১০. পরীক্ষিতের খোঁজ

মহিমবাবু বললেন, “আসুন ইন্স্পেক্টরবাবু, আসুন। কিন্তু আপনার আগেই আমরা পরীক্ষিতের খোঁজ পেয়েছি, তা তো দেখেছেন। কী করে পেলুম, তা যদি জানতে চান – “
কী করে পেলেন তা জানি” বলেই ইন্স্পেক্টরবাবু আবার পাহারাওয়ালাদের কী ইঙ্গিত করলেন, তারা হঠাৎ দুজনে মহিমবাবুর দু’দিকে গিয়ে দাঁড়াল পরের মুহূর্তে একজন খপ করে তাঁর হাত দুটো ধরে ফেললে আর একজন পরিয়ে দিলে হাতকড়া।
চঞ্চল চিৎকার করে উঠল, “এ কী! এ কী কাণ্ড!” পরীক্ষিৎবাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, আর উপেন ধর মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ল।

পরীক্ষিৎবাবু বললেন, “কে হে তুমি, তোমার তো বদ সাহস। খোলো, ওর হাত কড়া, খোলো। জান, ও আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু।”
“কী রকম বন্ধু প্রমাণ করে দিচ্ছি। ঐ টেবিলের উপর কাগজখানা কী?”
“তা দিয়ে তোমার দরকার?”
“তা দরকার একটু আছে বৈকি! আপনার নতুন উইলটা কী রকম হল?”
“সে সব বিষয়ে তোার সঙ্গে কথা কইতে আমি প্রস্তুত নই। তুমি এখানে এসেছ কেন – তোমাকে তো কেউ ডাকেনি?”
“কেন এসেছি? এইজন্যে -” রণজিৎবাবু এগিয়ে গিয়ে ছোঁ মেরে টেবিলের উপর থেকে কাগজখানা তুলে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ভরলেন। পরীক্ষিৎবাবু অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কী বলতে যাচ্ছিলেন, রণজিৎবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, “আমার সব কথা আগে শুনে নিন, তারপর যা হয় বলবেন। মহিমবাবু, আপনাকে একটু কষ্ট দিতে হল, কিন্তু আপনি যেরকম ডেঞ্জেরাস ক্রিমিনাল, ঐ হার কড়াটা না হলেও চলছে না। মাপ করবেন। তাই বলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন, বসুন না এখানে।”

পরীক্ষিৎবাবুর মুখে অপার বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। তিনি শুধু বললেন “তুমি কি পাগল হলে?”
রণজিৎবাবু একটা চেয়ারে বলে বললেন, “তাহলে সবটাই শুনুন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, চ্যাটার্জি ব্যাঙ্ক যখন ফেল পড়ল? আপনার কত টাকা ছিল সেখানে?”
“ছিল কিছু। সে কথা এখানে কেন?”
“কে একজন লোক জাল শেয়ার বেচে সরে পড়ল, ধরা গেল না। তাতেই ব্যাঙ্ক ফেল পড়ল, তাই তো? লোকটিকে এখন ধরা গেছে।”
“কে সে?”
“সে আপনার সামেই বসে আছে। তার আসল নাম মহিম চ্যাটুয্যে, কিন্তু শেয়ারগুলো বেচেছিল, হলধর হালদার নামে; অর্থাৎ আপনাদের পাঁচজনের টাকা মেরে দিয়ে…”

পরীক্ষিৎবাবু ভয়ানক উত্তেজিত হয় বললেন, মিথ্যে মিথ্যে কথা। এর প্রমাণ?”
“প্রমাণ আমি যথাসময়ে কোর্টে দাখিল করব। তারপর হল কী – নানা ব্যাঙ্কে নানা বেনামিতে লাখ কযক টাকা রেখে তিনি খুব গরিবের মতো কিছুদিন ঘুরে বেড়ালেন। তারপর বের করলেন, ‘কলকাতা হরকরা,’ এ পত্রিকার জন্য লালবিহারী মালাকারের কাছ থেকে মোটা টাকা বাগানো হল, আপনারা পাঁচজনও বাদ গেলেন না। কিছুদিন পরে নব-সাহিত্য-ভবনের সূত্রপাত হল, আপনার সব বই এখন থেকে ওরাই বার করবে, এইরকম কন্ট্র্যাক্ট হয়েছে, না?”
“তা তো হয়েছে। কিন্তু – “
“নব সাহিত্য ভবনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয়রাম শীলকে আপনি চেনেন? তাঁকে দেখেছেন কখনও?”
“তাকে দেখবার দরকার হয় নি। মহিমই সব ব্যবস্থা করে দিযেছে।”
“তাকে দেখবেনও না কখনও, কারণ মহিম চাতুয্যে আর জয়রাম শীল একই ব্যক্তি। নব সাহিত্য ভবন বেনামিতে মহিমবাবুরই কোম্পানি।”
“বল কী হে।”
“ঠিকই বলি। ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’কে খাটো করে ‘কলকাতা হরকরা’ যাতে জাঁকিয়ে উঠতে পারে এই উদ্দেশ্যে আগাগোড়া উনি নানারকম প্যাঁচ খেলে যাচ্ছেন। অসম্ভব চালাক লোক আপনার এই বন্ধুটি! আপনি কি লালবিহারীবাবু কেউ কিছু বুঝতে পারেন নি।”
এখানে চঞ্চল বলে উঠল, “কিন্তু পরীক্ষিৎবাবুর অন্তর্ধানের রহস্য – “
কথাটা শুনে পরীক্ষিৎবাবু চমকে উঠলেন, “আমার অন্তর্ধান! তার মানে?”
“বাঃ, এই একটা প্যাঁচেই তো ‘হরকরা’র কাটতি তিনগুণ বেড়ে গেল। আপনি তো এই কাশীপুরের বাগানবাড়িতে বসে আছেন – এদিকে খবরের কাগজে কী হুলুস্থূল – কলকাতায় কী হৈ চৈ – পুলিশ, গুলি ছোঁড়া – ডায়মণ্ড হার্বরে একটা পড়োবাড়িতে ধস্তাধস্তি – কত কিছুই তো হযে গেল! আপনি কি করে জানবেন – আপনাকে তো খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হয়নি, কি কারো সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় নি।”
“খবরের কাগজ আমি ইচ্ছে করেই পড়িনি। কাগজ খুলেই বড় বড় অক্ষরে পরীক্ষিৎ জয়ন্তীর খবর – এ আর ভালো লাগে না। বিরাট একটা হৈ চৈ তো হবেই, তার আগে একটা দিন নিরিবিলি এই বাগানবাড়িতে কাটাব, এই রকম ইচ্ছে ছিল। তা, এ নিযেও বুঝি হুলুস্থূল?”
“হুলুস্থূল বাড়িয়েছেন আপনার বন্ধুই – আর এই বাগানবাড়িতে এসে একটা দিন কাটাবার ইচ্ছেটা, মহিমবাবুই আপনার মনে জাগান – কেমন, ঠিক কিনা?”
“তা, মহিমই বলেছিল বটে -”
“এ কথাও বলেছিলেন যে বিজয়বাবুকে যেন আগে জানানো না হয়, পাছে তাঁর আপত্তিতে এমন চমৎকার প্ল্যানটা ভণ্ডুল হয়ে যায়।”
“কিন্তু বিজয় কি খবর পায় নি? মহিম, তুমি জানাওনি যে, আমি এখানে আছি?”
মহিম চাটুয্যে চুপ।

রণজিৎবাবু বলতে লাগলেন, “ব্যাপারটা এইরকম। মহিমবাবুর টাকার তৃষ্ণা অসীম! নানা অসৎ উপায়ে প্রায় সাত লাখ টাকা তিনি করেছেন, কিন্তু লোভ তাঁর বেড়েই চলেছে। এত বেশি লোভ করতে গিয়ে শেষ সামলাতে পারলেন না। কিন্তু মহিমবাবু, এ কথা বলবই যে আপনি অদ্ভুত ক্ষমতাশালী লোক। যেমন আপনার কল্পনাশক্তি, তেমনি আপনার দুঃসাহস। এ ব্যাপারটাও প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন, উপেন ধর মশাইও তাঁর পার্ট প্লে করেছেন চমৎকার, কিন্তু পরীক্ষিৎবাবুর ঘরে তাঁর টেবিলের উপর আরও একখানা অর্ধ সমাপ্ত চিঠি পড়ে ছিল, সেটি অপনি সরাতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাতেই আমার পক্ষে ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আজ সকালে যে চিঠিটা পরীক্ষিৎবাবুর টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আপনাদের সকলকে দেখালুম, তার তলাতেই আর একখানা চিঠি ছিল, সেখানা চট করে আমি পকেটে ভরে ফেলেছিলুম, আর কেউ লক্ষ করেনি।”
মহিমবাবুর মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট আর্তস্বর বেরুল।
রণজিৎবাবু পকেট থেকে একগদা কাগজ বার করলেন। তার ভিতর থেকে একটি বেছে নিয়ে পড়লেন – “মহিম, আমি প্রিন্সেপ ঘাটে থাকব, তুমি সেখানেই ।।… চিঠি শেষ করা হয়নি, টেবিলের উপরেই পড়ে ছিল। এ চিঠির পরে কি আপনি আবার লিখে পাঠিয়েছিলেন?”

রণজিৎবাবু কাগজখানা পরীক্ষিৎবাবুর সামনে টেবিলের উপর মেলে ধরলেন।
পরীক্ষিৎবাবু কাগজটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ আমার এক বদভ্যাস , একবারে একটা চিঠি প্রায়ই শেষ করে পারিনে – এক লাইন লিখে উঠে যাই। হ্যাঁ, পরে এই চিঠিই আবার লিখে পাঠিয়েছিলুম বইকি, তাতে হয়েছে কি?”
“এ হাতের লেখা তবে আপনারই?”
“হ্যাঁ, আমার বইকি!”
“আচ্ছা, দেখুন তো, এ হাতের লেখা আপনার কিনা?” বলে রণজিৎবাবু আর একখানা কাগজ ঔপন্যাসিকের সামনে মেলে ধরলেন।
“আরে, এ কী আশ্হর্য! এ তো হুবহু আমার হাতের লেখা, কিন্তু এ চিঠি তো আমি কখনও লিখিনি! কেনই বা লিখব? আমি তো কখনও ডায়মণ্ড হার্বারে বন্দী হইনি। এ কী কাণ্ড? এ যে দেখছি দস্তুরমতো নভেলিয়ানা!” পরীক্ষিৎবাবু বিহ্বলভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।

রণজিৎভাবে বললেন, “হ্যাঁ, খুবই আশ্চর্য! আপনার হাতের লেখার সঙ্গে এতই মিল যে, আমাদের হ্যাণ্ডরাইটিং এক্সপার্টেরও প্রথমটায় ধাঁধা লেগেছিল। উপেন ধর মাশাই নিপুণ শিল্পী বটে!
পরীক্ষিৎবাবু উপেন ধরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “উপেন, তোমার এই কাজ?”
উপেনবাবু হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, “আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, আমার কোনো দোষ নেই-”
রনজিৎবাবু বললেন, “ছি ছি, আপনি এত ব্যাকুল হয়ে পড়লেন কেন? থামুন, থামুন! আরে আপনাকে নিয়ে মহা মুশকিলই হল দেখছি। আপনার মতো একজন করিৎকর্মা লোকের কি এ সব কান্নাকাটি মানায়? বাস্তবিক,” পরীক্ষিৎবাবুর দিকে তাকিয়ে সামন্তমশাই বলতে লাগলেন, “এই উপেন ধরের মতো চৌকস লোক বাংলাদেশে প্রায় দেখা হায় না। রিভলবার ছুঁড়তেও ইনি ওস্তাদ। ছোট্ট কামরায় তিনজন লোক বসে আছে, একজনের কান ঘেঁষে, আর একজনের নাকের তলা দিয়ে, তৃতীয় ব্যক্তির ঠিক চুলের উপর দিয়ে গিয়ে গুলিটি কাঠের পার্টিশন ফুঁড়ে একঘর লোক পার হয়ে টাইপিস্টের টেবিলের তলায় গিয়ে পড়ল – ভাবতে পারেন?”

চঞ্চল এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিল, এইবার বলে উঠল, “ঐ গুলিতা তাহলে উপেন ধরই ছুঁড়ছিল? কেন? এর উদ্দেশ্য কী?”
ইন্স্পেক্টরবাবু সে কথার জবাব না দিয়ে বলতে লাগলেন, “সবই ঠিকঠাক মতো হয়েছিল, কিন্তু আপনাদের একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল মহিমবাবু, গুলিটা গরম ছিল না। এই ত্রুটি ছাড়া আপনাদের অভিনয় চমৎকার হয়েছিল – প্রশংসা করতে হয়। বিশেষ করে আপনার পার্ট! ওঃ, আপনার টেবিলের তলায় ঢোকাটি কী চমৎকারই হয়েছিল – ভুলতে পারছি না। রিয়ালি ম্যাগনিফিসেন্ট।”
বলে রণজিৎবাবু হাসতে লাগলেন।
চঞ্চল বললে, “কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে, কেন ছোঁড়া হয়েছিল? কার উদ্দেশ্য?”

রণজিৎবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “এইখানেই তো মজা। গুলিটা আসলে ছোঁড়াই হয় নি, ওটা আগে থেকেই পড়ে ছিল টাইপিস্টের টেবিলের তলায়। পিছন থেকে উপেনবাবু একটা ফাঁকা আওয়াজ করেছিলেন মাত্র।”
“পিছন থেকে। কোত্থেকে?”
“মহিমবাবুর কামরার পিছনেই তাঁর বাথরুম, সেখান থেকে।”
“তারপর তিনি পালালেন কেমন করে?”
“পালাবার দরকার হয় নি, বাথরুমেই বসে ছিলেন। তুমি হয়তো লক্ষ করোনি চঞ্চল, বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল, আর দরজায় একটা নোটিশ লাগানো ছিল – “নট টু বি ইউজড।”

চঞ্চল বললে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। তাই তো। বাথরুমটা খুঁজে দেখবার কথা তো কারও মনে হয় নি।”
“আমার হয়েছিল, কিন্তু দরকার বোধ করিনি। ব্যাপারটা কী, আমি তার আগেই বুঝে ফেলেছিলাম। মহিমবাবু একটা ঘণ্টা টিপলেন, বেয়ারার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, “টাইপ।” তারপরেই তো এই কাণ্ড। ঐ ঘণ্টা বাজিযে অসলে উপেন ধরকেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল।”
“কিন্তু এর দরকার কী ছিল, তাই তো আমি বুঝতে পারছি না।”
“দরকার ছিল এইতে প্রমাণ করা যে, পরীক্ষিৎবাবুর শত্রুরা শুধু তাঁকে সরিয়েই তৃপ্ত হয়নি, তাঁর শ্রেষ্ঠ বন্ধু মহিম চাটুয্যেকেও খুন করবার চেষ্টায় আছে।”

এখানে পরীক্ষিৎবাবু বলে উঠলেন, “তোমার কথাবার্তা শুনতে শুনতে আমার মাথা ঘুরছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। দয়া করে প্রথম থেকে বুঝিয়ে বলো, নয়তো একটু পরেই মনে হবে যে পাগল হয়ে গেছি।”
সামন্তমশাই বললেন, “বেশ, প্রথম থেকেই বলি। মহিমবাবুর এটা হল দেখা বিন্তির খেলা। প্রথম থেকেই দু হাতের খেলা খেলে যাচ্ছেন – সকলের সামনে এগিয়ে আছেন বরাবর, যাতে তাঁর উপর সন্দেহ পড়বার কথাই না ওঠে। আর তাঁর সহকর্মী হিসাবে নিলেন বেচারা উপেন ধরকে। উপেনবাবুকে সত্যি খুব দোষ দেওয়া যায় না। – তিনি মহিমবাবুর হাতের পুতুলমাত্র – তাঁর অবস্থা ভালো নয়, মোটা টাকার লোভে রাজি হয়েছিলেন।”
হঠাৎ উপেন ধর আবার খানিকটা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে উঠলেন।
ইন্সপেক্টরবাবু বলতে লাগলেন, “মহিমবাবুর মতলব ছিল, এই ব্যাপারে একঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা। প্রথমত, ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ আর বৃন্দাবন গুপ্তকে জব্দ করা – এঁরা পরীক্ষিৎবাবুর পক্ষপাতী নন, তাঁদের উপর সন্দেহ ফেললে লোকে সহজেই বিশ্বাস করবে। বেচারা বৃন্দাবন গুপ্তকে তো রীতিমতো হাজতবাসই করিয়ে নিলেন। আহা – এতক্ষণে বোধহয় আধখানা হয়ে গেছে বেচারা। লালবাজারে গিয়ে প্রথমে ওঁকে ছেড়ে দিয়ে তারপর অন্য কাজ।”
পরীক্ষিৎবাবু বললেন, “সে কী! বৃন্দাবন গুপ্ত হাজতে!”
“হ্যাঁ, আপনার অন্তর্ধানের সঙ্গে বৃন্দাবন গুপ্তের যে কোনোরকম সংশ্রব আছেই, মহিমবাবু প্রথম থেকেই খুব জোর দিযে তো বলতে লাগলেন। আমি ভদ্রলোককে ধরেই আনলুম – পাছে মহিমবাবু বুঝতে না পারেন যে আসলে ব্যাপারটা কি, যা আমি আঁচ করেছি। এর মধ্যে উপেন ধরকে এমন কৌশলে মহিমবাবু জড়িয়েছিলেন যে, আমারও প্রথমটা খটকা লেগেছিল। উপেন ধরের উপর খানিকটা সন্দেহ তিনি এইজন্যেই ফেলেছিলেন, যাতে পুলিশের গোলমাল লাগে।

“এদিকে লালবিহারীবাবুকে পটিয়ে মহিমবাবু শ্রী ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ফাঁদবার চেষ্টায় আছেন – অবশ্য নিজের নামে নয়, মাঝখানে উপেন ধর আছেন শিখণ্ডী। পরীক্ষিৎবাবুকে দিযে অনেকগুলো শেয়ার কিনিয়ে, তাঁকে ডিরেক্টর করে, জয়ন্তীর দিনে সব কাগজে তাঁর ছবি দিয়ে বড় বড় বিজ্ঞাপন বেরুতো – বেশ ভালোই হত; কিন্তু এর মধ্যে আর একটু প্যাঁচ না কষে মহিমবাবু তৃপ্ত হতে পারলেন না। তাই তিনি ভাবলেন – পরীক্ষিৎ একদিন গিয়ে মালাকার মশাইয়ের কাশীপুরের বাগানে থাকুক, এদিকে আমি ‘হরকরা’র হু হু করে কাটতি হবে, তারপর ঠিক জয়ন্তীর দিন ভোরবেলা ঔপন্যাসিকটিকে বের করে আনব – এবং তাঁকে উদ্ধারও করবে, পুলিশ নয়, অন্য কেউ নয়, ‘হরকরা’ই। মোটের উপর এ-ব্যাপারে ‘হরকরা’র প্রতিপত্তি এত বেড়ে যাবে যে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’কে নীচে ঠেলে সে ধাঁ করে উপরে উঠে যেতে পারবে। আর পরীক্ষিৎ উদ্ধারের ব্যাপারের নয়ক তিনি স্থির করলেন এই চঞ্চলকে, যে তাঁর আপিসের মধ্যে সবচেয়ে ছেলেমানুষ, যে কিছুই বুঝবে না, যাকে ইচ্ছেমতো চালনো যাবে।

“এরপর নাটকটি বেশ যত্নে সাজানো হল। পরীক্ষিৎবাবু এমনিই ক্লান্ত ও লোকের উৎপাতে বিরক্ত হয়ে ছিলেন – তাঁকে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে বিশ্রাম করতে সহজেই রাজি করানো গেল। স্থির হল, আগে কাউকে কিছু বলা হবে না, পরে বলা হবে শুধু বিজয়বাবুকে, তাও চুপে চুপে। আঠারো তারিখে সন্ধের পরে গঙ্গার ধারে মহিমবাবুর সঙ্গে পরীক্ষিৎবাবুর দেখা হল। পরীক্ষিৎবাবু গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন – তাঁর ড্রাইভার যে লম্বা লোকটিকে দেখেছিল, সে মহিম চাটুয্যে ছাড়া আর কেউ নেয়।”
“অ্যাঁ!” চঞ্চলের গল দিযে একটা বিস্মিত আওয়াজ বেরুল।
“সেখানে আলো কম ছিল, ড্রাইভার দূর থেকে ভালো দেখতে পায় নি, লক্ষও করেনি। লম্বা লোকটি কে হতে পরে, তা নিয়ে কত গবেষণা; এ কথা অবশ্য কারুরই মনে হয়নি যে মহিমবাবুও লম্বা। এদিকে লম্বা লোকটিকে যাতে উপেন ধর বলেই সন্দেহ হয় সেজন্য চেটার ত্রুটি হয় নি। উপেন ধরকে ঐ প্রিন্সেপ ঘাটে রেখে পরীক্ষিৎবাবুকে নিয়ে মহিমবাবু চলে এলেন কাশীপুরে। আপনারা কি ট্যাক্সিতে এসেছিলেন, না মহিমবাবুর গাড়িতে?”
পরীক্ষিৎবাবু বললেন, “ট্যাক্সিতে। কিন্তু উপেনকে তো ওখানে আমি দেখিনি।”
“আপনার তো দেখবার দরকার নেই যাদের দরকার, তারা দেখেছিল। রাত্রে বিজয়বাবু যখন চঞ্চলকে নিযে প্রিন্সেপ ঘাটে গেলেন, উপেনবাবু তার আগেই ব্রিন্দাবন গুপ্তের একটি ভিজিটিং কার্ড ওখানে ফেলে রেখেছিলেন – যে কোনো লোকের একখানা কার্ড জোগাড় করা কিছুই শক্ত নয়। তারপর ইচ্ছে করে ওদের সামনে দিয়ে হুস্ করে পালিয়ে গেলেন – এ আর কিছুই নয়, ব্যাপাটাকে আরও জটিল আরও গোলমেলে করে তোলা। ময়দানের ভিতরে অন্ধকারে তিনি যেন একেবারে মিলিয়ে গেলেন – না চঞ্চল?”
“তাই তো মনে হয়েছিল।”
“ময়দানের মধ্যে একটু দূরেই একটি গাড়ি অন্ধকারে মিলিয়ে ছিল – লালবিহারীবাবুর একটি ছোট অস্টিন মহিমবাবু কয়েকদিনের জন্য ধার করে এনেছিলেন। এ-গাড়ি কোন কাজে লাগবে লালবিহারীবাবুর অবশ্য তা স্বপ্নেরও অগোচর। সেই গাড়ি নিয়ে একেবারে ছুট মহিমবাবুর বাড়িতে। তারপর থেকে উপেন ধরকে আর পাওয়া যায় না – কী করেই বা যাবে, তিনি যে মহিমবাবুর বাড়িতেই দিব্যি খাচ্ছেন দাচ্ছেন আর ঘুমোচ্ছেন।তোমরা যখন মহিমবাবুর বাড়ি গেলে চঞ্চল, উপেন ধর তখন তোমাদের পাশে ছোটো ঘরটিতেই আরামে নিদ্রা যাচ্ছেন।”
চঞ্চল চেঁচিয়ে বলে উঠল, “বলেন কী?”
“এই তো ব্যাপার। বিজয়কৃষ্ণকে কিছুই বলা হল না, গরম গরম ‘হরকরা’ বেরুল আশ্চর্য খবর নিয়ে, পুলিশকে টেলিফোন করলেন মহিমবাবুই, তারপর পুলিশের মহা বন্ধু ও উপদেষ্টা হয়ে বসলেন। ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’র প্রোপ্রাইটর শশাঙ্ক বক্সিকেও এর মধ্যে জড়াবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। সকালবেলাই উপেন ধরের জাল চিঠি ডাকে দেওয়া হল, তারপর দুপুরবেলা মহিমবাবু তকে লুকিয়ে আপিসে এনে বাথরুমে বন্ধ করে রাখলেন। আমি যেই বললুম, “আমরা সকলকে সন্দেহ করি যতক্ষণ উল্টোটা প্রমাণ না হয়” তার একটু পরেই ঘণ্টা বাজাল আর গুলির আওয়াজ হল। এতে এটা প্রমাণ হল যে আর যাই হোক, মহিম চাটুয্যেকে সন্দেহ করবার সাহস পুলিশেরও নেই, গ্রেপ্তার তো ছাড়। ‘হরকরা’র বিজ্ঞাপনের দিক থেকেও মস্ত লাভ, জাঁকালো স্পেশাল বেরুল বিকেলে। মহিম চাটুয্যেকে হত্যা করবার চেষ্টা – উঃ কী সাংঘাতিক! তোলপাড় পড়ে গেল শহরে।”
“তারপর ডায়মণ্ড হার্বারের খবর নিয়ে ঐ চিঠি। ওর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, পুলিশকে নিযে একটু রগড় করা। তোমাকে নিয়েও চঞ্চল। উপেন ধরকে পাঠানো হল, কারণ তাকে অনুসরণ করে আমরা ঠিক জায়গায় এসে হাজির হব – আর তখন মহিমবাবু আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবেন – পরীক্ষিৎ উদ্ধারকার্য তাঁর দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে গেছে, আমাদের মিছিমিছি খাটালেন বলে দুঃখিত। কী করে উদ্ধারকার্য সম্পন্ন হল, সে বিষয়ে ছোটো একটি গল্পও ভেবে রেখেছিলেন – আমাদের আড়ালে ডেকে নিযে বলতেন, আর আমরা তাঁর ক্ষমতার স্তম্ভিত হয়ে কুর্ণিশ করে বিদায় নিতুম। কিন্তু সময় তাঁকে আর দেওয়া হল না।
“তুমি বোধ হয় জান না চঞ্চল, তোমার পিছন পিছন একই ট্রেনে উপেন ধরকে পাঠানো হয় ডায়মণ্ড হার্বারে আবার তার পিছনে আমার একজন চর ছিল। ডয়মণ্ড হার্বার স্টেশনে সেই গাড়িটি অপেক্ষা করছিল, তুমি স্টেশন থেকে বেরোবার আগেই উপেনবাবু সেই গাড়ি নিয়ে উধাও হলেন – ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে। সন্ধের কিছু পরে উপেনবাবু সেখানে এলেন গাড়ি নিয়ে, গাড়িটা কিছু দূরে রেখে ঢুকলেন বাড়িতে। তুমি তখন ভিতরের ঘরে বসে কাঁপছ, আর আমি পিছনদিকের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে। উপেনবাবুর ঘুঁষিগুলো যখন তোমার উপর পড়ছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল তোমার জন্যে, হাসিও পাচ্ছিল, কিন্তু তোমাকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করি নি, কারণ তাহলে নাটকটা মাঝখানেই নষ্ট হয়ে যায়। ঘুঁষোঘুঁষির উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, কালকের ‘হরকরা’য় খুব ফলাও করে ছাপা। উপেন ধরই অপরাধী হিসেবে ধরা পড়বে পুলিশের হাতে, বানিয়ে যা খুশি একটা গল্প বলবে, তারপর প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দিতেই হবে – মহিমবাবু প্ল্যান ছিল এইরকম। এদিকে তোমাকেও একজন ছোটোখাটো হিরো সাজিযে ‘হরকরা’য় কোন না লম্বা চওড়া লেখা বেরোবে। তুমি ভেব না চঞ্চল, যে তুমি উপেন ধরের গাড়িতে লাফিয়ে উঠতে পেরে খুব একটা বীরত্ব করেছিলে, তোমাকে না নিয়ে উপেন ধর যেতেই না। তার পিছন পিছন আমি আসব, তাও উপেন ধর জানে। সহজে ধরা দিলে ভালো দেখায় না, সেইজন্যে এত দূর এসে ইচ্ছে করে একটা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে গাড়িটাকে আস্তে ঠুকে দিলে। উপেনবাবু, আপনি যেমন চমৎকার অভিনেতা, তেমনি চমৎকার গাড়ি চালিয়ে। মহিমবাবুর প্ল্যান ছিল উপেন ধরকে ধরতে পারার জন্য আমাকে প্রচুর কংগ্রাচুলেট করবেন, আমাকে বলবেন তাকে এক্ষুণি হাতকড়া পরিয়ে লালবাজার নিয়ে যেতে, কিন্তু ব্যাপারটা হল একটু অন্যরকম। … আচ্ছা, মহিমবাবু, আপনাকে তাহলে এখন কষ্ট করে একটু গা তুলতে হচ্ছে। উপেনবাবু, আপনিও আসুন, আপনার কিছু ভয় নেই সত্য কথা খুলে বলবেন, এই আর কি!”
উপেন ধরের গলা দিয়ে বিকৃত একটা শব্দ বেরুল, তার মানে বোঝা গেল না।

সব শুনে পরীক্ষিৎবাবু বললেন, “এখনও আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”
“বোঝবার আর কী আছে, বলুন? হ্যাঁ, একটা কথা। এত রাত্তির অবধি জেগে ছিলেন?”
পরীক্ষিৎবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “একটু জরুরি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল।”
“উইলের বিষয় তো? মহিমবাবু আপনার কানে আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অনেক বিষ ঢালছিলেন, সেটা বুঝতেই পারছিলুম। আপনি না থাকলেই বিজয়বাবু খুশি হন, আপনার টাকার উপরেই ওঁর নজর… এই তো? নূতন উইলের ড্রাফটটা পকেটেই রয়েছে, ওতে মহিমবাবুর ছেলের হাতে কত দিচ্ছিলেন? …আপনার অনুমতি পেলে ওটা ছিঁড়ে ফেলি।”

পরীক্ষিৎবাবু উত্তরের অপেক্ষা না করেই রণজিৎবাবু পকেট থেকে সেই কাগজটা বের করে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেললেন। একটা হাই তুলে বললেন। “ওঃ, এখন একটু না ঘুমুলে আর পারব না। মহিমবাবু চলুন, আপনাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিই … কিছু ভাববেন না, আপনার বন্ধু উপেন ধরও সঙ্গে থাকবেন। উঃ, আপনার মতো টাকার লোভ সাধারণ দেখা যায় না। লালবিহারীবাবুকে দিয়ে একটা পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন, সেটাও ‘হরকরা’র নাম করে আত্মসাৎ করতেন। যাই হোক, আপাতত কযক বছরের জন্য আপনি নিশ্চিন্ত হলেন – আপনার সমস্ত খরচ গভর্মেন্টই বহন করবে।”

এরপর পরীক্ষিৎবাবুর দিকে তাকিযে রণজিৎবাবু বললেন, “আচ্ছা, এখন তাহলে বিদায় নিচ্ছি আমরা, আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা পুলিশের লোক, নানারকম অপ্রিয় কাজ করতে হয়, আপনার মূল্যবান সময়ও অনেকখানি নষ্ট করে গেলুম, তবে এটুকু ভাবতে ভালো লগছে যে আমার আজকের দিনের খাটুনি একেবারে ব্যর্থ হয়নি – আপনার জীবনের উপর হতে মস্ত কালো একটা ছায়া আমি সরিয়ে নিতে পারলুম।”

পুলিশে ঘেরাও হয়ে গাড়িতে ওঠবার আগে মহিম চাটুয্যে চঞ্চলের দিকে তাকিযে বললেন, “চললুম, চঞ্চল। ফিরতে কিছু দিন দেরি হবে। যদি পার, ‘হরকরা’ চালিয়ে নিও।”

Leave a Reply to মোস্তাফিজুর রহমান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *