কথাশিল্পী রশীদ করীমের ৮৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল ১৪ আগস্ট। এই বিশিষ্ট লেখককে আমাদের শ্রদ্ধা
রশীদ করীমের (১৯২৫) সমসাময়িক অনেক লেখকই যখন বিশেষ বিশেষ আদর্শের সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠায় নিজেদের শক্তি নিঃশেষ করেছেন, তখন তিনি তাঁর সাহিত্যের জগৎ হিসেবে বেছে নিয়েছেন রক্ত-মাংসের মানুষকে। দশকের পর দশক ধরে অক্ষরে অক্ষরে তিনি এঁকে গেছেন রক্ত-মাংসের মানুষের মুখচ্ছবি। তিনি বাংলার বিরল মানববাদী লেখকদের একজন, যিনি পাঠকের ওপর কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না বরং মানুষের পাপী ও সৎ সত্তা, প্রেমী ও ভোগী অবয়ব সবকিছুই সাদাসিধেভাবে জাজ্বল্য করেন। একজন শিল্পী মানুষকে কীভাবে দেখছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। রশীদ করীমের সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লেখক হিসেবে তাঁর উচ্চায়তন অধিষ্ঠান ঘটিয়েছে।
রশীদ করীমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। প্রথম দিকে গল্পই লিখতেন তিনি। ১৯৪২ সালে সওগাত পত্রিকায় তার ‘আয়েশা’ গল্পটি প্রকাশিত হয়। এক সুন্দরী বাল্যসখীর প্রেমাভিঘাতের গল্প সেটি। সেই শুরু। তারপর তাঁর গল্প বেরুতে থাকে সমকালীন খ্যাতনামা পত্রপত্রিকায়। ১৯৪১-৪৫ কালপর্বে তাঁর সিংহভাগ গল্পের জন্ম। এর মধ্যে ‘একটি মেয়ের আত্মকাহিনী’ গল্পটির কল্যাণে যখন বুদ্ধদেব বসুর প্রশংসা অর্জন করেন তখন তিনি ষোলো-সতেরো। তারপর প্রায় ষোল বছরের বিরতি। অবিশ্বাস্য! দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে তিনি কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি ক্যালটেক্সের চাকরি নিয়ে।
১৯৬১ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ। ষোল বছর রশীদ করীম হয়তো আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চা করেননি, কিন্তু পরবর্তী সময়ে যে বিচিত্র ব্যাপ্ত সাহিত্যকর্মে যুক্ততা ঘটে তার নেপথ্য মুঞ্জরণ নিশ্চয়ই ওই সময়ে ঘটেছে। বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট প্রস্তুতি অভিনিবেশ নিয়ে তিনি কথাসাহিত্যের জগতে পা বাড়িয়েছেন। কারণ তাঁর হাত থেকে নিঃসরণের অপেক্ষায় ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের অলিখিত উপাখ্যান। অনন্য কল্পনাশক্তি, নিজস্বতাদীপিত ভাষাভঙ্গি ইত্যাদির পাশাপাশি তাঁর ভান্ডারে ছিল জীবনাভিজ্ঞতার সুপ্রচুর রসদ।
তাঁর সৃষ্টির মূল ক্ষেত্র উপন্যাস। উত্তম পুরুষ, প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, শ্যামা, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত, লাঞ্চবক্স-এর মতো উপন্যাসের স্রষ্টা রশীদ করীমের একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রথম প্রেম। শক্তিমান এই কথাশিল্পী তিনটি রুচিঋদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থেরও জনয়িতা—আর এক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নূতন পুনরায় এবং মনের গহনে তোমার মুরতিখানি।
১৯৯২ সালে আকস্মিক অসুস্থতার পর তাঁর কথাসাহিত্যের বেগবতী ধারা ফুরিয়ে এলেও শারীরিক দুর্দৈবের মধ্যেই তিনি লিখেছেন জীবন মরণ নাম্নী নাতিদীর্ঘ কিন্তু মূল্যবান আত্মজীবনী। এই বইয়ের করুণ ভূমিকায় তাঁর লেখন—‘এই আমার শেষ লেখা। ইংরেজিতে যাকে বলে সোয়ান সঙ—মরাল সঙ্গীত।’
আমরা, রশীদ করীমের মুগ্ধ পাঠকেরা কোনোভাবেই চাইব না এটা তাঁর শেষ লেখা হোক।
২.
উত্তম পুরুষ (১৯৬১) কিংবা মায়ের কাছে যাচ্ছি (১৯৮৯) উপন্যাস দুটিকে আমরা লেখকের নিজ জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে পারি। আত্মস্মৃতিকে যে লেখক সামষ্টিক করে তুলতে পারেন, তিনি ক্রমে তাঁর জনগোষ্ঠীর আপন লেখকে পরিণত হন। চল্লিশের দশকের কলকাতার যে চিত্র উত্তম পুরুষ-এ অঙ্কিত হয়, তাতে একদিকে যেমন শাকের, সলিল, শেখর, সেলিনা, অনিমার মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম আন্তসম্পর্কের চালচিত্র উদ্ঘাটিত হয়, তেমনি অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাতঙ্কের মধ্যে কাল কাটানো অর্থনৈতিক মন্দাগ্রস্ত মানুষের অবয়বও স্পষ্ট। একদিকে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ডামাডোল, অন্যদিক আর্থিক প্রতিশ্রুতির কাছে শুদ্ধতাবাদী ধর্মীয় রক্ষণশীলতার আত্মসমর্পণের চিত্রও পরস্ফুিট।
আপাতদৃষ্টে মনে হবে, শাকের উত্তম পুরুষের নায়ক। তবে যেকোনো সচেতন পাঠকই বলবেন, উত্তম পুরুষের নায়ক হচ্ছে সময়। ইতিহাস রক্ষার দায় রশীদ করীম নেননি বটে, তবে তাঁর উপন্যাসের পটে ইতিহাসের আলো-ছায়ার যে সম্পাত ঘটে, তা লেখক হিসেবে পাঠকের সঙ্গে তাঁর সংযোগ আরও দৃঢ় করে। রচনার ৫০ বছর পেরিয়ে উত্তম পুরুষ নতুন নতুন তাত্পর্যে ধরা দিতে সক্ষম। সাময়িক প্রসঙ্গ ধারণ করেও ভীষণভাবে চিরায়ত।
দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসন্ন পাষাণ-এ (১৯৬৩) আমরা দেখি, শত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তিনি প্রেমকে চরমমূল্য দিতে আগ্রহী। চরমমূল্য তো নয়, সত্যমূল্য। উত্তম পুরুষে কাহিনি এগিয়ে গেছে শাকেরের জবানিতে আর প্রসন্ন পাষাণে তা ঘটে তিশ্নার জবানিতে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কামিল বাবার মত্যুর পর তার মা ও পিতৃব্যের সুসম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। আড়চোখে দেখেছে কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তার ইচ্ছায় বাবার কবরের বদলে চাচার কবরের পাশে মায়ের কবর হয়। জীবিতকালে যে সম্পর্ককে সে মেনে নেয়নি, মৃত্যুর পর তাকে সে প্রাণখুলে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের সমাজ প্রবলভাবে অর্গলবদ্ধ। খোলা হাওয়ার বড্ড অভাব। প্রকৃত লেখকের কাজ বদ্ধ আবহাওয়ায় টাটকা বাতাস বইয়ে দেওয়া। সেই ষাটের দশকে উপন্যাসে সমাজ-অসম্মত সম্পর্কের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে রশীদ করীম আসলেই মানবিকতারই বৈজয়ন্তী ওড়ান।
মানবিক শিল্পী বলেই তিনি আলোচ্ছটার পাশাপাশি মানুষের অন্তর্গত অন্ধকারকেও বাঙ্ময় করেন। তৃতীয় উপন্যাস আমার যত গ্লানি (১৯৭৩) শুরুই হয়েছে এভাবে—‘আমি লোকটা আসলে একটা খচ্চর; যদিও আমার বাপ লোকটা মোটের ওপর ভালোই ছিলেন।’ এবং এরফান চৌধুরীর স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে লেখক যেন বিম্বিত করেন বাস্তবের মারে নিঃশেষিত আধুনিক মানুষকে—‘খাঁটি জিনিস আমি খুব কম দেখেছি এবং সব চাইতে কম খাঁটি আমি নিজে।’
ব্যক্তির ফাঁপা অস্তিত্ব থেকে হঠাৎ উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয় সমষ্টিগত গন্তব্যে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে হাটখোলার মোড়ে এক পথচারী ছেলে এরফানকে জিজ্ঞেস করে—‘আপনি কি ভিড়ে আটকা পড়ে গেছেন? কোথায় যাবেন?’ এরফানের উত্তর—‘শেখ সাহেবের কাছে, স্বাধীনতার কাছে।’
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সার্থক উপন্যাস লেখা হয়নি বলে আমাদের অনেকেরই আক্ষেপ। আমার যত গ্লানি আমাদের এই আক্ষেপ দূর করতে পারে। যুদ্ধপরিস্থিতি আর যুদ্ধজয়ের আনন্দকেই রশীদ করীম চিত্রিত করেননি বরং উপন্যাসের অন্তঃভাগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সংলাপের আদলে রেখায়িত হয় যুদ্ধধ্বস্ত বাংলার হতশ্রী—‘দগ্ধ গ্রাম, বিরান মাঠ, শূন্য কুটির দেখে, আপনি ভাবতেন, রিদয় এ কোন দেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। এ রকমটি তো ছিল না। আমরা বলতাম, ওবিন ঠাকুর, চিন্তা করবেন না। এই ধ্বংসস্তূপেই এখন দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।’
যুদ্ধজয়ী মানুষের সোনার বাংলার স্বপ্নও একই সঙ্গে তারার মতো জ্বলজ্বল করে—“ ‘সেরা দেশ—সোনার দেশ—সবুজ দেশ—ফলন্ত ফুলন্ত বাংলাদেশ।’ আপনার রিদয় যদি আবার আমাদের দেশে বেড়াতে আসে সেই আশ্চর্য বাংলাদেশকেই সে আবার দেখতে পাবে। আবার আমরা গড়ে নেবো, সেই সোনার দেশ।”
রশীদ করীমের প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮) নামটি আজ এক লোকপ্রিয় প্রবচনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই উপন্যাস পাঠে উপলব্ধ হয়—প্রেম শুধু লাল গোলাপই নয়, সেই সঙ্গে লাল রক্তক্ষরা কাঁটাও বটে। আবার সেই কাঁটাকেও তিনি উপেক্ষণীয় করে দেখেন না, কারণ কাঁটাতেও গোলাপ থাকতে পারে। স্বামী-স্ত্রী রানু-উমর। তাদের প্রেমভুরভুর মালঞ্চে কাঁটার মতো প্রবিষ্ট সুফি সাহেব হঠাৎ বদলে দেন সব। নিজের স্ত্রীকেও তখন অচেনা মনে হয় উমরের—‘রানুকে খুব ভালো লাগছে উমরের। নিজের স্ত্রী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজকেই প্রথম পরিচয়। খুব জয় করে নিতে ইচ্ছে করছে তাকে। কিন্তু জয় করতে পারবে না। রানু সুদূর।’
পুরোনো প্রেমকে সোনায় মুড়ে নেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে এমন কাঁটার দরকার আছে বোধ হয়। রানুকে হঠাৎ ‘সুদূর’ বলে ভ্রম হলেও রানু আসলে ভালোই বাসে উমরকে। আমাদের সবার জীবনেরই মধুর সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎ সুফি সাহেবের রুমালের অপরিচিত গন্ধ এসে ভিড় করে, তবে শেষতক প্রেমগোলাপের রক্তিম গন্ধ সেই অচেনা গন্ধকে ধূলিসাৎ করে।
গল্প-উপন্যাস-কবিতায় ব্যবহারে ব্যবহারে প্রেম জরাজীর্ণ কিন্তু রশীদ করীমের হাতে বিষয় হিসেবে প্রেমের যেন নবজন্ম ঘটে।
জটিল কাহিনি ফাঁদেন না রশীদ করীম। আমাদের চেনা পৃথিবীর আপাততুচ্ছ বিষয়-আশয় এমন শিল্পরসায়নে জারিত করেন তিনি যে আমরা গোপন দর্পণে নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠি। সাধারণ লোকের কাহিনি, বিপুল নৈঃসঙ্গের কাহিনি, পায়ের তলায় ঘনীভূত রক্তের কাহিনি, শ্যামা অথবা সামান্য একটি লাঞ্চবক্সের কাহিনি এমন চারুদক্ষতায় তিনি উপহার দেন যে তাঁকে অনায়াসে আমাদের প্রধান বহুপ্রজ লেখকদের একজন হিসেব চিনে নিতে পারি। ‘বহুপ্রজ’ বিশেষণটি সচেতনভাবেই ব্যবহূত হলো, কারণ শিল্পক্ষেত্রে সংখ্যাগত বিশালতা নয়, কাজের বৈচিত্র্যই বহুপ্রজতার মানদণ্ড বলে বিবচিত হওয়া উচিত।
৩.
উপন্যাসকে রশীদ করীম শুষ্ক বর্ণনার আখড়ায় পরিণত করেননি বরং তাঁর উপন্যাস কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এমনকি ক্রীড়ার সজীব সমাবেশস্থল। কাঠামোবদ্ধ চরিত্রের বাইরে তাঁর উপন্যাসসমূহে প্রায়শই অনুপ্রবেশ ঘটে শেক্সপিয়ার, বায়রন, এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ, কাননবালা, সায়গল, খেলোয়াড় মুশতাক প্রমুখের।
উপন্যাসে এমন অনেক নিরীক্ষা তিনি করেন, যা সত্যি অভাবনীয়। প্রেম একটি লাল গোলাপ উপন্যাসের উৎসর্গপত্র খুঁজে পাই উপন্যাস শুরু হয়ে যাওয়ার এক-দেড় পৃষ্ঠা পর। এ নিয়ে তার ব্যাখ্যা—‘উপন্যাস উৎসর্গ করবারও একটা নিয়ম আছে। আমার এই উপন্যাস বিনীতভাবে উৎসর্গ করছি কবি আহসান হাবীবকে। কাহিনি প্রায় শুরু হয়ে যাওয়ার পর মাঝখানে হঠাৎ করে উৎসর্গ করাটা নিয়ম নয় জানি। কিন্তু লিখবার সুবিধার জন্য নিয়মগুলোকে একটু-আধটু উল্টেপাল্টে নিলে ক্ষতি কি!’
৪.
গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের পাশাপাশি রশীদ করীমকে আমাদের অগ্রগণ্য প্রবন্ধশিল্পীদের একজন মানতে কারোরই দ্বিধা থাকার কথা নয়। মাত্র তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি যে অভিনতুনতার সাক্ষ্য রেখেছেন তা বিস্ময়কর। প্রচলিত সিদ্ধান্তবাদী প্রবন্ধধারার বিপরীতে বৈঠকি ঢঙের এক সরস প্রাবন্ধিক গদ্যরীতির চর্চা করেছেন তিনি। দারুণ খোশমেজাজে তিনি কোনো প্রসঙ্গের অবতারণা করেন এবং প্রবন্ধের শেষ পর্যন্ত সেই প্রসন্নতার রেশ অটুট থাকে।
স্মৃতিচারণিক বেশ কিছু প্রবন্ধ আছে তাঁর। যেমন আবু সয়ীদ আইয়ুব, সৈয়দ মুজতবা আলী বা সমরেশ বসুকে নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ শুধু স্মৃতিচর্যায় শেষ হয় না বরং তিনি তাঁদের সৃজনকর্ম যাচাই করে দেখেন নিজস্ব আলোয়। তাঁর অনেক চিন্তার সঙ্গেই হয়তো পাঠক সহমত হতে পারবেন না। (যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-সম্পর্কিত তাঁর মূল্যায়ন) কিন্তু তাঁর প্রাবন্ধিক চিন্তা পাঠকের মনে সঞ্চার করে নতুনতর ভাবনা। তাঁর প্রাবন্ধিক কৃতিত্বের প্রধান দিক কথাশিল্পী মাহমুদুল হক ও আহমদ ছফাকে তাঁদের সাহিত্যজীবনের প্রায় সূচনাপর্বে শনাক্তকরণ। রশীদ করীমের প্রবন্ধের এক কেন্দ্রীয় ভূভাগ কবিতা। আবুল হোসেন ও শামসুর রাহমানের কবিতা আলোচনায় তাঁর কিছু তাত্পর্যবাহী উদ্ভাবন আছে।
আবুল হোসেন কবিতায় আবেগমুক্তির প্রবল পক্ষপাতী। সেই আবুল হোসেনের কবিতা সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ—‘আবুল হোসেন আবেগকে বাঘের মতোই ডরান, অথচ তিনি তখনই ভালো কবিতা লিখেছেন, যখন আবেগকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন।’ (‘কবিতার গণ্ডে লাবণ্য চাই’)
শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতার স্থায়িত্ব সম্পর্কে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সংশয়কে তিনি নাকচ করেন—‘শামসুর রাহমানের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে তাঁর কবিতার প্রবল সমসাময়িকতার কথা, যে কারণে পাঠকের সঙ্গে অবিলম্বে তাঁর যোগাযোগ ঘটে যায়। এটাও তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তার এটি কারণ। গত তিরিশ বছর ধরে আমাদের এই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও সঙ্কটাপন্ন ঘটনাবলীর কোনো অভাব দেখিনি আমরা। সেই সব মুহূর্তে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রায় একজন অভিভাবকের মতোই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের হূদয়ে যে আবেগ স্তব্ধ হয়েছিল, তাকে তিনি ভাষা ও প্রাণচাঞ্চল্য দিয়েছেন। জাতির চেতনা শামসুর রাহমানের কবিতার মধ্যে মিশে গেছে। আবার শামসুর রাহমানের কবিতাও জাতির চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে।’ (‘শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা’)
রশীদ করীমের দুটো অভিসন্দর্ভি প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে সেন্টিমেন্টালিজম’ এবং ‘উপন্যাসে স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্ক’। সাহিত্যের সাধারণ পাঠের পাশাপাশি এর সমাজতত্ত্ব নিয়েও যে তিনি সমান ভাবিত, তার পরিচয় মিলবে এই প্রবন্ধ দুটোতে।
সত্তরের দশকে গণসাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নাট্য নিয়ে লিখিত তাঁর ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে’ প্রবন্ধে যে সরস প্রজ্ঞার দেখা মেলে, তার ধারাবাহিকতা লঘু-গুরু নানা বিষয়াশ্রয়ী প্রবন্ধের মধ্য দিয়েই জলবতী ধারার মতো বহমান। বাঙালির মিশ্র সংস্কৃতি থেকে শুরু করে একটি অচেনা মেয়ের হাসির কারণ অনুসন্ধান করেও তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন।
৫.
রশীদ করীমের আকস্মিক অসুস্থতা আমাদের সাহিত্য ভুবনের দীপ্তি হ্রাস করেছে। আমরা দীর্ঘদিন তাঁর অনন্য উপন্যাস থেকে বঞ্চিত; তাঁর প্রবন্ধের স্বাদ বহু দিন অলভ্য। আমরা চাই শারীরিক দুর্দৈবের বিরুদ্ধে রশীদ করীম জয়ী হোন। তিনি আবার ফিরে আসুন তার লেখার টেবিলে। উন্মোচন করুন ক্রমঅধঃপতিত সময়ের উত্তম পুরুষদের মর্মমূল।
পঁচাশি পূর্ণ হচ্ছে রশীদ করীমের। তাঁকে একটি নয় অজস্র লাল গোলাপ অভিবাদন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০১০
Leave a Reply