১২.রায়-নন্দিনী – দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ গুরু-শিষ্য

দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ গুরু-শিষ্য

কাপালিককুল-চুড়ামণি অভিরাম স্বামী এবং পাপাশয় কেহদাকান্ত স্বর্ণকে খুঁজিবার ছল করিয়া তাহাদের আরদ্ধ কার্য সুসম্পন্ন করিবার জন্য নৌকাযোগে সাদুল্লাপুর পরিত্যাগ করিল। হেমদাকান্তের সহকারী গুণ্ডার দল স্বর্ণকে লইয়া পূর্ব পরামর্শানুসারে ইদিলপুরের নিবিড় জঙ্গলে আশ্রয় লইয়াছিল। তখন স্বর্ণকে লইয়া নৌকাপথে বেশীদূর ভ্রমণ করিলে, পাছে কেহ কোন সন্ধান পায়, এজন্য স্বামী ও শিষ্য ইদিলপুরের নির্জন কাননেই আপনাদের পাপ অভিসন্ধি সম্পাদনের নিরাপদ আশ্রয় মনে করিয়াছিল। গুণ্ডার দল স্বর্ণময়ীকে লইয়া সেই কাননাভ্যন্তরে কুটীর রচনা করিয়া বাস করিতেছিল। তিন দিবস পরেই পাপাত্মা অভিরাম স্বামী ও হেমদাকান্ত সেই কানাভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। তাহারা রোরুদ্যমানা এবং ক্ষিপ্তমনা স্বর্ণকে নানাপ্রকার সান্তনা তাহাদের বাক্য শ্রবণে যার-পর-নাই মর্মপীড়িতা হইল। সে কখন ক্রন্দন, কখন তর্জন-গর্জন করিয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিল। কিন্তু “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী”। স্বর্ণের মানসিক উত্তেজনা এবং উৎক্ষিপ্তভাব দর্শনে স্বামী-শিষ্য মিলিয়া তাহাকে কঠোরভাবে শঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখিল। স্বর্ণ যখন দেখিল, তাহার কষ্ট ও নির্যাতন চরমে উঠিয়াছে এবং অল্পদিনের মধ্যে পাপ-সংকল্পে সম্মত না হইলে, পাষণ্ডদ্বয় বল-প্রকাশেও কুণ্ঠিত হইবে না, তখন সে এই বিষম বিপদ হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য এক কৌশলজাল বিস্তারের কল্পনা করিতে লাগিল। মাকড়সা যেমন আশ্রয়শূন্য হইলেই নিজের দেহের ভিতর হইতে সূত্র নির্গত করিয়া জাল নির্মাণ পূর্বক আপনাকে আশ্রয়-সংস্থিত করে, মানুষও তেমনি বিপদে পড়িলেই তাহার অন্তরস্থ আত্মা তাহাকে নূতন বুদ্ধি-কৌশল উদ্‌ভাবনের কল্পনায় মাতাইয়া তোলে। স্বর্ণ দেখিল, অভিরাম স্বামীও তাহাতে মুগ্ধ এবং লুব্ধ। হেমদা এবং স্বামীজি উভয়েই তাহার শিকার। সুতরাং আপাততঃ একজনকে ভালোবাসার ছলনায় মুদ্ধ করিতে পারিলেই অন্যের সহিত তাহার বিরোধ উপস্থিত অনিবার্য। উভয়ের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত করিতে পারিলে, হয়ত তাহার উদ্ধার হইবার কোন পথ খুলিয়া যাইতে পারে। এই সংকল্পে স্থির-সিদ্ধান্ত হইয়া ক্রমে ক্রমে স্বামীজি এবং হেমদাকান্তের সহিত কথোপকথন করিতে ও স্বামীজির প্রতি একটু বেশী ভালবাসা দেখাইতে লাগিল। নানাপ্রকার উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং দুস্প্রাপ্য জিনিসের ফরমায়েস করিতে লাগিল। অন্যান্য লোক থাকিলে তাহার সঙ্কোচ ও লজ্জা বোধ হয়, এই অছিলায় সমস্ত লোককে বিদায় করিয়া দেওয়াইল। এণে এই নিবিড় অরণ্যে স্বামীজি, হেমদা এবং স্বর্ণ ব্যতীত আর কেহই রহিল না।

স্বর্ণকে লইয়া প্রথম প্রথম স্বামীজি ও শিষ্যের মধ্যে ঈর্ষা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি, তৎপর অত্যল্পকাল মধ্যে কলহ হইতে লাগিল। স্বর্ণ চালাকী করিয়া সে কলহে স্বামীজির পক্ষ অবলম্বন করিতে লাগিল। শুধু তাই নয়, স্বামীজি সম্মুখে আসিলেই সে আনন্দ প্রকাশ করে, কিন্তু হেমদাকে দেখিলেই সে লজ্জা ও ঘৃণায় ঘোমটা টানিয়া বসে। ইহাতে হেমদার দিনদিন স্বামীজির প্রতি জাতক্রোধ হইতে লাগিল। এই সময় একদিন সুযোগ বুঝিয়া, হেমদা কার্যোপলক্ষে একটু দূরে গেলে পর, স্বামীজিকে ডাকিয়া বলিল “আমি যখন ভাগ্য-দোষে অশুলে পতিত হয়েছি, তখন কুলে উঠবার আর আশাও নাই, ইচ্ছাও নাই। কুলে উঠলে লোক-গঞ্জনায় গলায় কলসী বেঁধে ডুবে মরতে হবে। সুতরাং মনে করেছি, অকুলে থেকেই একটু কুলে আশ্রয় নেব। দুই কুল ত আশ্রয় করতে পারব না। একটা মন দু’জনকে দিতে পারব না। গুরু থাকতে লঘুকে বরণ করতে পারব না। কিন্তু যেরূপ ব্যাপার দেখছি, তাতে বোধ হয়, শিষ্যই অবিলম্বে আমাকে উচ্ছিষ্ট করবে। কিন্তু সেরূপ হলে নিশ্চয় জেনে রেখ, আমি আত্মহত্যা করব। তোমাকেই স্ত্রী-হত্যার পাতকভাগী হতে হবে। ঠাকুর! যদি আমার জীবনে তোমার মমতা থাকে, তা’হলে আমাকে নিয়ে পলায়ন কর।”

অনলস্পর্শে তুবড়ীবাজি যেমন অসংখ্য স্ফুলিঙ্গে প্রবলভাবে জ্বলিয়া উঠে, স্বর্ণময়ীর অনুরাগপূর্ণ হিত-পরামর্শে অভিরাম স্বামীর হৃদয় আশা, আনন্দ ও উৎসাহে তেমনি নাচিয়া উঠিল।

কুকুর যেমন প্রভুহস্ত হইতে মাংসখণ্ড পাইবার সম্ভাবনায় আনন্দে নৃত্য করিয়া উঠে, কাম-কুক্কুর অভিরাম স্বামীও স্বর্ণময়ীর পরামর্শে তেমনি আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল। তাহার হৃদয়-উদ্যানের শুঙ্ক কুঞ্জে সহসা লক্ষ কুসুম ফুটিয়া উঠিল। স্বর্ণ-রাজ্য তাহার চরণতলে গড়াগড়ি যাইতে লাগিল। নিরাশার মরু-সৈকত বিপ্লাবিত করিয়া সুপ্ত প্রেমের ক্ষুদ্র নির্ঝর, যাহা কেবল তাহার হৃদয়ের অতি নিভৃত কোণে লুক্কায়িত ছিল-প্রবল তরঙ্গ-ভঙ্গে আবর্ত রচিয়া ফুলিয়া-ফাঁপিয়া সাগর-সঙ্গমে ছুটিয়া চলিল। পরামর্শ ঠিক হইয়া গেল। পর দিবস রাত্রি থাকিতেই মেহদাকে নিরাশার অন্ধকারে নিপে করিয়া সেই কানন-পথেই পলায়ন করিতে হইবে।

রাত্রি এক প্রহর থাকিতেই অভিরাম স্বামী শয্যা ত্যাগ করিতে স্বর্ণকে লইয়া সেই কাননের অন্ধকার-পথে দণি দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। নৌকাপথে অন্য কোন দিকে পলায়ন করিলে, হেমদা তাহার সন্ধান পাইতে পারে, এই আশঙ্কায় সেই কাননের দণিভাগে অগ্রসর হইতে লাগিল। কাপালিক চিন্তা করিল যে, আমরা যে আশ্রম ত্যাগ করিয়া পুনরায় এই কাননের অন্যত্র আশ্রয় লইব, হেমদা তাহা কল্পনাও করিতে পারিবে না।

এদিকে হেমদা যথাসময়ে গাত্রোত্থান করিয়া স্বর্ণ ও অভিরাম স্বামীকে দেখিতে না পাইয়া অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত হইয়া উঠিল। তাহার বরে স্পন্দন যেন থামিয়া যাইতে লাগিল। সে চঞ্চল পদে এদিক্‌-ওদিক্‌ খুঁজিয়া দুইজনের একজনকেও দেখিতে পাইল না। শেষে অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, উভয়ের বস্ত্র, অলঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান হালকা জিনিস-পত্র কিছুই নাই। তখন হেমদা দুঃখে ও wেভে প্রোজ্জ্বলিতপ্রায় হইয়া উঠিল। তাহার প্রতিহিংসাবহিৃ একেবারে নভঃস্পর্শী হইয়া উঠিল। তাহাকে অনন্তকাল নরকানলে দগ্ধ করিলে এবং কুটী কুটী করিয়া কাটিলেও তাহার ক্রোধ কিছুতেই শান্ত হইবে না।

স্বর্ণ এবং স্বামীজী কোন পথে কোথায় পলায়ন করিয়াছে, তন্নির্ধারণেই তাহার একমাত্র চিন্তার বিষয়ীভূত হইয়া উঠিল। সে অনেক ভাবিয়া শেষে কানন-পথেই উড়ো-পাখীর পশ্চাদ্ধাবিত হইল। স্বামী এবং স্বর্ণ যে-পথে পলায়ন করিয়াছিল, সে-পথে অনেক লতা ও গাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা ভগ্ন এবং নত হইয়া পড়িয়াছিল। স্থানে স্থানে বর্ষা-পুষ্ট ঘাসের মাথা দলিত হইয়াছিল। হেমদা বণ্ড কষ্টে সেই সমস্ত চিহ্নের অনুসরণ করিয়া দ্রুত অগ্রসর হইতে লাগিল।

অভিরাম স্বামী এবং স্বর্ণময়ী দ্রুতপদে দক্ষিণাভিমুখে ক্রমাগত চলিতেছিল। বেলা দুই প্রহরের সময় তাহারা ক্ষুৎপিপাসায় অত্যন্ত কাতর হইয়া এক স্থানে বিশ্রাম করিতে লাগিল। সঙ্গে যে যৎসামান্য ফল-মূল ছিল, স্বামীজি পরম যত্নে তাহা স্বর্ণকে খাওয়াইতে লাগিল। যে স্থানে বসিয়া তাহারা জলযোগ করিতেছিল, সে স্থান মাহতাব খাঁর আশ্রম হইতে বেশী দূর নহে। স্বর্ণ এবং অভিরাম স্বামী জলযোগান্তে সে স্থান হইতে প্রায় উঠিবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময়ে অপহৃত-শিকার শার্দুলের ন্যায় ক্রুদ্ধ ও রুদ্রমূর্তি হেমদাকান্ত পশ্চাদ্দেশ হইতে আসিয়া একলম্ফে অভিরাম স্বামীর স্কন্ধদেশে ভীষণ খড়গ প্রহার করিল। অভিরাম স্বামী বিকট চীৎকার করতঃ বনভূমি বিকম্পিত করিয়া দশ হাত দূরে যাইয়া ভূতলে পতিত হইল। তাহার বিক্ষত ম্কন্ধদেশ হইতে অজস্রধারে রক্ত পড়িতে লাগিল। হেমদা রোষাবেশে কম্পিত এবং প্রদীপ্ত হইয়া অত্যন্ত তীব্র কটূক্তিতে অভিরাম স্বামী ও স্বর্ণময়ীর মর্মবিদ্ধ করিতে লাগিল। দারুণ ঘৃণায় অভিরাম স্বামীর মস্তকে গুরুতর পদাঘাত করিল। অতঃপর বিকট গর্জন করিয়া রক্তরঞ্জিত-শাণিত-খড়গ উদ্যত করতঃ স্বর্ণকে বলিল, “বল্‌, এখন তোর মতলব কি?” এই বলিয়া নিতান্ত অকথ্য এবং অশ্রাব্য ভাষায় স্বর্ণকে গালাগালি করিতে লাগিল। স্বর্ণ তখন লজ্জা, রোষ এবং ক্ষোভে দলিতা ফণিনীর ন্যায়, সন্তপ্তা সিংহীর ন্যায়, কুক্কুরাক্রান্ত নিরূপায় মার্জারের ন্যায়,-বৃক্‌তাড়িত মহিষীর ন্যায় নিতান্ত প্রখরা মূর্তি ধারণ করিল। বন-পথে আসাকালীন অভিরাম স্বামী একখানি তলওয়ার লইয়া আসিয়াছিল। স্বর্ণময়ী মুহুর্ত মধ্যে ভূতল হইতে সে তরবারি উত্তোলন করিয়া সংহারিণী-মূর্তিতে-দৃষ্টিতে অগ্নিকণা বর্ষণ করিয়া বলিল, “পাপাত্মা হেমদা! আয় দেখি তোর কত শক্তি ও সাহস! তোর পাপ-বাসনা অদ্য রক্তধারে নির্বাপিত করব।” এই বলিয়া বিপন্ন সতী তাহার গ্রীবামূল লক্ষ্য করিয়া বিদ্যুদ্বেগে তরবারি প্রহার করিল। পলকে হেমদাকান্ত ঈষৎ পশ্চাতে হটিয়া গেল। হেমদা তখন স্বর্ণময়ীর প্রেমে সম্পূর্ণ হতাশ হইয়া দারুণ প্রতিহিংসায় খড়গ প্রহারার্থে উদ্যত হইল। এমন সময়ে অভিরাম স্বামীর বিকট চীৎকারে উদ্বিগ্ন ও কৌতূহলী হইয়া মাহতাব খাঁ তথায় উপস্থিত হইয়া “কি কর, কি কর” বলিয়া হেমদার উপরে ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় পতিত হইলেন এবং তরবারির আঘাতে হেমদার হস্তের মাটিতে ফেলিয়া দিলেন। অতঃপর মুহুর্ত মধ্যে হেমদার বক্ষে এক প্রচণ্ড পদাঘাত করিয়া তাহাকে ভূতলশায়ী এবং বন্দী করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *