১৩.রায়-নন্দিনী – ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদঃ উপযুক্ত প্রতিফল

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদঃ উপযুক্ত প্রতিফল

ঊষার শুভ্র হাসি পূর্ব-গগনে প্রতিভাত হইবার পূর্বেই-বিহগ-কণ্ঠে ললিত কাকলী উঞ্ছগীত হইবার বণ্ড পূর্বেই ঈসা খাঁ মসনদ-ই-আলী সহস্র পদাতি, দুইশত সাদি লইয়া বজ্র-প্রতাপে, প্রতাপের সৈন্যের উপর পতিত হইলেন। প্রতাপ-সৈন্য সহসা পশ্চাদ্দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া নিতান্ত ভীত, চকিত এবং নিস্তেজ হইয়া পড়িল। অনবরত অস্ত্রাঘাতে তাহারা কদলী তরুর ন্যায় পতিত হইতে লাগিল। ঊষালোক প্রকাশমান হইলে প্রতাপের সৈন্যদল ঈসা খাঁর সেনাবল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর দর্শনে অতিমাত্র সাহসী হইয়া বিষম বিক্রমে যুদ্ধ করিতে লাগিল। এদিকে ঠিক সেই সময়ে ঈসা খাঁর অবশিষ্ঠ বাহিনী ভীষণ ঝঞ্চাবাত্যার ন্যায় বিদ্যুত্তেজে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া মহা সংহার আরম্ভ করিল। কেদার রায়ের সৈন্যগণও দুর্গ হইতে নির্গত হইয়া ভীম তেজে প্রতাপ-সৈন্যকে আক্রমণ করিল। ঈসা খাঁর গোলন্দাজ সেনা অব্যর্থ লক্ষে প্রতাপের পর্তুগীজ সৈন্য-পরিচালিত তোপগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলিল। বহু পর্তুগীজ আহত ও নিহত হইল। অসংখ্য তরবারি সঞ্চালনে মনে হইল যেন গগণমণ্ডলে অসংখ্য বিদ্যুৎ ক্রীড়া করিতেছে। বৈশাখের ঝটিকা যেমন মেঘদলকে বিচ্ছিন্ন করে, ঈসা খাঁর প্রবল প্রতাপে তেমনি যশোহরের সৈন্যদল ছিন্ন-ভিন্ন, দলিত, নিহত এবং আহত হইয়া সমরক্ষেত্রে আচ্ছাদিত করিয়া পতিত হইতে লাগিল।

প্রতাপাদিত্য আত্মরক্ষার জন্য পলায়নপর হইলে, ঈসা খাঁ শোণিত-রঞ্জিত কৃপাণ হস্তে ঘূর্ণিতলোচনে, শক্র-সংহারক-বেশে প্রতাপাদিত্যের সম্মুখীন হইয়া তরবারি বিস্তারপূর্বক গতিরোধ করিলেন। ঈসা খাঁ প্রতাপাদিত্যের তরবারি ঢালে উড়াইয়া বলিলেন, “প্রতাপ! এখনও স্বর্ণময়ীকে দিতে স্বীকৃত হও, নতুবা আজ তোমার রক্ষা নাই। আজ মুসলমান তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে। নিজেকে রাজা বলে পরিচয় দিয়ে যে-ব্যক্তি পরের কন্যাকে দস্যুর ন্যায় হরণ করে, তা’কে আমি দস্যুর ন্যায়ই হত্যা করে থাকি। স্বর্ণময়ী কোথায়? প্রকাশ করলে এখনও তোমাকে প্রাণদণ্ড হতে অব্যাহতি দান করতে পারি!’ এই কথা বলিয়া তরবারি সঞ্চালন করিলেন। ঈসা খাঁ তরবারির আঘাত ঢালে উড়াইয়া কৃতান্তের রসনার ন্যায় দীপ্ত অসি প্রতাপের স্কন্ধদেশে প্রহার করিলেন। প্রতাপ সে আঘাত কৌশলে ব্যর্থ করিলেন। দুইজন দুইজনকে মণ্ডলাকারে পরিভ্রমণ করিয়া নানা প্রকার অস্ত্র-কৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। অস্ত্র উভয়ে উভয়ের প্রতি নিক্ষেপ করিতে পরিশ্রান্ত অশ্বদ্বয়ের মুখ হইতে ফেনা নির্গত হইতে লাগিল। প্রতাপ বলিলেন, “ষাঁ সাহেব! এসো অশ্ব হতে নেমে দু’জনে মল্ল যুদ্ধ করি।” অতঃপর প্রতাপ ও ঈসা খাঁ অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক মল্ল যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। দুই এক পেঁচ খেলিবার পরেই প্রতাপ বুঝিলেন, ঈসা খাঁ তাঁহার অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তখন প্রতাপ সহসা পরিচ্ছেদের অভ্যন্তর হইতে একখানি শাণিত ছুরিকা ঈসা খাঁর বক্ষে বিদ্ধ করিতে উদ্যত হইলে, ঈসা খাঁ মুণ্ডর্তে মুষ্টিতে ধরিয়া ফেলিলেন। ছুরির আঘাতে হস্ততল বিক্ষত হইয়া গেল। প্রতাপের বিশ্বাসঘাতকতায় ঈসা খাঁ ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় “বেইমান, কাফের” বলিয়া ভীষণ গর্জন করতঃ প্রতাপের কটিবন্ধনী আকর্ষণ করিয়া তাহাকে শূন্যে উঠাইয়া সবলে ভূমিতে নিপে করিলেন। প্রতাপ শৃঙ্গচ্যুত বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের ন্যায় ভূতলে পতিত হইয়া পুনরায় উঠিতে যাইতেছেন দেখিয়া ঈসা খাঁ সজোরে বরে উপর দাঁড়াইয়া জ্বালাময় ভল্ল বক্ষলক্ষে উদ্যত করিয়া বলিলেন, “বল জাহান্নামী কাফের, স্বর্ণ কোথায়? নতুবা এই বল্লাস্ত্রে তোর বক্ষ বিদীর্ণ করব!” প্রতাপ বলিল, “আমি স্বর্ণময়ীর কোন সংবাদই অবগত নহি, অকারনে আমাকে বধ করো না।”

চতুর্দিক হইতে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, “কি! এখনও প্রবঞ্চনা? মারুন শয়তানকে।” ঈসা খাঁ একবার বর্শা আরও দৃঢ়মুষ্টিতে উর্ধ্বে উঠাইলেন। এমন সময়ে এক ব্যক্তি অশ্বের দাপটে চতুর্দিকে শব্দায়মান করিতে শ্বেত পতাকা হস্তে “থামুন! থামুন!” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে করিতে নক্ষত্র-গতিতে ঈসা খাঁর নিকটবর্তী হইলেন। ঈসা খাঁ সকলকে পথ ছাড়িয়া দিতে বলিলেন। অশ্বারূঢ় ব্যক্তি ঈসা খাঁকে কুর্ণিশ করিয়া বলিলেন, “হুজুর! প্রকৃত অপরাধীকে আমি বন্ধন করে এনেছি। যশোহরপতি স্বর্ণকে হরণ করেন নাই, সুতরাং তাঁকে দণ্ড প্রদান করবেন না।” ঈসা খাঁ আগন্তুকের সম্ভ্রান্ত এবং তেজোব্যঞ্জন মূর্তি দেখিয়া তাঁহাকে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিতে বলিয়া প্রতাপাদিত্যকে রাজবন্দীরূপে রক্ষা করিতে কর্মচারীদিগকে আদেশ দিলেন!

সুচতুর পাঠক বোধ হয় বুঝিতে পারিয়াছেন যে, এই আগন্তুক মাহতাব খাঁ। প্রতাপের পরাজয়ে রাজা কেদার রায় পরম আনন্দে ও উল্লাসে ঈসা খাঁকে অভ্যর্থনা করিয়া রাজপ্রাসাদে লইয়া গেলেন। দুঃখ-দুর্ভাবনা-পীড়িত শ্রীপুরে আবার নব আনন্দ ও নবশ্রী ফিরিয়া আসিল। নহবতে নহব বিজয়-বাজনা বাজিতে লাগিল। নগরবাসীরা পত্র, পল্লব, লথা, পুস্প, কদল বৃক্ষ ও পতাকার নগর সুশোভিত করিলেন। নানা স্থানে উচ্চ উচ্চ তোরণ নির্মিত ও গীতবাদ্য হইতে লাগিল। কেদার রায় বিপুল আড়ম্বরে ঈসা খাঁ ও তাঁহার সৈন্য-সামন্তকে ভোজ প্রদানের জন্য বিপুল আয়োজন করিতে লাগিলেন। এদিকে লোকজন ও বাহক যাইয়া মাহতাব খাঁর নৌকা হইতে আহত কাপালিক এবং বন্দী হেমদাকে লইয়া আসিল! পাল্কী করিয়া পরম সমাদরে অরুণাবতী ও স্বর্ণময়ীকে আনা হইল। স্বর্ণময়ীর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনিয়া সভ্যস্থ যাবতীয় ব্যক্তি ঘৃণা ও ক্রোধে কাপালিক এবং হেমদাকে প্রহারে জর্জরিত করিল। আহত কাপালিক সেই প্রহারের প্রাণত্যাগ করিল। হেমদাকে দগ্ধ করিয়া মারিবার জন্য তাহার পিতা বরদাকান্ত এবং রাজা কেদার রায় ঈসা খাঁকে নিবেদন করিলেন। সভার সমস্ত লোক এশবাক্য “ইহাই পাপাত্মার উপযুক্ত শাস্তি” বলিয়া উঠিল। কিন্তু ঈসা খাঁ প্রাণদণ্ডের সমর্থন না করিয়া হেমদার নাক-কান কাটিয়া দেশ হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন। সকলে তাহাতে আরও সন্তুষ্ট হইল। মিথ্যা ধারণার জন্য ঈসা খাঁ এবং কেদার রায় উভয়ের প্রতাপাদিত্যের নিকট দুঃখ প্রকাশ করিলেন। ঈসা খাঁ সরল ও পবিত্র অন্তঃকরণে প্রতাপাদিত্যের সহিত গলায গলায় সম্মিলিত হইলেন। তাঁহাকে বন্ধুতার চিহৃ-স্বরূপ অনেক মূল্যবান দ্রব্য উপহার প্রদত্ত হইল।

ঈসা খাঁর ধর্মগুরু মওলানা রেজাউল মোস্তফা বলিলেন যে, “পাপের দণ্ড ভোগ অনিবার্য। কিন্তু পরকাল অপেক্ষা ইহকালে দণ্ড ভোগ অনেক সুখের। মহারাজ! আপনি পূর্বে যে স্বর্ণময়ীকে হরণ করবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, সেই পাপের ফলে আপনার এই পরাজয়, লোকক্ষয়, ধনক্ষয়, অপযশ এবং লাঞ্জনা ভোগ করতে হল। পাপের শাস্তি তখন না হলে অনেকে মনে করে উহা পাপ নহে। কিন্তু ইহা অত্যন্ত ভুল। পাপ কঠোর শাস্তি প্রসবের জন্যই সময় গ্রহণ করে থাকে।

অতঃপর ঈসা খাঁ অরুণাবতীর বিবাহের কথা পাড়িলেন। প্রতাপ সাশ্রুনেত্রে বলিলেন, “সেনাপতি সাহেবের সঙ্গে পূর্ব হতেই অরুণাবতীর বিবাহ দিবার জন্য আমার সংকল্প ছিল। আমার দুর্গতিবশঃই তাঁর সহিত আমার বিরোধ ও শক্রতা জন্মে ছিল, কিন্তু তিনি আজ আমাকে আসন্ন মৃত্যু হ’তে রক্ষা করেছেন। তাঁর উদারতা ও মহত্ত্বে আমি যথেষ্ট লজ্জিত এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। তাঁর ন্যায় মহানুভব এবং হৃদয়বান পরমোপকারী ব্যক্তির করে কন্যাদান করতে পারলে এণে আমি পরম সুখ ও গৌরব অনুভব করব। আমার অরুণাবতী-রূপ মাধবীলতা উপযুক্ত সহকারকেই আশ্রয় করেছে।” অতঃপর প্রতাপাদিত্য বিবাহের তারিখ নির্দ্দিষ্ট করিয়া অরুণাবতীকে সঙ্গে যশোহরে ফিরিয়া গেলেন।

মাহতাব খাঁ ঈসা খাঁর সৈন্যদলে চাকুরী গ্রহণ করিলেন। প্রতাপাদিত্য রাজধানীতে প্রত্যাগত হইয়া কয়েকদিন পরে, গভীর দুঃখ এবং শোকের সহিত ঈসা খাঁ ও মাহতাব খাঁকে লিখিয়া জানাইলেন যে, বসস্ত রোগের আক্রমণে অরুণাবতী সহসা পরলোকগমন করিয়াছে। মাহতাব খাঁ এই দারুণ সংবাদে মর্মাহত হইয়া পড়িলেন। আশার জ্যোৎস্না চির আঁধারে ঢালিয়া গেল। অরুণাবতীর যে অরুণিমাজাল তাঁহার হৃদয়ে আলোক-প্রবাহ ও আনন্দের উৎস সৃষ্টি করিল। হায় প্রেম! হায় সুখ! তোমাদের আশা এমনি করিয়া মানুষের হৃদয় চিরকাল ভাঙ্গিতেছে, জ্বালাইতেছে এবং নিস্পেষণ করিতেছে। তোমাদের দুইজনের মোহে এই বিশ্ব-সংসার মুগ্ধ হইয়া ছুটিতেছে। তাহার ফলে-নিরাশা, অবিশ্বাস, অপ্রাপ্তি; তাহার ফলে-শোক, দুঃখ, বিষাদ ও হাহাকার বিশ্ব-সংসার পরিপূর্ণ হইতেছে। ঈসা খাঁ এই আকস্মিক দুর্ঘনায় যার পর ব্যথিত হইলেন। তিনি মাহতাব খাঁর প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়া তাহাকে নানারূপে সান্তনা করিতে ও প্রবোধ দিতে লাগিলেন। অন্য স্থানে তাঁহার বিবাহের প্রস্তাব করিতে চাহিলেন। কিন্তু মাহতাব খাঁ আর বিবাহ করিবেন না বলিয়া দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *