ক্ষিতীশ সরকার তাঁর দল নিয়ে পরিবেশনায় একদিন বাংলাদেশের সীমারেখা অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভীমপুর এলাকার আসাননগর-কদমখালী গ্রামে পৌঁছি। সেখানে লালনতীর্থে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লালনমেলা সমিতি আয়োজিত লালনমেলা প্রত্যক্ষ করতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গে লালনমেলা কেমন করে উদ্যাপিত হয়, তা প্রত্যক্ষ করাই আমার মূল লক্ষ্য ছিল। সেখানে প্রতিবছরের মতো লালনমেলা শুরুর আগের দিন সন্ধ্যায় কবিগানের আসর বসবে শুনেছিলাম। আমি তাই দিল্লি, চণ্ডীগড় ও কলকাতার কাজ আগেভাগেই শেষ করে যথাসময়ের আগেই নদীয়ার কদমখালীর লালনতীর্থে পৌঁছালাম। তারিখটা ছিল ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর। সেদিনের কবিগানের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘মীর মশাররফ হোসেন ও কাঙ্গাল হরিনাথ’। আমার দেখা কবিগানের আসরের মধ্যে এ ধরনের বিষয়বস্তু নির্ধারণ ছিল রীতিমতো অভিনব। সে যা-ই হোক, আসরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দুই প্রখ্যাত কবি জগদীশ সরকার (৫০) ও ক্ষিতীশ সরকারের (৪৫) দল। তাঁরা মূলত ‘মীর মশাররফ হোসেন এবং কাঙ্গাল হরিনাথ’ বিষয়ে আলোচনার ভেতর দিয়ে লালন-রবীন্দ্রনাথ ও জসীমউদ্দীনের চিন্তাভাবনাকেও আসরে উপস্থিত জনমানুষের মধ্যে উপস্থাপন করতে তৎপর হয়েছিলেন। লালন প্রবর্তিত মানবধর্মের মাহাত্ম্য প্রকাশের লক্ষ্যে কবি জগদীশ সরকার প্রাসঙ্গিকভাবে জসীমউদ্দীনকে আসরে যেভাবে হাজির করেছিলেন, নিচে তা উপস্থাপন করা যেতে পারে।
জগদীশ সরকার বলেন, ‘কবিয়াল বিজয় সরকার বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি জসীমউদ্দীন রচিত লিখিত সাহিত্য আখ্যানকাব্য নকসী কাঁথার মাঠ-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রদ্বয়ের বেদনাবোধকে আত্তীকৃত করে আরেকটি গান গেয়েছিলেন। তার আগে জসীমউদ্দীনের নকসী কাঁথার মাঠ-এর কাহিনিটা একটু উল্লেখ করে নিতে চাই, কেননা আপনাদের অনেকেরই তো কাব্যটি পড়া হয়ে ওঠেনি।
কবি জসীমউদ্দীন তাঁর নকসী কাঁথার মাঠ-এর নায়ক রূপাই। সে গাঁয়ের ছেলে। তার কতগুলো গুণ আছে, সে কৃষ্ণকায় ছেলে, তার কাঁধ পর্যন্ত চুল আছে, সে ভালো ঘর ছাইতে জানে এবং যে হাত দিয়ে সে সুন্দর ঘর ছায়, সেই হাতেই লড়কি চালাতে জানে, সড়কি চালাতে জানে, আবার বাঁশের বাঁশিতে তার মতো আড় আর কেউ দিতে পারে না, এমনকি তার মতো আর কেউ গান গাইতেও পারে না। এই রূপাইয়ের সঙ্গে পাশের গ্রামের মেয়ে সাজুর ভালোবাসা হয়। তারপর তাদের বিয়ে হয়। তারা সুখের সংসার পাতে। একদিন গভীর রাতে চাঁদ ওঠে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে রয়, তাই একসময় বাঁশির বাজনা থেমে যায়। কারণ, যার উদ্দেশে বা যাকে শোনানোর জন্য রূপাই এত দিন বাঁশি বাজিয়েছে, সেই মানুষটি এখন তার ঘরে। সেদিন রাতের পূর্ণিমার আলোতে সাজুর রূপ দেখে দারুণ মুগ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই রূপাইয়ের মনে কী যেন এক সংশয় জেগে ওঠে। সে ভাবে, এত সুখ আমার সইবে তো! একটা অজানা আশঙ্কায় তার ভেতরের বেদনার উদ্গত অশ্রু সাজুর কোমল মুখের ওপর পড়ে, সাজুর ঘুম ভেঙে যায়, স্বামীর চোখে জলের ধারা দেখে সাজু বলে, তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো আমি কোনো আঘাত দিইনি। রূপাই বলে, সে জন্য কাঁদছি না—একটা অজানা আশঙ্কায় কাঁদছি। বলে, না না, আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। এমন সময় হঠাৎ খবর আসে, বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা-চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে মারামারি হয়, কয়েকটি খুন হলে রূপাই ফেরারি হয়ে গেল। আর সাজু রোজ একটা পিদিম বা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকে সব সময়। যখন একটা মরা পাতা ঝরে পড়ে, ওই পাতার শব্দে সেই রূপাই-বিরহিণী সাজু পাতার শব্দ লক্ষ্য করে আলোটা নিয়ে ছুটে যায়, কোথায় রূপাই? দিন চলে যায়। একদিন গভীর রাতে রূপাই এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। সাজু দেখে, রূপাইয়ের সারা গায়ে মাটি মাখা, রক্তের দাগও লেগে আছে কোথাও কোথাও। সাজু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে আর যেতে দেবো না।’ রূপাই বলেছে, ‘আমার না যেয়ে উপায় নেই, সাজু যেতেই হবে। কেননা, আমি যদি ধরা পড়ি, আমার ফাঁসি অথবা কালাপানি হবে।’ সাজু এখানে বলেছিল, ‘তুমি তো চলে যাবে আমাকে কার কাছে তুমি রেখে যাবে’, এখানে জসীমউদ্দীনের ভাষায় রূপাই বলছে, ‘সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই/ সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।/ মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে/ তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণতলে।’ ইহলোকে রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর এই শেষ দেখা। সাজু আর কী করবে, সেই প্রথম দেখা ও বৃষ্টির জন্য কুলা নামানোর দিনের দৃষ্টি বিনিময় থেকে শুরু করে তাদের জীবনের সব কথাকে এমনকি যে রাতে রূপাই জন্মের মতো চলে গেল, এসব অতীত স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে লাগল সুচ-সুতা দিয়ে। যেদিন শেষ হয়ে গেল মায়ের কাছে দিয়ে বলল, ‘মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এই নকসী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনো দিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে।’ বহুদিন পরে গাঁয়ের কৃষকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির ধ্বনি শুনতে পায়, আর প্রভাতে সবাই এসে দেখে, সাজুর কবরের পাশে একজন ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। এই হলো নকসী কাঁথার মাঠ। কবি জসীমউদ্দীন এই আখ্যানের একেবারে শেষ পর্বে এর করুণ বেদনাকে প্রকাশ করতে লিখেছেন, ‘আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে/ নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।’ শুধু তা-ই নয়, তিনি এ কাহিনির বেদনাকে বিস্তার করে দিতে আরও লিখেছেন, ‘কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে/ মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে/ হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে/ তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।’ এখানে দাঁড়িয়ে কবি বিজয় সরকার লিখেছেন—
নকসী কাঁথার মাঠে রে
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।
তাদের আশার বাসা ভেঙে গেছে রে
তবু যায়নি ভালবাসাবাসি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি
কত আশা বুকে নিয়ে (তারা) বেঁধেছিল ঘর
কত সুখে মিশেছিল মিলন-মঞ্চ ’পর
হঠাৎ আসিয়া এক বৈশাখী ঝড় রে
সে ঘর কোথা গেল ভাসি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি
সাজুর কবরের এক পাশে নকশিকাঁথা গায়
রূপাই মিঞা শুয়ে আছে মরণের শয্যায়
তারা আছে চির নীরবতায় রে
তাদের দুইটি হিয়া পাশাপাশি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি
অকরুণ দারুণ বিধি বিচার তোর কেমন
তোর বুঝি ভালবাসার কেউ নাহি রে এমন
তাইতে বুঝিস না তুই বিরহীর মন রে
(হা রে) কেন তাদের কান্না-হাসি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বেদনার ছায়ায়
নকসী কাঁথা লিখেছেন তার মনের মায়ায়
ভাবুক কবিগণ আনে কল্পনায় রে
যত সত্য লোকের তত্ত্বরাশি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি
নকসী কাঁথার মাঠে লোকে আজো শুনতে পায়
সাজুর ব্যথায় রূপাই মিঞা বাঁশরী বাজায়
পাগল বিজয় বলে পরানে চায় রে
আমি একবার গিয়ে শুনে আসি\
সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।
জগদীশ সরকার এই গানটি গেয়ে থেমে যান না। তিনি আরও বলেন, ‘এখনো নাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে ফরিদপুর জেলার এক বিস্তীর্ণ মাঠের পাশে রূপাই-সাজু শুয়ে আছে। কবি বিজয় সরকারের মতো আমারও মনে বড় ইচ্ছা, সেই প্রেমিকা-প্রেমিকা যুগলের তীর্থ মাঠ দেখে আসতে। জানি না, এই জীবনে সেই সৌভাগ্য আসবে কবে।’
কবিগানের আসরে বসে বাংলা ভাষার লিখিত সাহিত্য ও মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে এই সেতুবন্ধ রচনার বিষয়টি লক্ষ করে কার না আনন্দ হবে। একই সঙ্গে এ-ও তো ঠিক, নতুন ধরনের গবেষণার সূচনা হতে পারে এখান থেকে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৫, ২০১১
Leave a Reply