তারাবাঈ ০৯ পরিচ্ছেদ

একটি মনোহর ও প্রশস্ত কক্ষ মধ্যে একটি অনতিউচ্চ পর্যাঙ্কে মহাবীর আফজাল খাঁ শায়িত রহিয়াছেন। একজন হাকিম, দুইজন দাসী এবং স্বয়ং তারাবাঈ প্রাণপণে তাঁহার সেবা শুশ্রূষায় পরিলিপ্ত রহিয়াছেন। গৃহের ছাদের দোদুল্যমান শতবাহুবিশিষ্ট ঝাড় প্রোজ্জ্বলিত হইয়া উজ্জ্বল আলোকে গৃহতল আলোকিত করিয়াছে। ক্রমে রাত্রি বেশি হইলে, হাকিম সাহেব চলিয়া গেলেন। দাসী দুইটিও কান্তরে যাইয়া শয়ন করিল। তখন তারাবাঈ সময় পাইয়া ধীরে ধীরে আফজাল খাঁর ললাটে ও মস্তকে হস্ত বুলাইতে লাগিল। দুইজন দুইজনকে দর্শন করিয়া গভীর প্রেমাবেশে অভিভূত হইতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ দেখিলেন, তারা অসাধারণ সুন্দরী। তাহার প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, উন্নত নাশিকা, আরক্তিম গন্ড, শঙ্খবিনিন্দিত কণ্ঠ সমস্তই চিত্তাবর্ষক এবং মনোহর। তাহার টানাটানি বাঁকা ভুরু আর তাহার নিন্মে সেই ডাগর ও উজ্জ্বল চক্ষুর লাস্যময় বিদ্যুৎ-কটাক্ষে মুনির মনও বিচলিত হইয়া যায়। সুন্দরীর যৌবন-কুসুম মনোহর ভঙ্গিতে বক্ষ-সাগরের বিকাশোন্মুখ সঞ্চার করে। সুন্দরীর বাহু, অধরোষ্ঠ, তালু, অংস, বক্ষ সমস্তই সুবিভক্ত এবং সুবিন্যস্ত। আফজাল খাঁ তারাবাঈ-এই সৌন্দর্য দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেলেন। কৃষ্ণবর্ণ মারাঠীর ঘরে ইরান-তুরানের এই অপরূপ সৌন্দর্য কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল! বস্তুতঃ, তারাবাঈ-এর বেশ পরিবর্তন করিয়া, কোনও শাহজাদীর পোশাকে তাহাকে সজ্জিত করিলে কেহই তাহাকে মারাঠী-সুন্দরী বলিয়া অনুধাবন করিতে পারিবে না। আফজাল খাঁ তারাকে যতই দেখিতে লাগিলেন, ততই মুগ্ধ হইতে লাগিলেন। তারার গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও কমনীয় হস্তখানি নিজ হস্তে ধীরে ধীরে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “তারা! তোমার ঋণ শোধ করা সুকঠিন। তোমার সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রেমেই আমার জীবন রক্ষা হয়েছে। তুমি যদি সেদিন সৈনিকের ছদ্মবেশে সাবধানতাসূচক পত্রখানি না দিতে, তা’ হলে আমি দেহরক্ষী সৈন্যসহ ঘোড়াডুবি-গর্তে পড়ে প্রাণ হারাতাম। তোমার পিতা যে এরূপ নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্র করবেন, তা’ আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল।

“এমন কঠিন পিতার ঔরসে জন্মিলেও তোমার অন্তঃকরণ অতি পবিত্র ও মহৎ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তুমি কেমন করে তোমার পিতার এই গভীর ষড়যন্ত্রের বিষয় অবগত হয়েছিলে? আর কি কৌশলেই বা তুমি রায়গড় পরিত্যাগ করে সেই নিবিড় বনরাজিপূর্ণ দুর্গম স্থানের সন্ধান পেলে?

তারাবাঈ ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেনাপতি! আপনাকে দর্শন করবার পর ত’তেই আমার প্রাণে ধীরে ধীরে আসক্তির তীব্র অনল প্রোজ্জ্বলিত হয়। তারপর আমাকে উন্মত্ত হস্তীর পদতল হ’তে ক্ষিপ্রতা এবং বীরত্ব ও কৌশলের সহিত রক্ষা করায়, আমি আপনার চরণেই আত্ম বিকিয়ে বসি। আমি সেই গভীর রজনীতে বিমনায়মান চিত্তে উদ্যানবাটিকায় বেড়াতে বেড়াতে উদ্যানমধ্যস্থ গৃহের নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারলাম যে, গভীর নিশীথে সেই গৃহের দ্বার রুদ্ধ করে আমার পিতা, গুরু রামদাস স্বামী, মালোজী প্রমুখ কি যেন পরামর্শ করছেন।

“অতঃপর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেই গৃহের অবরুদ্ধ জানালা সংলগ্ন হয়ে এই ভীষণ ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথাই শুনতে পেলাম। শিকারে যাবার কথা এবং শিকারে লয়ে লয়ে যেয়ে কৃষ্ণগড়ের নিকটবর্তী গিরিসঙ্কটে ঘোড়াডুবি-গর্তের মধ্যে কৌশলে নিক্ষেপপূর্বক প্রাণবধ করবার সমস্ত কথা শ্রবণ করে আমি যার-পর-নাই আকুল ও অস্থির হয়ে উঠি।

“কি করব, কোন উপায়ে আপনাকে রক্ষা করব, একান্ত মনে কেবল তাই অবিরাম কয়েকদিন পর্যন্ত চিন্তা করি। অবশেষে মনে করলাম, গোপনে কোনও রূপে দেখা করে বা পত্র দিয়ে আপনাকে সাবধান করে দিব। এইরূপ চিন্তায় একান্ত উন্মনা হয়ে আমার ধাত্রীমাতাকে সমস্ত কথা খুলে বলে তাঁর চরণ ধারণ করলাম। তিনি আমাকে নিবৃত্ত হবার জন্য অনেক বুঝালাম; কিন্তু তাতে আমি আরও অধীর ও ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। আপনার অহিত বা অনিষ্ট হলে আমি যে গলায় ছুরি নিব, তা’ তাঁকে বিশেষ দৃঢ়তার সহিত বললাম। তিনি গোপনে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করে আপনাকে সাবধান করে দিবেন বলে যে-দিন স্বীকার করলেন, দুঃখের বিষয় যে সেই দিনই আপনি পিতার সহিত সহসা শিকারে বহির্গত হয় পড়লেন।

“আপনার মৃগয়ায় গমনের পরে আমি ধাত্রীমাতার সাহায্যে আপনার উদ্দেশে জনৈক ভৃত্যকে আমার বহুমূল্য হার প্রদানের অঙ্গীকারে সঙ্গে লয়ে গভীর নিশীথের অন্ধকারে অশ্বারোহণে কৃষ্ণগড়াভিমুখে যাত্রা করি। অনুমানের উপর নির্ভর করে আমার সেই প্রাচীন ভৃত্যটি ইঙ্গিতে একটি পার্বত্য পথ দিয়ে আপনার নিকট উপস্থিত হই। পাছে কেউ ধরে ফেলে, এই ভয়েই চকিতে বিদ্যুৎ-গতিতে পত্র দিয়েই পলায়ন করি এবং অবিলম্বে কৃষ্ণগড়ের রানী মালেকা আমিনা বানুর নিকটে উপস্থিত হই। তিনি যখন আমাদের বাটী গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সহিত আমার গভীর প্রণয়ের সঞ্চার হয়। তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে আপনার পথের বিপদ এবং গুপ্ত সৈন্যের অবস্থানের কথা নিবেদন করে, আপনাকে রক্ষা করবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করি।

“সেই সূত্রে তিনি একশত তেজস্বী ও বিক্রান্ত অশ্বারোহী পাঠান সৈন্য লয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরমেশ্বরকে অনন্ত ধন্যবাদ যে, এই হতভাগিনীর চেষ্টা ও উদ্যম, আপনার জীবন রক্ষায় কতকটা সফল হয়েছে। আর কিছু পূর্বে মালেকার সৈন্যদল, ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলে, আপনি এরূপ গুরুতরভাবে জখম হতেন না। যা’ হোক, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এবং হাকিম সাহেবের চেষ্টায় আঘাত প্রায় আরোগ্য হয়ে এসেছে। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আপনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন।”
আফজাল খাঁ বলিলেন, “বিশ্বস্রষ্টার কৌশল ও মহিমা অপরিসীম! যিনি তোমার পিতার অন্তঃকরণে ভীষণ কুটিলতা ও হিংসার বিষ প্রদান করেছেন, সেই তিনিই আবার তোমার অন্তঃকরণ কোমলতা এবং প্রেমের সুধায় পরিপূর্ণ করেছেন! যিনি পাষাণকে কঠিন ও নীরস করে সৃষ্ট করেছেন, সেই তিনিই পাষাণের বক্ষ ভেদ করে তরল নির্মল জলের ধারা প্রবাহিত করেছেন।

“একই বৃন্তে একই উপাদানে তিনি কুসুম ও কণ্টক সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রহস্য, তাঁর মহিমা সকল। বিচিত্র ও কৌশলময়! তিনি কোমল কুসুমের কঠিন ফলের জন্ম দেন। আবার কঠিন ফলের মধ্যেই সুমিষ্ট রস ও সুশীতল স্নিগ্ধ বারি রক্ষা করেন। অনন্ত তাঁর মহিমা! অপরিসীম তাঁর কুদরত! তাঁকে ধন্যবাদ দাও।

“যিনি তোমার হৃদয়ে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন, যিনি তোমাকে কল্যাণের পথে পরিচালিত এবং তোমার প্রেমতৃষ্ণাকে তৃপ্তি দান করুন, এই প্রার্থনা করি।”

তারাবাঈ বলিলেন, “সেনাপতে! হৃদয়ের আকুল উন্মাদনায় তোমার জন্য গৃহত্যাগ করে আজ অরণ্যে চলে এসেছি। এখন তোমার পূজায় মন্দিরে যদি স্থান দাও, তোমার পূজায় লাগব, আর যদি স্থান না পাই, তবে অকালে জীবনকুসুম শুঙ্ক হয়ে ঝড়ে পড়বে! যেদিন হ’তে তোমাকে দেখেছি, সেইদিন হতেই সব ভুলে তোমাকে মজেছি। সেইদিন হতে তোমার চরণকমলের ধ্যান ব্যতীত দেবাদিদের মহেশ্বর শিবের ধ্যান আর করতে পারি নাই। মহেশ্বরকে যে ফুল ও বিল্বপত্র যুগিয়েছি, তা’ তোমার চরণেদ্দ্যেশেই যুগিয়েছে। সেইদিন হতে তোমার মোহনমূর্তি আমি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে এক মুহূর্তের জন্যও নিস্মৃত হতে পারি নাই।
“মনকে যত বুঝাতে লাগলাম, মত ততই অবুঝ হয়ে উঠতে লাগল; যতই ধৈর্যধারণ করতে চেষ্টা করলাম ততই অধীর ও উন্মত্ত হয়ে উঠল! চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তোমার হৃদয় তেমনি আমাকে আকর্ষণ করেছে! এ আকর্ষণে এ সন্মিলনে বাধা দিবার শক্তি কা’রও নাই!

“তুমি বিজাপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। তুমি একজন মস্ত বীর পুরুষ! তোমার সস্মুখে যশঃসন্ধান ও উচ্চপদ নিয়তই তোমাকে প্রলুব্ধ করছে! তুমি আমার জীবন-বসন্তের মলয়ানিল, হৃদয়-আকাশের চূর্ণ চন্দ্রমা এবং ঊষার আকাশে শুকতারা হলেও, আমি তোমার সম্পূর্ণ অযোগ্য। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র নদী আজ তোমার উদ্দেশে-তোমার প্রেম-পরিপূর্ণ হৃদয়-পারাবার পানেই ছুটে চলেছে।

“তার গতি অবাধ! সে আজ আত্মহারা অবশভাবে ছুটে চলেছে। তার পরিণামে কি হবে, তদ্বিষয়ে সে কিছুমাত্র চিন্তা না করেই তোমাতেই আত্ম বিকিয়ে বসেছে! হে প্রাণেশ্বর! হে স্বামিন! হে আমার জীবন-প্রভাতের হোমন ঊষা! হে জীবনবারিধির কৌস্তভ রতন! এখন তোমার আদর-অনাদরেই এ হতভাগিনীর জীবন-মরণ নির্ভর করে।”

শিবাজী-নন্দিনী আর কিছু বলিতে পারিলেন না। উচ্ছ্বসিত প্রেমাবেগে সন্দেহ এবং আশঙ্কায় তাহার পদ্মপলাশলোচন হইতে তরল মুক্তাধারা নির্গত হইতে লাগিল।

হে রমণী অনিশ্চিত প্রেমের আশায় চিত্তের উন্মাদনায় পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনের স্নেহের বন্ধন খন্ডন করিয়া তাহার প্রেমাস্পদের সেবায় উপস্থিত হইয়া পিপাসা পরিতৃপ্তি করিতে পারিতেছে না, তাহার প্রেমাস্পদের নিকটে নিজের অবস্থার বিবরণ খুলিয়া বলিতে যাইয়া শোকাবেগে ক্রন্দন করা নিতান্তই স্বাভাবিক।

আফজাল খাঁ সুন্দরীর প্রেমোচ্ছ্বাস এবং হৃদয়ের অবাক হইয়া গেলেন। মনের ভিতর দ্রবীভূত হইয়া নিতান্ত চাঞ্চল্য অভিভূত এবং প্রেমের ধারায় অভিসিক্ত হইলেন। অন্তরে বাহিরে তখন মহাবীর আফজাল খাঁর তুমুল ঝটিকা প্রবাহিত হইল। প্রাণের পরতে পরতে অনন্ত পুলক শিহরিয়া উঠিতে লাগিল! নব বসন্তের মলয়া হাওয়ার প্রথম চুম্বনে শীত-সঙ্কুচিত কুসুমকলিকাগুলি যেমন শিহরিয়া উঠিয়া ফুটিয়া উঠে, আফজাল খাঁর হৃদয়-মালঞ্চ তেমনি শিহরিয়া উঠিয়া প্রেমের পুস্পে ভরিয়া গেল।

অনন্ত প্রেমের কুসুম-সুষমার মোহিনী আভা, সন্ধাকাশে স্বর্ণমেঘের ন্যায় হৃদয় জুড়িয়া বসিল। হৃদয়ে হৃদয়ে আভা ফুটিল। মরমে মরমে বাণ ছুটিল। তখন আগ্রহ ও ব্যগ্রতায় হৃদয়-কুঞ্জে প্রেমের কোকিল পাপিয়া অবিরাম কুজনে ডাকিতে লাগিল।

আফজাল খাঁ প্রেমাবেশে সেই নির্জন দীপালোক-আলোকিত-কক্ষে শিবাজী-নন্দিনীকে বুকের ভিতরে টানিয়া লইয়া তাহার গোলাপী গন্ডে কয়েকটি চুম্বন দান করিলেন। প্রদীপ-শিখা একটু কাঁপিয়া উঠিল! যুবতীর হৃদয় লজ্জা ও প্রেমে সঙ্কুচিত অথচ সহর্ষ হইয়া উঠিল।

উভয়েই ক্ষণকাল নীরব। উভয়ের বক্ষের স্পন্দন দ্রুত চলিতে লাগিল। উভয়ে উভয়ের গভীর প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। মারাঠা রাজকুমারীর নেত্র-কুবলয় হইতে প্রেমের মুক্তধারা বর্ষিত হইয়া পাঠানবীরের বক্ষস্থল বিপ্লাবিত করিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *