত, কাঠ বেড়া যাবতীয় জিনিসের স্কুপ হয়ে উঠেছে। একটা ছোট হাত-তণ্ডুলে জনা তিনেক কাজ করছে। তণ্ডুল, এই উনুনেরই আর এক নাম। এক জন প্রায় বৃদ্ধ মানুষ, নুয়ে পড়ে কথা বলছে এক জনের সঙ্গে। যার সঙ্গে কথা বলছে, সে বেশ ফিটফাট, পরিচ্ছন্ন মানুষ।

বৃদ্ধ লোকটির দিকে খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেই চমকে উঠল মেঘু। লালমিঞা ! ছেড়া লুঙ্গি, ছেড়া গেঞ্জি, তণ্ডুলের ধোঁয়ায় কালো শরীর। এ কী অভাবিত ব্যাপার ! অত বড় গদির মালিক, ধনী লালমিঞার এই বেশ!

লালমিঞা বাইরে মানুষ দেখে জিজ্ঞেস করল, ওখানে দাঁড়িয়ে কে?

মেঘু এক মুহূর্ত ভাবল। তারপরে জবাব দিল, আমি মেঘু।

মেঘু? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল লালমিঞা, মদন সা’র ছেলে?

হ্যাঁ।

কোথায় ছিলি, আঁ? আয় আয় বাপ। বোস, তারপরে কথা বলছি।

বলেই লালমিঞা সেই লোকটির দিকে ফিরে তার হাত দুটি ধরে কী যেন বলল। 

সেই লোকটি কোনও জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেল কঠিন মুখে।

মেঘু সামনে এসে দেখল, লালমিঞার চোখ ছলছল করছে। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে মেঘুকে অভ্যর্থনা করল সে। নিজের কথা ভুলে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল মেঘুকে। গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ওরে বাপরে, এত বড় হয়েছিস। মদনদাকেও যে ছাড়িয়ে গেছিস। বোস বোস। আসরফ, হরির দোকান থেকে দুই পয়সার মুড়ি বাতাসা নিয়ে এসো। এক পালি জল দাও।

মেঘু বলল, থাক না—

থাকবে কেন? এবার বল, কোথা থেকে এলি?

মেঘুর কথা সরে না মুখে। কী ব্যাপার। বড় তণ্ডুল খা খা করছে। ছোট তণ্ডুলে কাজ করছে মাত্র জনা কয়েক। সব দেখতে দেখতেই সে নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল, এলাম ঢাকা শহর থেকে। বলে বিস্মিত গলায় ডাকল চাচা এ সব

লালমিঞা ভীত সন্ত্রস্তভাবে তাড়াতাড়ি দু হাতে মেঘুর হাত ধরে বলল, থাক, ও সব কথা পরে হবে মেঘু।

মেঘু চুপ করল। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আচমকা ব্যথার মোচড়ানি দিয়ে বুকটা টনটন করে উঠল তার। কোনও কথা নয়, শুধু লালমিঞার মুখের দিকে তাকিয়েই এক গভীর দুঃসংবাদের সঙ্গে দারুণ যন্ত্রণার সন্ধান পেল যেন সে।

হ্যারিকেন আর লম্ফ জ্বলল। লালমিঞার এত বড় কারখানা ঘর। সমস্ত ঘরটা আলোকিত হয়ে একটা আলো আঁধারির সৃষ্টি করল। তার মধ্যে ছোট তণ্ডুলের খোলা গহ্বরটা হাঁ করে রয়েছে। গহ্বর মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। থেকে থেকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। যেন অন্ধকারের মধ্যে একটা মস্ত দানব তার রক্ত মুখ ব্যাদান করে গিলতে আসছে।

মেঘু দেখল, সামান্য ছিটের কাজ হচ্ছে। ছিটের কাজ, অর্থাৎ বিস্কুট। দেশীয় কারিগরেরা তাই বলে। সে বিস্কুটের এক এক রকমের নাম। এক এক দেশের এক এক রকম।

মেঘু দেখেছে, দুটো পেল্লাই হ্যাজাক জ্বলত এই ঘরে। আলো হত দিনের মতো। কাজ করত জনা বারো চৌদ্দ। আর লালমিঞা বার্মা দেশের রেশমি লুঙ্গি পরে, গায়ে কলিদার পাঞ্জাবি চাপিয়ে গদি থেকে এসে দেখে যেত ঘুরে ঘুরে। দরকার হলে হাতও লাগাত বই কী।

সেই লালমিঞা। ময়লা লুঙ্গি আর ছেড়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বসে আছে তার কাছে। মনে মনে মেঘুর অস্থিরতা। মুড়ি তার গলা দিয়ে যেতে চায় না।

লালমিঞা কিন্তু সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেঘুর দিকে, বলল, আর দু পয়সার এনে দেবে?

মেঘু বলল, আর আধ পয়সারও নয়। বলে ঘটি তুলে চকচক করে জল খেল অনেকটা।

লালমিঞা তুলল পুরনো কথা। মেঘুর বাবার কথা আর লক্ষ্মণ সা’র গদির ঘটনা। শুনতে শুনতে সেই পুরনো দিনে ফিরে গেল মেঘু। সে বলতে আরম্ভ করল তার জীবন বৃত্তান্ত। কী ভাবে, এত বছর সে কাটিয়েছে। কোথায় কী করেছে।

শুনতে বড় কষ্ট হচ্ছিল লালমিঞার। মেঘুর অজান্তে কয়েকবার চোখের জল মুছেছে সে।

লালমিঞাকে দিয়েছেন খোদা অসীম শক্তি। শক্তির পরীক্ষা তার উপর দিয়েই চলতে পারে। খোদা দিয়েছেন, একবার পরীক্ষা করবেন না : কিন্তু এই বাচ্চার উপর কেন? যাকে কিছুই দেওয়া হয়নি, তার আবার পরীক্ষা কীসের। জীবনে যে কিছুই পায়নি, খোদার মর্জির কাছে কী দিয়ে সে খিদমদগারি করবে !

মেঘুর কথা শেষ হলে লালমিঞা বলল, কিন্তু এখানে কেন ফিরে এলি বাপ। এখানে তুই কী পাবি? যেখানে ছিলি, সেখানেই তো ভাল ছিলি?

মেঘু বলল, চাচা, সত্যি কথা বলব?

বল তো বাবা।

তোমার ঘরে কাজ করব বলেই পালিয়ে এসেছি।

হাচা, হাচা-ই? সুখে আনন্দে হাসতে হাসতে মেঘুর চিবুকটি তুলে ধরল সে। আর অমনি তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল। শক্তিমান পুরুষ লালমিঞা আর মেঘুর সামনে রোধ করতে পারল না চোখের জল।

বলল, আমার ঘরে কাজ করবি? আমার যে ঘর নেই। আমি যে ফকির হয়েছি বাবা। খোদা যে আমাকে ছেড়ে গেছে। কী দিয়ে তোকে রাখব?

এই সর্বনাশের কথাটি চোদ্দো আনাই আঁচ করছিল মেঘু। জিজ্ঞেস করল, কেমন করে হল এ সব?

লালমিঞা বলল, বলব, সব বলব তোকে। তুই থাকবি খাবি কোথায় বল তো?

বাজারেই কোথাও থাকব।

যদি অসুবিধা না বুঝিস, আমার এ ঘরেই থাকতে পারিস। নিজের হাতেই রাঁধবি খাবি।

মেঘু বলল, বেশ তো। তা হলে তো বেঁচে যাই।

লালমিঞা বলল, তারপর লোকে যখন বলবে, মেঘু মুসলমানের ঘরে থাকে খায়?

মেঘু বলল, এ তো তোমার কারখানা। ঘর নয়। আর খাবও নিজের হাতে পাক করে। পরের কথায় কী যায় আসে। সবাই তো কিল মারার গোঁসাই, ভাত দেবে কেউ? আর কদিনই বা থাকতে পারব চাচা। চলে তো আমাকে যেতেই হবে।

কাজের শেষে লালমিঞা মেঘুকে বলল তার দুর্দশার কাহিনী। সে কাহিনী বাংলা দেশের এক চিরন্তন বিশ্বাসঘাতকতার নিষ্ঠুর কাহিনী। লালমিঞা দু বছর একেবারে শয্যাগত ছিল। কাজ চলে না, গদি বন্ধ যায়। বাধ্য হয়ে সে দেশ থেকে ডেকে পাঠাল তার দুই সতাতো ভাইদের। তারা সৎ মায়ের দুই ছেলে। দেশের ঘর বাড়ি সম্পত্তি নিয়ে এই দুই ভায়ের অনেক নক্কারজনক খবর পেয়েছে লালমিঞা। তবুও ডেকে পাঠিয়েছে। এক বাবার পয়দায়িস তারা তিন ভাই। পেট আলাদা। তাতে কী হয়েছে? ভাই তো ! আর লালমিঞা জানে কাজ। পরিশ্রম, বুদ্ধি আর সততা তার মূলধন। লোককে অবিশ্বাস সে কোনওদিন করেনি। দুস্থ সৎ ব্যবসায়ীর জন্য চিরকাল তার হৃদয় কেঁদেছে। মেঘুর বাপের কথা সে কোনওদিন ভুলতে পারবে? না, অমনি লোককে অবিশ্বাস করতে পারে কেউ ! এই যে মেঘু তুই, তোকে যে অবিশ্বাস করবে, খোদা তাকে ছাড়বে না। আসল কখনও মার খায়? মার খায় না। খাঁটি মরে না। খোদা নিজের হাতে তার দায়িত্ব নেয়। সব সময় খোদা তাকে দৌলত দেয় না। তাকে পরীক্ষা করে। তার পরীক্ষা দিয়ে, আর এক জনকে দেখে, যাচাই করে আর একজনকে। খাঁটিকে দেখে খাঁটি হতে চায় কিনা কেউ, তাই দেখে। তোর বাবা গেল। আমিও যাব হয়তো। গেছিই তো। কিন্তু সব সাচ্চা কারবারি মরবে না। দেখিস তুই।

লালমিঞা বলে গেল, বিশ্বাসের কী ভয়াবহ মর্যাদা দিয়েছে তার দুই ভাই। কী ভাবে তার অনুপস্থিতি ও রোগের সুযোগ নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করেছে তারা। দুই ভাই কী ভাবে যোগসাজস করেছে গদি আর কারখানার কর্মচারীদের সঙ্গে। সারা বাজার গ্রাম, পরগনাসুদ্ধ লোকের সঙ্গে তাদের বিবাদ। লালমিঞার চরিত্র নিয়ে যারা কোনওদিন একটি সামান্য কথাও বলতে পারেনি, তারা থুথু দিয়েছে লালমিঞার ভাইদের গায়ে।

রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে কিছু শুনেছে সে। গদি অপবিত্র করেছে তারা। বেশ্যা এনে তুলেছে সেখানে। দু বছরে একটি পয়সা জমা পড়েনি। উলটে ঘর থেকে টাকা বেরিয়েছে। এ সব খবর সে জানত না। সামান্য উড়ো খবরে সে বিশ্বাস করতে পারেনি। তার বউ তাকে সে সংবাদ দিত না। দিত না এই ভেবে, তার সোয়ামির ব্যানো বেড়ে যাবে।

কিন্তু সে তো জানত না, তার সোয়ামির ব্যানোর চেয়ে কত বড় ব্যামো অদৃশ্যে অজান্তে সোয়ামির সর্বনাশ করছে। মহেশ্বরদীর মাঝের পাড়ার মেয়ে, মেঘনা পাড়ের বউ। মন তার জল ঘাসের ডগার মতো নরম মিষ্টি আর সুন্দর। প্রাণ দিয়ে মহব্বত করা আর মহব্বত করে প্রাণে মরা, এই তার জীবনের রীতিনীতি। পিরিতির অংশীদার জোটেনি বেটির কপালে, কোলে নেই ছাওয়াল পাওয়াল। লালমিঞা তার জীবনমরণ, তার খোদা, তার পয়গম্বর। রোগ ব্যানোর মধ্যে দুঃসংবাদ সে দেবে কেমন করে তাকে। তার শুধু মাথা খারাপ হত, শ্রীনগরের ডাক্তারবাবু রায়মহাশয় সপ্তাহে একবার করে না এলে। বুড়ো মানুষ রায়মহাশয়। সদা হাসি মুখোনি। দেখলে রুগির রোগ সারত, রুগির আত্মীয়দের প্রাণ জুড়াত। ঘোড়ায় চেপে আসতেন, লালমিঞার বিবি তার সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু খুশি হয়ে আপনা হাতে ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াত।

তবু ভয়ে অশান্তিতে, বিবির অবস্থা খারাপ হয়ে উঠেছিল। স্বামীকে না জানিয়ে সে ঘর থেকে টাকা দিয়েছে বেইমান দেবরদের। শুধু তাই না, যখন যে কাগজ এনে টিপসই চেয়েছে, তাই দিয়েছে। লালমিঞা রোগশয্যায় শুয়ে ভাবত, আমি দিনে দিনে ভাল হচ্ছি, বিবির কেন মুখ শুকায়?

তারপরে এল একদিন বিপিন। সেরা কারিগর বিপিন। লালমিঞার কারখানার জন্মকাল থেকে আছে সে। তাকে সবাই বলত বড় মিস্তিরি। চাটগাঁয়ের মানুষ। ভারী কাজের লোক।

বিবি কী কাজে ব্যস্ত ছিল। নইলে বিপিন লালমিঞার কাছে আসতে পারত না। সে এসে বললে, তাকে জবাব দিয়েছে লালমিঞার ভাইয়েরা। জবাব ! কেন? খুঁটিয়ে সব বৃত্তান্ত বলল বিপিন। সর্বনাশ! এত বড় সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে! কার রোগ, কার ব্যামো। লালমিঞা লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। ব্যামো তো গদিতে। ব্যায়ো শেষ করেছে ব্যবসা।

সেই যে লাফ দিয়ে উঠেছিল লালমিঞা, সেই তার আরোগ্য হয়ে গেল। কই, আর তো সে রোগশয্যায় শোয়নি। এই তো সেই দেহ। কোথায় রোগ। রোগ ছিল তার মনে। বোধ হয় একটু আরাম চেয়েছিল সে। তাই তার রোগ কিছুতেই সারছিল না।

কিন্তু তখন শেষ অবস্থা। হাড় মাংস সব শেষ, আছে শুধু চর্বিত ছিবড়ে। তবু গদিতে এসে বসল। উলটেপালটে দেখল খাতা খতেন। কারখানায় গেল। কাজ তো আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারখানাও ফাঁকা।

মাথা গরম করেনি লালমিঞা। চুপ করে এসে বসেছে গদিতে। তার সঙ্গে বিপিন। বাদশার মতো গদিতে বসে ঠাণ্ডা গলায় হুকুম করেছে সে তার ভাইদের, আজ রাত্রের মধ্যে সরে পড়তে হবে এখান থেকে। কাল সকালে উঠে ওই মুখ দেখলে, খুনের দায়ে ফাঁসি যাবে লালমিঞা।

পালাতে পথ পেল না দুই শয়তান। ছি ছি, লালমিঞার বাপের ব্যাটারা যে এমন হারামখোর, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ওদের দুজনের সঙ্গেই পালাল নিমক খাওয়া বেইমান কর্মচারী কটা।

তারপরে এল পাওনাদারেরা। সবার বড় পাওনাদার ছিল ধলাইপুরের সুলতান মিঞা। লালমিঞার সতাতো এক ভাইয়ের সে শ্বশুর।

এ সংসারের বিচারে ভালর মাপকাটি কী হওয়া উচিত, সে কথা লালমিঞা যাচাই করতে চায়নি কোনওদিন। দেনার নথিপত্র বিবির টিপসই ছাড়াও অনেক দেনা ছিল, যা ইচ্ছা করলে লালমিঞা শোধ না করলেও পারত। কিন্তু সমস্ত দেনা পরিশোধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল সে। ওটাই খোদার অভিরুচি। নইলে গদির উপর শয়তানের নজর পড়বে।

রোগশয্যা থেকে উঠে এসে সাতদিন বাড়ি যায়নি সে। রোগ তার সত্যি একেবারে সেরে গিয়েছিল। সাতদিন ধরে নাগাড় খোঁজখবর করে সে এও টের পেল, ঘর থেকে টাকা দিয়েছে তার বিবি। বিবি তা হলে সবই জানত। বলেনি তাকে।

অবস্থা ভাল ছিল লালমিঞার। কিন্তু দৌলতের রোশনাইয়ে ঝকঝক করত না দিবানিশি তার ঘর গদি। বাদশা-ই ফকির বনে যায়। আর এ তো সামান্য গদির মালিক। সে শুধু নিঃশেষ হয়নি প্রায় সর্বহারা হয়েছে। লালমিঞা বুঝল, যেভাবে শুরু করেছিল, আবার সেইভাবে শুরু করতে। হবে। সেই ভাবে শুরু। তা কি আর হয় ! দুনিয়া ভেঙে আর একটা দুনিয়া হয়তো গড়তে পারেন খোদা। মানুষ ভাঙা বস্তু জোড়া লাগাতে পারে। কিন্তু ভাঙার কলঙ্কের দাগ কি যায়। তা ছাড়া উৎসাহ উদ্দীপনা বলে একটা কথা আছে। বয়সও কম হয়নি।

তবু যতক্ষণ পারা যায়, চেষ্টা করতে হবে।

এই সাতদিন ধরে রোজ বিবি খবর পাঠিয়েছে। লালমিঞা যায়নি। এত কাজতা ছাড়া বিবির উপর অভিমানও হয়েছিল। অন্য মানুষ হলে গলায় দা বসাত। কিন্তু হারামবৃত্তি কোনওদিন রপ্ত করেনি লালমিঞা।

সাতদিন পরে বাড়ি এল। বিবি কথা বলতে পারে না। গম্ভীর হয়ে বলল সে, দলু, বিবি, তোকে তালাক দেব ঠিক করেছি।

দৌলতোন্নেসা তবুও তাকাতে পারল না। কথাও বলতে পারল না। খালি কাঁদল। ওইটুকু ছাড়া ওর আর কিছু ছিল না।

লালমিঞা বলল, ওর চোখের পানি দেখে খুব খানিকটা হাসলাম। বড় জোর হাসি পেয়েছিল। মাগি হাসি দেখে কেঁদে মরে আর কি!

মেঘু চুপ করে সব শুনল। লালমিঞার ভাইদের সে চেনে না। কিন্তু এত বড় অভিশাপ কেন তার উপর নেমে এল, এই অবিচারের কারণটা সে বুঝল না।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত দেনাপাওনার সংবাদ সংগ্রহ করল সে লালমিঞার কাছ থেকে। তারপর সারা রাত ধরে ভাবল। ভাবল অনেক কথা। আজ আর সে কথা তার মনে নেই। কিন্তু সারারাত ঘুমুতে পারেনি সে।

পরদিন সকালবেলা লালমিঞাকে বলল, চাচা, একটা কথা বলব?

লালমিঞা বলল, বল তো বাবা?

মেঘু বলল, এত বচ্ছর বাইরে ঘুরে হাতে কিছু টাকা করেছি। শ তিনেক হবে।

লালমিঞা শঙ্কিত গলায় বলল, তবে আমার কাছ থেকে সরে পড় বাবা। দেখছিস না শয়তান রয়েছে আমার কাছে। তোর দুঃখের ধন কোনখান দিয়ে কী হয়ে যাবে। পরে আর কেঁদে বাঁচবি না।

মেঘুর বুদ্ধি ছিল, এ-কথা বললে ভুল হবে। তার ছিল হৃদয়। সে আবেগভরে, সরলভাবেই বলল, যায় যাবে, কাঁদি কাঁদব। তোমার চেয়ে বেশি তো আমার যাবে না। সমুদ্রে এক ফোঁটা জল এই তিন শো টাকা। তবু লাগাতে চাই তোমার কারবারে।

লালমিঞা পরিষ্কার বলল, আমি পারব না বাবা। তুই অন্য জায়গায় যা।

বলেছি মেঘুর বুদ্ধি কম। হৃদয়বৃত্তি বড়। লালমিঞার কথাটা বুঝল অন্য রকম। বলল, আমাকে অবিশ্বাস করলে তুমি? তোমার এক পয়সাও নেব না। তোমারটা দিয়েথুয়ে যদি রোজ দু পয়সাও পাই…

লালমিঞা খেপে উঠল একেবারে। হারামজাদা, এই চড়ে তোর বত্রিশ পাটি দাঁত আমি তুলে ফেলব জানিস? অবিশ্বাস, আমার এক পয়সাও নিবি না এত বড় কথা বলছিস আমাকে। মদনদার ছেলে না তুই?

হৃদয়বৃত্তি দু জনেরই সমান। মেঘু তো হাঁ।

লালমিঞা বলল, বড় কথা শিখেছিস অবিশ্বাস করলাম তোকে? ব্যাটা, দেখছিস না, বুড়ো হয়ে মরতে চলেছি। আমার দ্বারা আর কিছু হবে? তারপরে দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে আবার বলল, তুই পারবি একলা সব করতে? পারবি, সারাদিন কাজ করে মাল বানাতে। সারাদিন মাল বানাবি, সারা। রাত্রি নিজের পাইকের হয়ে বিশ মাইল দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, নৌকা ঠেলে মাল কাটাবি। নিজের হাতে খাতা কলম দেখবি, মাল কিনবি, টাকা দিবি। পোয়াভর ময়দারও নিক্তি ওজনের হিসাব করতে হবে। এক পো ময়দার মাল নষ্ট হলে হলপ করে উপোস ধরে কাজ আদায় করতে হবে। আবার পিরিত করে একটা আধলাও যেদিন খসাবি, সেইদিনই তোর সর্বনাশ হবে। হাত মুঠো করবি, শিবের বাবা জানবে না কানা কড়ি আছে কি মোহর আছে। পানি গলা দূরের কথা, হাতের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকবে না। আবার লক্ষ্মীর বাটায় যখন পয়সা দিবি, তখন প্রাণ খুলে দিবি। কিন্তু মূলধন যেদিন দিবি, সেদিন লক্ষ্মী নিজে তোর মুখে লাথি মেরে সরে পড়বে। পারবি? পারবি তুই?

লালমিঞা কথাগুলি বলে একদমে। তার এ রকম চেহারা কোনওদিন দেখেনি মেঘু। দেখবার সুযোগ জোটেনি, সম্পর্কও ছিল না সে রকম। তবু, অবোধ শিশু যেমন বোঝে স্নেহের কপট ঠোনা তেমনি অনুভব করল সে লালমিঞার ভর্ৎসনা। বলল, শান্তভাবেই বলল, পারব।

লালমিঞা তবু বলল, পারবি? একলা হাতে সামলাতে পারবি সব? মনে রাখিস, নিজের হাতে পায়ে মালের কাজ, আবার দেশে দেশে ঘুরে নিজের কারবার ছড়ানো। পেট ভরে খেতে পাবিনে। জাড়া বর্ষায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে দুদণ্ড ঘুমোতে পারবিনে।

জন্মের পর কবে পেট ভরে খেয়েছে মেঘু? কবে ঘুমিয়েছে আরাম করে? জীবনে অনেক কষ্ট সে সহ্য করেছে। বহন করেছে অনেক গ্লানি। কিন্তু, সে সবই তার কাছে তুচ্ছ। সে সবই তার নতুন প্রস্তুতির প্রস্তাবনা মাত্র। যে প্রস্তুতি তার রক্তধারার মধ্যে দিনে দিনে উত্তাল হয়ে উঠেছে, সেই দিনগুলির জন্যই প্রতীক্ষা করেছে সে। সে বেঁচে রয়েছে।

সামনের সে দিনগুলি অন্ধকার। তার ভালমন্দ কিছুই দেখা যায় না। সেই অন্ধকারে পা না বাড়ালে দেখাও যাবে না। হয়তো সর্বস্ব হারিয়ে আবার পথে বসবে মেঘু। কিন্তু মন স্থির করেছে সে। দমবে না সে আর।

বলল, আমি সব সইতে পারব চাচা। তুমি একটু নজর রেখো খালি, তা হলেই হবে।

লালমিঞা হতাশায় বিরক্তিতে ভেঙে পড়ল। বলল, কিছুই হবে না। বুঝেছি, ওই টাকা কুটকুট করছে তোর গায়ে। না গেলে তোর শান্তি নেই। টাকা যাবে, আর দশ জনের কাছে আমাকে গাল পেড়ে বেড়াবি যে, ওই লালমিঞা ব্যাটার জন্য আমি সর্বস্বান্ত হলাম। ও-ই আমার নসিব। নসিব খণ্ডাবে কে।

এই পর্যন্ত বলে লালমিঞা থামল। থেমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দূরের আকাশের দিকে। মুঠো করে ধরে রইল থুতনির শক্ত ঘন দাড়ির গুচ্ছ। তারপর আপন মনে বলে গেল, প্রথম জীবনে কী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে সে তার এ ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিল। কীভাবে সে তার প্রথম যৌবনে বিতাড়িত হয়েছিল বাড়ি থেকে সৎ মায়ের তাড়নায়।

মেঘুর দৃঢ়তা আজ তাকে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সেই কথাই বলেছে সে। এই বলার আড়ে আড়াল দিয়ে সাবধানের ইঙ্গিত ছিল মেঘুর প্রতি। তার অভিজ্ঞতার কথা শুনেও যদি মেঘু নিরস্ত হয়। যদি পেছোয়।

কিন্তু পেছুল না। বরং উলটো ফল ফলল। সে ভাবছিল, লালমিঞার কষ্টের পরিণতির কথা। সেসব তো সে নিজের চোখেই দেখেছে। সে উলটে উৎসাহিত হল। আর লালমিঞা নিরাশ করতে চাইলেও, তার বলার মধ্যে সংগ্রামের জয়গান, তার যৌবন ও সাহসের মহিমা। এও তো উৎসাহেরই ইন্ধন মাত্র।

কিন্তু লালমিঞা সহজে ছাড়ল না। পীরের দরগায় আর মা কালীর থানে প্রতিজ্ঞা করাল মেঘুকে, হাজার বিপদ আসুক, ভয় আসুক, কষ্ট আসুক, কোনও রকমেই সে পেছিয়ে আসবে না। এ যেন প্রায় গুরুমন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার মতো।

তারপর শুরু হল কাজ। লক্ষ্মণ সা’র গদি থেকে শুরু করে, গাঁয়ে ঘরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এই সংবাদ। নানান জনের নানান কথা। মেঘু সব কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কিন্তু লালমিঞার অপবাদ কেউ ঠেকাতে পারল না। রটনা হল, মেঘুর সঞ্চিত টাকা দিয়ে, শিঙ্গা ফোঁকা লালমিঞা আবার দাঁড়াবার চেষ্টায় আছে।

বছর না ঘুরতে শঙ্কিত হয়ে উঠল লালমিঞা। ভয় হল তার মেঘুকে দেখে। শেষে মেঘুকে জানে মারার অপবাদ নিতে হবে। এভাবে কত দিন বাঁচবে মেঘু।

অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে সেই রকমই। মেঘু সারাদিন কাজ করে কারখানায়। তারপর, আগের দিনের তৈরি মাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নৌকা নিয়ে। এক সময় লালমিঞার মাল যেত যত জায়গায়, সব জায়গায় যায় সে।

কোনও কোনও দিন হয়তো কোনও কারিগর সঙ্গে থাকে। নয়তো সে একলা। অন্ধকার রাত্রে, খাল নালা বিল পেরিয়ে বহু দূর দূরান্তে তার গতিবিধি। পথে তার বহু বিপদের সম্ভাবনা ওত পেতে থাকে। চোর ডাকাতের ভয়। ভয় হিংস্র জীব জানোয়ারের। তা ছাড়া অন্ধকার খাল বিলের বুকে বহু সহস্রবিধ অলৌকিক অদৃশ্য রহস্যজনক জীবদের আনাগোনা। মেঘু ভয় করে না। কিন্তু বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করেও সে লড়বার জন্য প্রস্তুত। অপদেবতারা ফেরে নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে। সে নেই কোথায় ! কিন্তু তার ভয়ে পেছিয়ে গেলে চলবে না।

রাত্রিচর শৃগালের দল খালপাড়ের অন্ধকার ঝুপসিতে দাঁড়িয়ে দেখেছে মেঘুকে। বিলপাড়ের বাঁশঝাড়ের বাঁশে লতার মতো পেঁচানো কালো নাগ। ফণা উঁচিয়ে জিভ লকলকিয়ে দেখেছে। মেঘুকে। মানুষের আক্রমণের ভয়ে বাঁশের বুকে ছোবল মেরে হিস হিস করেছে। বিলপাড়ের। হোগলা বনে ডেকে উঠেছে ক্ষুধার্ত বাঘ। তাছাড়া মানুষরূপী ভয়ঙ্করেরাও যে লক্ষ না করেছে, তা । নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগও কম নয়। বিশেষ বর্ষাকালে।

এ সবই ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর মেঘনাদও। প্রকৃতির মধ্যে নিজেকেও মিশিয়ে দিয়েছিল সে। এক নেয়ে ডিঙায় মাল সাজিয়ে, বৈঠা বেয়ে আর লগি ঠেলে দিকপাশ না দেখে ছুটে গেছে মেঘু। এক দিন এমনি করে লালমিঞা গিয়েছিল, সে পারবে না কেন? কীসের ভয়, আর কেন ভয়? প্রাণের জন্য তো! এ পথে হার হলে, প্রাণের প্রয়োজন তো আপনি ফুরিয়ে যাবে তার কাছে। কিন্তু যখনই টাকা নিয়ে ফিরেছে, তখনই ফিরেছে দিনের বেলা। সাহস ছিল তার। কিন্তু পথের মধ্যে দশ জনের সঙ্গে সে পারবে না, এটুকু সে বুঝত।

দু বছরের মধ্যে কারখানায় লোকের প্রয়োজন হল। মালের চাহিদা বেড়েছে। পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে প্রায় আগের মতো। গদি না খুললে আর নয়।

কে বসবে গদিতে। লালমিঞা। লালমিঞা বলল, মরে গেলেও আর গদিতে বসব না। মেঘুর কর্মচারীর কাজ করে দিতে পারি। ওতে আমার কোনও হক নেই।

মেঘু অরাজি হল না। তাই বসুক লালমিঞা। কর্মচারীর বেশে বসেই কাজ চালিয়ে যাক সে, কিন্তু তার পক্ষে বসার উপায় নেই। সময় নেই।

গদি খুলল। লোকে বলল, লালমিঞার গদি। মেঘু ভাবল, বলুক। গদি তো লালমিঞারই। সুলতানের দেনা শোধ করেছে সে। তাকে শোধ দেবে লালমিঞা। নতুন কারিগর রেখেছে। তাদের মাইনে ছাড়াও আগের কারিগরদের অর্ধেক খরচা বহন করে এসেছে সে। কেন না, বাড়তি কাজের দামটা যাবে কোথায়।

সে হিসাবের ভাবনা মেঘুর নয়। হিসাব করে লালমিঞা। বড় নিয়মতান্ত্রিক লোক। নিজের হিসাব আর মেঘুর হিসাব কড়ায় গণ্ডায় ঠিক রাখে। একটু এদিক ওদিক হবার উপায় নেই।

মেঘুকে হিসাব দেখতে ডাকলে সে ঘাড় বাঁকায়। লালমিঞা ঘাড় ধরে হিসাব দেখায়। ও সব। চলবে না। তারপরে দু দিন বাদে বদনাম দেবে, তা সে সহ্য করবে না। তাতে মেঘুর লাভ বই ক্ষতি নেই। হিসাব শিক্ষা হয় তার। ব্যবসায়ের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারটা দিনের আকাশের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে চোখের সামনে। লুকোছাপা নেই। দুর্বোধ্যতা কেটে আসে আপনি।

মুখে মুখে হিসাব চলবে না। লিখতে হবে নিজের হাতে। নিজের হিসাব, টাকা আনা কড়া ক্রান্তি, সব নিজেকে লিখতে হবে। জানিনে বললে চলবে কেন। কিনে আনো ধারাপাত, আবার হাত মকসো করো তালপাতায়। ছাড়ান নেই। নেমেছ যখন, ডুব দিয়ে ওঠো। দেখো, কত জল।

একদিন লালমিঞা হিসাব কষে দেখিয়ে দিল, বাজারের পাওয়ানা ছাড়াও মেঘুর মূলধন তিনশো টাকা স্থায়ীভাবে জমেছে। খরচ খরচা সব বাদ দিয়ে। জমেছে তিনশোর বেশি। জমেছে পাঁচশো। ঘুনসিতে চাবি বাঁধুক মেঘু। ওই চাবি ছাড়া কেউ জানবে না টাকার কথা।

সে-ই ভাল। কিন্তু মেঘুর তো গদিতে বসে থাকলে চলবে না। তার তত দিনে রাত্রে কাজ। তার সেই কাজের তো কামাই নেই।

কিন্তু সে কাজের ভার অপরকে দিতে হবে। যাকে দেবে, তাকে খুশি করে দিতে হবে। সে বাঁচলে, তোমাকে বাঁচাবে। এক নিয়মে বরাবর চলে না। নিয়ম বদলায়। প্রয়োজনে আইনের হেরফের করতে হয়। এখন আর একলা ঘরামিতে ঘর উঠবে না। লোকের হাতে ভার দিতে হবে। বিশ্বাস করে। নিজেকে খুঁটি আগলাতে হবে। মস্ত বড় কাজ। ওই খুঁটির মাথায় সব। ভেঙে পড়লে তোমারই ঘাড় ভাঙবে আগে। সকলের আগে মরণ তোমার।

নিয়ম বদলে গেল। মাল নিয়ে যাওয়ার কাজ পেল অন্য লোকেরা। বিশ্বাসী লোকেরা। তা ছাড়া দৈনিক প্রায় বিশজন পাইকের এখন দোকান থেকেই মাল নিয়ে যায়।

গদি হল। বাজারে দোকান ঘর করতে হল একটা। খুচরা বিক্রির দোকান। ব্যবসা বাড়ল, খরচও বাড়ল। গদিতে পাইকেরদের জন্য একটু পান তামাকের ব্যবস্থা করতে হয়। দশটা কথা। বলতে হয়। খবর নিতে হয়।

তা ছাড়া বারোমাসই কি আর ওই ছোট ডিঙাতে দৈনিক মাল চালান যাবে। তা নয়। এবার একটা নিজের নৌকা করা দরকার। বড় নৌকা। বিলান দেশ। নদী নালা ঘরের আগদুয়ারে, পাছদুয়ারে। ওইটি আগে দরকার। বড় নৌকা হলে, সপ্তাহান্তে একবার করে মাল চালান দিলেই হবে। সময় আসবে, যখন তার নিজের নৌকা দৌড়াদৌড়ি করবে না। কারবারিরা আসবে তাদের নৌকা নিয়ে।

এক সঙ্গে থোক টাকা দিয়ে নৌকা তো আর হবে না। ধীরে ধীরে করো। পৌষ মাঘ ফায়ূন চৈত্র, চার মাস ধরে কাজ চালাও। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠও হাতে পাবে। আষাঢ় মাসে নৌকা ভাসাবে। শুভদিন দেখে ভাসাতে হবে।

নৌকা হল। কিন্তু গদিতে লোক বাস করে না। ভিটামাটি করতে হবে। ঘরে বসাতে হবে ইষ্ট ঠাকুর। সেখানেও লক্ষ্মী বসাতে হবে।

এক দিনের কাজ তো নয়। এক বছরে হোক। পাঁচ বছরেই হোক না কেন। উদযোগ আয়োজন করতে হবে। এখন থেকেই লাগতে হবে। ভাবতে হবে সে সব।

লালমিঞা বলে, আমি কি তোর বাপের চাকর যেন চিরকাল তোকে সামলাব। কোনওদিন খোদা ফরমান দেবে, আমি চোখ বুজব। তখন চাচা চাচা করে চেঁচালে হবে।

তবে কী করতে হবে? বিয়ে করতে হবে। সংসার পাততে হবে। নইলে বয়সের নষ্টামো ধরবে না ! হোক মেঘুর মতো খাঁটি ছেলে। খাঁটি সোনা দিয়ে পাপের কাজ হয় না? ওটা হল আর এক খুঁটি। ঠিক না থাকলে সব আলগা। কাজকর্ম গদি পয়সা সবই। নইলে কোনওদিন দেখা যাবে সব রসাতলে গিয়ে বসে আছে।

তা ঠিক। এদিকে নজরও পড়েছে সকলের মেঘুর উপর। মেঘু, মেঘা, লক্ষ্মণ সা’র ছেলে। পদবিতে দাস। কিন্তু জাতে সাহা। লোকে সাহাই বলে। সবাই দেখছে, দিনে দিনে মেঘুর শ্রীবৃদ্ধি। লক্ষণ সা ঘুরেছে যে লক্ষ্মীর পেছনে পেছনে, সেই লক্ষ্মীকে খুঁজে নিয়ে এসেছে মেঘু।

লক্ষ্মণ সা তো কতদিন ডেকে ডেকেই কথা বলেছেন। বুড়ো লক্ষ্মণ সা। এখন তার ছেলেরাই গদি দেখে। সে বড় একটা গদিতে আসে না। কিন্তু এলেই মেঘুর খোঁজ করে। খোঁজ করে, লালমিঞা না আবার ছোড়াটাকে ফাঁকি দেয়। মায়ের চেয়ে যার দরদ বেশি, তাকে বলে ডাইনি। যে হাতে ধরে দাঁড় করাল, তার ফাঁক ধরে লক্ষ্মণ সা । খোঁজ নেয় লোকের কাছে, গদির কাজ কারবার দেখাশোনা করে কে।

শুধু তাই নয়। লক্ষ্মণ সা তার নাতনির সঙ্গে বিয়ে দিতে চায় মেঘুর। তার বড় ছেলের প্রথম মেয়ের সঙ্গে। প্রথম নাতনি, লক্ষ্মণ সা দেবেথোবে ভাল। নাতনিটিও পরমা সুন্দরী। কেন, মেঘু দেখেনি? এক বাড়িতে বাস করেছে, দেখেছে কতবার। যদি বিয়ে করে, তবে মেঘুর বাপের ভিটেটুকুও যৌতুক দেবে সে নাতজামাইকে।

এ সব সংবাদ মেঘুর চেয়ে লালমিঞার কানে আসে বেশি। যাকে নিয়ে এত কথা, তার কানে বড় একটা যায় না। তবু কাজের অন্ত নেই। চার বছর কেটেছে। অবস্থাও অনেকখানিই উন্নত হয়েছে। তবু এখনও মেঘু ন্যাকড়া পরে কারখানার কাজে হাত লাগায়। মনিবের সঙ্গে কাজ করতে অনেকের অসুবিধা হয়। কিন্তু মনিব সে রকম নয়, সেইটেই রক্ষা। সকলের সঙ্গে বসে বিড়ি খায়, কাজ করে, হাসি ঠাট্টা করে। দেখে বোঝার জো নেই এই মানুষই, এ সবের মালিক। আসলে মেঘুর নিজেরই এখনও সে বোধ নেই।

লালমিঞা প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছে। এদিককার কাজের দায়িত্ব সবই মেঘুর উপর। তবু গদি সামলানো তার দ্বারা হতে চায় না। আর লালমিঞা সেটাই তাকে দিয়ে রপ্ত করিয়ে নিতে চায়। না চাইলে চলবে কেন?

লালমিঞা একদিন বলল, তোর দাদাশ্বশুর যে বড় ভাবনায় পড়েছে রে মেঘু।

মেঘু বলল, দাদাশ্বশুর কে চাচা?

কেন লক্ষ্মণ সা।

কী করে?

সে যে তার ছেলের ঘরের বড় নাতনির সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তোর বাপের ভিটোটাও তোকে যৌতুক দেবে।

আচ্ছা। তবে ভাবনা কীসের বলছিলে?

কেন, লালমিঞা ব্যাটা তোকে ফাঁকি দেয় যদি।

মেঘু কয়েক মুহূর্ত নির্বাক বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপরে হেসে উঠল হা হা করে।

কিন্তু লালমিঞা গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু তোর দ্বারা তোতা ব্যবসা হবে না মেঘা।

কেন?

আমাকে তোর এত বিশ্বাসের কারণ কী। মনে রাখবি, বিশ্বাস এক কথা আর আনাড়ির মতো পরের হাতে সব রেখে দেওয়া আর এক কথা। ওটা বিশ্বাস নয়, ওর থেকেই আসে অবিশ্বাস। আমি আজ থেকে আমার যেটুকু আছে, সেটুকু গুটিয়ে নিলাম। আমার দ্বারা আর ব্যবসা হবে না। আমার ছুটি চাই।

মেঘু অসহায়ের মতো বলল, তা কী করে হয় চাচা?

সব হবে।

বলে আর কোনও কৈফিয়ত দিল না লালমিঞা। পরদিন থেকে গদিতে আসা বন্ধ করে দিল সে।

মেঘু জানত, জোর করে কিছু হবে না। সে খালি খোঁজ রাখে, লালমিঞার দিন চলছে কী ভাবে। হিসাব শিখেছে সে। লালমিঞার পাওয়াটা ঠিকমত পৌঁছে দেওয়ার ভার নিল সে নিজের হাতে। এমনকী দোকান বাজার হাট করে দেওয়া পর্যন্ত।

বাজারে মেঘুর স্বজাতিরা তাতে গোসা করল সবাই। হতে পারে লালমিঞা ভাল মানুষ। তা বলে নিজে একটা কারবারি হয়ে তার কাজ করে দেওয়া চাকরের মতো, এটা ঠিক নয়।

কিন্তু সব কথাই আড়ালে আড়ালে। এদিকে আবার মেঘনাদ বড় গোঁয়ার। দিনে দিনে তার চেহারাটি হয়েছে যেন মস্ত একটা সিংহের মতো। কী চেহারা। যেমন রং তেমনি চোখমুখ। কথা বলতে সাহস হয় না কারও। বলে শুধু পুরনো আমলের বিপিন, আর একমাত্র লালমিঞা। গদি আর কারখানার বাকি লোকেরা মেঘুকে ভয় পায় বটে। কেন না, অত পরিশ্রমী মানুষ, কখন কী বলে বসবে, তার ঠিক কী। কিন্তু সবাই ভালবাসে। সে ভালবাসার মধ্যে অনেকখানি বিস্ময়ও আছে। বিপিন বড় বন্ধু হয়েছে মেঘুর। বয়সে তার চেয়ে বড় বিপিন। কিন্তু দু জনে একেবারে হরিহরাত্মা। বিপিন দুর্দিনে ছাড়েনি লালমিঞাকে। আর মেঘুর ব্যবসায়ের প্রথম থেকে সে তার একজন দুঃখের সঙ্গী। তার অভিজ্ঞতা দিয়ে সে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য করে চলেছে মেঘুকে। তা ছাড়া বন্ধুত্বটা দু জনের কাজের মধ্য দিয়ে। মনিব কারিগরের সম্পর্কের মধ্যে নয়। দরকার হলে, বিপিনও ধমকেছে মেঘুকে। এখনও ধমকায়। হুকুম করে এটা সেটা এনে দেওয়ার জন্য। তবে একটু সামলে, দশ জনের আড়ালে। শত হলেও মনিবের একটা মান আছে তো।

আর ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক একটা খারাপ অভ্যাস মেঘুকে দিয়েছে বিপিন। সেটি কিছু নেশা ভাং। অবশ্য, এ কারখানা ঘরে যারাই কাজ করে, প্রায় সকলেরই সে দোষ কমবেশি আছে। লালমিঞারও ছিল। মেঘুও রপ্ত করেছে। কথাটা লালমিঞাও জানত। বাধা দিতে পারেনি। কীভাবে এ ব্যাপারে বাধা দেওয়া যেতে পারে, সেটা লালমিঞার বুদ্ধির অগোচরে। কেন না, নিজেও তাই করেছিল। নইলে অত পরিশ্রম বোধ হয় সম্ভব হত না সে দিন তার পক্ষে।

সামান্য অবসরের মধ্যে এক সঙ্গে বসে নেশা করাটুকু বিপিনের সঙ্গে মেঘুর অন্তরঙ্গতার আর একটি কারণ। তবে ব্যাপারটা এখনও সীমা ছাড়িয়ে যায়নি, সম্ভবও ছিল না। মেঘুর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে বটে নেশাটা। বাধ্যবাধকতা আসেনি এখনও। মূল মন্ত্রটা ব্যবসা।

বিপিন প্রায় জন্ম বাউণ্ডুলে। ঘর সংসার করেনি সে কোনওদিন। যত্র আয় তত্র ব্যয় করে এতখানি জীবন কাটিয়ে এসেছে সে। জীবনের অনেকটা সময় একলার পেটটা চালাতেই হিমশিম খেয়েছে। এ বয়সে আর ঘর করবার কথা মনেও হয় না তার।

কিন্তু বাজারের একটি মেয়েমানুষের কাছে যাতায়াত আছে তার। সেটা সকলে যেমন জানে, মেঘুও জানে তেমনি। বিপিন একদিন মেঘুকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। মেঘুর ভাল লেগেছিল। মেয়েটিকে। মেয়ে নয়, মেঘুর চেয়ে সে অনেক বড়।

কথাটা লালমিঞা জানতে পেরে বিপিনকে ধমকেছিল খুব। সেই থেকে বিপিন আর কোনওদিন তাকে নিয়ে যায়নি। মেঘুরও স্পৃহা ছিল না। তবে মেয়েমানুষটি সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে মেঘুর কাছে। কিছু চেয়েছিল। যা তোক কিছু মেঘু যেন ভালবেসে দেয় তাকে।

মেঘু দিয়েছিল কিনে একটি ভাল শাড়ি। লালমিঞা তাও জানত। জেনেও কিছু বলেনি তাকে। খালি বিপিনকে বলেছিল, ওকে ওভাবে ডোবাসনি বিপনে। ও বড় ভালমানুষ। কথা বলে। চ্যাটাং, চ্যাটাং, আসলে একেবারে গোবেচারা। ওর কাছে চেয়ে চেয়ে ওকে একজন সর্বস্বান্ত করতে পারে। আমি তো বুঝি ওকে। ওর দিনকাল ভাল হলে, তোর যা খুশি তাই চেয়ে নিস, কিন্তু রাঁড় বেশ্যার কাছে টেনে নিয়ে যাসনি।

কথাটা বিপিনকে ওইভাবে বলেছিল লালমিঞা। কারণ, সে মরলে বিপিন-ই হবে মেঘুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। বিপিন সে কথা রেখেছিল।

তখন থেকে লালমিঞার ভাবনা বেড়েছে। গদি ছেড়ে যাওয়ার কারণও তাই। চাপে পড়ে যাতে মেঘু ওদিকে একেবারেই নজর দিতে না পারে। তা ছাড়া, লক্ষ্মণ সা’র নাতনির সঙ্গেই যদি তার বিয়ে হয়, তোক ! মাথার উপরে তবু কেউ থাকবে।

কিন্তু মেঘু সেদিকে একেবারে বেঁকে দাঁড়াল। আবার, সে পথে পথে ফিরবে, তবু লক্ষ্মণ সা’র সঙ্গে আর সম্পর্ক পাবে না।

প্রায় দু বছরের মধ্যে একদিনও লালমিঞা আসেনি। কিন্তু একদিন তাকে আসতে হল। রাগে দুঃখে লালমিঞা সেইদিন অভিশাপ দিতে এল মেঘুকে।

ঘটনাটা হল, মনোহর বিস্কুটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গুনোহাটির বদরুদ্দিনের মনোহর বিস্কুটের বড় নামডাক চারদিকে। সমস্ত পরগনা জুড়ে মেঘুর প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র বদরুদ্দিনের মনোহর। ব্যবসায়ের প্রথম দিন থেকেই মনোহর একটি ছোট্ট কাঁটার মতো বিধেছিল মেঘুর বুকে। 

আজ সুযোগ পেয়ে বদরুদ্দিনের আসল কারিগর মনোহরকে নিয়ে এল সে নিজের কারখানায়। অবশ্যই বেশি মাইনের চুক্তিতে। কাজটা তার সুবুদ্ধির নয়, দুর্বুদ্ধিপ্রসূত। আসলে কোনও বুদ্ধির বশবর্তী হয়ে এ কাজ করেনি সে। করেছে বাধা অপসারণের ক্ষিপ্ততায়।

সংবাদটা লালমিঞাকে একেবারে দিশেহারা করে দিল। সে যখন এল, মেঘু তখন কারখানায়। মনোহরের সঙ্গেই কথা বলছে। লালমিঞাকে দেখে বলে উঠল, চাচা এসেছ? লালমিঞা চিৎকার করে উঠল, খবরদার। ওই মুখে আর চাচা ডাকিসনে। তোকে আমি বলতে এসেছি, তোর। কোনওদিন ভাল হবে না।

মেঘু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন চাচা?

কেন? যে পরের ভাল দেখতে পারে না, তার নিজের ভাল কোনওদিন হয় না।

কী করেছি আমি বলো।

শয়তান, তুই বদরুদ্দিনের কারিগর ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিস। লোভী কোথাকার। এখুনি ওকে ওর মনিবের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আয়, নইলে তুই সর্বস্বান্ত হবি।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে লালমিঞা। পড়ে যাবে হয়তো এখনই। মেঘু তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে বলল, তাই দিয়ে আসব চাচা। এখুনি দিয়ে আসব চাচা। এখনই দিয়ে আসব। তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো।

লালমিঞা বলল, বসব না যতক্ষণ না ওকে দিয়ে আসবি। আর বলে রাখি, ক্ষমতা থাকে, নিজের লোক দিয়ে ভাল মাল তৈরি করবি। পরের জিনিসে লোভ করবি তো মরবি। মনোহর বদরুদ্দিনের। তোর নয়।

মেঘু তখনই খরচ দিয়ে পাঠিয়ে দিল মনোহরকে। এ বিষয়ে বিপিনের হাত ছিল না। বরং তার অসন্তুষ্টির কারণ রয়েছে। মনোহর উড়ে এসে জুড়ে বসবে তার জায়গায়। এটা সে সহ্য করবে কেমন করে।

লালমিঞা আর দেরি করল না। হিসাব দেখে বুঝল, অন্যদিকে মেঘু ঠিক আছে। এবার ধরল সে মেঘুকে বসতবাড়ির জন্য।

আপত্তি করল না মেঘু। তাদেরই সেই পুরনো গাঁয়ে জমি কিনে বাড়ি উঠল। বাড়ির তদ্বির তদারকের ভার পড়ল বিপিনের উপর।

গাঁয়ে বড় একটা ঢুকত না মেঘু। এবার ঢুকতে হচ্ছে। যেতে হচ্ছে। প্রায়ই গাঁয়ের মধ্যে। সবাই ডেকে ডেকে কথা বলে, জিজ্ঞেস করে এটা সেটা।

পথের মাঝে দেখা একদিন নসীরাম গণকঠাকুরের সঙ্গে। মেঘু ভাবল, এই বুড়ো বোধহয় আর কোনওদিন মরবে না। জন্মে অবধি দেখছে সাদা চুল আর সাদা ভু জোড়া। এমনকী চোখের পাতাও সাদা। মুখটি কিন্তু কালো। আজও তেমনি আছে নসীরাম।

মেঘুকে দেখে ভ্রূ তুলে মুখ কুঁচকে থমকে দাঁড়াল নসীরাম। ফোগলা দাঁতে হেসে বলল, মদনের ব্যাটা মেঘু না?

নর-শ্রেষ্ঠ বামুনকে প্রণাম করা রীতি। কিন্তু কোমর বেঁকল না মেঘুর। বলল, হ্যাঁ। ভাল আছেন ঠাকুরমশাই। নসীরাম সে কথার ধার দিয়েও গেল না। বলল, তাই তো, কপালে যে তোমার রাজটিকা দেখছি বাবা। মা লক্ষ্মী তোমার সঙ্গে রয়েছেন দেখছি। বেশ বেশ। ভাল আছ তো বাবা?

মেঘু কথা বলতে শেখেনি। আদব কায়দা বোঝে না। বলল, তা এখন বেশ আছি ঠাকুরমশাই। কাজ করি খাইদাই।

বলে সরে পড়ার তাল খোঁজে মেঘু। নসীরাম বলল, সেই তত ভাল বাবা। ওকেই বলে মা লক্ষ্মীর কৃপা। শুনলাম, বাড়ি করছ। সৌভাগ্যের সূর্য দেখছি তোমার কপালে। তবে বাবা, একটু রাহু বেষ্টনের লক্ষণ দেখছি। সেটি তো ভাল নয়।

মেঘু বলল, ওটা কেটে যাবে।

নসীরাম তাড়াতাড়ি বলল, নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু তোমাকে বাবা একটু শুচি হতে হবে। গদিটা শত হলেও অন্য জাতের ছিল। মাখামাখিও করছ। একটু পুজোটুজো দিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে। আর তোমাকেও ফি বৈশাখে মঙ্গলচণ্ডীর—

মেঘু ততক্ষণ হাঁটা ধরেছে। মঙ্গলচণ্ডী ঠাকরুনের ব্রত করতে পারে সে। কিন্তু নসীরামের কথায় নয়। আর লালমিঞার গদি অশুদ্ধ নয়। যেদিন ভোলা হয়েছে, সেই দিনই লক্ষ্মী গণেশ বসিয়ে শুদ্ধিকরণ হয়েছে তার। তাও লালমিঞার অভিরুচি। বসতে না দিলেই বা বলার কে আছে। আর তার কপালের সূর্যের রাহুবেষ্টনি যে লালমিঞাকেই উদ্দেশ করছে, সেটাও সহজে বুঝল সে। বুঝে, নসীরামের প্রতি ঘৃণাটা বেড়ে গেল আরও।

মেঘু বোঝে একটি কথা। মন খাঁটি রাখতে হবে। কাজ করতে হবে খেটে। ওর চেয়ে শুচি শুদ্ধি আর কিছু নেই। তারপর কপালে দুঃখ থাকলে কেউ ঠেকাতে পারে না। আসলে লালমিঞার কাছ থেকে সরে আসার উপদেশ দিতে চায় বুড়ো গণকঠাকুর। কথাটা শুনে তাই রাগ হয়েছে মেঘুর। কথার জবাব না দিয়েই চলে গেছে সে। ও সব ভবিতব্য শুনতে রাজি নয় সে।

মেঘুর নতুন বাড়ির পথে লক্ষ্মণ সা’র বাড়ি। যাওয়ার পথে হঠাৎ একদিন ডাক পড়ল সেখানে। ডেকেছে কি পাঠিয়ে, অন্তঃপুরের বউ গিন্নিরা । যাওয়াটা সঙ্গত নয়। কিন্তু ঝিটা বলল, দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছে তাকে। না গেলে সকলে বড় দুঃখ পাবে।

মেঘুর গায়ে ময়লা জামা কাপড়। কিন্তু চেহারাটা আগুনের মতো। এমনকী তার মাথার চুলগুলিও কম্পিত, অগ্নিশিখা। আর চোখ কী ! যেন মহাদেবের ঢুলুঢুলু আঁখি। গোঁফজোড়া এর মধ্যেই গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে তার মুখে।

অন্তঃপুরে গেল সে। এক রাশ মেয়েমানুষের ভিড়। কেউ কথা বলে না। সকলেই চেয়ে চেয়ে হাসে ফিক ফিক করে। প্রৌঢ়া, যুবতী, বালিকা। লক্ষ্মণ সা’র অন্তঃপুরে চিরকালই রূপের বড় ছড়াছড়ি।

কিন্তু মেঘু মুখ তুলতে পারে না। অনেককেই সে চেনে এর মধ্যে। তার কৈশোরের স্মৃতি তো। সে ভোলেনি। এর মধ্যেই কারুর কারুর সঙ্গে তার বিচিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্পর্ক বিচিত্র নয়, অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য। গোপন নয়, অথচ একটা গোপনতা আপনি এসে আড়াল করেছিল তার মধ্যে। আজ সে সব কথা মনে করলে রক্তের মধ্যে কেমন একটা পাক দিয়ে ওঠে। কিন্তু কিশোর দেহের সেই দুর্বোধ্য যন্ত্রণা আজ আর নেই।

মেঘু এই নারীব্যুহ থেকে বেরিয়ে যাবে কি না ভাবছে। এমন সময় একটি বউ বলল, কই, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসো।

বলে একটি মস্ত বড় কাঁঠাল কাঠের মসৃণ পিঁড়ি পেতে দিল। বউটিকে চিনল মেঘু। অনেক অসহ্য আদর ও সোহাগ পেয়েছে সে বউটির কাছ থেকে। এখন বয়স হয়েছে, কিন্তু রূপে যেন ভাটা পড়েনি আজও। বউটি লক্ষ্মণ সা’র বড় ছেলের বউ। মেঘু বলল, বসব না, কাজ আছে। কিছু বলবেন নাকি?

বউটি বলল, বলব বইকী। না বসলে বলি কী করে? এখন তো আর সে মেঘু নেই। মস্তবড় কারবারি হয়েছ। তা বলে কি…।

মেঘু বলল, না না, সে কী কথা। বিস্কুট বিক্রি করে খাই।

মেয়েরা সব খিলখিল করে হেসে উঠল। ও বাবা ! কথা জানে। এ আর সেই লক্ষ্মণ সা’র বেটা মেঘা নেই।

বউটি ঠোঁট ফুলিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে বলল, তবু বসতে হবে বাপু।

মেঘু বসল। বউটি বলল, বাড়ি করেছ। বাস করবে কবে থেকে।

মেঘু বলল, করলেই হল একদিন।

আবার হাসি। অন্য একটি বউ বলল, তা বললে কি হয়। পুজোটুজো দিতে হবে।

মেঘু হাসল। বলল, মাথা গোঁজার দরকার। একলা মানুষের আবার পুজো কীসের?

কেন, দোকলা তো হলেই হয়।

মেঘু নীরব। লক্ষ্মণের বড় বউ ডাকল, কই লো ষোড়শী, মেঘুকে দুটো পান দিয়ে যা। বোঝা গেল ষোড়শী আসতে পারছে না লজ্জায়। টেনে আনতে হল তাকে। লজ্জায় কুঁকড়ে কোনরকমে পান দুটি দিয়েই পালাচ্ছিল। এক জন ধরে ফেলে মেঘুকে বলল, দেখো তো, আমাদের এই মেয়েটিকে কেমন লাগে?

মেঘু দেখল। সত্যিই সুন্দরী। বছর যোলো বয়স। বলল, ভাল।

আর একজন বলল, মনের কথা বলো।

মেঘু বলল, মনের কথাই বললাম।

বড় বউ বলল, তবে মেয়েটাকে তুমিই নাও মেঘু। আমার শ্বশুরের খুব ইচ্ছে। মিথ্যে না যে, মেঘু অবাক হয়েছে। কথাটা ভাবার মতো করে কোনওদিন ভাবেনি সে। আজও দুর্বোধ্য বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ও সব এখন বলবেন না। আমার মাথায় অনেক বোঝা। পরের কথা পরে।

বলতে বলতেই হাঁপিয়ে উঠল মেঘু। মনে হল, সে যেন কত যুগ তার গদি আর কারখানায় যায়নি। এই পরিবেশ তার সহ্য হচ্ছে না আর। মাথায় তার দিবারাত্রি অন্য চিন্তা। কথাটা বলে, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে হন হন করে চলে গেল সে। গিয়ে উঠল একেবারে কারখানায়। বিপিন বলল, হাতে পান কীসের?

পান দুটোও খাওয়া হয়নি। বিপিনকে দিয়ে বলল, খাও। দিয়েছিল এক জন। বিপিন চতুর। বুঝল, একটা কিছু হয়েছে।

পরে অবশ্য জেনে নিয়েছিল সে ব্যাপারটা। আর এও জেনে নিয়েছিল, লক্ষ্মণ সা’র নাতনিটি সুন্দরী বটে। তবে মনিব তার ও বাড়িতে বিয়ে করবে না কিছুতেই।

কিন্তু লালমিঞা আর দেরি করতে পারল না। বাজারের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সে বিয়ে স্থির করল। মেয়ের বাপের বাড়ি সোনাদুলির চর। অবস্থা ভাল নয়। বাপের সামান্য দোকান আছে। তাতে কোনওরকমে চলে। ভাই আছে গুটি ছয়েক। তার মধ্যে তিনটি থাকে কলকাতার কাছাকাছি। কাজ করে কলে কারখানায়। বাকি তিনটি বাপের কাছে সোনাদুলির চরেই থাকে।

কারখানার লোকজন, আর বাজারের জানাশোনা লোকদের নিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে এল মেঘু। বিয়ে করতে গিয়েও তার স্বস্তি ছিল না। ব্যবসার চিন্তাই তার মাথায় ঘুরছিল।

সবাই বলল, সুন্দরী বউ, তবে কালো। কালো সুন্দরী।

ঢাকা মেল গড়াতে গড়াতে এসে ধীরে ধীরে ব্রেক কষল আবার। লীলার মাথাটি আলগোছে এসে ঠেকল মেঘনাদের বুকে।

মেঘনাদ ফিরে তাকাল। এই সেই বউ। সুন্দরী বউ। তবে কালো। কালো সুন্দরী।

মাথাটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য মেঘনাদ হাত তুলেও থেমে রইল। সরিয়ে দিল না। তাকিয়ে রইল লীলার ঘুমন্ত মুখের দিকে। তেল চকচকে কালো মুখ। ফুটনোম্মুখ নীল অপরাজিতার মতো চোখের পাতা। আগুনের মতো লাল ঠেটি। অভিমানে ফুলে উঠেছে যেন। তারই মধ্যে মধ্যে মানবঙ্গের গোপন হাসি। চোখের দৃষ্টি নামতে দেখা গেল সুউচ্চ বুক। নিম্নাঙ্গের অনেকখানি আড়াল করে রয়েছে।

সোনাদুলির চরের মেয়ে, সেই লীলা। এই তো সেদিন বিয়ে করে নিয়ে এল একে মেঘনাদ। মুখের ভাব বড় একটা পরিবর্তন হয় না মেঘনাদের। যেন মুখের চামড়ার নীচে রক্তবাহী শিরাগুলি তার বিকল। সেই কাঠিন্য ও নিষ্ঠুরতা কাটতে চায় না। কিন্তু চোখে তার মুগ্ধ বিস্ময়। এমন করে। কোনওদিনের তরে বোধ হয় লীলার দিকে তাকায়নি সে। লীলা নয়, ঝুমি বলেই ডাকে সে।

বাইরে পাখি ডাকছে। পাখি বউ খুনি শাশুড়ি। ডাকছে, বউ জাগো, জাগো, জাগো ! রাত পুইয়ে এল নাকি। না, তার বাকি আছে এখনও অনেক। গাড়িটা দাঁড়িয়েছে পথের মাঝে, একটি গ্রামের ধারে। সামনে সিগন্যাল পায়নি, তাই।

রাত্রির ট্রেনের কামরায় সেই একঘেয়ে দৃশ্য। নিদ্রা, তন্দ্রা, হাইতোলা, ঢুলুনি আর বিড়ি খাওয়া। জেগে আছে শুধু সেই ছেলেটাই। পর পর বিড়ি খেয়েছে অনেকগুলি। এখন নিশ্বাসের সঙ্গে একটা শব্দ হচ্ছে সাঁই সাঁই করে। হাঁপানির মতো। কিন্তু ছেলেটার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এতক্ষণ বোধ করি নিজের ভাবনাতে ভুলে গিয়েছিল তার সামনের সহযাত্রী ও যাত্রিণীর কথা। মেঘনাদকে ফিরতে দেখে আবার তাকাল সেদিকে। তাকিয়েই অপেক্ষা করতে লাগল, কখন মেঘনাদ লীলাকে ধাক্কা দেবে। দেবে সুনিশ্চিত, এটা সে জানে। এতক্ষণ ধরে তাই দিয়েছে। আর সত্যি কথা বলতে কী, ধাক্কাধাক্কির দৃশ্যটা তার কাছে ভারী আনন্দদায়ক। বিশেষ লীলা যখন চমকে বোকার মতো। তাকায়, তখন তার ভেতরে কৌতুকের নিঃশব্দ হাসির ঢেউ ওঠে।

অপেক্ষা সে করতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। অনেকগুলি মিনিট কেটে গেছে। গাড়িও ছেড়েছে, কিন্তু কী আশ্চর্য ! ভয়ঙ্করমুখো লোকটা ধাক্কা দিচ্ছে না, সরছে না। এমনকী বাইরের দিকেও তাকাচ্ছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত বউটার দিকে।

জীবনের এই অল্প বয়সেই, মেয়ে পুরুষের ভালমন্দ বহুবিচিত্র দৃশ্য দেখতে সে অভ্যস্ত। কৌতূহলী হয়ে, তার অভিজ্ঞতার ছকে ফেলে ভাবতে বসল মেঘনাদের এই অদ্ভুত ব্যবহার। লোকটা হাত তুলেও থেমে রইল। কী করতে চায় !

অদ্ভুত কিছুই করতে চায় না মেঘনাদ। কিছু করার কথাও নয়। সে তার অতীত পথের একটা জংশন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। দাঁড়িয়েছিল, আবার চলতে আরম্ভ করেছে।

যে স্মৃতি তাকে আলিঙ্গন করেছে আজ, সে যে বিষের বাঁশি। না, সে এক বিশাল বিষধর সাপ। বিষে তার জ্বালা। স্পর্শ তার হিম শীতল। লীলাকে দেখতে দেখতে সে তলিয়ে গেল তার মনের অতলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *