আমানুল হক (জন্ম: ১৯২৫) বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফটোগ্রাফার। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বিশেষ বন্ধু। গত বছর সত্যজিৎকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই প্রসঙ্গ সত্যজিৎ। ৮৬ বছরে পদার্পণ করা এই কীর্তিমান ব্যক্ত্বিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজা।
প্রশ্ন: ছবি তোলার শুরু ও ক্যামেরার সঙ্গে আপনার সখ্য গড়ে উঠল কীভাবে?
আমানুল হক: ফটোগ্রাফি শুরু করি অনেক আগে। আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি নাইনটিন ফরটি থ্রিতে। এর থেকে যদি একটু পিছিয়ে যান, যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি, তখন থেকেই আমি মোটামুটি ফটোগ্রাফি করি। কলকাতার কাগজে, সাময়িক পত্রিকায় আমার ছবিও ছাপা হয়। আমার বাড়ি কিন্তু শাহজাদপুরে, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। তখন হিন্দু-মুসলমানের বেশ সম্প্রীতি ছিল। আমাদের অঞ্চলে তখন বর্ধিষ্ণু ছিল সাহা পরিবার। ওখানে দুজন সাহা ছিলেন, যাঁরা ওই পুরো অঞ্চলে স্টুডিও ফটোগ্রাফির কাজ করতেন। একজনের নাম বীরেন সাহা। আরেকজনের নাম অতুল সাহা। অতুল সাহা ছিলেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, বিগ ফরম্যাটের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল বীরেন সাহার সঙ্গে। তিনি একটু অ্যামেচার ধরনের কাজ করতেন, সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে। অতুল সাহা ছবি তোলার জন্য ঘোরাঘুরি করতেন না। কেউ ফরমায়েশ করলে স্ট্যান্ডের ওপর ক্যামেরা বসিয়ে ছবি তুলতেন। গ্রুপ ছবিই বেশি তুলতেন। আমরা বিশেষ কিছু দেখলেই বীরেনদাকে গিয়ে ধরতাম ছবি তোলার জন্য।
প্রশ্ন: বীরেন সাহার ক্যামেরা দিয়েই কি আপনার ছবি তোলার শুরু?
আমানুল হক: না, তা নয়। তাঁরা এই ব্যাপারটায় একটু হুঁশিয়ার টাইপের ছিলেন। তাঁরা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন, ফটোগ্রাফি খুব কঠিন জিনিস। এদিকে এসো না। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তাঁরা হয়তো এটাও ভাবতেন, আর কেউ ফটোগ্রাফি শিখলে তাঁদের কম্পিটিটর বাড়বে। যা-ই হোক, তাঁদের কাছে আমি ক্যামেরা পাইনি। তখন বিজ্ঞাপনের যুগ ছিল। হিন্দুবাড়িতে তো পঞ্জিকা থাকতই, মুসলমানদের বাড়িতেও পঞ্জিকা ছিল। পঞ্জিকার মধ্যে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি থাকত। তখন পঞ্জিকায় আমি একটা ক্যামেরার বিজ্ঞাপন পেলাম। তারপর ডাকযোগে জানালাম, এই ক্যামেরাটা আমার চাই। সেটা ছিল একটা জাপানি ক্যামেরা। ক্যামেরা হাতে পাওয়ার পর আমি প্রায় কেঁদে ফেললাম। এত সুন্দর ছিল ক্যামেরাটা, কিন্তু সেটা দিয়ে ছবি তোলা যায় না। খেলনা ক্যামেরা। আমি রাগ করে ক্যামেরাটা ভেঙে ফেললাম।
প্রশ্ন: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আপনি রফিকউদ্দিন আহমদের একটি ছবি তুলেছিলেন, গুলিবিদ্ধ, মাথার মগজ বেরিয়ে আছে, সেটাই বোধ হয় তখনকার রাষ্ট্রীয় সহিংসতার সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। আপনি তখন মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন। এই অমূল্য ফটোগ্রাফটি আপনি কীভাবে তুলেছিলেন?
আমানুল হক: হ্যাঁ, আমি তখন আর্টিস্ট ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতাম। এই কাজটা বাবার কাছ থেকে শিখেছিলাম। উনি বেশ ভালো ছবি আঁকতেন। এই ছবি তোলার বিষয়টি নিয়ে কিছু ভুল কথা চালু হয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন, ছবিটি বক্স ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছিল। আসলে তা নয়। মিলিটারি-পুলিশ তখন লাশগুলো গুম করে ফেলছিল। রফিকের লাশের সন্ধান আমাকে দিয়েছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদিরস। আমি ফুলহাতা হাওয়াই শার্ট পরেছিলাম। ক্যামেরাটা শার্টের নিচে লুকানো। রফিকের গুলিবিদ্ধ, খুলি উড়ে যাওয়া লাশটা মেডিকেল কলেজের পেছন দিকে একটা প্রায় অন্ধকার ঘরের মধ্যে পড়ে ছিল। আমি একা গিয়ে খুব সন্তর্পণে ছবিটা তুলেছিলাম। ছবিটি সেদিনই দৈনিক আজাদ-এ পাঠানো হয়েছিল। ছবির ব্লকও এসেছিল। কিন্তু রাত প্রায় দুটোর দিকে কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে ছবিটা আর ছাপা যায়নি। তবে আরেকটা ব্লক বানিয়ে ছাত্রদের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল। ছাত্ররা একটা প্রচারপত্র লিখে তাতে ছবিটি ছেপেছিল। পুলিশ পরে এগুলো সিজ করে।
প্রশ্ন: ১৯৫৪ সালে আপনার প্রথম এক্সিবিশন হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে। সেখানে আপনি ‘আমার দেশ’ চিত্রমালার প্রদর্শনী করেছিলেন। আপনি কি এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলেন, নাকি উদ্যোক্তাদের মধ্যেই ছিলেন?
আমানুল হক: আমরা একসঙ্গে যাঁরা প্রচুর ঘোরাঘুরি করতাম, পদব্রজে, তখন তো রিকশায় ওঠার পয়সাও আমাদের ছিল না, তাঁদের একজন ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। তো আমাদের ডাকবে কি, আমরাই তো উদ্যোক্তা। এই সম্মেলনের সূত্রেই কলকাতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। এঁদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
সে সময় তো আর এত প্রদর্শনী হতো না। ফলে এই প্রদর্শনীটি মোটামুটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: কাগমারীতেও আপনি একটা এক্সিবিশন করেছিলেন?
আমানুল হক: হ্যাঁ, সেটা আমার দ্বিতীয় এক্সিবিশন, ১৯৫৭ সালের কথা এটা। মওলানা ভাসানীর সহযোগী, কাগমারী মহাসম্মেলনের আইডিয়াটার সঙ্গেও যিনি গোড়া থেকেই জড়িত ছিলেন, তিনি হলেন কাজী মোহাম্মদ ইদিরস। অসাধারণ চরিত্র। সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের মধ্যে তাঁর বিরাট যোগাযোগ ছিল। তিনিই প্রথম এক্সিবিশনটার ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওখানেই তারাশঙ্করের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনি সম্ভবত কোথাও এমন লিখেছেন, তারাশঙ্কর একটু নাক-উঁচু ধরনের ছিলেন।
আমানুল হক: লিখেছি নাকি? অনেক পুরোনো ঘটনা তো, ঠিক মনে করতে পারছি না। আর আমি লেখালেখি অনেক দিন আগে থেকেই ছেড়ে দিয়েছি। তবে বাইরে থেকে তাঁকে ও রকমই মনে হতো। কিন্তু তাঁকে দেখলে আপনি যদি বলেন কোনো উকিলের মুহুরি বা কম্পাউন্ডার, তা-ও মানাবে। গায়ে ধূসর রঙের একটা চাদর। চেহারা ছিল শ্যামবর্ণ। শিল্পীদের যে বাহ্যিক কিছু ভাবভঙ্গির প্রকাশ থাকে, সেটা তাঁর ছিল না বলা যায়। আমি প্রথমবার তারাশঙ্করকে সামনে দেখে এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। আমার তখন একটু খারাপ লেগেছিল। আমি এত উৎসাহ দেখালাম, আর তিনি নিরুত্তাপ। এই আর কি।
প্রশ্ন: আমার দেশ প্রদর্শনীর পর আপনি সরকারি চাপের মুখে পড়েছিলেন। সে কারণেই বোধ হয় আপনি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। কলকাতায় যাওয়ার পরই কি আপনার সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় হলো, নাকি আগে থেকেই ছিল?
আমানুল হক: আমি যখন কলকাতায় গেলাম, তত দিনে সত্যজিৎ রায় জগদ্বিখ্যাত। কলকাতা থেকে আমি ঢাকায় ফিরি অনেক পরে, ১৯৬৫ সালের দিকে। সত্যজিতের সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হলো, তার আগেই পথের পাঁচালি বানানো শেষ। সত্যজিতের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছে কলকাতায়, কাকতালীয়ভাবে। ঢাকায় থাকতেই নতুন সাহিত্য বলে একটি পত্রিকার সুবাদে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। কলকাতায় যাওয়ার পর তিনি একটা চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন ডি জে কেমারের অফিসে, খুব বড় বিজ্ঞাপন এজেন্সি ছিল তখন। সত্যজিৎ রায় এখানে কাজ করতেন। সেদিন ডি জে কেমারের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সবাই খুব ব্যস্ত। আমার ছবি দেখার মতো সময় কারও নেই। স্বয়ং দেবীপ্রসাদ চিঠি লিখেছেন, না দেখেও ওদের উপায় নেই। দেবীপ্রসাদ চিঠির শেষে লিখেছেন, ‘এই কাজটা করে দিস। তোর বাড়িতে গিয়ে একদিন খেয়ে আসব।’ এই চিঠির সম্মান রক্ষা করতেই ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে ওরা আমার ছবি দেখল। তখন দেখি একটা লম্বা লোক খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। আবার মাঝেমধ্যে আমার ছবির দিকে আড়চোখে দেখছেন। এ রকম বার-দুই তিনি পাশ দিয়ে গেছেন। তারপর এসে ছবিগুলো হাতে নিলেন। খুব স্ক্যান করার মতো চোখে ছবিগুলো দেখলেন। তারপর কিছু না বলেই আবার চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর, আমি যখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে প্রথম গিয়ে ছবি দেখালাম, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আপনার ছবি তো আমি দেখেছি।’ তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার ছবিকে ব্রেসোর সঙ্গে তুলনা করলেন।
প্রশ্ন: আপনি সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবির শুটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। দেবী, তিন কন্যা, কাপুরুষ মহাপুরুষ, নায়ক, মহানগর—এসব ছবিতে ছিলেন। কিন্তু আপনার ভুমিকা কি ছিল?
আমানুল হক: এ বেশ মজার ব্যাপার। আমি কিন্তু কোনো দিনই অফিশিয়ালি সত্যজিতের ইউনিটের মধ্যে ছিলাম না। আমি ছিলাম তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সেই হিসাবেই যেতাম। এরকম কিন্তু অনেকেই আসতেন। ফিল্ম ডিরেক্টররা আসতেন, ফটোগ্রাফাররা আসতেন। নিমাই ঘোষের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা কিন্তু অনেকদিন এরকম ছিল। সে একবার একটা বক্তব্যে বলেছিল, সে এই যে আসে যায়—এটা তার কাছে অসহ্য। এর খরচাপাতিও আছে। সে বাধ্য হয়ে সত্যজিৎ রায়কে গিয়ে বললো, এক টাকা হলেও আপনি আমাকে দেবেন। তারপর ধীরে ধীরে সে বেতনভূক্ত হয়ে যায়। আমরা যে কাজটা করতাম সেটা কিন্তু স্টিল ফটোগ্রাফারের না। এটাকে বলত টেকনিক্যালি স্পিকিং—প্রোডাকশন স্টিল ফটোগ্রাফি।
প্রশ্ন: সত্যজিতের জীবনীকার মারি সিটন আপনাকে খুবই ভালোবাসতেন। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে উনি আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির বিষয় ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ওয়ার ভিকটিমদের জন্য যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটা সংস্থা কিছু করতে চায়। মারি সিটন লিখেছিলেন, উনি আপনার সাহায্য চান, ঢাকায় আসতে চান। আপনি তখন খুব আন্তরিকভাবে তাঁকে নিমন্ত্রণ করেননি। বইয়ে আপনার দ্বিধার কারণ হিসেবে লিখেছেন ‘বিশৃঙ্খল পরিবেশে মানসিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত’ ছিলেন। আসলে কী কারণে তখন আপনি তাঁকে আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করলেন না?
আমানুল হক: ঠিকই ধরেছেন, মারিকে তখন আমি খুব আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করিনি। বইতে আমি এটা স্পষ্ট করে বলিনি। আমার একটা আক্ষেপ ছিল। তখন বাংলাদেশে অরাজক একটা অবস্থা চলছে। আমি বঙ্গভবনে সিকিউরিটি চিফের কাছে গেলাম। সুশিক্ষিত না হোক, তাঁকে শিক্ষিত বলতে পারেন। তাঁকে আমি মারি সিটনের অরিজিনাল চিঠিটা দেখালাম। মারি সিটন তখন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির—বাংলা করলে এমনই দাঁড়ায়—জেনারেল সেক্রেটারি। তাঁদের একটা অ্যাপিল ছিল, আমরা অর্থ সংগ্রহ করতে চাই বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য। বাংলাদেশের ওয়ার ভিকটিম, মানে যারা ধর্ষিত হয়েছেন, বা যুদ্ধশিশু—এদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সে জন্যই উনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু চিঠি দেখে ওই ভদ্রলোক বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না। তিনি ‘দাঁড়ান আমি দেখছি’ টাইপের একটা ভঙ্গি করলেন। আমি বসে থাকতে থাকতে…আর আমার শরীরে কুলাল না, আমি চলে আসলাম।
এরপর আমি একাধিকবার গিয়েছি। আমি দেখলাম, এই অরাজকতাটা এত পীড়াদায়ক যে আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। আর বোঝেন, আমি ওই রকম এতিমের মতো বসে আছি। এদিকে সব ক্যাডার, পলিটিক্যাল ক্যাডার, যুবক ছেলেরা…।
প্রশ্ন: ছাত্রলীগের ক্যাডার…।
আমানুল হক: ন্যাচারালি। আমি ওটা মুখে আনতে চাইনি। তারা দলবেঁধে আসছে। পুলিশকে তো তারা তোয়াক্কাই করছে না। গটগট করেভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের ডেসটিনেশন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। এইটাই রিয়ালিটি ছিল। আমার অবস্থাটা কী, মানে হেল্পলেস একটা অবস্থা। চিঠিটাকে কোনো গুরুত্বই দিল না তারা। চিঠিটা যদি ঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে যেত, তাহলে হয়তো অন্য রকম কিছু ঘটতে পারত। এটা বলাই যায়।
প্রশ্ন: আপনি বিয়ে করেননি। কেন করেননি, তার কিছুটা ইঙ্গিত আপনার বইতে দিয়েছেন। বিজয়া রায় আপনাকে একদিন কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলেন। পরে সত্যজিৎ বউদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমানুল কী বলল? বউদি বলেছিলেন, আমানুল ঠিকই করেছে। কিন্তু কী ঠিকই করেছে, সেটা আর আপনি খোলাসা করেননি।
আমানুল হক: আসলে সেটা এমনই একটা কঠিন বিষয়, যেটা—আমার টাকা ছিল না, বা আমার শরীর খারাপ ছিল—এভাবে বলা যায় না কিন্তু। ব্যাপারটা, এত ইনডিরেক্ট, সেটা বলার ক্ষমতাও আমার আছে, বউদিকে আমি ঠিকই বলেছিলাম, আর মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার একটা স্বতঃস্ফূর্ত গুণ ছিল আমার, একটু বেশি আন্তরিক কিসের জন্য যেন আমি হয়ে যেতাম। বউদিকে যা বলেছিলাম, সেটা হয়তো এ জন্যই বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আপনাদের আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন: প্রশ্নটা নিশ্চয়ই অস্বস্তিকর। কিন্তু পরে যদি কখনো আপনাকে নিয়ে কোনো গবেষক কাজ করেন, তার জন্য এসব ব্যাপার জানার কোনো রাস্তাই থাকবে না।
আমানুল হক: যে প্রশ্নটা করেছেন, তার উত্তর আমি সত্যজিৎ রায়কেই বলিনি। আমার মাও বলেছিলেন, তুমি বিয়ে কোরো না। কারণ, মা জানতেন আমার জীবনের গতিবিধিটা। যা সত্যজিৎ রায়কেই সরাসরি কখনো বলি না, সেটা আর কাউকেই বলতে পারব না। আপনারা এত সমঝদার এবং গুণগ্রাহী, তাই আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা এপিসোডের কথা বলি।
প্রশ্ন: সেটা আপনি বোধহয় বইতে লিখেছিলেন। গ্রামের এক গৃহবধূ।
আমানুল হক: হ্যাঁ, তার স্বামী বিদেশে থাকত। ঐ মহিলার সঙ্গে আমি এক রাত ছিলাম। আমি সত্যজিৎ রায়কে কোনোদিন এই ঘটনা বলিনি। যাই হোক, সেই বধূ, আমি তার সঙ্গে রাত্রিযাপন করেছি, না সেই আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করেছে—এটা বুঝিয়ে বলাটা কঠিন। আমি তখন সম্বিৎবিহীন বলাও ঠিক হয় না। ওই রাতে আমি তখন অন্য একটা অনুভূতির মধ্যে চলে গেছি। বইতে আমি নপুংসক কথাটা লিখেছি। আমি সাইকোলজি কিছুটা পড়েছিলাম। সেখানে কিন্তু এরকম সিচুয়েশনের কথা আছে। যখন আমি মেডিকেলে কাজ করি তখন এক প্রফেসর আমাকে খুব ভালোবাসতেন। একদিন আমার সামনেই তাঁর কাছে একজন রোগী আসলো। আমার সামনেই রোগী দেখলেন। মানসিক রোগী, তার সমস্যা হলো স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের অবস্থা হলেই সে আর সঙ্গম করতে পারে না। যৌনাঙ্গে তীব্র ব্যথা হয়। রোগী চলে যাবার পর প্রফেসর আমাকে বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক। তার সঙ্গে আমার সিচুয়েশন কিছুটা মেলে।
প্রশ্ন: আপনি আপনার ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে একটি অ্যালবামের কাজ করছেন শুনেছি।
আমানুল হক: হ্যাঁ, ছবির বই নিয়ে কিছুটা বেসামাল অবস্থায় আছি। বইটি স্পন্সর করছেন ফরিদুর রেজা সাগর। কিন্তু আমরা যেমন ভেবেছিলাম, প্রডাকশন কস্ট তার থেকে অনেক দূর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে একটু বিপদের মধ্যে আছি। বইয়ের কাজ অবশ্য প্রায় শেষ। বইয়ের নাম দিচ্ছি নির্বাচিত আমার দেশ চিত্রমালা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৯, ২০১১
Leave a Reply