অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর
আখতার হুসেন
বাংলাদেশের গ্রাম: অতীত ও ভবিষ্যৎ: নজরুল ইসলাম \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: পৌষ ১৪১৭, জানুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী \ মূল্য: ৪০০ টাকা
এখনো বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ যেখানে গ্রামে বসবাস করে, যার অর্থনীতির প্রায় সমগ্রটাজুড়ে আছে কৃষি আর গ্রামীণ উৎপাদন, সেই গ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রয়াস বা এ সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের আলোচনার অবতারণা নিঃসন্দেহে আগ্রহসঞ্চারী বিষয়। তাই ‘বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ইতিহাস: অমীমাংসিত প্রশ্নাবলি’ শিরোনামধৃত প্রবন্ধ দিয়ে যখন এই গ্রন্থের সূচনা হয়, তখন একটু নড়েচড়ে বসতে হয় তো বটেই। উল্লিখিত প্রবন্ধে বাংলাদেশের একটি পূর্বাপর পর্যালোচনা-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসকে নানা ঐতিহাসিক-কালপর্ব বা অধ্যায়ে বিভক্ত করে লেখক এই অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ওই সব ঐতিহাসিক পর্ব, অধ্যায় বা অংশের আর্থসামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
গ্রন্থকার-গবেষক নজরুল ইসলাম আমাদের সামনে যখন তুলে ধরেন, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ও স্যার যদুনাথ সরকার প্রণীত The History of Bengal (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) এবং নীহাররঞ্জন রায়ের সুখ্যাত গ্রন্থ বাঙ্গালীর ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাস পরিবেশনে চমৎকার উৎকর্ষের পরিচয়বাহী হলেও, বাংলার আর্থসামাজিক ইতিহাসের অনেক মূল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন আমরা তাঁর যুক্তির অনুকূলে উপস্থাপিত তথ্যের গভীরে আত্মমগ্ন হতে বাধ্য হই।
নজরুল ইসলাম আমাদের জানাচ্ছেন, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসবিদ্যার চমৎকার বিশালতা সত্ত্বেও সামাজিক ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে সম্পাদিত গবেষণা ও প্রকাশনার উদাহরণ তুলনামূলকভাবে কম।’ ফলে তিনি তাঁর প্রসঙ্গিত বিষয়ের অনুকূলে সংগতভাবেই দ্বারস্থ হন ভারতের সামাজিক ইতিহাসের পথিকৃৎ দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বীর। এবং এই পথিকৃৎ সামাজিক ইতিহাসবিদের অনুসৃত পথেই নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলি, ভারতের সামাজিক ইতিহাস প্রসঙ্গ, ভারতে কৌম থেকে আঞ্চলিক সমাজগঠনের প্রক্রিয়া, ভারতবর্ষীয় গ্রামসমাজের উদ্ভবকাল, তার কাঠামোগত অভিঘাতের প্রশ্ন এবং বাংলাদেশের গ্রামের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সুগভীর আলোচনায় ব্রতী হয়েছেন। ভারতীয় গ্রামের উদ্ভবের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামের উদ্ভবের বিষয়টি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। ফলে নজরুল ইসলাম সে প্রসঙ্গের আলোচনাকে গভীরতর করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে গিয়ে উপরিভাসা কোনো তত্ত্ব, তথ্য, উদাহরণ, অভিমত বা দৃষ্টান্তের আশ্রয় নেননি। এ গ্রন্থে সংকলিত প্রতিটি প্রবন্ধ বহন করছে তাঁরই সাক্ষ্য। এই গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ, যার শিরোনামেই এই গ্রন্থের নাম, সেটি আবার ‘গ্রামের ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা’, ‘ভারতবর্ষীয় গ্রামসম্পর্কিত ইউরোপীয় আলোচনা’, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসবিদ্যায় গ্রাম’, ‘গ্রামের উদ্ভব ও বিবর্তনের পর্যায়সমূহ’, ‘বাংলাদেশের গ্রাম: ভবিষ্যতের প্রশ্ন’, ‘গ্রামের ভবিষ্যৎ রূপান্তরের রূপরেখার প্রশ্ন’ এবং ‘উপসংহার’ নামের উপশিরোনামে বিভক্ত।
গ্রন্থের শেষোক্ত প্রবন্ধে তিনি যে তথ্যসূত্রের সমাবেশ ঘটান, এক অর্থে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। আলোচ্য বিষয়ের প্রতিপন্নতায় তিনি নিজের মতটিকে উপসংহার হিসেবে তুলে ধরেন প্রায় ধ্রুবভাষ্যে এইভাবে, ‘…বর্তমানে একদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে জমির ওপর যৌথ মালিকানার প্রস্তাব করা কঠিন; অন্যদিকে ভূমিস্বল্পতার কারণে গ্রামের সব ভূমিহীন ও প্রায়-ভূমিহীন পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করে সমতাধর্মী জমি-মালিকানা অর্জনও দুরূহ। অথচ গ্রামের জল, জমি ও জনসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার অর্জনের জন্য এসব সম্পদের ওপর গ্রামের সবার অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।’ নজরুল ইসলাম এই পরিপ্রেক্ষিত বিচারে আবার এই বলে প্রশ্নও তুলছেন যে, ‘তার মানে কি এই যে, গ্রামের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের কোনো পথই আর খোলা নেই?’ জবাবে তিনি বলছেন, ‘পরিস্থিতিটি এত হতাশাকর নাও হতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামের অতীত ঐতিহ্য ও সাম্প্রতিক কালের কৃষি রূপান্তরের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এমন ফর্মুলার উদ্ভাবন সম্ভব, যাতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও ভূমিস্বল্পতার পরিস্থিতির মধ্যেও গ্রামের জমি ও জনসম্পদের ওপর সকল গ্রামবাসীর অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, যাতে গ্রামের সকলেই বিভিন্ন যৌথ বিনিয়োগমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়।’ বাংলাদেশের গ্রাম ও তার সম্ভাবনার একটা বিচ্ছুরণরেখা নজরুল ইসলাম যখন এইভাবে তুলে ধরেন, তখন গ্রন্থটির পাঠ-প্রয়োজন যে অপরিহার্য, বোধের মর্মে সেটা দীপ্র হয়ে ওঠে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০১১
Leave a Reply