০৩. সন্ধ্যা উৎরে যাওয়া রাতে

অথচ, সন্ধ্যা উৎরে যাওয়া রাতে, এখন যদি কেউ আজগর আর সুকুমারকে দেখে তাহলে কোনওভাবে সে ভাবতেই পারবে না, দুপুরে এই দুইজনের কী কাজিয়াটাই না হয়েছে!

লঞ্চঘাট ছাড়িয়ে নদীর কূল ধরে কাঁচা রাস্তায় বাজারের দিকে এগিয়ে গেলে, একটা দোকানের পাশে আজগরের ঝুপড়ি। যদিও আজগর বলে বাসা, জরিনা বলে খোঁয়াড় আর মানুষ বলে খুপড়ি। তা যে যাই বলুকু, বানর নাচিয়ে আজগর যা আয় রোজগার করে, এরচেয়ে ভালো একটু মাথা গোঁজার ঠাই সে কী করে জোটাবে। বললেই হল? জীবনটা কোর্টের চত্বরে চত্বরে, লঞ্চঘাটে, রেল স্টেশনে বান্দরে পাছায় লাঠির কুরুত দিয়ে কাটিয়ে দিল। এই জীবনে কোনওদিনও চালের তলায় মাথা দিল না, মেয়েমানুষ প্রায় গায়ের কাছে ঘেঁষতে দিল না। দিলেও দুই দিন বাদে নাকি কান্নার সুর তুলে যে ঘরের চালের নীচে মাথা দিতে চাবে, এই কাজে আজগরের প্রবল আপত্তি। এমনকি এই যে জরিনা তার সঙ্গে আছে, আছে থাকুক, কাল যদি গায়ের রং কালো, দাঁত নেই, দলা দেয়া চুল, বানরনাচানো আজগরকে তার ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে মন চায়, চলে যাক। যেখানে খুশি, যেদিকে দুচোখ যায়, যাক। আজগর বাধা দেবে না।

জরিনা ওই কোর্ট চত্বর থেকে একদিন রঙ্গ করতে করতে আজগরের সঙ্গেই সন্ধ্যার পরে থাকবে, দুঃখে প্রাণ কান্দে–এইসমস্ত বলে ওই ঝুপড়ির সামনে এলে আজগর বলেছিল, আচো থাহো। যদি কোনওদিন চইলগা যাইতে মন চায় চইলগা যাবা। কিন্তু কয়দিন থাইয়া ওই ঘর করার বাসনা চোদাবা না।

জরিনাও কি কম যায়। প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিল, কথার কী ছিরি! জীবনে পুরুষ মানষির মুহি এইরাম কতা শুনি নেই। তোমার কাছে আইচে কেডা ঘর করার বাসনা চোদাতি?

হু, হইচে। আইচো তো পিছন পিছান। এমনি মানষির ধারে কও বান্দর নাচাইয়ে খাই নিজের পেট চলে না। আইসকা হাজির হইচো!

আইচি তার হইচে কী, থাকতি দিলি থাকলাম। না দিলি চইলে যাব।

হয় যাইও, যেহানদে আইচো সেইহানে—

কোহানদে আইচি?

আজগরের যেখান দিয়ে আইচো এই কথার ইঙ্গিত জরিনা সহসাই ধরতে পারে। এই যেখান মানে কোন কোন জায়গা তা তার জানা আছে। কিন্তু তখন সে তা জানতে চায়নি। জানতে চাওয়া অপ্রয়োজনীয়। এই যে ওই কথা বলে আজগর বিড়বিড় করল, হয়তো সেই জায়গাগুলোর নামও বলেছে, এর কোনওটাই এখন জরিনার শোনার প্রয়োজন নেই। সে জানতে চায় না। শুধু বলল, থাকতিচে কেডা? ভালো না লাগলি তোমার সাতে কেন রাজপ্রসাদেও মানষি বেশিদিন থাকতি পারে না। থাকপো না, জ্বালাব না, যেরম আইচি এইরম একদিন চইলে যাব। এই দুনিয়ায় থাহার জায়গা আর মানষির কোনও অভাব নেই।

হয়, বারো ঘাট মাড়ানো মানষির থাহার জায়গার কোনওদিন অভাব হইচে?

ফাও কতা কইয়ে না। নিজে কয় ঘাট মাড়ানো?

এসব কথা এমনই। চলতেই থাকে। এ কখনও যেন শেষ হয় না। আগেও হয়নি, এখনও হবে। কিন্তু সেদিন জরিনা আজগরের ওই ছোট্ট ঘরখানির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই কথা। বাদর দুটোকে পাশে একটা একচালা টিনের ছাউনির নীচে রেখে, সেখানে শিকলে তালা আটকাতে আটকাতে আরও কথা হয়। কিন্তু আজগরের মতন মানুষেরও মনে ধরেছিল জরিনার ওই একটা কথাই, ভালো না লাগলি মানুষ রাজবাড়িতেও বেশি দিন থাকতি পারে না।

বাঁদর বেঁধে এবার ঝুপড়ির দরজা খুলছে আজগর। সেখানে তালা দেয় না। তালা দেয়ার মতন কিছু নেই। তার সম্পদ বলতে ওই বানর। নিজের ঝুপড়ি ঘরে আর আছেটা কী। একটা লম্ফ আছে, তাও বেশির ভাগ রাতে জ্বালানো লাগে না। একপাশে একখানা লুঙ্গি, প্রায় বোতাম ছাড়া আর একটা জামা। আর, আর প্রায় কিছুই নেই। সেই ঘরের দরোজার সামনের ঠেঙাটা সাটাতে সরাতে আজগর বলেছিল, তাইলে আমারে ভালো লাগে?

অন্ধকার, জরিনার মুখোনা দেয়া যায় না। সেখানে কোনও লজ্জার রেখা পড়ল কি না, তাও বোঝা গেল না। তবে জরিনা আজগরের প্রশ্নের উত্তরে বলে, যা একবার কইচি তো কইচি আর কওয়ার কিছু নেই!

এই কথা কয়দিন আগের? এমন আম পাকা গরমের বেশি আগে তো নয়। তবে, কোর্ট চত্বরের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর তখন ফুল! সেই চত্তির মাসে, আজগরের সঙ্গে জরিনার ওই কথা হয়েছিল! এখনও গরম আছে, জল কাদা বৃষ্টির দিন আসেনি, চৈতা গরমের ভাব এখনও টের পাওয়া যায়।

তবে, সুকুমার আর ঝিলিকের এখানে আসার কারণও জরিনা। এখন এই চারজন আজগরের ওই ঝুপড়ির কাছে, নদীর পাড়ের মাটির রাস্তার উপর বসে আছে, সবটাই জরিনার কারণে। আজগর জরিনার কায়দা-কৌশল কিছুই বোঝে না। এমনকি জানেও না যে, এই যে মেয়েটা ঝিলিক তার সঙ্গে সুকুমারের সম্পর্ক কী। জরিনা তাকে চেনে কীভাবে। সহজ একটা সমাধান অবশ্য আছে, ভিতরে ভিতরে সেই হিসেব করেও রেখেছে, যেমন বলেছিল একদিন স্পষ্ট করে না হলেও প্রায় বিড়বিড়িয়ে। কোন জায়গাদা না কোন জায়গাদা। এই কোন জায়গা আজগর চেনে। এই শহরে ওই জায়গাটা লাইট হলের পিছনে অথবা রেল স্টেশনের কাছ থেকে ধরলে, উত্তর দিকের পুরনো কাপড়ের কলের পাশের পচা পুকুর ফেলে। তারপর মোংলার আছে বানিয়াশান্তা। খুলনায় ভৈরবের ঘাট, যশোরে বাইরে মন্দির। সব জায়গায় আজগর গেছে। ওখানকার মেয়েদের তার চেনা আছে। আর মুখে না বললেও আজগরের মনে হয়, এই দুটোই ওইরম কোনও জায়গা থেকেই এসেছে। দুইজনই আগে থেকে পরস্পরকে চেনে। এখন এই জায়গায় এসে আবার খায়খাতির। আছে কোন বদ মতলবে কে জানে। যেমন, ইব্রাহিমের বছর দুই আগে এইরকম এক মেয়ের জন্যে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা সে আজও পোশাতে পারেনি।

অবশ্য, জরিনা কিংবা ঝিলিককে নিয়ে যাই ভাবুক, এসব আজগরের নিজের ভাবনা। এই ভাবনার তো একটা জিনিস আজগরের কাছে স্পষ্ট, সে এখনও জরিনাকে বিশ্বাস করে না। মনে হয় ভিতরে ভিতরে তার কোনও অনিষ্ট সাধনের মতলবে আছে ওই মেয়ে। কিন্তু উপরে যত রাজ্যের পিরিতি!

যাক, আজগর মানুষটাই হয়তো এমন। অল্পে খেপে। চটা বাতিকের। মাথায় সব সময় যেন বায়ু চড়ে থাকে। সেজন্যে কখনও কখনও কথা পুরোটা শোনার আগে খেপে যায়। আজ দুপুরের সুকুমারের সঙ্গে ঘটনাও তাই।

কিন্তু এখন নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসছে। আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ। কদিন বাদে পূর্ণিমা। নদীর ওপারের চরগাঁর আকাশ থেকে চাঁদা এখন প্রায় মাঝ নদীর উপরে। নদীতে জোয়ার। পানি ঢুকছে কুলকুলিয়ে। সে শব্দও যেন এখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে। লঞ্চঘাটটা স্থবির। পন্টুনে কোনও মানুষ নেই। সেখানে অন্ধকার। কাল সকালে যে লঞ্চগুলো ছেড়ে যাবে তা বাঁধা। বেশির ভাগই ছোটো লঞ্চ। ঢাকাগামী লঞ্চটা সন্ধ্যার পর-পরই ছেড়ে গেছে। কিছুক্ষণের ভিতরে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

নাগেরবাজারের দিকে নদীর পাড় ধরে কিছুটা এগোলে হাফেজের রুটির দোকান। কিছুক্ষণ আগে সেখানেই বসেছিল সুকুমার আর ঝিলিক। জরিনাও গিয়েছিল রুটি কিনতে। এই দোকানের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তবে আটাটা টেকা আর রুটি বানাতে গরম পানি ব্যবহার করে। রুটিগুলো নরম। রুটির সঙ্গে আখের পাটালি আর দয়াকলা (বিচিকলা) দেয়। গুড়ের দাম প্রায় সময়ই একই, তবে কলার দাম কেনার দাম বদলায়। এখানকার ক্রেতা বা একইসঙ্গে পাশের বেঞ্চিতে বসে খাওয়ার ভোক্তা প্রায় সবাই শ্রমজীবী। কেউ নদীর পাড়ের স-মিলে কাঠ চেরাই করে, কেউ কুড়ালে কাঠ ফাড়ে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ লঞ্চঘাটের কুলি অথবা কেউ এই আজগর জরিনা আর সুকুমার ঝিলিকের মতো। আরও আছে, এখানে জরিনা বা ঝিলিক প্রায় পরজীবী। কিন্তু কোর্টচত্বরে সারাদিন ছালা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকা পাগল আছে, কখনও কখনও দিনে জাগে আর সারাটা রাত্তির কোর্ট চত্বর পাহারা দেয়া। সেই রহম বা রহমত পাগলও আসে এখানে।

যদিও এমন রুটির হোটেল আরও কয়েকটি আছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই সন্ধ্যা রাতে বন্ধ হয়ে যায়। এটাই এই লঞ্চঘাট আর কোর্ট চত্বর এলাকায় খোলা থাকে। মেইন রোডে ভাতের হোটেল আছে অনেকগুলো। আবাসিক হোটেলের পাশের গলিতে উঁকি মারলেও ভাতের হোটেলের রান্নার গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোয় একবেলার ভাত খাওয়ার মতন পয়সা সব সময় তাদের কারও পকেটে থাকে না। তাছাড়া অনেকেই সকালে কোর্ট চত্বরে যাওয়ার আগে পেট ভরে ভাত খায়। সেই ভাতেই চলে সারাটা দিন। সন্ধ্যার মুখে একটু চা-মুড়ি যদি জোটে, তাও চাবায়।

সন্ধ্যার পর পর কোর্ট চত্বর ও এর আশপাশ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। বড়ো লাল দালানটায় তখন বাতি জ্বলে। সেই আলো এমন যে ওই ডিস্ট্রিক জজ বসার বিল্ডিঙেয়র বারান্দায়ও সেই আলোর আভা ভালোমতো যেন ঘুমাতে পারে না। লালচে মিটমিটে একটা বর্ণ ধারণ করে। ওদিক রাস্তায় আলো পড়ে না, সব গাছের পাতায় আটকে যায়। ডিসির বাড়ির গেটের দুই দিকের খাম্বায় আলো, সেখান থেকে ক্লাবের দিকে যেতে ডান পাশে ট্রাফিক ব্যারাকের বারান্দা অন্ধকার, শুকলাল সংগীত বিদ্যাপীঠ সন্ধ্যার পরে কেউ নেই। পাশে ক্লাবে উঠে যাওয়ার সিঁড়িতে আলো। সামনের জেলখানা পুকুরের পাশ দিয়ে ক্লাব চত্বরের ভিতরে টেনিস লনে আলো। সেই আলোতে পুকুরের জল চকচক করে। এক দিকে ফ্লাড লাইটের আলো গিয়ে লাগে পুকুরের ওপারের জেলখানা উঁচু দেয়ালের গায়ে। বামের হাতায় রেডক্রস ব্লিডিং ও সামনের স্বাধীনতা উদ্যানের ভিতরের যুবকেন্দ্রে রাত একটু বাড়লেও তরুণেরা খেলতে থাকে।

এই এলাকায় বাসাবাড়ি নেই। সন্ধ্যার পরে বাজারঘাটের সঙ্গেও কোনওপ্রকার সংযোগ নেই। মানুষজনই তো নেই। যেমন জেলখানার সামনে, স্বাধীনতা উদ্যানের পরে আদর্শ শিশু বিদ্যালয়। জেলখানার সামনের রাস্তা দিয়ে আবার মেইন রোডের দিকে হেঁটে গেলে, বাঁয়ে গার্লস স্কুল রোড, পরে অফিসার্স ক্লাব কিন্তু সামনে দেওয়াল নেই। পিছনে অন্ধকার। ক্লাব ভবনও নামমাত্র। এরপর আমলাপাড়ার দিকের রাস্তা। এদিকে গার্লস স্কুলের একটি গেট। অন্যদিকে বাগেরহাট স্কুলের ছোটো গেট। মূল রাস্তায় বাগেরহাট স্কুল, ডানে থানা তারপর সিভিল সার্জন অফিস। এটাই পুরনো হাসপাতাল। একটু এগিয়ে রাস্তা মিলেছে মেইন রোডের সঙ্গে। সেখানে লাশ কাটার ঘর।

এমন একটা এলাকায় সন্ধ্যার পরে কোনও কোনও ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষের পদচারণায় দোষ কী। তারা তো সকাল হলে আর থাকে না। যেমন স্বাধীনতা উদ্যানের বেঞ্চিগুলোয় ও রেড ক্রিসেন্ট ভবনের বারান্দায় কেউ ঘুমায়। কেউ না আসুক রহমত পাগল প্রায় দিন রাতে এখানে আসবে। এই ছোট্ট শহরে ভাসমান হিসেবে আবির্ভূত কেউ কেউ রাত কাটাবে এই স্বাধীনতা উদ্যানে। পাশেই পার্কের পুকুর। তার উলটো দিকে মহিলা সমিতির বিল্ডিং, সামনে পিছনে অনেকখানিক ফাঁকা জায়গা, সেখানেও থাকে কোনও ছিন্নমূল। ওই বিল্ডিংয়ের এক কোনায় দেয়াল ঘেষে কেয়ারটেকারের একচালা। এদিকে ডিসির বাড়ি-লাগোয়া ট্রাফিক ব্যারাকের রান্নাঘর। সেখানেও সন্ধ্যার কিছু পরে আর আলো দেখা যায় কই? এই পুরো এলাকা সন্ধ্যার পর থেকেই আধো আলো আধো অন্ধকারে। লাইট পোস্টের আলোও যেন গাছের পাতার সঙ্গে মাখামাখি করে আবছা অন্ধকার হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে।

জরিনা রুটি কিনতে গিয়েছিল। একটু পরে হয়তো আজগরই যেত তার সঙ্গে। কিন্তু জরিনা মনে করে, আজগর যেত না। দুপুরবেলার ঘটনার পর থেকে আজগর একটু মন-মরা। যদিও ঠিক ওই সময়ে হয়তো তার মন মরা ভাবটা তেমন ছিল না। বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে পয়সা জোটাতে হবে। ইব্রাহিম শেখের মজমা শেষ হলেই সে তাড়াতাড়ি ওই প্রায় ভাঙে ভাঙে আসরে গিয়ে ডুগডুগি বাজাতে থাকে। তার আগে ট্রেজারির সীমানায় কুলগাছে বাঁধা বানর দুটোকে নিয়ে এসে বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছে ইব্রাহিমের আসরে। ইব্রাহিমের মজমা তখন প্রায় শেষের দিকে।

বারিক বুড়োর তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে জরিনা মুখ টিপে হাসে। চোখের আড়ে একবার আজগরের দিকে তাকায়। চোখ টেপে। আজগর বোঝে জরিনা এই চোখ টেপা দিয়ে কী বোঝাতে চায়। আজগর মাথা নাড়ান, অর্থাৎ নিষেধ করে।

আজগর একটু কোনার দিকে। বারিকের সোজাসুজি ছিল জরিনা। তখন জরিনা উঠে আজগরের কাছে আসে। বলে, ক্যান?

আজগর জানায়, কী? মনে করছো বুড়ায় ঘুমায়? উঁহু, সব দেহে। কতবার আমরা পরীক্ষা কইরগা দেকচি, সব দেহে–ওইরম চক্ষু বোঝা থাকলে হইচে কী?

তাই নাকি? জরিনা অবাক। হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে তার। কাজটা একেবারে খারাপ পারে না সে, আজগর জানে। কয়েকদিন আগে জরিনার কাপড় কাঁচার সাবান আজগর গায়ে ঘষে নাইতে লাগলে, সে বলেছিল আইনে দেবানে। সত্যি পরদিন বিকালে জরিনা একখানা কসকো সাবান নিয়ে হাজির। আজগর জানতে চেয়েছিল, পাইলা কী কইরে? জরিনার সোজা উত্তর, বাজারে এক দোকানে কী ভিড়। সাবান দেকতি দেকতি একখান টেকে গুইজে নিয়ে চইলে আসলাম। আজগর হেসেছে, এইসব করো! ধরা খাইল এহেবারে চুইদে দেবে। মাইনষের তা না কইয়া আনো, দাম না দিয়ে! এতেও জরিনার উত্তর, হুঁ, ওইসব মাহাজোনগো কত আছে। অত বড়ো বড়ো দোকান, ওই জায়গায় দে আমার মতন মানুষ একখান সাবান নিলি কী হয়?

ফলে, জরিনার এখনকার তাই নাকির উত্তর একটু গলা নামিয়ে আজগর বলল, তা ছাড়া কী? এইহানে কী সব বই আছে, সেতে চোদাচুদি লেহা থাহে, সেগুলোর একখানে হাত দিলিই বুড়ো চোখ খুলে তাকায়।

জরিনা আজগরের কথায় একটু যেন লজ্জা পায়। কিন্তু তার জানা আছে এমন কথা সে আগেও শুনেছে। এমনকি বই সাজানোর সময় বাঁধা বইগুলোর ভিতরে পুরুষ মহিলার ছবি দেয়া অমন বই দুই-একখানা দেখেওছে সে। কিন্তু ওই বইয়ের ভিতরে কীভাবে ওই কথা লেখা থাকে, ছাপা অক্ষরে ওইসব কথা কীভাবে লেখে শিক্ষিত মানুষ, কোনওভাবেই জরিনা ভেবে পায় না।

এই সময়ে, ওই ঈষৎ হাসিমুখের জরিনার কাছে কথাটা জানতে চেয়েছিল আজগর। তাছাড়া কথা ঘুরানোরও সময়। আশেপাশে কেউ তাদের কথা শুনে ফেললে কী ভাববে? জরিনার যা মুখ, দেখা গেল বারিক বুড়োকে জিজ্ঞাসাই করে বসল, কোন বইতে ওইসব লেখা আছে। তার একখানা তার চাই, তারপর খুঁজে বের করবে কে তাকে সেই বই পড়ে শোনাতে পারে। এই ভেবে আজগর বলল, ওই জরি, তুমি ওই ছেমড়িরে চেনো কী বিলে?

জরিনা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল, কোন ছেমড়িরে?”

বারিকের দোকানের বইয়ের সামনে থেকে জরিনাকে সরানোর জন্যে আজগর এবার উলটো দিকে ইব্রাহিমের মজমার দিকে চেয়ে থাকল। জানে, জরিনা এবার তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এদিকেই তাকাবে। আজগর বলল, ওই যে সুকুমারের সাথে গেল।

ও, ওই ঝিলিকরে? আর কইয়ে না, ওরে না চেনে কেডা? আমার সাথে কয়দিন আগে রেল স্টেশনে দেহা হইল। কোনও বিষয় নিজের মতো করে বুঝিয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকলে জরিনা তখন দ্রুত কথা বলে। কোন দিক থেকে কী বলে তার প্রায় ঠিক থাকে না।

কবে দেহা হইল? কতদিন আগে? আজগর বুঝতে চায় আসলে জরিনার সঙ্গে কখনও ওই মেয়েটির আগে দেখা হয়েছে, নাকি আদৌ দেখা হয়নি, নাকি তারা পূর্ব পরিচিত। কিন্তু আজগরের মনে হল, একথা এখন আর জিজ্ঞাসা না-করাই ভালো। ইব্রাহিমের শেষ। এখন মানুষজনের ভিড় ফেটে যাওয়ার আগেই তাকে চত্বরে ঢুকতে হবে। একটা বানর তার হাতে ধরা। অন্যটা দড়ি খুব খাটো করে বারিকের পাশের গাছটার পাশে একটা কংক্রিটের খণ্ডের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। একসঙ্গে থাকলে মারামারি করে, কখনও হুটোপুটি করে, তাতে শক্তি ক্ষয় হয়, বানরের খিদে লাগে। সেই সকালে দুটো কলা খেতে দিয়েছিল, তারপর আর কিছুই খেতে দিতে পারেনি। আজগর জানে, বানর দুটোর খিদে লেগেছে। কিন্তু এখন কিছুই দেয়ার মতো তার হাতে নেই। এমনকি একটু আগে একটা বিড়ি সে চেয়ে খেয়েছে মোসলেমের কাছ থেকে। আজগর জরিনাকে ঝিলিকের বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এখনই তার ইব্রাহিমের ওই জায়গায় গিয়ে বানরের মজমা মিলানো দরকার। জরিনা বারিকের দোকানের এক কোনায় বসে। আজগর সামনে এগিয়ে যায়। জরিনা এখন বসে বসে দেখবে আজগর কীভাবে বান্দরনাচানো আসর জমায়।

এই বানর দুটোকে নিয়ে একটু আগে ইব্রাহিমের বসা জায়গায় বসল আজগর। দুটো বানরই তার কাছে, বাম হাতের দড়িতে গোটানো। ডান হাতে ডুগডুগি। ছন্দ মিলিয়ে ডুগডুগি বাজায় সে। আর মুখে বলে, এই ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া! আসেন আসেন, আইচে ল্যাঙেড়া পাহাড় থেকে এক বানর বুড়াবুড়ি। আপনাগো খেলা দেখাবে।

আশ্চর্য এতক্ষণ ইব্রাহিম শেখের মজমায় বাচ্চারা, এক্ষেত্রে বালক-কিশোর, প্রায় কেউ ছিলই। শহরের স্কুল সব খোলা। চাইলেই ওই বয়েসের বালকরা এখানে থাকতে পারে না। কিন্তু আজগর ওখানে যাওয়ার পরে, বার দুই ডুগডুগি বাজিয়ে তার সঙ্গী এই বানর দুটোর গুণকীর্তন করতে করতে ওই বয়েসি কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে। এখন হয়তো স্কুলে টিফিনের সময়। অথবা তারা স্কুল পালিয়েছে। এমনিতে বোঝা যেত না। কিন্তু কারও পরনে সাদা শার্ট নেভি-ব্লু প্যান্ট, কারও পরনে উপরে সাদা নীচেও সাদা, কারও পরনে উপরে কমলা নীচে কোনও ঠিক নেই। অর্থাৎ এরা সরকারি স্কুল, টাউন স্কুল আর আমলাপাড়া স্কুলের ছাত্র। আজগর তাদের দেখেই বুঝতে পারে। এ বাদে স্কুলের পোশাক না-পরাও দুই-চারজন আছে। এরা কেউই তার বানর খেলা দেখে টাকা-পয়সা দেবে না। কিন্তু হাততালি দেবে। আজগর খেলা দেখাবে, সেই খেলা দেখাতে তালিরও তো দরকার আছে। ফাও তালি দেয়ার লোক সে পাচ্ছে কোথায়?

জরিনা একইভাবে বসে থাকে। আজগরের কাণ্ড দেখে। আজগর বড়ো ছোটো জোয়ান বুড়ো, কোর্টের কাজে অথবা এমনি ঘুরতে আসা এই মজমায় সামিল সব ধরনের লোকের চোখ নিরিখ করে। মুখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে বানর-ধরা দড়ির হাত থেকে সরিয়ে বৃত্ত বড় করে। মাথার চার দিক থেকে দড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে, সঙ্গে বানরটাও তার চারপাশে সেভাবে ঘুরে আসে। আজগরের বৃত্ত বড়ো হয়। স্কুলে-পড়া ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, দেখি, বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও। বলে হাসে। তালি বাজে। আজগর তাদের মুখের দিকে তাকায়। জানে, এই যারা তালি বাজাচ্ছে, এদের কারও কারও সঙ্গে পথ চলতে দেখা হলে জানতে চাবে, ভালো আছেন? আজগর জানে, তারা তার খেলা দেখেছে। এমনকি কখনও কখনও এমনও হয়, আজগরকে লক্ষ্য করে পথ চলদে তারা নীচু গলায় একে অন্যকে বলে, এই যে ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া যায়!… বুড়া এখন বুড়িকে আদর করবে! শুনে, আজগর তখন হাসে। কিন্তু এখন কী সেই হাসি হাসা যায়।

বরং, আজগর জানায়, খেলা দেখবেন, হা করে থাকবেন না। সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল থেকে এসেছে এই অবলা জানোয়ার। আজ আপনাদের কাছে খেলা দেখাবে। কী দেখাবি না? বলেই একটা বানরকে সে খোঁচা মারল। বানরটা এই কথার সঙ্গে সঙ্গে একটু সামনের দিকে এগোল আর হাত নাড়াল। আজগরের বানর। পারেও, জরিনা দেখে আর ভাবে।

এরপর, খেলা শুরু। এই বুড়া, তুই এই আসরের সবাইকে সালাম দে–কুর্নিশ কর। বানরটা তাই করে। এই দেখেন, বানর আপনাদের সালাম-আদাব দিয়েছে, আপনারা হাততালি দেন, বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও। এবার বুড়ো, দই বিক্রি করতে বের হবে। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে দিল আজগর। বানরটা সেই লাঠিটা ঘাড়ে নিয়ে চারদিকে এক চক্কর ঘুরে এল। এদিকে বুড়ি তখন রান্না করছে। বুড়ো বাড়ি ফিরলে খেতে দেবে। আজগর ধারাভাষ্য দিয়ে চলে। বানর দুটো একের পর এক তাই করে। আজগর জানায় খাওয়া দাওয়া শেষ, এবার বুড়ো বুড়িকে আদর করবে। মাদি বানরটা তখন বসে থাকা মর্দা বানরের কোলের ভিতর গিয়ে বসে। মর্দাটা মাদিটার গায়ে মাথায় হাত বোলায়। এরপর আজগরের ভাষ্য মতো মাদিটা মর্দাটার মাথার উকুন বেছে দেয়।

এরপর আজগর তাদের ডাকে। তারা কাছে আসতে আসতে বলে, এবার এ দুটো ভদ্দরলোক হবে। বুড়া জামা কাপড় পরবে। বলে পাশের মলিন ঝোলা থেকে একটা ছোট্টো স্কার্ট মতন বের করে, সেটাই বুড়ার প্যান্ট। বুড়ো অর্থাৎ মর্দা বানরের শরীরের নীচের দিকে তা পেচিয়ে দিলে, সেটা এখন ভদ্দরলোক সেজে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা আনন্দদায়ক, মর্দা বানর পোশাক পরে, কোমর দুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। বালকরা হাততালি দেয়। ভিড়ের কারণ বারিকের দোকানের সামনে বসা জরিনা কিছুই দেখতে পারছে না, কিন্তু তখন সেই সোজা ভিড়টা যেন একটু পাতলা, সেখান থেকে একটি বানরের এমন করসৎ জরিনা দেখে। সেও হাতে তালি দেয়। সেই তালিতে বারিক বুড়োর তন্দ্রা টোটে অথবা কিছু একটা ঘটেছে বুঝে বারেক চোখ খোলে। চোখটা একটু কচলে নিয়ে তাকায়, দেখে কিছুই ঘটেনি। আজগরের বান্দর নাচানো দেখে জরিনা খুশিতে হাততালি দিয়েছে। তাতে বারিক যেন একটু নাখোশ, যা, ওই জায়গায় যাইয়ে দেখ।

জরিনা বারিকের দিকে তাকায়, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, ও কা?

সেয়া দিয়ে তোর কাজ কী?

জরিনা একটু আগে আজগরের সঙ্গে তার বিষয়টা মিলিয়ে নিতে চায়। তাহলে বারিক বুড়োও ঘুমায়। তাহলে আজগর যে বলল, কোনওভাবে বুড়োর বই হাতসাফাই করা যায় না? জরিনার হিসেব মেলে না। সে আবারও বারিকের দিকে তাকায়। বলে, ভুল হইয়ে গেইচে। কিন্তু কাকা, ওই জায়গায় বিটি মানুষ হইয়ে অত বেটাগো মদ্যি যাইয়ে বান্দর খেলা দেখা যায়?

বারিক তা শুনেছে অথবা শোনেনি। আবারও তার চোখে তন্দ্রা।

এদিকে জরিনার সামনের সেই ভিড় আবার জমেছে। সে দেখতে পায় না কিছুই। তার একটু পিছনে, বারিকের দোকানের পর ছোট্ট ড্রেনের কোনায় ছোট্ট একটা বক্স মতো যন্ত্র নিয়ে বসা দিলদার। এই যন্ত্র নাকি বাত ছাড়ায়। সে সেখান থেকে বারিককে বলে, কাকা, আমার এই যন্তরটা থাকল, এট্টু ঘুইরে আসি। দেইহেন।

জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দিলদারকে দেখল, । হইছে, ওইয়ে দিয়ে মানষি আইজকাল বাত ছুটোতি আসপে নানে, পুলিশে পিটোইয়ে সব বাত ছুটোইয়ে দিতিচে।

সমস্যা নেই, কেউরে না-পালি তারপর তোর বাত ছুটোবানি। দেহিস–তুই ধরবি আর যন্তরডা এমন ঘুল্লি ঘুরব, তুই এহেবারে তিড়িং বিড়িং নাচতি থাকপি!

হইচে, ধইরে দেকপানি তোমার ওই বালের যন্তর, দেহি নাচি কীরাম?

হয়। তুমি তো আজগরের যন্তর ধইরে নাচতিচো!

জরিনা যেন একটু লজ্জা পেল। সে উলটো দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে থাকা দিলদারকে দেখে। দিলদারের চোখের ভাষা বুঝতে চায়। দিলদার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে। কিন্তু এখন আর কিছু বলল না। যেন, যা বলার জরিনার উদ্দেশ্যে বলেই ফেলেছে। তাছাড়া বারিক বুড়ো কাছেই। সে চোখ নাচিয়ে বলে, কী?

জরিনা দাঁড়ায়, কী? ধীর পায়ে এগিয়ে দিলদারের কাছে যায়।

দিলদার এইবার গলা নামিয়ে বলে, কী? কলাম তো, ওই আজগরের যন্তর ধরিচো তো ধরিচো, ওইয়ে ধইরে তিড়িং বিড়িং নাচতিচো, আমার তা এট্টু ধরলি পারি?

ধরবানে, ধরবানে, ধইরে দেকপানে তুমি নাচাও কীরাম

আজগরের চাইয়ে খারাপ নাচানো নানে–আইসো!

উভয়ের চোখে দারুণ ভাষা খেলে। দিলদার কথায় জরিনাকে আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু জরিনা এতটা সহজে তার ইঙ্গিত বুঝবে ভাবেনি। ফলে, আর কিছু না-বলে দিলদার বলে, এহোন বইসে থাহো, আজগরের প্রায় শেষ। আবার দেহা হবেনে। এট্টু লঞ্চঘাটের দিকদে ঘুইরে আসি।

লঞ্চঘাট কী?

খাব। আলতাফের দোকানে—

আমারে খাওয়াইনে একদিন। আলতাফের ওইহেনে দেখি মাংস রান্দে—

আচ্ছা। কলাম তো যন্তর ধরলি নাচ দেখপো আর খাব।

জরিনা দিলদারের কথায় ইঙ্গিত পুরোপুরি বুঝল। তাকাল চারদিকে। কেউ শোনেনি তো। বারিক বুড়োর চোখ বন্ধ, কিন্তু কান নিশ্চয়ই ভোলা।

জরিনা চোখ ঘুরিয়ে জমায়েতে আনে। আজগরের বানর নাচানো প্রায় শেষ দিকে। কয়েকদিন ধরে দেখতে দেখতে জরিনা তা বুঝতে পারে। আজগর জানাল, বুড়া এখন হাই জাম্প দেবে। বলে লাঠিটা উঁচু করে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ধরল। লাঠিটার উপর দিয়ে মর্দা বানরটা এক লাফে এপাশ থেকে ওপাশ পার হয়ে চলে গেল। হয়তো আজগরের বলার ভিতরেই কায়দাটা আছে, এই বানর জোড়া এতদিন ধরে শুনতে শুনতে তা বুঝে গেছে। আবার এই যে তার হাতের লাঠিটা, এই লাঠিই তো কখনও কখনও বাঁদরদের পিঠে আছড়ে পড়ে! এখন লাঠিটা সে এমন ভাবে উঁচু করে ধরে যেন মর্দা বানরটা দেখেই বুঝতে পারে তাকে কী বলা হচ্ছে। কী চাই। লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিবারই সফলতার সঙ্গে লাফিয়ে পার হয়। তবে, আজকাল আগের তুলনায় একটু কম উঁচুতে লাঠিটা ধরে আজগর। আগের মতন আর প্রায় আড়াই হাত মতন উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে না, আজগরের ভাষায়, এই ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া-তুড়া। কে জানে কেন এইসব বলে সে, এই বলে ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া, কিন্তু সঙ্গে জানায় সুন্দরবন থেকে আনা এই বানর। সুন্দরবনে পাহাড় আসবে কোথা থেকে, সে-কথা কেউ কখনও প্রশ্ন করে না।

জরিনা চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। আজগর খেলার এই শেষ দিকে, তার মজমায় হাজির সবার উদ্দেশে জানিয়েছে, যে যা পারে যেন এই বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে দেয়। বানর দুটোর রশিতেও ঢিলে দিয়েছে আজগর। তারা পায়ের উপর ভর দিয়ে চারদিকে সবার কাছে হাত পাতছে। কেউই বলতে গেলে এক টাকা দেয়নি। সবই রেজগি। কেউ ছুঁড়ে দেয়, কেউ দেয় বানরের হাতে। বানর তাই এনে আজগরের সামনে রাখে। আবার যায়। সেই স্কুল-পালানো ছেলেরা এতক্ষণে চলে গেছে। কোর্ট মসজিদ রোডের মসজিদে জোহরের আজান হয়েছে কিছু আগে, নামাজিরাও চলে গেছে, টাকা বা পয়সা দিয়ে দর্শকরা পাতলা হতে থাকলে, সেই চত্বরে এখন এই জায়গায় আছে একমাত্র আজগর আর তার দুটো বানর। পাশে তার মলিন অপরিষ্কার পুটলিটা। আর আজগর বরাবর সোজা পিছনে বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো জরিনা।

আজগর সব গুছিয়ে নিয়ে জরিনার কাছে যায়। জরিনা আজগরের দিকে চেয়ে হাসে। মাথায় আজগর আর জরিনা প্রায় সমান, সেই দিক দিয়ে আজগর খাটোই জরিনা তুলনায় লম্বা। ফলে, সরাসরি পরস্পরের চোখে চাইতে পারে। বানর দুটো আজগরের হাতে দড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্ত। তাই তাদের স্বাভাবিক বাঁদরামি নেই। আজগর টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলে বানরদের বাধে তারপর জরিনাকে সেখানে দাঁড়াতে বলে মেইন রোডের দিকে যায়। সেখান থেকে চারটে কলা কিনে আনে। বানরদের দেয়। কলা খেতে খেতে বানররা চাঙা হয়, আজগর বোঝে। তা জরিনাও কিছুটা বুঝতে পারে। যখন মর্দা বানরটা দ্বিতীয় কলাটা খাওয়া হলে খোসাটা একটু দূরে ছুঁড়ে মারে আর তারচেয়ে আকৃতিতে ছোটো মাদি বানরটার কাছ থেকে সেটার না খাওয়া কলার অর্ধেক নিতে ছোটাছুটি করে।

জরিনা বলে, এই শুরু হইচে তোমার বান্দরের বাদরামি—

আমার বান্দর আর কত ভালো হবে। তয় অন্য মানুষও বান্দর কোম না!

কেন হইচে কী? দেখলাম দিলদারের সাথে হাইসে কতা কইলা!

জরিনা দ্রুত চকিতে তার চোখ আজগরের চোখে রাখে। হয়তো বলত, কইচি তা হইকে কী? এমনিতে তো এমন কত কত সোমায় কই। কিন্তু এখন তা বলল না, আজগরের চোখের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, এইরে তুমি বান্দরামি কও? তা ইব্রাহিম ভাইর সাতে তো কতো কতা কই!

না, বেশ ঢলতিলি! এটা অবশ্য আজগর দেখেনি, এমনিতেই আওয়াজ দিল। শুনবে জরিনা কী বলে?

কোতায়? দেখলা কোতায় ঢলতিলাম—

ও। মনে হল।

নিজে বান্দর নাচাতি নাচাতি ওই দুই চোহে বান্দরামতি ছাড়া আর কিছু দেহো না, না?

এই সময় বানরদের কলার সঙ্গে নিজের জন্যে কিনে আনা বিড়ি ধরিয়ে আজগর কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে। জরিনা ভেবেছিল এখনই হয়তো আজগর লঞ্চঘাটের দিকে যাবে। বানর দুটোকে নিজের ঝুপড়ির পাশে বেঁধে রেখে কোথাও ভাত খেতে যাবে। যাবে আর কোথায়, নিশ্চয় রাহাত হোটেলের গলি ধরে নদীর কূলের ভাতের হোটেল। লঞ্চঘাটের পাশের নদীর কূল ধরেও যাওয়া যায়। আজগরের ঝুপড়ির পরে আর কতটুকুই-বা পথ। কিন্তু একটু এগোলে একটা ড্রেন নেমেছে। ড্রেনের পাশের মাটি সরে যাওয়ায় এখন তা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া কষ্টকর। কিন্তু এখন কী আজগরের সেইসমস্ত কোনও চিন্তা আছে? বরং, আজগর তার কাছে উলটো খবর জানতে চায়, এই জরি, সুকুমার খেলা দেহাবে না?

কী জানি?

ইব্রাহিম গেইচে পর আর আসে নাই?

না। এদিক আর তো দেকলাম না।

গেল দেহি তোর সেই পরিচিত ছেমড়ির সাতে? কী যেন নাম ওই ছেমড়ির?

ওই ছেমড়ির নাম দিয়ে তোমার দরকার কী? সুকুমারদা আর এদিক আসিনি। ওই যে বারিক বুড়ো মেয়ার গাছতলায় তার খেলার জিনিসপাতি।

আজগর সেদিকে তাকায়। সত্যি, সঙ্গে সঙ্গে আজগরের মনটা একটু খারাপ হয়। ছেমড়ার সাতে হোন না-বাধালিই হইত। আইজের খেপ গেল। যদিও এখন কোর্ট চত্বরে মানুষজন তেমন নেই। তাছাড়া সুকুমারের আয় রোজগার বেশ ভালো। একদিনের খেপ না দিলে কিছুই হবে। দেখা গেল, বিকাল হতে না-হতে ছুটল রেল লাইনের দিকে। কিন্তু রেল নিয়ে কী সমস্ত ঝামেলা হচ্ছে। আজগরের মতন মানুষ তা সব অবশ্য জানেও না।

আজগর বিড়ি ছুঁড়ে জরিনাকে বলল, চল, যাই। খাওয়া লাগবে। পেট পুজো করি। পেটে দুটো দেখার জন্যিই এত কিছু!

জরিনা হাসে। এইবার না বান্দরনাচানো আজগর আসল কথায় আইচে। একটু আগে তার ভান দেখে জরিনার মনে হচ্ছিল আজ যেন আর খাবেই না। হাওয়া খেয়ে আজকের দিন পার করে দেবে।

লঞ্চঘাট ফেলে ঝুপড়ির দিকে যেতে যেতে আজগর আবার একই কথা বলে, খুব তো রঙ্গ ওই দিলদারের সাতে, যাইতি তার সাতে খাইতে!

জরিনা আবার এক ঝটকায় আজগরের চোখে চোখ রাখে। না-সেখানে এখন আলাদা কোনও ইঙ্গিত নেই। ক্লান্ত চোখ। এবার ক্যানভাস করে এসে লোকটা এক গ্লাস পানিও খায়নি। এখন খাবে। বান্দর দুটো বেঁধে আজগর ঘরের দরজা খুলে ঘটি বের করে। পানি প্রায় তলানিতে। সেটুকু চুমুক দিয়ে খায়। হাতের ফাঁকা ঘটিটা জরিনাকে দেয়। জরিনা যেন খাওয়ার পরে এই ঘটিভরতি পানি আনে হোটেলের পিছনের চাপকল থেকে। ওই কলের পানি খুব ঠান্ডা, নোনা ভাব কম আর পাতলাও। পানি যে পাতলা আর ঘন (আয়রন বেশি) ওই কলের পানি খাওয়ার পর আজগর বুঝেছে। কোর্টের কোনায় ওই ট্রাফিক পুলিশদের ব্যারাকের সামনে একটা চাপকল আছে, সেখানকার পানি মাঝে মাঝে খায় আজগর, খুব ঘন সেই পানি। পরে শুনেছে, আয়রন না কী বলে, ওই পানিতে তাই খুব বেশি।

দুপুরে খেয়ে এসে ঝুপড়িতে শুয়ে পড়তে পড়তে আজগর আবার ঘটিতে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা বলে, এইভাবে চুমুক দিয়ে পানি খালি সেই ঘটির পানি আবার মানষির খাতি ইচ্ছা করে। আর তোমার দাঁতের ঝা ছিরি, মুখের চার পাশের যে অবস্থা। দাড়ি মোচ।

খালি খাও, না খালি নিজের জন্যি ঘটি এট্টা কি না নিয়া আসো।

খালি খোটা দাও। তুমি খোটা না-দিয়ে কোনও কতা কতি পারো না, না?

না, পারি না।

ঝুপড়ির দরজা খেলা। আজগর ভিতরের দিকে পা-দিয়ে শুয়ে পড়েছে। জরিনা মাথার কাছে বসা। আজগর বলে, জরিনা সুন্দরী, এবার মাথার চুল কয়ডা এট্টু টাইনে দাও।

তোমার ওই খোটা দেয়া এট্টু বাদ দাও।

হইচে। পান খাইয়া ঠোঁট তো এহেবারে রাঙা লাল!

হইচে আর অত পিরিত দেহানো লাগবে না।

কেন হইচে কী?

ফাও কতা কইয়ে না। সামনে লঞ্চঘাট। দিন দুপুর। এই রাস্তা দিয়ে মানুষজন হাইটে যায়। বান্দরের সাতে থাইহে থাইহে তোমারও বান্দরামতিতে পাইচে এই বুড়ো বয়সে।

তোমারে কইচে। আজগর আবার বুড়ো হলো কবে? খালি কয়ডা দাঁত পড়িছে তাও পোকে খাইয়ে।

হয় বুজিছি, নিজেরে আরও কচি খোকা বানান লাগবে না।

কেডা বানায় কচি খোকা?বলে আজগর জরিনাকে ঝুপড়ির ভিতরের দিকে ঢুকতে বলে। আজগর ভিতরের দিকে মাথা দেয়া একখানা ভাঙা তক্তপোশ, তার মাথায় একটা বালিশ। সেইদিকে মাথা দিয়ে জরিনা আজগরের দিকে আসতেই আজগর ভিতর থেকে দরজা আটকায়। জরিনা বোঝে, আজগর এখন কী করবে।

শুধু একবার বলে, এই দিনে দুপুরে দরজা দেও। পেটের ভাতও হজম হল না!

পেটের হাত একটু ঝাঁকি-ঝুঁকি খাইলে এমনেই হজম হইয়া যাবে।

জরিনা হাসে। হাসিতে শব্দ হয়। কিন্তু খিলখিল ভাবটা নেই। বরং, হাসির সঙ্গে মুখে-ঠোঁটে জড়ানো কথা। তার পরনের শাড়িখানা আজগরের অবুঝ টানে ও চাপে কুচকে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় সে খুলে ফেলে। অথবা, হতে পারে উলটো দিকে খোলা পাল্লা, যা টানলেও লাগে না, সেখানে শাড়িখানা দিয়ে দেওয়া। ঝুপড়ি তাতে একটু অন্ধকারও হল। এতে জরিনার লাজশরমও যেন উধাও। সে একবার আজগরকে বোঝাবে, এই দুপুরে একবেলা ভাত খাইয়ে এখানে তারে এনে এ কোন রঙ্গ!

ফলে, জরিনার কারণে আজগর ঘুমে তলায়। ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, কতকাল যেন লোকটা ঠিকঠাক ঘুমায় না। প্রায়শ এই দুপুরের দিকে এখানে জরিনাকে নিয়ে আসে। কোনও কোনওদিন রাতেও থাকে জরিনা। সেই সব রাতে, রাত একটু গম্ভীর হলেই আজগর ঘুমে তলায়। তখন জরিনা পাশে আছে অন্য কেউ বোঝা যায় না। তারপর জরিনা জানে, হঠাৎ মাঝরাতে লোকটা ঘুম ভেঙে ঝুপড়ির দরজা কোনওমতে চেপে দিয়ে লঞ্চঘাটে চলে যাবে। পন্টুনে বসে থাকবে। হয়তো ঘাটে বাঁধা কোনও একখানা লঞ্চের উপরেও উঠে বসে থাকতে পারে। পশ্চিম আকাশে ঢলে-পড়া চাঁদের আলো নদীর জলে। দূরে শহরের কোনও বাড়ির আলো এখান থেকে। চোখে পড়ে। ট্রেজারির ঘণ্টা রাত্তির জানান দেয়। উঁচু পাঁচতলা রাহাত হোটেলের উপরের কোনও একটি রুমে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে তাকিয়ে জরিনার মনে হয় আজগর আসলেই অন্ধকারে বসে আছে। সেও যেন অনেকখানিক অন্ধকার পথ সাঁতরে এখানে এসেছে। পন্টুনের কেয়ারটেকার লোকটা একবার জেগেছিল, কিন্তু আজগরকে দেখে সঙ্গের ছোটো রুমটায় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে, জরিনাকে দেখলে হয়তো খ্যাকখ্যাক করত। একদিন করেছিল। বলেছিল, এই রাইতে আজগরের সাতে এই জায়গায় কী? যা করার আজগরের খুপড়িতে যাইয়ে কর।

ব্যাটার কথার কী ছিরি! সব তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখলেই ওই এক কথা। মানষির যেন ওই কাজ ছাড়া আর কোনও কাজে ধারে আসার কোনও কারণ নেই। খালি ফাও কথা। যদি জানত এই জায়গায় কেন?

তা আলি নামের ওই লোক জানবে কী করে। জানে জরিনা। এই গরমে রাত একটু গম্ভীর হলে আজগর তার খুপড়িতে ঘুমাতে যায়। জরিনাও এক পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এতক্ষণ নদীর কূলে ওইভাবে বসেছিল যেন এই ঘুম আনার জন্যে। প্রায় চারদিন আটকা, মাথার কাছে ছোট্ট একটা কপাট, এমন বদ্ধ ঘরে মানুষ ঘুমাতে পারে। কিন্তু রাতের ওই বাতাসে চারদিক জুড়িয়ে আসলে আজগর শুয়ে পড়েই ঘুমিয়ে যায়। জরিনা চোখ খুলে এটা-ওটা ভাবে। আজগরের শুয়ে পড়ামাত্রই ঘুম। জরিনার ঘুম আসে দেরিতে। কিন্তু একবার এলে আর ভাঙে না। তাছাড়া আজগরের এই ঝুপড়িতে সে ঘুমায় একটু ভয়ে ভয়ে। শত হলে আজগর পরপুরুষ। যত আপনারাই হোক, যতই এই কয়দিনের জন্যে এক সাথে থাকুক আপনার বলে ভাববার কোনও উপায় আছে। কিন্তু পাশে ঘুমালে সেই মানুষটাকে বড়ো আপনার মনে হয় জরিনার। ঘণ্টায় ঘন্টায় ঘুম ভাঙে। মাঝেমধ্যে কোনওদিন উঠে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করতে যায়। এসে ঘটিটা ধরে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা ঘুমের ঘোরে তা টের পায়। কোনওদিন ওই যে পেচ্ছাপ করতে ওঠে, তারপর এসে আর ঘুমায় না। জরিনা ঘুমিয়ে থাকে। কখনও এই ছোট্ট তক্তপোশে একটু পাশ ফিরলে টের পায়, পাশে আজগর নেই।

একদিন এমন হলে অন্ধকারে জরিনা চোখ খুলে জেগে থাকে। তার গাঢ় ঘুম, একবার কেটে গেলে আবার আসতে সময় লাগে। কিন্তু এই করে সময় কেটে যায়। জরিনার চোখ আবার ঘুমে জুড়িয়ে আসে। কিন্তু আজগর না আসা পর্যন্ত আর সে ঘুমাবে না। কিন্তু চাইলেও কী তা হয়। কোনও কোনও দিন সে আজগরকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চায়, কোনও দিন আজগর তাকে নিঃস্ব করে দেয়, একেবারে তখন আর তার শরীরে কোনও বল ভরসা থাকে না। এই নিঃস্ব করে দেয়ার কায়দাটা বুড়ো বেটা ভালোই জানে। এত মানুষ তার শরীরের উপর দিয়ে আসল গেল, এত দেখল, কিন্তু আজগর যেমন বান্দর নাচায়, একইভাবে আজগর তার নিজের শরীরটাকেও ওই বান্দরের মতোই চঞ্চল করে তোলে আর জরিনার শরীর যেন সুন্দরবনের গেওয়া গাছ, যার ডালে ডালে আজগর বান্দরের মতন বেয়ে বেয়ে চলছে। তখন জরিনা ওই সমুদ্রের তীরে হারিয়ে যায়, তার সারাটা গায়ে এসে কোত্থেকে বাতাস লাগে, সারাটা শরীরে অনেকগুলো ফাঁকা, সেখানে হু-হু  বাতাস ঢুকছে! আজগর সেখানে সেই বাতাসের ভিতরে তার শরীরটাকে আরও হালকা করে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে।

আজ রাতেও তাই ঘটেছিল। তারপর জরিনার চোখ জুড়ে ঘুম। কিন্তু আজগর বাইরে, নদীর কূল গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে থাকে। এরপর জরিনা গেলে পাশের দোকানের বেঞ্চিখানা টেনে এনে দুইজন কাছাকাছি বসে। নদীতে জোয়ার আসছে। অমাবশ্যার গোন। চারদিক বড়ো বেশি অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ একটি দুটি মশা এসে উড়ে পায়ে বসে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে। তাদের আলাপের যাতে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। তারপর এক সময়, আজগরের মনে হয়, সত্যি রাত গম্ভীর হয়েছে, শরীর ক্লান্ত, যতই ঘুম না-আসুক এখন ঘুমাতে হবে। সকালেই বানর দুটো জেগে খিদেয় ছটফট করবে। সে সময় হতে তেমন বেশি বাকি নেই।

কিন্তু সেই ঘুম আজগর ঘুমাল কোথায়? কিছুক্ষণ বাদে পেচ্ছাপ করতে উঠে গেল, যদিও ঘুমাতে আসার আগে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করে এসে ঘুমিয়েছিল। জরিনাও তখন আজগরের দেখাদেখি একটু তফাতে গাঢ় অন্ধকারে গিয়ে বসেছিল। তারপর অভ্যাস মতন, প্রায় কোনও কথা না বলে আজগরের শুয়ে পড়া। পায়ের দিকে বেড়ানো দরজাটা আধ ভেজানো। জরিনার এতে ভয় করে। কিন্তু সেকথা আজগরকে বলে আগে ধমকও খেয়েছে। বলেছে এই জায়গায় চোররাও আজগরের এই ঘর চেনে, এই জায়গায় নেই কিছু, এই দিক আসপে না কেউ। দিনে সারাদিন প্রায় উদলাই থাকে, কেউ আসে না। এহোনও আসপে না। তা সত্যি, আজগরের যত চিন্তা তার ওই বানর দুটো নিয়ে।

হঠাৎ ঘুম ভাঙলে জরিনা টের পায় আজগর পাশে নেই। চারধার বড়ো নিকষ অন্ধকার। নিশ্চয়ই শহরে কারেন্ট চলে গেছে। লঞ্চঘাটের কোনার লাইটটাও জ্বলছে না। নাকি কদম আলি সেই লাইটটা বন্ধ করে রেখেছে।

জরিনা আজগরকে খোঁজে। কোথায় যেতে পারে তার জানা আছে। নিশ্চয় লঞ্চঘাটের পন্টুনে বসে আছে। অথবা ঘাটে বাঁধা কোনও লঞ্চে। একা–পানির দিকে তাকিয়ে! অন্ধকারে লোকটা পানিতে কী দেখে!

জরিনা যা ভেবেছিল তাই। পন্টুনে নেই আজগর, সে দুই দিকেই দেখে এসেছে। উঠেই সামনের দিকটা দেখাই যায়। দক্ষিণ দিকে গেলে সেখান থেকে দেখা যায়, আজগরের ঝুপড়ি ঘর। কোথায় গেল? সাত-আটটা লঞ্চ বাঁধা। মূলত দুটো লঞ্চ আর গোটা পাঁচেক ট্রলার। সবকটায় উঠে দেখা সম্ভব না। লঞ্চে মানুষ ঘুমায়, এই অন্ধকারে, সেখানে জরিনার ওঠা ঠিক হবে?

জরিনা পন্টুনের উত্তর কোনায় আসে। ভাটার পানি নামছে। সেখানে পানি আটকে কুল কুল শব্দ। জরিনা টের পায় যেন এই শব্দের সঙ্গে মিলে আছে কান্নার শব্দ। পাশের ছোটো ট্রলারটার উপরে হাঁটুমুড়ে বসে আছে আজগর।

জরিনা কাছে যায়। আজগরের চুলে বিলি কাটে। আজগর মাথা তোলে না। চুলে ওই আঙুল পড়তেই বুঝেছে এই হাত জরিনার! জরিনা আজগরের আরও কাছে এসে বসে। জানতে চায়, কী হইছে তোমার?

আজগর গলা নামিয়ে হু-হু করে। ডানে বামে মাথা নাড়ে। কোনও কথা বলে না।

জরিনা বোঝে, আজগর মদ গিলেছে! কিন্তু কখন? ঘুম থেকে উঠে। পেল কোথায়। যদি এখন সেকথা সে জানতে চায়ও না। আজগর মাঝে মধ্যে কর্মকার পট্টির পিছনের দোকান থেকে সালসার ছোটো বোতল আনে, সে জানে। সন্ধ্যায় খাওয়ার আগে গলায় ঢালে, রাত্রেও। কিন্তু আজ এই জিনিস আনল কখন আর পেল কোথায়? জরিনা তা জানতে না-চেয়ে শুধু কান্নার কারণ জানতে চায়। বড়ো অদ্ভূত এই কান্না। অন্ধকার চরাচরে মিশে যাচ্ছে কান্নার সুর।

জরিনা গলা নামিয়ে জানতে চায়, কান্দো কেন? হইল কী?

আজগর আবারও হু-হু করে। দুদিকে মাথা নাড়ে। প্রায় মাসখানেক আগে সেদিন পয়লা আজগরের কান্নার কারণ জানতে পারে জরিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *