১১. লন্ডনের মতো ভারতীয়দের ভিড়

লন্ডনের মতো ভারতীয়দের ভিড় বা নিউইর্কের মতো ভি-আই-পি-র স্রোত নেই বার্লিনে। ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটদের কাছে এটা শুধু শাস্তি নয়, স্বস্তিরও বটে। তবে বার্লিনে আছে ডেলিগেশনের অফুরন্ত ধারা। অতীত দিনের বাংলাদেশের মতো বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে এখানে। পলিটিশিয়ানের সংখ্যা সীমিত হলেও ডিগনিটারীর অভাব নেই। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট থেকে শুরু করে ফিল্ম-স্টার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট পর্যন্ত।

ডেলিগেশন বে-সরকারি হলে ডিপ্লোম্যাটদের দায় থাকে, দায়িত্ব থাকে না। কর্তব্য থাকে কিন্তু দুশ্চিন্তা থাকে। কন্সাল জেনারেল মিঃ ট্যান্ডন নিছক ভদ্রলোক। রিটায়ার করার মুখোমুখি কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে চান না। তাছাড়া ফরেন অফিসের একজন প্রবীণ ডিপ্লোম্যাট বলে আলাপ আছে সারা দেশের সরকারি বে-সরকারি মানুষের সঙ্গে। সুতরাং ঝামেলার শেষ নেই।…

সেবার জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার কনফারেন্স ইন্ডিয়ান ডেলিগেশনের লিডার ছিলেন মাইশোরের লেবার ও ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার মিঃ ভীমাপ্পা। ভীমাপ্পাসাহেবের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। ভীমাপ্লাজনক ছিলেন মাইশোর মহারাজার ডেপুটি পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। শৈশব, কৈশোরে দশের শোভাযাত্রায় হাতি চড়ে ঘুরেছেন গার্ডেন সিটি মাইশোরের রাজপথ। প্রথম যৌবনের সোনালি দিনগুলিতে লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘোরাঘুরি করেছেন রাজপ্রাসাদের আনাচে-কানাচে।

ভীমাপ্লাসাহেবের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের এই শেষ নয়, শুরু। পড়াশুনা করেছেন ব্যাঙ্গালোরের মিশনারী কলেজে, হৃদ্যতা হয়েছে ডজন ডজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলায় তাদের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন চমরাজ সাগর-লেকের ধারে। ছুটির দিনে ছোট মেল চড়ে দল বেঁধে গিয়েছেন নন্দী পাহাড়ে। কখনও বা শিবাসমুদ্রমে গিয়ে কাবেরীর জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

আরো কত কি করেছেন এই ভীমাপ্লাসাহেব। দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো সুর করে ইংরেজি ইনি বলেন না। অসোনিয়ন ইংলিশ না বললেও ইংরেজি বেশ বলেন।

আরো পরের কথা। এম-এল-এ হবার পর চুড়িদার শেরওয়ানী পরে ঘোরাঘুরি শুরু করলেন দিল্লির রাজনৈতিক মহলে। গোটা দুয়েক ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার প্যাসেঞ্জার হবার পর একদিন শুভক্ষণে মন্ত্রী। লেবার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার। অদৃষ্টের সিংহদ্বার খুলে গেল।

একবার নয়, দুবার নয়, সরকারি-বেসরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে বহুবার বহু কারণে গিয়েছেন পৃথিবীর নানা দেশে। মিঃ ট্যান্ডনের সঙ্গে সেই সূত্রেই আলাপ। একবার একটা গুড উইল ডেলিগেশনে ওরা দুজনেই গিয়েছিলেন ইস্ট ইউরোপের কয়েকটি দেশে।

ভীমাপ্পা যে জেনেভায় ইন্ডিয়ান ডেলিগেশনের লিডার হয়ে গিয়েছেন, সে খবর পৌঁছেছিল বার্লিনে। কিছুদিন পরে ওঁর একটা চিঠিও এলো মিঃ ট্যাভনের কাছে।…কি নিদারুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে, তা বোঝাতে পারব না। এত মতভেদ ও মতবিরোধ যে দেখা দেবে আমাদের ডেলিগেশনের মধ্যে, তা আগে ভাবতে পারিনি। যাই হোক কনফারেন্স শেষ হলে কয়েক   সপ্তাহের জন্য একটু ঘুরেফিরে বেড়াব। বার্লিনে নিশ্চয়ই যাব। কয়েকটা দিন একটু আনন্দ করা যাবে।

সেদিন কনসুলেটে যেতেই মিঃ ট্যান্ডন তলব করলেন তরুণকে। বললেন, আই হোপ ইউ ননা মিঃ ভীমাপ্পা? ওই যে মাইশোরের লেবার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার।

তরুণের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও ভীমাপ্পাসাহেবের কথা সে শুনেছে। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি ওঁর কথা। তাছাড়া উনি তো আই-এল-ও কনফারেন্সে আমাদের ডেলিগেশনের লিডার।

মিঃ ট্যান্ডন খুশি হয়ে বললেন, দ্যাটস্ রাইট। তুমি দেখছি কারুর কথাই ভুলে যাও না।

হাসতে হাসতে তরুণ বলে, ভারতবর্ষের এসব স্মরণীয় ব্যক্তিদের ভুললে কি আর চাকরি করতে পারি?

ট্যান্ডনও একটু না হেসে পারলেন না। তা তুমি ঠিকই বলেছ। স্মরণীয়ই বটে।

একটু থেমে একটু মুচকি হেসে বললেন, তুমি কিছু জান নাকি ওর সম্পর্কে?

বিশেষ কিছু না, তবে শুনেছি জলি গুড ফেলো।

ঠিক শুনেছ। যাই হোক, উনি আসছেন কয়েকদিনের জন্য। যদিও প্রাইভেট ভিজিটে আসছেন, তবুও মিনিস্টার তো, কিছু ব্যবস্থা কিছু দেখাশুনা করতেই হবে।

পশ্চিমের অনেক দেশে ডিপ্লোম্যাটদের অনেক রকম টুকটাক সুবিধে দেওয়া যায়। ডিপ্লোম্যাট হিসেবে কেনাকাটা করলে অনেক সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ডিপ্লোম্যাটিক মিশন থেকে বুক করলে বহু হোটেলেও চার্জ কম লাগে। ভীমাপ্পাসাহেবের মতো যাঁরা ঘন ঘন বিদেশে যান ও ইন্ডিয়ান মিশনের সঙ্গে খাতির আছে, তাদের হোটেলে বুকিং হয় ইন্ডিয়ান মিশনের মারফৎ। সুতরাং মিঃ ভীমার জন্য হোটেল আম জুতেই অ্যাকোমডেশন বুক করা হল। কনসুলেটের একটা গাড়িও রাখা হল মাঝে মাঝে ভীম্পাসাহেবকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করার জন্য। সরকারিভাবে নয়, বেসরকারিভাবে। দিনকাল বদলে যাচ্ছে। কোথা থেকে কিভাবে যে খবর বেরিয়ে যায় তার ঠিক নেই। এসব খবর অপোজিশন এম-পি-দের হাতে পড়লে রক্ষা নেই। সুতরাং আইন-কানুন বাঁচিয়েই গাড়ির ব্যবস্থা করা হল।

মিঃ ট্যান্ডন নিজেই এয়ারপোর্ট গেলেন ভীমাপ্লাসাহেবকে রিসিভ করতে। তবে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার পর হোটেলে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিলেন কনসুলেটের একজন সাধারণ কর্মীকে।

এয়ার ফ্রান্সের প্লেন ঠিক সময়েই এল। কথামতো ভীমাপ্পা এলেন। পিছনে এলেন মিঃ শর্মা। হাসিমুখে মিঃ ট্যাভনের সঙ্গে করমর্দন করার পর ভীমাম্পাসাহেব বললেন, মীট মাই ফ্রেন্ড মিঃ শর্মা…

স্বভাবসুলভ খুশি মনেই মিঃ ট্যান্ডন হ্যাঁন্ডসেক করে বললেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিঃ শর্মা।

এরপর ভীমাপ্পাসাহেব শৰ্মাজীর পরিচয় দিলেন।… জানেন মিঃ ট্যান্ডন, শৰ্মাজী একজন ফেমাস ট্রেড ইউনিয়ন লিডার। এবার আমাদের ডেলিগেশনের একজন মেম্বারও ছিলেন! র‍্যাদার হি ওয়াজ দি মোস্ট অ্যাকটিভ মেম্বার অফ অল দেম।

ভীমাপ্পা শৰ্মাজীর আরো অনেক গুণের কথা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে অতক্ষণ বকবক করা ভালো দেখায় না বলে মিঃ ট্যান্ডন বললেন, কয়েক দিন থাকছেন তো? পরে ভালোভাবে কথাবার্তা বলা যাবে।

মিঃ ভীমাপ্পার সঙ্গেই আবার চলে যাব। আপনি কোথায় থাকছেন?

ভীমাল্লাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, একসঙ্গে এসেছি একসঙ্গেই থাকব।

ট্যাভন সাহেব চিন্তিত না হয়ে পারলেন না। এক্সকিউজ মী মিঃ ভীমাল্লা, আপনি কি ওর বিষয়ে কিছু জানিয়েছিলেন?

না, তবে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে।

কথাটা শুনে মনে মনে ট্যান্ডন বিরক্ত বোধ করলেন। হরিদ্বার-লছমনঝোলা বা কাশী-গয়ার ধর্মশালায় এক ঘরে পাঁচ-দশজনকে থাকতে দিতে পারে কিন্তু বার্লিনে যে তা সম্ভব নয়, ভীমাপ্পা ভালোভাবেই জানেন। একটু খবর দিলেই সবকিছু ব্যবস্থা ঠিক থাকত। কিন্তু অধিকাংশই ভীমার্গার দলে। কেউ সোমবার বলে মঙ্গলবার, সকাল বলে বিকেলে আসেন; আবার কখনও তিনজন বলে একজন অথবা একজন বলে তিনজন।

এই তো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইন্ডিয়ান ডেলিগেশন নিয়ে কি কাণ্ডটাই হয়ে গেল। দুটি ফিচার ফিল্ম, একটি ডকুমেন্টারী ইন্ডিয়ার অফিসিয়াল এনট্রি ছিল। এইসব ফিল্মর প্রডিউসার, ডিরেক্টার, অভিনেতা ও অভিনেত্রীর দলে এগারোজন থাকার কথা। এ ছাড়া ফেস্টিভ্যাল কমিটি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভারতীয় ফিল্ম দুনিয়ার চারজনকে। এরা সবাই আসবেন বলে কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে থেকে চিঠি এল। চিঠি পাবার পর হোটেল বুক করা হল।

আবার চিঠি এল, টেলিগ্রাম এল। কেউ জানালেন সোমবার আসছেন, কেউ জানালেন মঙ্গলবার আসছেন, কেউ সকালে, কেউ বিকেলে।

চিঠি আসা বন্ধ হল, শুরু হল টেলিগ্রাম আসা। ফরেন একচেঞ্জ নট ইয়েট স্যাংশান। ডিপারচার ডিলেড-বলে জানালেন কলকাতা থেকে মিঃ গুপ্ত। ফেস্টিভ্যাল কমিটির আমন্ত্রণে যে চারজনের আসার কথা তাদের দুজন বোধহয় ধার-দেনা করেও প্লেন ভাড়া জোগাড় করতে পারেননি, তাই শেষ মুহূর্তে দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন! সরি, ক্যান্ট অ্যাটেন্ড, সিরিয়াসলি ইল বলে জানালেন কলকাতার এক বিখ্যাত ফিল্ম জার্নালিস্ট। বোম্বের ভদ্রলোক হিন্দী ফিল্মের মতো টেলিগ্রাম করে জানালেন, এয়ারপোর্টে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সুতরাং সরি, ভেরী সরি। সামনের বছর নিশ্চয়ই আসব।

আরো কত টেলিগ্রাম এল। বোম্বের প্রডিউসার ভোসলে জানালেন, নায়িকা কুমারী সুন্দরীকে নিয়ে বুধবার আসছি। নায়ক দুর্লভকুমার রিচিং থার্সডে। কিন্তু কখন? বার্লিনে কি একটাই ফ্লাইট? একদিনে তিনটি টেলিগ্রাম এল কলকাতা থেকে। কোনোটাতেই স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই।

কি বিভ্রাটেই না কনসুলেটকে পড়তে হয়েছিল। ফেস্টিভ্যাল কমিটি থেকে বার বার করে ফোন আসে কন্সাল জেনারেলের কাছে। অথচ তিনি কিছুই বলতে পারেন না। বলবেন কী? নিজেদের সরকারের অকর্মণ্যতার কথা বাইরে বলা যায়, বলা যায় না, বিশ্বের সব চাইতে অস্পষ্ট মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষগুলিই ফরেন একচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেন।

শেষ পর্যন্ত তিন দিন ধরে চারটে আলাদা আলাদা ফ্লাইটে এলেন সাতজন। হোটেলে পৌঁছে প্রডিউসার ভোসলে অবাক হলেন সিঙ্গল রুম অ্যাকোমোডেশন দেখে। প্রথমে অনুরোধ, পরে দাবি জানালেন ডবল রুমের জন্য। ইউরোপের নানাদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন বার্লিন ফেস্টিভ্যাল দেখতে। তিল ধারণের জায়গা নেই কোনো হোটেলে। হোটেল কর্তৃপক্ষ অক্ষমতা জানালেন। ভোসলে সাহেব ক্ষেপে লাল!

মুখে বললেন না, তবে বেশ স্পষ্টভাবেই কন্সাল জেনারেলকে বুঝিয়ে দিলেন, আপনাদের মতো সত্যমেব জয়তের তিলক পরে আমাকে গোলামি করতে হয় না। হাজার হাজার টাকা খরচা করে হিরোইনকে নিয়ে এসেছি শুধু ফিল্ম জার্নালে দুচারটে ছবি ছাপাবার জন্য নয়, নিজের প্রয়োজনে।

মিঃ ট্যান্ডনের মতো লোকও আর সহ্য করতে পারলেন না। বললেন, মিঃ ভোঁসলে, আপনাদের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। নিছক ভদ্রতা, সৌজন্যের খাতিরে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। দ্যাটস অল রাইট।

দেশের সুনাম বা প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তো নয়, নিছক রক্তমাংসের দেহটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্যেই কোনো অনারেবল ডেলিগেটের আগমন হয়। কিন্তু তাহলে কি হয়! ইন্ডিয়ান মিশনের জ্বালাতনের শেষ নেই।

ভীমাপ্পাসাহেব একজন মন্ত্রী ও ইন্ডিয়ার ডেলিগেশনের নেতৃত্ব করেছেন! দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে তাকে অপবাদ দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তবুও তিনি শৰ্মাজীকে আনার আগে একটা খবর দেওয়া কর্তব্য মনে করেননি।

মিঃ ট্যান্ডন মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে বললেন, ঠিক আছে, চলে যান হোটেলে। আই হোপ দে উইল ম্যানেজ সামহাউ।

পরের দুদিন ভীমাপ্পা ও শৰ্মাজীর টিকিটি পর্যন্ত দেখা গেল না। তিন দিনের দিন দুপুরের দিকে কনসুলেটে হাজির হয়ে ট্যান্ডনকে অনুরোধ করলেন, আমি আর শর্মাজী কিছু কেনাকাটা করব। মিঃ সেনগুপ্ত যদি একটু কাইন্ডলি হেল্প করেন…?

লন্ডনে গিয়ে ভিড়ে ভর্তি পাবে গিয়ে এক জাগ বিয়ার না খেলে বিলেত যাওয়া বৃথা। প্যারিসে গিয়ে নাইট ক্লাবে যেতে হয় আর পারফিউম কিনতে হয়। রোমে গিয়ে ক্যাসিনো। তেমনি বার্লিনে গিয়ে নাইট ক্লাবে রাত কাটাতে হয়, সস্তায় ক্যামেরা কিনতে হয়। এসব নিয়ম পালন না করলে ইন্ডিয়ান ভি-আই-পি-দের ধর্মরক্ষা হয় না।

ভীমাপ্পা নিজেই বললেন, ইউ সি মিঃ ট্যান্ডন, লাস্ট দুটো নাইট রেসিতে বেশ কেটেছে।

রেসি?

হ্যাঁ, বলহাউস রেসি। বার্লিনের পৃথিবীখ্যাত নাইট ক্লাব। ডান্সিং ফ্লোরের চারপাশে ছোট ছোট কেবিন। প্রত্যেক টেবিলে আছে টেলিফোন ও ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে চিঠি আদান-প্রদানের অপূর্ব ব্যবস্থা। খোলামেলা কেবিনে বসে দেখে নিন কে কোথায় বসেছে। টেবিলের উপর রাখা ম্যাপ দেখে জেনে নিন অন্যের টেবিল নম্বর। তারপর চিঠি লিখুন, দূর থেকে আপনাকে বেশ লাগছে। যদি আপত্তি না করেন তাহলে এই ভারতীয় আপনার সঙ্গে একটু নাচতে চান।

ইলেকট্রনিক্সের কৃপায় মুহূর্তের মধ্যে সে চিঠি পৌঁছে যাবে ঠিক অভীষ্ট স্থানে। উত্তর আসবে, এই শ্যাম্পেনটুকু শেষ করার ধৈর্য ধরতে পারলে বার্লিনে ভ্রমণরতা ও হ্যাঁমবুর্গবাসিনী কৃতার্থ হবে।

জার্মান মেয়েদের সম্পর্কে আমার অত্যন্ত উঁচু ধারণা ছিল, কিন্তু সামান্য এক গেলাস শ্যাম্পেনের প্রতি আপনার দুর্বলতা দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারছি না।

মাই ডিয়ার জেন্টলম্যান, কি করব বলুন? শুধু নাচতেই নেমন্তন্ন করলেন। শ্যাম্পেনের অফার তো পেলাম না।

ভীমাপ্পাসাহেব নিশ্চয়ই ভাবলেন, বিদেশ বিভূঁইতে তোমার মতো ডাগর-ডোগর জার্মান বান্ধবী পেলে এক গেলাস কেন, বোতল বোতল শ্যাম্পেন দিতে পারি।

যাই হোক উত্তর গেল, ইউ আর ওয়েলকাম টু ডান্স অ্যান্ড ড্রিংক।

এমনি করে খেলা চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শ্যাম্পেন খেয়ে নাচতে নাচতে মদির হয়ে অনেকে দেখতে বসেন রেসি ওয়াটার শো। সে আর এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রতি মিনিটে নহাজার জেট আট হাজার লিটার জল ছড়াচ্ছে এক লক্ষ আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে।

রেসির গল্প করতে করতে আনন্দে, খুশিতে ভীমাপ্লাসাহেবের মুখোনা হাসিতে ভরে গেল, চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জানেন মিঃ ট্যান্ডন, রেসিতে গেলে ভুলে যেতে হয় এই মাটির পৃথিবীর কথা।

ভীমাপ্পাসাহেব এত আগ্রহ করে সব বলেছিলেন যে মিঃ ট্যান্ডন তাকে একেবারে দমিয়ে দিতে পারলেন না। এরা আনন্দ করতে জানে।

এবার ভীমাঞ্জাসাহেব লিডারের মতো কথা বলতে শুরু করলেন, যে জাত আনন্দ করতে জানে না, সে পরিশ্রম করতেও জানে না। কাজ করতে হলে আনন্দ করার, ফুর্তি করার স্কোপ চাই। কিন্তু ইন্ডিয়াতে কোথায় সেই আনন্দ করার স্কোপ?

দ্যাটস রাইট মিঃ ভীমাল্লা।

মিঃ ট্যান্ডন প্রবীণ হলেও ফরেন সার্ভিসের লোক। খুব বেশি না বুঝলেও একটু বুঝলেন, রেসিতে নাচতে নাচতে মিঃ ভীমাপ্পা কোনো শিকার ধরেছিলেন নিশ্চয়ই।

শর্মাজী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। রেসির স্মৃতি মনের মধ্যে টগবগ করে ফুটছিল। আর সামলাতে পারলেন না, ডু ইউ নো মিঃ ট্যান্ডন, ওই যে মেয়েটি-মিস রিটারের সঙ্গে দুদিন কাটিয়ে কিছু কিছু জার্মান কথাও শিখেছি।

মিঃ ট্যান্ডন ইংরেজিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে বললেন, ডাংকেসন! শৰ্মাজী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বিটুসেন।

ভীমাপ্পা আবার কেনাকাটার কথা শুরু করলেন, টুমরো উই আর ফ্রি। তারপর কিছু ইন্ডাস্ট্রি দেখব। দু একটা পার্টির সঙ্গে কথাবার্তা আছে। ওরা হয়তো কোলাবরেশন করে মাইশোরে কিছু স্টার্ট করতে পারে।

অর্থাৎ আগামী কালই শপিং করতে চান? ট্যান্ডন জানতে চাইলেন।

দ্যাট উড বি ফাইন।

ট্যান্ডন সাহেব তরুণ সেনগুপ্তকে ভালোভাবেই জানেন। এক বোতল বিয়ার বা একটা ডিনারের লোভে সে ইন্ডিয়ান ভি আই-পি-দের ল্যাংবোট করে ঘুরতে আদৌ পছন্দ করে না। তাছাড়া নিজের নামে কিনে ভীমাপ্পাকে দিতে তার আপত্তি থাকবেই। অথচ।

অথচ আবার কি? ফরেন সার্ভিসে এসব হজম করতেই হয়। কতজনের মেয়ের বিয়ের সময় হাজার হাজার টাকার মালপত্র কিনে ডিপ্লোম্যাট বা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ মারফত পাঠাতে হয়।

কি কি কিনতে চান তার একটা লিস্ট আর সেগুলোর দাম রেখে যান। আই উইল ট্রাই টু হেল্প ইউ। ট্যান্ডন সাহেব আর কি বলবেন!

সঙ্গে সঙ্গে দুজনে পকেট থেকে ক্যাটলগ, প্রাইস লিস্ট বের করলেন। দুজনে মিলে কত আলোচনা-সমালোচনার পর একটা লম্বা লিস্ট তৈরি করলেন।

আই অ্যাম আফ্রেড, এতগুলো কেনা সম্ভব হবে না।

শৰ্মাজী বললেন, আমরা তো রোজ আসব না। আর তাছাড়া ভীমাঞ্জার ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট আছে। বোম্বে বা দিল্লিতে কাস্টমসের ঝামেলা থাকবে না। তাই…।

কিন্তু আপনার মতো অনেকেই তো আসছেন।

ভীমাপ্পা অত্যন্ত বিবেচকের মতো বললেন, ঠিক আছে। লিস্ট রেখে গেলাম, যা পারেন তাই কিনবেন।

ভি-আই-পি-দ্বয় বিদায় নিলেন। ট্যান্ডন সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন তরুণকে।

তরুণ ঘরে ঢুকতেই ওই লিস্ট আর এক বান্ডিল দ্যবেস্তা মার্ক এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমার পুরস্কার দেখেছ?

তরুণ হাসতে হাসতে বলল, উনি যে ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার! তাই তো দেশের কিছুই ওঁর পছন্দ হবে না। ইমপোর্টেড জিনিসে ঘর ভর্তি না থাকলে কি ওঁদের প্রেস্টিজ থাকে?

একটু থেমে তরুণ আবার বলে, মাঝে মাঝে মনে হয় ট্রানজিস্টার টেরিলিন ক্যামেরা হুইস্কীর জন্য ইংরেজ যদি কিছু ব্যয় করত, তবে বোধহয় ওরা আবার ভারতবর্ষে রাজত্ব করতে পারত।

ট্যান্ডন সাহেব বললেন, বোধহয় তোমার কথাই সত্যি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *